প্রেম পর্ব -২১+২২

প্রেম 💜 (Love has no limits)

#পর্বঃ ২১

অঝোরে কাদছে স্পর্শিয়া। সবাই হসপিটালে। আরাধ্য আইসিউতে। আজ ওর জন্যই আরাধ্যর এই অবস্থা। আরাধ্যর কিছু হয়ে গেলে ও নিজেকে কখনো মাফ করতে পারবে না। এমন একটা অঘটন ঘটবে বলেই অস্থির লাগছিল সকাল থেকে, বুকটা খা খা করছিল। ও শুধু চেয়েছিল আরাধ্যর লাইফ থেকে সরে যেতে, কারণ আরাধ্য আর কখনোই ওকে খুশি মনে এক্সেপ্ট করে নিতে পারবে না। আর আরাধ্যর এই ঘৃণা নিয়ে ও সংসার করতে চায়নি । সংসার হয় ভালোবাসায়, বিশ্বাসে। অবিশ্বাস, সন্দেহ, আর ঘৃণায় কখনো সংসার করা যায় না। সেজন্যই দূরে সরে যেতে চেয়েছিল আরাধ্যর কাছ থেকে। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল। আরাধ্য এরকম একটা পদক্ষেপ নিবে ও জানলে সারাজীবন আরাধ্যর শত অত্যাচার সহ্য করে হলেও ও আরাধ্যর কাছেই থাকতো। সবকিছুর বিনিময়ে হলেও ও আরাধ্যর জানটুকু চায়। আজ আবারো মনে হচ্ছে ও আরাধ্যর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কখনোই ছিল না। একটা মানুষ ওকে এতটা ভালোবেসেছে, আর ও বিনিময়ে কি দিয়েছে? কষ্ট, আর ধোকা ।

এরইমধ্যে একবার ডক্টর এসে জানিয়ে গেছে আরাধ্যর শরীরের কন্ডিশন খুব খারাপ। একসাথে ২০ টা স্লিপিং পিল খেয়েছে ও। ওকে হসপিটালে আনতে দেড়ি হওয়ায় এখন ও ডেঞ্জার জোনে আছে। ওয়াশ করানোর পরেও শরীর নর্মাল হচ্ছে না। যতক্ষন পর্যন্ত পিল এর প্রভাব কেটে গিয়ে জ্ঞান না ফেরে ততক্ষণ পর্যন্ত কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না। ডাক্তাররা সময় দিয়েছে আগামীকাল দুপুর থেকে সন্ধ্যার ভেতরে স্লিপিং পিলের প্রভাব কমে জ্ঞান ফিরবে, আর নয়তো যে কোন কিছু হতে পারে। সেটা আর ডাক্তারদের হাতে থাকবে না।

সবার মুখে চিন্তার ছাপ। আরাধ্যর মা এসব শুনেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। তাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্নিগ্ধা স্পর্শিয়ার হাত শক্ত করে ধরে ওর পাশে বসে আছে। স্নিগ্ধা বুঝতে পারছে কেন আর কি ঘটেছে। কিন্তু, এখন স্পর্শিয়ার সাথে এসব বলার সময় নয়।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

সেই বিকাল থেকে কাদছে স্পর্শিয়া। কাদতে কাদতে গলা শুকিয়ে গেছে, চোখের পানিও যেন ফুরিয়ে গেছে, চোখ ভেতরে ঢুকে গেছে। এখন আর পানি পড়ছে না চোখ থেকে। শুধু কষ্টে বুকটা চিপ দিচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে আরও খারাপ কিছু না হয়ে যায়। সায়ান স্পর্শিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে ওকে শান্ত্বনা দিচ্ছে।
– স্পর্শিয়া তুমি যদি আগেই বলতে আরাধ্য ভাইয়াকে তুমি ভালোবাস তবে আজ এতকিছু হতো না।
সায়ানের কথা স্পর্শিয়ার শরীরে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো মনে হলো। এমনিতেই টেনশনে, ভয়ে চোখেমুখে ঘোলা দেখছে, তার উপর সায়ানের এমন কথার কোন মানেই হয় না।

স্নিগ্ধা এসে স্পর্শিয়াকে সায়ানের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। সায়ানকে স্নিগ্ধার কাছে কখনোই সুবিধার মনে হতো না। সেদিন স্পর্শিয়া ওকে বলল সায়ান নাকি ভালো হয়ে গিয়েছে, তখনও এই কথাটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল ওর।

রাত হয়ে যাওয়াতে সবাই চলে যাচ্ছে। হসপিটালের রুলস অনুযায়ী একজনের বেশি রোগীর সাথে থাকতে পারবে না। মিনহাজ চৌধুরী বললেন উনি থাকবেন রাতে আরাধ্যর সাথে। সাথে সাথে স্পর্শিয়া বলল ও রাতে হসপিটালে থাকতে চায়। প্রথমে কেওই রাজী হয়নি। কিন্তু, ওর মনের অবস্থা বুঝে আর ওর জোড়াজুড়িতে ওকে হসপিটালে থাকতে দিতে বাধ্য হলো সবাই। সবাই চলে গেল। স্পর্শিয়া একাকী পড়ে রইলো ওর খারাপ স্মৃতিগুলোর সাথে। আইসিউতে কারও ঢোকা নিষেধ। তাই একটু পর পরই দরজার সামনে গিয়ে গ্লাস দিয়ে আরাধ্যকে দেখতে লাগলো ও। স্যালাইন চলছে আরাধ্যর, নাক দিয়ে পাইপ দেয়া হয়েছে। ছেলেটার সুন্দর মুখটা মেঘের মতো কালো হয়ে আছে। ডুকরে কেদে উঠলো স্পর্শিয়া। আরাধ্যর স্মৃতি হাতড়াতে লাগলো ও। ওর সব পাগলামি সহ্য করতো আরাধ্য। একবার আরাধ্যর সাথে ও রাগ করাতে কানে ধরে উঠবস করতে বলেছিল। আরাধ্য কোন কিছু চিন্তা না করে পার্কের মধ্যেই কানে ধরে উঠবস করা শুরু করে। স্পর্শিয়া খিলখিল করে হেসে দেয়। আরাধ্য নিজে অপমানিত না হয়ে উল্টো স্পর্শিয়ার হাসিতে যোগ দিয়েছিল। এরকম অসংখ্য স্মৃতি আছে ওদের। কত খুনসুটি, কত ভালো লাগা, কত গল্প। আরাধ্যর সাথে থাকলে যেন স্পর্শিয়ার গল্প ফুরাতোই না, কিন্তু সময় ঠিকই ফুরিয়ে যেত। হঠাৎ হঠাৎ আরাধ্যর করা আদর, ওর দুষ্টুমি এই মূহুর্তে সবকিছু মিস করছে ও। এই হাস্যোজ্জ্বল ছেলেটা ওকে এখন পেলে কত কথাই না বলতো, কত দুষ্টুমিই না জানি করতো। সেই ছেলেটাই এখন নিথর হয়ে পড়ে আছে ওর চোখের সামনে।

.
.
.
.
.
.
.
স্পর্শিয়াকে সকালে বাসায় নিয়ে এসেছে ওর মা। আসতে চায়নি ও৷ কিন্তু এইটুকু একটা মেয়ের পক্ষে এত ধকল সহ্য করে, সারারাত হসপিটালে পাড় করে এখনও ওইখানে থাকে সম্ভব না । স্পর্শিয়া ঠায় বসে আছে। বাসায় ফিরে এ পর্যন্ত কারও সাথে একটা কথাও বলেনি। ওর মা ওকে অনেক কিছু বলেই বুঝাচ্ছে। খাওয়ার জন্য ফোর্স করছে অনেকক্ষন যাবত, কিন্তু ও শুনছে না। শুধু একদৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেজ চাচী এসেও বুঝাচ্ছে ওকে।
– মা রে, তুই খেয়ে নে। এভাবে তুই ভেঙে পড়লে কি চলবে বল? আরাধ্যর কিচ্ছু হবে না তুই দেখিস। আমরা তো চিন্তাও করিনি আরাধ্য এমন কিছু করবে। কাল সকালেই তো আমাদের সবার সাথে দেখা করে গেল ও। এত হাসি খুশি ছেলেটার কি এমন হলো যে কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এমন একটা পদক্ষেপ নিল।
স্পর্শিয়া এবার চোখ তুলে ওর চাচীর দিকে তাকাল।
– আরাধ্য কাল সকালে বাসায় এসেছিল?
– হ্যা। তুই কলেজ যাওয়ার কিছুক্ষন পরই এসেছিল। আমাদের সবার সাথে গল্প করলো, দোয়াও নিয়ে গেল আমাদের সবার কাছ থেকে, অথচ বিকালেই শুনি এই খবর।

স্পর্শিয়া কয়েক মূহুর্ত কিছু ভাবলো চুপ করে। তারপর বলল,
– প্লিজ তোমরা যাও।
– কেন?
– আমি ঘুমাবো। খারাপ লাগছে। প্লিজ বের হও তোমরা।
– একটু খেয়ে নে।
স্পর্শিয়া চেচিয়ে উঠলো,
– যেতে বলেছি না? যাও তোমরা। আমাকে একা থাকতে দাও।

স্পর্শিয়ার মা আর চাচী দুজনেই বের হয়ে গেলেন। স্পর্শিয়া সাথে সাথে দরজা লাগিয়ে ওর রুমের সব কিছু ওলট পালট করে কিছু একটা খুজতে লাগলো। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না। কি খুজছে তা ও নিজেও জানে না। কিন্তু ও এটা জানে যে এই রুমে কিছু একটা নিশ্চিত আছে। অবশেষে তা পেল ওর ডায়রির ভেতরে। এই ডায়রিটা পাচ মাস আগে আরাধ্য গিফট করেছিল ওকে। বলেছিল ওর লাইফের সব হ্যাপিয়েস্ট মোমেন্টগুলো ডাইরিতে লিখে রাখতে। কিন্তু এখন পর্যন্ত ডাইরিতে ও কিছুই লিখেনি। ডায়রির ভেতরেই ও পেয়েছে জিনিসটা। আরাধ্যর চিঠি। যখন চাচী বলল গতকাল ওর অনুপস্থিতিতে আরাধ্য এখানে এসেছে, তখনি ও বুঝতে পেরেছে বিনা কারনে আরাধ্য এখানে আসেনি। কিছু না কিছু ওর জন্য আরাধ্য নিশ্চয়ই রেখে গিয়েছে। চিঠিটা খুলে দেখলো অসংখ্য পানির ফোটা পড়ে চিঠিটার অনেক জায়গায় কুচকে গেছে। নিশ্চয়ই এগুলো আরাধ্যর চোখের পানি ছাড়া আর কিছুই না। হয়তো চিঠিটা লিখার সময় অনবরত পানি পড়ছিল ওর চোখ বেয়ে। এক রাশ কষ্ট বুকে চেপে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো স্পর্শিয়া।

