প্রেম পর্ব -১৯+২০

প্রেম 💜 (Love has no limits)

#পর্বঃ ১৯

স্পর্শিয়া চোখ বড়বড় করে সায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। সায়ান আরাধ্যকে ভাইয়া বলে কেন ডাকছে! ঠিক একইভাবে আরাধ্য একবার সায়ানের দিকে তাকাচ্ছে, একবার স্পর্শিয়ার দিকে তাকাচ্ছে। কি হচ্ছে ওর চোখের সামনে কিছুই যেন বুঝে উঠতে পারছে না। ওরই খালাতো ভাই সায়ান, ওর হবু বউয়ের হাত ধরে বসেছিল, ওর হবু বউ এইমাত্র ওর খালাতো ভাইকে ভালোবাসে তা স্বীকার করলো, এসব কিছুই যেন আরাধ্যর বুঝার বাইরে।

পরিস্থিতি সামলাতে সায়ান স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
– তোমরা কথা বলো। আমি এখন আসি।
একমূহুর্ত অপেক্ষা না করে সায়ান চলে গেল। এখন ওদের সামনে থাকলে কি না কি হয় বলা যায় না। এর চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো। ওরা দুজন মিলে সবকিছু সলভ করুক আগে।

স্পর্শিয়া মুখ নিচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আরাধ্য কিছু বলতে পারছে না, ওর গলায় যেন সব শব্দ দলা পেকে গিয়েছে। বারবার একটাই কথা মনকে নাড়া দিচ্ছে, ওর স্পর্শ ওকে ছেড়ে চলে যাবে। আরাধ্য কোন চিন্তা না করেই সাথে সাথে নিচে বসে স্পর্শিয়ার পায়ে ধরে ফেললো। অঝোর ধারায় পানি পড়ছে আরাধ্যর চোখ থেকে।

– স্পর্শ, প্লিজ স্পর্শ। আমি কোন ভুল করে থাকলে আমাকে মাফ করে দাও। ভালোবাসায় কোন কমতি থাকলে মাফ চেয়ে নিচ্ছি৷ তোমাকে আগের চেয়ে আরও বেশি ভালোবাসবো। কিন্তু প্লিজ, আমাকে ছেড়ে যেও না স্পর্শ। প্লিজ। আমি মরে যাব তোমাকে ছাড়া। এত বড় শাস্তি আমাকে দিও না প্লিজ ।
স্পর্শিয়া কান্না থামিয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে আরাধ্যর দিকে। আরাধ্যর মতো হাসিখুশি একটা ছেলে এভাবে কাদছে ওর পায়ে পড়ে এটাই যেন ওর কান্না থামানোর জন্য যথেষ্ট। হঠাৎ খেয়াল এল, আশেপাশের মানুষ ওদের দেখছে। স্পর্শিয়া সাথে সাথে আরাধ্যকে ওর পায়ের সামনে থেকে তুলে নিল। আরাধ্যকে বসিয়ে দিয়ে নিজেই আরাধ্যর চোখ মুছে দিল । আস্তে করে বলল,
– আরাধ্য আ’ম সরি। অনেকবার চেষ্টা করেছি তোমাকে আমার আর সায়ানের ব্যাপারে সবকিছু বলার। কিন্তু কখনো কখনো সাহসে কুলায়নি, আবার কখনো কখনো সেই সিচুয়েশন ছিল না। কিন্তু আরাধ্য…
স্পর্শিয়ার কথা শেষ না হতেই আরাধ্য চোখ তুলে ভয়ংকর এক দৃষ্টিতে স্পর্শিয়ার দিকে তাকালো। স্পর্শিয়ার কথাতেই যেন হুশ ফিরে পেল ও। তারপর কোন কথা না বলে চোখ মুছে স্পর্শিয়াকে রেখেই রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে চলে এল। স্পর্শিয়া ভয়ে আর একটা কথাও বলার সাহস করলো না।

