তোর নামেই এই শহর পর্ব -১২

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১২

(৪০)

ছাদের কোণঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নাবাদ। মাথার উপর কাঠফাটা রোদ্দুর মস্তিষ্ক ভেদ করে চলেছে। সেদিকে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। তার স্থির চাহনি উঠানের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর উপর। শেষবার যখন গ্রামে এসেছিলো মেয়েটাকে সে হুরায়রার সাথে আম বাগানে হাঁটতে দেখেছিলো। মেয়েটার মুখে অদ্ভুত এক মায়া উপছে পড়েছিল সেদিন যেটা নাবাদ এড়িয়ে যেতে পারে নি। আকাশের একরাশ নীল যেনো মেয়েটার চোখের গভীরে এসে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নীল দরিয়ার সমস্তটুকু নীল মেয়েটি তার চোখে ধারণ করে বেড়াচ্ছে। কি অদ্ভুত মায়া চোখ দুটিতে।প্রায় দুই বছর পর আবারও মেয়েটা তার সামনে। অথচ অনুভূতিটা সেই প্রথম দিনের মতোই আছে।
“নাবাদ?”
ইয়াদের ডাকে পেছন ফিরে তাঁকায় নাবাদ। মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে ফিরে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায় সে। ইয়াদ এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়াতে নাবাদ প্রশ্ন করে বলল,
“আচ্ছা ভাইয়া তুমি লাভ এট ফাস্ট সাইট বিশ্বাস করো?”
“প্রথম দর্শনেই প্রেম!”
“করো বিশ্বাস?”
“প্রেমে পড়েছিস?”

নাবাদ কপালে ভাঁজ ফুটিয়ে মাথা নেড়ে উঠানে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখালো। ইয়াদ হালকা গাড় ঘুরিয়ে দেখলো তাকে। বলল,
“এই তাহলে তোর সেই নীল চোখী?”
“কয়েক মুহূর্তের দেখায় মনের মাঝে যে অনুভুতির জন্ম হয় সেটাকে কি আদৌ কোন ভালোবাসা নাকি শুধু ক্ষণিকের ভালোলাগা মাত্র?”

“ভালোলাগা আর ভালোবাসা যে এক জিনিস নয় তা ঠিক। তবে ভালোলাগা থেকেই যে ভালোবাসার জন্ম সেটাও নেহাত মিথ্যা নয়।”
ইয়াদের কথায় মাথা দুলিয়ে হাসলো নাবাদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ভালোলাগা আর ভালোবাসার তফাৎ যদি বুঝতেই পারো তবে হুরায়রার ছোট্ট হৃদয়ের অনুভুতিগুলো কেনো বুঝো না? মেয়েটা দিনের পর দিন এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে।”

“ছোট্ট হৃদয় বলেই যে বড্ড ভয় নাবাদ। হুরের সমস্তটা জুড়ে আমি কিন্তু আমাকে যে সর্বত্র বিচরণ করা মানায় না।”

“তবে সব ছেড়ে ছুড়ে গ্রামে কেনো পড়ে আছো? শুধু যে প্রজেক্টের কাজই একমাত্র উদ্দেশ্য নয় সেটা কেউ না বুঝলেও আমি কিন্তু বুঝতে পারি।”

“কি করবো বল সে বড্ড অবাধ্য।”
নাবাদ কিছু বলল না। সে জানে হুরায়রার মতো ইয়াদের সমস্তটুকু জুড়েও হুরায়রাই আছে। তবে কেনো যে এত অনুভূতি আড়াল করার লড়াইতে নেমেছে ইয়াদ সেটা তার বোধগম্য হলো না।
নাবাদ প্রশস্ত শ্বাস ছেড়ে আবারো মেয়েটাকে দেখলো।
“নাম জানিস?”
“জানা হয় নি।”
“হুরকে জিজ্ঞেস করতে পারতিস। সে তো মহাজ্ঞানী শুধু নাম নয় পুরো হিস্ট্রিই বলে দিতো।”

“সত্যি বলতে এই দুবছরে গ্রাম থেকে যাওয়ার শুরুর কয়েকটা দিন ছাড়া তাকে খুব একটা বেশি মনে পড়ে নি কখনো, আসলে মনে পড়ে নি বললে ভুল হবে আমি তাকে ভুলে গেছিলাম।”

