দ্যি এল্ডরিচ সিটিজেনস, পর্ব:৬

#দ্যা_এলেমেন্টাল (১)
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া

৬ষ্ঠ পর্ব

পানির অতলে হাঁপাচ্ছে মায়রা। কিছুতেই পানির উপরে মাথা তুলতে পারছে না। হঠাৎ ভয় পেলে যেমন হয়। কিন্তু বেশিক্ষণ এমনটা হলো না। হঠাৎ পানির নিচ থেকেই মায়রা শ্বাস নিতে পারে, যেন সে কোন মাছ। এমনটা হওয়ায় মায়রা বেশ অবাক হয়। সে শান্ত হয়ে স্থির হয়ে থাকে। না, শ্বাস প্রশ্বাসে তার কোন ব্যাঘাত ঘটছে না। সে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত। কিভাবে সম্ভব! পরমুহূর্তে মায়রা তার নিজের মাঝে বিদ্যমান অলৌকিক শক্তির কথা স্মরণ করে। পানিও তো প্রকৃতির একটি অংশ, তবে সেই পানিতে মায়রার ক্ষতি হবে কেন! খানিকটা হাসার চেষ্টা করে মায়রা। শীতল পানির নিচে কিছুক্ষণ স্থির থেকে তার সৌন্দর্য উপভোগ করে মায়রা।
পানির উপরটায় কি আছে তা মায়রা জানে না। সাঁতরে কিছুটা উপরে উঠে পানি থেকে মাথা তুলে বড় এক শ্বাস নেয়। পানিতে ভাসতে ভাসতে আশেপাশে তাকায়। সে বেশ আশ্চর্য হয়। কারণ, যখন নিজ বাড়ি থেকে আয়না জগতে প্রবেশ করে, তখন সময়টা ছিল মাঝরাত। কিন্তু এখানে দুপুর। মাথার উপর সূর্য, যাকে কেন্দ্র করে উড়ছে অদ্ভুত প্রজাতির পাখি। মায়রা তার ডানপাশে তাকালে আরো বেশি অবাক হয়। কেননা, সেখানে তুষারপাত হচ্ছে এবং নির্দিষ্ট অঞ্চল ব্যতীত এক বিন্দু পরিমাণ তুষার কণা অন্য কোথাও সরছে না। বর্তমানে মায়রা যেখানে আছে, আবহাওয়ার উপর ভিত্তি করে অনুমান করে বলা যায় তা গ্রীষ্মকাল। অথচ কিছুটা দূরে শীতকাল। স্থানটির প্রতি মায়রার কৌতুহল বেড়ে যায়।
ভয়ংকর এক শব্দে মায়রা তার মাথার উপরের দিকে তাকায়। কিছুক্ষণ আগে যেই পাখিগুলো উড়ছিল, তা মায়রার দিকে লোভনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দিকে তেড়ে আসছে। যেন ঈগল কোন মাছকে শিকার করতে যাচ্ছে। মায়রা বুঝতে পেরে নিজের জীবন রক্ষার্থে পানির নিচে ডুব দেয়। অদ্ভুত প্রজাতির বিশাল পাখিটি মায়রাকে ধরবে বলে তার পা পানির নিচে ডুবিয়ে দেয়। পায়ের নখের আঘাতে মায়রার হাতের কিছু অংশ কেটে যায়। মায়রার আঘাতপ্রাপ্ত স্থান থেকে রক্ত বের হয়ে তা সমুদ্রের পানিতে মিশে যেতে থাকে।
এমন প্রজাতির পাখি মায়রা প্রকৃতি কন্যা হয়েও দেখেনি। সে জানেও না এমন প্রজাতির পাখি আছে। পাখিটির পুচ্ছপাখনা ময়ূরের পেখমের মতো। পা দুটো গন্ডারের পায়ের মতো মোটা চামড়া এবং মাংসপেশিযুক্ত। সেই পায়ে আবার চার আঙুল এবং চারটি আঙুলের নখ ধারালো অস্ত্রের মতো। পাখিটির অন্যান্য অংশ একটি ড্রাগনের মতো এবং ডানা দুটি বাদুড়ের ডানার মতো।
মায়রা এক হাত দিয়ে নিজের ক্ষতস্থান চেপে ধরে। প্রচন্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। একটা কথা সে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে। এই পাখিগুলো সাধারণ নয়। মায়রাকে অদ্ভুত অঞ্চলে যেতে হলে এই পানির নিচ দিয়েই যেতে হবে। দেরি না করে সাঁতার কেটে সে এগিয়ে যায়।
অদ্ভুত অঞ্চলটির কাছাকাছি এসে মায়রা আর এগোতে পারে না। কোন এক অদৃশ্য দেয়াল তার পথ আটকে দেয়। কিন্তু অদৃশ্য দেয়াল সম্পর্কে মায়রা জানে। তাই তার বেশি কষ্ট হয় না নিজের পথ খুঁজে নিতে। সমুদ্রের একদম তীরে, অদ্ভুত শীতল অঞ্চলটিতে এসে মায়রা পানি থেকে কাশতে কাশতে উঠে বসে। মায়রা কিছুটা ঠান্ডা অনুভব করছে, কারণ সে ভিজে আছে।
একজোড়া হাত এসে মায়রাকে পানি থেকে সম্পূর্ণ ডাঙায় তুলে নেয়৷ মায়রা প্রথমে ভাবে এ বুঝি তার নতুন বিপদ। কিন্তু না, তা হয় না। তার সামনে জলজ্যান্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পানি থেকে উঠে আসতে মায়রার শরীর শুষ্ক হয়ে আসে। শরীরে বা চুলে বিন্দু পরিমাণ পানি অবশিষ্ট আছে বলে মনে হয় না। ছেলেটি মায়রার উদ্দেশ্যে বলে,