সেই ভয়াবহ মূহুর্তগুলো মনে করতে করতেই আরাধ্যর চোখ বেয়ে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো এখন। আরাধ্য হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নিজে নিজেই হাসতে লাগলো এই ভেবে যে, ও চোখের পানিও ফেলতে জানে। সবসময় ও ভাবতো যে ও শুধু হাসতে আর হাসাতেই জানে। ফোনটা হাতে নিল। স্পর্শিয়ার ছবি এখনো ওয়ালপেপারে দেওয়া। খুব ইচ্ছা ছিল স্পর্শিয়া লাল শাড়িটা পড়লে অনেকগুলো ছবি তুলবে, আর সবচেয়ে সুন্দর ছবিটা ওয়ালপেপারে দিবে। কিন্তু তা আর হলো কই?
একটা হিসাব মেলাতেই আরাধ্যর চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। এই জিনিসটা এতদিন ওর মাথায় আসেনি কেন? যদিও সায়ান আউট অফ কান্ট্রি থাকার কারণে ওর এ্যাঙ্গেজম্যান্ট এটেন্ড করতে পারেনি, কিন্তু সায়ানকে তো এ্যাঙ্গেজম্যান্টের পর পরই স্পর্শিয়ার ছবি দেখানো হয়েছিল। আর তাছাড়া স্পর্শিয়া আর আরাধ্য দুজনের ফেসবুক প্রোফাইলেই দুজনের একসাথে শত শত ছবি। তারমানে, সায়ান সেই শুরু থেকেই জানতো যে ওর এক্সগার্লফ্রেন্ড স্পর্শিয়ার সাথেই ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। এক্স গার্লফ্রেন্ড নাকি গার্লফ্রেন্ড? সায়ান আর স্পর্শিয়ার কি এতদিন ব্রেকাপ ছিল, নাকি রিলেশন কন্টিনিউ ছিল? হয়তো স্পর্শিয়াও জানে যে, সায়ান ওর খালাতো ভাই। তাহলে কি সব জেনেশুনেই ওরা দুজন মিলে ওকে ধোকা দিচ্ছিল? নাহ। এটা কি করে সম্ভব? এত নীচ স্পর্শিয়া? ছিঃ! আরাধ্যর এতদিনের জিদ টা যেন স্পর্শিয়ার ওপর এখন ঘৃণায় রুপ নিচ্ছে৷ ওর বারবার মনে হচ্ছে স্পর্শিয়া সায়ানের সাথে রিলেশন কন্টিনিউ রেখেই ওর সাথে এ্যাঙ্গেজমেন্ট করেছে। সায়ানও এত বড় একটা ধোকা দিবে ওকে এটা ওর চিন্তার বাইরে ছিল। আরাধ্যর মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। বারবার স্পর্শিয়ার ধোকাটাই ওর নজড়ে পরছিল, সেদিন কেন স্পর্শিয়া কাদছিল সায়ানের কাছে, কেনই বা সায়ান বারবার স্পর্শিয়াকে জিজ্ঞেস করছিল ও ভালোবাসে কি না সায়ানকে, এরকম কোন প্রশ্নই আরাধ্যর মাথায় এলো না।
নাহ, যা ডিসিশন নেওয়ার তা আরাধ্য নিয়ে নিয়েছে ৷ কঠিন এক ডিসিশন। এখন তাই হবে, যা আরাধ্য চিন্তা করেছে।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
সায়ান আর স্পর্শিয়া মুখোমুখি বসে আছে।
– আমাকে এখানে কেন আসতে বলেছ সায়ান?
– বিয়েটা ভেঙে দাও স্পর্শিয়া।
স্পর্শিয়া ভীত দৃষ্টিতে সায়ানের দিকে তাকালো।
সায়ান আবারো বললো,
– আমার ওপর কি তোমার বিশ্বাস নেই স্পর্শিয়া? হ্যা, আমি জানি আমি ভুল করেছি, তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, তোমার ভালোবাসার কোন মূল্য দেইনি৷ কিন্তু এখন? এখন তো ফিরে এসেছি তোমার কাছে। আমি যে এখন শুধুই তোমার। আই প্রমিস, আগের চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাসবো তোমায়৷ আমার ভালোবাসায় আর কোন ক্ষুত পাবেনা তুমি৷ আমি এখন তোমাকে আমার করে চাই স্পর্শিয়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে করতে চাই তোমাকে।
– বিয়ে!
– হ্যা, বিয়ে। সেজন্যই বললাম, আরাধ্য ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়েটা ভেঙে দাও।
– কিভাবে ভাঙবো?
সায়ান যেন এবার একটু চিন্তায় পড়ে গেল৷
– আচ্ছা স্পর্শিয়া, এর মধ্যে কি ভাইয়া তোমার সাথে কোন যোগাযোগ করেছে?
– না। কিন্তু আমি অনেকবার কল করেছি, ও একবারও কল পিক করেনি৷
– তবে তো হলোই। আমার মনে হয় আরাধ্য ভাইয়া সময় নিচ্ছে সিদ্ধান্ত নিতে। হয়তো দু এক দিনের মধ্যে উনি নিজেই বিয়ে ভাঙার ব্যাপারে কিছু বলবে তোমাকে।
এ কথা শুনে স্পর্শিয়ার কলিজাটা চিপ দিয়ে উঠলো।
– আরাধ্য এমন না। আমার মনে হয় না ও কখনো এমন কিছু করবে । ও খুব ভালোবাসে আমাকে। সহজে ও আমাকে ছাড়তে চাইবে না।
কথা শেষ করে সায়ানের সাথে চোখাচোখি হতেই দেখল সায়ান ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
– স্পর্শিয়া, মাত্র চার মাসের সম্পর্ক আমাদের। সম্পর্ক থাকাকালীন আমি দেশে ছিলাম মাত্র মাসখানেক। তারপরেই এম.এস.সি করতে কানাডা চলে যাই। আর কানাডা যাওয়ার মাস দুয়েকের মাথায় আমি তোমাকে ইগনোর করা শুরু করি৷ সম্পর্কের চার মাস যখন, তখন আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে পুরোপুরি আলাদা করে দেই। তবুও তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে, কিন্তু আমি রেসপন্স করতাম না। হয়তো আমি রেসপন্স করতাম না বলেই তোমার বিয়ে ঠিক হওয়ার ব্যাপারটাও আমাকে জানাতে পারনি। আমাকে তুমি কাছে পেয়েছ মাত্র কয়েক দিন, আর বাকি দিনগুলোতে ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু আরাধ্য ভাইয়াকে তোমার কাছে পেয়েছ পুরো একটা বছর। আবার সে তোমার হবু হাজবেন্ড। একজন অপরিচিত মানুষের সাথে দিনের পর দিন থাকলেও মানুষ মায়ায় পড়ে যায়৷ আর সে জায়গায় তো ভাইয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে, কেয়ার করে। তার মায়ায় পড়া, বা তাকে ভালোবেসে ফেলা অস্বাভাবিক কিছু না। তুমি সত্যি বলতে পারো আমাকে। যদি এখন তুমি আমাকে না চাও সেটাও বলতে পারো, যদি ভাইয়াকে ভালবেসে ফেলো তবে সেটাও বলতে পার। আমি তোমাদের পথে আর বাধা হয়ে দাড়াবো না ৷ কিন্তু শুধু এটুকুই বলতে চাই , আমি খুব ভালবাসি তোমাকে। আমার কৃতকর্মের জন্য আমি সরি। তোমার ভালবাসাকে অবহেলা করার জন্য আমি সরি। ভাইয়া যখন এ্যাঙ্গেজম্যান্টের পরে তোমার ছবি দেখালো তখনও আমার কিছু আসে যায় নি। কিন্তু এখন! এখন আমি রিয়েলাইজ করি কতটা ভালোবাসি তোমাকে। আমার এখনি দেশে আসার কথা ছিল না। আমি শুধুই তোমার জন্য স্টাডি ইনকম্পলিট রেখে দেশে ফিরে এসেছি। অনুশোচনায় ভুগছি আমি। তোমার ভালোবাসার কাঙাল হয়ে গেছি। তুমি আমাকে তোমার করে চাও নাকি আরাধ্য ভাইয়াকে, এটা এখন তোমার হাতে। শুধু এটুকুই বলবো, যা ই করো না কেন নিজের মনের কথা শুনো, ব্রেইনের না। এটা ভেবো না যে আরাধ্য ভাইয়ার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে বলে পরিবারের মান সম্মানের ভয়ে তাকেই এক্সেপ্ট করবে। আমি যে কোন পরিস্থিতিতে তোমার সাথে আছি।
.
.
.
.
.
.
.
.

