তোর নামেই এই শহর পর্ব -০৯

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_০৯

(৩১)

আলমারি থেকে বাছাই করে বেশ কয়েকটা শাড়ি সযত্নে ব্যাগে গুছিয়ে নিলো তিয়াশা। সব চেয়ে সুন্দর আর শালীনতা বজায় থাকে এমন কিছু সেলোয়ার কামিজ নিয়ে আরেকটি ব্যাগে গুছিয়ে রাখলো। ইতিমধ্যে তার জামা কাপড় গুছানো প্রায় শেষ। গ্রামে যাওয়ার জন্য সে মোটামুটি তৈরী। প্রায় বছর দুয়েকের বেশি হবে সে একবার গ্রামে গিয়েছিলো। তুরিনের বিয়ের কথা যখন চলছিলো তখন ইয়াদের পুরো পরিবারের সাথে সেও গ্রামে গিয়েছিলো। সেবার যে কয়টা দিন সে গ্রামে ছিলো সময় গুলো বেশ ভালোই কেঁটেছিলো।বিশেষ করে রাহেলা বেগমের সাথে তার ভালো একটা সখ্যতা তৈরী হয়েছিলো। বৃদ্ধা যে শুধু তাকে খুব বেশি স্নেহ করতেন তা নয় বরং তিনি বন্ধুর মতো মিশতেন। যে কোনো মানুষকে অতি অল্প সময়ে নিজের করে নিতে তিয়াশার জুড়ি নেই।হুরায়রা এবং হুমাশার সাথেও তার বেশ ভাব হয়েছিলো যদিও এখন তাদের সাথে খুব একটা ফোনে যোগাযোগ হয় না তারপরও তিয়াশা ইয়াদের কাছ থেকে হুরায়রা কিংবা হুমাশার খবর নিতে ভুলে না।

আলমারি থেকে সবুজ পাড় হলুদ রঙের তাঁতের শাড়িটা নিয়ে নিজের গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো তিয়াশা। শাড়িটায় তাকে বেশ লাগছে পড়লে মন্দ লাগবে না ভেবে তিয়াশা সেটা চটজলদি পড়ে নিলো। সাথে সবুজরং এর মেচিং ব্লাউজ, হালকা কিছু কাঠের গয়না পড়ে চুলগুলো হাত খোঁপা করে কাঁধের একপাশটায় এলিয়ে দিলো। এক হাতে ঘড়ি আর অন্য হাতে হলুদ সবুজ মেশালে কিছু চুড়ি পড়লো সে। ঠোঁটে হালকা লিপিস্টিক লাগিয়ে চশমাটা পড়ে একেবারে তৈরী হয়ে নিলো।

“ওরে বাবাহ এতো দেখছি বিশুদ্ধ বঙ্গললনা হয়ে গেছে।”
পিছন থেকে নাবাদের কন্ঠস্বর কর্ণকুহর হতে সেদিকে তাঁকিয়ে মুচকি হাসলো তিয়াশা।
“আচ্ছা আমি মাঝে মাঝে একটা ব্যাপার কিছুতেই বুঝিতে পারি না কেনো বলো তো?”
“কি ব্যাপারে?”

“এই যে সব সময় এমন বঙ্গললনা হয়ে থাকো। শহরের আধুনিকতার মাঝে বেড়ে উঠেও নিজের মাঝে বাঙালী নারী ভাবটা ফুটিয়ে রাখাটা কিন্তু যেই সেই কথা না।”

“কঠিন কি সেটা, আমি বাঙালী আর আমি আমার নিজের মাঝে সেটাকেই ফুটিয়ে তুলতে বেশি পছন্দ করি। আজকাল আমাদের দেশের মেয়েদের মাঝে বঙ্গনারী বলতে যে একটা কথা আছে সেটার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা নিজেদের সংস্কৃতি ছেড়ে ওয়েস্টার্ন ড্রেস পড়ে ভিনদেশীদের অনুকরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।”

“হুম তা ঠিক। তবে তোমার এই ব্যাপারটা আমার খুব ভালো লাগে। যদিও আমার ছেয়ে ভাইয়া এটাকে বেশি পছন্দ করে।”

তিয়াশা কিছু বলল না কিঞ্চিৎ হাসলো।

“আচ্ছা এখন চলো নিচে সবাই অপেক্ষা করছে।”

“হ্যাঁ যাচ্ছি। আচ্ছা এক মিনিট।”

“আবার কি হলো?”

