তোর নামেই এই শহর পর্ব -১৩

#তোর_নামেই_এই_শহর
#লেখিকাঃসুমাইয়া_জাহান
#পর্ব_১৩

(৪২)
বেশ ভোর বেলায় হুরায়রার ঘুম ভাঙলো। চারদিকে তখনো ঠিক করে আলো ফুটে নি। একটা মৃদু আলোয় ভরে আছে চারপাশ। হয়তো এটাকেই উষালগ্ন বলে লোকে। হুরায়রা বিছানা ছেড়ে জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। জানালার বাহিরে ছাতিম ডালে দুটো হলদে পাখি জড়াজড়ি হয়ে বসে আছে। হুরায়রা জানালার বাহিরে হাত বাড়াতেই তাড়া উড়ে গিয়ে সবচেয়ে উঁচু ডালটায় বসলো। ধীরে ধীরে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠছে। হুরায়রা জানালার পাশ থেকে সরে এসে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। বাড়ি সকলে এখনো ঘুমে, শুধু রাহেলা বেগমের ঘর থেকে চাপাকান্না সুর ভেসে আসছে। হুরায়রা একবার ভাবলো দাদীর ঘরে যাবে পরোক্ষণেই আবার কি ভেবে আর গেলো না। পা টিপে টিপে রাহেলা বেগমের ঘর হয়ে বেড়িয়ে এলো উঠানে।

উঠানে পা রাখতেই হুরায়রার সমস্ত শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো। ভোরের হাওয়া আর চাপা ফুলেরগন্ধে চারপাশ মেতে উঠেছে। এমন সুন্দর পরিবেশ, সকাল সকাল যদি গ্রামের রাস্তায় একটুখানি হেঁটে আসা যায় তবে মন্দ হয় না। যেই ভাবা সেই কাজ হুরায়রা আর দেরি করলো না মাথায় ওড়না টেনে পা বাড়ালো বাড়ির বাহিরে।
হাঁটতে হাঁটতে পুকুরের উত্তর পাড়ে এসে খেতের আইল ধরে সামনে হাঁটা লাগালো সে। পুকুরের এই দিকটা তার বেশ পছন্দের। কেমন শান্ত আর নিরিবিলি। আর খেতের আইল ধরে হাঁটতে তো তার বেশ লাগে। কচি কচি ঘাসের ডগায় পা ফেলে চলতে যে কি আনন্দ সেটা বোধ হয় হুরায়রা ছাড়া অন্য কেউ অনুভব করতে জানে না।

কচি ঘাসের উপর খালি পায়ে হেঁটে সামনে এগোচ্ছে সে। আজকে আকাশটাও কেমন ভার হয়ে আছে। বৃষ্টি নামবে হয় তো। হুরায়রা হাঁটতে হাঁটতে একটা বাড়ির সামনে এসে থামলো। বাড়ির সমুখে বিশাল বড় পুকুর আর তাতে শান বাঁধানো ঘাট ঠিক যেন তাদের পুকুরের সাদৃশ। এর আগে সে কখনো এইদিকটায় আসে নি। হুরায়রা বাড়িটাকে অবলোকন করতে করতে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেলো। পুকুরের খুব কাছাকাছি এসে সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিতে নজর পড়লো ঘাটের সিঁড়ির উপর। সেদিনের যুবকটি বড়শি হাতে মাছ ধরছে। হুরায়রা কাঁহাতক সেখানে দাঁড়িয়ে তার মাছ ধরা দেখলো। যুবকটি বেশ দক্ষ হাতে মাছ ধরছে। পটাপট বড়শিতে বড় মাছ তুলে আনছে।

পর পর বেশ বড় কয়েকটা মাছ তুলে রেখে শেষের মাছটা তোলার অপেক্ষায় আছে সামির। পানিতে বড়শি ফেলে মনোযোগ দিয়ে সে দিকেই তাকিয়ে রইলো। একটুপর বড়শিতে টান পড়তেই সে মাছ তুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো। এবারের মাছটা অন্য মাছ গুলোর চাইতে কিছুটা বড় মনে হলো। মাছ তুলতে বেশ জোর খাটাতে হচ্ছে তাকে। পুকুরের অপর পাশ থেকে তা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে হুরায়রা। মাছটা সত্যিই বড় সাইজের। সামির সেটা টেনে তুলতে গিয়ে একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছে। একা এত বড় মাছ তুলে আনা যেই সেই কথা নয়। বেশ খানিকটা সময় চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না বড়শি হাত থেকে ছুটে পানিতে পড়ে গেলো। হুরায়রা এমন দৃশ্য দেখে নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলো না চারপাশ মাতিয়ে খিলখিল শব্দ করে হেসে উঠলো।

