প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ২১+২২

#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২১.

প্রায় দশমিনিট খইয়ের কান্না নিরবে সয়ে নিলো রাকীন। ওর পিঠে লেপ্টে থেকে মেয়েটা অঝোরে কেদে চলেছে এতোক্ষন হলো। বাধা দেয়নি ও। বাধা দেওয়াটা উচিত বলে মনে হয়নি ওর। এভাবে কাদাটা জরুরি ছিলো খইয়ের জন্য। ওকে নিয়ে সাদিক সাহেব শহরে চলে আসার পর ভাদুলগায়ে একটা একটা মুহুর্ত অস্থিরতায় কেটেছে রাকীনের। পড়ন্ত বিকেলের রোদ্দুরটা আজ যখন আরেকদফায় শুকমরার তীরকে বিদায় জানাচ্ছিলো, সে অস্থিরতাকে বাস্তবে রুপ দিতে বাধ্য হলো রাকীন। নির্মানাধীন ব্রীজটার কাগজপত্র ব্যাগে তুলে উঠে পরে ঢাকার ফিরতি ট্রেনে। আসার আগে গ্রামপঞ্চায়েতের কাছ থেকে সাদিক সাহেব আর মিষ্টিঘরের ঠিকানা নিয়ে এসেছে ও। বাসায় ফিরে দু দন্ডও দেরি করেনি। গাড়ি নিয়ে তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পরেছে মিষ্টিঘরের উদ্দেশ্যে। তবে ঠিক কেনো, কোন টানে ছুটে এসেছে এখানে, সে প্রশ্নের উত্তর জানা নেই বলে মিষ্টিঘরে যাওয়ার সাহস হয়ে ওঠেনি রাকীনের। ঝিলের দিকটায় গাড়ি থামিয়ে সেই প্রশ্নেরই উত্তর খুজছিলো ও। শুনশান রাতের একলা মানবসত্ত্বা জাগ্রত হয়ে শুধু এটুকো জানান দিয়েছে, খইকে ছাড়া ভাদুলগাঁয়ে ভালো ছিলো না ও। একদমই ভালো ছিলোনা। একসুরে বাধা পরতে সেই মেয়েটিই কি করে ওর বুকে এসে মুখ গুজবে, তা কি করে জানবে ও? খইকে ছাড়িয়ে নিয়ে পেছন ফিরলো রাকীন। ঝাপসা চোখ তুলে তাকালো খই। রাকীন ওর দুগালের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,

-কেদেকেদে এ-কি হাল করেছো নিজের?

খই নিজেকে ছাড়িয়ে একপা পেছোলো। কিঞ্চিত অবিশ্বাসে তাকিয়ে রইলো রাকীনের দিকে। একটু চুপ থেকে আবারো ফুপিয়ে কেদে দিয়ে বললো,

-আমার মা আর নাই নকশাদার! আ্ আমি অন্…

আর কিছু বলার আগেই ওর হাত ধরে একটানে ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো রাকীন। শক্ত করে জরিয়ে রাখলো খইকে। খই আরো শব্দ করে কেদে দিলো এবার। রাকীন বললো,

-হুশ! কাদে না! আর কেদো না! কাদলে মা আরো কষ্ট পাবে খই! এভাবে কাদতে নেই।

-কান্না থামাও খই। অনেক কেদেছো।

খইয়ের থামার নাম নেই। রাকীন ওর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

-কান্না না থামালে জ্বী’ন ঘাড় ম’ট’কে দেবে কিন্তু এবার!

মাথা তুলে তাকালো খই। এতোক্ষনে ওর মাথায় আসলো, এই লোকটার এখানে থাকা কতোটা অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রশ্নসমেত নিজেকে সামলাবে বলে আগে কান্না থামানোর চেষ্টা করলো খই। আর তার জন্য ওর এবার হিচকি উঠেছে। রাকীনের বুকে মৃদ্যু শক্তি দিয়ে সরে যাবে বলে উদ্যত হলে ওর হাত ধরে ফেললো রাকীন। খানিকটা গম্ভীরভাবে বললো,

-এইডা তো ভাদুলগাঁওয়ের শুকমরার তীর না। তো এতো রাইতে এইহানে কি? হুম?