“অরাও কি আমাদের সাথে সত্যি সত্যি যাচ্ছে?”
নাবাদ মুখে বিরক্তিভাব ফুটিয়ে বলল,

“ভাইয়া যে কেনো এই সাইকো টাকে নিতে বলেছে কে জানে, নিচে গিয়ে দেখো তাহলে বুঝবে তার কি অবস্থা।”
“উফ ইয়াদটাও যে কি,,,আচ্ছা চলো।

নাবাদ আর তিয়াশা নিচে নেমে আসতেই মেহেরিমা বললেন,
“ওই তো ওরা চলে এসেছে।”

“আরেহ বাহ এটা আমার তিয়াশা? বেশ দেখতে লাগছে তো আমার মেয়েটাকে।”
মেহেরিমার কথা শুনে অরা সে দিকে তাঁকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে নিলো। তিয়াশা সেটা লক্ষ্য করলেও কিছু না বলে মেহেরিমার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বলল,

“মামি মা তোমাদের হয়ে গেছে?”

“এই তো হয়ে গেছে তোদের জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”

“মামু কোথায়?”

“এই তো মামনি আমি এইখানে।”
বলে ইশরাক ইহতেসাম সেদিকে এগিয়ে এলেন।
“বাহ মামু তোমাকে তো একেবারে ইয়াং ইয়াং দেখাচ্ছে কি ব্যাপার?”

“ইয়াং দেখাচ্ছে তাই না রে তিয়াশা? বল যে বুইড়া ষাঁড় দেখাচ্ছে দেখ না দেখ চুলে কেমন কালো কালি লাগিয়েছে।”

“এই দেখেছিস তো যাওয়ার পথে তোর মামি মা কিভাবে আমার মোড টা নষ্ট করতে চাইছে।”

“এহহহ এসেছে আমাকে মোড দেখাতে, বলি তোমার আবার মোড কি হ্যাঁ সারাদিন তো দেই দেই করে নাচো।”

“উফ মামু থামো তোমরা এখন ঝগড়া বাঁধাবে না প্লিজ।”

“ওহ মিস তিয়াশা স্যার কি ভুল বলেছেন? ম্যাম তো কথাটা একেবারেই ঠিক বলেন নি,,,স্যারকে সত্যি অনেক ইয়াং আর হট দেখাচ্ছে।”

নাবাদ মাত্র পানির গ্লাসটা মুখে তুলে নিয়েছিলো অরার কথা শুনে সেটা টপ করে হাত হতে ছেড়ে দিলো। আর সাথে সাথে পানি মাথায় চড়ে কাশতে শুরু করলো।
ইশরাক ইহতেসাম অরার কথায় প্রচণ্ড খুশি হয়ে বললেন,

“একেবারে সঠিক বলেছো অরা,,এই বাড়ির একটা মানুষও আমার প্রশংসা করতে জানে না।”

“বুড়ো বয়সে,,।”

“মামি মা চুপ আর কিছু বলো না অরার সাথে সাথে মামুর মাথাটাও গেছে।”

“আচ্ছা মিস অরা আপনি কি এই পোষাকে গ্রামে যাবেন?”
নাবাদ কিছুটা ভ্রুকুঞ্চিত করে অরার দিকে তাকিয়ে বলল।
অরা নিজের দিকে একবার ভালো করে দেখে বলল,

“অফকোর্স নাবাদ। ড্রেসটা খুব সুন্দর তাই না। আমাকে কেমন লাগছে বললে না তো।”

“মিস অরা আপনি বোধ হয় ভুলে যাচ্ছেন আমরা গ্রামে যাচ্ছি কোনো হাই সোসাইটির পার্টিতে নয়। আর আপনি এই ধরনের ড্রেস পড়ে গ্রামে যাওয়ার মতো সুবুদ্ধি কোথায় থেকে পেলেন বলুন তো?”