হুরায়রা হাসির শব্দে চমকে উঠে সামির। আশপাশটায় চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো পুকুরের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেদিনের ষোড়শীটি কোমরে হাত দিয়ে হাসছে। সামির তাকে হাসতে দেখে ভ্রুকুচকে নিলো। গলা বাড়িয়ে বলল,
“হুরায়রা! এত সকাল তুমি এইদিকে কি করছো?
হুরায়রা হাসি থামিয়ে বলল,
“আপনার মাছ ধরা দেখছিলাম। শেষেরটা দেখার সৌভাগ্য আর হলো না বড়শি সহ মাছ পানিতে।”
বলেই আরেক দপা হাসলো সে। সামির মুগ্ধ দৃষ্টিতে হুরায়রাকে দেখলো। এমন ভোর বেলায় আকস্মিকভাবে মেয়েটা তার সামনে উদয় হবে এই যেন তার ভাবনাতীত। কল্পনাও যা কল্পনা করা যায় নি এই মুহূর্তে ঠিক তাই ঘটলো তার সাথে।
“ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে ভেবেছো নাকি এইদিকে আসবে?”
“উঁহু ওদিকে যাবো না। আপনিই আসুন না।”
সামির বাকি মাছ গুলো তুলে ঘাটের একপাশে রেখে এদিকেই এগিয়ে এলো। বলল,
“ভাবি নি এই দিকে আসিবে তুমি তাও আবার এমন ভোর বেলায়।”
“এই দিকটায় এর আগে কখনো আসি নি আমি।”
“আগে আসো নি?”
“উঁহু।”
“তবে আজ এলে?”
“হাঁটতে হাঁটতে কখন চলে এসেছি বুঝতে পারি নি। এর আগে কখনো এই দিকটায় আসা হয় নি, তাই জানতামও না এখানে আমাদের বাড়ির পুকুরের মতোই একটা পুকুর আছে।”
“এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবে নাকি ওখানটায় বসবে।”
“উঁহু বসবো না। দেরি হয়ে যাবে। কাউকে জানিয়ে আসি নি তো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে হাঁটতে হাঁটতে না হয় কথা বলা যাক কি বলো।”
“আচ্ছা বাড়িটা কি আপনার?”
“একরকম তাই।”
“এর আগে তো আপনাকে কখনো দেখি নি গ্রামে এবারি প্রথম এলেন বুঝি?”
“বেশ কয়েকবার এসেছি। আচ্ছা তুমি যে বললে তুমি এর আগে এই দিকটায় কখনো আসো নি এটা কি করে সম্ভব বলো তো। তুমি তো গ্রামেরই মেয়ে তোমার তো এই দিকটায় আসার কথা।”
“আসবো কি করে আমার তো ঘর থেকে বেড়িয়ে পুকুর ঘাটে আসাও বারণ।”
“কেনো কেনো?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো সামির। হুরায়রা কিছুটা ব্যথিত হয়ে গাল ফোলাল। বলল,
“উনি আমাকে কোথাও বের হতে দেন না। এমন কি আম বাগানে পর্যন্ত যেতে দেন না। সেদিন আম বাগানে গিয়েছি বলে দু ঘন্টা কান ধরিয়ে পুকুরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন।”
সামির কপালে ভাঁজ তুলে বলল,
“উনি টা কে?”
“ওই যে যাকে আপনি মি.ইয়াদ বলেন সে।”
সামির এবার অবাক না হয়ে পারলো না। হুরায়রার দিকে তাকিয়ে সে সন্দিগ্ধ হয়ে বলল,
“উনি তোমায় শাস্তি দেন?”
“কথার অবাধ্য হলেই তো দেন। গত কালও দিয়েছে।”
“তুমি সেটা মেনে নাও?”
“হুম।”
সামির আর কথা বাড়ালো না। সে বেশ বুঝতে পেরেছে ইয়াদকে হুরায়রা কতটা ভয় পায়। তবে হুরায়রা প্রতি ইয়াদের এত বাধা নিষেধের ব্যাপারটা কিছুতে মাথায় ঢুকলো না।

