না_চাইলেও_তুই_আমার পর্ব ১৯

#না_চাইলেও_তুই_আমার
[ সিজান ৩ ]
#লেখিকা_সারজীন_ইসলাম
#পর্ব- ১৯
আতিক সাহেব হল রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছে।আজ আর এ বেলা বাড়ি থেকে বের হবেন না তিনি। মিরান ছেলেটাকে বেশ লেগেছে তার কাছে। নম্র ভদ্র ছেলেটা। আজ ওর জন্যই বাড়িতে থাকছেন তিনি। তার স্ত্রী স্নেহা এসে এক কাপ চা এগিয়ে দিয়ে বলল,

—-” শোন না তুলি আজ স্কুলে যাবে না, আজ ও তোহার সঙ্গে ময়মনসিংহ যেতে চায়। তুমি ওর স্কুলে ফোন করে জানিয়ে দেও তুলি কিছুদিন স্কুলে যেতে পারবে না।”

আতিক সাহেব কপাল ভাঁজ করে বলল,

—-” তুলির না কিছুদিন পর পরিক্ষা? তুলির কোচিংর পরিক্ষার জন্য জুঁইয়ের বিয়েতেও যেতে পারে নি এখন যাবে তোহার সঙ্গে?”

স্নেহা আগে থেকেই জানতো উনি এমন কথাই বলবেন। এই মানুষটা মেয়েদের লেখাপড়া একটু এদিক ওদিক হতে দেয় না। স্নেহা আতিক সাহেবের পাশে সোফায় বসে বলল,

—-” তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। তুলি আমাকে বলেছে ও সবকিছু সামলে নিবে। যেতে দেও না মেয়েটাকে না হলে দেখবে মেয়েটা বাড়িতে মন খারাপ করে বসে আছে। তখন তোমারও এসব দেখতে ভালো লাগবে না।”

আতিক সাহেব কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,

—-” ঠিক আছে তুলি যাক তোহার সাথে।”

আতিক সাহেবের কথা শুনে স্নেহা মৃদু হেসে উঠে রান্না ঘরের দিকে চলে যায়।

______________________________

একমনে যে গাড়ি ড্রাইভ করবে সেটা পারছি না মিরান। এই দুই বোনে গাড়িতে উঠেছে পর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি করে যাচ্ছে। মিরান বারবার অসহায় বালকের মতো ওদের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু কে শোনে কার কথা। ওরা যেন আজ নিজ থেকে দায়িত্ব নিয়েছে আজ মিরানের মাথা খারাপ করেই ছাড়বে। কিছুক্ষণ পরপর দুই বোনে গাড়ি থামাতে বলে এটা ওটা খাওয়ার বায়না ধরছে। ইতিমধ্যে আইসক্রিম, পিজা, বার্গার খাওয়া শেষ করেছে দু’জনে। মিরান দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করছে, ও তো পারছেনা দুটোকে মাথার ওপর থেকে আছাড় দিয়ে ফেলে দিতে। মিরান গাড়ি স্লো করে পিছনে তাকিয়ে করুন গলায় বলল,

—-” আপনারা তো দু’জনে কথা বলছেন আমি গাড়ির FM টা বন্ধ করে দেবো?”

তোহা হাসি চেপে রেখে মিরানের দিকে তাকায়। এতক্ষণে ইচ্ছে করে বোনের সঙ্গে নিয়ে ওকে জ্বালাচ্ছিলো। এবার জালানো টা বন্ধ করা দরকার। না হলে বেচারা নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবে তাদের দুই বোনের জন্য। তোহা ছোট করে বলল,

—-” আচ্ছা, বন্ধ করো।”

মিরান তোহার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে FM টা বন্ধ করে দেয়। এর কয়েক মিনিটের মাথায় তুলি মৃদু চিৎকার করে বলল,

—-” ভাইয়া! ভাইয়া প্লিজ গাড়িটা থামাও।

মিরান গাড়ি না থামিয়ে গাড়ি স্লো করে বলল,

—-” এখন আবার গাড়ি থামাবো কেন?”