“মিস. তিয়াশা আপনি আন্তত আমার ড্রেস নিয়ে কিছু বলবেন না। আমি আপনার মত গেঁউ ভুত হয়ে সেখানে যেতে পারবো না। আমি যেমন আছি একদম পারফেক্ট আছি আর তাছাড়া সেখানে মি.ইয়াদ আছেন সেখানে আমি কি আর যেই সেইভাবে যেতে পারি?”
অরার কথা শুনে নাবাদ হোহো করে হাসতে গিয়েও চেপে গেলো। তারপর দু কদম এগিয়ে তিয়াশার কানের কাছে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া একে এই বেশভূষায় দেখলে যে কি করবে সেটা ভেবেই আমার এখনি হাসি পাচ্ছে।”

“চুপ একদম চেপে যাও। যা হবার গ্রামে যাওয়ার পরই হবে।”

“আমি ভাবছি গ্রামের মানুষ তাকে দেখে ভুল করে চিড়িয়াখানার জন্তু না মনে করে।”
বলেই নাবাদ আর তিয়াশা এক সাথে হাসলো। অরা ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বলল,

“এই তোমরা কি নিয়ে হাসছো?”

“না তেমন কিছুই না।”
বলে নাবাদ তিয়াশা দুজনেই বেড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।কিছুক্ষণ পর অরাও সেই গাড়িতে এসে বসে পড়লো। নাবাদ একবার তিয়াশার দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি দিয়ে বলল,
“হয়ে গেলো।”
“কথা না বাড়িয়ে গাড়ি ছাড়ো। আর অরা আমাদের গাড়িতে এসেছেন ভালো কথা তবে আপনার মুখটা একটু বন্ধ রাখবেন।”
“তুমি আমাকে অপমান করতে চাইছো?”
“সেটা বুঝার ক্ষমতা আছে বুঝি?”
অরা আর কথা বাড়ালো না। সে এমনিতেই তিয়াশাকে খুব একটা পছন্দ করে না। ইয়াদকে নিয়ে যখনি সে কিছু বলে তখনি তিয়াশা তাকে বাঁধা দেয়। এমন একটা ভাব করে যেনো ইয়াদ তার একার সম্পত্তি। তাছাড়া অনেক প্রতিরক্ষা পর সে ইয়াদের কাছাকাছি যেতে পারছে তাই এখন তিয়াশার সাথে কথা বাড়িয়ে আর মুড খারাপ করে লাভ নেই।

(৩২)
চৈত্রের কাঠফাটা রোদ্দুর। মাথার উপর সূর্যের প্রখরতা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বেলা যত গড়িয়ে আসছে রোদের উত্তাপ যেনো ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাস্তা পেরিয়ে ধান ক্ষেতের আইল ধরে বাড়ির দিকে পা চালিয়ে যাচ্ছে হুরায়রা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাড়ির পথে যেতে বেশখানিকটা সময় লাগবে তাই সে এই রাস্তা টা সে ধরলো। কোচিং থেকে ফিরতে আজ তার একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। এখন যত দ্রুত সম্ভব তাকে ক্ষেতের আইল ধরে পা চালিয়ে দ্রুত বাড়ি যেতে হবে।

বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে এসে হুরায়রা দেখলো রাস্তার কাছাকাছি তাল গাছের নিচে কেউ একজন সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আরো কিছুটা পথ এগিয়ে এসে দেখলো আবরার এক পা সাইকেলের হ্যান্ডেলে অন্য পা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে হুরায়রার বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সে এতোক্ষণ ধরে তার অপেক্ষাতেই ছিলো।

আবরার হুরায়রাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে কিছুটা নড়েচড়ে দাঁড়াল। তার মুখের অভিব্যক্তি দেখে হুরায়রার বুঝতে দেরি হলো না যে সে তাকে কিছু বলতে চায়। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লম্বা একটা শ্বাস ছেড়ে হুরায়রা আবার নিজের পথে হাঁটা লাগায়। আবরার তাকে চলে যেতে দেখে পিছন থেকে ডেকে বলল,

“হু-হুরায়রা? হুরায়রা একটা বার দাঁড়া। আমি বেশি সময় নিবো না।”

আবরারের কথায় থমকে দাঁড়ায় সে। মুখে একরাশ বিরক্তি ভাব নিয়ে তাঁকাতে আবরার চোখ নিচু করে ফেললো। হুরায়রা ঘুরে দাড়াতেই সে একবার আড় চোখে তাকে দেখে আবার মাথা নত করে ফেললো। বলল,

“হু-হুরায়রা আ-আমার তো-তোর সাথে কয়েকটা কথা ছিলো।”

” আপনার আমার সাথে কি কথা থাকতে পারে আবরার ভাই?”