“এল্ডরিচ দুনিয়ায় তোমাকে স্বাগতম ৷ অবশ্যই তুমি সাধারণ কেউ নও। এজন্য রক্ষণশীল দেয়াল ভেঙে তুমি এই শহরে প্রবেশ করতে পেরেছ। ”
“তুমি কিভাবে জানলে, আমার মাঝে অলৌকিক শক্তি আছে?” মায়রা ভয়াতুর হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
” ভয় পাওয়ার কিছু নেই, এখানে যারা আছে তারা সবাই অলৌকিক শক্তির অধিকারী। যাক সেসব কথা। আমি অর্ণব এবং তুমি?”
“আমি মায়রা।”
“অর্ণব, কার সাথে কথা বলছিস?” একই চেহারার একটি মেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে।
“অরনি, সে মায়রা। মায়রা, সে আমার বোন অরনি,” অর্ণব পরিচয় করিয়ে বলে।
” কিন্তু মায়রা, তুমি এই অঞ্চলে প্রবেশ করেছ কিভাবে? সমুদ্র পথে ম্যাকিউক তোমায় আক্রমণ করেনি? ” অরনি প্রশ্ন করে।
“ম্যাকিউক? তুমি কি অদ্ভুত প্রজাতির পাখির কথা বলছ?” মায়রা কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ। ম্যাকিউক খুব ভয়ংকর পাখি। তাদের জন্যই এল্ডরিচ শহরে রক্ষণশীল দেয়াল,” অরণি বলল।
“অদৃশ্য দেয়াল আমি নিজে তৈরি করতে পারি। আর ম্যাকিউক আমায় আক্রমণ করেছে। এই হলো তার ফল,” মায়রা তার হাতের ক্ষত দেখিয়ে বলল।
“কোথায়? দেখি। ব্যান্ডেজ করে দিতে সাহায্য করো,” দ্বিতীয় আরেক অরনি এইড বক্স হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে৷ মায়রা এতে ঘাবড়ে যায়। তবুও কিছু বলে না।
দুই অরনি মায়রার হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয়। অতঃপর দুজন মায়রাকে নিয়ে এগিয়ে যায় বিশাল ও সুউচ্চ এক ভবনের দিকে, যা দেখতে রাজপ্রাসাদের মতো। নির্দিষ্ট একটি এলাকা পর্যন্ত সুন্দরভাবে পরিপাটি করে সাজানো, এই এলাকার পরই ঘন জংগল। একপাশে সমুদ্র, যা মায়রা অতিক্রম করে এসেছে। অপরপাশে বড় মাঠ। এছাড়াও বিভিন্ন গাছপালা, প্রশিক্ষণের জন্য বিভিন্ন আসবাবপত্র সুন্দর ভাবে রাখা হয়েছে।
মায়রা অন্যদের দিকে তাকালো। কিন্ত কেউ মায়রার দিকে সেরকম ভাবে তাকায় না, যে যার মতো ব্যস্ত। মায়রাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অর্ণব অরনিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

—”অরনি, মায়রাকে সকল কিছু ঘুরিয়ে দেখিয়ে ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে দে। আর প্রফেসরের সাথে সাক্ষাৎ করার কথা ভুলে বসে থাকিস না। আমি আসছি।”
—” আমি জানি এসব,” অরনি ভেঙচি কেটে বলে।

