#নেশাটাই_তুমিময়
#লেখনিতে:- আবরার আহমেদ শুভ্র
•|পর্ব – ০৩|•
[কার্টেসি ছাড়া কপি একদম নিষেধ]
বাবর কাতর কন্ঠ শোনে ছুটে এলো রুদ্ধ। তাকে দেখে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায় সে। কারণ, বা হাতে গুলি লেগেছে ফারদিন শাহরিয়ারের। বুলেটটা কাধের ঠিক নিচে দিক দিয়ে আঘাত করে শরীরের এসপার ওসপার হয়ে সামনে রাখা কাচের গ্লাসে গিয়ে লাগল। আর অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। ব্যথার চোটে সেন্সলেস হয়ে গেছেন তিনি। রুদ্ধ খুব দ্রুতই হসপিটালে এডমিট করিয়েছে তার বাবাকে। যতোই হোক না কেন, সে তার জন্মদাতা পিতা বলে কথা! খুব গোপনতার সাথে কেউ একজন এই কাজটা করেছে। কিন্তু কে বা কারা করেছে সেটা এখনও জানা যায় নি। তবে সেটা খুব শীঘ্রই জানা যাবে বলে আশা করা যায়। কেননা শহরের প্রতিটা কোনায় কোনায় এখন পুলিশ চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। খবরটা যেন বাতাসের আগেই সকলের কানে কানে পৌঁছে গেলো। মন্ত্রী ফারদিন শাহরিয়ারকে কেউ একজন গুলি করে মারাত্মকভাবে জখম করেছে। হাসপাতালের করিডোরের এক কোণে চেয়ারে মাথানিচু করে বসে আছে রুদ্ধ। হঠাৎ, কাঁধে কারো হাত পরতেই চমকে উঠলো সে। মাথা তুলে সেদিকে তাকাতেই তার মাকে অশ্রুসিক্ত নয়নে দেখতে পেলো। মানুষটি আজ বেশ অনেক বছর পর এসেছে রুদ্ধের কাছে। রুদ্ধ তার মাকে জড়িয়ে ধরে হোহো করে কেঁদে উঠল,
– মাম্মা, কোথায় ছিলে তুমি? তোমায় কত জায়গায় খুঁজেছি, জানো তুমি? আমায় কি তোমার একটিবারও মনে পরলো না? তোমার ছোট্ট রুদ্ধর কথা কি তোমার মনে নেই!
– বাবাটা! আমি ছিলাম কোনো এক জায়গায়। তোমার বাবার খবরটা শোনে না এসে পারলাম না। হাজার হোক, আমার স্বামী হোন উনি। একটা অধিকার তো আছে তার প্রতি, তাই না?
অধিকারের কথা কানে আসতেই রুদ্ধ তার মায়ের থেকে ছিটকে দূরে সরে আসলো। তার রুদ্ধের কথা একটিবারও মনে পরলো না! দীর্ঘ ১৩ বছর পর এসেও তার স্বামীকেই দেখতে এলেন তিনি? জন্মদাত্রী মা হয়েও কেমনে ছেলের কথা মনে রাখলেন না হাফসা বেগম? কি দোষ করেছিলে সেদিন সে যার কারণে তিনি তাদের ছেড়ে চলে এলেন? যার নিমিত্তে তাদের বাবা ছেলের সম্পর্ক এতো তিক্তময় হলো! কই সে তো এখানে আসার পর রুদ্ধের কথা একবারও জিজ্ঞেস করলো না? জন্ম দেয়ার পর কি সব কিছু থেকে দায়মুক্তি হয়ে গেলেন তিনি? এতে কি রুদ্ধের অধিকার ছিলো না? আকাশসমান অভিমান নিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে সেই স্থান ত্যাগ করলো সে। কি অধিকার নিয়ে তাকে আবার মা বলে ডাকবে রুদ্ধ? ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে, যেখানে ডাক্তার অপারেশন করে বেরোল সবেমাত্র! তাদের কাছে আসতেই,
– মিস্টার রুদ্ধ! ডোন্ট পেনিক, হি ইজ আউট অফ ডেন্জ্ঞার নাও! তাকে ঘুমের ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। সো ইট মে টেক টাইম ফর রিগেইন হিজ সেন্স।
– থ্যাংকস ডক্টর।
– হা, একটু আমার চেম্বারে আসুন। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলার আছে আপনাকে। তারা দুজনেই চেম্বারে গিয়ে বসল,
– আপনাকে একটা ইম্পরট্যান্ট নিউজ দিবো বলেই এখানে ডেকে আনলাম। মিস্টার ফারদিন আউট অফ ডেন্জ্ঞার হলেও আরেকটা একটা কথা, ওনার শরীরে স্লো পয়জন এন্ড তিনটে বুলেট পাওয়া গেছে! দুটো বাহাতের একদম উপরে এবং একটা ডানপাশের বুকে। স্লো পয়জন ঠিক দেড় ঘণ্টা আগে পুশ করা হয়েছে। যেটা আস্তে আস্তে ওনার শরীরকে নিস্তেজ করে দিতে দিতে একেবারে নিঃশেষ করে দিবে।
– ওয়াট? কি বলছেন এসব? কিন্তু ওনাকে এই স্লো পয়জন দিবে কে?