“না-মানে,ইয়ে।”

“দেখেন আপনার সাথে এইভাবে ভর দুপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো সময় আমার নেই। তাই কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন।”

“হুরায়রা আমি তো-তোকে,,,।”

আবরার কথা শেষ করার আগেই হুরায়রা তার দিকে ভ্রুকুটি করে তাঁকালো। হুরায়রার এমন চাহনি দেখে কিছুটা দমে গেলো সে। ভ/য়ে ভ/য়ে একটা শুকনো ঢোক গিলে অশহায় দৃষ্টিতে হুরায়রার দিকে তাঁকিয়ে বলল,

“হুরায়রা তুই তো জানিস আমি তোকে প-প-প।”

“উফ আবরার ভাই কি মেয়েদের মতো কাছুমাছু করে কথা বলছেন? যা বলবেন সেটা সোজাসুজিভাবে বলুন আর হ্যাঁ আমি জানি আপনি আমাকে কি বলতে চাইছেন দেখুন আবরার ভাই,,,।”

হুরায়রা আর কিছু বলার আগেই আবরার পিছন থেকে হাত বের করে হুরায়রার সমুখে ধরলো। হুরায়রা লক্ষ্য করলো আবরারের হাতে একটা বাবুই পাখির বাসা। তাতে দুটো বাবুই পাখির ছানা মুখ বের করে কিচিরমিচির ডাকছে। ছানাগুলো এখনো উড়তে শিখেনি সবে গায়ে পালক গজিয়েছে। দেখে খুশিতে হুরায়রা চোখ চকচক করে উঠলো।

” এটা তোর জন্য।”
কাঁপা কাঁপা হস্তে হুরায়রার দিকে এগিয়ে দিলো আবরার।
হুরায়রা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল,
“কোথায় পেলেন এটা?”

“শাপলা পুকুর পাড়ে বড় বড় তাল গাছ গুলো আছে না সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখি যে গাছের গোড়ায় একটা বাসা পড়ে আছে। বাতাসে হয়তো ছিড়ে পড়েছে গিয়ে উঠিয়ে দেখি তাতে দুটো ছানাও আছে তাই তোর জন্য নিয়ে এলাম। ইনান সেদিন বলেছিলো তুই নাকি,,,,।”

“ওহ আচ্ছা তাই বুঝি আপনি গাছ হতে পেড়ে নিয়ে এলেন তবে মিথ্যা কেনো বললেন?”

আবরার ধরা খেয়ে লজ্জায় মাথা চুলকালো। হুরায়রা সে দিকে পাত্তা না দিয়ে বলল,

“আচ্ছা এত উঁচুতে উঠলেন কি করে?”

“উঠেছি উঠেছি তোর জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি।”

“কিন্তু এটা এখন আমি কি করে বাড়ি নিয়ে যাবো?”

“কেনো হাতে করে নিবি।”

“আরে না উনি যদি দেখে তবে তো আমাকে আর আস্ত রাখবে না।”

“হুরায়রা তোকে কিছু বলার ছিলো।”
ভয়ে ভয়ে বলল আবরার। তার বুক ডিব ডিব করছে। বার বার গলা শুকিয়ে আসছে। সে কিছুতেই হুরায়রাকে তার মনের কথা বলতে সক্ষম হচ্ছে না।ত বুও সাহস করে আবার হুরায়রার নাম ধরে ডাকলো।

“হুরায়রা শুন তো-তোকে।”

“এখন আর সময় নেই আবরার ভাই পরে কথা হবে আমি আসছি।”

