পরিশিষ্ট পর্ব ১০+১১

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১০ (বোনাস পার্ট)

রোদ্দুর ভাই পাঠায়নি তো?অহির হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে চিন্তায়।হঠাৎ ফোন হাতে নিয়ে নিজের ম্যাসেন্জারে ঢুকলো।উদ্দেশ্য রোদ্দুর ভাইকে পাঠানো মেসেজ চেক সিন করেছে কি না দেখা।

ম্যাসেন্জারে ঢুকে অহির মাথায় চিন্তার ছোট খাটো একটা পাহাড় জমে গেল।কারণ রোদ্দুর ভাই মেসেজ এখনো সিন করেনি!তাহলে এটা কার কাজ?

এই মেসেজ যে সে রোদ্দুর ভাইকে পাঠিয়েছে সেটা তো সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ জানে না!এমনকি রোদেলা আপুও না!

এই রহস্যের সমাধান করার জন্য রোদ্দুর ভাইকে লাগবে।অহি আবারো রোদ্দুর ভাইদের বাসায় যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছানো শুরু করলো।আজ দুটো বইও সঙ্গে নিল।কিছুদিন পর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা!সে মনে মনে ঠিক করে রাখলো রোদ্দুর ভাই যেমন ব্যবহারই করুক না কেন,কিছুদিন সে থাকবেই!

রোদ্দুর ভাই সেই যে তার জন্মদিনের পরের দিন ভোরে চলে গেছে আর তার সাথে দেখা হয়নি।আজ এগারো দিন হতে চলল তার!

——————–

রোদ্দুর ভাইদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল অহির।আজ সে একা নয়।সাথে অপূর্ব এসেছে।সদর দরজার সামনে দাঁড়াতেই অপূর্ব হাত উঁচিয়ে বলল,

—“বুবু,দেখো!খালুজি নিশ্চিন্ত ভবনের জায়গা কি লিখেছে!”

অহি তাকালো।দরজার একদম উপরে লেখা,” পাগল হইতে সাবধান”।তার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,’এ বাড়ির একজন কিছুদিন হলো মেন্টালি সিক।তাহার হইতে সাবধান।’

অহি কলিং বেলে চাপ দিয়ে বলল,

—“অপূর্ব রে।খালু মেন্টালি সিক বলতে তাকে বুঝিয়েছে?খালামণিকে?”

—“আমার তো তাই মনে হয় বুবু।হয়তো খালামণির সাথে খালুর আবার ঝগড়া হয়েছে।সেজন্য ইচ্ছে করে এসব লাগিয়েছে।”

এটুকু বলেই অপূর্ব ফিক করে হেসে ফেলল।অহি কিছু বলার আগেই দরজা খুলে গেল।দরজা খুলেছে ফজিলা।

অহি সোফায় বসতেই তার খালামণি এসে দফায় দফায় কান্না করলো।প্রথম দফায় খালুর নামে হাজারো নালিশ।এটা নতুন কিছু নয়!আর দ্বিতীয় দফায় যেটা বলল সেটা শুনে অহি নিজেও চমকে উঠলো।

জন্মদিনের সময় অহিদের বাসা থেকে ফেরার পর থেকেই রোদ্দুর ভাই নাকি কেমন জানি আচরণ করছে।মাঝে মাঝে একা বিড়বিড় করে।হুট করে আনমনা হয়ে যায়।কখনো আবার গুনগুন করে গান গায়।

অপূর্ব ফিক করে আবারো হেসে দিল।শাহিনুর রাগী চোখে তাকাতেই সে আমতা আমতা করে বলল,

—“খালামণি,রোদ্দুর ভাই কি গান গায়?”

শাহিনুর বুঝদারের মতো বলল,

—“আমি কি অত বুঝি নাকি?তবে কুটি বলেছে রোমান্টিক গান গায়।কিন্তু ও তো আগে কোনোদিন গান গাইতো না!সত্যি সত্যি হয়তো জ্বীনে ভর করেছে।কিন্তু আমি পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি ও রাজি হচ্ছে না।”

—“বাহ!রোদ্দুর ভাইয়ের থেকে আজ রাতেই গান শুনবো।কি বলো বুবু?”

