প্রাণদায়িনী পর্ব -০১

সিগারেটে পরপর দুটো টান দিয়ে দাপটের স্টাইলে ধোয়া ছাড়ছে লোকটা। সিঙ্গেল সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে দাম্ভিকতার ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। চোখদুটো সামনে থাকা মেয়েটার উপর স্থির রেখে মাথা-থেকে-পা পযর্ন্ত চোখ বুলাচ্ছে। মেয়েটার ঘার্মাক্ত দেহ, সুশ্রী মুখ, আতঙ্কে দিশেহারা চোখদুটো থেকে অশ্রু বর্ষণ হচ্ছে তখন। ঠোঁটের উপর বেঁধে দিয়েছে সাদা রঙের কাপড়। মুখবাঁধা মেয়েটার ডাগর-ডাগর চোখদুটো তিন ঘন্টার অশ্রান্ত অশ্রুপাতে ফুলে উঠেছে, রক্তিম হয়ে আছে পুরো মুখ। হাতদুটো নাইলনের রশি দিয়ে পিছমোড়া করে বেঁধেছে। হঠাৎ জাঁদরেল ধরনের এক ব্যক্তি সিগারেট টানা লোকটার কানের কাছে আসলো, গলার স্বর কিছুটা নিচু করে সর্তক কন্ঠে বললো,

– আপনার জন্য এটাকেই চুজ করেছি বস। ওরই নাম এশা। মেয়েটা প্রাইভেট পড়াতে যাচ্ছিলো, রাস্তা খালি ছিলো ওমনেই সুযোগ পেয়ে তুলেছি। ঠিক করেছি না?

‘ বস ‘ সম্বোধন করা লোকটা এবার সিগারেটে জোরে একটান দিলো। ঠোঁটটা হালকা একটু ফাঁক করে ধোয়াযুক্ত নিশ্বাসগুলো ছাড়তে লাগলো। বাঁহাতটা কালো প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফোন বের করলো, ডানহাতটা ঠোঁটের কাছে এনে আঙ্গুলের ফাঁক থেকে সিগারেট গুঁজলো ঠোঁটে। জোরে টান দিয়ে ঠোঁটের কাছ থেকে ডানহাত সরাতেই পুনরায় ধোয়া ছাড়তে-ছাড়তে ফোনটা কানে ঠেকালো। কলের শব্দগুলো একবার-কি-দুবার বাজতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হলো, আর্দ্রমিশ্রিত কন্ঠটা কিছু বলবে তার আগেই মাঝপথে দাঁড়ি বসিয়ে দিলো। কান্নায় ঢলে পরা মেয়েটার দিকে স্থির দৃষ্টি তাক করে প্রশ্নসূচকে বললো,

– মেয়েটার নাম কি এশা? কি করে এই মেয়ে? আমিতো দেখছি কান্নায় ভালোই ঢপ দেখাতে পারে। এর ভাই যেই শক্ত মাল, সেই তুলনায় দেখি বোন পুরোই নড়বড়ে।

ওপাশ থেকে প্রচণ্ডরূপে বিষ্ময় নিয়ে ‘ কি বললি ‘ সুরে চিল্লিয়ে উঠলো নারীকন্ঠটা। শব্দের তীব্রতায় বিষম খেলো শ্যূট-বুট পরা লোকটা। চাপা বিরক্তি নিয়ে কান থেকে ফোন আলগা করলো, ফোন খানিকটা দূরে নিবে তখনই অস্থির সুরে চেচিয়ে উঠলো কন্ঠটা,

– তুই কোথায় আছিস? তুই এখন কোথায় বল! তু-তুই-ই না, তুই না সমুদ্র দেখতে গেলি? তু-তু-তুই কার কথা বললি? কা-কা-কে তুলেছিস তায়েফ? ঠিক করে বল!

স্মিত হেসে ফোনটা আবার কানে ঠেকালো তায়েফ। শক্ত মুখটার উপর বাঁকা হাসির খেলা চলছে এখন। সহোদর বোনের আতঙ্কগ্রস্থ কন্ঠ শুনে প্রচুর হাসি পাচ্ছে তার, মেয়েটা সামনে না থাকলে ঠিকই হো-হো করে রুম কাঁপিয়ে হাসতো। ফোনের ওপাশ থেকে জমজ ভাইয়ের কার্যকলাপ শুনে স্তম্ভিত হয়ে আছে তায়েবা। মাথায় ঠাস করে হাত রেখে বিছানায় ধপ করে বসলো, নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায় চোখদুটো বন্ধ করলো। তায়েফের মতো জঘন্য ছেলে আজ পযর্ন্ত দুটো দেখেনি! অতীতের পুরোনো ঘটনাগুলো মনে পরতেই তীব্র উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে চেঁচাতে লাগলো,

– তুই ওকে ছেড়ে দে তায়েফ। ওকে কিছু করিস না ভাই। মেয়েটা ছুটি কাটাতে বাড়ি এসেছে, কিছুদিন থেকেই চলে যাবে। ওর সাথে কিচ্ছু করার চিন্তা আনিস না লক্ষ্মী ভাই। ওকে আমার জন্য হলেও ছেড়ে দে। তুই কি আমার কথাও শুনবি না? তায়েফ রে, প্লিজ কথাটা —

