দ্যি এল্ডরিচ সিটিজেনস, পর্ব:৫

#দ্যা_এলেমেন্টাল (১)
#লেখনীতে_মাহমুদা_মায়া
(কাহিনি যুক্তকরণ)
৫ম পর্ব

বাড়িতে ফেরার পর রিহান, নিশি এবং মায়রা একত্রে খাওয়া-দাওয়া করে নেয়।
প্রতিদিন স্কুল, স্কুলের পর বাড়ি ফেরা, বিকেলে পশুপাখির যত্ন নেওয়া এবং রাতের বেলা পড়ালেখা করা এসবের ভেতর দিয়েই মায়রার দিন কাটতে থাকে। একই সাথে সে বড়ও হতে থাকে।দেখতে দেখতে স্কুল জীবন পেরিয়ে সে কলেজ জীবনেও পা রাখে। এর মাঝে বহু বাধা বিপত্তি এসেছে, কিন্তু সে সব কিছু উপেক্ষা করে এগিয়ে গিয়েছে সামনের দিকে।

১৪ বছর পর,

এক্স গবেষণাগার,

“এতদিনে মেয়েটি নিশ্চয়ই আরো বড় হয়েছে। সেই সাথে তার শক্তিও বৃদ্ধি পেয়েছে,” মোটা ফ্রেমের চশমা পরিহিত একজন কাঁচ বক্সে থাকা টিকটিকি দিয়ে কিছু পরীক্ষা করতে করতে বলল।
“তা তো বটেই। কিন্তু কিভাবে মেয়েটিকে বন্দি করব?”
মায়রার সাথে তর্ক করা সেই পুলিশ অফিসার লোকটির পেছনে দাঁড়িয়ে বলল।
“তুমি আইনের লোক। তুমি ভালো জানো কিভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে,” লোকটি একধরনের বর্ণহীন তরল সেই বাক্সের টিকটিকির শরীরে প্রবেশ করিয়ে বললেন।
“জ্বি, বুঝতে পেরেছি। আসছি আমি,” অফিসার সেখান থেকে চলে যায়।
টিকটিকিটির দেহ অদ্ভুতভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। সাইজে কিছুটা বড় হয়ে দেহের রঙ পরিবর্তন করে এবং কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করে। টিকটিকির গলার অংশ পরিবর্তন হয়। জিরাফের মতো লম্বা হয় তার গলা এবং তা ডাইনোসরের মুখের আকৃতি ধারণ করে, সামনের পা দুটো ছোট হয়ে যায় এবং পেছনের পা দুটোতে ভর করে দাঁড়ায়। গিরগিটির আকারের এক অদ্ভুত ডাইনোসর। লোকটি টিকটিকিকে এক অদ্ভুত প্রাণীর রূপ দেয়। যখন সে তার কাজে সফল হয় তখন সে পৈশাচিকভাবে হাসে।

মায়রা এবং রুহান এখনও একত্রে কলেজে যাতায়াত করে। একদিন, কলেজ ছুটির পর দুজনই দুষ্টুমি করতে করতে একটি জংগলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল। রুহানকে দেখতে এখন অনেক বেশি হ্যান্ডসাম এবং কিউট দেখায়।

“মায়রা, তাড়াতাড়ি চল না, এই জংগলের রাস্তাটুকু আমার খুব ভয় করে,” রুহান ভীত হয়ে মায়রাকে তাড়া দিয়ে বলল।
“প্রতিদিন বলিস ভয় করে, কিন্তু কেন?” মায়রা কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“জংগলে বাঘ-ভাল্কুক থাকে, জানিসই তো,” ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে চারদিকে তাকিয়ে রুহান উত্তর দেয়।
“তুই বাঘ-ভাল্লুককে ভয় পাস? তাও আমার পাশে থেকে?” কথাটা বলেই মায়রা হাসতে থাকে।
“দেখ মায়রা, মানলাম তোর কাছে কিছু সুপারন্যাচারাল পাওয়ার আছে। কিন্তু আমি? আমি তো একটা মানুষমাত্র। আমাকে তো আর ছেড়ে দেবে না,” রুহান কিছুটা রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে।
“ধ্যাত, ভীতুর ডিম। অযথা ভয় পাস না তো। আমি আছি, কিছু হবে না। উপরে দেখ। ”