আবরার হুরায়রাকে আটকাতে চেয়েও পারলো না। তার অন্তঃকরণে প্রণয়ের বহ্নিশিখার বলয় প্রবল বেগে জ্বলতে শুরু করেছে। যার উত্তাপ সমস্ত হৃদয় জুড়ে প্রাবাহিত হচ্ছে।
হুরায়রা চলে যাওয়ারও কিছু সময় পর পর্যন্ত আবরার সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলো। আজও তার মনের কথাটা হুরায়রাকে জানানো হয় নি। সে জানে না যখনি হুরায়রা তার সামনে আসে তখনি কেন সব কিছু কেমন অগুছালো হয়ে যায়। এই মেয়েটিকে সে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে। কিন্তু ভয়ে আজও তাকে নিজের ভালোবাসার কথাটা জানিয়ে উঠতে পারে নি।
হুরায়রাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরেই আবরারদের বাড়ি।হুরায়রাকে সে মধ্যমিকে পড়াকালীন সময় থেকেই পছন্দ করতো অথচ ভালো লাগার কথাটা সে আজও বলতে পারে নি। সে স্বভাবতই একটু লাজুক প্রকৃতির। যার কারনে নিজের মনের কোণে থাকা হুরায়রার প্রতি সুপ্ত ভালোবাসাটা আজও প্রকাশ করা হয় নি। সে চায় হুরায়রা বুঝুক তাকে, তার অপ্রকাশিত ভালোবাসা অনুভব করুক কিন্তু হুরায়রা কি সেটা কখনো বুঝতে পারবে? ভেবে ভেবে একটা প্রশস্ত শ্বাস ছাড়ে আবরার।

বাড়ি ফিরে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো হুরায়রা। ওড়নার আড়াল থেকে চুপিচুপি বাবুই পাখির বাসাটা বের করে তার ঘরের বারান্দার এক কোণে নিয়ে লুকিয়ে রাখলো। বহুদিনের শখটা আজ পূর্ণ হয়েছে। তাই সে কিছুতেই বাবুই পাখি এবং বাসা দুটোর কোনটাই সে কারো হাতে পড়তে দিবে না। নিজের ঘরে লুকিয়ে রেখেই পাখি গুলোকে সে বড় করবে বলে স্থির করলো।
অথচ সে জানে না একজোড়া চোখ সর্বক্ষণ তার উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখে। সে দৃষ্টিকে পাঁকি দেয়ার অভিপ্রায় এখন পর্যন্ত এই ষোলো বছর বয়সী ষোড়শীটির হয়ে উঠে নি।

(৩৩)

আজ দিন তিনেক একের বেশি হবে হুরায়রা ইয়াদের মুখোমুখি হচ্ছে না। অনেকটা ইচ্ছা করেই ইয়াদের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখছে হুরায়রা। নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে একটা নিজস্ব গণ্ডিতে। তার প্রতি ইয়াদের অবহেলাপূর্ণ অধিকার বোধটা দিন দিন অসহনীয় হয়ে উঠছে। যেখানে ভালোবাসা শব্দটা অনুপস্থিত সেখানে অধিকার বোধটা বড্ড বেশি বেমানান। ইয়াদের প্রতি তার মনে প্রচণ্ড অভিমান জমেছে যেটা তাকে না চাইতে ইয়াদের কাছ থেকে শতযোজন দূরে সরিয়ে নিচ্ছে। অভিমান বস্তুটাই বড্ড অভিমানী। ব্যাক্তি কিংবা বস্তু বেঁধে সেটার ধরন সম্পুর্ণ আলাদা হয়ে উঠে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে অভিমান বস্তুটি ক্রমশ বাড়তে থাকে। ইয়াদের প্রতি ছোট্ট ছোট্ট অভিমান গুলো জমতে জমতে কখন যে পাহাড় সম হয়ে উঠে তা হুরায়রা নিজেও বুঝতে পারে নি। না হয় যাকে না দেখে সে এক মুহূর্ত থাকতে পারতো না, যার সাথে কথা না বললে দিনটাই তার খারাপ যেত অথচ আজ দিন তিনেক ধরে সে কিনা তারই ধরাছোঁয়ার বাহিরে আছে।

ঘর থেকে বেরোতেই ইয়াদের মুখোমুখি হলো হুরায়রা। এই কয়দিন তাদের মধ্যে কিঞ্চিৎ পরিমানের দেখা সাক্ষাৎও হয় নি। হুরায়রাকে দেখেই ইয়াদ বুকের ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠলো। সে যেনো এই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষাতেই ছিলো। তবে সেটা হুরায়রার সমুখে প্রকাশ করলো না। নিজের মধ্যে স্বাভাবিকতা ধরে রেখে বলল,
“কিরে হুরমতি এই কয়দিন যে তোর টিকি টুকুও দেখা যায় নি, আমায় দেখা দিবি না বলে কি অনশন করেছিলি?”