রাকীনের কথা বলার ভঙিমা শুনে দৃষ্টি প্রসারিত হলো খইয়ের। ঠোট টিপে হাসি আটকে প্রশ্নের উত্তরের জন্য ইশারা করলো রাকীন। খই দৃষ্টিনত করে ধরা গলায় বললো,

-ওই ইটপাথরের ঘরে দম বন্ধ হইয়া আইতাছিলো আমার। শ্বাস নেওনের লাইগা বাইর হইছি।

উত্তর দিয়ে রাকীনের কপালে সুক্ষ্ম ভাজের রেখা লক্ষ্য করলো খই। ওটা বিরক্তিপ্রকাশকের সাথে চিন্তার প্রকাশও বটে। বাসা থেকে একটা মেয়ে এভাবে বেরিয়ে আসলো, কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা আদৌও আছে কি সেখানে? রাকীন এমন ভাবনায় মত্ত্ব হওয়ার আগেই খই হাত মুচড়ালো নিজের। রাকীন ওর হাত না ছেড়ে বললো,

-ভাদুলগাঁয়ে তো প্রতিবার ঝাঁ’সির রাণী সেজে দর্শন দিতে। তা শহরে এসে নকশাদারকে ভয় পাচ্ছো নাকি?

-আমার কান্দোনে ভয় আছিলো নকশাদার?

হাত আলগা হয়ে আসলো রাকীনের। খই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। রাকীন জোরপুর্বক হেসে বললো,

-অচেনা একটা জায়গায় এতো রাতে বেরিয়েছো, কিভাবে বেরোলে?

-তুমি এইহানে ক্যান নকশাদার?

উত্তরের পরিবর্তে প্রশ্ন শুনে আটকে‌ গেলো‌ রাকীন। কেনো যেনো ওর মনে হলো, মায়ের মৃত্যুতে আরেক নতুন খইয়ের জন্ম হয়েছে। যে দস্যি বটে, কিন্তু আগের মতো আর গা ছাড়া নেই। কথাতে কারন খুজতে শিখে গেছে সে। যেটা ওর জন্য ভালো। রাকীন মৃদ্যু হাসলো।‌ একপা এগিয়ে বললো,

-আমি এই শহরেরই কেউ‌ খই।

খই‌ চোখ‌ নামিয়ে নিলো। রাকীন বললো,

-আশ্রমের কেউ‌ দেখেনি তোমায় বেরোতে?

-বাড়ির হক্কলে ঘুমায়।

আবারো কপাল কুচকে এলো রাকীনের। বাড়ি বাড়ি কেনো বলছে খই? মিষ্টিঘর যে অনাথআশ্রম, তা কি জানেনা ও? নাকি মিষ্টিঘরকে অনাথআশ্রম বলে সম্বোধন করা হয়না? একটু ঝুকে বললো,

-আর এই সুযোগে রায়বাঘিনী বেরিয়ে পরেছে শহরভ্রমনে। তাইতো? তা কোথায় যাচ্ছিলেন শুনি? এই ঝিল অবদি শুকমরার ফিল নেবেন বলে? নাকি আরো দুরে কোথাও‌ যাওয়ার প্লান ছিলো আপনার? হুম?

-কোনহানে যাওন উচিত আমার নকশাদার?

আকস্মাৎ খইয়ের কাতর আবেদন শুনে রাকীন নিজেই এলোমেলো হয়ে গেলো যেনো। হাসিটা উবে গেলো ওর ঠোট থেকে। খই বললো,

-তুমিই কওনা? এইহানে সাদিক কাকা ছাড়া তো আর কাউরে তো চিনি না। হেয় তো আমারে ওই ঘরটাই চেনাইছে ওহনো অবদি। আর তাতে শুধু আমার দম ফুরাইছে নকশাদার। ওহন তুমি যহন আছোই, এইবার না হয় তোমার কথাডাই শুনি। আমার দম বাচানোর লাগি, আমারে বাচানোর লাগি জবাব দিও একটু? কোনহানে যাওন উচিত আমার নকশাদার? যাওনের জায়গা আছে আমার?