“আমার স্পর্শ,
জানিনা আমার মৃত্যুর কতদিন পরে চিঠিটা তুমি হাতে পেয়েছ। তুমি হয়তো চিন্তা করছো চিঠিটা লিখলামই বা কেন। কিছু কথা যা তোমাকে না বলে থাকতে পারছিলাম না। বেচে থাকতে যখন জানাতে পারলাম না, তবে আমার মৃত্যুর পরেই তা জেনে নাও। স্পর্শ, প্রথমত আমি মাফ চেয়ে নিচ্ছি আমি গত কয়েকদিনে তোমার সাথে যে ব্যবহার করেছি সেজন্য। আমি তো আর তোমার সামনে আসতে পারলাম না। আসতে পারলে তোমার পায়ে ধরে মাফ চেয়ে নিতাম। তুমি আমার ব্যবহারে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছ আমি জানি। আসলে, অনেক ভালোবাসি তোমাকে, তাই তোমাকে অন্য কারও সাথে সহ্য করতে পারছিলাম না। তুমি অন্য কাওকে ভালোবাস এটা আমি কখনো স্বপ্নেও চিন্তা করিনি, অথচ তা বাস্তবে হওয়ায় আমি মেন্টালি ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম। কি রেখে কি করছিলাম নিজেও বুঝতে পারছিলাম না। তোমার গায়ে হাত তুলেছি, অনেক খারাপ ভাষায় তোমার সাথে কথা বলেছি, অনেক বাজেভাবে গালিগালাজ করেছি, আমাকে মাফ করে দিও স্পর্শ। আমি আমার মধ্যে ছিলাম না। পশুর থেকেও জঘন্য হয়ে গিয়েছিলাম। আমি নিজের কানে শুনেছি তুমি সায়ানকে ভালোবাস বলেছ, তারপরেও আমি তোমাদের আলাদা করতে চেয়েছি, তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি। আমার স্পর্শ অন্য কাওকে ভালোবাসে সেটা আমার সহ্য হচ্ছিল না। হয়তো ফ্যামিলির প্রেশারে পড়ে বিয়েতে রাজি হয়েছিলে তুমি। কিন্তু বিশ্বাস কর স্পর্শ, তুমি যদি আরও আগে আমাকে মানা করে দিতে, যদি বলে দিতে তুমি আর সায়ান দুজন দুজনকে ভালোবাস তাহলে আমি তোমাদের দুজনের মাঝে থেকে সরে যেতাম। হয়তো কষ্ট হতো, কিন্তু সরে যেতাম। কাওকে কিছু বুঝতেও দিতাম না। তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা আমিই করে দিতাম। কিন্তু আজ একটা বছর পার হয়ে গিয়েছে আমাদের সম্পর্কের। তোমাকে এত কাছ থেকে পেয়ে তোমাকে হারিয়ে ফেলাটা আমার বুকের মধ্যে আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। তাই তোমাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে চেয়েছিলাম তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। আর সেজন্যই তাড়াহুড়ো করে বিয়েও করে ফেলতে চেয়েছিলাম। ধন্যবাদ তোমাকে, সেদিন আমার চোখ খুলে দেওয়ার জন্য। আমি ভুল করছি তা আমাকে বুঝানোর জন্য। সেদিন বলেছিলে না জোর করে হয়তো তোমাকে বিয়ে করতে পারবো, কিন্তু তোমার ভালোবাসা কখনোই পাব না। সেই একটা কথাই আমার ভুল বুঝতে আমাকে সাহায্য করেছে। সারাটা রাত আমি চিন্তা করেছি আমি কি করবো? কি নিয়ে বাচবো তোমাকে ছাড়া? তোমাকে ছাড়া যে আমার জীবন অর্থহীন। বেচে থাকলে তোমাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, আর তোমাকে না পাওয়ার কষ্ট তীব্র থেকে তীব্রতর হতো। তাই নিজের জীবন দিয়ে দিলাম। হয়তো কখনো কখনো ঘৃণাও হতো তোমার উপর। কিন্তু তোমাকে ঘৃণা করে বেচে থাকা আমার জন্য সম্ভব ছিল না। আমি বেচে থাকলে সায়ানকে বিয়ে করতেও তোমাকে খুব সমস্যার সম্মুখীন হতে হতো। এখন আমি নেই, তোমরা চাইলে খুব সহজেই বিয়ে করতে পারবে। ফ্যামিলি রাজিও হবে। সবশেষে এটাই বলবো, খুব ভালোবাসি তোমাকে। কেও কাওকে মন থেকে ভালোবাসলে নাকি দুনিয়াতে সম্ভব না হলেও, আল্লাহ তাদের পরপারে মিলিয়ে দেন। যদিও আমি মহাপাপ করেছি আত্মহত্যা করে, তবুও আমি পরপারে তোমারই অপেক্ষায় থাকবো। আমার ভালোবাসা সত্যি হলে আমি তোমাকে এই দুনিয়াতে না হোক, ওই দুনিয়াতে পাবো। ভালো থেকো আমার স্পর্শ। ”
ইতি
– আরাধ্য

চিঠিতে আরাধ্যর চোখের শুকানো পানির সাথে যুক্ত হলো স্পর্শিয়ার চোখের পানি। চিঠিটা ভিজে নরম হয়ে কয়েক জায়গায় ছিড়ে গেল। আরাধ্যর না, বরং ওর ই বেচে থাকার কোন অধিকার নেই। কোন পাপের শাস্তি এতদিন ও নিস্পাপ ছেলেটাকে দিয়েছে তা ও ভেবেই পাচ্ছে না। নিজের চোখেই ও নিজে আজ খুব বড় অপরাধী। এমন একটা ছেলেকে যেই মেয়ে কষ্ট দিতে পারে তার চেয়ে বড় অপরাধী আর কে ই বা হতে পারে?
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
যখন হসপিটালে ফিরে গেল স্পর্শিয়া তখন সবাই আইসিউ এর সামনে। ডাক্তার বলেছিল দুপুর থেকে সন্ধ্যার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। সবার মুখে চিন্তার ছাপ। আরাধ্যর মা কাদছে আর হাত তুলে মোনাজাত করছে। কি ভয়াবহ একটা ঘটনা, আজকের এইসবের জন্য সবার নজরে যে মেয়েটা নিতান্তই বাচ্চা সে মেয়েটাই দায়ী।

পায়েল স্পর্শিয়ার সামনে এল।
– স্পর্শিয়া, আজ সকালে আমরা আরাধ্যর রুম থেকে একটা চিঠি পেয়েছি।
স্পর্শিয়ার গলা বুক শুকিয়ে গেল। আরাধ্য ওর বাসায়ও চিঠি লিখে রেখেছিল? ও কি ওদের সম্পর্কে কিছু বলেছে? ওর সুইসাইড অ্যাটেম্পের কারণ লিখেছে চিঠিতে? নাকি অন্যকিছু?
মূহুর্তেই অনেকগুলো চিন্তা একসাথে করে ফেললো স্পর্শিয়া। তারপর কাপা কাপা গলায় বলল,
– কি… কি লেখা ছিল চিঠিতে ভাবি?
– গত কিছুদিনে আরাধ্য বেশ কয়েকটা বিজনেস প্রজেক্টে লস করে। সেখানে প্রায় ৩০ কোটি টাকার মতো লস হয়। সেই কষ্টে ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। পর পর এতোগুলো প্রজেক্টে লস করায় ওর ধারণা হয়, ও কখনো বিজনেসে ভালো কিছু করতে পারবে না। আর এতগুলো টাকা লস হওয়ায় ও খুব অনুতপ্ত তাই ও সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। আর এইজন্যই গত কয়েকদিন ও খুব ডিপ্রেসড ছিল। কারও সাথে তেমন কথা বলতো না। ওর চুপচাপ থাকার কারণ কেও জিজ্ঞেস করলে তাও বলতো না। স্পর্শিয়া আমরা তো বিশ্বাস ই করতে পারিনি আরাধ্য প্রজেক্ট লস হওয়াতে এত বড় একটা ডিসিশন নিয়ে ফেলবে। ওর মতো একটা বুদ্ধিমান ছেলে এমন কি করে করতে পারে তুমিই বলো?
কথা বলতে বলতেই পায়েল কেদে দিল। স্পর্শিয়া দ্রুত পায়েলের সামনে থেকে চলে এলো। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো ও। আরাধ্য জানতো ও সুইসাইড করার চেষ্টা করলে সন্দেহ টা সবাই কম বেশি স্পর্শিয়াকেই করবে। তাই ও এই মিথ্যা চিঠিটা লিখে গিয়েছে। আর প্রজেক্টে লস হলে তার দায়ীও তো ও নিজেই৷ ওর জন্যই তো আরাধ্য কাজে কনসার্নট্রেট করতে পারেনি।

সন্ধ্যা পার হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখনো আরাধ্যর জ্ঞান ফেরেনি। স্পর্শিয়ার মন কু ডাক ডাকছে। ভয় হচ্ছে ওর। আল্লাহর কাছে বার বার দোয়া করছে আরাধ্যর জ্ঞান ফেরার জন্য।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে আরাধ্যর জ্ঞান ফিরলো। চোখ খুলতেই সামনে ওর মা কে পেল। ঘোলা চোখে চারিদিকে নজর বুলালো। সবাই হাসি হাসি চেহারা নিয়ে ওর আশেপাশে দাঁড়িয়ে আছে । স্পর্শিয়ার উপর নজর পড়তেই সবকিছু মনে পড়ে গেল ওর। স্পর্শিয়া দূরে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। এতগুলো স্লিপিং পিল খাওয়ার পরেও আল্লাহ ওকে কেন বাচিয়ে রাখলো সেই দুঃখ প্রকাশ করতে লাগলো মনে মনে। নাকে, গলায় জ্বালাপোড়া করছে। খেয়াল করতেই দেখলো ওর নাক দিয়ে পাইপ ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারলো না। তার আগেই চোখ দুটো বন্ধ হয়ে গেল। আরাধ্যর চোখ বন্ধ করার সাথে সাথে স্পর্শিয়া কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সবাই হৈ চৈ শুরু করে দিল। ডাক্তার সবাইকে আশ্বস্থ করে বললেন আরাধ্য এখন আউট অফ ডেঞ্জার। স্লিপিং পিলের প্রভাব এখনো কাটেনি। কয়েক ঘন্টা ঘুমালে ও ঠিক হয়ে যাবে। আর ওকে আইসিউ থেকে নরমাল কেবিনে ট্রান্সফার করা হবে একটু পরেই। নাকের নলটাও খুলে ফেলা হবে। দীর্ঘ সময় পর স্পর্শিয়া এবার একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।