“তাহলে এটাকে ভালোলাগা কিংবা ভালোবাসা কোনটাই বলা চলে না। আমরা চোখে তো অনেক কিছুই দেখি অনেক কিছুকে ভালোও লাগে কিন্তু দেখা যায় ভালোলাগাটা আমাদের ততক্ষণই স্থায়ী হয় যতক্ষণ সেটা আমাদের নজরের কাছাকাছি থাকে। নজর সরলে যা মনের অগোচরে চলে যায় সেটা কখনো ভালোবাসা হতে পারে না।”

“হবে হয় তো। তবে তাকে দেখার পর প্রথম দিনের অনুভূতিটা কেমন বুকে নাড়া দিয়ে উঠছে।”
ইয়াদ নিশ্চুপে মেয়াটাকে একবার দেখলো তারপর নাবাদকে।
তিয়াশা ইতিমধ্যে সব জায়গায় খুজে শেষে ছাদে এসে ইয়াদ আর নাবাদকে পেলো। দেখলো দুই ভাই কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে কি জরুরী বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। তাদের দেখে সে বলল,
“তোমরা দুজন এখানে দাঁড়িয়ে গল্প করছো আর আমি তোমাদের কোথায় না কোথায় খুঁজছি। এই রোদে দাঁড়িয়ে দুটিতে কি পরামর্শ হচ্ছে আমায় বলা যাবে কি।”
ইয়াদ নড়েচড়ে দাঁড়ালো। বাহুতে হাত গুঁজে বলল,
“তেমন জরুরী কিছুই না। কেনো খুজছিলে?”
“এমনিই। চলো নিচে চলো। ওই দিকে অরা কি কান্ড বাঁধিয়েছে দেখবে গিয়ে।”
“আবার কি কান্ড বাঁধিয়েছেন উনি?”
“কি আর কাণ্ড বাঁধাবে নানীজানের সাথে তার ঝগড়া বেঁধেছে। এক্ষুনি তাদের না থামালে সেখানে যে কিছু একটা ঘটে যাবে এই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।”

“আমি বুঝিতে পারছি না ভাইয়া তুমি ওকে কেনো নিয়ে আসতে বলেছিলে আমাদের সঙ্গে।”

“নাবাদ ঠিক বলেছে অরাকে এখানে আনা ঠিক হয়নি ইয়াদ।”

“ইয়াদ এমনি এমনি কিছু করে না সেটা নিশ্চই তোমাদের অজানা নয়। তাছাড়া তোমাদের আরেকটা বিষয় অবগত করে রাখি মি.সামির কিন্তু এখানেই আছে। সো মিস অরাকে আনার ব্যাপারটা নিশ্চই এবার বুঝতে পারবে।”
কথা শেষ করে আর একমূহুর্তও দাঁড়ালো না ইয়াদ। গট গট করে হেঁটে নিচে চলে গেলো। তিয়াশা ইয়াদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
“সামির এখানে আছে ইয়াদ তো সেটা আগে বলে নি।”
“কেন তুমি জানতে না সেটা।”
“আমি আর জেনে কি করবো নাবাদ। সামির আর ইয়াদের শত্রুতা কি কখনো শেষ হবে আর হলেও বা কি আমি তো,,।”
বলেই থামলো তিয়াশা। চোখের কোণে অশ্রু এসে জমতেই সেটা আড়াল করার চেষ্টা করে বলল,
“ইয়াদ কি করতে চাইছে বলতে পারো? সামিরের কোন ক্ষতি করবে না তো?”
“তোমার কি তাই মনে হয়? তাছাড়া তুমি বেশ ভালো করেই জানো ভাইয়া আর যাই করুক কারো ক্ষতি করার কথা চিন্তা করতে পারে না।”
“তবে অরাকে কেন এনেছে?”
“তুমি সামিরকে নিয়ে একটু বেশিই ভাবিছো তিয়াশা।”
“মোটেই না। তেমন কিছুই নয় আমি শুধু জানতে চেয়েছি।”
নাবাদ ইতিমধ্যে তিয়াশাকে লক্ষ্য করলো। তিয়াশার চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। কি আছে তিয়াশার মনে? মেয়েটা কি এখনো তবে? না আর ভাবতে পারলো না সে। এখন তাকে নিচে যেতে হবে। তিয়াশার ব্যাপারটা আপাতত না ভাবলেও চলবে। কিছু জিনিস সময়ের হাতেই ছেড়ে দেয়া উচিৎ। সময় তখন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাবে।