খইয়ের চোখে জল টলমল করছে। যখনতখন বেরিয়ে আসবে সে প্রবাহ। দুহাত মুঠো করে নিলো রাকীন। মনে দোটানা তান্ডব শুরু করেছে। যে প্রবাহের টানে এতোদুর অবদি এসেছে ও, সে প্রবাহকে আগলে রাখার দায়িত্বটা কি ওরই নয়? কি করে অস্বীকার করবে ও নিজেকে নিজের বিবেকের কাছে আবদ্ধ করে দেওয়া সে দায়িত্বকে? উচিত হবে অস্বীকার করা? পারবে ও?

ইচ্ছে উপুর হয়ে শুয়েশুয়ে পা দোলাচ্ছে। ল্যাপটপে নিজেরই কিছু গান দেখতে দেখতে গুনগুন করে গান গাইছে আর মাঝেমধ্যে কাঠবাদাম মুখে পুরছে। টমি এতোক্ষন অবদি মেঝেতে শুয়েশুয়ে বল নিয়ে এদিকওদিক করছিলো। ব্যালকনি দিয়ে আসা দমকা বাতাসে গিটারের হাতলে রাখা ইচ্ছের স্কার্ফটা এসে মেঝেতে পরলো। টমি মেঝে শুকতে শুকতে স্কার্ফের কাছে গেলো। আচমকাই শব্দ করে উঠলো ও। চোখ সরিয়ে টমির দিকে তাকালো ইচ্ছে। অকারনে শব্দ করার অভ্যেস নেই টমির। ইচ্ছে একবার বললো,

-টমি সাইলেন্স।

টমির ভায়োলেন্স বাড়লো বই কমলো না। ইচ্ছে ল্যাপটপ ছেড়ে উঠে বসলো। বিরক্তি নিয়ে বললো,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড ডুড? স্কার্ফ মেঝেতে পরেছে। আমি নই!

টমি তখনো থামেনি। মুখ দিয়ে উল্টেপাল্টে দিলো স্কার্ফটা। স্কার্ফের ছেড়া অংশ দৃশ্যমান হলো ইচ্ছের কাছে। ইচ্ছের মনে পরে গেলো, এটা সেই স্কার্ফ যেটা আগেরদিন ছিড়ে নিয়েছে প্রাপ্ত। মনে পরতেই হাসি পাচ্ছিলো ইচ্ছের। হাসিটা আটকে বাবু হয়ে বসে টমিকে বললো,

-টমি? ওটা বাইকে লেগে ছিড়ে গেছে।

টমি থামলো। লেজ গুটিয়ে বেডের দিকে এগোচ্ছিলো শান্তিতে বসবে বলে। ইচ্ছে ঠোট টিপে হেসে বললো,

-আরে না না! টমি? ওটা তো বাইকে লেগে ছেড়ে নি! ওটা তো…

টমি আবারো শব্দ করতে লাগলো। ইচ্ছে আগের মতোই হাসি সংবরনের‌ চেষ্টা করে‌বললো,

-টমিইইই? ওটা মেবি রাকাদের‌ বাসার দরজার কোনায় বেঝে ছিড়ে‌ গিয়েছিলো।

টমি আবারো নিশ্চুপ। আগের মতো এবারো ইচ্ছের কাছে যাবে বলে এগোচ্ছিলো ও। ইচ্ছে ফট করে‌ বলে দিলো,

-স্কার্ফটা প্রাপ্ত ছিড়েছে।

শব্দের সাথে নিজের তীব্র প্রতিশোধস্পৃহাকে এবার প্রদর্শন করাতে লাগলো টমি। একপ্রকার ফুসে ওঠা‌ যাকে বলে। ইচ্ছে আর পারলো না নিজের হাসি ধরে রাখতে। শব্দ করে হাসতে লাগলো ও। ওর হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠলো পুরো বাসা। অনেকগুলো বছর পর আবারো এ বাসার চারদেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগলো ইনায়াত নিক্কনের বিলুপ্তপ্রায় সে হাসির ঝংকার। টমি প্রথমকেই স্কার্ফ শুকে‌ বুঝে গিয়েছিলো ওতে ইচ্ছের গায়ের সাথে প্রাপ্তরও স্পর্শ আছে। তাই শুরু থেকেই অপছন্দের লোকটার উপস্থিতি অনুভব করে চেচাচ্ছিলো ও। ইচ্ছে করেই ইচ্ছে দুবার ভুলভাল বলেছে ওকে। তখন সেটাকে সত্য মেনে শান্ত হয়ে গিয়েছিলো টমি। শেষবারে ইচ্ছে যেই প্রাপ্তর নাম‌ নিয়েছে, সত্যিসত্যিই টমির সেই অপছন্দের প্রাপ্ত স্কার্ফটা ছিড়েছে প্রমান পেয়ে ওইভাবে শব্দ করতে শুরু করেছে ও। সবটা বুঝে হাসতে হাসতে বিছানায় গরিয়ে পরলো ইচ্ছে। অনেকক্ষন পর হাসি থামিয়ে হাপাতে হাপাতে বললো,