রাতে স্পর্শিয়া থাকতে চাইলেও নিশাত চৌধুরী থাকতে দিলেন না। স্পর্শিয়া যখন তাকে বলল ও আজ রাতেও থাকতে চায়, খুব কড়া করেই তিনি স্পর্শিয়াকে বলে দিলেন,
– তুমি এখানে থাকতে পারবে না। তোমার সে অধিকার নেই৷ কালকে আমি অসুস্থ ছিলাম, এখানে থাকলে আমি কখনোই তোমাকে হসপিটালে থাকার পারমিশন দিতাম না।
স্পর্শিয়া চমকে গেল নিশাত চৌধুরীর কথা শুনে । তিনি তো কখনো এভাবে কথা বলেন না। ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল,
– আন্টি আপনি আমার সাথে এভাবে কথা বলছেন কেন?
– এভাবে কথা বলবো না কেন? আজ তোমার জন্য আমার ছেলের এই অবস্থা।
নিশাত চৌধুরীর কথা শুনে স্পর্শিয়ার নিশ্বাস ধীর হয়ে গেল। তিনি বলতে লাগলেন,
– আরাধ্যর মতো ছেলে শুধু বিজনেস প্রজেক্টে লসের জন্য সুইসাইড করার চেষ্টা করবে এটা বাকি সবাই মানতে পারলেও আমি মানতে পারবো না। আমার ছেলে ও, জন্ম দিয়েছি ওকে। রগে রগে চিনি আমি আমার ছেলেকে। আমার ছেলে কখনো ভীতুদের মতো মুখ লুকায় না, বরং যা হয় তা সামনাসামনি ফেস করে। গত কয়েকদিনে আরাধ্য আগোছালো হয়ে গিয়েছিলে। কি করতো ও নিজেই বুঝতো না। পাগলের মতো ব্যবহার করতো প্রায়ই। তোমার সাথে যে ওর গত কয়েকদিন কথা হয়নি সেটা আর কেও খেয়াল না করলেও আমি করেছি। আর তার কিছুদিন পরেই হঠাৎ সবাইকে জড়ো করে বলল ও তোমাকে ইমিডিয়েটলি বিয়ে করতে চায়। আগে সন্দেহ হতো, কিন্তু এ কথার পর আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে তোমার সাথে জড়িত কিছু নিয়েই ও আপসেট। আর, আজ আমার ছেলেটার এ অবস্থা। আজ আমার ছেলের কিছু হয়ে গেলে এর দায়ী শুধু তুমিই থাকতে।

নিশাত চৌধুরী কাদতে কাদতে চলে গেলেন স্পর্শিয়ার সামনে থেকে। স্পর্শিয়া থরথর করে কাপতে লাগলো। ভারসাম্য রাখতে না পেরে দেয়াল ধরে দাড়ালো। কি চেয়েছিল ও, আর কি হচ্ছে। সব কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
বাসায় এসে নফল নামাজ পড়লো স্পর্শিয়া। আরাধ্যর জান বাচানোর জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলো। ওর দীর্ঘায়ুর জন্য দোয়া করলো আল্লাহর কাছে। নিজের ভুলের জন্য মাফ চাইলো, আল্লাহ যেন ওকে সঠিক পথটা দেখাতে পারে সেই দোয়া করলো।

নামাজ শেষ করে বিছানায় মাথাটা একটু এলিয়ে দিতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। ফোনের রিংটোনে চোখ খুললো। সায়ান কল করেছে। কিন্তু এ সময়ে সায়ান কেন কল করলো? ফোন ধরবে নাকি ধরবে না তা ভাবতে ভাবতেই কল কেটে গেল। আবারো কল দিল। এবার স্পর্শিয়া সাথে সাথেই কল পিক করলো।
– হ্যা সায়ান, বলো। কি ব্যপার?
– স্পর্শিয়া, তখন তোমার আর খালামনির সব কথাই আমি শুনেছি।
স্পর্শিয়া কিছুক্ষন চুপ করে বলল,
– হ্যা, সত্যিই তো শুনেছ। আমার জন্যই তো আজ আরাধ্যর এই অবস্থা। ভুল কিছু তো বলেননি উনি। আর উনি আমার সাথে এমন ব্যবহার করায় আমি রাগও হইনি। বরং, যা আমার পাওনা ছিল, সে ব্যবহার টাই পেয়েছি আমি।
– না আসলে.. কথা তো অন্যকিছু।
– কি, বলো।
– তোমার কি মনে হয় আরাধ্য ভাইয়ার এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী তা বুঝতে পারার পরেও খালামনি তোমাকে এক্সেপ্ট করবে?
স্পর্শিয়া উত্তর না দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
সায়ান আবার বলল,
– স্পর্শিয়া, আমি নিজের ভুল যেহেতু বুঝতে পেরেছি, তোমাকে ভালোবাসি সেটা যেহেতু রিয়েলাইজ করতে পেরেছি, আমি তোমাকে কখনোই ফিরিয়ে দিব না। তুমি যে কোন সময় আমার কাছে আসতে পার।
– না, সায়ান। আমি আরাধ্যকে ভালোবাসি, তোমাকে না। এতদিন যা ছিল, তা আমার ভুল ছিল, আবেগ ছিল, ভালোবাসা না।
– ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে। কিন্তু, আমি তোমার। আর সবসময় তোমারই থাকবো। আশা করি তুমি আবারো ভেবে দেখবে। জীবনটা তো আর পুতুল খেলা না।
স্পর্শিয়া সায়ানকে উত্তর না দিয়েই কল কেটে দিল। চাচ্ছে টা কি ও? সব ক্লিয়ারলি জানানোর পরেও এসব কথা বলার কোন মানে হয় না। যাইহোক, এখন আরাধ্যকে নিয়ে ভাববার সময়, সায়ানকে নিয়ে না।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

.
.
.
.
আরাধ্যর ঘুম ভাঙলো পরদিন সন্ধ্যায়। এখন ও অনেকটাই সুস্থ। কিন্তু শরীর দুর্বল হওয়াতে আরও দুদিন হসপিটালে থাকতে হবে। আরাধ্যর সবার আগেই খেয়াল এলো, স্পর্শিয়ার ডাইরিতে ও যে চিঠি রেখে এসেছে তা ওর সরাতে হবে। সবাই আরাধ্যর সাথে এসে কথা বললেও স্পর্শিয়া ওর সাথে কথা বলছে না। সারাক্ষণ হয়তো ওর আশেপাশেই থাকছে, অথবা ওকে দূর থেকে দেখছে, কিন্তু ওর কাছে এসে ওর সাথে কথা বলছে না। আরাধ্য বুঝতে পারলো না কি চলছে ওর মনে।

রাতে নিশাত চৌধুরী আরাধ্যকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছিলেন, তখনই আরাধ্য বলে বসে,
– মা, তোমার যদি কোন আপত্তি না থাকে তবে আজ রাতে স্পর্শিয়া হসপিটালে থাকুক?
স্পর্শিয়া আর নিশাত চৌধুরী দুজনেই দুজনের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো।
প্রেম 💙 (Love has no limits)

#পর্বঃ ২২

সবাই চলে গিয়েছে হসপিটাল থেকে। আরাধ্যর ইচ্ছে অনুযায়ী আজ রাতে স্পর্শিয়াকে হসপিটালে থাকতে দিচ্ছে সবাই। স্পর্শিয়া কি করবে, বা আরাধ্য কেনই ওকে থাকতে বলল বুঝতে পারছিল না ও । তাই অযথাই কেবিনের এদিক সেদিক হাটাহাটি করছিল, এটা সেটা গোছাচ্ছিল। আরাধ্যর ডাক শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল ও।
– স্পর্শিয়া, এদিকে এসে বস।
স্পর্শিয়ার বুক টা মোচড় দিল। আরাধ্য ওকে এখনও স্পর্শিয়া বলে ডাকছে। না জানি কি বলবে। ধীর পায়ে আরাধ্যর সামনে গেল।
– চেয়ারটায় বস স্পর্শিয়া।
স্পর্শিয়া আরাধ্যর বেডের সামনে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।

দুজনেই চুপচাপ। আরাধ্য কিছু বলছে না। একদৃষ্টিতে ওকে দেখেই যাচ্ছে । সেই দৃষ্টিতে না ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছে, না কোন ক্ষোভ। স্পর্শিয়া বুঝতে পারছে আরাধ্য ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু ওর সাহস হচ্ছে না আরাধ্যর চোখে চোখ মেলানোর। তাই নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। নিস্তব্ধতার প্রতিটা মূহুর্ত স্পর্শিয়ার কাছে এক একটা ঘন্টা মনে হচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে, হাত কাপছে। একটু পরপর কপালের সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো সরাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন স্পর্শিয়া ওর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে নিলে আরাধ্য রাগ করতো। আরাধ্য সবসময় নিজের হাতে স্পর্শিয়ার কপালের চুল সরাতে পছন্দ করতো। বেশ কিছু সময় এরকম অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পাড় করার পরে নিস্তব্ধতা ভেঙে স্পর্শিয়াই বলল –
– আ… আরাধ্য, কিছু খাবে?
কথাটা বলার সময় স্পর্শিয়া গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না।
আরাধ্য স্পর্শিয়াকে পালটা প্রশ্ন করলো,
– এনিথিং রং?
– ন… না, কই? কিছু না তো।
– স্পর্শিয়া, আমাদের কো…
আরাধ্যর কথার মাঝে স্পর্শিয়া ওকে থামিয়ে দিয়ে নিচু স্বরে বলল,
– আরাধ্য, তুমি তো আমাকে স্পর্শিয়া বলে ডাকো না।
আরাধ্য মৃদু হেসে বলল,
– সেটা আমার ভালোবাসার ডাক ছিল। সেই অধিকারটা এখন আর আমার নেই।
আরাধ্য স্পর্শিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাথে সাথেই বলা শুরু করলো।
– স্পর্শিয়া, কিছুদিন যাবত আমাদের কোম্পানির হিউজ অ্যামাউন্টের বেশ কয়েকটা প্রজেক্ট লস হয়। ইট ওয়াজ মাই বেড লাক, প্রজেক্টগুলো আমিই হ্যান্ডেল করছিলাম। এর মধ্যে একটা ইন্টারন্যাশনাল প্রজেক্ট ছিল। খুব স্বপ্ন ছিল প্রজেক্ট টা নিয়ে আমার। কিন্তু, প্রজেক্ট টা খুব বাজে ভাবেই লস হলো । খুব কষ্ট হচ্ছিল এই ভেবে যে, এই প্রথম ভাইয়া আর ড্যাড আমার ওপর ট্রাস্ট করে এত বড় একটা প্রজেক্ট হাতে দিল, আর আমি তা এভাবে লস করে ফেললাম। এটা চিন্তা করতে করতেই ডিপ্রেসড হয়ে গিয়েছিলাম । কোন কিছু চিন্তা করতে না পেরে সুইসাইডের চেষ্টা করেছি। আমার কাছে তখন মনে হচ্ছিল আমি হয়তো কোন কাজের না, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। তাই…

