প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ১৯+২০

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

১৯.

-আজ সকালে খইয়ের মা মারা গেছে। মেয়েটা অনাথ।

বাবার মুখে কথাটা শুনে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্ত পিয়ালী। ডাইনিং টেবিলে ছেলেমেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছিলেন সাদিক সাহেব। খই নিজের ঘরেই ছিলো। সাদিক সাহেবকে ওরা কেউই কিছু জিজ্ঞাসা করেনি খইকে নিয়ে। জানে সময় হলেই ওদের সবটা বলবেন সাদিক সাহেব। চুপচাপ বাবার হাতে খাবার খাচ্ছিলো দুজনে। হঠাৎই বাবার এমন কথা শুনে থেমে রইলো দু ভাইবোন। পিয়ালী বললো,

-কি বলছো তুমি বাবা? আজই ওর মা…?

সাদিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। খাবার মাখাতে মাখাতে বললেন,

-হ্যাঁ। মেয়েটার আপনজন বলতে ওর মা-ই সব ছিলো। বাবা নাকি মারা গেছে অনেক আগেই। মৃত্যুর আগে ওর মা বলে গেছে, আত্মীয়স্বজন নেই ওদের কোনো।

-ওমন মিষ্টি মেয়ে কোথায় কিভাবে থাকবে, কে কিভাবে রাখবে, বিষয়গুলো বেশ ভাবাচ্ছিলো। আমার তখন আর কিছুই মাথায় আসেনি প্রাপ্ত। গ্রামপঞ্চায়েতের অনুমতি নিয়ে তাই ওকে এখানেই নিয়ে এসেছি।

প্রাপ্ত নিচদিক তাকিয়ে ভাবছিলো কিছু। বাবার কাছে নিজের নাম শুনে খানিকটা ধ্যানভাঙা চাওনিতে চোখ তুলে তাকালো ও।‌ সাদিক সাহেব ওরই দিকে তাকিয়ে। প্রাপ্ত আশ্বস্তের হাসি ঝুলিয়ে বললো,

-ডোন্ট ওয়ারী বাবা। ও খুব ভালো থাকবে এখানে।

-আর ওকে ভালো রাখার সে দায়িত্বটা আমাদের। তাইনা প্রাপ্ত?

মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়লো প্রাপ্ত। দু সেকেন্ড নিরবতার পর পিয়ালী টুপ করে বাবার হাতে থাকা লোকমা নিজের মুখে পুরে নিলো। যদিও ওটা প্রাপ্তর দিকে ছিলো। প্রাপ্ত ওর চুল টেনে দিলো জোরেসোরে। দুজনকে হাসিখুশি দেখে খাওয়ানো শেষ করলেন সাদিক সাহেব। খাওয়া শেষে চলে গেলেন নিজের ঘরে। পিয়ালীও পড়তে বসবে বলে ঘরে চলে গেলো। কি ভেবে প্রাপ্ত খইয়ের ঘরের দিকে এগোলো। দরজায় দাড়িয়ে দেখে খই হাটু জরিয়ে মেঝেতে বসে আছে। বড়বড় খোলা চুলগুলো পিঠ-কোমড় ছাপিয়ে, মেঝেতে পরে আছে। প্রথমে প্রাপ্ত ভেবেছিলো হয়তো খইয়ের চুল তেমন বড় না। এবার বুঝলো, সেদিন ভাজ দেওয়া ছিলো ওর‌ বিনুনি।‌ দরজা থেকে কয়েকপা এগোতেই প্রাপ্ত টের পেলো খই ফোপাচ্ছে। কাদছে ও। প্রাপ্তর কি হলো, আর এগোলো না ও। পিছিয়ে দরজায় চলে এলো আবারো।

