#নেশাটাই_তুমিময়
#আবরার_আহমেদ_শুভ্র (Writer)
#পর্বঃ ১৪
৩১.
– ‘তোমরা নিশ্চয় শহর থেকে এসেছো এখানে?’
কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে আসলেন রুদ্ধের দাদুই আফাজ শাহরিয়ার। তা দেখে রুদ্ধ কিছুক্ষণ ওনার দিকে তাকিয়ে মাথানিচু করে বলে উঠল,
– ‘হা, আসলে আমরা শহর থেকেই এখানে এলাম। আর..’
রুদ্ধের কথার মাঝেই বাঁধ সাধলেন তিনি। দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন,
– ‘এসেছো ভালো কথা। তা হঠাৎ এখানে আসার কারণ! তাও শীতের মৌসুমে! এই মৌসুমে কখনও এখানে কেউ আসে না তেমন।’
পাশ থেকে অহন বলে উঠল,
– ‘আপনি আমাদের দাদুর মতোই, তাই আপনাকে দাদু বলেই ডাকছি। আসলে, দাদু এখানে আমরা ঘুরতে এসেছি। কখনও আমাদের শীতের মৌসুমে কুয়াশাচ্ছন্ন গ্রামের দেখা হয়নি তো তাই দেখতে এলাম কুয়াশায় ঘেরা গ্রামের দৃশ্য দেখতে কেমন লাগে! আর সেটা উপভোগ করার জন্যই এখানে আসা মূলত। যদি আপনাদের অসুবিধা হয় তো আমরা।’ বলে রুদ্ধের দিকে একপলক তাকালো অহন।
– ‘আচ্ছা বেশ দাদু বলেই ডাকো। আর তোমরা এখানে থাকলে আমাদের কোনো অসুবিধে নেই বরং আমরা খুব খুশিই হবো। যদি তোমরা এখানকার শীত সহ্য করতে পারো তাহলে নিশ্চিন্তে এখানে পুরো মৌসুমটা কাটিয়ে তবেই যেতে পারবে। কারণ, এই বিচিত্রা-পুরের শীতের মৌসুম বেশ প্রকট! যার দরুন এখানে তেমন অতিথিদের আসা হয় না। তোমরা চাইলে এখানে পুরো মৌসুম জুড়েই থাকতে পারো। এতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
– ‘ধন্যবাদ দাদু, তবে আমরা পর্যাপ্ত কাপড়ও এনেছি। এখানে থাকতে আমাদের কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে না।’
– ‘বেশ, তাহলে এসো ভিতরে তোমরা।’ বলে বাড়ীর দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। আর চাকরদের ফরমায়েশ করতে লাগলেন রুদ্ধদের সাহায্য করতে আর তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে।
কাজের লোকগুলো রুদ্ধদের লাগেজগুলো নিয়ে তাদের বাড়ীর দিকে নিয়ে চললো। তারপরে বাড়ীর বড় ফটক পেরিয়ে সকলে বাড়ীর ভিতরে প্রবেশ করলো। এ যেন একটার ভেতর আরেকটা বাড়ী সম্মীলন এখানে। সকলে বেশ অবাক হয়ে চারদিকটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। সবুজের সমারোহ তাও বাড়ীর ভেতরে!
৩২.
