প্রেমের খেয়া পর্ব ৬

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৬

অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলো শেহেরজাদ।আয়নায় সিমির দিকে চোখ পড়তেই শেহেরজাদের হাত থেমে গেলো।সিমির মুখ গোমড়া। সুন্দর মুখশ্রীটিতে যেন কেউ কালি লেপে দিয়েছে। শেহেরজাদ পেছনে ফিরে সিমির দিলে তাকালো।সিমি অন্যমনস্ক হয়ে আছে।গভীরভাবে কিছু ভাবছে হয়তো। টাই এর বাধন লুজ করে দিলো শেহেরজাদ।তারপর দু-হাত পকেটে দেখে একটু এগিয়ে আসে।সিমির পরিবর্তন হলো না।ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো শেহেরজাদের। সিমির সামনে গিয়ে বসে পড়ে।একটু এগিয়ে সিমির হাতে হাত রাখতেই সিমি চমকে উঠে।একটু দূরে সরে যায়।শেহেরজাদ সিমির দিকে একবার তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালো আবারো। সিমি দৃষ্টি নত করে নেয়।সিমির এলোমেলো চাহনী দেখে শেহেরজাদ বুঝতে পারে সিমি ঠিক নেই।মৃদুস্বরে গম্ভীর কন্ঠে সিমিকে জিজ্ঞেস করে,
“-আর ইউ ওকে?
“-দুপাশে মাথা নাড়ালো সিমি ” হুম ঠিক আছি”!
সিমিকে একবার দেখে শেহেরজাদ উঠে দাঁড়ায়।সামনে পা বাড়াতেই হাতে টান পড়ে শেহেরজাদের। শেহেরজাদ বুঝতে পারে সিমি হাত ধরেছে।চট করে পেছনে ফিরে দেখলো সত্যিই সিমি হাত ধরেছে। কিন্তু সিমি তো শেহেরজাদের হাত ধরে না তাহলে আজ কেন?শেহেরজাদ বুঝতে পারে সিমি ঠিক নেই।সিমির সেই চাহনীতে মিশে আছে অনেক কিছু।কিছু বলতে চায় সিমি।শেহেরজাদ মাটিতে হাটু ভাজ করে বসে পড়ে।সিমির হাতের উপর হাত রেখে চুমু খেলো।
“-মিথ্যে কেন বলেছিলে?
“-সরি!আসলে যদি আপনি রেগে যান তাই?মাথা নোয়ালো সিমি।
শেহেরজাদ একহাত সিমির গালে রাখে।মুচকি হেসে বলে,
“-“রাগ করবো না!না বললে রাগ করতাম।বলো কি হয়েছে”!
“-বলছিলাম যে…!ঢোক গিললো সিমি।
“-কি?
“-শেহেরজাদের দিকে একবার তাকালো সিমি।তারপর চোখ নামিয়ে নেয়।সিমিকে চুপ থাকতে দেখে শেহেরজাদ চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিলো,
“-কি হলো বলো”!
“-অনেক দিন তো হলো বাংলাদেশ থেকে এসেছি। আমি বলছিলাম যে যদি আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে চলুন না একবার!!এক দমে কথা গুলো বলে দেয় সিমি। সিমির কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শেহেরজাদ উঠে দাঁড়িয়ে যায়।দুহাত পকেটে রেখে দৃষ্টি বাহিরে স্থির করে। সিমি শেহেরজাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তবে কি আবারো শেহেরজাদকে রাগিয়ে দিলো?

সিমির ভাবনায় ফাটল ধরিয়ে শেহেরজাদ বলে,
“-আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। আসছি আমি। লম্বা পা ফেলে শেহেরজাদ চলে গেলো।সিমি অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো শেহেরজাদের যাওয়ার পথে। প্রতিদিন সিমির কপালে আর ঠোঁটে চুমু দেওয়া ছাড়া শেহেরজাদ বাহিরে পা রাখে না।আজ সিমির দিকে একবারও তাকালো না। সিমির ভেতর জ্বলছে।কেন জ্বলছে তার কারণ এখনো বুঝতে পারছেনা সিমি। শেহেরজাদের এহেন আচরণে?নাকি সিমির কথা ইগনোর করে চলে যাওয়ার কারণে?চোখের পানি মুছে উঠে দাড়ালো সিমি।