মায়রার কথামতো রুহান উপরের দিকে তাকায় এবং একটি বানর রুহানের মুখে লাল বর্ণের টমেটোর মতোই জংলী ফল নিক্ষেপ করে। রুহান সম্পূর্ণ চেহারা লাল বর্ণ ধারণ করে। কপাল কুঁচকে, নাক মুখ খিঁচে রুহান মায়রার দিকে তাকায়। মায়রা হাসতে হাসতে সেখানেই বসে পরে। আর বানরটিও মায়রার পাশে এসে বসে এমন শব্দ করে, যেন সেও হাসছে।

“কাজটা ভালো করলি না,মায়রা, ” রুহান পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছতে মুছতে বলে।

মায়রা কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই একদল বখাটে ছেলে হৈ-হল্লা করতে করতে তাদের জীপ নিয়ে মায়রা এবং রুহানের সামনে দাঁড় করায় এবং জীপ থেকে নেমে যায়। মায়রা বসা থেকে উঠে এবং রুহানের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বখাটে ছেলেগুলোর মাঝ থেকে একজন চুইংগাম চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এসে বলে,

“এই মালটাকে দেখ। সম্পূর্ণ আবেদনময়ী। আজকে তো হেব্বি মজা হবে, যুবকেরা। ”

কথাটা বলা মাত্রই ছেলেটি সহ তার সাথীরাও বিশ্রি এক হাসি দেয় এবং মায়রার দিকে খারাপ নজরে তাকায়। মায়রা কিছু না বলে তার ডান হাত সুন্দর মতো পেতে রাখে, যেন কিছু একটা তার হাতের নীচে এসেই মাথা দিবে আদর করে দেওয়ার জন্য। মায়রা ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলে,

“মজা করতে চাও? ভেবে বলেছ? আমি কিন্তু প্রস্তুত। ”
“ওয়াহ! মেঘ না চাইতেই জল! তাহলে অপেক্ষা কেন করাচ্ছ। জীপে চড়ে বসো, সাথে তোমার প্রেমিককেও নিয়ে আসো,” বখাটে ছেলেটি লোভনীয় দৃষ্টি নিয়ে মায়রাকে পা থেকে মাথা অব্দি পর্যবেক্ষণ করে বলে।
—”একটু অপেক্ষা করো। আরো একজন, মাত্র একজন আসুক। তারপর একত্রে যাওয়া হবে।”

মায়রার কাজকর্ম কিছুই রুহান বুঝে উঠতে পারছে না। কথাটা শুনামাত্রই বখাটে ছেলেটি হেসে বাদবাকিদের দিকে তাকায়। তারাও হাসতে হাসতে থেমে যায়। একেকজনের চেহারায় ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তারা এতোটায় ভয়ে আছে যে, কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে এবং তুতলাচ্ছে। কিন্তু তাদের মুখনিঃসৃত শব্দগুলো অর্থহীন।

“কি হয়েছে? তোরা এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? এই সামান্য মে,,মে,,মে,,,মে, ”

বখাটে ছেলেটি “সামান্য” বলে সামনে তাকায় এবং মায়রার ডান হাতের দিকে তাকিয়েই আর কিছু বলতে পারে না, শুধু তোতলাতে থাকে।
মায়রার ডান হাতের নীচে একটি বাঘ দাঁড়িয়ে আছে এবং বখাটে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আছে, যেন সে মায়রার অনুমতির অপেক্ষায় আছে। অনুমতি পাওয়ামাত্রই শিকার করবে। ছেলেগুলোর এমন অবস্থা দেখে মায়রা তার হাতের নীচের বাঘ নিয়ে এগিয়ে যায় আর বলে,

“কি হলো, তোতলাচ্ছ কেন? চলো, মজা করবে না? আমার আরেকজন সাথী তো চলেই এসেছে।”

মায়রাকে এগোতে দেখে ছেলেটি পিছিয়ে যায় এবং পরেও যায়। তার সাথের বাকি ছেলেগুলো জীপে উঠে জীপ স্টার্ট দিয়ে দেয়। এটা দেখে পরে যাওয়া ছেলেটি হুড়মুড়িয়ে উঠে জীপের পেছন পেছন দৌড়ায়। ছেলেটিকে দৌড় দিতে দেখে মায়রার সাথে থাকা বাঘটি জোরে ডেকে উঠে। এতে ছেলেটির দৌড়ের গতিও বেড়ে যায়।
এই কান্ড দেখে রুহান এবং মায়রা দুজনেই হেসে উঠে। মায়রা বাঘটিকে কিছুক্ষণ আদর করে দিলে, সে আবার জংগলে হারিয়ে যায়।