অর্নব চলে গেলে অরনি মায়রাকে বিশাল ভবনের ভেতর নিয়ে যায়। বাহির থেকে যতটা না সুন্দর, ভেতর থেকে আরো বেশি সুন্দর। হলরুমের মাঝ একটি সিড়ি উপরের দিকে পথ করে উঠে গিয়েছে। একেক কক্ষের সামনে গিয়ে সিড়িগুলো শেষ হয়েছে। যেন এটি কোন এক গাছ এবং তার প্রতিটি শাখাপ্রশাখায় একটি করে ঘর। আর এই শাখাপ্রশাখাই একমাত্র রাস্তা এসব ঘরে প্রবেশের।
অরনি মায়রাকে নিয়ে সিড়ি বেয়ে কিছুটা উপরে উঠে। নির্দিষ্ট একটি সিড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। সিড়িটি একাই সরে যায় এবং একটি কক্ষের সামনে গিয়ে থেমে যায়। মায়রা অরণিকে অনুসরণ করে সিড়ি বেয়ে সেই কক্ষে যায়। একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা কক্ষটিতে আছেন। দরজায় কড়া নেড়ে অরণি বলে,
“প্রফেসর, ভেতরে আসতে পারি?”
“অবশ্যই, অরণি,” পুরুষ কন্ঠে ভেতর থেকে বাক্যটি শুনা যায়।
অরণি মায়রাকে ইশারা করে আগে আগে প্রবেশ করে। অরণির পেছন পেছন মায়রা নিজেও প্রবেশ করে। অরণি কিছু বলার আগে প্রফেসর ডেভিড অর্থাৎ পুরুষ প্রফেসর বলে,
“স্বাগতম, মায়রা। এতদিন তোমাদের অপেক্ষায় ছিলাম। তোমাদের আগমন মানে বাকিরাও ধীরে ধীরে চলে আসবে এবং আমরা আমাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ করতে পারব।”
মায়রা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে,
“তোমাদের মানে? এখানে তো একমাত্র আমি এসেছি। আর কিসের মিশন?”
“ধীরে ধীরে সবটা জানা ভালো। তোমাদের বলতে আরো একজন এসেছে। আমি প্রফেসর জুলিয়া,” মহিলাটি হাসিমুখে বলল।
“অরণি তোমায় সব জানতে বুঝতে সহায়তা করবে। অরণি, মায়রাকে সাথে নিয়ে ক্লাসে যাও,” প্রফেসর ডেভিড অরণিকে আদেশ করে।
অরণি আদেশ মেনে মায়রাকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। কক্ষটির সামনে অর্ণব দাঁড়িয়ে ছিল। অরণি ও মায়রা বেরিয়ে আসতে সে বলে,
“শ্রেণি কক্ষে যেতে বলেছে?”
“না, তোকে মর্গে পাঠাতে বলেছে,” অরণি বলল।
মায়রা দুই ভাইবোনের কথায় হেসে জিজ্ঞাসা করে, “তো তোমরা যমজ? তাহলে কি তোমাদের শক্তিও এক?”
“না, আমাদের পাওয়ার এক নয়,” অর্ণব বলে।
“তাহলে?” মায়রা অরনবের দিকে তাকিয়ে বলে।
“দেখো তো মায়রা, আমাকে স্পর্শ করতে পারো কি না?” পাশ থেকে অরনি বলে উঠে।

অরনির কথায় মায়রা অরনির দিকে তাকায় এবং তাকে স্পর্শ করার জন্য চেষ্টা করে। কিন্তু সে পারে না। যতবার অরনির কাঁধে হাত রাখার চেষ্টা করে, ততোবারই তার হাত অরনিকে ভেদ চলে যাচ্ছে। হঠাৎ পেছন থেকে কারো স্পর্শ পেয়ে মায়রা পেছনে ঘুরে অবাক হয়ে যায়। অরনি তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মায়রা সামনে তাকালে দ্বিতীয় অরনি হেসে মায়ারাকে হাত দিয়ে হাই দিচ্ছে।

“এটাই হচ্ছে আমার পাওয়ার, মায়রা। একাধিক প্রতিচ্ছবি তৈরি করা এবং অন্যদের মাঝে ভয় বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা। ‘ড্যেজা ভো’ শুনেছ কখনও? আমার শক্তিটাই ‘ড্যেজা ভো’ ,” অরনি বলল।
“বাহ! এটা তো অনেকটা ভৌতিক,” মায়রার কথায় বুঝা যায় সে অরনির শক্তি বেশ পছন্দ করেছে। ” আচ্ছা, অরনব, তোমার শক্তি কি?”
“আমার শক্তি? অপেক্ষা করো। ওই ডেরিয়ান।” অর্ণব নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে ডাকে।
“ডেকেছিস?” ছেলেটি উত্তরে বলে।
“তোর হাতে কিরে?” অর্ণবের দ্বিতীয় প্রশ্ন।
“কোক, কেন?”

অর্ণব বাকি কিছু না বলে ডেরিয়ানের হাতে থাকা টিনের কৌটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কৌটাটি আপনা-আপনি খুলে গিয়ে তার ভেতরে থাকা পানীয় হাওয়ায় উড়ে উড়ে অর্ণবের দিকে এগোতে থাকে, যেন একদল পিঁপড়া সারিবদ্ধভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।

“অর্ণব, তোর মজা থামা, ” ডেরিয়ান নীচ থেকে বলতে থাকে।

পিঁপড়ার মতো লাইন ধরে আসা পানিয় হঠাৎ বরফ হয়ে থেমে যায়। আবার ধীরে ধীরে বাষ্প হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
নীচে দাঁড়িয়ে থাকা ডেরিয়ান রেগে সেখান থেকে চলে যায়। অর্ণব হেসে মায়রার দিকে তাকায় আর বলে,

“এটাই ছিল আমার শক্তি। পানি নিয়ন্ত্রণ করা।”
“বেশ দারুণ তো!” মায়রা বলে।
“কি হচ্ছে কি এখানে? ”

গম্ভীর কণ্ঠের কথাটা শুনে মায়রা,অরনি এবং অর্ণব তিনজনই সামনে তাকায়।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here