রুমে পায়চারী করছে সামরান।সেই অনেক্ষণ যাবত এদিক ওদিক পায়চারী করেই যাচ্ছে। সিগারেট এর প্যাকেট খুলতেই দেখলো আর একটি সিগারেট আছে।বিরক্তি নিয়ে সামরান সিগারেট টি ধরালো।আর প্যাকেট টি ছুড়ে ফেলে দিলো। সিগারেট শেষ করে নিচে নেমে আসে সামরান। ড্রয়িংরুমে বসে আছে সামাদ মালিক।সেলিনা মালিকের সাথে কথা বলছে। সামরান এসে সামনে দাড়াতেই সামরান কে দেখে সামাদ মালিক উঠে দাড়ালো।অনেক বছর পর আজ সামরান নিজেই সামাদ মালিকের সামনে এসে দাড়িয়েছে। সামাদ মালিক ডাকা ছাড়া আসেনা সামরান।ডাকলেও খুব একটা দেখা মেলেনা।সেখানে আজ নিজ হতে আসা মানেই হাতে চাঁদ পাওয়ার মত।মুখে হাসির রেখা টেনে সামরান কে জিজ্ঞেস করে সামাদ,
“-কিছু বলবে?
“-আসলে….সামরান থেমে যায়।সেলিনা মালিকের দিকে একবার তাকালো।সেলিনা মালিক সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো।
“রয়েল এসএস” কোম্পানিটি আমায় কিনে দিতে হবে মি.মালিক!! আপনি ছাড়া পসিবল না।বলেই সামাদ মালিকের দিকে তাকালো সামরান।
সামাদ মালিক ভ্রু কুঁচকালেন!
“-এসএস কোম্পানি? এটা দিয়ে কি হবে?
“-দরকার আছে!আপনি কিনে দিন…
“-তুমি চাইলেই পারো! আর ওরা কি সেল করবে বলেছে?
“-না বলেনি!কিন্তু আপনিই তো বলেন টাকাতে তো সব হয়! টাকার আগে কিচ্ছু না।তাহলে..?সামরানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামাদ মালিককে আবারো নাড়িয়ে দেয়।
“-ঠিক আছে।কিনে দেবো।তুমি কিছু চেয়েছো তা দেবো না এমন হয়েছে?
“-দিয়েছিলেন?সামাদ মালিকের চোখে চোখ রেখে বলে সামরান।
“-ওটা তোমার ছিলো না!!
“-তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো সামরান। তারপর বললো,কোম্পানি কিনবেন আপনি তবে ওখানে বসবো আমি।মানে এমডি আমি থাকবো সেটা ওখানে উল্লেখ করবেন।কাজ শেষ হলে আমায় জানিয়ে দেবেন।আর এডভান্স থ্যাংকস!!বলেই সামরান উপরে চলে গেলো।সামাদ মালিক উপরে তাকিয়ে সেলিনা মালিকের দিকে তাকালো।

সেলিনা মালিক উঠে সামাদ মালিকের পাশে দাড়ালো,
“-আমি আজও জানিনা তিনবছর আগে আপনার নেওয়া সেই সিদ্ধান্ত আদৌ ঠিক ছিলো কি না।তবে এই তিনবছরে সামরান একবারও আপনাকে বাবা বলে ডাকেনি। আমি জানি কষ্ট আপনার হয়।কিন্তু সামরানের দিক টা বুঝুন!!আমার সামরান সবাই থাকা সত্ত্বেও একাকিত্বের গহীনে তলিয়ে গেছে।
“-আমি ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করবো সেলিনা!!ও তো আমারই ছেলে কষ্ট আমারও হয়।তবে তোমার ছেলে বুঝলো না।
“-আমার ছেলে এমনি আকারে বড় হয়েছে অথচ মনের দিক থেকে এখনো সেই ছোট আছে।বলেই হাসলো সেলিনা
“-জানি।

ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে আছে মায়া।পাশেই আছে রাহাদ। মায়া নিজের মত করে কথা বলেই যাচ্ছে।আর রাহাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে।মায়া কথা বলার সময় রাহাদের দিকে তাকাতেই চমকে যায়,
“-কি দেখছো?চোখের সামনে হাত নেড়ে বলে মায়া।
“-কিছু না।রাত কয়টা বাজে দেখেছো?
“-৩টা বাজে।আমি কি বলেছিলাম তুমি আসো।নিজেই এসেছো। আমার ঘুম এখন আর আসবে না তাই চুপচাপ বসে থাকো।বলেই পা দোলাতে থাকে মায়া। একটি শর্ট জামা আর সালোয়ার পরেছে মায়া।চুলগুলো খোলা।কোমর অবধি ঠেকেছে।বাতাসে উড়ছে। মায়া বার বার খোপা করছে কিন্তু বাতাসের ঝাপটায় চুলের খোপা বারবারই খুলে যাচ্ছে। রাহাদ তা দেখে হাসছে।
“-তোমার কলেজ কেমন কাটলো?
“-ভালোই কেটেছে।অনেক ভালো লাগছে।
“-ওহহ!!
“-হুম।আচ্ছা তুমি বললে না তো কিসের চাকরী করো?
“- রাহাদ চমকে উঠে,আরে এই তো ছোট খাটো একটা জব করি।
“-ওহহ। করো অনেক বড় হউ।
“-আচ্ছা মায়া?তোমাকে কেউ যদি অনেক ভালোবাসে তুমি কি তাকে গ্রহণ করবে।
“-না করবো না।
“-কেন?ভ্রু কুঁচকালো রাহাদ।
“-কারণ আপু চলে যাওয়ার পর ছোট মা ছোট আব্বু অনেক কষ্ট পেয়েছে।আমি চাই না আবারো এমন কিছু হোক।যার আমাকে পছন্দ হবে সে আমার ছোট আব্বুকে বলবে।আমাকে বলে কি লাভ?আমি কি নিজের গার্ডিয়ান? আমার গার্ডিয়ান তো আছেই।
“-ওহহ!যাক ভালোই হলো। জেনে নিলাম।
“-নিয়ে লাভ কি?
“-হতেও পারে আমি প্রপোজাল নিয়ে গেলাম।
“-মায়া হাসলো!!তুমিও না।তুমি আমার বন্ধু।এর বাহিরে কিছু হবেও না।মজা করো না।
“-ধুর দিলে তো মাটি করে।কোথায় ভাবলাম একটু প্রেমিক সাজবো।
“-আমার প্রেমিক সাজতে এসো না।কারণ আমার আসল প্রেমিক যে হবে সে যদি জানে তাহলে তোমার রক্ষে নেই।
“-আচ্ছা?কে সেই মহান ব্যাক্তি শুনি..
“-মায়া হাসলো। আমি জানিনা জানলে আমি নিজেই নিয়ে আসতাম কান ধরে।
রাহাদ হেসে দিলো।সাথে মায়াও।