সকলে চলো এলো বিশাল রাজপ্রসাদতুল্য বাড়ীটার একদম ভিতরে। রুদ্ধ-অহনদের বাড়ী এই বাড়ীর তুলনায় কিছুই নয়। চাকরগুলো তাদের রুম দেখিয়ে দিলো। অহন রুদ্ধ তারা একেকজন একরুমে। আর অনিমা-তন্বী দুজনেই একরুমে। তারাও যে যার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। সবশেষে তাদের খাবারের জন্য নিচে ডাকা হলো। সবাই নিচে নেমে দেখতে পেলো হরেক রকম পিঠাপুলির সমাহার ডাইনিং টেবিলটাতে। রুদ্ধের দাদুই তাদের আসতে দেখে টেবিলে বসার জন্য বলল। তারাও বসল সাথে জোড় করে আফাজ শাহরিয়ার মানে রুদ্ধের দাদুই কে বসিয়ে দিলো। তার হাজারো বাহানা শোনলও না তারা। আড়ালে দাঁড়িয়ে তাহমিদা খাতুন মানে রুদ্ধের দীদুন মুচকি হাসি দিয়ে মনে মনে বলে উঠলেন ,
– ‘যাক, ফারদুর ছেলেটা অবশেষে এলো দেখি। ওই পারবে তার দাদুর সব ভুল ভেঙে মন থেকে সব মুছে সঠিক দিকে ফিরিয়ে আনতে। দোয়া করি দাদুভাই সফল হো তুই। আমি তো মা! আমি জানি আমার ফারদুটা সেদিন কিছুই করেনি তাকে ফাঁসিয়েছিল সেই নংপুসকের দল। এবার সবকটাই শাস্তি পাবে। তুই দিবি তাদের শাস্তি দাদুভাই। আমি সেটা মনেপ্রাণে বিশ্বাসও করি! আমি এও জানি আমার ফারদুই তোকে এখানে সকল সমস্যা সমাধানের জন্যই পাঠিয়েছে।তুই পারবি শাহরিয়ার প্যালেসের সেই আগের উচ্ছাসটা ফিরিয়ে দিতে।’ বলে আঁচল দিয়ে চোখের জলগুলো মুছে নিলেন।
সবাই খুব আয়েশ করেই নাস্তা সেড়ে নিলো। এর পরে আফাজ শাহরিয়ার রুদ্ধদের নিয়ে বারান্দায় বসলেন। তাদের বসতে বললেন তাদের কাছ থেকে কিছু জিজ্ঞেস করবেন বলে।
– ‘তা তোমরা কি ভাই বোন? মানে সবাই কি ভাই বোন?’
সবাই ভাইবোন কিনা জানতে চেয়ে যেনো রুদ্ধদের অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেললেন আফাজ শাহরিয়ার। রুদ্ধ কাছুমাছু হয়ে উত্তর দিলো,
– ‘না দাদুই, অহন মেহবুব আর অনিমা মেহরুবা এরা দুইজনই আপন ভাইবোন। আর অহনের বোন মানেই তো আমার বোন। অনিমার পাশের জন হলো গিয়ে তন্বী মানে, অনিমা ইনকিয়াত তন্বী। মানে অনিমার হবু ভাবি সাথে অনিমার মামাতো বোনও সে। আর আমি রুদ্ধ শা. আহমেদ মানে অহনের বন্ধু, ভাই, বেস্টফ্রেন্ড যা ভাবেন আরকি।’
এদিকে অনিমা মনে মনে ভীষন ক্ষেপেছে রুদ্ধের উপর। রাগে দুঃখে অনিমা মনে মনেই বিড়বিড় করছে, ”আমি আপনার বোন লাগি! তাই না? তা কোন জন্মের বোন হা? আপনার কোন মা আমাকে জন্ম দিলো শুনি? বোন বললেম তো আমায়! দেখেন আমি কি করি আপনাকে! যাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ! বোন বলার শাস্তিও হারে হারে টের পাবেন আপনি, মিস্টার অসভ্য!” বলে হাতজোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। পারলে এখনই আস্ত গিলে ফেলবে এই অবস্থা অনিমার। তন্বী মুখটিপে হেসে চলছে অনিমার কান্ড দেখে। তার ভাবনার মাঝেই রুদ্ধের দাদুই বলে উঠল,
– ‘বেশ ভালো লাগল পরিচিত হয়ে। আর যাও ফাহাদের ছেলে-মেয়েদের সাথে যাও ঘুরে দেখে এসো আমাদের গ্রামের দিকটা। আর আমার ছোট ভাইয়ের ছেলে ফাহাদ। ওরই ছেলে মেয়ে ওরা। নাম রোদ শাহরিয়ার আর তুর্শা শাহরিয়ার। আর কোনো ছেলেই নেই আমাদের পরিবারে। তবে, আমার ছেলেও…’ বলে থেমে গেলো উনি।
তার অর্ধেক কথায় থেমে যেতে দেখে রুদ্ধও এবার অন্য চাল দিলো, ‘আপনার ছেলে নেই? মানে আপনার ভাইয়ের সন্তান আছে, কিন্তু আপনার সন্তান?’