তুলি জানলা দিয়ে হাতের ইশারায় ফুচকার দোকান দেখিয়ে দিয়ে বলল,

—-” ফুচকা খাবো ভাইয়া, প্লিজ গাড়িটা থামাও।”

মিরান একা একা বিড়বিড় করে বলল,

—-” সেই কখন রওনা দিছি, এখনো ঢাকায় আটকে আছি এই দু’জনের জন্য। এটা ওটা খাবে বলে বারবার গাড়ি দাঁড় করাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই তো আইসক্রিম খাবে বলে বায়না ধরেছিল এখন আবার ফুচকা!তাছাড়া এই রাস্তার পাশের খাবারগুলো তো ওদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।”

মিরান জবাবে বলল,

—-” একটু আগে না আইসক্রিম খেলে! এখন আবার ফুচকা? এত বাইরের খাবার খাওয়া ঠিক না, এগুলো শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সবচেয়ে বড় কথা রাস্তার পাশের দোকানের খাবার তো একদমই নিরাপদ নয়। তার চেয়ে ভালো কোন রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করাই সেখানে ফুচকা খেও।”

তুলি ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

—-” আচ্ছা তোমরা ডাক্তার গুলো এমন কেন বলবে আমায়? সব সময় এত কড়া শাসনে রাখো কেন? এটা করবে না ওটা খাবে না। যেন সব নিয়মমাফিক হতে হবে। এই নিয়মের একটু এদিক-ওদিক হলেই যেন কারো গর্দান যাবে। আমি অতশত পারি না বাবা। সব থেকে বড় কথা হলো এই রাস্তার পাশের খাবারগুলো কতো টেস্টি হয় তা তোমাদের ডাক্তারদের কোন ধারণা নেই। আমি এখন ফুচকা খাবো প্লিজ ভাইয়া।”

মিরান গাড়ি থামিয়ে পিছন ফিরে তাকায়। এইটুকু পিচ্চি মেয়ে কেমন বড়দের মতো করে কথা বলছে। তুলি মুখ ফুলিয়ে রেখেছে দেখে মিরান হালকা হেসে বলল,

—-” পিচ্চি দেখি তো আবার অভিমান করতেও জানে? থাক আর অভিমান করে থাকতে হবে না।চলো ফুচকার দোকানে।”

তুলি ঠোঁটে হাসি এনে বলল,

—-” থ্যাংক ইউ ভাইয়া, তুমি খুব খুব খুব ভালো।”

মিরান হাসিটা আরেকটু প্রসারিত করে বলল,

—-” চলো এখন, আমাকে আর পাম দিতে হবে না।”

মিরানের কথা তোহা আর তুলি দু’জনেই হেসে দিয়ে গাড়ি থেকে নামে। তোহা আর তুলি একপ্রকার দৌড়ে ফুচকার দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মিরান ধীরেসুস্থে ওদের কাছে এসে দেখে অলরেডি ওরা ফুচকার অর্ডার দিয়ে দিয়েছে। মিরান ওদেরকে আর কিছু না বলে আশেপাশে চোখ বুলায়। প্রকৃতির সৌন্দর্য যতই দেখি ততই দেখতে ইচ্ছে করে মিরানের। অন্ধকার চারদিকে জেঁকে ধরেছে। সোডিয়াম লাইটের আলোতে পথিকরা তাদের গন্তব্য অনুযায়ী হেঁটে চলেছে। কেউ বা প্রিয়জনের হাত ধরে! মিরান চোখ বুলাতে বুলাতে এক নিদারুন দৃশ্যে চোখ আটকে যায়। চৌদ্দ কিংবা পনের বছর বয়সী একটা ছেলে ফুচকার দোকানের পাশে বসে চা বিক্রি করছে। মিরান বেশ কিছুক্ষণ ধরে খেয়াল করছে ছেলেটাকে। কেউ ছেলেটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলেও ছেলেটা হাসিমুখে মেনে নেয়। মিরান চোখ সরিয়ে তোহার দিকে তাকায়। দুই বোনের মধ্যে কিছু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে। মিরান ওদের আর কিছু না বলে ছেলেটার কাছে যায়। এক হাতে বড় একটা ফ্লাক্স অন্য হাতে একটা বালতির মধ্যে কিছু ওয়ানটাইম কাপ। মিরান গিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়ালে ছেলেটা মৃদু হেসে ফ্লাক্স আর বালতি নামিয়ে রেখে বলল,

—-” চা খাবেন ভাইজান?”

মিরান ছেলেটার দেখে মায়াবী চোখে তাকিয়ে বলল,

—-” হুম, ভালো করে বানিয়ে দাও তো এক কাপ চা!”