বাসায় ঢুকতেই স্পর্শিয়া অবাক হয়ে গেল। আরাধ্য, আর ওর ফুল ফ্যামিলি হল রুমে বসে আছে। দাদা দাদী থেকে শুরু করে সব চাচারাও এখানেই। দেখে মনে হচ্ছে কোন সিরিয়াস কথা চলছে। ভয়ে স্পর্শিয়ার হার্ট ওর গলায় এসে আটকে পড়েছে এমন মনে হচ্ছে। যেকোন সময় মনে হয় হার্ট টা ওর মুখ দিয়ে বের হয়ে যাবে। এত ভয় আর জীবনে কখনো পায়নি ও। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পা নড়ছে না ওর ৷ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। আরাধ্য কি তবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এসেছে বিয়ে ভাঙার জন্য? ওর ফ্যামিলি কি এখন আরাধ্যর ফ্যামিলির কাছে অপমানিত হবে? নাকি অপমানিত হয়েছে অলরেডি? ওর এখন কি করা উচিত? নিজের ভুলের জন্য মাফ চাইবে সবার কাছে? নাকি সবার সামনেই গিয়ে আরাধ্যর পায়ে পড়বে? কি করবে ও? নাহ! মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না। এসব চিন্তা করতে করতেই আরাধ্যর বাবা মিনহাজ চৌধুরী স্পর্শিয়াকে দেখে ডাক দিলেন। স্পর্শিয়া সামনে এগিয়ে গেল ঠিকই, কিন্তু ভয়ে সবাইকে সালাম দেওয়ার কথাও মাথায় এল না। আরাধ্য একবার স্পর্শিয়ার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল। কে বলবে এই ইনোসেন্ট লুকের পেছনেই ভয়ংকর এক স্পর্শিয়া লুকিয়ে আছে। তাই আরাধ্যর ইচ্ছে করছে না ওর দিকে তাকাতে।

মিনহাজ চৌধুরী স্পর্শিয়াকে ডেকে এনে নিজের পাশে বসিয়ে দিলেন। ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্পর্শিয়ার দাদার দিকে তাকিয়ে বললেন,
– আমাদের আমানত এবার আমাদের হাতে তুলে দিন। আমরা আর কিছু চাই না।

কথা শুনে স্পর্শিয়া চমকে উঠলো। কি বলতে চাচ্ছেন উনি? একবার আরাধ্যর দিকে তাকাল স্পর্শিয়া। এতক্ষন উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে করতে ওর দিকে তাকানোর সুযোগ পায়নি। আরাধ্যর সুন্দর মুখটা চুপসে গেছে, চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে। যেন কয়েকদিনেই ওর বয়স অনেক বেড়ে গেছে। এসবই যে ওর নিজেরই প্রতিদান তা বুঝতে বিন্দুমাত্র সময় লাগলো না ওর। আরাধ্যর দৃষ্টি ফ্লোরে। নিজের পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে টাইলস ঘষছে আরাধ্য, আর বারবার নাক ফুলাচ্ছে। আরাধ্য যখন খুব টেনশন অথবা রাগে থাকে তখন এভাবেই নাক ফুলায় আর চেহারা লাল হয়ে যায়।

স্পর্শিয়ার ছোট চাচী ওকে ভেতরে পাঠিয়ে দিলেন। স্পর্শিয়া ওর রুমে ঢুকেই ধপ করে খাটে বসে পড়লো। বাইরে হচ্ছে টা কি? আর আরাধ্যর আব্বু এ কথাই বা বললেন কেন? কি বুঝালেন উনি? তবে কি আরাধ্য সবাইকে কিছুই জানায়নি এখনো? কি করতে চাচ্ছে ও? কি জন্য এসেছে সবাই এখানে? স্পর্শিয়ার অস্থির লাগছে। যতক্ষন পর্যন্ত সব জানতে না পারবে, এই অস্থিরতা কমবে না। এরইমধ্যে একবার মেজ চাচী রুমে এসেছিলেন কিছু একটা নেওয়ার জন্য। স্পর্শিয়া সাথে সাথে চাচীকে ধরে জিজ্ঞেস করল তারা সবাই কেন এসেছে এখানে? আর কি কথা চলছে সবার মধ্যে? মেজ চাচী উত্তর দিলেন আরাধ্যর ফ্যামিলির সবাই চাচ্ছে শীঘ্রই ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। এটুকু বলেই চাচী চলে গেলেন।

