প্রেমজাল পর্ব ৬

#প্রেমজাল
পর্ব ০৬
জান্নাতুল মাওয়া মাহিমুন

“তাহলে চল। যাও যাক” বলে আদ্র ভাই গাড়ির গেইট খুলে দিলো। আমি যেই না পা বারাবো অমনি কেও খপ করে হাত ধরে থামিয়ে দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে ফিরতেই হৃদ স্পন্দন ট্রেনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে লাগলো। আমি ভয়ে ঠোঁট আনমনেই কামড়ে ধরলাম। নিশ্বাস প্রগাড় হয়ে আসতে লাগলো। মস্তিষ্ক নামক পদার্থটি উদ্দীপনা দেওয়া থামিয়ে দিয়েছে। আয়ান আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার স্থির চাহনি ঝড় আসার পূর্বাভাস দিচ্ছে। অনেক ভয়ঙ্কর জিনিস হতে চলেছে। ভাবতেই হাত-পা হিম ধরে গেলো।

-“চল আমার সাথে” থমথমে স্বরে বললো আয়ান।

সাথে সাথে ঠাস করে বিকট শব্দ হতেই কেপে উঠলাম আমি। আদ্র ভাই গাড়ির গেইট এতো টাই জোরে বন্ধ করেছে যার শব্দ এতোটা উৎকট। ইয়া আল্লাহ মালুম!! এখন যদি ৩য় বিশ্ব যুদ্ধ লেগে যায়, তাহলে কেমন হবে? আয়ান হাতটা খানিকটা চেপে ধরতেই মনে উশখুস যেন আরো বেড়ে গেলো।

“আহানা, আমি আজ তোকে বাড়ী নিয়ে যাবো। কারোর সাথে কারোর বাড়ি যেতে হবে” জোরালো কন্ঠে বলে আদ্র ভাই আমার আরেক হাত ধরলো। হায় আল্লাহ!! এখন আমার দুই হাত দুই জনের হাতে আবদ্ধ। কেও এর থেকে কেও কম না। না যেতে পারবো ডানে আর না যেতে পারবো বামে।

আকস্মিকভাবে তখনি আমার ক্লাসমেট মাধুরী আসলো। মাধুরী আসতেই আদ্র ভাই দৃষ্টিগোচর খাতিরে হাত ছেড়ে দিলেও অই ব্যাটা বজ্জাত ঘাড় ত্যাড়া ন্যায় স্তব্ধ রইলো। এমন একটা ভাব-সাব যে আমি তার নিজের কেনা জিনিস তাই হাত ছাড়া করবে না। মাধুরী অনুরোধের স্বরে বলতে লাগলো,

-“দোস্ত! আমার একটু তোর হেল্পের প্রয়োজন”

আমি মাধুরীর দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই গরগর করতে বলতে লাগলো,

-“আরে দোস্ত আর বলিস না। আজকে আমার একটা Get Together ছিলো। এই যে এই সামনেই। আমার সাথে আদিবার যাওয়ার কথা ছিলো বাট ওর পারিবারিক সমস্যা থাকার কারণে যেতে পারছে না। তুই প্লীজ আমার সাথে আয়। বিকালের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। প্লীজ প্লীজ আয়!! প্লীজ”

প্রথমত আমার এইসব পার্টি পছন্দ না। কিন্তু এই দুই হতছাড়ার থেকে বাচার জন্য মাধুরীর সাথে যাওয়া হলো বেস্ট উপায়। দ্বিতীয়ত, মেয়েটা এতো রিকুয়েস্ট করছে। তাই না চাইতেও সম্মতি দিয়ে দিলাম। আয়ান আমার হাত খামচে ধরলো। উনার চোখ মুখে এখন হিংস্রতার চাপ। পারলে হয়তো এখনি গিলে খেয়ে ফেলতো।

-“আহানা বেব। কাম ফাস্ট”

মাধুরী তাড়া দেওয়ার স্বরে ডাকতেই ছেড়ে দিলো। খামচে ধরার জায়গায় কিঞ্চিৎ রক্ত ইতিমধ্যে জমা হয়েছে। এটার আমার কাছে আর নতুন কি। সবসময় কষ্টই দিয়েছে। তবুও তার দেওয়া কষ্টে আমার সুখ। আমি তপ্ত শ্বাস নিয়ে মাধুরীর সামনে হাটতে হাটতে রাস্তার বাক ঘুরলাম। পিছনে এক পলক তাকিয়ে উনাকে দেখার ইচ্ছা থাকলেও বুকের ভেতর চাপা আর্তনাদ এ চেপে গেলাম।

মাধুরী আসতে আসতে একটা উঁচু বিল্ডিংয়ের সামনে এসে থামলো। আমি কিছুক্ষণ ইতস্তত হয়ে মাধুরীকে জিজ্ঞেস করলাম,

-“আর ইউ সিউর মধু? এখানেই তো?”