ইয়াদের কথার কোন জবাব সে করবে না বলে ঠিক করলো। নিজের মধ্যে কঠিনতা ধরে রাখতে স ডান হাতের বৃদ্ধা আংগুল দিয়ে বা হাতের তর্জনী খুঁটতে লাগলো। ইয়াদ সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেটা একেবারেই হুরায়রার নজর এড়িয়ে গেলো না। ইয়াদের দীর্ঘশ্বাস কানে লাগতেই হুরায়রার ভেতরটা কেঁপে উঠলো। জমে থাকা অভিমান গুলো খুব করে চাইলো গলে যেতে কিন্তু না হুরায়রা এত সহজে গলে যাবে না তাই সে নিজেকে ধাতস্থ রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। ইয়াদ হুরায়রার কাছ থেকে কোন প্রকার জবাব না পেয়ে বলল,

“হ্যাঁরে হুর তুই তাহলে এত দিন আমাকে না দেখে থাকতে পেরেছিস। তা বেশ করেছিস এখন থেকে না দেখে থাকার অভ্যাস টা তবে করেই ফেল কে জানে কখন যে আবার চিরকালের জন্য চোখের আড়াল হয়ে যাই।”
ইয়াদের এমন কথায় নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারলো না হুরায়রা। নিচের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দিলো। হুরায়রা আর যাই করুক এই লোকটার প্রতি কঠিন হতে পারবে না। যতই সে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুক শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যাওয়া আর হয় না। এই লোকটার সামনে গেলেই তার সব কিছু কেমন ওলটপালট হয়ে যায়। নিজের রাগ অভিমান গুলো যেনো তার সাথে বেঈমানি করে পালিয়ে যায়।
হুরায়রা কাঁদছে বুঝতে পেরে ইয়াদ নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“তোকে না বলেছিলাম কাঁদবি না, কাঁদলে তোকে কেমন বিচ্ছিরী দেখতে লাগে? আরে কি হলো এমন পেত্নীর মতো কাঁদিস কেনো?”

“আপনি খুব খারাপ।”

“কেনো রে কি করেছি আমি?”

“আপনি কেনো বুঝেন না আমি আপনাকে,,,। ”

“আমাকে কি?”

“আপনি কি কখনোই আমাকে একটু ভালোবাসতে পারেন না?”

“তোর মাথায় কি সারাদিন এইসব কিছুই ঘুরে? খুব বেশি পেঁকেছিস। আর তুই কি ভেবেছিস তুই আমার সামনে না থাকলে আমি তোর কোনো খোঁজ খবর পাবো না?”

ইয়াদের শেষ কথাটা কানে পৌঁছাতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো হুরায়রা। বাবুই পাখির বাসাটার কথা কোনভাবে ইয়াদ জেনে যায় নি তো? একটু আগে যে কাঁদছিল এখন মনে হচ্ছে তার চোখের পানিটুকু ইয়াদের শেষের বাক্য শুনে শুকিয়ে গেছে। ইয়াদ কোন ভণিতা ছাড়াই বলল,
“তা তুই নিজেই তো একটা পিচ্ছি ছানা বাবুই পাখির ছানা দিয়ে কি করবি শুনি?”