স্পর্শিয়া তব্দা খেয়ে বসে রইলো। বিয়ে? মানে কি? তারা এত জলদি বিয়ে কেন করাতে চাচ্ছেন? আরাধ্য কি ওর ফ্যামিলিকে সব বলে দিয়েছে? নাহ। কোন ফ্যামিলি এসব জানার পরে একটা মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিতে পারবে না। একটু টেনশন করলেই আজকাল মাথা ব্যথা শুরু হয় ওর। এখনো ঠিক তার ব্যতিক্রম হলো না। নাহ, আরাধ্যর সাথে ওর আজ কথা বলতেই হবে। ওকে সব কিছু জানাতে হবে। পরমূহুর্তেই মনে হলো, কি জানাবে ও? সত্যিই তাই, কি জানাবে ও? ও তো নিজেই কনফিউশনে আছে। প্রতিটা মানুষের জীবনে ই এমন একটা সময় আসে যখন সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। কোনটা সঠিক, আর কোনটা ভুল সেটা বোঝার ক্ষমতা তখন থাকে না। এটা এমন একটা সময় যখন ব্রেইন আর মন দুটোই একসাথে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। স্পর্শিয়া এখন সে সময়টাই অতিক্রম করছে। একদিকে আরাধ্য ওকে ভালোবাসে, আরেকদিকে ও সায়ানকে ভালোবাসে। যেখানে সায়ান সম্পর্ক শেষ করেছিল এটা বলে যে “স্পর্শিয়া তুমি খুব ইমম্যাচিউর, খুব বাচ্চামি করো। তোমার সাথে আমার যায় না। ” ঠিক সেখানেই আরাধ্য সম্পর্ক শুরু করেছিল “আমার বাচ্চা বউটাকে আমি লালন পালন করে বড় করবো ” বলে।

হঠাৎ আরাধ্য রুমে ঢোকাতে স্পর্শিয়া হকচকিয়ে গেল। হার্টবিট যেন দশ গুন বেড়ে গেল। সাথে সাথে দাড়িয়ে পড়লো স্পর্শিয়া। আরাধ্য দ্রুত ওর কাছে এসে বেড এ বসে পড়লো।
– দাঁড়িয়ে রইলে কেন স্পর্শিয়া? আমার পাশে বস।
স্পর্শিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো আরাধ্যর দিকে। একরাশ আতঙ্ক ওকে গ্রাস করে আছে। প্রথমত, আরাধ্যর ব্যবহার খুব নর্মাল যেন কিছুই হয়নি। দ্বিতীয়ত, আরাধ্য ওকে “স্পর্শিয়া” বলে ডেকেছে।

স্পর্শিয়াকে বলার পরেও না বসাতে আরাধ্য ওকে হেচকা টান দিল। স্পর্শিয়ার ছোটখাটো শরীর এত বড় টান সইতে না পেরে ভারসাম্য হারিয়ে ও বিছানায় পড়ে যায়। উঠতে নিতেই আরাধ্য ওকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। আরাধ্য স্পর্শিয়ার দুই হাতের উপর নিজের দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরে স্পর্শিয়ার ওপর উঠে পড়ে। স্পর্শিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে আরাধ্যর দিকে। স্পর্শিয়া শত চেষ্টা করেও আরাধ্যর হাতের থেকে নিজের হাত ছুটাতে পারছে না। আরাধ্যর নখ স্পর্শিয়ার হাতে সুইয়ের মতো বিধছে। অস্ফুট স্বরে স্পর্শিয়া বলল,
– আরাধ্য আমি ব্যথা পাচ্ছি।
আরাধ্য সাথে সাথে ওর একটা হাত স্পর্শিয়ার হাতের ওপর থেকে সরিয়ে স্পর্শিয়ার দুই গালে চেপে ধরলো। এবার স্পর্শিয়া আরও ব্যথা পেতে লাগলো। মনে হচ্ছে ওর চোয়াল এখনি কটমট করে ভেঙে যাবে।