“তোর ভয় ভেঙেছে?” মায়রা রুহানের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে।
“হুম, আর ভয় করবে না। তবে ওদের অবস্থা দেখে খুব হাসি পাচ্ছে।”
“চল এখন।”
কথা বলতে বলতেই মায়রা এবং রুহান বাড়িতে ফিরে যায়।
বাড়ির ভেতর প্রবেশ করা মাত্রই নিশি মায়রাকে জড়িয়ে ধরতে আসে। কিন্তু মায়রা হাত উঠিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় আর বলতে থাকে,
“মা, তোমায় কতোবার বলেছি? বাহির থেকে ফেরার পর ফ্রেশ না হওয়া পর্যন্ত আমায় স্পেশাল করবে না। জীবাণু লাগতে পারে তো।”
“প্রকৃতি কন্যার আবার কিসের জীবাণু-রে?” নিশি প্রশ্ন করলেন।
“মা!” মায়রা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকায়।
“আচ্ছা, বাবা। সরি, আর বলবো না।”
“ক্ষিধে পেয়েছে। খাবার দাও, আমি ফ্রেশ হয়ে ফিরছি,” মায়রা কথাটা বলতে বলতে নিজ কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়।
নিশি মায়রার খাবার প্রস্তুত করতে থাকে। রিহানের পিতামাতার মৃত্যু ঘটেছে আরো ১০ বছর পূর্বেই। এরপর থেকে তারা তিনজন এই বাড়িটিতে থাকছে। ইদানীং রিহানের শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। বয়স তো আর কম হলো না।
ফ্রেশ হয়ে মায়রা খাবার খেতে আসে। মা-মেয়ে বেশ গল্পগুজব করে। প্রাত্যহিক নিয়মে আজও তার দিন অতিবাহিত হয়।

কোন এক অচিন জায়গা। মায়রা এই জায়গায় কখনও আসেনি। সব কিছু তার কাছে নতুন। অন্ধকারের মাঝে রক্তিম আলো। গা হিম করা এক স্থান। কিন্তু মায়রা এমনভাবে প্রস্তুত হয়ে আছে, যেন সে যুদ্ধ করছে। সামনে তার বিশাল ও ভয়ংকর এক দৈত্য। এই দৈত্যের সাথেই লড়াই করছে মায়রা। একই স্থানে দুই মায়রা। এক মায়রা যুদ্ধ করছে, আরেক মায়রা সবটা দেখছে। হঠাৎ, যুদ্ধা মায়রা দাঁড়িয়ে থাকা মায়রার দিকে ছুটে আসে। মায়রা কিছুটা ভীত হয়, কিন্তু যে স্থানে দাঁড়িয়েছিল সেথায় দাঁড়িয়ে থাকে। সে এক চুল পরিমাণও নড়তে পারছে না। যুদ্ধা মায়রার পেছনে ছুটছে বিশাল দৈত্যটি। দ্বিতীয় অর্থাৎ যুদ্ধা মায়রা ছুটে এসে দাঁড়িয়ে থাকা মায়রার শরীরে প্রবেশ করে বা তার মাঝে মিশে যায়। বিশাল ও ভয়ংকর দৈত্যটি মায়রাকে মারার জন্য হাত উঠালে বিপরীত পাশ থেকে অপরিচিত এক যুবক চিৎকার করে বলে,

“মায়রা, সরে যাও।”