নিজেকে পেছোতে দেখে চরমমাত্রায় অবাক হলো প্রাপ্ত। আজ কি তবে ওর সাহস কম পরে গেলো কোনোভাবে? যেনো ও চাইছে না খইকে সহমর্মিতা জানাতে। বারবার মনে হচ্ছে মা হারানোর যন্ত্রনায় তো ইচ্ছেকেও কাদতে দেখেছে ও। সেদিন তো ইচ্ছেকেও‌ সমবেদনা জানাতে পারে নি। আজ কি করে খইকে শান্তনা দেবে ও? ইচ্ছের ক্ষেত্রে তবে অন্যায় হবে না? আকাশকুসুম ভাবনার শেষে নিজের মাথার চুলগুলো উল্টে ধরলো প্রাপ্ত। এখানেও ইচ্ছে! কেনো? এখানে ইচ্ছের তো থাকার কথা নয়! কোথাওই থাকার কথা নয় ওর! ও তো ওর চিন্তার বিপরীর সত্ত্বা! তবে ও কেনো জুড়ে যাবে ওর চিন্তায়? কেনো? একরাশ অস্থিরতা নিয়ে এবার বাসা থেকেই বেরিয়ে এলো প্রাপ্ত। বাইকটা নিয়ে অজানা কোনো গন্তব্যে এগোবে বলে। বাসায় থাকলে এই অস্থিরতা বাড়বে বই কমবে না। মুদি দোকান থেকে ওকে বাইকে চড়তে দেখলো মাহীম। দৌড় লাগালো তৎক্ষনাৎ। দুর থেকে ডাক লাগিয়ে বললো,

-প্রাপ্ত? আমিও যাবো! বাইক থামা! প্রাপ্ত?

প্রাপ্ত পেছন ফিরে দৌড়াতে দেখলো ওকে। না চাইতেও বাইক থামালো ও। মাহীম বাইকের কাছে এসে হাটুতে হাত রেখে হাপাতে লাগলো। প্রাপ্ত বললো,

-কোথায় যাবি?

-তুই যেখানে যাবি।

দাত কেলিয়ে বললো মাহীম। প্রাপ্ত কিছু বললো না আর। মাহীম ঝটপট উঠে বসলো ব্যাকসিটে। একটু গা ছাড়াভাবেই বসেছিলো ও। প্রাপ্ত বাইক ছুটাতেই প্রায় পরে যাওয়া অবস্থা ওর। কোনোমতে সামলালো নিজেকে। বাইকের একটু বেশিই গতি দেখে বললো,

-কিরে? এতো জোরে বাইক কেনো চালাচ্ছিস?

-কিরে? হয়েছে কি তোর?

-ক্ষেপেছিস কেনো প্রাপ্ত?

প্রাপ্ত আরো জোরে চালাতে লাগলো বাইকটা। মাহীম কিছুই বুঝে উঠলো না। ওর কথায় আরো যেনো সমহারে গতি বাড়লো বাইকের। তাই সিদ্ধান্ত নিলো কথাই বলবে না আর। মনেমনে নিজেকে গালি দিতে লাগলো যেচে প্রাপ্তর বাইকে ওঠা নিয়ে। মনপ্রানের বিদ্ধস্ততা নিয়ে বাইক চালাতে গিয়ে প্রাপ্ত এতোটাই বেখেয়ালী হয়ে পরেছিলো যে, রাস্তায় যে ট্রাফিক সিগনাল পরেছে সেটা খেয়ালই করিনি ও। রঙরুটে চলে এসেছে ট্রাফিক অমান্য করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রাপ্তর বাইককে আরেকটা বাইক ধাক্কা মেরে দিয়ে যায়। বাইকসহ প্রাপ্ত-মাহীম দুজনেই গরিয়ে পরলো রাস্তার পাশে।

প্রাপ্তরা ছিটকে পরার পরপরই একটা দ্রুতগতির ট্রাক একদম পাশ কাটিয়ে চলে যায় ওদের। কয়েকজন পথচারী এসে জড়ো হয় ওদের চারপাশে। বাইক থেকে পরে খুব বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি দুজনের কারোরই। প্রাপ্তের বা হাতের কনুই আর মাহীমের হাটুতে ছড়ে গেছে। তবে বাইকে ধাক্কা না লাগলে ট্রাকের সাথে বড়সর একটা এক্সিডেন্ট হয়ে যেতো ওদের। তাই অন্য বাইকটার প্রতি ক্ষোভ নেই কারো। প্রাপ্তর রঙরুটে আসা উচিত হয়নি, এমনটাই বলছিলো ওরা। প্রাপ্ত গায়ের ওপর থেকে বাইকটা সরিয়ে উঠে হাত ঝারলো। মাহীমকে তুলে দাড় করিয়ে বললো,

-ঠিক আছিস তুই?

-হুম। তোর কিছু হয়নি তো?