আরাধ্য চোখ বড়বড় করে বলল,
– ব্যথা? হ্যা? ব্যথা পাচ্ছিস তুই? তোর এই ব্যথা কি আমার বুকের ভেতরের ব্যথার চেয়ে খুব বেশি?
স্পর্শিয়া অবাক না হয়ে পারলো না। আরাধ্য ওকে তুই- তোকারি করে কথা বলছে। কষ্টে, অপমানে, ব্যথায় সব মিলিয়ে স্পর্শিয়া কেদে দিল। আরাধ্য গর্জে উঠে আরও জোড়ে স্পর্শিয়ার চোয়ালে চাপ দিয়ে বলল,
– এ্যাই চুপ। কাদবি না আমার সামনে। অনেক দেখেছি তোর এই ঢং। আর কাদবি না। তোর মতো মেয়েরা এসব মায়াকান্না দেখিয়েই ছেলেদের বশ করে।
স্পর্শিয়া জোরে মাথা ঝাকিয়ে নিজের মুখ আরাধ্যর হাত থেকে ছুটিয়ে ভাঙা গলায় বলল,
– আমার মতো মেয়েরা মানে?
– হ্যা, তোর মতো মেয়েরা । তোর মতো নোংরা মেয়েদের কথা বলছি আমি, যারা একসাথে একাধিক ছেলেকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে।
– আরাধ্য আমি তোমাকে নিয়ে খেলেছি?
– চুপ। একদম চুপ। একটা কথা বলবি না। এত ভালোবাসা দিয়েছি তোকে আমি। আর তুই আমাকে বিনিময়ে কি দিয়েছিস? ধোকা? লজ্জা করেনি তোর আমার ভাইয়ের সাথে রিলেশন থাকার পরেও আমার এত কাছে আসতে? আমার সাথে এত কিছু করতে? মিথ্যে ভালবাসার ছলনা করতে?
স্পর্শিয়া দরদর করে ঘামছে। আরাধ্য কি বলছে এসব? তারমানে ওর ধারণা এই এক বছর সায়ানের সাথে ওর রিলেশন ছিল। নাহ, আরাধ্য তো ওকে ভুল বুঝছে। ওকে যে সব বলতেই হবে।
– আরাধ্য, শোন তুমি আমাকে ভুল বুঝছ।
– ভুল? কোনটা ভুল? তুই সায়ানের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলি সেটা ভুল? নাকি আমি নিজের কানে শুনেছি তুই সায়ানকে ভালোবাসিস বলেছিলি সেটা ভুল? কই, কখনো তো আমাকে ভালোবাসিস বলিস নি। এতো ভালোবাসা থাকলে আমার প্রতি এই এক বছর যা দেখিয়েছিস তা কি ছিল? কয়জনের প্রতি ভালোবাসা থাকে একসাথে?
এ কথার পরে স্পর্শিয়া চুপ হয়ে গেল। নিজের ব্যপারে আর কোন সাফাই ই দিতে ইচ্ছে করলো না ওর।
– আমিও দেখি তুই কিভাবে তোর সায়ানকে নিয়ে থাকিস। তুই আমার বউ হবি, বুঝলি? শুধু আমার বউ। যেভাবে তুই আমার জীবনটা নষ্ট করেছিস ঠিক একইভাবে আমি তোর জীবনটাও নষ্ট করে দিব। না তুই তোর সায়ানকে পাবি, না আমাকে। বউ হবি ঠিকই আমার, কিন্তু সেটা অন্য সবার চোখে। আমার চোখে তুই একটা ছলনাময়ী মেয়ে, আর আজীবন থাকবি।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
নিঃশব্দে কাঁদছে স্পর্শিয়া। আরাধ্যর বলা কথাগুলো বার বার কানে বাজছে। যে মানুষটার কাছে ও এক সময় পুরো পৃথিবী ছিল, কয়েকদিনের ব্যবধানে সে মানুষটার কাছেই আজ ওর অবস্থান এতটা নিচে? সত্যিই মানুষ খুব দ্রুত বদলে যায়। আরাধ্যর এই হঠাৎ বদলে যাওয়ার কারণ কি ও নিজে নয়? আচ্ছা, ও নিজে কি চায়? সায়ানকে নাকি আরাধ্যকে? আরাধ্য কি এই এক বছর শুধুই ওর ফিওন্সে ছিল? ও কি কখনো স্পর্শিয়ার ভালোবাসা ছিল না? সায়ান যখন আরাধ্যর সাথে বিয়েটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিল তখন সাথে সাথেই কলিজাটা চিপ মেরে বসেছিল। তবে কি ও আরাধ্যকে… নাহ। তবে সায়ান? যে ছেলেটা দেড় বছর পর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে ফিরে এসেছে সবকিছু ছেড়ে, সে ছেলেটার কি হবে? সায়ানকে ও ভালোবাসে তা যে স্বীকারও করে ফেলেছে। সায়ান এখন শুধু অপেক্ষায় আছে স্পর্শিয়ার। কবে স্পর্শিয়া বিয়েটা ভাঙবে আর কবে ও স্পর্শিয়াকে নিজের করে পাবে। দরজার সামনে কারও পায়ের আওয়াজ পেতেই সাথে সাথে চোখ মুছলো স্পর্শিয়া। ওর মা ঘরে ঢুকেছে। স্পর্শিয়ার পাশে এসে বসলেন উনি। ওর মাথায় হাত রেখে বললেন,
– কিরে মা, স্নিগ্ধা তোকে কিছু বলেছে?
– বিয়ের ব্যাপারে?
– হ্যা।
– বলেছে।
– তুই কি রাগ করেছিস আমাদের এই ডিসিশন এ?
স্পর্শিয়া মায়ের আচলে মুখ গুজে কান্না করে দিল।
– কাদছিস কেন? কি হয়েছে? স্পর্শিয়া, কি হয়েছে তোর?
স্পর্শিয়া মুখ তুলে বলল,
– কিছুনা মা। তোমাদের ছেড়ে চলে যাব, এই ভেবেই কান্না পাচ্ছে।
– ধুর বোকা। কান্নার কি আছে? এখন তুই পরের ঘর ছেড়ে নিজের ঘরে যাবি। আমাদের তো ইচ্ছে ছিল না তোকে এত জলদি বিয়ে দিব। অন্তত তোর এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর বিয়েটা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ হঠাৎ করেই আরাধ্যর পরিবারের সবাই চলে এল, আর এত জোড়াজুড়ি শুরু করলো যে আমরা আর মানা করতে পারলাম না। তুই যেহেতু এনগেইজড, তাই তুই এখন অলরেডি তাদেরই। এ্যাঙ্গেজমেন্ট না হলে আমরা তাদের ওপর প্রেশার দিতে পারতাম, কিন্তু এখন তো আর সম্ভব না সেভাবে প্রেশার দেওয়া। তোর দাদাই সম্মতি দিয়ে দিল। তাই আমরা আর আপত্তি জানালাম না। তারা তো এই মাসেই বিয়ে করে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু, আমাদের নতুন পিড়ির প্রথম বিয়ে, ধুমধাম করে দিব বলেই দুই মাস সময় চেয়ে নিলাম।
– মা, আরাধ্য কি কিছু বলেছে?
– হ্যা, বলেছে।
স্পর্শিয়ার চোখমুখ আতঙ্কে ছেয়ে গেল। কাপাকাপা কন্ঠে বলল,
– কি বলেছে ও?
– বলল তোকে নিয়ে সন্ধ্যায় বের হবে। সেজন্য পারমিশন চাচ্ছিল আমার কাছে। আমি ভেবেছিলাম তুই রেডি হচ্ছিস বাইরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তোর তো রেডি হওয়ার নাম গন্ধও নেই। যা তুই রেডি হ৷ আমি যাই এখন।