স্পর্শিয়া বুঝতে পারলো না আরাধ্য ওকে মিথ্যা কেন বলছে। ও ভেবেছিল আরাধ্য ওর সাথে এই কয়েকদিনের মতোই খারাপ ব্যবহার করবে। তাই ওর ভয় হচ্ছিল। কিন্তু ওর বিহেব তো বেশ নরমাল। তবে কি আরাধ্যর ধারণা ও চিঠিটা পায়নি এখনো?
স্পর্শিয়া সাথে সাথেই বলল,
– আরাধ্য আমি চিঠিটা পড়েছি।
কিছুক্ষন সময় নিয়ে আরাধ্য বলল,
– হ্যা, বাসায় চিঠিটা আমিই লিখেছিলাম সবাইকে জানানোর জন্য।
– তুমি আমার ডাইরিতে যে চিঠিটা রেখেছিলে আমি সেটার কথা বলছি।
আরাধ্য এবার চুপ হয়ে গেল। ওর ধারণা ছিল না স্পর্শিয়া এত জলদি চিঠিটা পেয়ে যাবে। যেহেতু ওর জান বেচে গিয়েছে তাই ও আর চায়নি স্পর্শিয়ার হাতে চিঠিটা পড়ুক।

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে আরাধ্য বলল,
– আচ্ছা, থাক এসব বাদ দাও। বলো সায়ানের কি খবর? মানে, তোমরা এ কয়দিন হয়তো আমাকে নিয়ে বিজি ছিলে, এখন কিভাবে কি করবে তা বলো।
স্পর্শিয়ার বুক ফেটে কান্না আসতে লাগলো আরাধ্যর কথা শুনে। কাপা কাপা গলায় বললো,
– আরাধ্য। আমার লাইফের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা বলি? শুনবে?
– বলো।
– ক্লাস টেইনে পড়তাম যখন সায়ানের সাথে আমার সম্পর্ক হয়৷
আরাধ্য হেসে বলল,
– ও আচ্ছা! তোমার লাভ স্টোরি শুনাতে চাচ্ছ আমাকে?
– আরাধ্য শুনবে তো আগে।
– হুম, শুনছি। বলো।
– কোচিং এ যাওয়া আসার সময় রাস্তায় প্রতিদিন দেখা হতো, ও আমাকে ফলো করতো, অনেকটা সেই চিরপ্রচলিত স্টাইলেই ওর সাথে আমার রিলেশন টা হয়। যেহেতু ও আমার ফার্স্ট লাভ ছিল, তাই…
স্পর্শিয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়েই আরাধ্য কিছুটা তুচ্ছ হাসি দিয়ে বলল,
– ওওও, ফার্স্ট লাভ? তো, সেকেন্ড লাভ কেও আছে নাকি শুনি।
মজার সুরে বললেও আরাধ্যর যেন কলিজাটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল স্পর্শিয়ার কথা শুনে। এই মেয়ে আর কিছু পেল না, অবশেষে সায়ানের কথাই শুরু করতে হলো ওকে?

স্পর্শিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
– আরাধ্য আমাকে কি তুমি কথা শেষ করতে দিবে? আর যদি শুনতে ভালো না লাগে তবে চুপ হয়ে যাই।
– না। শুরু যখন করেছ, তবে বলেই ফেল।
– ছোট ছিলাম বলে সহজেই উইক হয়ে পড়ি সায়ানের ওপর। টান টা একটু বেশিই কাজ করতো। রিলেশনের এক পরেই ও এম.এস.সি এর জন্য বাইরে চলে যায়। বাইরে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম ভালোই চলছিল সব। সুযোগ পেলেই কথা বলতো আমার সাথে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ও চেঞ্জ হয়ে যায়। কথা বলা হতো না বললেই চলে। ওর সাথে যা যোগাযোগ করার আমিই করতাম। ফেসবুকে নক দিলে রিপ্লাই করতো না, হোয়াটস অ্যাপে কল দিলে কখনো পিক করতো কখনো করতো না। মাঝেমধ্যে কল রিসিভ করলে আশেপাশে মেয়েদের হাসাহাসির ভয়েস পেতাম। একবার এক মেয়ে ফোন পিক করে বলেছিল “আ’ম সায়ান’স গার্লফ্রেন্ড। হু আর ইউ? ” সে রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। হাজার টা কল দেওয়ার পরেও সায়ান কল পিক করেনি। তিনদিন পর আমার কল পিক করে সায়ান বলেছিল, মেয়েটা ওর ফ্রেন্ড হয়। মজা করেছে আমার সাথে। সবসময় এরকমই চলতো। ও আমাকে ব্যস্ততার অজুহাত দেখাতো। তবুও আমি কন্টাক করেই যেতাম। আমি নাকি সবকিছু এক্সেস করতাম, ওর এসব পছন্দ ছিল না। একপর্যায়ে ও আমাকে বলে আমার সাথে ও কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। শুদ্ধ ভাষায় যেটাকে আমরা বলি “ব্রেক আপ”। আর ব্রেক আপ এর কারণ দেখিয়েছিল আমি নাকি বড্ড বেশি বাচ্চা। সবকিছুতেই বাচ্চামি করি। ওর প্রবলেমস বুঝতে চাই না। সেদিনের পরেও আমি প্রতিদিন ওকে কল দিয়েই গিয়েছি কিন্তু ও কখনোই আর কল পিক করেনি।

আরাধ্যর চোখ বেয়ে পানি পড়লো দু ফোটা। স্পর্শিয়া যেন দেখতে না পায় তাই জলদি চোখ মুছে ফেললো। ভাবতে লাগলো, সায়ান কত ভাগ্য নিয়েই না জন্মিয়েছে, স্পর্শিয়া ওকে এত ভালোবাসে। ও হলে তো স্পর্শিয়াকে সারাদিন মাথায় করে রাখতো। কিন্তু আফসোস সে ভালোবাসা ওর নয়।
– তারপর বলো। কি হলো তারপর?
– এরইমধ্যে তোমার বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। আমার ফ্যামিলি আমাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে আমি বিয়েতে রাজি কি না। দাদা তোমাকে খুব পছন্দ করেছিল, তাই আর মানা করতে পারিনি। আর তাছাড়া সায়ান কখনো আমাকে ফিরিয়ে নেবে না ওর লাইফে তাও বুঝে গিয়েছিলাম। তাই বিয়েতে রাজি হয়ে যাই। যেখানে নিজের ভালোবাসাকে পাবো না, সেখানে ফ্যামিলিকে কষ্ট দেওয়ার কোন মানে হয় না। আর জিদ করে আমার বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা সায়ানকেও জানাই না। কল দিলে পিক করবে না জানি, মেসেজ দেওয়াও তখন প্রয়োজন মনে করিনি। এতদিনে না ওর কোন কল আসে, না আমি কোন কল দেই। প্রায় এক মাস আগে আমার ফোনে ও কল দেয়। তখন…
– ওয়েট! এক মাস আগে কল আসে? মানে এই এক বছরে তোমার আর সায়ানের কোন কন্টাক্ট ছিল না?
– না।
আরাধ্যর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ও তো এতদিন এটাই ভেবে এসেছে যে সায়ান আর স্পর্শিয়ার রিলেশন সবসময়ই কন্টিনিউ ছিল।

আরাধ্যকে চুপ থাকতে দেখে স্পর্শিয়াই আবার বলা শুরু করলো।
– তোমাকে আমি মন থেকে আপন করার খুব চেষ্টা করেছিলাম। আফটার অল, তুমি আমার হবু হাজবেন্ড। কিন্তু মাসখানেক আগে যখন সায়ান কল দিল তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই৷ ওর কথা বার্তাই ছিল বাকরুদ্ধ হওয়ার মতো। ও আমার কাছে মাফ চায়, অনেক কান্নাকাটি করে। এটা সেই সায়ান যাকে আমি কখনোই চিনতাম না। ওর কথাবার্তায় আমি যেন হিপনোটাইজ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে তা জানার পরেও ও আমার সাথে সব ঠিক করতে চাইতো। আমি ওকে প্রতিবারই মানা করতাম। বারবার দেখা করতে চাওয়ায় আমি সেদিন রাজি হই দেখা করতে। সত্যি বলতে আমি এতটাই টেনশনে থাকতাম যে আমার মনেই ছিল না সেদিন আমাদের এ্যাঙ্গেজমেন্টের ফার্স্ট এ্যানিভারসারি ছিল। আমি ওর সাথে দেখা করতে যাই, আর তখন আমাকে ও বারবার জিজ্ঞেস করছিল ভালবাসি কি না ওকে এখনো। আমি হয়তো আবেগের বশেই বলে দেই যে আমি ওকে ভালোবাসি। তখনি দেখি তুমি আমার সামনে উপস্থিত, সব কথা শুনছো।
– ওয়েট ! তুমি জানতে যে সায়ান আমার কাজিন, তারপরেও তুমি আমাকে কখনো কিছুই বল নি, এমন কি জিজ্ঞেসও করনি কখনো ওর ব্যাপারে কিছু।
– না আরাধ্য। আমি জানতাম না ও তোমার কাজিন। সেদিন যখন তুমি আমাদের সামনে চলে এলে, তখনি আমি জানতে পেরেছি। পরবর্তীতে যখন আমি সায়ানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম, ও আমাকে বলেছিল ও সবকিছু আগে থেকেই জানত যে তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে, কিন্তু সায়ান আমাকে এসব বলে কখনো ডিপ্রেসড করতে চায়নি, কষ্ট দিতে চায়নি । আর পরবর্তীতে ও যখন সবকিছু রিয়েলাইজ করতে পারলো ওর ভুল, আর ও আমাকে ভালোবাসে সেটা যখন বুঝতে পারলো তখন ও নাকি থাকতে না পেরে আমার কাছে ফিরে এসেছিল।

আরাধ্যর কাছে কেমন যেন আগোছালো লাগছে কথাগুলো। প্রথমত, সায়ান স্পর্শিয়াকে ভালোবাসতো না ঠিক আছে, কিন্তু যখন সায়ানকে আরাধ্য স্পর্শিয়ার ছবি দেখিয়েছিল তখনও সায়ান কিছু বলে নি। এমনকি স্পর্শিয়াকেও ও কখনো কল দেয় নি। কেও কাওকে বিন্দুমাত্র ভালো না বাসলেও তো তার গার্লফ্রেন্ডের সাথে নিজেরই কাজিনের বিয়ে ঠিক হয়েছে তা শুনার পরে একটু হলেও কৌতুহল জাগে। এমন কি সায়ান কখনোই স্পর্শিয়ার ব্যাপারে কিছু জানতে চায়নি। অথচ আজ এক বছর পর যখন সায়ান ফিরে এল তখন ও বলছে স্পর্শিয়া যাতে সবকিছু শুনে কষ্ট না পায়, ডিপ্রেসড না হয়, সেজন্য এতদিন ওকে কিছু জানায়নি। যেন সায়ানের কত কনসার্ন স্পর্শিয়াকে নিয়ে। ব্যাপারগুলো খুব অদ্ভুত লাগছে আরাধ্যর কাছে। অথবা, এমন নয় তো স্পর্শিয়া ওকে মিথ্যা বলছে? কারণ একটা কথার সাথে আরেকটা কথার কানেকশন খুব উইক।