মাহীমকে মাথা নেড়ে ঠিক আছে বুঝালো প্রাপ্ত। তারপর বাইক তুলে দাড়ালো ঠিকঠাকমতো। আশপাশের কথাগুলোকে পাত্তা না দিয়ে সবে বাইকে চড়ে বসতে যাবে, প্রাপ্ত দেখলো ওদেরকে ধাক্কা মেরে যে বাইকটা গিয়েছিলো, সেটা আবারো ওদের দিকেই আসছে। হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সরুদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ও বাইকারের দিকে। দুজন আছে। দুজনেই হেলমেট পরিহিত। কামিজ পরনের পেছনেরটা যে মেয়ে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সামনের জনকে নিয়ে কিছু আন্দাজ করার আগেই বাইকটা একদম ওর সামনে এসে থামলো। বাইক চালক বাইকে বসেবসে সুন্দরমতো বুকে হাত গুজে বললো,

-হোয়াটস্ আপ মিস্টার গ্যাংস্টার? রঙরুটে কি মনে করে?

গলার স্বর শুনেই‌ প্রাপ্তর চেনাচেনা লাগছিলো। আর এই গ্যাংস্টার সম্বোধনে আরো নিশ্চিত হয়ে গেলো ও। এই বাইকার, ইচ্ছে। পেছনে গিটারের ব্যাগ নিয়ে বসে থাকা মেয়েটা ভয়ে ভয়ে হেলমেট খুললো নিজের। সে রাকা। ওকে দেখে মাহীমও‌ বুঝে গেলো, বাইকের চালক আর কেউ নয়, স্বয়ং ইচ্ছে। সবার সামনে যে ও হেলমেট খুলবে না, সেটা বুঝলো‌ প্রাপ্ত। হাত মুঠো করে‌ দাড়িয়ে রইলো চুপ করে। ঠিক কি ঘটছে ওর সাথে? এই মেয়েটার থেকে সরে যেতে গিয়ে আরো জরিয়ে কেনো যাচ্ছে ও? নিজের উপরই রাগ হচ্ছে প্রচন্ড ওর। শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো শুধু। ওর মুঠো করা হাত দেখে হাসি পেলেও হাসলো না ইচ্ছে। গুন্ডামো আটকানোর এই ভঙিমাটার সাথে পরিচিত হয়ে গেছে ও। রাকাকে বাসা থেকে পিক করতে গিয়েছিলো। ফেরার পথে রঙরুটে ঢুকে পরা বাইকটাকে ট্রাকপেষা হওয়ার হাত থেকে বাচাতে, বাধ্য হয়েছে নিজের বাইকেই ধাক্কা লাগাতে। ঘটনার পর বুঝলো ওটা প্রাপ্তর বাইক ছিলো। মুচকি হেসে ইচ্ছে আবারো বললো,

-বললে না? রঙরুটে কেনো এসেছিলে? মারতে তো নয়।‌ দেন? মরতে?

-দ্ দেখ ইচ্…

কাপাকাপা‌ গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলো রাকা। ইচ্ছে ওকে বলার সুযোগ দিলো না। প্রাপ্তকে উদ্দেশ্য করে আফসোসের স্বরে বললো,

-শিট! যদি তুমি সত্যিই মরতে এসে থাকো, আমি তো তোমাকে মরতে দিলাম না! ইশ্! কত্তোবড় ভুল করে ফেললাম। অবশ্য ভুল করলে‌ আমি সরি বলতে জানি। কেউ সরি এক্সেপ্ট না করলে, সেটাকেও এক্সেপ্ট করতে পারি। নট লাইক ইউ! ইউ নো!

প্রাপ্তর চেহারায় রাগ ফুটে উঠলো আরো। হেলমেটের আড়ালে ইচ্ছে ঠোট টিপে হাসলো। তারপর প্রাপ্তর দিকে আরেকটু মুখ এগিয়ে বললো,

-আর যদি মরতে না এসে থাকো, দেন তোমাকে আজ আমি বাচিয়ে দিয়ে গেলাম মিস্টার গ্যাংস্টার। তবে এর জন্য কিন্তু তোমার কাছ থেকে একদমই থ্যাংকস্ এক্সপেক্ট করছি না! ট্রাস্ট মি!