অহি চোখ পাকিয়ে অপূর্বকে উপরে পাঠিয়ে দিল।শাহিনুর আবার বলল,

—“ছেলেটার যে হঠাৎ করে কি হলো রে অহি?আমার সোনার টুকরো ছেলে!”

শাহিনুর আঁচল চেপে আবার কান্না শুরু করলো।অহি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

—“খালামনি,তুমি কান্না করবে না একদম।আমরা সবাই এসেছি।দেখি ব্যাপারটা কি!রোদ্দুর ভাই কি বাসায়? ”

—“না!অফিস থেকে ফিরেনি।তোর খালুও আসেনি।”

—“অফিস তাহলে ঠিক ঠাক করছে।এটা ভালো! ”

—“অহি রে।তোকে একটা কথা বলি।কাউকে বলবি না কিন্তু।আমি কাউকে না জানিয়ে গুলিস্তানের এক পীর সাহেবের কাছে গেছিলাম।উনি বলেছে একটা মাঝারি দেখে গরু জবাই করে ফকির খাওয়ালে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

—“সে কি!”

—“হ্যাঁ রে!কি করা যায় বল তো?পীর সাহেবের কথা বলে কথা!ফেলনা কিছু নয়।”

অহি খালার পিঠে হাত রেখে বলল,

—“খালামণি,তুমি একদম চিন্তা করবে না।রোদ্দুর ভাইয়ের সুস্থতা বলে কথা।এক গরু কেন,প্রয়োজনে দুই গুরু জবাই হবে।”

শাহিনুর সন্দেহের দৃষ্টিতে বলল,

—“তুই বলছিস?তোরা তো আবার দু পাতা ইংলিশ শিখে পীর টীর মানিস না!”

—“কে বলেছে মানি না!আলবাত মানি।হাজার বার মানি।তুমি বরং আমাকে একবার তোমার পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যেয়ো।”

শাহিনুর খুশিতে ঝলমল করছে।অহিকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল।আজ রাতের ডিনারে দেখা যাবে, খালা অহির স্পেশাল ডিশ রান্না করেছে।

অহি মুচকি হেসে উপরে চলে গেল।রোদেলা আপু নাকি ঘুমাচ্ছে।কলেজ থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে আজ নাকি ফিরেছে।

——————

রোদ্দুর অফিস থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে ঢুকলো।আজ বড্ড ক্লান্ত।হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রাখলো।গলার টাই খুলে বিছানায় ঢিল দিতেই সেদিকে চোখ পড়লো।অহি গুটিশুটি হয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।

রোদ্দুর অবাক হলো না।শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বলল,

—“এতক্ষণ অফিসে জ্বালাচ্ছিলি এখন সোজা বেডরুমে চলে এসেছিস?থাক!তোকে পড়োয়া করে কে!সেখানে খুশি সেখানে থাক।”

বলেই রোদ্দুর নিজের শার্ট খুলে অহির মুখে ছুঁড়ে মারলো।অহি ঘর্মাক্ত শার্টটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নাক সিঁটকে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি তো দেখি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন?এমন আচরণ করছেন কেন?”

রোদ্দুরের অহির সম্পূর্ণ কথা কানে গেলো না।গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা একটানে খুলে অহির দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,

—“বাহ!তোর কত উন্নতি হয়েছে রে অজান্তা!এতদিন শুধু হুটহাট, যেখানে সেখানে তোর চেহারা ভেসে উঠতো।এখন তো দেখি মুখে বুলিও ফুটেছে।”

অহি রোদ্দুরের উদাম শরীর দেখে লজ্জায় মিইয়ে গেল।রোদ্দুর ভাই কি সত্যিই তাকে মেয়ে মনে করে না?এতটুকু লাজ লজ্জা নেই? অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি আমার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন?”

—“তুই না আমার স্বপ্নে খালি গায়ে নাচানাচি করিস তার বেলা?এখন আমার খালি গা দেখে লজ্জা পাওয়ার ভান ধরছিস কেন?তুই তো নির্লজ্জ!”

অহি দু হাতে মুখ ঢেকে বলল,

—“ছি!”

রোদ্দুর নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতে বলল,

—“ছি ছি করা?এখন আমি প্যান্টও খুলবো।দেখি তুই এরপরো কিভাবে আমার সামনে থাকিস!”