টুট টুট টুট করে অনবরত শব্দ হতেই বুকটা কঠিনভাবে মোচড়ে এলো। চোখের কোটর ভীষণ বড় হয়ে চোয়াল হা হয়ে গেলো, কান থেকে ফোনটা ধপাস করে বিছানায় পরে গেলো তায়েবার। বীভৎস স্মৃতিগুলো তাজা হয়ে উঠলো ওর। দুই মিনিটের বড় ভাইটা চরিত্রের দিক থেকে জঘন্য। লেখাপড়ার সবটুকুই বিদেশের মতো পাশ্চাত্য দেশ থেকে সেরে এসেছে, সেখানকার ট্রেডিশান অনুযায়ী চলতে গিয়ে লম্পট, বেহায়া, উশৃঙ্খল, বদমেজাজী হয়েছে আরেফিন তায়েফ। দেশের মাটিতে এসেও সুস্থির থাকেনি, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে-ঘুরে করে ক্লাব চষে বেড়িয়েছে। মা-হীন সংসারে বাবার সাথেই লাস ভেগাসে পাড়ি জমিয়েছিলো, আজ সহোদর বোনের উছিলায় ফের দেশে আগমন হয়েছে ওর। ছ’মাসের ছুটিতে দেশে আসতেই চর্তুথ মাসে তায়েবার আপন ননদিনীকে তুলে এনেছে ওর সাঙ্গুরা। তায়েবা নিজেও জানেনা মেয়েটার উপর কি ধরনের নির্যাতন চালাতে পারে, সেটা কি শারীরিক না মানসিক তার নূন্যতম ধারণা নেই। লোকমুখে যতদূর শুনতে পেয়েছে তার ভাই প্রতিদিনই সাদা চামড়ার মেয়েদের প্রতি দূর্বল হতো। তার ভাই কি রকমের আচরণ দেখাতে পারে, এশার সাথে কি করবে, আদৌ মেয়েটাকে স্বাভাবিক রূপে ছাড়বে কিনা…. আর ভাবতে পারলো না তায়েবা। চোখদুটো বন্ধ করে দুহাতে মাথার চুলগুলো টেনে রইলো। অস্থিরতায় দম ফেটে যাচ্ছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে শেষ। আবারও ফোন নিয়ে তায়েফের নাম্বারের কল করলো, কোনো লাভ হলো না। রাগে-ক্ষোভে আছাড় মারলো ফোনটা, ওমনেই ফ্লোরে বারি খেয়ে চুরমার হলো সেটা। পাগলপ্রায় তায়েবা রুমের মধ্যে পায়চারী করতে থাকলো, ঘুমন্ত দেড় বছরের মেয়েটার দিকে চোখ দিতেই কেদেঁ ফেললো। সময় গড়াতে-গড়াতে আকাশের রঙ পালটে গাঢ় কালো হলো, নির্জন হয়ে গেলো চারপাশ। ব্যস্ত সড়কের হর্ণগুলো কমতে-কমতে গাড়ির চলাও হ্রাস পেয়ে গেলো, তবুও তায়েফের ফোন খোলা পেলো না। দেড় বছরের মেয়ে ফাইজাকে কোলে নিয়ে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে তায়েবা, আকাশের তারাগুলো মলিন মুখে যেনো তাকেই দেখছে। স্বামীকে খবর দিয়ে তার বোনের ব্যাপারে বলবে কিনা এখনো দ্বিধায় ভুগছে। একটু আগে আফিফ বাসার ফোনে দিয়ে জানিয়েছে, রাতে ফিরতে একটু দেরি হবে, হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা প্রচুর। তায়েবা যেনো জেগে না থেকে খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পরে, অপেক্ষা যেনো না করে সে। এদিকে ভীষণ অপেক্ষায় ধৈর্য্য হারাতে বসেছে তায়েবা। রাত দশটার বেশি বাজে তবুও এশার খবর নেই। মেয়েটা কি ভালো নেই? না তায়েফের বণ্য হিংস্রতার শিকার হয়েছে? ধিক্কারে বুক ফুলে উঠলো তায়েবার! মনে-মনে অকথ্য-অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলো নিজের মায়ের পেটের ভাইকে। নয় মাস একই মাতৃগর্ভে বেড়েছে দুজন, অথচ চরিত্রের দিক দিয়ে আকাশ-পাতাল ফারাক।