ওর কথা শুনে রীতিমতো ভয়ে আছে রাকা, মাহীম। ইচ্ছে যেনো ইচ্ছে করেই উ’স্কা’চ্ছে প্রাপ্তকে। আর সেটার পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না বলে দুজনেরই ভয়। কথাটা বলে ইচ্ছে আগের মতোই ঠোট টিপে হাসতে হাসতে প্রাপ্তর প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় রইলো। ভেবেছিলো হয়তো পাব্লিক প্লেসেই ওকে বলবে কিছু একটা। ওকে অবাক করে দিয়ে আচমকাই ঠা’স করে পাশের একটা ছেলের গালে চ’ড় লাগিয়ে দিলো প্রাপ্ত। ইচ্ছে, রাকা, মাহীম তিনজনসহ উপস্থিত বাকিরা সবাইই চমকে উঠেছে। মাহীম ওর গালে আলতোভাবে হাত বুলিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,

-আলহামদুলিল্লাহ আমার গালটা বেচে গেছে।

সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ছেলেটা ছুট লাগাতে যাচ্ছিলো। প্রাপ্ত ওর কলার ধরে ফেলেছে। ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে, দাতে দাত চেপে বললো,

-ভীড়ের সুযোগ নেওয়া উচিত হবে?

ইচ্ছে কি বলবে, কিছুই বুঝে উঠলো না। ভীড়ের ঠিক কেমন সুযোগ নেওয়ার কথা বুঝালো এই‌ লোকটা? প্রাপ্ত ছেলেটার দিকে ফিরলো এবার। শান্তভাবে বললো,

-যেই দেখলি লোকজন জড়ো হয়েছে, ভীড়ের সুযোগ নিয়ে নিজের পকেট ভারী করতে লেগে পরলি তাইনা? তো এখানকার কার মানিব্যাগটা মে’রে দিলি শুনি? কতো আছে ওটাতে?

সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো প্রাপ্তর দিকে। তারপর নিজেদের পকেট চেইক করতে লাগলো। ছেলেটা নিজেও অবাক। একজন বললো তার মানিব্যাগ নেই। প্রাপ্ত ইশারা করে মানিব্যাগ বের করতে বলতেই তৎক্ষনাৎ নিজের পকেট থেকে একটা মানিব্যাগ বের করে সামনে ধরলো ও। প্রাপ্তর সামনে হাতজোড় করে বললো,

-ভ্ ভুল হয়ে গেছে ভাই! ভুল হয়ে গেছে!

প্রাপ্ত লোকগুলোর হাতে ছেড়ে দিলো ছেলেটাকে। সবাই ওকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। ইচ্ছে শুধু দেখলো সবটা। প্রাপ্ত এগিয়ে এসে হুট করে ইচ্ছের গলায় প্যাঁচানো স্কার্ফ ধরলো। বিস্ফোরিত চোখে ওর দিকে তাকালো ইচ্ছে। প্রাপ্ত বেপরোয়াভাবে ওর স্কার্ফের একাংশ একটানে ছিড়ে ফেললো। আঁতকে উঠলো রাকা, মাহীম। প্রাপ্ত আগের মতোই গা ছাড়া ভাবে স্কার্ফের টুকরোটা নিজের কনুইয়ের কাটা জায়গায় প্যাঁচালো। তারপর ইচ্ছের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে শান্তশিষ্টভাবে বললো,

-থ্যাংকস্।

ইচ্ছে যেনো থমকে আছে। নির্বিকারচিত্ত্বে নিজের বাইকে চড়ে বসলো প্রাপ্ত। মাহীম ওর প্যান্টের হাটুর দিকে ছিড়ে যাওয়া অংশটার দিকে কাদোকাদোভাবে তাকালো একপলক। আরেকপলক তাকালো রাকার ওড়নাটার দিকে। ‘আই উইশ, প্রাপ্তর মতো করে থ্যাংকস্ বলতে পারতাম’ মনেমনে এমন আফসোসপর্ব শেষ করে চড়ে বসলো ব্যাকসিটে। প্রাপ্ত বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো। ওরা চোখের আড়াল হতেই গলার ছেড়া স্কার্ফটা আস্তেধীরে হাতে তুলে ধরলো ইচ্ছে। নিশব্দে হেসে দিলো হঠাৎই। ঠোটে মুচকি হাসিটা রেখে বাইকের আয়নায় রাস্তার দিকে দৃষ্টিস্থির করে বললো,

-হি ইজ সামথিং এলস্। স্ট্রেইন্জ একটা লোক।

-অদ্ভুত না ইচ্ছে। যখন সে তোর ঠোটে হাসির কারন, হি ইজ স্পেশাল ইচ্ছে! ভেরি স্পেশাল!