বলেই একটানে প্যান্টের জিপার খুলে ফেলল।অহি সমস্ত শক্তি দিয়ে এক চিৎকারে রুম থেকে বের হয়ে গেল।দরজা এখনো নড়ছে।অহির চিৎকারের শব্দ এখনো কানে আসছে।রোদ্দুর অবাক হয়ে ভাবল,এটা কি হলো?অজান্তার তো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা।এর আগে তো এতদিন তাই ঘটেছে।চিৎকার চেঁচামেচি করলেই নাই হয়ে যেত।আজ হঠাৎ দরজা দিয়ে পালাল কেন?দরজা তো এখনো নড়ছে?তাহলে কি অজান্তা সত্যি সত্যি এখানে ছিল?শিট…….

রোদ্দুর এক নজর নিজের দিকে তাকিয়ে বিছানায় ঝাপ দিল।বিছানার চাদর টেনে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলল।ছি!অহি ওকে এখন কি না কি ভাবছে!অহিকে এখন মুখ দেখাবে কি করে এখন?

নিচে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে।রোদ্দুর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।চোখে মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে বের হলো।হাতের কাছে রাখা ফুল হাতা টিশার্টটা গায়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।

মুখের দিকে ভালো করে এক নজর দেখে নিচের দিকে তাকালো।নাহ!প্যান্টের জিপার লাগানো আছে।তারপর বেশ স্বাভাবিক ভাবে নিচে নামলো।

ড্রয়িং রুমে ভিড় জমে গেছে।অহিকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা।পিএইচডি ধারী থেকে শুরু করে পড়াশোনার প না জানা সবাই।সবার মাঝে সোফায় শাহিনুরকে জড়িয়ে অনবরত চোখের জল ফেলছে অহি।রোদেলা একপাশে থেকে অহির পিঠে হাত বুলাচ্ছে।

রোদ্দুর কাছে গিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

—“এখানে কিসের জটলা?”

কেউ উত্তর দিল না।তবে অহি বাদে বাকি সবাই এক জোড়া করে চোখ দিয়ে রোদ্দুরকে গিলে ফেলল।

রোদ্দুর কপাল কুঁচকেই বলল,

—“সবাই আমার দিকে এভাবে কেন তাকাচ্ছো?আমি কি করেছি?”

হঠাৎ অপূর্বর দিকে চোখ পড়তে হেসে বলল,

—“আরে অপূর্ব যে!হোয়াটসঅ্যাপ ব্রো!কেমন আছিস?”

অপূর্ব মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো।রোদেলা নিরবতা ভেঙে বলল,

—“রোদ্দুর, অহিকে কিছু বলেছিস?তোর রুম থেকে ভয় পেয়ে দৌঁড়ে বের হয়েছে।কিছু জিজ্ঞেস করছি।বলছেও না।কিছু করেছিস?”

—“হে হে হে।আমি কি করবো রোদ আপু?ও তো তেলাপোকা দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়েছে।তাই না রে অজান্তা?”

অজান্তা কিছু বললো না।রোদেলা বলল,

—“রোদ্দুর।আমি জানি অহি তেলাপোকা ভয় পায় না।তাছাড়া ও প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে।দুদিন পর পর জীবন্ত তেলাপোকা কাটে।”

রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,

—“তাই তো!আগে তো ভেবে দেখিনি।ও হ্যাঁ!আপু ও আসলে ভূত দেখে ভয় পেয়েছে।তাই না রে অজান্তা?”
#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১১

রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,

—“তাই তো!আগে তো ভেবে দেখিনি।ও হ্যাঁ!আপু, ও আসলে ভূত দেখে ভয় পেয়েছে।তাই না রে অজান্তা?”

অজান্তা এতক্ষণে চোখ তুলে তাকালো।রোদ্দুরের দিকে এক নজর চাইলো।রোদ্দুরের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।চোখ দিয়ে যেন বার বার বলছে,

—“প্লিজ,এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দে।”

অহি মাথা নিচু করে গাল মুছলো।তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

—“রোদ্দুর ভাইয়ের রুম অন্ধকার ছিল।ছায়ার মতো কিছু একটা দেখেছি।”

তারপর রক্ত চক্ষু নিয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।সবার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কথাটা তাদের বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হচ্ছে।ফজিলা খালা বলেই ফেলল,

—“মা অহি!পুরুষ ভূত নাকি মাইয়া ভূত ছেল?”