– ‘ছিলো একসময়! কিন্তু আজ সে আর আমি বহুদূরে! বিরাট দূরত্ব আমাদের মাঝে। যেমন, এক তারকা থেকে অন্য তারকার দূরত্ব ঠিক তারই সমান! কোনো একটা ভুল বুঝাবুঝির কারণেই সে আজ আমায় ছেড়ে বহুদরে।’ বলে চোখ মুছতে মুছতে উঠে চলে গেলেন ওনার রুমে। মন খারাপ হয়ে গেলো সকলের।
রুদ্ধ মনে মনে বলছে, ”বহুদূরে নয় দাদুই! তোমার কাছেই আছে বাবাই। খুব শীঘ্রই এই দূরত্ব শেষ হয়ে বাবা ছেলে এক হবেই। ভালোবাসায় ভরপুর হয়ে থাকবে ‘শাহরিয়ার প্যালেস’। ইনশা’আল্লাহ্!” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে।
৩৩.
বিচিত্রাপুরে বেশ কয়েকটা দিন আনন্দের সাথেই কেটে গেলো সকলের। আর এ কদিনেই আফাজ শাহরিয়ারের একদম কাছের কেউ হয়ে গেছে রুদ্ধ। তার সাথে একদম বন্ধুর মতোন সম্পর্ক তৈরি হলো রুদ্ধের। নিজের জীবনের সকল কিছুই তিনি এখন রুদ্ধের সাথেই শেয়ার করেন। তাছাড়া তার চাচা-চাচি, চাচাতো ভাইবোনসহ সকলের সাথে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কও তৈরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু সম্পর্কের অবনতি হচ্ছে অনিমার সাথে। সে রুদ্ধকে একদম কাছে ঘেঁষতেই দেয় না। বেচারা রুদ্ধও আছে বেশ দুঃখে। এই নিয়ে তার দুঃখের শেষ নেই। অসহায় হয়ে বারংবার অহনের কাছে গেলেও শেষমেশ একই দুঃখ নিয়েই ফিরতে হয় তাকে। কেননা, অনিমার মতোন তন্বীও এখন সেই হারে অহনকে ইগনোর করছে। খালি কথায় কথায় ভাইয়া ভাইয়া বলে মাথা খাচ্ছে। তাদের কান্ড দেখে তুর্শা আর রোদ হাসতে হাসতে শেষ।
কিন্তু তার মাঝেও এবার আসল কাজটা করা এখনও বাকি রুদ্ধদের। যে কারণে এখানে আসা তাদের! কেননা শীতও প্রায় শেষের পথে এখন। আর কাজটাও শীতের শেষ হওয়ার আগেই করতে হবে। আর সেই কাজ হলো সবকিছুর রহস্য উন্মোচন করা। কেন তার বাবা আজ সকলের চোখে এতোটা খারাপ হলো। সে তার প্রথম ধাপ হিসেবে তার চাচাকেই মার্ক করলো। তার চাচা ফাহাদ শাহরিয়ারই হয়তো তাকে এই সম্পর্কে বেশ কিছু ধারণা দিবে বলে মনে হচ্ছে অহনের। অহন বলে উঠল,
– ‘রুদ্ধ আমার কি মনে হয় জানিস? ফাহাদ আংকেল তোকে অনেক তথ্য দিতে পারবে। তুই একবার ওনার সাথে কথা বলে দেখ। আই থিং হি উইল হেল্প ইউ।’
– ‘ভয় লাগছে যদি জিজ্ঞেস করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়ে যায়! তাহলে সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। আর বাবাইকে দেয়া কথা আমার আর রাখা হবে না!’ বলে বেশ কিছুক্ষণ পিনপিন নীরবতা বিরাজ করছে সেই রুমে। হঠাৎ রুদ্ধ বলে উঠল,
– ‘আচ্ছা চল, ভয় করলে হবে না। আমাদের এখনই সময় চাচ্চুর কাছ থেকে সত্যিটা জেনে নেয়া। নাহলে সময় গড়িয়ে যাওয়ার পরেও আর কিছু হবে না।’