-এই লোকটাকে তোর এতো অপছন্দ কেনো টমি? আমার স্কার্ফে তার স্পর্শ আছে এইটুকো বুঝেই এতো আক্রোশ তোর? হোয়াই ডুড?

টমির শান্তশিষ্ট ভাবখানায় যেনো স্পষ্ট জবাব, “হু! অপছন্দের লোকই‌ বটে। তোমার গিটার ভেঙেছে, ঝাল খাইয়েছে, দেয়াল টপকেছে, সরি বলেনি, থ্যাংকস্ দেয়নি। এখন শুনি তোমার স্কার্ফও‌ ছিড়েছে। তো তাকে অপছন্দ করবো না তো তোমার মতো তার নামে আকাশ কাপিয়ে হাসবো? তুমিই বা কেনো উল্টোপথে চলছো? হোয়াই ডুড? হোয়াই?”
ইচ্ছে কি বুঝলো, কতোটুকো বুঝলো ওর ভঙিমায়, উঠে বসলো চুপচাপ। হাসোজ্জ্বল চেহারায় আবারো বিষন্নতার মেঘ জমলো যেনো। তা দেখে‌ ভাব পাল্টালো টমি। চাঁদমুখে অমাবশ্য এনে দিলো বুঝি ও নিজেই। লেজ নেড়ে‌ এগিয়ে গিয়ে ইচ্ছের পায়ে গা ঘেষলো ও। ইচ্ছে মৃদ্যু হেসে কোলে তুলে‌ নিলো ওকে। গায়ে হাত বুলিয়ে চোখ স্থির করলো ব্যালকনির বাইরের আকাশের দিকে। চাঁদ লুকিয়েছে কালোমেঘের আড়ালে। ইচ্ছে একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে থেকে মিহিস্বরে বললো,

-আই উইশ তোর প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকতো আমার কাছে। আই উইশ! কিন্তু এই উত্তরহীনতার এই কালোমেঘ ঘোচানোর আগে যে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর জানা চাই আমার টমি। উত্তরগুলো কি সত্যিই‌ নেই আমার কাছে? নাকি আমিই‌ মানতে নারাজ? কোনটা?
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে: মিথিলা মাশরেকা

২২.

-তুমি মিষ্টিঘরে ফিরে যাও খই।

রাকীনের কথা শুনে কিছুক্ষন নিরবে ওর‌ দিকে‌ তাকিয়ে রইলো খই। রাকীনের শান্ত চাওনি। খই চোখ সরিয়ে দুহাতে দুগাল মুছলো নিজের। কিসব বলে রাকীনকে দুর্বল করে দিতে যাচ্ছিলো‌ ও? রাগ হলো‌ ওর নিজের উপর। নাক টেনে বললো,

-হ! ত্ তুমিও বাড়ি ফিরা যাও নকশাদার। আসতাছি।

একমুহুর্ত দেরি না করে উল্টোপথে হাটা ধরলো খই। যেখানে দায়ভার হয়ে থাকবে না বলে সাদিক সাহেবের বাসা থেকে ও বেরিয়ে এসেছিলো, সেখানে রাকীনের কাছে নিজের বলা কথাতে ওকে দায় করে‌ দিতে যাচ্ছিলো ও। আজ নিজেই নিজেকে অপমান করেছে ও। রাকীন পেছন থেকে ওর এক হাত ধরে‌‌ বললো,