অহি জবাব দেয়ার আগে কুটি বলল,

—“ও খালা!পুরুষ ভূত।বিড়িদ্ধ ভূত।কুঁজা হইয়া পা ফালায়!”

সবাই আগ্রহ নিয়ে কুটির দিকে তাকালো।ফজিলা সন্দেহ নিয়ে বলল,

—“তুই কেমতে জানলি রে কুটি?”

কুটি হাত নেড়ে নেড়ে বলল,

—“আমি জানুম না?আমি হইলাম গিয়া গন্ধ শুইকা বইলা দিতে পারি কোন বাড়িত ভূত আছে! এ বাড়ির আসার পর থেইকা আমারে ঘুমের মধ্যে বুইড়া একটা ভূত ডিরিস্টার্ব করতো।পরে একদিন স্যান্ডেলের ফটাফট শব্দে বাইর হইয়া দেহি এক কুঁজো ভূত।পরিচয় জিগাইতেই কইল,উনি নাকি হিম দাদার পূর্বপুরুষ।উনার নাম হইলো গিয়ে ছক্কেল পরামাণিক।উ…..”

রোদ্দুর এক ধমক দিয়ে কুটিকে থামিয়ে দিল।কুটি মেয়েটা মুহূর্তে নতুন গল্প ফেঁদে বসে।তার গল্প বানানোর প্রতিভা অসাধারণ।

এতক্ষণে মুজিবুর রহমান মুখ খুললেন।চোখের চশমাটা টেনে নাকের ডগায় এনে তার উপর দিয়ে কুটির দিকে তাকালেন।তারপর বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

—“মা,কুটিরন।আমার পূর্বপুরুষের চার ঘর পর্যন্ত সবার নাম জানি আমি।তাহাদের মধ্যে ছক্কা না কি যেন নাম বললে?ছক্কা ফক্কা কেউ ছিল না।”

কুটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল,

—“আমি কেমনে কমু বড় বাজান।বুইড়া ভূতও যে মিছা কথা কইবে তা তো ধারণার মধ্যি ছিল না।কি যুগ আইলো গো!ভূতরাও মিছা কথা কয়।”

ফজিলা ফের কিছু একটা বলতে নিতে রোদ্দুর থামিয়ে দেয়। তারপর শাহিনুরকে বলে,

—“আর একটা কথাও না।মা,টেবিলে খাবার রেডি করো।অপূর্ব আয় তো!আমার পাশে বসবি তুই আজ।”

——————

অহি রোদেলার রুম চিন্তিত মুখে বসে আছে।রোদেলা রুমে নেই।কিচেনে কফি করতে গেছে।রাতের বেলা ঘুমানোর আগে চা,কফি কিছু একটা পান করে ঘুমানো তার অভ্যাস হয়ে গেছে যে তা অহির অজানা নয়।তবে অহি রোদ্দুর হিম নামক মানুষটাকে কেন জানি ভয় পাচ্ছে।এরকম সাংঘাতিক মানুষের সাথে একই ছাদের তলায় থাকাটাও বিপদজনক মনে হচ্ছে।

রুমের দরজায় কারো ছায়া পড়লো।অহি চমকে বলল,

—“কে?রোদ আপু?”

কেউ উত্তর দিল না।তবে মিনিট দুয়েক পর রোদ্দুর ভেতরে এক পা রেখে বলল,

—“অজান্তা!কি করিস?”

অহি ভয়ে কুঁকড়ে গেল।কোনো উত্তর দিল না।রোদ্দুর দু পা ভেতরে রেখে বলল,

—“তুই অনেক ভয় পেয়ে গেছিলি না রে?”

তারপর নিজের মাথা চুলকে বলল,

—“আসলে ব্যাপার হলো কি…….রোদ আপু তোকে ছাদে ডাকে।কফি টফি কিছু একটা নিয়ে উপরে উঠতে দেখলাম।”

বলেই রোদ্দুর চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।অহি একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ফোনের দিকে তাকালো।রাত সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি।

গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো করে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।মাথার চুলগুলো পেছনে নিয়ে খোপা করে বড় ক্লিপ লাগালো।তারপর ফোনটা নিয়ে রুম থেকে বের হলো।ছাদে উঠার সিঁড়ি রোদ্দুর ভাইয়ের রুমের পাশ দিয়ে।অহি দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালো।দরজা ভেতর থেকে আটকানো।

তারপর বড় বড় পা ফেলে ছাদে উঠে গেল।

ছাদে জনমানবের চিহ্ন নেই।অহি তবুও চারিদিকে নজর বুলালো।ছাদে লাইট জ্বালানো নেই।অাজ আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদও নেই।তবুও চারপাশ একদম পরিষ্কার।চাদে সে বাদে দ্বিতীয় কেউ নেই।তাহলে কি রোদ্দুর ভাই মিথ্যা বলল?