স্পর্শিয়া ভাবতে লাগলো, আরাধ্য ওকে নিয়ে বের হবে কেন এখন? এমন একটা সিচুয়েশনে? যেখানে ও ঠিকমতো কথাই বলছে না, সেখানে তো ডেটে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আচ্ছা, আরাধ্য ওকে গুম করে ফেলবে না তো? নাকি মেরে ফেলবে? অথবা অন্য কোন খারাপ কিছু? ভাবতেই শিউরে উঠলো স্পর্শিয়া। আরাধ্য এখন ওর উপর যে পরিমাণে রেগে আছে, সেখানে ও কি করে ফেলে বলা যায় না।
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে নিতে এসেছে। গাড়িতে স্টার্ট দিতেই শো পিসের ঠিক পাশেই রাখা একটা চাকুর ওপর স্পর্শিয়ার নজর পড়লো। সাথে সাথে ওর শিড়দাড়া বেয়ে রক্তের শীতল স্রোত নিচে নামলো। একবার ভয়ে ভয়ে আরাধ্যর দিকে তাকাল। আরাধ্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। পুরোটা রাস্তা স্পর্শিয়া ভয়ে ভয়ে কাটালো। নাহ, আরাধ্যকে নিয়ে ও যে ভয় পাচ্ছিল সেরকম কিছু করেনি ও। গাড়ি থামালো সেই রেস্টুরেন্টের সামনে যেখানে আরাধ্য প্রথমবার সবাইকে এ্যাঙ্গেজমেন্ট উপলক্ষে ট্রিট দিয়েছিল। যেই টেবিলে ওরা সেদিন বসেছিল, আজও সেই টেবিলেই বসলো। সেদিন যা খেয়েছিল সেই খাবার ই অর্ডার দিল আরাধ্য। স্পর্শিয়া বুঝতে পারছে না আরাধ্য কি করতে চাচ্ছে। খাবার আসার সময়টুকুর পুরোটাই আরাধ্য এদিক সেদিক তাকিয়ে পার করে দিল। একবারও স্পর্শিয়ার দিকে তাকালো না, মুখ দিয়ে একটু আওয়াজও বের করলো না। স্পর্শিয়া মনে মনে অপমানিত বোধ করলো।

খাবার দিয়ে যাওয়ার পর কোন কথা না বলে আরাধ্য খাওয়া শুরু করলো। স্পর্শিয়া আরাধ্যর মতি গতি বুঝতে না পেরে নিজেও খাওয়া শুরু করে দিল। দুই মিনিট না যেতেই আরাধ্য ওয়েটারকে শুকনো মরিচের ফাকি নিয়ে আসতে বললো। স্পর্শিয়া পরপর বেশ কয়েকবার ঢোক গিলল। সেই প্রথমদিনের কথা মনে পড়ে গেল যেদিন ওর কারনে আরাধ্যকে এক বাটি মরিচ ফাকি মিশানো স্যুপ খেতে হয়েছিল। তবে কি আজ আরাধ্য এ জন্যই ওকে এখানে নিয়ে এসেছে? আরাধ্য কি আজকেও সেম জিনিসটাই করতে চাচ্ছে? আরাধ্য কি ওকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আজকেও স্যুপে মরিচ ফাকি মিশিয়ে খাবে?
মরিচ ফাকি দিয়ে যেতেই আরাধ্য স্পর্শিয়াকে অবাক করে দিয়ে সবটুকু মরিচ স্পর্শিয়ার স্যুপের বাটিতে ঢেলে দিয়ে বললো,
– মাই লাভ। ইউর ফেভরেট, স্পেশাল স্যুপ ফর ইউ। উইথআউট ওয়াটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে স্যুপটা শেষ কর।
স্পর্শিয়া মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারলো না, শুধু একদৃষ্টিতে আরাধ্যর দিকে তাকিয়ে রইলো। আরাধ্য ওকে শাস্তি দিতে চাচ্ছে তো? দেক।
স্পর্শিয়াও কোন কথা না বলে আরাধ্যর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্যুপ খাওয়া শুরু করে দিল। স্পর্শিয়ার বিশ্বাস ছিল আরাধ্য কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্যুপের বাটিটা সরিয়ে নেবে ওর কাছ থেকে। কিন্তু ওকে আরও একবার অবাক করে দিয়ে আরাধ্য খুব তৃপ্তি সহকারে ওর পুরোটা স্যুপ শেষ হওয়া অব্দি তাকিয়েই রইলো ওর দিকে। ঝালে স্পর্শিয়ার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল, বাড়বাড় কাশি আসছিল, তবুও আরাধ্য একটাবারের জন্য স্পর্শিয়াকে থামায় নি। খাওয়া শেষ করে রাগে স্পর্শিয়া পানিও খেল না।

গাড়িতে উঠে আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে রুঢ় দৃষ্টি দিয়ে বলল,
– ডেট টা সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই না স্পর্শিয়া?
স্পর্শিয়া কোন জবাব না দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো। আরাধ্য গাড়ি স্টার্ট দিল।