(৪১)
গলা সমান পানিতে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে হুরায়রা। একটু পর পর নাক টেনে টেনে কাঁদছে সে। ইয়াদ ঘাটে বসে পায়ের উপর পা রেখে হুরায়রাকে অবলোকন করছে। ইয়াদের স্থির চাহনির দিকে তাঁকিয়ে হুরায়রার গলা প্রায় শুকিয়ে এলো।দেড় ঘন্টা যাবত সে গলা সমান পানিতে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আরো কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে জানে না। ইয়াদ কান চুলকাতে চুলকাতে বলল,

“এইভাবে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদছিস কেনো?”

“আপনি আমাকে শাস্তি দিচ্ছেন কেনো কি করেছি আমি?”

“তুই বলতে চাচ্ছিস যে তুই শাস্তি পাওয়ার মতো কিছুই করিস নি?”

“না আমি কিছুই করি নি। আপনি ইচ্ছা করে আমার সাথে এমন করছেন। আর সেটা কেনো করছেন একটু বলবেন আমায়।”
ইয়াদ কান চুলকানো থামিয়ে হুরায়রার দিকে মনোযোগ দিলো। ভ্রু যুগল কুচকে বলল,
“তোকে না সেদিন বলেছিলাম আবরারের সাথে আর কখনো কথা বলতে দেখলে তোর ঠ্যাং আমি ভেঙে দিবো। তবে আজ আবার কোন সাহসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার সাথে কথা বলতে গেলি?”

“আমি কি ইচ্ছা করে উনার সাথে কথা বলতে গিছি নাকি উনিই তো আমাকে দাঁড়াতে বলল।”
হুরায়রার এমন জবাবে রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো ইয়াদ।প্রচণ্ড রাগে তার কপালের সুরু রগগুলো ফুলে উঠেছে।
“আজকাল মুখে মুখে তর্ক করাও শিখে গেছিস দেখছি।”

“আমি কি ভুল বলেছি আপনি কেনো আমার সাথে এমন করেন? আমি তো বলেছি আমি ইচ্ছা করে দাঁড়াই নি।”

“তুই কি ভেবেছিস ইয়াদ কিছুর খবর রাখে না? খুব প্রেমপত্র পাওয়ার ইচ্ছা হচ্ছিলো তাই না, সে জন্যই রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেমপত্র দেয়া নেয়া হচ্ছিলো?”

প্রেমপত্র শব্দটা শুনে ভয়ে একেবারে দমে গেলো হুরায়রা।ইয়াদ যে আবরারের দেয়া চিঠিটার কথা জেনে যাবে সেটা সে ভাবতেও পারে নি। মনে মনে একটা ফাঁকা ঢোক গিললো সে।কোন কু ক্ষণে লিরার কথা ধরে চিঠিটা সে নিতে গেলো।
ইয়াদ পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ইয়াদ ঘাটের শেষ সিঁড়িতে এসে সেটা হুরায়রার সামনে মেলে ধরে বলল,

“এটাই তো সেই চিঠি তাই না। পড় এখানে কি লিখা আছে।”

হুরায়রা ছলছল চোখে চিঠিটার দিকে তাঁকালো। তারপর বলল,
“আপনার ইচ্ছে হলে আপনি পড়ুন আমার পড়ার ইচ্ছে নেই।

“ইচ্ছে নেই তবে এটা নিয়েছিলি কেনো?

