দ্যি এল্ডরিচ সিটিজেনস, পর্ব:১

‘দ্যি এল্ডরিচ সিটিজেনস’
১ম অধ্যায়: দ্যা এলেমেন্টাল
লেখনীতে: মাহমুদা
|১|

জংগলের ভেতর থেকে খুব মিষ্টি সুরের গান ভেসে আসছে। গানের সাথে সাথে মৃদু ঠান্ডা বাতাস আর মিষ্টি ফুলের সৌরভ। জংগলটাকে সবাই ভয়ংকর জংগল বলে জানে। যার জন্য কেউ এই জংগলের গাছপালা কাটতে, বা পশু-পাখি শিকার করতে আসে না। যার ফলাফল, জংগলটা এখনও আগের মতোই সবুজ এবং এর সৌন্দর্য আগের মতোই বিদ্যমান।
এক বয়স্ক দম্পত্তি জংগলের পাশ দিয়ে গাড়ি করে বাড়ি ফিরছিল। পুরুষটির নাম রিহান নিগাম, আর মহিলার নাম নিশি নিগাম। এরা নিগাম পরিবারের সদস্য। নিঃসন্তান দম্পত্তি জংগলের পাশের সমুদ্র তীরে যায় সমুদ্র বিলাসের জন্য। বাড়ির দিকে ফেরার সময় মিষ্টি কন্ঠে গান শুনতে পায়।
“রিহান, গাড়ি থামাও,” নিশি হঠাৎ অস্থির হয়ে বলল।
” কি হয়েছে?” নিশির অস্থিরতায় চিন্তিত রিহানের প্রশ্ন।
“হুসস,” নিশি ঠোঁটের কাছে আংগুল নিয়ে রিহানকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করে।
নিশির কথায় রিহান চুপ হয়ে যায়, নিশির সাথে রিহানও মেয়েলি কন্ঠের সেই মুগ্ধকর গান শুনতে পায়। রিহান নিশির দিকে তাকায়। নিশি রিহানকে ইশারা করে গাড়ি থেকে নামতে এবং নিজেও নেমে যায়।
“নিশি, যেও না। এই জংগল ভয়ংকর,” রিহান চেঁচিয়ে বলে নিশিকে থামানোর বৃথা চেষ্টা করে।
“তাহলে গান ভেসে আসছে কিভাবে, রিহান?তাও মনুষ্য কন্ঠে, ” নিশি রিহানের কথাকে উপেক্ষা করে চলতে লাগল।
“অশরীরী হতে পারে।ফিরে এসো।”
“হাসালে আমায়, আমি যাচ্ছি গানের উৎস খুজতে, ” নিশি কথাটা বলেই জংগলের ভেতরে পা বাড়ায়।
রিহান কোন উপায় না পেয়ে গাড়ি থেকে নেমে নিশির সাথে যায়। নিজের স্ত্রীকে বড্ড বেশি ভালোবাসে। তাই সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিয়ে করে নি।অনেকবার অনেক অনাথ আশ্রমে গিয়ে একটা ছোট বাচ্চা এডপ্ট করতে চেয়েছিল।কিন্ত নিশি তা করতে দেয় নি। সে বলেছিল,
” যেহেতু সৃষ্টিকর্তা তাদের নিঃসন্তান রেখেছে, যদি তাদের শূন্য কোল ভরিয়ে দেওয়ার ইচ্ছা হয়, তবে সন্তান তিনিই দিবেন।”
তাই রিহানও আর কখনো কিছু বলে নি। তবুও তার ভেতরে একটা চাপা কষ্ট থেকে যায়, যা কখনো কাউকে বুঝতে দেয় নি।