সেদিন রাতে কোনো দেখাই মেললো না এশার। প্রচণ্ড অস্থিরতায় জবুথবু হয়ে শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা বাড়লো তায়েবার। দ্রুত এ্যানহেলার টেনে শ্বাসকার্য সচল রাখার চেষ্টা চালালো, তবুও অসহ্য যন্ত্রনায় সমস্যা হচ্ছিলো তার। পরদিন সকালের দিকে বাসায় ফিরলো স্বামী আফিফ। এসেই বোনের ব্যাপারে জেরা শুরু করলো, বোনকে আশেপাশে দেখতে পেয়ে ভাইয়ের স্নেহ মনটা নিশপিশ করছিলো। সংসার জীবনে এই প্রথম মিথ্যা কথা বললো তায়েবা, এশার ব্যাপারটা নিয়ে ধামাচাপা দিলো, সে বান্ধুবীর বাসায় স্লিভ-ওভারের পার্টি করতে গিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে আর কোনো বাক্য উচ্চারণ করলো না আফিফ, চুপচাপ খেয়েদেয়ে রেস্ট নিয়ে পুনরায় কাজে ফিরে গিয়েছে। এদিকে দুপুরের আযানও দিলো, আছরের আযানও একই মসজিদ থেকে মুখর হলো, তখনও বাড়ির কাছে ভিড়লো না গাড়ি। ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে উদভ্রান্তের মতো আবার কল করলো, এবার ফোনটা ঢুকলো ঠিকই কিন্তু বাজতে-বাজতে বন্ধ হয়ে গেলো। নিরাশ-হতাশ-বিমূঢ় তায়েবা যখন ধৈর্য্যের সবটুকু হাল ছেড়ে দিলো তখনই কান ফাটিয়ে বাসার নিচে গাড়ি থামলো দুটো। শব্দ শুনতে দেরি সবকিছু ছেড়েছুড়ে উন্মাদের মতো নিচে দৌড়ে নামলো, সদর দরজায় ‘ কে? ‘ বলে প্রশ্ন করলোও না, তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে হাপাতে লাগলো। চোখের সামনে যে দৃশ্য দেখতে পেলো তাতে আশ্চর্য হয়ে মুখে ডানহাতের তালু চেপে থমকে গেলো তায়েবা। নিজের চোখকেই যেনো বিশ্বাস করাতে পারছেনা! ক্রিম কালারের হাঁটু সমান কূর্তি পরেছিলো এশা, সঙ্গে কালো রঙের জিন্স। মাথার সবগুলো চুল একত্র করে উঁচুতে একটা ঝুটি করেছিলো, হাতে ছিলো ফ্যাশনেব্যাল অনেকগুলো ব্রেসলেট। পায়ে কালো রঙের শর্ট বুট পরা ছিলো ওর। অথচ এখন সম্পূর্ণ ভিন্নবেশে দেখতে পেয়ে কলিজা শুকিয়ে গেছে তায়েবার। গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি পরেছে এশা, ব্লাউজটা মিচমিচে কালো। হাতে কোনো ব্রেসলেট তো নেই, পা’দুটো একদম খালি। এশাকে শাড়ির বেশে দেখে হতবাক তায়েবা অনেকক্ষণ পর পেছনে তাকালো, পকেটে হাত গুঁজে সৌষ্ঠব্য দেহের পুরষটাকে দেখে চিনতে ভুল করলো না। তায়েফের মুখটা শক্ত হয়ে আছে, কোনোপ্রকার হাসি নেই। এশাকে চৌকাঠায় নামিয়ে দিয়ে থেমে থাকা গাড়িটায় চড়ে বসলো তায়েফ। ততক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে রণমূর্তি দৃষ্টিতে তাকালো তায়েবা, এশার হাতটা ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলো। ধাম করে গাড়ির দরজা লাগাতেই একটু-একটু করে মাথা ঘুরিয়ে পিছু তাকালো একজোড়া সরল দৃষ্টি, গাড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতেই আচমকা হাতে টান খেয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে লাগলো সে। পা চালিয়ে ভেতরে যাচ্ছিলো ঠিকই, দৃষ্টি পরে রইলো গাড়িটার ভেতরে। হাতমুখ ধুইয়ে শাড়ি পালটে এশাকে নিয়ে শান্ত চিত্তে বসলো তায়েবা। খুঁটে-খুঁটে সব প্রশ্ন করতেই প্রথম প্রশ্ন দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে ধরলো,

– ওই শয়তান তোকে কিছু করেছে? তোর গায়ে হাত-টাত দিয়েছে? কোনো উঁচু-নিচু কাজ —-

কথার মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে এশা বিব্রত সুরে ভাবীর হাত ধরে বললো,

– না ভাবী, আমাকে কিচ্ছু করেনি। বিশ্বাস করো, আমি ঠিক আছি।

তায়েবা তবুও স্বস্তি পেলো না। নিজের ভাই বলেই খুব তীক্ষ্ম ভাবে চেনে ওকে। এশার হাতটা ছেড়ে দিয়ে নিজেই ওর হাতদুটো মুঠোয় আগলে ধরলো, লাল হওয়া ঠোঁটটার দিকে দৃষ্টি যেতেই আচমকা গলার স্বরটা কাঠিন্য করে চিল্লালো তায়েবা,

– ওই জা’নোয়ারটা তোকে কি করেছে সত্যি বল!
ঠোঁটে কাপড় বেঁধে দিলে ওমন লাল হয়? লাল কেনো হয় আমি কি জানিনা? তুই আমার কাছে ওই জানোয়ারের কথা লুকাচ্ছিস?

– চলমান .

#প্রাণদায়িনী ❤
#পর্বসংখ্যা_০১.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here