রাকার কথায় কিঞ্চিত চমকে উঠলো ইচ্ছে। হেলমেটের আড়ালের হাসিটা কি করে দেখলো ও, কে জানে! কিন্তু ওর কথাটা সত্যিই কি অযৌক্তিক? প্রাপ্ত কি সত্যিই ওর হাসির কারন নয়? নিজেকে প্রশ্ন করে থমকে গেলো ইচ্ছে। এ প্রশ্নের উত্তর ওর অনুকুলে নয়। তাকে বরং উপেক্ষা করাই শ্রেয়!
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২০.

-প্রাপ্ত, মাহীম কোথায় গেছে রে সাফোয়ান? আর তুই হঠাৎ এ বাসায় কেনো? অরি কল করে বললো তোর নাকি…

রুমে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বলছিলো মিষ্টি। কিন্তু কথা শেষ না করেই থামতে হলো ওকে। সাফোয়ান উদোম গায়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে। শার্ট খুলে কাধের দিকের ক্ষতটায় ওয়েন্টমেন্ট লাগাচ্ছিলো ও। মিষ্টির আওয়াজ‌ শুনেই ধরফড়িয়ে উঠলো সাফোয়ান। তরিঘড়ি করে গায়ে জড়ালো শার্টটা। ওর হাত থেকে ওয়েন্টমেন্টও নিচে পরে গেছে। কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মিষ্টি। সাফোয়ান শার্ট আঁকড়ে ধরে বললো,

-একবার নক করে আসবি না?

কুঁচকানো কপাল আরো কুঁচকে ফেললো মিষ্টি। সাফোয়ান বিপাকে পরে গেছে। রুমটা তো মিষ্টিরই। ও ভেবেছিলো এ সময় আসবে না ও। তাই ফার্স্ট এইড বক্স নিতে মিষ্টির রুমেই ঢুকে পরেছে ও। সাফোয়ান বেশ বুঝতে পারলো, ওকে ওই অবস্থায় দেখে মিষ্টি বিন্দুমাত্রও লজ্জা পায়নি। উল্টো লজ্জা যেনো ওরই পুরুষভূষণ হয়ে উঠেছে। আমতাআমতা করে বললো,

-ক্ কিছু বলবি?

মিষ্টি নিশব্দে ঘরে ঢুকলো। সাফোয়ানের পেছনে দাড়িয়ে ওর কাধের দিকে তাকিয়ে বললো,

-কি হয়েছে এখানে?

-ও কিছু না। তুই বল কি বলছিলি। আমি…

মেঝে থেকে ওয়েন্টমেন্ট তুলে মিষ্টি নিজেই সাফোয়ানের কাধে হাত লাগালো। সাফোয়ান সরে যাচ্ছিলো। মিষ্টি ওর হাতের কবজি আঁকড়ে ধরে বললো,

-একচুলও নড়বি না। কিভাবে লাগলো?

মিষ্টি ঔষুধ ছোয়ালো ওর ক্ষততে। সাফোয়ান আর বাধা দিলো না। ব্যথায় চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিয়ে বললো,

-রাস্তায় দুই গ্রুপের মারামারি হচ্ছিলো। সামলাতে গিয়ে কেটে গেছে কিছু একটাতে।

আর কিছু বললো না মিষ্টি। সামনে এসে সাফোয়ানের হাতে ওয়েন্টমেন্ট ধরিয়ে দিয়ে‌ বললো,

-সাবধানে কাজ করবি তো।

-বিনামুল্যে নার্সিং সেবা পেলে আর সাবধানে কাজ করতে ইচ্ছা করেনা রে মিষ্টি!

সাফোয়ানের কথায় ঠাট্টার আভাস। মিষ্টি হাসলো না। সাফোয়ান হাসি থামিয়ে‌ শার্ট পরতে পরতে বললো,

-আজ এতো আগেআগে চলে এলি কি জন্য?

-পিয়ালী কল করেছিলো আমাকে। সাদিক আঙ্কেল নাকি খই নামের একটা মেয়েকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে। গিয়েছিলাম ওখানে। মেয়েটা তো…

-তুই গিয়েছিলি? তো মেয়েটাকে এখনো মিষ্টিঘরে আনিস নি কেনো?

মিষ্টি আবারো কপালে ভাজ ফেলে তাকালো সাফোয়ানের দিকে। বললো,

-তুই জানিস খইয়ের বিষয়ে?