কিন্তু মায়রা সরতে পারে নি। দৈত্যটির অস্ত্র মায়রার ত্বকের একদম নিকটে চলে আসে। অস্ত্রটি স্পর্শ করার মুহূর্তে মায়রা সব কিছু অন্ধকার অনুভব করে।
হুড়মুড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে মায়রা। তার সমস্ত শরীর ঘেমে একাকার। হাঁপাচ্ছে মায়রা। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারে সে তার নিজ কক্ষেই আছে। এরমানে সে এতোক্ষণ দুঃস্বপ্ন দেখছিল।
টেবিলের পাশে হাতড়িয়ে সুইচ অন করে সম্পূর্ণ কক্ষকে আলোকিত করে মায়রা। ক্লান্ত শরীর নিয়ে এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের দিকে। চোখেমুখে বেশ কিছুক্ষণ পানির ছিটা দেয়। মায়রা যতো পানি স্পর্শ করছে, ততোই যেন তার পানি স্পর্শ করার ইচ্ছাটা বেড়ে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে, তা মায়রার অজানা।
এমন গভীর রাতে বাড়ির আশেপাশে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনে বেশ আৎকে উঠে মায়রা। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে নিজ কক্ষে যায়। নিশি ছুটে আসে মায়রার দিকে। সে হন্তদন্ত হয়ে বলে,

“মা, মায়রা। তুই পালিয়ে যা, মা। তোর অলৌকিক শক্তি প্রয়োগ করে তুই কোথাও পালিয়ে যা।”
“কিন্তু কেন, মা? কি হয়েছে? আর এতো পুলিশ’ই বা কি করছে?” মায়রা কোন কিছু না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসা করল।
“পুলিশ ও কিছু গবেষকেরা এসেছে। তোকে নিয়ে যেতে এসেছে। তোকে নিয়ে না-কি কি পরীক্ষা করবে। মা, তুই পালিয়ে যা। ওরা তোকে মেরে ফেলবে।”
“মা, এমন কিছু হবে না।”
মায়রা তার মা’কে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা করে। তার চেষ্টাকে আরো বৃথা করে দেয় উচ্চশব্দে পুলিশের বলা কথাগুলো। একজন অফিসার মাইকের সাহায্যে বলে,
“মিস্টার এবং মিসেস নিগাম। আপনাদের জাদুকরী কন্যাকে আমাদের হাতে হস্তান্তর করুন। পালানোর কোন পথ নেই। আমরা চারদিক থেকে আপনাদের বাড়িটি ঘিরে রেখেছি।”

মায়রার মা অর্থাৎ নিশি আরো বিচলিত হয়ে পরেন। সে মায়রার হাত তার মাথায় রেখে কসম দিয়ে বলে,
“তোকে আমার দিব্যি। তুই এখন এই মুহুর্তে পালিয়ে যাবি।”
“মা, এসব,,,” মায়রাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে রিহাব এসে বলে,
“আমি কিছু শুনতে চাচ্ছি না। তুই এখন, এই মুহুর্তে নিজের শক্তি ব্যবহার করে পালিয়ে যাবি।”
নিশিকে কিছু বুঝিয়ে রিহান বাহিরে পুলিশের মুখোমুখি হওয়ার জন্য চলে যায়। মায়রা নিজের কক্ষে একা পরে থাকে। কি করবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ওয়াশরুমে চলে যায়৷ ওয়াশরুমের দেয়ালে আটকে রাখা আয়নার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলে। কিন্তু পরমুহূর্তে সে চঞ্চল দৃষ্টিতে পুনরায় তাকায়। কিছুক্ষণ আগে যেই মায়রাকে স্বপ্নে লড়াই করতে দেখেছিল, ঠিক সেই মায়রা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আয়নার বিপরীতে। এই মায়রার ঠোঁটে হাসি, পরনের জামাও ভিন্ন। মায়রা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। আয়নার বিপরীতে থাকা মায়রা হাতের এক আঙুল দিয়ে আয়না স্পর্শ করে এবং চিন্তিত মায়রাকে ইশারা করে একই কাজ করতে। কোন কিছু না ভেবে মায়রাও একই কাজ করে। ঘূর্ণিপাকের মতো করে আয়নাটি স্বচ্ছ অংশ ঘুরছে। যেন এটা এক সমুদ্র, আয়না নয়। মায়রা তার হাত সরিয়ে নিতে অক্ষম। এই ঘূর্ণিপাক মায়রাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায়। কোন এক অচিন দেশের অচিন সমুদ্রের অতলে মায়রাকে ফেলে দেয়। এতো এতো দুশ্চিন্তার মাঝে মায়রা নিজের শক্তির ব্যবহার প্রায় ভুলে গিয়েছে। মায়রার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার মনে হচ্ছে এই বুঝি তার জীবনের শেষ।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here