সময় সময়ের গতিতে ছুটে চলেছে।ছুটতে ছুটতে মধ্যরাতে এসে থামলো।আর কিছুক্ষণ পরই হয়তো ঘন কালো আকাশ ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় ছেয়ে যাবে।মৃদু বাতাস বইছে। সামরানের রুমের জানলা খোলা।বারান্দাও খোলা।বাতাসের ধাক্কায় কাপছে পর্দাগুলো। ঘুমের মাঝে সামরানের কপাল কুঁচকে আসে।বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জমাট বাধে কপালের আঙিনায়।সামরানের ঠোঁট কাপছে। ধপ করে উঠে বসে পড়ে সামরান।আবারো ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো।সামরান চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন শ্বাস নিতে থাকে।ফোন বের করে ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই দেখলো ৪ঃ৩০।
ফোন ছুড়ে পাশে রেখে দেয় উঠে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় সামরান। বিগত ৩বছরে একবারও পুরো রাত ঘুমাতে পারেনি সামরান।সামরানের ঘুম ভাঙে ভয়ংকর এক দিনের কথা স্মরণ করে।সামরান চাইলেও সেই দিনের কথা ভুলতে পারবে না। সেই একটি দিন সামরানের জীবন থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।বদলে দিয়েছে সামরান কে।পাথরে পরিণত করে দিয়েছে সামরানের ভেতরটা। ওয়াইন ফ্ল্যাক্স এ চুমুক দিয়ে হাতের উল্টো পিঠে মুখ মুছে নিলো সামরান।তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,
“- আমার সুখের দিন খুব একটা দূরে নেই।আমার তৃপ্তি আমি খুঁজে পেয়েছি।যা এতোদিন ধরে খুঁজে এসেছি তার দেখা অবশেষে পেয়েছি।আমি এতোটাও আনলাকি নই।
বলেই আবারো ওয়াইন ফ্ল্যাক্স এ চুমুক দিলো সামরান।

শেহনাজ মায়ার রুমে এসে থমকে গেলো।এই মেয়েকে তিনবার ডেকে গেছে শেহনাজ এখনো ওঠার নাম নেই। শেহনাজ রেগে গিয়ে মায়ার কান মলে দেয়।কানে ব্যাথা অনুভব করার সাথে সাথেই মায়া লাফিয়ে উঠে পড়ে।
“-কি ছোট মা কেন এমন করছো?ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে মায়া।
“-কলেজ যাবিনা।কয়টা বাজে দেখেছিস?
“-ওহহ বাজুক আজ আমি যাবোনা।প্রতিদিন ক্লাস ভাল্লাগেনা।বলে আবারো শুয়ে পড়লো মায়া।
শেহনাজের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেলো।
“-প্রতিদিন কোথায়?পরশুই তো নবীন বরণ হলো।মাঝখানে একদিন ক্লাস করে কি এমন রাজকার্য উদ্ধার করলি তুই।
“-ছোট মা তোমার কি রান্নাঘরে কাজ নেই?যাও না কাজ করো আমাকে ঘুমাতে দাও।বলে বালিশ এ মুখ গুজলো মায়া।
শেহনাজ রেগে গেলো,
“-আজ আসুক তোর বাবা।বিচার যদি না দিয়েছি। আমার কথা কেউ পাত্তা দেয়না।তুই ও সেই একই হলি।কথা কানে নেওয়ার নামই নেই। রাগে গজ গজ করতে করতে রুম ছাড়লো শেহনাজ।শেহনাজ যাওয়ার সাথে সাথে মায়া উঠে তুলো নিলো তারপর দু কানে গুজে দিলো।
“-এবার তুমি শান্তিতে চিল্লাও আর আমিও শান্তিতে ঘুমটা দিই বলেই চোখ বন্ধ করে নিলো মায়া।

বিঃদ্রঃ অসুস্থ ছিলাম তাই দেওয়া হয়নি।আবারো রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করবো।সবাই প্লিজ গঠনমূলক মন্তব্য করুন।
চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here