-আমারও ঠিক একই প্রশ্ন, এতো সিকিউরিটি থাকার মাঝেও এসব সত্যি আনবিলিবেবল! আমার মনে হয় এসব আপনার আপন কোনো মানুষের কাজ। না হলে এসব কাজ যেন বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার মতোন মনে হচ্ছে।
– থ্যাংকস ডক্টর আমায় সঠিক তথ্য দেয়ার জন্য।
– ইটস্ মাই ডিউটি সান! টেক কেয়ার।
রুদ্ধ বাইরে চলে এলো। কোথাও তার মাকে দেখতে পেলো না। আর দেখতেও চাই না, যে তার খবর রাখে না তার খবর সে নিয়েই বা কি করবে? আপন যখন আপন রক্তকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দীর্ঘ ১৩বছর কাটাতে পারে তাহলে সে কেন পারবে না সারাজীবন কাটতে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে এগুতেই ফোনটা বেজে উঠল। কল রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে খবর এলো,
– স্যার কাজ হয়ে গেছে। আপনার বাবার ক্ষতি করতে চাওয়া ব্যক্তিটির খবর কিছু পেলেও সেটা ভুয়া মনে হচ্ছে। তবে তুর্যন ইনকিয়াত চৌধুরীকে আমরা কিডন্যাপ করে নিয়ে এসেছি।
– গুড, ওকে কয়েকটা দিন অনাহারে রাখো। এখন যেহেতু শীতের মৌসুম, প্রতিটা কাপড় খুলে বস্ত্রবিহীন শরীরে বেধে রাখো।
– কিন্তু স্যার….
– তোমাকে অর্ডার করেছি, সো ডু ইউর জব।
-ও্ ওকে স্ স্যার।
ফোন কেটে দিলো রুদ্ধ। রাগে থরথর করে কাঁপছে সে। ‘তুর্যন ইনকিয়াত চৌধুরী! হাহ! এবার বুঝবি এই রুদ্ধ শাহরিয়ার কি জিনিষ! আমার পার্সোনাল প্রপার্টিতে হাত দিয়েছিস না তুই? তোর সেই হাত ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিবো আমি। আগে কয়েকদিন শীতের আমেজ উপভোগ করে নে। ফোন পকেটে রেখে চলে গেলো তার বাবার ক্যাবিনে।
__________
‘চৌধুরী বাড়ী’ তে সকলে মুখ কালো করে বসে রয়েছে। সকলের চোখেমুখে শোকের ছায়া! অনিমাও আতংকে রয়েছে! কি কারণে তুর্যন অপহরণ হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে না সেও। কি হয়ে গেলো তুর্যনের? বৌভাতের রাত থেকেই কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তুর্যনকে। বাড়ীর মেঝো ছেলে হঠাৎ এমন হুট করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া যেন কেউই মেনে নিতে পারছে না। যে ছেলে কোথাও যাওয়ার আগে তার মায়ের কান ঝালাপালা করে দিতো সেই ছেলে আজ দুদিন ধরে নিখোঁজ। বিষয়টা একটু বেশিই রহস্যময় লাগছে তুর্যন-তুরনের বাবা ইনকিয়াত আনাস চৌধুরীর কাছে। শিল্পপতি বলে শত্রুর অভাব নেই তাদের! কিন্তু করলো কে এসব? হঠাৎ কল আসলো তুরনের মোবাইলে। মোবাইল নিয়ে একপাশে চলে এলো সে। একটু টুকরো আগ্রহ নিয়ে সকলে সেদিকে রইল যেন কোন খবর পাওয়ার আশায়! কিন্তু সকলের আশায় এক বালতি পানি ঢেলে দিলো যখন তুরন এসে অসহায় কন্ঠে বলল,
– ২২০৮৮ থেকে টিউন সেট করতে কল দিছে। তাই কেটে দিছি।
– এদের আর খেয়েদেয়ে কোন কাজ নেই? বিপদের উপর আসছে টিউন সেট করতে! যাও কোনো খবর পাও কিনা দেখো। আর সকলে শোনো বাড়ীর ছেলেমেয়েদের কয়েকদিন বাড়ীর বাইরে যেতে দিও না। পরিস্থিতি আমার ভালো ঠেকছে না।