-তো তোর কি মনে হয়? পুলিশকে ইনভল্ব না করেই সাদিক আঙ্কেল একটা মেয়ের দায়ভার নিয়ে নেবে? আইনি ঝামেলা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান আছে তার। আগে থেকেই জানিয়েছে আমাকে মেয়েটার ব্যাপারে। ওই গ্রাম ছাড়ার সময়ই।

একদম স্বাভাবিক গলা সাফোয়ানের। মিষ্টির কিঞ্চিত অভিমান হলো। সবটা জেনেও সাফোয়ান ওকে জানায় নি কিছুই। অবশ্য প্রাপ্তর কল্পনার সে রুপ সত্যিই ওর জীবনে এসেছে, এ নিয়ে যথেষ্ট খুশী ও। পিয়ালীও কতো খুশি! সাদিক সাহেব তো মনেমনে খইকে বৌমা মেনেই নিয়েছেন হয়তোবা। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে সাফোয়ান পেছন ফিরলো। বললো,

-কিরে? চুপ করে আছিস যে?

-হুম? কিছুনা। দেখনা! অতঃপর আমাদের প্রাপ্তর কল্পনায় থাকা সেই শ্যামাকন্যা সত্যিসত্যিই ওর জীবনে এন্ট্রি নিলো‌ বল? ভালোই হলো। এবার আর অস্বীকারের সুযোগ নেই। ঠিকই এই খইয়ের সাথে প্রেমনোঙরে বাধা পরতে চলেছে সাদমান ইনাব প্রাপ্ত। আফটার অল, ও যেমনটা চেয়েছিলো, তেমন কাউকেই পেয়ে গেছে বলে কথা!

-আর যদি সে প্রেমনোঙর আমার চাওয়ার বিপরীত স্রোতে আটকে যায়, সে দায় কার মিষ্টি? সেই বিপরীত স্রোতস্বীনির? নাকি নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পারা এই আমিটার? কার?

প্রাপ্তর গলা শুনে থমকে উঠে পেছন ফিরলো মিষ্টি। দরজায় দাড়িয়ে প্রাপ্ত। ওর ঠিক পেছনে ঝুকে হাটু ধরে দাড়িয়ে আছে মাহীম। প্রাপ্তর কথা শুনে অবুঝভাবে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো সবগুলো। মাহীম একটুপরেই ব্যথায় কুকড়ানো কন্ঠে বললো,

-ওয় সিস্টার? নিজের সিস্টাররুপ নয়তো মাদার তেরেসা ফর্মে আয়। আমার পা দেখ আগে! বাচা আমাকে ভাই! দেখ কতোখানি ছড়ে গেছে!

মিষ্টি এগোলো। খানিকটা ঝুকে মাহীমের হাটু পরখ করে নিয়ে বললো,

-এখানে ঔষুধ লাগালে ঔষুধকে অপমান করা হবে। কিছুই হয়নি। বাসায় গিয়ে ডেটল দিয়ে ধুয়ে নিস। আমার বাসার ফার্স্ট এইড বক্স পুরো মিষ্টিঘরের বাচ্চাকাচ্চার কাজে লাগে। ওয়েস্ট করবো না।

মাহীম হতবিহ্বলের মতো তাকিয়ে রইলো ওর‌ দিকে। মিষ্টি ওর সে চাওনিকে পাত্তা না‌ দিয়ে প্রাপ্তর দিক ফিরে‌ বললো,

-হ্যাঁ, কিছু বলছিলি তুই। আবার বলতো?

-কিছুনা।

সাফোয়ান এগিয়ে এসে বললো,

-খইয়ের‌ সাথে কথা বলেছিস?

-সেভাবে না।

-তো কথা বল প্রাপ্ত! মেয়েটা আর কতোদিন ওভাবে ঘরের কোনে আটকে রাখবে নিজেকে? আর কতোদিন ওভাবে গুমড়ে গুমড়ে মরবে? আমাদের সবারই ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে হবে তো! সাদিক আঙ্কেল‌ একা আর কতো করবে বল?

প্রাপ্ত কিছুই বললো না। হাতে বাধা স্কার্ফের টুকরোর দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। মিষ্টি বললো,

-মেয়েটাকে‌ স্বাভাবিক‌জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে প্রাপ্ত। ওকে দেখলে মনে হয়, যেনো বেচে থেকেও মরে গেছে, মরে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

-তোর হাতে কি হয়েছে আবার?