ছেলেটা চা বানানো শুরু করে হাসিমুখে বলল,

—-” একবার খাইয়া দেখেন ভাইজান পরে আর আমার চায়ের স্বাদ আর জীবনেও ভুলবেন না।”

মিরান মৃদু স্বরে বলল,

—-” নাম কী তোমার?”

ছেলেটা চা বানানো রেখে মিরানের দিকে তাকায় হয়তো এই প্রথম কেউ চা খেতে এসে ওর নাম জানতে চাইল। ছেলেটা ছোট করে বলল,

—-” হাবিবুর রহমান ভাইজান তয় মায় আমারে ভালোবাইসা হাবিব বইলা ডাকতো।”

মিরান অস্পষ্ট স্বরে বলল,

—-” হাবিব!”

ছেলেটা মিরানের সামনে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,

—-” এই নেন ভাইজান আপনার চা রেডি।”

মিরান একনজরে হাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে পরে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিয়ে বলল,

—-” চলো রাস্তার পাশে বসে তোমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করি চা খেতে খেতে।”

হাবিব বিস্ময় চোখে মিরানের দিকে তাকায়। হাবিব কিছু বলার আগে মিরান হাবিবের হাত ধরে রাস্তার পাশে পাকা বেঞ্চে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

—-” বাহ তুমি চা টা তো বেশ বানাও। কিন্তু তুমি এইটুকু বয়সে কাজ করছ তোমার বাবা-মা?”

হাবিব উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। কিছু মুহূর্ত নীরবতা পালন করে হাবিব মলিন হেসে বলল,

—-” বাবা-মা? ছিল অনেক কাল আগে।”

মিরান মোলায়েম গলায় বলল,

—-” ছিল মানে?”

হাবিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—-” এক সময় আমার বাবা-মা দু’জনেই ছিল। আমারে খুব ভালোবাসতো। একদিন আমি প্রতিদিনের নাহান মাঠে খেলতে যাই। খেইলা বাড়ি এইসা দেখি মা মাটিতে বসে কানতেছে। আমি দৌড় দিয়ে মায়ের কাছে যাইয়া জিজ্ঞেস করি কানতেছে কেন? মায়ের তখন চোখ মুইছা কয় কিছু না বাজান। পরে আমি পাশের বাড়ির চাচীর কাছ থেকে শুনছিলাম আব্বায় মায়রে মারছিল টাকার জন্য। এরপর থেকেই আমি প্রায়ই দেখতাম মায়ের কান্না। তখন অনেক ছোট্ট থাকায় কিছু কইতেও পারতাম না। যহন ক্লাস ফোরে উডি তখন একদিন আব্বায় মায় অনেক ঝগড়া করে। তার দুইদিন পর থেকেইকা আর মায়েরে খুঁইজা পাইনা। তারপরে দিন রাইতে খবর এলো পাশের গ্ৰামে নদীতে একটা লাশ পাইছে। আমরা সবাই মিইলা সকালে পাশের গ্ৰামে যাই গিয়া দেখি লাশটা আর কারো না আমার মায়ের। মায়েরে ঐ রকম মুখ থুবরে পড়ে থাকতে দেখে আমি দৌড়ে যেতে চাই কিন্তু ওহানকার লোকজন আমারে ধইরা রাখছিল কেউ যাইতে দেয় নায় আমার মায়ের কাছে। পরে পুলিশ আইসা তদন্ত কইরা জানতে পারে আমার মায়েরে খুন করা হইছে। খুন টা কেউ না আমার নিজের আব্বায় করছে। আব্বায় নেশার টাকার জন্য সবসময় মায়েরে মারধর করতো সেদিন নেশার ঘোরে আব্বায় মায়ের কাছে টাকা চাইলে মা দিতে পারে না। পরে এককথায় দুই কথায় আব্বায় মায়ের গলা টিইপা মাইরা ফেলায়। পুলিশ আব্বারে জেলে নিয়া যায়। আমি এলাকার লোকজনের সাহায্যে মায়ের কবর দিয়া পাশের বাড়ির চাচীর কাছে বাড়ির চাবি টা দিয়া চইলা আসি এই ঢাকার শহরে‌। আসার সময় পাশের বাড়ির চাচী আমারে কিছু টাকা দিছিলো সেই টাকা দিয়াই এহন চা বেচি আমি।”

এইটুকু বলে থামে হাবিব। মিরানের চোখগুলো লাল লাল হয়ে আছে। মিরানের পিছনে তোহা আর তুলির চোখে পানি।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here