হুরায়রার সন্দেহই ঠিক ইয়াদ ঠিক টের পেয়ে গেছে। কোন কুক্ষণে যে তার সাথে দেখা হলো। তার ভয় হলো ইয়াদ না জানি ছানা গুলোকে ফেলে দেয়। মনে সন্দেহ নিয়ে হুরায়রা একবার ইয়াদের দিকে তাঁকায়। ইয়াদকে বুঝার চেষ্টা করে। ইয়াদের গম্ভীর চোখের দৃষ্টিতে দিকে তাকিয়ে আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না হুরায়রার, অজান্তেই পুনরায় সে চোখের পানি ছেড়ে দিলো। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল,

“আসলে ওই যে আসার সময়,,।”

“হ্যাঁ তোকে আর ব্যাখ্যা করে সব বলতে হবে না, তুই কি ভেবেছিস তুই না বললে আমি জানতে পারবো না? যাই হোক
শুন বাবুই পাখির বাসাটা আমি সরিয়ে নিয়েছি। আর হ্যাঁ তোর কত বাবুই পাখির বাসা চাই এইবার আমি দেখবো।”

“মা-মানে?”

“মানে ওই শাপলা পুকুরপাড় যে বড় বড় তাল গাছ আছে তোকে সেগুলোর আগায় নিয়ে বসিয়ে দেবো। আর শুন ফের যদি দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওই আবরারের সাথে কথা বলেছিস বা এই হাত দিয়ে তার থেকে কিছু নিয়েছিস তবে তোর হাত দুটো আর এই যে দুই ঠ্যাং আমি ভেঙে দিবো।”

হুরায়রা লক্ষ্য করলো ইয়াদ যখন কথাগুলো বলছিলো তখন তার কপালে সুরু রগ গুলো ফুলে উঠেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। হুরায়রার বড্ড ইচ্ছা হলো ইয়াদের কপালটা আলতো করে ছুয়ে দিতে কিন্তু সাহস হলো না। ইয়াদের ধারে কাছে যাবার কিংবা গোপনে তাকে একটিবার ছুঁইয়ে দেখার মতো সাহস তার কোন কালেই নেই।

“এই ভাবে কি দেখছিস আমাকে? আগে কোনোদিন দেখিস নি?”

ইয়াদের কথায় চমকে উঠে সাথে সাথে চোখ নিচু করে ফেললো হুরায়রা।

“তা আমায় দেখা না দিয়ে থাকার অনশন আর কতদিন চলবে শুনি?”

হুরায়রা কিছু না বলে চুপচাপ নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইলো।ইয়াদ হুরায়রার দিকে তাঁকিয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করে বলল,

“যার সান্নিধ্য লাভের আশায় নিজেকে গুটিয়ে নিতে চাইছিস সে আদৌ তোর সান্নিধ্যে আসার যোগ্য কিনা সেটা ভেবেছিস কখনো?

হঠাৎ ইয়াদের মুখে এমন কঠিন বাক্য শুনে বিস্মিত চোখে তাঁকালো হুরায়রা। ইয়াদের কঠিন কথার মানে সে কোন কালেই বুঝে পারে নি আর আজও নয়। সে শুধু একরাশ হতাশা নিয়ে চেয়ে রইলো। ইয়াদ তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,

“এই কয়দিনে বেশ রোগা হয়ে গেছিস।”

“তাতে আপনার কি?”

“আমার বিশেষ কিছু নয়।”

“তবে বলছেন কেনো। আমি শুকিয়ে যাই কিংবা মুটিয়ে যাই তাতে তো আর আপনার কিছু আসে যায় না। আপনি তো আর আমায় ভালোবাসেন না। যদি বাসতেন তবেই তো আপনার কিছু এসে যেতো।”
বলতে বলতে হুরায়রার চোখ ছলছল করে উঠলো। ইয়াদের এমন কঠিন কঠিন কথা আর এমন কঠোর ব্যাবহার ঠিক হজম করতে পারছে না সে। এই যে সে এতদিন অভিমান করে ইয়াদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে তা নিয়ে ইয়াদের মধ্যে কোনো হেল দোলই নেই। তার অনুপস্থিতি যে ইয়াদকে খুব একটা পীড়া দেয়নি সেটা দেখে হুরায়রা মন যেনো আরো ভেঙে গেলো। অন্তঃকরণে ঝড় বইতে লাগলো, কান্নাগুলো সব দলা পাকিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইলো অনেক কষ্টে সেটা চাপিয়ে রাখতে চেয়েও লাভ হলো না শেষে কেঁদেই ফেললো।

“তুই এত ছিঁচকাঁদুনে হলি কি করে বলতো, কথায় কথায় কাঁদিস।”

ইয়াদের কথার কোনো জবাব না করে নাক টেনে টেনে কেঁদে চলেছে হুরায়রা। ইয়াদ কিছু না বলে মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে একটানে তাকে নিজের কাছে টেনে নিলো। আকস্মিক ঘটনায় হুরায়রা চমকে গেলো। খানিকটা বিস্ময় আর অবাক হয়ে ছলছল চোখে ইয়াদের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। ইয়াদ সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হুরায়রাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

“যখন অভিমান করে নিজেকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবি না তবে চেষ্টা করতে গেলি কেনো?”