আরাধ্যকে চুপ করে থাকতে দেখে স্পর্শিয়াই জিজ্ঞেস করল,
– কি হলো আরাধ্য? কিছু বলছ না যে।
আরাধ্য ওর নিজের মনের চিন্তাগুলো স্পর্শিয়ার সামনে প্রকাশ না করে কথা ঘুরিয়ে বলল,
– এখন তো খুশি তুমি খুব, তাই না? তোমার সায়ানকে তুমি ফিরে পেয়েছ। ও এখন তোমারই থাকবে সবসময়। আর, আমার দিকে থেকেও এখন আর কোন বাধা নেই।
– কিন্তু, আমি তো এটা চাই না।
আরাধ্য অবাক হয়ে গেল স্পর্শিয়ার কথায়। ভ্রু কুচকে বলল,
– এটাই তো এতদিন যাবত তোমার একমাত্র চাওয়া ছিল।
– হ্যা, কিন্তু এখন আর চাই না। এখন চাই তুমি আমাকে আগলে রাখো, তোমার কাছে আটকে রাখো, যেতে দিও না আমাকে সায়ানের কাছে।
– কিন্তু কেন?
– তোমাকে ভালোবাসি যে তাই!

হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন “কিছু কিছু সময় আসে যখন আমরা বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের সীমারেখায় অবস্থান করি। তখন আমরা একই সঙ্গে দেখতে পাই ও পাই না। বুঝতে পারি ও পারি না৷ অনুভব করতে পারি ও পারি না। সে বড় রহস্যময় সময়। ”

আরাধ্যর এই সময়টা ঠিক সেরকম ই। ও যেন হ্যাং হয়ে গেল স্পর্শিয়ার কথা শুনে। ওর এক মন কেন যেন ইচ্ছে করছে স্পর্শিয়ার কথাটা বিশ্বাস করতে, আবার আরেক মন মানা করছে। বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। স্পর্শিয়া সত্যিই ওকে ভালোবাসে, নাকি অন্য কোন কারণ আছে এখানে? আর, সায়ান? সায়ানকে না স্পর্শিয়া ভালোবাসে, তবে ওকে কেন ভালবাসি বললো? দ্রুত কথাগুলো চিন্তা করে স্পর্শিয়ার দিকে নজর দিল আরাধ্য। স্পর্শিয়ার স্থির দৃষ্টি ওর দিকেই নিবদ্ধ। কিছুটা চড়া গলাতেই আরাধ্য বলল,
– পেয়েছ টা কি? কখনো বলবে সায়ান কে ভালোবাস, আবার কখনো বলবে আমাকে। সমস্যা টা কি তোমার?
স্পর্শিয়া কিছুটা চমকে গেল হঠাৎ আরাধ্যর এমন ব্যবহারে।
– স্পর্শিয়া, আর কখনো এ টাইপ কথা আমাকে বলবে না।
– আরাধ্য, আমার কথা তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?
– স্পর্শিয়া, আমাকে আগের মতো ব্যবহার করতে বাধ্য করো না। লিভ মি এ্যালোন। ভুল হয়েছে তোমাকে আজ হসপিটালে থাকতে বলাটা। বের হও কেবিন থেকে। আমার এই মূহুর্তে কিচ্ছু ভালো লাগছে না।

শেষের কথাগুলো আরাধ্য খুব চেচিয়ে বললো। আর পাশের টেবিলে ওর স্যালাইন লাগানো হাত দিয়ে জোরে বাড়ি দিল। মনে হচ্ছে আওয়াজ এখনো কানে বাজছে। ঘটনার আকস্মিকতায় স্পর্শিয়া চুপ হয়ে গেল। এসি রুমেও আরাধ্যর নাক বেয়ে তিড়তিড় করে ঘাম পড়ছে। চেহারা লাল হয়ে গেছে। স্পর্শিয়া রুম থেকে বের হয়ে যেতেই আরাধ্যর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো এক ফোটা। মনে মনে বলতে লাগলো, এমন কেন তুমি স্পর্শ? কতটা ভালবাসি আমি তোমাকে। অথচ যেই তুমি দুদিন আগেও সায়ানের জন্য বিয়ে ভাঙতে চেয়েছ, সেই তুমিই আজ আমাকে ভালোবাস বলছ? ভালোবাসা কি এতই মূল্যহীন? এতই ঠুনকো? এতটাও বাচ্চা নও তুমি যে ভালোবাসা কি সেটাও বোঝ না।

কেবিনের দরজায় শব্দ হতেই আরাধ্য তড়িঘড়ি করে চোখ মুছে নিল। স্পর্শিয়া এসেছে, সাথে একজন নার্সও আছে। স্পর্শিয়া দূরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। নার্স এসে আরাধ্যর হাত ধরতেই ও খেয়াল করলো ওর হাত দিয়ে রক্ত ঝরছে। বুঝতে পারলো তখন এই হাত দিয়েই টেবিলে জোরে আঘাত করায় ক্যানোলা ছুটে রক্ত বেরিয়ে গেছে। অথচ ওর মনের কষ্টটা এতই বড় ছিল যে শরীরের ব্যথাটা অনুভব ই করতে পারলো না।

নতুন করে স্যালাইন লাগিয়ে নার্স জিজ্ঞেস করলেন,
– শরীর কেমন এখন?
– হ্যা, ভালোই আছি এখন আলহামদুলিল্লাহ।
– ভালো তো হবেই। যখন আইসিউতে ছিলেন আপনার বউ যেই পরিমাণে কান্নাকাটি আর দোয়া করেছেন আপনার জন্য, এতো ভালোবাসা দেখলে কপালে মৃত্যু থাকলেও দূরে সরে যায়। সারারাত শুধু আপনাকেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন উনি ।
আরাধ্য এক পলক স্পর্শিয়ার দিকে তাকালো। স্পর্শিয়া ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল, কিন্তু চোখাচোখি হতেই নজর সরিয়ে নিল।
– আচ্ছা আমি আসি। নিজের যত্ন নিবেন। এভাবে হাত টানাটানি করবেন না, নয়তো আবারো খুলে যাবে।

নার্স চলে গেল। স্পর্শিয়া আরাধ্যর সামনে এসে বসলো। আরাধ্যর দৃষ্টি অন্যদিকে। স্পর্শিয়া আরাধ্যর হাত ধরলো। আরাধ্য সাথে সাথেই স্পর্শিয়ার দিকে তাকালো। কি নিস্পাপ একটা চেহারা। এই মুখের দিকে তাকালেও সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। মনে হচ্ছে যেন স্পর্শিয়ার দু চোখে ভালবাসা ঠিকরে পড়ছে আরাধ্যর জন্য।

স্পর্শিয়া আরাধ্যর হাত ওর বুকের বাম পাশে রেখে বললো,
– আরাধ্য, আমাকে তুমি ভালোবেসে থাকলে ঠিকই বুঝবে আমার বুকের স্পন্দন শুধুই তোমার নাম নিচ্ছে।
আরাধ্য একবার স্পর্শিয়ার বুকে রাখা ওর হাতের দিকে তাকালো। হাতটা সরিয়ে ফেলতে চেয়েও সরাতে পারলো না। কেন যেন মনে হচ্ছে সত্যিই স্পর্শিয়ার বুকের ভেতর আরাধ্যর নামই জপছে। আগেও তো বেশ কয়েকবার স্পর্শিয়ার বুকে হাত রেখেছিল। কই? কখনো তো এই অনুভূতি টা হয়নি ৷

স্পর্শিয়া কাদতে লাগলো। ওর চোখের পানি আরাধ্যর হাতের উপর পড়লো । আরাধ্যর কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠলো । স্পর্শিয়া আরাধ্যর বুকের ওপর পড়ে আরও জোরে কেদে উঠলো। আরাধ্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না এর জন্য।
– আরাধ্য, আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি আরাধ্য। শুধুই তোমাকে ৷ সায়ান আমার অতীত ছিল, আমার ভুল ছিল। সেই আগের একটা আবেগকে আমি ভালোবাসা ভেবে বসেছিলাম। ভালোবাসা তো আমাকে তুমি শিখিয়েছ আরাধ্য । আরাধ্য, আমি যে শুধু তোমাকেই ভালোবাসি। সায়ানকে না পাওয়ার বেদনা আমাকে ওর দিকে আকৃষ্ট করেছে, আর তোমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিয়েছে । আমি তো বুঝতেও পারছিলাম না যে কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। কোনটা ভালোবাসা আর কোনটা শুধুই আবেগ। কিন্তু, তোমার এই কয়েকদিনের শূণ্যতা আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে এই মনটা তোমাকেই চায়, সায়ানকে না। আরাধ্য, প্লিজ আমাকে এক্সেপ্ট করে নাও। আমি যে তোমার । প্লিজ আরাধ্য, আর দূরে ঠেলে দিও না আমাকে। মরে যাবো আমি।
স্পর্শিয়া একদমে কথাগুলো বলেই আরাধ্যর বুকের ওপর নেতিয়ে পড়ে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদতে থাকে।

আরাধ্যর হার্টবিট বেড়ে গেছে। এই মূহুর্তে মস্তিষ্ক না, মন কাজ করা শুরু করেছে। আরাধ্যর কেন যেন স্পর্শিয়ার কথাগুলো বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করছে। ভালো না বাসলে তো এমন করার কথা না। এ যেন স্পর্শিয়ার এক অন্য রুপ ওর সামনে প্রকাশ পেয়েছে। একটা মেয়ে একটা ছেলেকে মন থেকে ভালোবাসলে যে রুপ প্রকাশ পায়, সে রুপ। আরাধ্য স্পর্শিয়ার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলো,
– আমাকেই যদি ভালোবাসো তবে আগে জানাওনি কেন? আর সেদিন তোমার বাসায় ডেকে নিয়ে কেন বললে আমাকে তুমি বিয়ে করতে চাও না?
স্পর্শিয়া আরাধ্যর বুক থেকে মুখ তুলে বলল,
– আরাধ্য, তোমাকে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ এটা ছিল না যে আমি সায়ানকে বিয়ে করতে চাই। আমার ততক্ষণে রিয়েলাইজ হয়ে গিয়েছিল যে আমি তোমাকেই ভালোবাসি। সে রাতেই আমি সায়ানের কাছে মাফ চাই সবকিছুর জন্য আর বলি যে ওর কাছে ফিরে যাওয়া আমার জন্য সম্ভব না । আর আমি যে তোমাকেই ভালোবাসি তা ওকে জানিয়ে দেই। নিজেকে বারবার দোষী মনে হচ্ছিল। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি আমি অকারণে। তুমি আমার সাথে যেমন ব্যবহার শুরু করেছিলে আমার তখন মনে হতো বিয়ের পরেও তুমি আমাকে কখনো বিশ্বাস করতে পারবে না, আর কখনো ভালোবাসতে পারবে না। আর আমি তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম, ঘৃণা না। তাই তোমাকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেই। আমি যদি জানতাম আমার এই সিদ্ধান্তে তুমি নিজের এত বড় ক্ষতি করবে, তবে আমি সারাজীবন তোমার ঘৃণার সাথেই থাকতাম, তবুও মুখ ফুটে কখনো কিছু বলতাম না।