“নিয়েছি বেশ করেছি। আপনার তাতে কি আপনি তো আমায় ভালোবাসেন না তবে কেউ যদি আমায় চিঠি দিয়ে থাকে তাহলে আপনার এত লাগছে কেনো।”

ইয়াদ কিছু বলার আগে সময় নিলো। হুরায়রার কথার ধরণ তাকে রাগিয়ে দিচ্ছে তাও সে কেমন শান্ত হয়ে রইলো। বলল,
“কান ছাড়। আর এটা হাতে নিয়ে পড়। জোরে জোরে পড়বি যাতে আমি শুনতে পাই।”

হুরায়রা আর কিছু বলতে পারলো না পানির দিকে দৃষ্টি নত করে কাঁদতে শুরু করলো। তাকে কাঁদতে দেখে ইয়াদ ধমক দিয়ে বলল,
“একদম ন্যাকা কান্না করবি না। দিন দিন তোর সাহস দেখছি চড়চড় করে আকাশে উঠছে। এত সাহস তুই পাস কোথা থেকে।”
হুরায়রা আর কোন জবাব করলো না। দৃষ্টি নত করে কান ধরে দাঁড়িয়ে রইলো গলা সমান পানিতে। ভেতর ভেতর ইয়াদের প্রতি প্রচন্ড রাগ হলো তার। একটা মানুষ কতটা নির্দয় হতে পারে তা প্রতিমুহূর্তে বুঝিয়ে দিচ্ছে ইয়াদ। মাঝে মাঝে নিজের উপর রাগ হয় হুরায়রার। সে চায় ইয়াদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে অথচ হাজার চেষ্টা করেও পারে না। ইয়াদের দেয়া শাস্তিগুলো আগে মেনে নিতে খুব একটা কষ্ট হতো না তার ইদানীংকালে বেশ রাগ হয় তার।

দূর থেকে ইয়াদকে পুকুরঘাটে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এলো অরা। পুকুর ঘাটের কাছাকাছি এসে তার নজর পড়লো পানিতে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকে হুরায়রার উপর। হুরায়রা মুখচোখ ইতিমধ্যে লাল হয়ে উঠেছে। অরাকে ঘাটের সিঁড়িতে এসে দাঁড়াতে দেখে সে নাক টেনে বলল,
“ইয়ায়ায়ায়াদ,,মি. ইয়ায়ায়াদ! ন্যাকা ষষ্ঠী।”
হুরায়রা এমন হাবভাব দেখে পেছন ঘুরে তাঁকায় ইয়াদ। অরা তাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“এখানে কি করছেন আপনি? আর মেয়েটা এভাবে পানিতে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেনো।”
“তাতে তোর কিরে ন্যাকা ষষ্ঠী।”
বিড়বিড় করে বলল হুরায়রা। ইয়াদ হুরায়রা দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি হুরায়রা বলে উঠলো,
“আপনার পি.এস চলে এসেছে। একটা কাজ করুন তাকেও আমার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে রাখুন। কাল রাতে দাদীর সাথে যা করেছে।”
“তোকে এত কথা বলতে বলেছি নাকি।”
“তা বলবেন কেনো? পারেন তো শুধু আমার সাথেই এমন করতে।”
ইয়াদ আর হুরায়রা কথোপকথনের মধ্যেই অরা এসে বাঁধা দিলো। বলল,
“আপনার সাথে আমার কিছু দরকার আছে ইয়াদ। একটু সময় হবে?”
“এখন পারছি না। সময় হলে আমি নিজেই আপনাকে ডেকে নিবো।”
“কিন্তু মি ইয়াদ।”
অরা কথা শেষ করতে পারলো না এর মাঝেই হুরায়রা পুকুর থেকে উঠে দৌড় দিলো বাড়ির দিকে। ইয়াদ ধরতে যাবে তার আগেই হুরায়রা অঞ্চল ছেড়ে পালিয়ে গেলো। হুরায়রা হঠাৎ এমন কাজ করবে ভাবতে পারে নি সে। মেয়েটা যে দিনকে দিন পাজী হচ্ছে এটাই তার প্রমাণ।

হুরায়রা চলে গেলে ইয়াদ অরাকে বলল,
“আচ্ছা চলুন সামনে যাই। কারখানার কাজ চলছে বাবা আর নাবাদ সেখানেই আছে। যেতে যেতে কথা বলি।”
অরা কিছুটা খুশি হলো তবে প্রকাশ করলো না। একটু আগে সে অনেক বড় কাজ সেরে এসেছে এই মুহূর্তে তাকে সবার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে হবে নয় তো ধরা পড়ে গেলে রক্ষে থাকবে না।
চলবে,,,,।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here