প্রাপ্তর দোটানা আরো গাঢ়তর হলো। অস্থিরতা বাড়লো আবারো। বেরিয়ে আসলো ও মিষ্টির বাসা থেকে। সোজা নিজের বাসায় ঢুকে খইয়ের রুমের দিকে তাকালো। দরজা লকড্ না। পিয়ালীর রুমে এখনো লাইট অন। পড়ছে হয়তো। প্রাপ্ত এগোলো খইয়ের ঘরের দিকে। দরজায় দুবার টোকা দিয়ে বললো,

-খই?

সাড়া এলো না। প্রাপ্ত দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। খই দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে। এবার মুখটা দেখা যাচ্ছে ওর। কাদতে কাদতে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে একদম। প্রাপ্ত আরো এগোলো। মিহিস্বরে বললো,

-আর কতো কাদবে?

-তুমি এভাবে কাদলে তোমার মা ফিরবে না খই।

-নিজেকে আর কষ্ট দিও না প্লিজ। আমি, পিয়ালী, বাবা, মিষ্টিঘরের সবাই আছি তো তোমার পাশে। জীবন তো এভাবে চলে না বলো?

-তুমি যদি চাও, আমি বাবাকে কালই‌ বলবো তোমার পড়াশোনা নিয়ে কিছু ভাবতে। তোমার যে বিষয়ে পড়াশোনার ইচ্ছে…

ইচ্ছে শব্দটা উচ্চারনের পরপরই থেমে গেলো প্রাপ্ত। দুহাত মুঠো করে নিলো তৎক্ষনাৎ। খই তখনো একধ্যানে নিচদিক তাকিয়ে।‌ নিজেকে সামলে প্রাপ্ত বললো,

-যেমনটা তুমি চাও, তেমনটাই হবে।

-হু।

পুরোটা শুনে এই এটুকোই বললো খই। প্রাপ্ত আর একমুহুর্ত দাড়ালো না। শান্তনা দেওয়ায় যে ও সনদপ্রাপ্ত কাচা, তা টের পেলো বেশ। আর তার সাথে ইচ্ছের নাম জুড়ে আরো সবটা এলোমেলো করে দিয়েছে। প্রাপ্ত বেরিয়ে যাবার অনেকটা সময় পর খই চোখ তুলে জানালায় তাকালো। খোলা জানালার‌ পর্দার আড়ালে একফালি চাঁদ‌ দেখা‌ যায়। তারা কি আছে? পাশের দালানের জন্য আকাশের পুরোটা দেখা‌ যায় না। চোখের কোনের জল শুকিয়ে উঠেছে খইয়ের। সবাই দয়া করছে ওকে। এ শহরে সবার শান্তনা পর দয়ার পাত্রী ও। আচমকাই খইয়ের কি হলো, বেরিয়ে এলো নিজের‌ ঘর থেকে। ড্রয়িংরুমে এসে আবছা আলোয় চোখ বুলালো আশেপাশে। কেউই‌ জেগে নেই। গুটিগুটি পায়ে এগোলো দরজার‌‌ দিকে। দম বন্ধ লাগছে ওর‌ এ বাসায়। এক ঘরে। ভাদুলগায়ের বটতলা, শুকমরার পাড় ছেড়ে এই ইটপাথরের দালানের মাঝে শ্বাস নিতে‌ কষ্ট হচ্ছে ওর।

দরজায় কাপাকাপা হাত লাগালো খই। কয়েকবার চেষ্টার পরও খুলতে পারলো না ওটা। চোখ গেলো উপরে উঠে‌ যাওয়া‌ সিড়িটার দিকে। একটা বড়সর দম নিলো খই। আজ ও বেরোবেই। যে করেই হোক! সিড়ি‌ বেয়ে উপরে উঠে‌ এসে নিজেকে ছাদে আবিষ্কার করলো খই। দ্বিতল ভবনের ছাদ থেকে রাতের শহরের উপরে আকাশে জ্বলতে থাকা তারা, নিচে জ্বলতে থাকা হাজাররঙা বাতিগুলো দেখে বিস্ময় জাগলো না ওর চোখে। বরং অচেনা জায়গার অনুভবে কান্নাগুলো দলা পাকিয়ে আসতে লাগলো গলায়। চোখ এদিকওদিক সরিয়ে খানিকটা দুরেই‌ জলাধার দেখতে পেলো খই। চাঁদের আলোর‌ প্রতিফলনে ঝিলমিল করছে সে জলাধারের পানি। শুকমরার কথা‌ মনে পরে গেলো খইয়ের। এভাবেই কতো রাত জেগে শুকমরার তীরে বসে চাঁদ তারার সাথে আড্ডা দিতো ও। মায়ের কোল ছেড়ে উঠে আসতো নিজের সময় বের করবে বলে। আর আজ ওর মনপ্রান শুধু সেই ছত্রতলটাই খুজে চলেছে। একটু শান্তি, একটু স্বস্তির একটা জায়গা।