স্পর্শিয়া আরাধ্যর হাত শক্ত করে ধরে বলল,
– প্লিজ আরাধ্য। ভুল করেছি, মাফ করে দাও। আর কিছুই চাই না আমি আরাধ্য। শুধু তোমাকে চাই। যে শাস্তি দিবে মাথা পেতে নিব। শুধু আমাকে আমার আগের আরাধ্য ফিরিয়ে দাও।

আরাধ্য খুব কষ্টে বেড এ উঠে বসলো। স্পর্শিয়া এখনো আরাধ্যর দুই হাত ধরে আছে। আজ ও আরাধ্যর ভালো খারাপ যে কোন কথা শুনতে প্রস্তুত। আরাধ্য নিজের শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে স্পর্শিয়াকে টেনে নিজের বাহুডোরে আঁকড়ে ধরলো । স্পর্শিয়ার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললো,
– বোকা মেয়ে। আরাধ্য তো সবসময়ই স্পর্শর ছিল, আছে, আর ওর ই থাকবে। ভালোবাসায় ঝড়-ঝাপটা এলে কি ভালোবাসা কমে যায়? শুধু আমার পাগল বউটা আর কখনো কনফিউজড না হলেই চলে।
স্পর্শিয়া আরাধ্যকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আরাধ্যর চোখের পানি স্পর্শিয়ার কপালে টুপ করে পড়লো, স্পর্শিয়ার চোখের পানিতে আরাধ্যর শার্ট ভিজে গেল। এ যেন এক সুখের কান্না।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
দুই দিন পর –

রুদ্র গোস্বামী বলেছিলেন, “যে প্রেমে চোখের জল নেই, তা প্রেম নয়। সে প্রেম সাময়িক আবেগ, শরীর, অথবা অন্যকিছু । ”

আরাধ্যর কাছে সকাল থেকেই স্পর্শিয়াকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা খুব ভালোভাবেই প্রেমে পড়েছে। আনমনেই হাসছে আরাধ্য । নাহ, অবশেষে বাচ্চাটাও প্রেমে পড়লো শক্ত পোক্ত ভাবে। গত দুদিনে বেশ কয়েকবার স্পর্শিয়াকে কাদতে দেখেছে ও। আজ তো কান্নার পরিমাণ আরও বেড়ে গিয়েছে। কারণ, আজ আরাধ্যকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে হসপিটাল থেকে। আরাধ্য এখন পুরোপুরি সুস্থ। ডাক্তার শুধু মেডিসিন নিতে বলেছে সময় মতো। তাছাড়া নিজের ভালোবাসাকে আবারো ফিরে পেয়েছে স্পর্শিয়া। সব মিলিয়ে আজ একটু বেশি বেশিই কাদছে।

রিলিজ নিয়ে সবাই গাড়ির কাছে আসতেই আরাধ্য এক আবদার করে বসে।
ও স্পর্শিয়ার আব্বুকে বলে,
– আপনাদের যদি কোন সমস্যা না থাকে, স্পর্শিয়াকে সাথে করে আমাদের বাসায় নিয়ে যাই। ও তিন চারদিন থেকে আসুক।

আরাধ্যর কথা শুনে স্পর্শিয়া চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে রইলো। বাকি সবাই একজন আরেকজনের দিকে চাওয়া চাওয়ি করছে।

নিশাত চৌধুরী সেই ঘটনার পর থেকে এখন আর চান না আরাধ্য আর স্পর্শিয়ার বিয়েটা হোক। বলা যায় না যেই মেয়ের জন্য তার ছেলের আজ এ অবস্থা, পরে এই মেয়ে আরাধ্যকে আবার না জানি কোন পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়।
তিনি নিজেই বললেন,
– আরাধ্য, স্পর্শিয়া এ সময় আমাদের বাসায় যাবে ব্যাপারটা কেমন না?
– মামনি, স্পর্শ আমাদের সাথে নানুবাড়িতে ঘুরে এসেছে আরও এক বছর আগে। আর কয়েকদিন পরে আমাদের বিয়ে। এখন আমাদের বাসায় থাকাটা কি খুব খারাপ কিছু?

মিনহাজ চৌধুরী আরাধ্যর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন,
– আরে, চলুক না স্পর্শিয়া। যেই ধকল গেল এ কয়দিন সবার উপর, ও বাসায় গেলে সবার মনটাও ফুরফুরে থাকবে। আর আরাধ্যও সুস্থ হবে জলদি।
চোখ টিপ দিয়ে তিনি বললেন,
ভালোবাসা কিন্তু মানুষকে জলদি সুস্থ হতে সাহায্য করে।
তার কথায় তাল দিয়ে সবাই হেসে দিল।

মিনহাজ চৌধুরীই জোড়াজুড়ি করে স্পর্শিয়াকে নিয়ে এলেন বাসায়।

স্পর্শিয়া তো মহা খুশি। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বাড়িটাকে আপন আপন মনে হতে লাগলো স্পর্শিয়ার কাছে । প্রথম শ্বশুর বাড়ি এসেছে বলে কথা।
আরাধ্য ওর কানের কাছে এসে বলল,
– ওয়েলকাম টু হোম বউ।
স্পর্শিয়া লজ্জাভরা হাসি দিল।
– ইস! এভাবে হেসো না স্পর্শ । বুকে গিয়ে বিধে তো।

বিশাল বড় বাড়ি আরাধ্যদের। ভেতরে ঢুকে স্পর্শিয়ার মনে হলো রাজপ্রাসাদের চেয়ে কম না। আরাধ্য সবার কথায় বাধ্য হয়েই উপরে ওর রুমে চলে গেল রেস্ট নিতে। স্পর্শিয়া নিচে সবার সাথে বসে রইলো। একটু পরে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে, আরাধ্যর বড় ভাই আরিয়ান চৌধুরীর দুই মেয়ে সিনথিয়া আর সিলভিয়া স্পর্শিয়াকে পুরো বাড়ি দেখানোর জন্য হৈ চৈ করতে লাগলো। স্পর্শিয়া বেশ আনন্দ নিয়েই নিজের শ্বশুর বাড়ি দেখতে লাগলো। আরাধ্যর রুমের কাছে যেতেই ওরা বলল,
– চাচী মনি, দেখ এটা চাচ্চুর রুম। চলো চাচ্চুকে ডিস্টার্ব করি।
স্পর্শিয়ারও ইচ্ছে করছিল একটু মজা করতে আরাধ্যর সাথে। কিন্তু বেচারা হয়তো রেস্ট নিচ্ছে, তার ওপর অসুস্থ। এই ভেবেই মত পালটে ফেললো। চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতেই আরাধ্য দরজা খুললো।
– আরে, আমার বুড়ি মামুনিগুলা, কি হচ্ছে হুম?
– ধুর। আমরা তো তোমাকে ডিস্টার্ব করার প্ল্যান করছিলাম চাচ্চু। তুমি দরজা খুলে ফেললে।
স্পর্শিয়া হেসে দিয়ে বললো,
– বাচ্চারা, তোমরা তো সবই ফাস করে দিলে তোমাদের চাচ্চুর কাছে।
সিনথিয়া আর সিলভিয়া দুজনেই একসাথে জিব কাটলো।
আরাধ্য ওদের চুলে হাত নাড়তে নাড়তে বলল,
– এখন তো তোমাদের শাস্তি পেতে হবে। আমাকে ডিস্টার্ব করতে চেয়েছ। ইটস নট গুড এট অল।
দুজনেই একসাথে বললো,
– সরি চাচ্চু। আর হবে না এমন।
– তবে শাস্তি কি তা শোন। তোমাদের রুমে যাও। দুজনের টেবিলের সেকেন্ড ড্রয়ারে চকলেটস আছে অনেকগুলো। সেগুলো এবার বসে বসে খাও। আর খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমার কাছে আসবে না।
দুজনেই খুশিতে লাফাতে লাফাতে চলে গেল।

স্পর্শিয়া কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরাধ্য ওকে কোলে তুলে নিল। স্পর্শিয়া হকচকিয়ে গেল।
– কি করছ তুমি? নামাও আমাকে। কেও দেকে ফেলবে তো। তুমি না অসুস্থ? নামাও প্লিজ।
– তুমি চুপ কর। নয়তো কেও না দেখলেও তোমার হৈ চৈ শুনে চলে আসবে।
স্পর্শিয়া চুপ হয়ে গেল। আরাধ্য ওকে রুমের ভেতরে নিয়ে গেল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে ওকে নিয়ে দাড়া করালো। স্পর্শিয়া আয়নায় তাকিয়ে আছে। আরাধ্য পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। স্পর্শিয়া লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে।
– এ্যাই বউ।
বউ শব্দটা স্পর্শিয়ার বুকটায় সবসময়ই ধড়াক করে লাগে। আজ কতদিন পর এরকম ভালোবাসার মূহুর্ত কাটাচ্ছে ওরা। নাহ, এই মূহুর্তটা আগের চেয়েও অনেক স্পেশাল, অনেক বেশি সুখের । আগে ও জানতো না যে আরাধ্যকে ও ভালোবাসে। কিন্তু এখন জানে।
স্পর্শিয়া চোখ তুলে আয়নায় আরাধ্যর প্রতিবিম্বের দিকে তাকাল।
– কোলে নিয়েছি কেন জানো?
– কেন?
– আমার খুব ইচ্ছে ছিল বিয়ের দিন তোমাকে কোলে নিয়ে আমাদের রুমে ঢুকবো। কিন্তু তুমি আজ ই চলে এসেছ। তাই এ সময় আর মিস করি কি করে? টেনশন করো না, বিয়ের দিনও ঠিক এভাবেই কোলে নিয়ে ঘরে ঢুকবো। তুমি এখন আমাদের রুমে আছ স্পর্শ।