অহি এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণের রেলিং ধরে দাঁড়াল।রোদ্দুর ভাইদের দু তলা বাসা।আশপাশে কাছাকাছি আর কোনো বাড়ি নেই।সামান্য একটু দূরে একটা ছিমছাম বিল্ডিং চোখে পড়ে।বিল্ডিংয়ের তিন তলায় আলো জ্বলছে।

—“দড়ি কেনার টাকা আছে তো অজান্তা?”

আচমকা কন্ঠ শুনে চমকে গেল অহি।পেছন ঘুরে দেখে রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে।সে বুকে এক দলা থুথু দিয়ে বলল,

—“এভাবে কেউ ভয় পাইয়ে দেয়?”

রোদ্দুর বিড়বিড় করে বলল,

—“তুই যে ভূতের মতো যেখানে সেখানে উদয় হোস তা৷ বেলা?”

সে এগিয়ে এসে অহির থেকে কয়েক হাত দূরত্ব বজায় রেখে রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়ায়।সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“তুই বল,দড়ি কেনার টাকা আছে তো?”

অহি কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,

—“কিসের দড়ি?দড়ি কিনবো কেন?”

—“তুই তো সেকেন্ডে সেকেন্ডে ভালোই ভং ধরতে পারিস!তোকে নিয়ে সংসার করতে গেলে তো মুসিবতে পড়তে হবে রে।”

—“কি সব বলছেন রোদ্দুর ভাই?”

—“রোদ্দুর ভাই, তুই যদি এবার আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করিস তাহলে তোকে একদম খুন করে ফেলবো।তারপর নিজের গলায় দড়ি দিবো।তাই বললাম!দড়ি টড়ি কিনে রাখিস আগে থেকেই।আমি কিছুদিন পর অন্য একজনকে বিয়ে করছি।”

এটুকু বলেই রোদ্দুর হাই তুলল।অহির কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।রোদ্দুর ভাই এসব জানলো কি করে?মেসেজ তো সিন করেনি তাহলে?কোনোভাবে কি তাহলে তার ফোন থেকেই দেখেছে?দেখেও এত নির্লিপ্ত কেন?এতক্ষণে তো কানের নিচে দুটো দেয়ার কথা!

তার মানে আননোন নাম্বার থেকে যে ম্যাসেজ গুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলো রোদ্দুর ভাইয়ের নাম্বার?অহি আর চিন্তা করতে পারছে না।ধপ করে নিচে বসে পড়লো।

রোদ্দুর দু পা এগিয়ে এসে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

—“তাহলে দড়ি কিনে রাখিস।টাকা না থাকলে আমার থেকে নিস।পরে শোধ করে দিবি!যা!ভুলেই গেছিলাম।তুই উপরে চলে গেলে টাকা শোধ করবে কে?আচ্ছা, যা।আমি দড়ি কেনার টাকাটা ফিতরা হিসেবে দিব।”

অহি অনেক কষ্টেও চোখের জল আটকাতে পারলো না।তার ফিলিংসকেও এভাবে হাসির খোরাক বানাচ্ছে রোদ্দুর ভাই?

সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—“আপনি এত নিষ্ঠুর কেন রোদ্দুর ভাই?”