-খই আমি…

খই‌ ছাড়িয়ে নিলো‌ নিজের হাত। একটা জোরপুর্বক হাসি দিয়ে বললো,

-ফিরা‌ যাও নকশাদার। আ্ আমি অনাথআশ্রমে‌ যাইতাছি। চিন্তা করন লাগবো না তোমার। আ্ আমি ঠিক আছি। জানিনা তহন কি হইছিলো, পাগল হইয়া গেছিলাম হয়তো। তয় ওহন ঠিক আছি। তুমি যাও।

রাকীন ওর সামনে এসে দাড়ালো। খইয়ের দুহাত মুঠো করে নিয়ে, মাথা নিচু করে বললো,

-আমাকে ক্ষমা করে‌ দিও খই। জানিনা এটুকো সময়ের ব্যবধানে, ভাঁদুলগাও থেকে শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবে ঢাকা চলে আসার এতো সাহস কি করে আসলো আমার‌ মাঝে। তবে এটা জানি, এই‌মুহুর্তে তোমাকে পরিচয় দেওয়ার‌ সাহস আমার নেই‌। তাই…

খই বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো রাকীনের দিকে।‌ রাকীনের চেহারায় তীব্র আত্মগ্লানি। খইয়ের নিজের উপরও রাগ হলো। টের পেলো, অনেকবেশি আবোলতাবোল বকেছে ও। যার‌ জন্য এই‌ লোকটা এতোটা দ্বন্দে পরে গেছে। কিন্তু ও তো সেভাবে বলতেই চায়নি। আপনার ভেবে, দুঃখটাকে উগড়ে দিতে গিয়ে বলে দিয়েছিলো কথাগুলো। ও তো কারো দায়বদ্ধতা হতে চায়ই‌ নি। সেখানে ওর‌ কথাতেই রাকীন দায়বদ্ধতায় পরে যাচ্ছিলো। যেখানে ওর চেয়ে শতসহস্র ভালো কিছুর দাবিদার এই‌ মানুষটা, ও‌ কি করে তার‌ কাছে দাবি রাখতে পারে? মুচকি‌ হেসে রাকীনের হাতে হাত রেখে বললো,

-খই নিজের পরিচয়ে বাচবো নকশাদার। তুমি দেইখো। আমার মায়ে যা চাইছিলো, তাই হইবো। তুমি নিজের উপরে কোনো দায় নিও না। ভালো থাইকো।

রাকীন চোখ তুলে তাকালো। সুন্দর একটা হাসি দিয়ে খই‌ হাত ছাড়িয়ে নিলো নিজের। অন্ধকারে চলে গেলো সে পথে, যে পথ দিয়ে এসেছিলো। মাথার চুলগুলো একহাতে উল্টে ধরে আকাশের দিকে মুখ তুললো রাকীন। চোখ বন্ধ করে নিতেই জল গরালো ওর চোখের কোনা বেয়ে। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ওর ছায়ার সাথে হৃদয়ের চাপা কষ্টগুলোর প্রতিধ্বনি স্পষ্টতর হতে লাগলো। প্রতিটা প্রশ্বাস যেনো তীব্র যন্ত্রনাসমেত বলছে,
“যে জায়গাটা এতোগুলো বছরে ইচ্ছেকে দিতে পারিনি, সে জায়গাটা কি করে তোমায় দিয়ে দেবো খই? যে সেই ছোটবেলা থেকে রাকীনের সবটা জুড়ে আছে, তোমার সাথের এই দুদিনের সাক্ষাতে কি করে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো বলো? খেয়া যেখানেই থাকুক না কেনো, আমি তো জানি, আমার সবটা জুড়ে শুধু ওই আছে। ওর অনুপস্থিতি কেউ পুরন করতে পারবে না। আমি দেবো না কাউকে সে অধিকার। দিতে পারবো না!”