“আমাদের রুম” কথাটা শুনেই কেমন যেন একটা অনুভূতি হলো স্পর্শিয়ার। লজ্জাও যেন বেশি লাগছে আজ। প্রেমে পড়লে কি লজ্জা বেশি বেশি লাগে নাকি? কথা ঘুরানোর জন্য স্পর্শিয়াকে বলল,
– আরাধ্য, তুমি সিনথিয়া আর সিলভিয়া কে পাঠিয়ে দিলে কেন?
– উফফফহহহ! তুমি কি আমাদের রোমান্সে থার্ড পারসন না আনলে পারো না? শোন। ওদের পাঠিয়ে দিয়েছি তোমার সাথে রোমান্স করতে। বুঝলে?
– যখন চকলেট না পেয়ে ফেরত আসবে তখন বুঝবে মজা।
– না। ওদের রুমে সবসময়ই আমি চকলেট রেখে দেই। ওইদিন পিলস খাওয়ার আগেও ওদের জন্য চকলেট রেখে গিয়েছিলাম। সেটাই এখন কাজে লাগালাম।

স্পর্শিয়া নিজের অজান্তেই বলে ফেললো,
– আমার তো ওদের খুব ভালো লাগে । আমাদেরও এরকম জমজ বেবি হলে কত কিউট হবে না?
আরাধ্য স্পর্শিয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দুষ্ট দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,
– কি বললে তুমি?
স্পর্শিয়ার সেন্স এল, আসলেই কি বলে ফেলেছে ও।
আরাধ্য স্পর্শিয়াকে জোরে নিজের সাথে লাগিয়ে বলল,
– স্পর্শ, তুমি চাইলে কিন্তু প্রসেসিং এখনো শুরু করা যায়।
এ কথা বলেই আরাধ্য স্পর্শিয়াকে কিস করার জন্য মুখ সামনে এগিয়ে নিল।
স্পর্শিয়া আরাধ্যকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– সরো। তুমি সবসময় বাজে কথাই বলো।
আরাধ্য স্পর্শিয়ার কপালে চুমু খেল। দু হাতে স্পর্শিয়ার গাল ধরে আদর করতে লাগলো ।
– এইটুকু তো করতেই পারি তাই না?
স্পর্শিয়া লজ্জা পেল। সাথে সাথেই নর্মাল হয়ে বলল,
– আরাধ্য, যাও তুমি রেস্ট নাও।
– আরে বাবা, কোন অপারেশন হয়নি আমার। জাস্ট একটু দুর্বলতা আছে, তা আজকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।

স্পর্শিয়া জোর করে আরাধ্যকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে ঘুরে ঘুরে রুম দেখতে লাগলো। আরাধ্যর রুম দেখে মনে হয় না এটা ওর রুম। ছেলেদের রুম সাধারণত আগোছালো থাকে। কিন্তু ওর রুমটা বেশ পরিপাটি৷ সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে আরাধ্যর বারান্দাটা। লতা পাতা আর ফুল পেচিয়ে আছে বারান্দার প্রতিটা গ্রিলে। বারান্দার সাইজ এত বড়, মনে হচ্ছে যে বারান্দা না বরং খেলার মাঠ।

স্পর্শিয়া চলে যাওয়ার জন্য আরাধ্যকে ডাক দিল৷ আরাধ্য ওকে ওর পাশে এসে বসতে বলল।
– স্পর্শ, আমি তোমাকে এখানে কেন এনেছি জানো?
স্পর্শিয়া ভ্রু কুচকালো।
– কেন এনেছ?
– তোমার আর মার সাথে কি হয়েছে?
স্পর্শিয়া ঢোক গিলল। আরাধ্য কি করে জানলো ভাবতে লাগলো।
– স্পর্শ, বলো কি হয়েছে। এই দুইদিন দেখলাম মা তোমার সাথে তেমন কোন কথাই বলছে না। তুমিও যেন ভয়ে ভয়েই ছিলে। সত্যি বল তো আমাকে।
– আরাধ্য, আসলে… আসলে… আন্টি সবকিছু বুঝে ফেলেছে যে তুমি আমার কারণেই সুইসাইডের চেষ্টা করেছ।
আরাধ্য চমকে উঠলো।
– কি বলো? কিভাবে জানলো? আর সায়ানের ব্যাপারটাও কি জানে মা?
– না।
– তবে?

স্পর্শিয়া সব খুলে বলল আরাধ্যকে। আরাধ্য চিন্তায় পড়ে গেল।
– এরকম একটা কান্ড হবে আমি তো বুঝতেই পারিনি। আমি ভেবেছি হয়তো কোন টুকটাক কারনে আম্মু রাগ তোমার ওপর, তুমি দু চার দিন এখানে থেকে তার সাথে সময় কাটালে, গল্প করলেই ঠিক হয়ে যাবে সব। কিন্তু এখন কি করা যায়? এটা তো কোন ছোটখাট সমস্যা না।

আরাধ্য আর স্পর্শিয়া দুজনেই পড়ে গেল মহা টেনশনে।
.
.
.
.
.
.
.
.

রাতে আরাধ্য নিশাত চৌধুরীকে নিজের রুমে নিয়ে এলো। মায়ের কোলে মাথা রাখল। নিশাত চৌধুরী ওকে আদর করতে লাগলেন মাথায় হাত দিয়ে।
– বাবারে তোর কি খারাপ লাগছে?
– না তো।
– তবে হঠাৎ এভাবে…
আরাধ্য মায়ের কোলে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
– মামনি তোমার কোলে কতদিন এভাবে মাথা রাখি না।
– হুম, বুঝেছি। কি আহ্লাদ এসেছে এতদিন পর।
এমন সময় স্পর্শিয়া আরাধ্যর রুমে ঢুকলো। স্পর্শিয়াকে দেখে মিসেস চৌধুরীর হাসি হাসি মুখ টা কালো হয়ে গেল। আরাধ্য মায়ের কোল থেকে মাথা সরিয়ে উঠে বসলো ।
মিসেস চৌধুরী বললেন,
– তোরা দুজন গল্প কর। আমি যাই।
আরাধ্য মায়ের হাত ধরলো।
– মামনি, বসো না প্লিজ।
ছেলের কন্ঠে কাতরতা শুনে মিসেস চৌধুরী বসে রইলেন। স্পর্শিয়া খাটে এসে বসলো।
আরাধ্য মায়ের হাত দু হাতে ধরে বলল,
– আম্মু, মানুষ তো জীবনে অনেক ভুল করে। আমরা ছোট, আমরা ভুল একটু বেশিই করি, তাই বলে কি বাবা মা আমাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে?
– কেন রে বাবা, এ কথা বলছিস যে?
– আম্মু, আমি দুদিন যাবত দেখছি তুমি আর স্পর্শিয়া কথা বলো না তেমন। কি হয়েছে তোমাদের? ও না তোমার মেয়ে। মেয়ের সাথে হঠাৎ এতো অভিমান যে।

মিসেস চৌধুরী বুঝে ফেললেন আরাধ্য কি বলতে চাচ্ছে।
তাই কোন দ্বিধা ছাড়াই তিনি বলে দিলেন,
– আজ স্পর্শিয়ার জন্য তোর এ অবস্থা। তুই এত বড় একটা কাজ করতে চলেছিলি শুধুমাত্র ওর কারনে। তোর কিছু হলে তখন আমি কি করে বাচতাম রে বাবা?

কেদে দিলেন নিশাত চৌধুরী।

আরাধ্য মায়ের চোখের পানি মুছে দিল। স্পর্শিয়া নিশাত চৌধুরীর হাত ধরে বলল,
– আম্মু আমি ভুল করে ফেলেছি। মাফ করবেন না আমাকে?
স্পর্শিয়ার কন্ঠে কাতরতা।
মিসেস চৌধুরী স্পর্শিয়ার দিকে তাকালেন। মেয়েটার চোখ ছলছল করছে। এই প্রথম মেয়েটা উনাকে আম্মু বলে ডেকেছে।

আরাধ্য মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
– মামনি, ভুল কি স্পর্শিয়া একা করেছে? স্পর্শিয়া আর আমার মাঝে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল। সেই ইস্যুটাই আস্তে আস্তে বড় হয়ে যায়। মামনি ঝগড়া কি একা একা করা যায়? এতে ওর যতটুকু দোষ ছিল আমারও ঠিক ততটুকুই দোষ ছিল। আমরা দুজনের কেওই ঝগড়া টা সলভ করার চেষ্টা করিনি। একপর্যায়ে আমার মনে হতে লাগলো ও এখন আর আমাকে ভালোবাসে না। তাই আমি ডিপ্রেশনে পড়ে এমন একটা কাজ করে ফেলি।

স্পর্শিয়া খুব অবাক হলো। আরাধ্য মিথ্যা কথা বলছে ওর মা কে। ও যতটুকু জানে আরাধ্য ওর মায়ের সাথে মিথ্যা বলে না। ও ভেবেছিল ওর আর সায়ানের ব্যাপারে সব সত্যিটা আরাধ্য জানিয়ে তারপর হয়তো মাফ চাইবে। কিন্তু ও তা করলো না।

আরাধ্য মা কে চুপ থাকতে দেখে স্পর্শিয়ার হাত নিয়ে নিশাত চৌধুরীর হাতে দিল।
– মা, তুমি কি কিছু বলবে না? স্পর্শিয়ার ওপর যদি রেগে থাকো, তবে রাগের যোগ্য তো আমি নিজেও। ভুল তো ও একা করেনি। আমিও শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

মিসেস চৌধুরীর মন গলতে লাগলো ওদের কথায়। শুধু শুধু আরাধ্যর টেনশনে কত উলটা পালটা কথা ভেবে বসেছিলেন তিনি। স্পর্শিয়া আর আরাধ্য দুজনের কানই একসাথে টেনে ধরলেন তিনি।
– তোদের দুজনকেই একসাথে মারবো বুঝলি? দুজনই ফাজিল। কেও কারও চেয়ে কম না ।
আরাধ্য হেসে দিল।
– তোমার ছেলে আর ছেলের বউ কেও কারও চেয়ে কম হয় কি করে তুমিই বল।

নিশাত চৌধুরী আরাধ্য আর স্পর্শিয়া দুজনকেই নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিলেন।
– তোরা আর কখনো অযথা এমন ঝগড়া করিস না। ঝগড়া করে এরকম পাগলামিও করিস না আর। কিছুদিন পর নতুন জীবন শুরু করবি, সংসার শুরু করবি। তখন টুকটাক অনেক কিছুই হবে৷ ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। এভাবে হুটহাট করে কিছু করলে বাবা আমাকে আগেই বলে দে তোরা, বিয়ে আরও দু বছর পরে করাবো, বড় হয়ে নে আগে তোরা।

আরাধ্য চেচিয়ে উঠলো,
– না মামনি। কি যে বল। সব ঠিক আছে। দু বছর পরে কেন, দু মাস পরেই করবো বিয়ে।
– ওরে আমার বিয়ে পাগলা রে। করাচ্ছি তোর বিয়ে।