মাধুরী আমাকে আশ্বাস দিয়ে হাত ধরে ৫ম তলায় উঠতেই কাচের একটা বড় গেইট দেখতে পেলাম। সেখানের একজন ওয়াচম্যান কে মাধুরী কার্ড জাতীয় কিছু দেখাতেই আমাদের ভিতরে যেতে দিলো। ভিতরে ঢুকতেই মাথা চক্কর দিতে লাগলো। চারপাশে লাল, নীল, সবুজ মরিচাবাতিতে ভরপুর। আমি সংকোচে মাধুরীর হাত চেপে ধরলাম।

“আরে বেক্কলের মতো ভয় পাচ্ছিস কেন? তুই দাড়া আমি একটা জিনিস নিয়ে আসি” বলে মাধুরী অন্য প্রান্তে চলে গেলো।

চারদিকে অনেক ছেলে মেয়ে। প্রায় সবাই মর্ডান ড্রেস পরে আছে। হৈ-হুল্লোড় নাচানাচি করছে। গান বাজছে। দেখে তো কোনো নরমাল পার্টি সেন্টার মনে হচ্ছে না। অনেকটা টিভি তে দেখানো ডিসকো ক্লাব লাগছে। কিন্তু এখানে মাধুরী আদৌ কারো সাথে কি মিট আপ করতে এসেছে?

খানিকটা দূরে মাধুরী কয়েকজন ছেলে মেয়ের সাথে একটা টেবিলে গোল করে প্যাকেটে থেকে কি জানি খেলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ আমার খুব ভয় লাগতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পরে আর না পেরে ডাক দিলাম। কিন্তু গানের তীব্রতার কারণে হয়তো অইপাশে পৌছালো না।

আমি দাড়িয়ে থেকে মাধুরীকে ফোন দিলাম কিন্তু রিসিভ না করেই চারপাশে তাকালো। আমি হাত দিয়ে ইশারা দিতেই কেমন একটা পৈশাচিক হাসি দিলো। যার অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না। আমার আর ভালো লাগছে না। চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আচমকা একটা ছেলে আমার সামনে এসে দাড়ায়। কি যেন বিরবির করে বলছে। আমি ইগনোর করে অন্য পাশে ফিরতেই ছেলেটা পথ অবরোধ করলো। আরো দুটো ছেলে এসে যোগ দিলো। খুব আজেবাজে কথা বলতে লাগলো।

“চলো ফুলটুসি। আজকে তোমাকে রাতের রানী বানাবো। তোমাকে পাওয়ার জন্য যে চড়া দাম দিয়েছি”

আমি কিছুটা ঘাবড়ে যাই। আমি পিছনের দিকটা খালি আন্দাজ করতে পেরে কৌশলে দৌড় দিলাম। নেশাগ্রস্থ লোকগুলা পিছন পিছন ফলো করছে। রীতি মতো আমার হাত পা,শরীর কাপছে। পা আটকে যাচ্ছে বারবার। সামনে একটা ওয়াশরুম দেখতে পেয়ে দৌড়ে ঢুকে দরজার লক করে দিলাম। লোকগুলা দরজা ধাক্কাতেই শরীর ভয়ে কাটা দিতে লাগলো। আমার এই মুর্হুতে কি করার উচিত কিছুই মাথা আসছে না।

শেষ-মেষ আয়ানকে ফোন করলাম। যদি আয়ান জানতে পারলে আমাকে খুন করবে তবুও এখন আয়ানের চেয়ে ওরা বেশি ডেঞ্জারাস। প্রথম দুইবার রিং বাজলেও রিসিভ হলো না। বাইরে শোরগোল কমলেও দম যেনো আটকে আসছে। চোখ দিয়ে ঝরে পরছে অজস্র অশ্রু কণা। তৃতীয়বার ফোন দিতেই আয়ান কল বেক করলো। আমি আশ্বাস্ত হয়ে চোখ-মুখ মুছে রিসিভ করতেই ভরাট গলায় বললো,