রেকর্ডিংয়ের জন্য বাসা থেকে বেরোলো ইচ্ছে। আজও ব্রেকফাস্ট করেনি বলে নওশাদ সাহেবের অসহায় আর্জি আর নাফিজা বেগমের বিব্রত চাওনি দেখতে হয়েছে ওকে। সেসব মাথা থেকে ঝেরে, গাড়িতে বসে ডিরেক্টরের এসিসটেন্টের লাস্ট কলের সময় দেখবে বলে মোবাইলের কললিস্ট স্ক্রল করছিলো ইচ্ছে। হঠাৎই একটা আননোন নম্বরে চোখ আটকালো ইচ্ছের। সময়, তারিখ আর আননোন নম্বর লিস্টে দেখে একটা ঘটনাই মনে পরলো ওর। পিয়ালীর সে সন্ধ্যার ঘটনাটা। পুরো নম্বরটা কয়েকবার চোখ বুলালো ইচ্ছে। কি ভেবে বাটন ফোনটা বের করলো ও। ঠিকঠাকমতো নম্বরটা তুলে কল করতে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার আগে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নিলো পাশের টমিকে। চোখ বুজে শুয়ে আছে টমি। মুচকি হেসে ইচ্ছে একহাতে ওর গায়ে হাত বুলালো। নড়েচড়ে আরো আরাম করে শুয়ে পরলো টমি। ঠোট কামড়ে হেসে নম্বরটা ডায়াল করলো ইচ্ছে। কি হলো ওর, রিং হবার আগেই কেটে দিলো কলটা। কিছুক্ষন ইতস্তত করে, একটা জোরে শ্বাস ফেলে আবারো নম্বরটায় কল লাগালো ও।
ফোনের আওয়াজে চোখ মেলে তাকালো প্রাপ্ত। হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে নিলো। নম্বর না দেখে রিসিভ করলো কলটা। ঘুমুঘুমু গলায় বললো,

-হ্যালো?

প্রতিত্তরে কুকুরের আওয়াজ শুনে তখনতখন চোখের ঘুম গায়েব প্রাপ্তর। ইচ্ছে চোখমুখ খিচে বন্ধ করে নিলো টমিকে আওয়াজ করতে শুনে। কল কেটে দিলো তৎক্ষনাৎ। সরু চোখে তাকিয়ে রইলো টমির দিকে। টমি লেজ নেড়ে আদর বুঝালো ওকে। ইচ্ছে কড়া গলায় বললো,

-শব্দ করলি কেনো?

টমি সিটের উপর রাখা ইচ্ছের অন্য ফোনের স্ক্রিনে থাকা প্রাপ্তর নম্বরে সামনের পা রাখলো। ইচ্ছের মুখ হা হয়ে গেলো আপনাআপনিই। বললো,

-ওই লোকটা মোবাইলের ওপাশ থেকে হ্যালো বলেছে, সেটাও কানে গেছে তোর?

টমি আবারো শুয়ে পরলো আরাম করে। ইচ্ছে ওর গা ছাড়া ভাব দেখে বললো,

-সরি ডুড, ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাদের তুলনায় তো তোর শ্রাব্যতার সীমা অনেক বেশি। ঠিক বুঝে গেছিস কার নম্বরে ডায়াল করেছি।

টমি আরো দুবার ডাকলো। যেনো আরো বেশি ভাব বুঝালো ও। ইচ্ছে শব্দ করে হেসে দিলো এবার। টমিকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলো। গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

-ইউ‌ নো হোয়াট টমি? মিস্টার গ্যাংস্টারের প্রতি তোর এই বিহেভটা আমি এন্জয় করতে শুরু করেছি। পারিসও তুই!

টমি কিছুই বললো না। মনেমনে হয়তো চাপা ঈর্সা পুষতে শুরু করলো প্রাপ্তর প্রতি। এদিকে টমির গলা চিনতে কষ্ট হলেও ভুল হলো না প্রাপ্তর। উঠে বসে হা হয়ে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে রইলো ও। ঠিকই শুনেছে কিনা ঘুমের ঘোরে, সেটাও একটা বিষয়। টমি ওর নম্বর কিভাবে পাবে, ওকেই‌ কেনো কল করবে, সর্বপরি কিভাবে কল করবে ভেবে সকালটাই উল্টেপাল্টে গেলো প্রাপ্তর। নম্বরটা পড়ে নিলো কয়েকবার। মোবাইল বিছানায় রেখে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে দেখে ড্রয়িংরুমে সোফায় পিয়ালী, সাদিক সাহেব আর মিষ্টিঘরের আরেক অভিভাবক বাকের কাকা সবাই বসে। হাতের ঘড়িটা পরতে পরতে পুরো ড্রয়িংরুমের পুরোটা চোখ বুলিয়ে এককোনে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকা খইকেও‌ দেখতে পেলো রাকীন। পিয়ালী‌ বললো,

-কোথায় যাচ্ছিস ভাইয়া?

