নীল দিগন্তে পর্ব ১৬

#নীল_দিগন্তে
পর্ব- ১৬
লেখা- নীলাদ্রি নীরা

ভোর সোয়া পাঁচটা বাজে। পুষ্প তখনও জেগে ছিল রাজীবকে সরি বলবে বলে। কিন্তু রাজীব এতক্ষণ হাওয়া হয়ে ছিল। রাজীব রুমে ঢুকতেই তাকে দেখে পুষ্প ভ্যাংচি কাটলো। একদম কথা বলবে না ওর সাথে। ছাদেই থাকতো। এসেছে কেন? পুষ্প বিছানার এক কোনায় গুটিশুটি হয়ে বসে রইল। ভুলেও তাকাবে না ও রাজীবের দিকে। রাজীব পুষ্পকে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। পুষ্প সরে যেতে চাইলেও পারলো না। রাজীবের শক্তির সাথে ও পেরে ওঠেনি। রাজীব পুষ্পর গালে থুতুনি উঁচু করে ধরে বলল,
-” এই যে তখন এভাবে চিৎকার করেছিলি কেন? মা কি ভাবলো? হাজবেন্ড ওয়াইফের পার্সোনাল কথা অন্যদের জানাতে হয়?”
-” আমি ইচ্ছে করে তো বলি নি। আমি কি জানতাম নাকি তুমি এসেছো? ”
-” কেন জানতিস না? জানা উচিত ছিলো।”
-” তুমি কি বলেছো তুমি আসবা? ”
-” কেন বলতে হবে? তুই হিসেব রাখবি না যে আমি কবে গিয়েছি, কয় মাস হলো, কয় দিন বাকী আছে?”
-” আশ্চর্য আগে থেকেই কি ফিক্সড ছিল নাকি যে তুমি অমুক মাসে, অমুক দিন আসবা? ”
-” ওখানে সবই ফিক্সড! আপনি ফেইল করেছেন আমার খোজ রাখতে। ”
-” ভালো হয়েছে। কেন খোঁজ রাখবো? ”
-” কেন মানে? ”
-” প্রপোজ করেছ?”
পুষ্প ঠোঁট বাকালো। রাজীব ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
-” আচ্ছা! প্রপোজ করতে হবে? আমরা কি প্রেম করছি নাকি?”
-” জানিনা। হাত সরাও সুরসুরি লাগে।”
রাজীব হাসলো। হাত সরালো না। উল্টো পুষ্পকে বিছানায় ফেলে সে পুষ্পর উপরে উঠে গেলো। পুষ্প পুরু জমে গেল৷ পুরো শরীর কাঁপছে, অস্থিরতা ও কাজ করছে। রাজীব ওর গলায় নাক ডুবালো। পুষ্প ধাক্কাচ্ছে ওকে। দুই হাত দিয়ে পুষ্পর দুই হাত চেপে ধরে ফিসফিস করে সে বলল,
-” ভালোই শক্তি আছে দেখি। সাপের মতো এত মুচড়া মুচড়ি শুরু করেছিস কেন?”
পুষ্প চুপ। কি বলবে সে! রাজীব পুষ্পর একটা হাত ছেড়ে গালে আসা চুল গুলো কানের পিছনে গুজে দিলো। তারপর হাতটা পুষ্পর কানের পিছনে নিয়ে রাখলো।
-” আমি তো সবার মতো প্রপোজ করব না। নেভার! আই হ্যাভ মাই ইউনিক স্টাইল। আই উইল নেভার প্রপোজ ইউ।”
পুষ্প ভ্রু কুচকে তাকায় আছে। তবে রাজীবের দিকে না সে তাকিয়ে আছে রাজীবের গলার দিকে। ছেলেদের গলা কি খুব এট্রাকটিভ কিছু? রাজীবের গলা এত আকর্ষণ করছে কেন পুষ্পকে? রাজীব কি বলছে কিছুই ওর কানে যাচ্ছেই না। পুষ্পর গালে রাজীব নিজের গাল ঘসে দিলো। পুষ্প ব্যথায় কুকড়ে উঠলো। খোঁচা খোঁচা দাড়ির ধারে কি গালটা কেটে গিয়েছে নাকি। এত জ্বলছে কেনো। উফফ…
পুষ্প হাত দিয়ে রাজীবের মাথাটা সরালো। রাজীব ভ্রু নাচিয়ে বলল,
-” এখন দূরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে? খুব তো আসার জন্য তাড়া দিচ্ছিলি। এসে কি লাভ হলো? সেই তো দূরে ঠেলাঠেলি।”