রোদ্দুর অহির থেকে কিছুটা দূরে নিজেও পা ভাঁজ করে বসে পড়লো।তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললো,

—“তুই আমাকে ভালোবেসে কি করেছিস রে অজান্তা?কিচ্ছু করিস নি।উল্টো এমন ভাব নিয়ে চলতি,যেন আমি তোর রক্তের ভাই।তিন লাইনের একটা বাক্যে তিন বার করে রোদ্দুর ভাই, রোদ্দুর ভাই করতি!আমার বাপেরও তো ক্ষমতা নেই তোর ফিলিংস বোঝার।শোন অজান্তা!পৃথিবীতে কেউ তোর নিরবতা বা নিঃশব্দতার পেছনের গল্প খুঁজতে যাবে না।তোর সাইলেন্সের আড়ালে লুকানো শব্দভান্ডার বোঝার ক্ষমতা কারো নেই।তাই কাউকে কিছু বলতে চাইলে মুখ ফুটে বলতে হয়।না হলে ওই মানুষটার আড়ালেই সব থেকে যায় সারাজীবন।”

—“এখন তো জানেন।”

—“কি জানি?”

—“ওটা!”

—“কোনটা?মুখে বল!হাতে সময় নেই কিন্তু।”

অহি শেষ মেষ বলেই ফেলল,

—“আমি আপনাকে ভালোবাসি রোদ্দুর ভাই।”

রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।অহির এই একটা বাক্য তাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল।তার হাত পা কাঁপছে।হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ যেন বেড়ে চলেছে।নাহ!আজ হয়তো অজান্তার হাতে ধরা পড়েই যাবে।মনের ভেতর অন্য ধরনের ভালো লাগা কাজ করছে।চোখের সামনে যেন হাজারো রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ছে।সে চোখ বন্ধ করলো।

অহির বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেল।রোদ্দুর ভাই তাহলে তাকে রিজেক্ট করবে।তাই তো?এই ভয়টাই তো এতদিন পেত সে।তার কান্নার বেগ বেড়ে গেল।

কান্নার শব্দে রোদ্দুর পেছন ঘুরে তাকাল।স্বাভাবিক গলায় বললো,

—“তোকে একটা রূপকথার গল্প শোনাই অজান্তা।কান্না থামিয়ে শোন।এক দেশে ছিল এক রাজকুমার। রাজকুমার ছোটবেলা থেকেই একটু রাগী ছিল।হুটহাট রেগে যেত।সেজন্য তার তেমন বন্ধু মানুষও ছিল না।বড় হওয়ার পর সেই দেশের এক দাসী মেয়ে রাজকুমারকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠায়।রাজকুমার বহু মানুষের সামনে মেয়েটাকে কিছু কটু কথা বলে রিজেক্ট করে।দাসী মেয়েটা পণ করে।যে করেই হোক,রাজকুমারকে কষ্ট দিতে হবে।তখন সে নানা উপায়ে রাজকুমারকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে।একটা সময় রাজকুমার দাসী মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে তাকে বিয়ে করতে চায়।কিন্তু বিয়ের দিন দাসী মেয়েটা ছল চাতুরী করে পালিয়ে যায়।রাজকুমারের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

তখন অন্দরমহলের এক রাজকুমারী এসে রাজকুমারের পাশে দাঁড়ায়।তার ক্ষত মোছার চেষ্টা করে।কিন্তু রাজকুমার এত অন্ধ ছিল যে রাজকুমারীর চোখের ভাষা বুঝতে পারেনি।এর বেশ কিছুদিন পর রাজকুমার একদিন হঠাৎ রাজকুমারীকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে বেঁহুশ হয়ে যায়।তার চোখ আটকে যায় রাজকুমারীতে।সর্বপ্রথম রাজকুমারীকে দেখে তার অন্য ধরনের ফিলিংস হয়।একদম অন্য ধরনের ফিলিংস যার সাথে সে অপরিচিত।এমনকি দাসী মেয়েটার জন্যও তার সেসব অনুভূতি হতো না।

তারপর থেকে রাজকুমার কেমন পাগল পাগল হয়ে যায়।যেই মানুষটাকে সবাই ভয় পেত,সেই কি না এক রমণীকে যমের মতো ভয় পাওয়া শুরু করলো।রমণীটা তার শয়নে, স্বপনে এসে হানা দিতো।চোখ খুললেও তাকে দেখে,বন্ধ করলেও তাকে দেখে।কি এক্টা অবস্থা।ক্রমেই রাজকুমারের ছটফটানি ভাব বেড়ে গেল।একটা সময় সে বুঝতে পারলো রাজকুমারীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।তারপর সে লুকিয়ে রাজকুমারীর ঘুমের সময় তাকে দেখে আসতো।একদিন হঠাৎ রাজকুমারীর ফোন হাতে নিয়ে ঘেঁটে জানতে পারে রাজকুমারীও তার জন্য পাগলপ্রায়।তাকে ভালোবাসে।