নিশি আর রিহান জংগলের অনেকটাই গভীরে চলে যায়। উভয়েই এক বিরাট গাছের নীচের এক ছোট, ফুটফুটে, খুব মায়াবী মেয়েকে বসে থাকতে দেখে,যে গানটা গাইছে। যার পরনে সাদা রঙের লম্বা পোশাক, মাথায় ফুলের তৈরি মুকুট। সেই ফুলগুলো দেখে মনে হচ্ছে কোন গাছের ফুটন্ত ফুল, প্রজাপতি ব্যস্ত তার মধু সংগ্রহ করতে। মেয়েটার এক পাশে খরগোশ, একপাশে ক্যাংগারু সহ অনেক রকমের পশু-পাখি বসে তার গান শুনছিল।
মি. এবং মিসেস রিহানের উপস্থিতি বুঝতে পেরে পশুপাখিগুলো পালিয়ে যায়। এতে সেই ছোট মেয়েটি বিরক্তিকরভাবে তাদের দিকে তাকায়।
“কে তোমরা? এই জংগলে এসেছ কেন? জানো না, এটা ভয়ংকর জংগল?”মেয়েটি শান্ত কিন্তু কঠোর কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে।
“সেই একই প্রশ্ন তো তোমাকে করতে ইচ্ছে হচ্ছে, মামণি।তুমি এই জংগলে একা কি করছ? তাও পশুপাখিদের সাথে?” নিশি মেয়েটির সামনে বসে বলে।
“তুমি আমায় মামণি বলেছ?” মেয়েটি মুহুর্তে ফুলের মতো কোমল কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে।
“হুম তো, বলেছি। ” নিশি কিছুটা হেসে বলে।
” আমি তোমায় মা বলি?”
ছোট মেয়েটির কথা শুনে নিশির চোখ ছলছল করে উঠে। মুখে হাসি ফুটিয়ে রিহানের দিকে তাকায়। রিহান অবাক হয়ে নিশি আর মেয়েটির দিকে তাকায়। রিহানও মেয়েটির সামনে বসে, আর তাকে প্রশ্ন করে,
“তোমার নাম কি,মামণি?”
“আমাকে তো আমার বন্ধুরা “মায়রা” বলে ডাকে,” উত্তরে মেয়েটি বলে।
“তোমার বাড়ি কোথায়?” নিশি মায়রার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে।
“এই জংগলই তো আমার বাড়ি,” মায়রা বলল।
“তাহলে বন্ধু?” নিশি কিছুটা কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করে।
“এই জংগলের সবাই আমার বন্ধু,” মায়রা হেসে বলে।
রিহান আর নিশি অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকায়। নিশি প্রশ্ন করে,
” মায়রা, আমরা কিন্তু মজা করে প্রশ্ন করি নি।”
“আমিও তো মজা করে উত্তর দেই নি,” মায়রা কিছুটা হতবাক হয়েই বলে।
“তাহলে তুমি পশুপাখির ভাষা বুঝো কিভাবে?” নিশির দ্বিতীয় প্রশ্ন।
“সে-কী! পশুপাখির সাথে ভালোভাবে মিশলে তুমি ঠিক ওদের বুঝতে পারবে,” মায়রা প্রথমে অবাক হলেও, পরবর্তীতে শান্তভাবেই উত্তর দেয়।
রিহান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে,
“যাবে আমাদের সাথে?”