দুজন চলতে চলতে প্রায় বাড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। হুরায়রা এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
“আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হলো না।”
“সামির।”
“আমার বাড়ি এসে গেছে। এখন যেতে হবে। আসি আমি।”
বিদায় নিয়ে হুরায়রা সামনে এগিয়ে গেলো। সামির তাকে ডেকে বলল,
“আমার সাথে কথা বলেছো দেখে ইয়াদ তোমায় শাস্তি দিবে না তো।”
হুরায়রা মুচকি হেসে বলল,
“যার শাস্তি দেয়ার সে কারণে হোক অকারণে হোক সেটা দিবেই। তবে এখন আর আমি তার শাস্তির ভয় করি না। সয়ে গেছে তো।”
বলেই হুরায়রা আর দেরি করলো না বাড়ির পথ ধরলো।
সামির মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করে হুরায়রার দিকে তাকিয়ে দেখলো। মেয়েটা যে বড্ড সরল এই ব্যাপারে তার সন্দেহ নেই। তবে যতবার সে ইয়াদের কথা বলতে গেছে ততবারই চেহারায় আলাদা একটা আভা দেখা গেছে যেটা একবারের জন্যও সামিরের নজর এড়িয়ে যায় নি। মেয়েরা স্বভাবতই এমন যাকে সে মন থেকে ভালোবাসে কিংবা পছন্দ করে কারণে হোক আর অকারণে তারা শুধু সেই মানুষটির কথাই বার বার বলে। হুরায়রার কথায় সামিরের এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে মেয়েটা ইয়াদের প্রেমে পড়েছে, শুধু প্রেমে পড়েই ক্ষান্ত হয় নি বরং প্রেম নামক কঠিন অসুখে ভুগছে। এই অসুখ সহজে সারবার নয়।

(৪৩)

বাড়িতে এসে হুরায়রা সোজা নিজের ঘরে চলে গেলো। তার ভেতরটা ডিব ডিব করছে। সারা শরীরে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। ইশ কি লজ্জা। ইয়াদের কথা মনে পড়তে সে দুহাতে মুখ ঢেকে নিলো।