পুষ্প লাজুক ভঙ্গিতে হাসলো। রুম অন্ধকার। তাও রাজীব দেখতে পাচ্ছে ২২ বছরের এক তরুণী চোখ দুটো বন্ধ করে হাসছে। তার চেহারায় রাজ্যের ভয়, সংকোচতা এবং লজ্জা।
-” এখন আবার হাসা হচ্ছে?”
-” উহু লজ্জা পাচ্ছি”
এই বলে পুষ্প নিজের মুখ ঢাকলো। বিয়ের পর রাজীবের নানুর সাথে যখন পুষ্পর কথা হয় তখন নানু বারবার বলেছিলেন স্বামীর কাছে লজ্জা পেতে নেই। স্বামীই মেয়েদের সব। পুষ্প তখন ভেবেছিল ও একদমই লজ্জা পাবে না। অথচ লজ্জায় সে চোখ মেলে তাকাতেও পারছে না। রাজীব বিরবির করে বলল, এই লজ্জা কাটাতে হবে। পুষ্পর দিকে ফিরে রাজীব বলল,
-” আমি খুব টায়ার্ড পুষ্প। অলমোস্ট তেরো ঘন্টা জার্নি করে এসেছি। আই নীড আ হেভি স্লিপ। সো আপনি পুরো একদিন সময় পাচ্ছেন৷ বুঝেছেন? গুড নাইট”
রাজীব পুষ্পর নাক টেনে দিয়ে আবার গালে গাল ঘসে দিল। পুষ্প গালে হাত দিয়ে হতভম্ব! সে একদিন দিয়ে করবেটা কি?
….
ফেয়ারওয়েলের প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার কথা এগারোটায়। অথচ একটা বাজতে চলল প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার নাম নেই। পুষ্প নওশিন, সুবহা, অরিন, সৌমিক আরও অনেক ফ্রেন্ডস দের সাথে গল্প করছিল। সেখানে মিসিং শুধু আলিফ আর রুমা। অবশ্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিক না। আলিফ ওদের সাথে জয়েন করার প্রশ্নই আসে না। পুষ্প যখন কদিন আগে আলিফকে ফোন করেছিল তখন দেখলো ওর নাম্বার আলিফের ফোন থেকে ব্লক করা। ইউনিভার্সিটিতেও আলিফ ওকে এড়িয়ে চলে। পুষ্প মনে মনে বলল, এড়িয়ে চললেই কি আর না চললেই কি। আমি তো স্বার্থের জন্য তোদের সাথে মিশিনি। চারটা বছর একসাথে পড়া হয়েছে, আর কখনো দেখা হবে কি না ঠিক নেই। সবার সাথেই কথাটথা বলা উচিত। আলিফের সাথে কথা বলে ওর ভুল বোঝাবুঝিটাও মেটানো উচিত। রুমার সাথেও কথা বলা উচিত। ও কেন পুষ্পদের কারও সাথে কথা বলছে না। পুষ্প লক্ষ্য করলো রুমা একটা চেয়ারে বসে ফোন টিপছে। পুষ্প রুমাকে টেক্সট করলো, কিরে? খবর নেই কেনো? কথা ছিল তোর সাথে। রুমা টেক্সটটা পেয়েই অবাক হয়ে এদিক সেদিক তাকিয়ে পুষ্পকে খুজলো। পুষ্পকে দেখেই ও ফোনে কিছু টাইপ করল। পুষ্পের ফোনে টেক্সট আসলো, শহীদ মিনারে আয়।
পুষ্প নওশিনদের উদ্দেশ্যে বলল,
-” তোরা বস আমি আসছি।”
নওশিন বলল,
-” কোথায় যাস?”
পুষ্প ফিসফিস করে বলল,
-” শাড়ির সেফটিপিন খুলে গিয়েছে।”
-” আচ্ছা যা।”
পুষ্প দ্রুত পায় এগিয়ে যাচ্ছে শহীদ মিনারের দিকে। ওর হঠাৎ করে মনে হলো সকালে যখন রাজীব ঘুমিয়ে ছিল তখন ওর গলায় একটা চুমু দিয়ে দিলেই ভালো হতো। এখন আফসোস হচ্ছে ওর। পুষ্প মিটিমিটি হাসলো। সেটা রুমার দৃষ্টি এড়ালো না। কালো পাড়, ছাই রঙের জমিনে শাড়িটাতে পুষ্পকে কি দারুণই না লাগছে।