“আপনি আমার ভালোবাসা কেনো বুঝেন না?”

“বললাম তো ভালোবাসা বলতে কিছু হয় না যা হয় তা শুধু ক্ষনিকের মৌহ।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই এক ঝটকায় নিজেকেও ইয়াদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো হুরায়রা। বলল,

“আপনি কখনো কারোর মনের গভীরতা বুঝতে পারবেন না, পারবেন না সেখানে প্রবেশ করতে। কারো মনের গভীরতা বুঝতে হলে হৃদয়ের প্রয়োজন কিন্তু আপনি তো একটা হৃদয়হীন মানুষ আপনি কি করে বুঝবেন ভালোবাসা আর মৌহের পার্থক্যটা আসলে কি?”

হুরায়রার এমন কড়া কথায় যেন থম মেরে গেলো ইয়াদ। এই কয়দিনে হুরায়রার মাঝে অমুল পরিবর্তন চলে এসেছে। ইয়াদ ভাবতেই পারে নি হুরায়রা তার চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলতে পারে।

” খুব কথা শিখে গেছিস হুর। বাহ এই কয়দিনে দেখছি নিজের ভালোই উন্নতি করেছিস।”
প্রচণ্ড রাগে কিড়মিড় করে বলল ইয়াদ।

হুরায়রা তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারে নি রাগের মাথায় সে কি বলে ফেলেছে। ইয়াদ তাকে এক ঝটকায় হুরায়রাকে কাছে টেনে এনে বলল,
“তোর খারাপ হোক সেটা আমি কখনো চাই নি আর চাইবো না। কতটুকু বয়স হয়েছে তোর? লজ্জা করে না এই বয়সে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে বেড়াতে। একবারো ভেবেছিস তোর এমন বেহায়াপনাতে আমি কি মনে করছি?”
হুরায়রা একেবারে থম মেরে গেলো। ইয়াদ অনর্গল কথাগুলো বলে যাচ্ছে। বেশ খানিকটা সময় পর হুরায়রা নিজেকে ইয়াদের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
“তবে আমার প্রতি আপনার কিসের এত অধিকারবোধ। কে হই আমি আপনার কেনো আপনি আমার জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে প্রতিটা জিনিসে উপর হস্তক্ষেপ করেন? আমি আপনাকে সে অধিকার দিয়েছি নাকি আমার মা বাবা দিয়ে দিয়েছে। এই যে বাবুই পাখির বাসা সেটাই বা আপনি ফেলে দিয়েছেন কেনো আমার না হয় মুল্য নেই আপনার কাছে, আমার ভালোবাসার তো নেই ই। কিন্তু আমার শখ আমার ইচ্ছা সেগুলো?”
ইয়াদ চোয়াল শক্ত করে হুরায়রার কথা গুলো শ্রাবণ করছে। সে বিশ্বাস করতে পারছে না হুরায়রা তাকে এভাবে কথাগুলো বলতে পারছে। তবে হুরায়রা মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলো হুরায়রা এখন নিজের মধ্যে নেই। তার জ্ঞান লোপ পেয়েছে। মেয়েটা সত্যিই প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছে যার ফলে সে কাকে কি বলছে বুঝতে পারছে না। ইয়াদ নিজেকে কিছুটা শান্ত করে হুরায়রা দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটা বড্ড অবুঝ ওর সাথে এমনটা করা হয় তো তার নিজেও ঠিক হয় নি। নিজের দূর্বলতা ঢাকতে বারবার মেয়েটাকে কষ্ট দিয়ে ফেলে সে। তবে হুরায়রাও কম কিসের সে জেনেও কেনো তার কথার অবাধ্য হয়।

চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here