“কোথায়?” মায়রা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে।
“আমাদের বাড়িতে, আমাকে না ‘মা’ বলবে তুমি? তাহলে মায়ের সাথে থাকবে না?” নিশি মায়রার দুহাত ধরে প্রশ্ন করে। চোখে তার অনেক আশা। মায়রার উত্তরে হয়তো আশারা আলো খুঁজে পাবে, নয়তো নিরাশ হবে।
“মা? মায়ের ভালোবাসা কেমন হয়? আমি আমার মা-কে কখনও দেখি নি। আমার বন্ধুরা বলে, সে নাকি দূর আকাশে চলে গিয়েছে,” মায়রা ছলছল নয়নে বলে।
“তো কি হয়েছে? সৃষ্টিকর্তা আমাদের পাঠিয়েছেন তো। তোমাকে অনেক আদর করব, যেমনটা তোমার বন্ধুদের তার বাবা-মা করে। এই পিংকি প্রমিস করছি, ” রিহান মায়রার ছোট কানি আংগুলের মাঝে নিজের আংগুল ক্রস করে বলে।
“কিন্তু,আমার বন্ধুরা?” মায়রা একবার পেছনে ঘুরে তাকিয়ে বলে।
“প্রতি সপ্তাহে আমরা তোমাকে নিয়ে আসব,প্রমিস,” নিশি বলে।
“সপ্তাহ কি?” মায়রা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করে।
“৭ দিনকে এক সপ্তাহ বলে,” রিহান স্বাভাবিক হয়েই উত্তর দেয়।
মায়রা কিছু না বলে রিহান আর নিশি দুজনেরই দিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কয়েক সেকেন্ড পর মায়রা বলে,
“আমি যাব তোমাদের সাথে।”
মায়রার কথায় রিহান আর নিশি বেশ খুশি হয়। রিহান মায়রাকে কোলে নিয়ে জংগল থেকে বেরিয়ে আসে। তবে নিশি মনে মনে ভাবতে থাকে,
“মেয়েটার বয়স বড়জোর আট কি নয় হবে। এতো সুন্দর করে গান গাওয়া,কথা বলা এসব কিভাবে পারে?! আর একা এই জংগলেই-বা ছিল কিভাবে?”
“নিশি,পিছনে কেন? গাড়িতে উঠ,” রিহান কথাগুলো বলে মায়রাকে ব্যাক সিটে বসিয়ে দেয়। মায়রা অবাক হয়ে পুরো গাড়িতে চোখ বুলায়। নিশি আর রিহানও গাড়িতে উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
“এটা কি?” মায়রা গাড়িকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞাসা করে।
“এটা হলো গাড়ি। আর এই গাড়ি করেই আমরা এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে পারি।”
নিশি কথাটা বলে মায়রার দিকে তাকায়। মায়রার চোখগুলো দেখে মুগ্ধ হওয়ার পাশাপাশি কিছুটা চিন্তিত ও হতবাক হয়। কারণ মায়রার চোখগুলো খুবই অনন্য ছিল। চোখগুলো রংধনুর মতো হরেক রং মিলিয়ে একের পর এক গোলাকার হয়ে লেন্সকে ফুটিয়ে তুলেছে। চোখের পাপড়িগুলোও অস্বাভাবিকভাবে ঘন। ঠোঁটের শেপ থেকে শুরু করে মাথার চুল সবদিক দিয়েই অনন্য মায়রা। এরকম কারো হয় বলে মনে হয় না
“মা, কি দেখছ আমার দিকে তাকিয়ে?”
মায়রার কথায় নিশির ঘোর কাটে। চোখের পলক ফেলে মায়রার দিকে তাকাতেই আরো অবাক হয়ে যায়। চোখের রং একদম স্বাভাবিক, আর তা সবুজ রঙের। নিশি এবার একটু বেশি চিন্তিত হয়। তবুও নিজেকে সামলিয়ে বলে,
“তোমাকেই দেখছিলাম, মামণি। বাড়ির সবাই তোমায় দেখে ভীষণ খুশি হবে। তোমাকে খুব ভালোবাসবে।”
মায়রা “ভালোবাসবে” কথাটা শুনে খুব খুশি হয় আর খুব মিষ্টি করে একটা হাসি দেয়। বাড়ি ফেরার পথে রিহান একটা শপিংমলের সামনে এসে গাড়ি থামায়। মায়রা গাড়ির জানালা দিয়ে শপিংমলটা উপরের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে।রিহান মায়রাকে গাড়ি থেকে নামালে সে প্রশ্ন করে,
“এটা কি, বাবা?”