ব্যস!রাজকুমারের খুশি আর ধরে কে।সেদিন বাসায় ফিরেই সারারাত রোমান্টিক গান গেয়ে গেয়ে নেচে গেল সে।বুকের ভেতর সে কি ভালোলাগা।নতুন স্বপ্ন, নতুন সংসার।সবকিছু রাজকুমারীকে ঘিরে।কিন্তু একটা সমস্যা হলো রাজকুমার সারা দুনিয়ার সামনে একরকম,আর তার ভালোবাসার কাছে অন্য রকম।সে পৃথিবীতে রাজকুমারীকে ভীষণ ভয় পায়।তাকে ছুঁয়ে দিতে ভয়,জড়িয়ে ধরতে ভয়,হাতে হাত রাখতে ভয়!সবকিছুতে শুধু ভয় আর ভয়।”

রোদ্দুর মুখ ঘুরিয়ে আবার অন্য দিকে তাকালো।অহির কান্না অনেক আগেই থেমে গেছে।সে কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে যেন।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।রোদ্দুর ভাইও তাকে ভালোবাসে?

রোদ্দুর ভাইয়ের তাকে ছুঁতে ভয় থাকলেও তার তো নেই।সে এক লাফে উঠে রোদ্দুরের সামনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।

রোদ্দুর চোখ বন্ধ করলো।তার হা পা মেয়েদের মতো কাঁপছে।এর আগেও একবার না দুবার অহিকে জড়িয়ে ধরেছে সে।কিন্তু এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি।

অনেক্ষণ পর অহি রোদ্দুরের বুকে মাথা রেখেই অবাক হয়ে বলল,

—“আপনার হার্টবিট এত বেড়ে গেছে কেন রোদ্দুর ভাই?কেমন ধাড়াম ধাড়াম শব্দ হচ্ছে।আমার মাথাও যেন ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে।”

রোদ্দুর এক ঝটকায় অহিকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।তার গাল, কান আবার লাল হয়ে গেছে।অহি দেখতে পেলে নিশ্চিত ক্ষেপাবে।সে পা বাড়িয়ে বলল,

—“এক চড় খাবি উল্টাপাল্টা কথা বলা।চল,নিচে যাই।”

অহি পেছনে থেকে রোদ্দুরের ডান হাত টেনে ধরে বলল,

—“এত তাড়াতাড়ি যাবেন রোদ্দুর ভাই?কত প্রতীক্ষার পর আপনাকে পেলাম।”

—“তো? আর কি করতে চাস?জড়িয়ে ধরলি নির্লজ্জের মতো তাতে হলো না?”

অহি মুখ টিপে হাসছে।সে বেশ বুঝতে পারছে দাবার চাল উল্টে গেছে।এতদিন সে রোদ্দুরকে ভয় পেত,এখন রোদ্দুর তাকে ভয় পায়।তার কাছে যাওয়াতে ভয় পায়।

অতি রোদ্দুরের হাত ধরেই তার সামনে গেল।পায়ের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে বলল,

—“চুমু খাব।”

রোদ্দুর ছিটকে পেছনে সরে বলল,

—“ও মাই গড।কি সাংঘাতিক।তু-তুই নিচে যা তো অজান্তা।”

—“যাব না।চুমু দিবেন, তারপর যাব।”

রোদ্দুর আরো দু পা পিছিয়ে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

—“তুই আমায় নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে মেরে ফেলবি অজান্তা।আই হেইট ইউ।”

অহি এগিয়ে গিয়ে মুখটা নিচু করে রোদ্দুরের বাম গালে একটু চুমু দিয়ে দৌঁড়ে নিচে নেমে গেল।

রোদ্দুর গালে হাত রেখে ছাদে শুয়ে পড়লো।এই মেয়েটা নিশ্চিত তার পৃথিবী উলোটপালোট করে দিবে।

(চলবে)

একটু ব্যস্ত ছিলাম।দেরিতে দেয়ার জন্য দুঃখীত।কাল দুটো পার্ট দিবো ইনশাআল্লাহ।

আগের পর্বের লিংক, পর্ব –১০
(চলবে)

ছোট হয়েছে অনেক।😒 লেখার সময় পাইনি।🤦‍♀️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here