– আমার তুর্যনের কি হবে? আজ দুদিন ছেলেটার কোন খবর নেই! আমার মনে হয় এসব আপনার বোনের মেয়ের কাজ। ঐদিন সবার সামনে অপমান করছিলো বলে ওরে কিডন্যাপ করাইছে।… বলে ন্যাকা কান্না জুড়ে দিলেন তুরনের মা কলি চৌধুরী।
– সাটআপ কলি ভাবি। কি পেয়েছো কি তোমরা হা? তোমার বড় ছেলের বিয়েতে নিয়ে অনির চরিত্রে কালি লাগালে আর আজ নিজের ছেলে নিরুদ্দেশ হয়েছে বলে কি সেটাও ওর নাম দিবে? কি ক্ষতি করেছিলো অনি তোমাদের? বাড়ীতে যত দোষ হয় সবটাই কি অনির নামে দিবে তুমি? ব্যাস অনেক হয়েছে এর একটা বিহিত করতেই হবে এবাড়ীতে, নাহলে কেউই কখনও ন্যায়বিচার পাবে না।
অনিমার চোখ বেয়ে দুফোটা নোনাজল গড়িয়ে পড়ল। এই দুজন মানুষই তাকে এতো ভালোবাসে। তার সাথে করা প্রতিটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তারা। তাদের ছাড়া কেমনে থাকবে সে? কিন্তু তাকে থাকতে হবে। মা-বাবার স্বপ্নপূরণের জন্য হলেও। সে এবার অবাক হলো তার বড়মামা ইনকিয়াত আনাস চৌধুরীর কথায়। সে আজ তার হয়ে কথা বলল,,
– আহা আনাফ! থামো তোমরা। আর কলি তোমার কি আক্কেল জ্ঞান বলতে কিছু নেই? কোথায় কি বলতে হয় সেটা কি এখনও যানো না তুমি? অনি মেয়েমানুষ, তার এতোটা সাহস নেই যে ডিরেক্ট তুর্যনকে কিডন্যাপ করবে। ও এমন করবেও না, সেটা বিশ্বাস। এটা এমন কেউ করেছে যার হদিস আমরা কখনও পাই কিনা সন্দেহ আছে।
– তাহলে কি করবো বাবা? তুর্যনকে তো আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।
– ডিসি মামুনকে কল করে এখানে আসতে বলো ইমিডিয়েলি। এখন আমরা ওনার সাহায্য ছাড়া কিছুই করতে পারবো না।
– ওকে।
– সবাই এখানে বসে থাকলে কি হবে? সবটা সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দাও। যাও সকলে নিজেদের কাজ করো গিয়ে। আনাস চৌধুরীী কথায় যে যার কাজে চলে গেলো।
অনিমাও চলে এলো রান্নাঘরে। তার এখনও অনেক কাজ করা বাকি। এসব ভাবলে হবে না তার। তাই কাজে মন দিলো সে। কিন্তু ফোনে মেসেজের শব্দে চোখ ঘুরালো সেদিকে। মেসেজ ওপেন করতেই বড় ধরনের একটা শক খেল সে, কি দেখছে সে এটা? ভয়ে অন্তরাত্মা থর থর করে কেঁপে উঠল তার! ভয়ে বার বার গলা শুকিয়ে কাট হয়ে আসছে তার।
প্রিয় ফুলপরী,
কেমন আছো? ভালো আছো কিংবা খারাপ! খারাপ থাকারই কথা। কেননা চৌধুরী বাড়ীর মেঝো ছেলে নিখোঁজ বলে! যায়হোক, সেটা আমিই করলাম। কেন জানো? তাকে আমার প্রেয়সী ফুলপরীকে অসম্মান করার সাহস কে দিলো সেটা জানতে আর বুঝাতে যে আমার ফুলপরীর দিকে চোখ তুলে তাকালে সেই চোখ আমি তুলে নেবো কতো নিষ্ঠুরতার সাথে। কজ, অনিমা মেহরুবা ইজ মাই পার্সোনাল প্রপার্টি! সি ইজ অনলি মাইন! তার প্রাপ্য শাস্তি পেয়ে সে আবার চৌধুরী বাড়ীতে ফিরবে। তবে সে তার ফার্স্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং নিয়েই সেই বাড়ীতে প্রবেশ করবে। বাই! সিই ইউ সোন ডিয়ার ফুলপরী!
মেসেজ পড়া শেষে চোখ তুলবে এমন সময় কেউ একজন এসে ফোনটা হাত থেকে নিয়ে নিলো তার। সে তাকাতেই আরেকদফা ভয় পেলো সে। তাহলে কি সবাই আবারও তাকে ভুল বুঝবে? ছোট মামা-মামিও কি তাকে ভুল বুঝবে তাহলে?
#চলবে কি?