স্পর্শিয়া কাদছে নিঃশব্দে। মাঝেমধ্যে নাক টানার হালকা পাতলা শব্দ শোনা যাচ্ছে। কষ্ট, ক্ষোভ, তেষ্টা সবকিছুর বহিঃপ্রকাশ করছে স্পর্শিয়া ওর কান্নার মাধ্যমে। আরাধ্য কয়েকবার ওর দিকে তাকিয়েছে, কিন্তু কিছু বলছে না। স্পর্শিয়া একবার জোড়ে শব্দ করে কান্না করতেই আরাধ্য গাড়ি থামিয়ে দিল। সাথে সাথে স্পর্শিয়াও শব্দ করে কান্না করা থামিয়ে দিল। আরাধ্য নিজের সিট থেকে এগিয়ে স্পর্শিয়ার কাছে গিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বলল,
– কাদছ কেন সোনা? ঝাল লাগছে? মিষ্টি লাগবে তোমার?
এ কথা বলেই আরাধ্য ওর ঠোট স্পর্শিয়ার ঠোঁটের সামনে নিয়ে গেল। স্পর্শিয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল। আরাধ্যর রাগ যেন সপ্তম আসমানে উঠে গেল।
– হ্যা, আমি আদর করতে চাইলে তো মুখ ঘুরিয়ে নিবে ই তুমি। কারণ, আমি তো আর সায়ান না। তোমার তো ভালো লাগবে তোমার সায়ানের আদর।
এসব কথা শোনার চেয়ে স্পর্শিয়ার কাছে মৃত্যু শ্রেয় মনে হলো। আরাধ্য এত বাজে কথা কি করে উচ্চারণ করছে?
– শোন, তুমি শুধু আমার। বুঝলে? শুধুই আমার। তোমার ওপর, তোমার মনের ওপর, তোমার শরীরের প্রতিটা অংশে শুধু আমার অধিকার। শুধুই আমার। আমাকে যে কষ্ট দিয়েছ তুমি, তা নিজেও হারে হারে টের পাবে।
আরাধ্যর হাত স্পর্শিয়ার শরীরের এদিক সেদিক বিচরণ করতে লাগলো। স্পর্শিয়া শুধু নিরবে চোখের পানি ফেলছে। এ ছোয়ায় আজ ভালোবাসা নেই, হিংস্রতার পরশ পাচ্ছে স্পর্শিয়া। আরাধ্য স্পর্শিয়ার জামার সামনের অংশের চেইন খুলতে নিতেই স্পর্শিয়া ধরে ফেললো আরাধ্যর হাত। করুন এক চাহনিতে তাকিয়ে রইলো আরাধ্যর দিকে। আরাধ্য ওর চোখে তাকিয়ে যেন হুশ ফিরে পেল। কি করছে ও এসব ? স্পর্শিয়াকে পেতে আজ ও এতই ব্যাকুল? কষ্ট আর যন্ত্রণায় ভরপুর স্পর্শিয়ার সেই চোখ দুটো। ও না হয় আরাধ্যকে ধোকা দিয়েছে, কিন্তু এভাবে স্পর্শিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্পর্শিয়ার সাথে এরকম কিছু করা ওর নিজের সাজে না। নিজেকে সামলে নিয়ে আরাধ্য নিজের সিটে ফিরে এল। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করলো আবারো। স্পর্শিয়া আরাধ্যকে দেখছে আর ভাবছে, আজ ও আর আরাধ্য পাশাপাশি হয়েও ওদের মধ্যে কতটা দুরত্ব।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.

কয়েকদিন পর…

মেয়ে হয়ে জন্মানোর অনেক যন্ত্রনার মধ্যে একটা হলো নিজের মনের কথা বলতে না পারা। স্পর্শিয়া খুব ভালো মতোই বুঝতে পেরেছে যে ও আরাধ্যকে ভালোবাসে। গত কয়েকদিনের সবকিছু ওকে এটাই রিয়েলাইজ করিয়েছে। সায়ান ওর অতীত, কিন্তু আরাধ্য ওর বর্তমান । আর, অতীত নিয়ে পড়ে থাকা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। সায়নকে ও আগে ভালোবাসতো, এখন বাসে না। সায়ানকে ভালবাসার একটা ভুল ধারণা এতদিন ও পুষে রেখেছিল নিজের মধ্যে। ওই যে একটা কথা আছে না, যে জিনিস আমরা না পাই সেটার প্রতিই আমাদের আকর্ষন বেশি থাকে। স্পর্শিয়ার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। সায়ান ওকে ছেড়ে চলে যাওয়াতেই হয়তো আকর্ষনটা তীব্র হয়েছে। জোড় করে নিজের মনকে বুঝিয়েছে ও সায়ানকেই ভালোবাসে, আর সেজন্য অন্য কাওকে ভালোবাসা ওর পক্ষে সম্ভব না । সায়ানকে ও আজই বলে দিবে সবকিছু, আর ক্ষমা চেয়ে নেবে সায়ানকে এক্সেপ্ট করতে না পারার জন্য, আর এতদিন ভ্রান্তিতে থাকার জন্য। কিন্তু ও আরাধ্যকেও এক্সেপ্ট করবে না। হ্যা, স্পর্শিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে বিয়ে করবে না ও আরাধ্যকে। যে ভুল ও করেছে তা শুধরানোর কোন সুযোগ ওর নেই। আরাধ্য কখনো ওর কথা বিশ্বাস করবে না, আর ওকে বিশ্বাস করানোর মতো প্রমান ওর নিজের কাছেও নেই। চাইলে সায়ানকে দিয়ে আরাধ্যর সাথে কথা বলানো যায়, কিন্তু এখানেও দুটো ব্যাপার ঠেকছে । প্রথমত, আরাধ্য সায়ানের কথা বিশ্বাস করবে না। ওকেও হয়তো ঠিক সেভাবেই অপমান করবে যেভাবে স্পর্শিয়াকে করে। আর দ্বিতীয়ত, স্পর্শিয়ার বিবেক ওকে বাধা দিচ্ছে । যেই ছেলেটাকে ও গ্রহন ই করবে না, সেই ছেলেকে ও কোন মুখে বলবে আরাধ্যর কাছে গিয়ে সব সত্যিটা জানাতে। আর তাছাড়া ভুল তো ওর ই। নিজের ফিওন্সে থাকা সত্ত্বেও এক্স বয়ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছে, এক্স বয়ফ্রেন্ডকে ভালবাসি বলেছে। এতটুকু বুক কাপেনি ওর এই কাজগুলো করতে ৷ মোহে পড়ে যেন আরাধ্যর কথা ভুলেই গিয়েছিল ও৷ ওর এই অপরাধের কি কখনো মাফ হয় নাকি? আরাধ্য আর কখনো ওকে আগের মতো ভালোবাসবে না, সবসময় ওর চোখে নিজেকে নিয়ে শুধু ঘৃণাটাই দেখতে পাবে। এভাবে সারাজীবন নিশ্চয়ই পার করা যায় না। আরাধ্য যখনি ওকে দেখবে, ওর সেই পুরনো কথা মনে পড়ে যাবে। মনে পড়বে কিভাবে স্পর্শিয়া ওকে ধোকা দিয়েছিল। আরাধ্য আর ও দুজনই একসাথে বেচে থেকেও প্রতিদিন ধুকে ধুকে মরবে। তার চেয়ে কি ভালো না এই সম্পর্কটা এখানেই শেষ হোক?
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
আরাধ্য অফিসে বসে চিন্তা করছিল স্পর্শিয়ার কথা। আজকাল আর তেমন অফিসে আসা হয় না। অফিসে এলেও কাজ হয় না। সব কাজেই ভুল করে ফেলে আরাধ্য। বিগত কয়েকদিনে ও যে কয়টা প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে প্রত্যেকটাতেই লস করেছে।