-এমনি, মাহীমদের ওদিকে…

প্রাপ্তকে শেষ করতে না দিয়ে সাদিক সাহেব উঠে দাড়িয়ে বললেন,

-খই মিষ্টিঘরে চলে যেতে চায় প্রাপ্ত।

প্রাপ্ত অবাকচোখে তাকালো খইয়ের দিকে। খই কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সেভাবেই নিচদিকে তাকিয়ে আছে ও। পিয়ালী বললো,

-সকালবেলা উঠেই‌ আমাকে বলছে এ বাসায় থাকবে না। আমি অনেক বললাম এখানে…

প্রাপ্ত এগিয়ে গেলো খইয়ের দিকে। খই অনড়। মেয়েটার চেহারা শুকিয়ে গেছে একদম। চোখ কোঠরে বসে গেছে। প্রাপ্ত বললো,

-এ বাসায় থাকতে চাওনা তুমি?

-না।

খইয়ের স্পষ্ট জবাব। সাদিক সাহেব এগিয়ে আসলেন ওর দিকে। বললেন,

-কিন্তু খই…

-এই বাড়িতে আমার দমবন্ধ লাগে কাকা। আমারে আশ্রমে যাইতে দাও। ওইহান থাইকা‌ পড়তে চাই আমি। নিজের পরিচয়ে বাচবার‌ চাই। বাধা দিও না কাকা। পায়ে পরি তোমার। আমারে আশ্রমে যাইতে‌ দাও।

প্রাপ্ত কি‌ বলবে, বুঝে উঠতে পারলো না। বেশ অনেকক্ষন খইয়ের আকুতি শোনার পর সাদিক সাহেব হার মানলেন খইয়ের কাছে। উনি ভালোমতোই জানেন, এই‌মুহুর্তে খইয়ের আত্মসম্মানই ওর কাছে বড়। এদিক দিয়ে ওকে জোর করা হলে, হিতের বিপরীত হবার সম্ভবনাই বেশি। আর তাছাড়া উনি নিজেও‌ চান, খই নিজের দিকগুলো বুঝে বাচতে শিখুক যতো‌ দ্রুত সম্ভব। প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বললেন,

-তুমি কি বলো প্রাপ্ত?

-যেটা খই চায়, সেটা করাই উচিত হবে বাবা।

একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেলে‌ বাকেরের সাথে সবধরনের ফর্মালিটি মিটিয়ে‌ নিলেন সাদিক সাহেব। খই শক্ত করে নিলো নিজেকে। বাকের কাকার সাথে বেরিয়ে এলো প্রাপ্তদের বাসা থেকে। বেরোনোর সময় সাদিক সাহেব ওকে পেছনডাক দিলেন। খই থামলো। সাদিক সাহেব ওর‌ মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-অনেকঅনেক দোয়া তোমার জন্য। শুধু বাসাটা বদলেছে। তোমার প্রতি আমাদের ভালোবাসা না। সবসময় আমরা পাশে আছি তোমার। নিজেকে প্রস্তুত করো খই। এই বাসা, বাসার মানুষগুলো এক নতুন তোমার‌ স্থায়ী আগমনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো কিন্তু!

খই প্রাপ্তর দিকে তাকালো একপলক। প্রাপ্তর শান্তস্থির চাওনি। দুজনের মনে আচমকাই অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের আভাস হানা দিতে লাগলো। এ যেনো নতুনের শুরু নয়, অন্তিমের পুরোনো ট্যালি…

#চলবে…

[ গ্যাপের জন্য দুঃখিত। কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত কারনে আজকের পর্বটাও সাজাতে পারিনি সেভাবে। ক্ষমা করবেন। রাতে আরেকটা পর্ব দেওয়ার চেষ্টা করবো ইনশাল্লাহ্। ভালোবাসা❤ ]
#চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here