-“আমি দরজার বাইরে, বাইরে এসো”

আমি সাত-পাচ না ভেবে দরজা খুলতেই আয়ানকে দেখে দৌড়ে বের হয়ে এসে উনাকে জাপটে ধরলাম। শ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসছে। সব কথা যেনো গলায় আটকে আছে।

পাশ থেকে একজন পুলিশ কন্সটেবল উদ্বগ্নি সরে বললো,

-“স্যার! এদের এখন কি করবো?”

আয়ান চোখ-মুখ শক্ত করে বললো,

-“এই আয়ান চৌধুরীর বউ এর দিকে নজর দেওয়ার মতো দুঃসাহস করছে। এদের এমন খাতির দারি করো যাতে নিজেরাই নিজেদের দেখলে আত্না কেপে উঠে”

আয়ান চৌধুরীর বউ শুনে অনেকেই চমকালো কিন্তু আয়নের রাগের আভাস পেয়ে কেও আর কথা বাড়ালো না। আসামীদের টেনে হিচড়ে নিয়ে গেলো। আমি নিশ্চুপে সব শুনতে লাগলাম।

_______________

চৌধুরী বাড়ির লিভিংরুমে আমি ফুপিমণিকে জরিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদছি আর ফুপিমণি আমার মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছে। আদ্র ভাইও এখানে আছে। ফুপিমণির সাথে দেখা করতে এসেছিলেন বোধহয়। আর আয়ান ভাইয়া সোফায় বসে মাথা চেপে স্থির দৃষ্টিতে নিচে তাকিয়ে আছে।

-“হয়েছে তো সোনাপাখি! আর কাদে না” সান্ত্বনা স্বরে বললো ফুপিমণি।

-“মাম্মাম! তুমি বুঝতে পারছো কি সাংঘাতিক বন্ধু পাতিয়েছে? ওই মেয়ে ড্রাগস নেয়। যার যাই হোক আমি আহানাকে আর অই ভার্সিটিতে যেতে দিবো না। নেভার!” বলে উঠে দাঁড়ায়। এক পলক তীক্ষ্ণ নজরে আদ্র ভাই এর দিকে তাকিয়ে হনহন করে সিড়ি বেয়ে চলে গেলো।

আয়ান ভাইয়া চলে যেতেই আমি জেদ ধরলাম আর কিছুতেই এখানে থাকবো না। এভাবেও কালকে সবার গ্রামের বাড়ি যাওয়ার কথা। তাই ফুপিমণি রাজি হয়ে গেলেন। আয়ান আগেই জানিয়েছে উনি যাবেন না। তাই আমি, ফুপিমণি আর আদ্র ভাই গ্রামের বাড়ি পাড়ি দেওয়ার জন্য মন স্থির করলাম।

_________________

ছাদের এক কোণায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাতের চাঁদ দেখছি। গ্রামে আসতে আসতে রাত হয়ে গেসে। আমি আকাশের পানে তাকিয়ে আয়ানের কথা ভাবসি। অজান্তেই চোখ বেয়ে এক কণা অশ্রু বিসর্জন দিলো। এর পরিপক্ক কারণ আমারো যে জানা নেই।

-“আহানা তুই এই সময়ে এখানে?”

পিছন থেকে আদ্র ভাই এর কথা বোধগম্য হতেই চোখের পানি আড়ালে মুছে হালকা হাসলাম।

-“এমনি। আচ্ছা তুমি থাকো” বলে এক প্রকার ইগনোর করে চলে আসলাম।

আমি চলে আসতেই আদ্র ভাই আকাশের লক্ষ তারাকে সাক্ষী রেখে বিড়বিড়িয়ে বললো,

-“দুনিয়া এমন কেনো? যাকে চাই তাকে পাই না, আর যা পেতে চাই না তাই পাই” বলে গভীর একটা শ্বাস ফেললো।

#চলবে…

[আগামী পর্বে রহস্য উন্মোচন করে দেওয়া হবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here