❝একে শপিংমল বলে, সকল প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে পাওয়া যায়,❞ রিহান মায়রাকে নামিয়ে দিয়ে বলে।
” আমরা এখানে এসেছি কেন? তোমাদের কি কিছুর প্রয়োজন?” মায়রা আবার প্রশ্ন করে।
“তোমার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে,” নিশি বের হয়ে উত্তর দেয়।
” কিন্তু আমার তো কোন কিছুর প্রয়োজন নেই,” মায়রা বলল।
“অবশ্যই প্রয়োজন আছে। বাড়ি ফিরে সব বলব, এখন এসব কথা নয়, কেমন? এখন চলো।”
রিহান মায়রার হাত ধরে আগে আগে যায়। আর নিশি কিছুটা পেছনে। নিশি মায়রার মাথার ফুলের মুকুট লক্ষ্য করে তার ফুলগুলোকে আগের মতোই সতেজ দেখতে পায়। এতোক্ষণে ফুলগুলো কিছুটা টলে যাওয়ার কথা, কিন্তু তা হয় নি।
শপিংমলের ভেতর প্রবেশ করে প্রথমেই মায়রার জন্য জামা-কাপড় কিনতে যায়।
” মায়রা, দেখো তো, কোন জামাটা তোমার ভালো লাগে?” নিশি হেসে জিজ্ঞাসা করে।
নিশির কথায় মায়রা আশেপাশে ভালোমতো তাকিয়ে দেখে আর বলে,
“আমি কি নিজে পছন্দ করব?”
“হুম, করো,” রিহান অনুমতি দিয়ে বলে।
মায়রা কিছুটা সামনে এগিয়ে গিয়ে কয়েকটা জামা পছন্দ করে। রিহান সেগুলো হাতে নেয় দেখার জন্য। আশ্চর্যকর ব্যাপার হলো, একটা জামাও প্রাকৃতিক কারুকার্য ব্যতীত নয়। সবগুলোতেই লতাপাতা বা পাখি, প্রজাপতির চিত্র। ছোট বাচ্চার এমন পছন্দ দেখে নিশি এবং রিহান দুজনেই অবাক। জামাকাপড় কেনা হলে মায়রাকে নিয়ে খেলনার দোকানে যায়। সেখানেও এক অবস্থা, বিভিন্ন ধরনের পশুপাখির খেলনা পছন্দ করে। রিহান বড় একটা বার্বি দেখিয়ে বলে,
“মামণি, দেখো তো এটা পছন্দ হয় কিনা?”
“না, ওটা সুন্দর না। ”
এমন উত্তর-ই আশা করেছিল রিহান৷ কিন্তু উপস্থিত বাকিরা মায়রার দিকে কেমন আড়চোখে তাকায়। মায়রার আচরণ এমন দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতোই। মায়রার পছন্দমতো সব কিছু কেনাকাটা করে, রিহান, নিশি ও মায়রা বাড়ি ফিরে। বাড়িতে রিহানের বাবা-মা আর তারা স্বামী স্ত্রীই থাকে। ছোট মায়রাকে দেখে রিহানের বাবা-মা খুশিতে আপ্লূত হয়ে বলে,
” কে এই ছোট পরী?”
“বাবা, এই তোমাদের নাতনি,” রিহান শপিং ব্যাগগুলো একটি চেয়ারের উপর রেখে বলে।
রিহানের কথায় রিহানের বাবা তার দিকে তাকায়। রিহান চোখের পলক ফেলে বুঝায় যে সত্যি। রিহানের বাবা ছোট মায়রাকে হাতের ইশারায় ডাকে। মায়রাও সুন্দর মতো তার কাছে যায়।
“বাহ! আমার দাদুভাই এতোদিন পর আনার কাছে এসেছে?”
“দাদুভাই, আমি মায়রা,” মায়রার উত্তর।
ছোট বাচ্চাকে কিছু শিখিয়ে দিতে হয় না দেখে রিহানের বাবা-মা দুজনই অবাক হয়ে যায়। নিজের বাবা-মাকে অবাক হতে দেখে রিহান বলে,
“মা, বাবা, আমরাও প্রথমে অবাক হয়েছিলাম, ও ছোট হলেও বয়সের তুলনায় একটু বেশি বুদ্ধিমতী। এটাই আমাদের মায়রার অনন্য গুণ।”
” হ্যা, মা। আমরাও খেয়াল করেছি,আর মেনে নিয়েছি,” নিশি তার স্বামীর কথায় সম্মতি দিয়ে বলে।

চলবে,,,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here