স্পর্শিয়া মিসেস চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– আম্মু, আমি আগেই বলে রাখি আরাধ্য আমার সাথে ঝগড়া করলে আমি আপনার কাছে বিচার দিব। আপনি ওকে মেরে দিবেন।
– হ্যা, এবার ঠিক বলেছিস। এই ফাজিলটা কিছু করলে আমার কাছেই বিচার দিস। আমি ওকে দেখে নিব।
আরাধ্য মুখ কালো করে বলল,
– ওও, এবার বউ শ্বাশুড়ি মিলে আমার সাথে না ইনসাফি করবে ?
রুমের মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। অবশেষে সব ঠিক হয়েছে গেল।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

পরদিন সকালে স্পর্শিয়া আরাধ্যর রুমে যেতেই দেখে ও রুমে নেই। বারান্দা দিয়ে সূর্যের আলো আসছে। আরাধ্য হয়তো বারান্দায় এটা ভেবে ওকে খুজতে গিয়ে দেখে সেখানেও নেই। বারান্দায় সূর্যের আলো ঝিকমিক করছে। কি সুন্দর রৌদ্রময় দিন। টবের মধ্যে লাল, নীল, হলুদ, বেগুনী রঙের অসংখ্য ফুল। গোলাপ ছাড়া আর কোন ফুলের নামই ও জানে না। কিন্তু এত সুন্দর লাগছে ফুলগুলো দেখতে। ইচ্ছে করছে কয়েকটা নিতে। কিন্তু গাছগুলো যেহেতু আরাধ্যর তাই ওর পারমিশন ছাড়া নেওয়াও ঠিক হবে না।

রুমের ভেতরে কিছুর আওয়াজ হতেই স্পর্শিয়া ভেতরে গেল, হয়তো আরাধ্য চলে এসেছে। রুমে ঢুকে তো ওর চোখ ছানাবড়া। আরাধ্য দরজা লাগিয়েছে মাত্র সেই আওয়াজ হয়েছিল। আরাধ্য শুধু একটা টাওয়াল পড়ে ভেজা শরীরে ওর সামনে দাড়িয়ে আছে। ওর শরীর থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। থুতনির নিচে জমে থাকা পানিটুকু গলা বেয়ে গড়িয়ে আরাধ্যর বুক বেয়ে নিচে নামতে নামতে হারিয়ে গেল। সুঠাম দেহ, পুরুষালী গঠন। স্পর্শিয়ার সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে গেল যেদিন আরাধ্যকে ও খালি গায়ে দেখেছিল। আরাধ্যর অবাক চাহনি থেকে আস্তে আস্তে চোখেমুখে দুষ্টুমি ভর করতে লাগলো। স্পর্শিয়া অনেক কষ্টে ওর চোখ দুটো নিচে নামিয়ে নিল। কিন্তু ওর যে খুব ইচ্ছে করছিল আরাধ্যকে দেখতে।

আরাধ্য ধীর পায়ে ওর সামনে এগিয়ে এল। ভয়ে আর লজ্জায় স্পর্শিয়ার গলা শুকিয়ে আসছে। এরই মধ্যে কানের পেছনে দু বার চুল গুজে ফেললো স্পর্শিয়া। আরাধ্য ওর কাছে এসে ওর থুতনি ধরে উপরে তুললো ।
– বাহ। আজ দেখছি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।
স্পর্শিয়া কাপাকাপা কন্ঠে বলল,
– আরাধ্য তুমি দরজা লাগিয়েছ কেন আমাকে দেখে?
– মিসেস আরাধ্য, আমি আপনাকে দেখিনি। আপনি বারান্দায় ছিলেন। বায় দা ওয়ে, কথা ঘুরাচ্ছেন কেন?
– ক…ক..কই কথা ঘুরালাম?
আরাধ্য কিছু না বলেই স্পর্শিয়াকে কোলে তুলে নিল।
স্পর্শিয়া চমকে গেল।
– আরাধ্য। ছাড়ো। কি করছ? কেও দেখে ফেলবে তো। প্লিজ ছাড়ো।
– দরজা লাগানো। সো, নো ওয়ান উইল ডিস্টার্ব আস।

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে খাটে শুইয়ে দিল। স্পর্শিয়া উঠতে নিতেই আরাধ্য ওর উপরে উঠে গেল।
স্পর্শিয়ার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
– আরাধ্য, কেও চলে আসবে।
– আসুক। বুঝবে কি করে যে তুমি এখানে, দরজা তো লক।
আরাধ্য নিজের ভেজা শরীরে স্পর্শিয়াকে জাপটে ধরলো।

– আরাধ্য তুমি যদি এখন না সরো আমার উপর থেকে, তবে আমি তোমার টাওয়াল ধরে টান দিব।
– এত ইচ্ছা? আমার জন্য তো খুশির ব্যাপার এটা। দাড়াও এখনি আমি নিজেই খুলে ফেলছি টাওয়াল।

আরাধ্য টাওয়ালের উপর হাত দিল খোলার জন্য। স্পর্শিয়া সাথে সাথে দু হাতে নিজের চোখ ঢেকে ফেললো।

– এ্যাই স্পর্শ। চোখ খোলো। তুমি না দেখতে চাইলে।
– না, অসম্ভব। তুমি সরো আমার ওপর থেকে।
– খোল না প্লিজ।
– না। তুমি লুইচ্চা, লম্পট, বেহায়া আমি চোখ খুলবো না।
– নিজে বেহায়ার মতো আমার টাওয়াল খুলতে চাইলে, আর এখন আমিই লুইচ্চা লম্পট?
– আমি মজা করেছিলাম।
– আমিও তো মজাই করছি রে বাবা। টাওয়াল খুলিনি। চোখ খোল।

স্পর্শিয়া এক চোখ থেকে হাত সরিয়ে দেখলো সত্যিই আরাধ্য টাওয়াল খুলেনি। দু হাত সরিয়ে দিল চোখ থেকে।
হাফ ছেড়ে বলল,
– বড় বাচা বাচলাম। নয়তো আমি তো ভেবেছিলাম তুমি…
– দুই মাস পরের প্র্যাক্টিস আগে থেকে করলে কিন্তু মন্দ হয় না। প্র্যাক্টিস মেকস অ্যা ম্যান পারফেক্ট।
– ছিঃ কি অশ্লীল!
– অশ্লীলতা শুরু হলো কই?
– উফফফ! আরাধ্য!!
আরাধ্য স্পর্শিয়ার মুখ চেপে ধরলো।
– এ্যাই মেয়ে। এখনি এভাবে চেচাচ্ছ, আর বিয়ের পর কি করবে? তখন তো পুরো বাড়ির মানুষ এক করে ফেলবে দেখছি।

স্পর্শিয়া ওর মুখের উপর থেকে আরাধ্যর হাত সরিয়ে চোখ টিপ দিয়ে দুষ্টুমির সুরে বললো,
– তখনো তো মুখ চেপে ধরার জন্য তুমিই থাকবে।
আরাধ্য মুখে বিশাল এক হাসি দিয়ে স্পর্শিয়াকে জাপটে ধরলো। খাটের এ মাথা থেকে ওই মাথা পর্যন্ত স্পর্শিয়াকে নিয়ে জাপটে ধরে গড়াগড়ি করলো।

– আরাধ্য কি করছ? শরীরের পানিতে খাট ভিজে যাচ্ছে তো।
আরাধ্য স্পর্শিয়ার ঘাড়ে নাক ঘষে বলল,
– ভিজুক না।
আরাধ্যর কন্ঠস্বর ভারী শোনাচ্ছে। আরাধ্য স্পর্শিয়ার গলায় ওর পানিতে ভেজা ঠান্ডা নাক ঘষছে। স্পর্শিয়ার রক্ত হিম হয়ে যাচ্ছে। আরাধ্য চুমুতে ভরিয়ে দিল স্পর্শিয়ার গলা। ওড়নাটা সরিয়ে দিল বুকের ওপর থেকে। স্পর্শিয়ার বুকের খাযে চুমু খেল আরাধ্য। স্পর্শিয়া আবেশে আরাধ্যর পিঠ খামচে ধরেছে। আরাধ্য স্পর্শিয়ার মুখের ওপর এসে থেমে গেল৷ দুজনের ভারী নিঃশ্বাস বাড়ি খাচ্ছে। আরাধ্য স্পর্শিয়ার ঠোট ছুয়ে দিল হাত দিয়ে । স্পর্শিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো লজ্জায়। এগিয়ে গেল স্পর্শিয়ার ঠোটের কাছে আরাধ্য । ওর কোমল ঠোটে নিজের ঠোঁট ছুয়ে দিল । আলতো করে চুমু খেল। স্পর্শিয়া সাথে সাথে চোখ খুলে ফেললো। আরাধ্য মিটিমিটি হাসছে। কি করলো আরাধ্য এটা? স্পর্শিয়ার বুকে যেন কেও হাতুড়ি পেটাচ্ছে। স্পর্শিয়ার গলার আওয়াজ যেন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু বলতেও পারছে না। আরাধ্য স্পর্শিয়াকে অবাক করে দিয়ে আরও একবার ওর ঠোটে আলতো করে চুমু দিল। পরপর তিনবার চুমু খেল স্পর্শিয়ার ঠোটে। স্পর্শিয়ার তো যায় যায় অবস্থা। আরাধ্য বুঝতে পেরেছে স্পর্শিয়া ঘটনার আকস্মিকতায় কিছু বলতে পারছে না। তাই ও নিজেই স্পর্শিয়াকে মজা করে বলল,
– কি স্পর্শ, কিছু বলবে?
স্পর্শিয়া যেন মূর্তি হয়ে গিয়েছে।
আরাধ্য বলল,
– কিছু বলার নেই? তবে আরেকটু আদর করি?
স্পর্শিয়া এখনো কোন সাউন্ড করতে পারছে না মুখ দিয়ে।
আরাধ্য আরও দু বার স্পর্শিয়ার ঠোটে ঠোট রেখে চুমু খেল। শেষের চুমুটা বেশ গভীর ছিল।
এবার স্পর্শিয়া শরীরের সব শক্তি দিয়ে, আর ভয় কাটিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
কাপা কাপা গলায় বলল,
– কি করলে আরাধ্য?
– কি করেছি?
– তুমি… তুমি আমাকে.. আমাকে..
– হুম বলো, কি করেছি?
– ধুর বলবো না। অনেক খারাপ তুমি৷
– ওহ তাই নাকি? তবে তুমিই বলো, ভালো লাগেনি তোমার? যদি ভালো না লাগে আর কখনো করবো না।
স্পর্শিয়া নিশ্চুপ।
– বলো স্পর্শ।
স্পর্শিয়া কি করে উত্তর দিবে? লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে যে ও। কোন উত্তর না দিয়ে আরাধ্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর গলা, ঘাড় অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিল স্পর্শিয়া।

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi
(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here