…..

খুশবু ভেবে রেখেছেন তিনি পুষ্পর সংঘটনে চলে যাবেন। অবশ্য তিনিও কিছু টাকা ওখানে ইনভেস্ট করবেন। তবে সেটা উনার স্বামীর দূর্নীতির টাকা নয়। উনার অনেক গয়নাগাটি আছে যেগুলো উনার বাবা মায়ের দেয়া উপহার। ওগুলো বিক্রি করে দিবেন। উপহার নাকি রেখে দিতে হয়। রেখে কি হবে? দরকার নেই৷ বরং একটা ভালো কাজে লাগুক। তাতে উনার বাবা মায়েরও সওয়াব হবে। সংঘটনের টিনশেডের অফিসটা চেঞ্জ করে বড়সড় একটা বাসা নিতে হবে। একটা রুমে তিনি থাকবেন। সংঘটনটা দেখাশুনা করবেন। তিনি তেমন কাজ না জানলেও লিডিং তো করতে পারবেন। পুষ্পকে সাহায্য করবেন। পুষ্পর সাথে কথা বলা দরকার। মেয়েটা নিশ্চয়ই না করবে না।
খুশবু নিজের রুম ছেড়ে বেরিয়ে দেখলেন পুষ্প এসেছে কি না। তখনই বাসায় ঢুকলো পুষ্প। খুশবু পুষ্পকে ঢেকে নিজের রুমে নিয়ে আসলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন মেয়েটার চেহারাটা শুকনো শুকনো লাগছে। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। কান্না করেছে নাকি?
-” কি হয়েছে আম্মা? মুখটা এত ফ্যাকাসে লাগছে কেন? ”
পুষ্প নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল,
-” কিছু হয় নি ফুফু। কিছু বলবা তুমি? ”
-” দরকার ছিল তোর সাথে। তোর ওই যে জীবিকার তাগিদে সংঘটনের কি খবর? ”
পুষ্পর আত্মার পানি শুকিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। ইউনিভার্সিটির প্রোগ্রামের জন্য আজকে সংঘটনে যাওয়া হয় নি। টাকাটার কথাও সে ভুলে গিয়েছিল। এত দুশ্চিন্তা আর ঝামেলায় ওর কিছুই ভালো লাগে না। পুষ্প বলল,
-” ভালোই।”
-“অর্ডার টর্ডার কেমন পাস?”
-” পাই ভালোই ”
-” আমি ভাবছিলাম তোর সংঘটনটা দেখতে। এখানে শুধুশুধু বসে বসে খাওয়ার থেকে কিছু একটা করা তো ভালো। আমি ভেবেছি ওখানেই গিয়ে থাকব। তোর একা একা এতো কষ্ট করা লাগবে না। আমি ও সাহায্য করব।”
পুষ্প ভ্রু কুচকে বলল,
-” ওখানে গিয়ে থাকবে মানে? ওখানে কি থাকার জায়গা আছে নাকি? আর আমি তো একা সংঘটনটা চালাচ্ছি না ফুফু। আরও অনেক এ আছে।”
-” তোর ওসব ছাগল পাগল ফ্রেন্ডসদের উপর আমার ভরসা নেই। ওইতো সেদিন যখন গিয়েছিলাম দেখলাম সবকয়টা মিলে তামাশা করছে। ফ্যাশন শো করতে হলে একটা ফাংশন এরেঞ্জ করে সেখানে কর। এটা কি রঙ ঢং করার জায়গা? আর শোন পুষ্প ওইখানে থাকার জায়গা নেই ভালো কথা। ওই বাসাটা বদলা। কি একটা চিপার মতো জায়গা নড়াচড়ার ও সুযোগ নেই সেখানে ঘন্টার পর ঘন্টা এতগুলো মানুষ কিভাবে যে থাকে সেটাই বুঝে পাইনা।”
-” বাসা চেঞ্জ করার মতো টাকা নেই ফুফু।”
-“টাকা পেলে চেঞ্জ করবি?”
-” কোথায় পাবো?”
-” ধর আমিই দিলাম।”
-” তুমি কেন দিবে? ”
-” ধর আমি যে ওখানে থাকব সেজন্য দিলাম।”
-” তোমার ওখানে থাকতেই হবে? ”
-” তোর কি মনে হয় আমি মশকরা করছি? তোর সাথে আমার মশকরা করার সম্পর্ক? ”
-” না।”
-” তাহলে বাসাটা বদলা। টু-লেট, ফুলেট খুজে দেখ ভালো একটা বাসা নিবি। টাকা নিয়ে টেনশন করা লাগবে না।”
-” কত টাকা দিবা? ”
-” কত চাস?”
-” লাখ খানেক। হবে?”
খুশবু হাসলেন। তারপর বললেন,
-” একশবার হবে। বেশিও দিতে পারি।”
পুষ্প হাফ ছেড়ে বাঁচলো। খুশবুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-” তুমি হটাৎ ওইখানে যেতে চাইছো কেন বলবা ফুফু?”
খুশবু পুষ্পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-” তুই এত রাত করে ফিরিস। কত কাজ করিস। এখন থেকে ফিফটি ফিফটি করব। বাড়ির বউদের রাত করে বাড়ি ফিরতে নেই। বাড়িতে একটু সময় কাটাবি। ছেলেটা কতদিন পর এসেছে তার সাথে গল্পটল্প করবি। কয়দিন পর তো আবার চলে যাবে।”
পুষ্প একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলল, আর গল্প। প্রসঙ্গ পালটে পুষ্প বলল,
-” তুমি একা একা ওখানে থাকবে?”
-” কবরে কি একা থাকব না?”
-“ইহকাল আর পরকাল কি এক হলো ফুফু?”
খুশবু কিছু বললেন না। শুধু মনে মনে বললেন, আমার এই জীবনটা নরকের চেয়ে কম কিসে? বুড়ো বয়সে পাগল মেয়ে নিয়ে ভাইয়ের সংসারে উড়ে এসে জুড়ে বসাটা কি খুব স্বর্গীয় ব্যাপার?

চলবে……

(কথা ছিল পুষ্প বা রাজীবকে মেরে ফেলবো। মারলাম না করুক লোমান্স হুহ😏😏😏)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here