বলে রুদ্ধ একপলক অহনের দিকে তাকালো। সে নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় বসে আছে। সে জোড় করে অহনকে উঠালো তারপরে দুই জনেই ফাহাদ শাহরিয়ারের রুমের দিকে রওনা হলো। কিন্তু রুম থেকে বেরুতেই তাদের সামনেই বাধা হয়ে দাঁড়ালেন রুদ্ধের দীদুন তাহমিদা খাতুন। তিনি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে ইশারায় তাদের নির্দেশ দিলেন সদর দরজার বাইরে যে ঘরটা আছে সেখানে অপেক্ষা করতে। তারাও সেই কথা মতোন সেখানে গিয়ে তাহমিদা খাতুনের জন্য অপেক্ষারত রইল। ঘন্টাখানেক পর তিনি চোরের মতোন করেই ঢুকে ভিতী থেকে দড়জা আটকিয়ে দিলেন। বেশ অবাকও হলো রুদ্ধরা তার এমন আচরণে। কেন তিনি হঠাৎ তাদের এখানে নিয়ে এলেন। কিন্তু তাদের ভাবনার মাঝেই তিনি বলে উঠলেন,
– ‘রুদ্ধ দাদুভাই, আমি জানি তুই আমার ছেলে ফারদিনের ছেলে। এটাও জানি তুই এখানে কেন এসেছিস!’
চমকে উঠলে রুদ্ধ! সাথে অহনও। তারা আপন মনে ভাবছে তাহলে কি সবটাই শেষ হতে চললো? কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে তিনি বলে উঠলেন,
– ‘জানিস দাদুভাই, আমি তো মা। আমি ঠিকই ধরতে পেরেছিলাম যে আমার ছেলে কিছু করে নাই। কিন্তু তোর দাদুই যে রাগ তার কাছে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। আমার ছেলেটার কোনো দোষ ছিলো না। ঐ মানুষটিই সবকিছু করছে। সেই আমার ছেলেটাকে ফাঁসিয়েছে। সম্পত্তির লোভে পরে সে এসব করছে।’
– ‘তার মানে তুমি সব জানো দীদুন! কিন্তু দাদুইকে এসব বললে না কেন?’
– ‘আমি সব জানি না বাবা, তবে এ ব্যাপারে তোকে ফাহাদ সাহায্য করবে।’
– ‘আমরা তো ওনার কাছেই যাচ্ছিলাম মাঝখানে আপনি আসাতেই আর যাওয়া হলো না।’ বলে অহন তাহমিদা খাতুনের দিকে তাকালো।
– ‘কারণ, সে এখন রুদ্ধের দাদুইয়ের কাছে। রাতের বেলা আমিই নিজেই ওরে তোমাদের ঘরে পাঠাবো। তখন সবকিছু যেনে নিও। তবে সাবধান তোর দাদুই যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পাই।’
– ‘তুমি চিন্তা করো না দীদুন, তোমার দোয়ায় দেখবে সবকিছু আগের মতোই হয়ে যাবে। আই প্রমিজ উইথ ইউ দীদুন। কিন্তু লোকটা কে? সে এখন থাকে কোথায়?’
– ‘আমি জানি দাদুভাই, তুই পারবি সব ঠিক করতে। আর সে লোকটা হলো আলি মির্জার ছেলে! এই এলাকারই একজন বর্ণাঢ্য ব্যক্তি সে।’
– ‘কি নাম আলি মির্জার সেই ছেলের?’ প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো অহন। সাথে রুদ্ধও। কিন্তু তাহমিদা খাতুন যার নাম বলল তা শোনার সাথে সাথেই দুজনের অধরের কোণে বাঁকা হাসিটা ফোঁটে উঠল।
.
.
.
.
~চলবে ইনশা’আল্লাহ্।