সামিরের সঙ্গে কথা বলে বাড়ি ফিরতেই ইয়াদের মুখোমুখি হয়েছিলো হুরায়রা। ইয়াদ তখন পুকুর ঘাটে বসেছিলো। তাকে ওদিক থেকে ছুটে আসতে দেখে পথ আগলে দাঁড়ায়। হুরায়রা মনে মনে তখন এই ভয়টাই পাচ্ছিল। হয় তো ইয়াদ জেনে গেছে সারা সকালটা সে বাড়ি ছিলো না, তাই পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। অথচ তার সকল ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করে ইয়াদ তাকে একটানে কোলে তুলে নেয়। কিছু বুঝার আগেই ঘরে এনে তাকে বিছানায় ফেলে দিয়ে ঘরের দরজা লাগায়। ইয়াদের এহেন কর্মকাণ্ড বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে হুরায়রা। দরজা লাগিয়ে ফিরে এসে একটা চেয়ার টেনে হুরায়রার সামনে গিয়ে বসে ইয়াদ।
“কাল আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালিয়েছিলি কেন?”
হুরায়রা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারলো না। তার বুকে হাতুরি পেটার শব্দ হচ্ছে। ভয়ে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে ইচ্ছে করলো তার। ইয়াদ খানিকটা সময় ব্যয় করে আবার বলল,
“পালিয়েছিলি কেনো?”
হুরায়রা কিছু বলতে গিয়েও পারলো না গলায় আটকে গেলো কথা। ইয়াদ আরো কিছুটা সময় ব্যয় করে হুরায়রাকে পর্যবেক্ষণ করলো। তারপর বলল,
“সামিরের সাথে বেশ ভাব জমেছে দেখছি। তা ভালো ওটা নিয়ে কিছু বলবো না তার আগে জবাব দে পালিয়েছিলি কেনো?”
সামিরের নাম শুনে যতটুকু কথা বলার ছিলো সেটাও ভুলে গেলো হুরায়রা। সে বুঝতে পারে না ইয়াদ কি করে এতসব জানতে পারে? মাঝে মাঝে ইয়াদকে তার জিন বলে মনে হয় নইলে একটা মানুষ কি করে এত কিছুর খবর রাখতে পারে?
“কি হলো বলছিস না কেনো?”
এবার হুরায়রা অকপটে জবাব দিলো। বলল,
“আমার ইচ্ছা হয়েছে তাই পালিয়েছি। তাতে আপনার কি। জান বাঁচানো ফরজ কাজ। আমি নিজের জান বাঁচিয়েছি আপনি তো আমাকে মেরেই ফেলতে চেয়েছেন।”
ইয়াদ কাঁহাতক সময় হুরায়রার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রইলো। মেয়েটা দিন দিন তার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে সে কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারবে না।
“আপনি আমাকে ধরে এনেছেন কেনো? আর দরজা লাগিয়েছেনই বা কেনো?”
“তোর না খুব প্রেম করার স্বাদ। তাই আজ তোকে প্রেম করার সুযোগ দিবো।”
“মানে?”
“এত মানে তোকে বুঝতে হবে না। আমার খাট থেকে নেমে দাঁড়া। আর ওই যে দেখছিস আলমারি ওখান থেকে মলম এসে আমার মাথাটা টিপে দে।”
হুরায়রার নিজের ভ্রু কুচকে নিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“এটা কোন সভ্য মানুষের কাজ হতে পারে?”
“আমি আবার কখন অসভ্যতা করলাম। এখনো আমার খাটে বসে আছিস যে বলেছি না নেমে যেতে।”
“আপনি সত্যিই অসভ্য একটা লোক। আমি কি নিজে এসে বসেছি আপনার খাটে। আপনি তো আমাকে কোলে করে এনে এখানে ফেলে দিলেন।”
“বেশি কথা বললে আবার কোলে করে যেখান থেকে এনেছি সেখানে রেখে আসবো।”
“ইচ্ছা করছে আপনার মাথা নয় গলা টিপতে।”
“টিপেই দেখ যদি পারিস।
হুরায়রার আর কথা বাড়ালো না ভেংছি কেটে উঠে আলমারি থেকে মলম এনে ইয়াদের মাথায় লাগিয়ে দিলো।

চোখ বুজে হুরায়রার হাতের স্পর্শ অনুভব করছে ইয়াদ। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছা হয় হুরায়রাকে একবার বুকে জড়িয়ে নিতে। তপ্ত বিক্ষিপ্ত হৃদয়টাকে শীতল করতে হুরায়রা নামক মহাষুধ বোধ করি আর দুটো নেই পৃথিবীতে কিন্তু সেই উপায় কি তার আছে? না ভাবতে পারলো না সে। হুরায়রার কথা ভাবতে গেলেই মাথা যন্ত্রণা বেড়ে যায়। নিজের মনকে শান্ত করার আর কোন উপায় খুজে পায় না।

কপাল ছুঁয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই চোখ মেলে তাকায় ইয়াদ। হুরায়রা নীরবে অশ্রু বিসর্জন করছে। হুরায়রা অশ্রুসিক্ত আঁখি দুটি লাল হয়ে উঠেছে। ইয়াদ সেদিকে লক্ষ্য করে শোয়া থেকে উঠে বসলো। কি ভেবে দুই বাহুতে হুরায়রাকে আবদ্ধ করে কপালে তার উষ্ণ অধর যুগল ছুঁইয়ে দিলো। এক মুহূর্তে জন্য হুরায়রা কেঁপে উঠলো। তার সারা দেহ জুড়ে শিহরণ বয়ে যাচ্ছে। কি আশ্চর্য অনুভূতি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না সে লজ্জায় দু কান গরম হয়ে উঠেছে। ইয়াদের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কোনরকম ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো সে।

চলবে,,,।

আজকে থেকে নতুন করে লিখা শুরু করেছি। এতদিন পুরাতন পর্বগুলো এডিট করে কিছু বাদ দিয়েছি কিছু নতুন করে যোগ করেছি। আজকের পর্ব থেকে আপনারা নতুন পর্ব পাচ্ছেন। সবাই রেসপন্স করবেন আশা করছি। ধন্যবাদ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here