খই ছাদের রেলিং ঘেষে দাড়ালো। নিচ অবদি লাফিয়ে পরলেও খুবএকটা ক্ষতি হবে না‌ ওর। এর চেয়ে আরো উচু পেয়ারগাছ, গাবগাছ, আমগাছ থেকে পরার অভিজ্ঞতা আছে ওর। এমনটা ভাবনা মস্তিষ্কে আসলেও‌ তাতে‌ সায় দিলো না খই। নিচে তাকিয়ে‌ দেখলো উপরের ছাদ থেকে পাইপলাইন একদম নিচ অবদি চলে গেছে। অনায়াসে সেটা ধরেই নেমে যাওয়া‌ যাবে। খই ওর কামিজের ওড়না কোমড়ে‌ গিট দিলো। পাইপ ধরে ছাদ থেকে নিচতলায় নেমে আসলো অতি সহজেই। একটা শুকনো ঢোক গিলে আশেপাশে তাকালো আরেকবার। আগের খই হয়তো মনেমনে নিজেকে প্রশ্ন করতো, ব্যস্ত শহরও বুঝি রাতে ঘুমায়? কিন্তু এই খই নিজেকে বোঝালো, ভালো হয়েছে কেউ‌ জেগে নেই। ভালো হয়েছে, আমাকে দয়া করার জন্য কেউ‌ জেগে নেই।

খই এগোলো। ছাদ থেকে যেদিকে ঝিলটা দেখেছিলো, ঠিক সেদিকেই। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরদুটোকে দেখে স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এরা অন্তত ওকে দয়া দেখাবে না। এরা মানবতা বোঝে। কয়েককদম হাটতেই খই দেখতে পেলো সে ঝিলের সামনে একটা কালো গাড়ি দাড়িয়ে। আর গাড়ির বাইরে কোনো এক পুরুষ অবয়ব বুকে দুহাত গুজে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে। খই থামার পরিবর্তে সে মানুষটার দিকে তাকিয়ে থেকেই একপা দুপা করে এগোতে লাগলো। মধ্যবর্তী দুরুত্ব কমার সাথেসাথে হৃদস্পন্দন বাড়তে লাগলো খইয়ের। আরো খানিকটা এগোনোর পর পেছন থেকে‌ স্পষ্ট হলো সে অবয়ব। চোখ ফেটে জল‌ বেরিয়ে এলো খইয়ের। একছুটে গিয়ে পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো সে মানুষটাকে। তার বুকের শার্ট সর্বশক্তিতে খামচে ধরে, হুহু করে কাদতে কাদতে বললো,

-এইডা কি সত্যই তুমি? নাকি তোমার জ্বী’ন নকশাদার? কও না তুমি সত্যই আইছো! কও না! দয়ার পরিবর্তে আমারে একটু শান্তি দেও না এইডা কইয়া নকশাদার! একটু শান্তি দেও? দেখো না! আমি যে কাইন্দাও শান্তি পাইতাছি না! কান্দার মতোন জায়গাডা‌ নাই আমার! মা যে আর নাই! আমার চেনা আর‌ কেউ‌ নাই এই বিরাট দুনিয়ায়। এই অচেনা শহরে আমি একা। আমি ভালো নাই নকশাদার! ভালো নাই!

খইয়ের আচমকা আলিঙ্গনে কেপে‌ উঠেছিলো সে অবয়ব। তবে ওর কথাগুলো শুনে আলতোভাবে ওর হাতে হাত রাখলো সে। সময়ের‌ অতিবাহন আর খইয়ের কান্না শুনে‌ শক্ত করে‌ মুঠো করে‌ ধরলো সে খইয়ের হাতজোড়া। শীতল কন্ঠে বলে উঠলো,

-আমিও ভালো নেই খই। একদমই ভালো নেই।

#চলবে…

[ রিচেইক হয়নি। 🙁 ]
#চলবে…

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here