আরাধ্যর ব্যবহারের পরিবর্তন ওর পরিবারের সবার নজরেই ধরা পড়েছে সেটা আরাধ্য জানে, কিন্তু কেও শত জিজ্ঞেস করেও উত্তর না পেয়ে এখন আর কিছুই বলে না । ও চাইলেও নিজেকে নরমাল রাখতে পারছে না।

আগে অফিসে বসে থাকতে খারাপ লাগলে ওর টেবিলের ওপর রাখা স্পর্শিয়ার ছবিটা দেখতো। সব ক্লান্তি যেন নিমিষেই দূর হয়ে যেত। কিন্তু এখন সেই ছবি দেখলে যেন বুকটা খা খা করে উঠে। তাই ছবিটা সরিয়ে ফেলেছে। গতকাল রাতে ওর ফোনের ওয়ালপেপার থেকেও স্পর্শিয়ার ছবিটা সরিয়ে ফেলে। এই ছবি এখন আর শান্তি দেয় না, বুকের ব্যাথা বাড়াতেই কাজ করে৷ আরাধ্যর এক মন বলে, এত কাছ থেকে দেখেছে ও স্পর্শিয়াকে, একটা বছর এত কাছ থেকে ও জেনেছে ওকে, কখনো ওর মনে হয়নি স্পর্শিয়া ওকে ভালোবাসে না ৷ কখনো মনে হয়নি ওর লাইফে অন্য কেও আছে। মনে হচ্ছে, হিসাবে কোথাও ভুল আছে। ও কোথাও কিছু একটা ভুল করছে। স্পর্শিয়াকে কি সবকিছু ক্লিয়ার করার জন্য বলবে একবার? আবার আরেক মন বলে, কি ক্লিয়ার করতে বলবে? সব তো ও নিজের চোখেই দেখে এসেছে, নিজের কানে শুনে এসেছে। এগুলি তো আর কারও কান কথা নয়৷ সবই তো ওর সামনেই ঘটেছে। স্পর্শিয়ার আসল রুপ, যা এতদিন ঢাকা পড়ে ছিল তা এখন ওর সামনে চলে এসেছে। সায়ানকে ও নিজের আপন ছোট ভাইয়ের মতো আদর দিয়েছে সবসময়, সেই সায়ানও সেদিনের পর থেকে ওর সামনে আসছে না৷ ওদের মনে কোন খারাপ কিছু না থাকলে ওরা অবশ্যই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতো।

হঠাৎ ঝুপঝাপ আওয়াজ হতেই চমকে বাইরে তাকালো আরাধ্য। অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। এই বৃষ্টির সাথেও ওর আর স্পর্শিয়ার কত স্মৃতি জড়িত। কত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে এই বৃষ্টির আড়ালে । সেদিন স্পর্শিয়াকে নিয়ে সাভারে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল। রাস্তার মধ্যেই বৃষ্টি শুরু হলো। স্পর্শিয়া হঠাৎ বলে উঠলো,
– আরাধ্য গাড়ি থামাও।
আরাধ্য স্পর্শিয়ার কথা মতো কোন কারণ জিজ্ঞেস না করেই গাড়ি থামিয়ে দিল। স্পর্শিয়া কোন কিছু না বলেই সাথে সাথে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো । কারণ, ও জানে আরাধ্যকে বৃষ্টিতে ভেজার কথা বললে ও ঠান্ডা লাগার অজুহাতে ভিজতে দিবে না । আরাধ্য স্পর্শিয়াকে ডাকতে লাগলো, কিন্তু আরাধ্য যাতে ওকে ধরতে না পারে তাই ও দূরে চলে গেল। আরাধ্যও বাধ্য হয়ে স্পর্শিয়াকে নেওয়ার জন্য গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। খালি রাস্তা পেয়ে ইচ্ছেমতো লাফালাফি করছে স্পর্শিয়া। আরাধ্যকে নিজের কাছে আসতে দেখে দৌড় দিল স্পর্শিয়া। কারণ, আরাধ্য ওর কাছে এলেই ওকে জোড় করে নিয়ে গাড়িতে ঢোকাবে । স্পর্শিয়াকে ধরার জন্য আরাধ্যও দৌড় দিল ওর পিছুপিছু। আরাধ্য ওকে থামতে বলছে, কিন্তু ও না থেমে দৌড়িয়েই যাচ্ছে, আর আরাধ্যর ব্যর্থতায় খিলখিল করে হাসছে। একপর্যায়ে স্পর্শিয়া যখন দৌড়ে হয়রান তখনি আরাধ্য ওকে খপ করে ধরে ফেললো। স্পর্শিয়া যেন খোদার এক র্অপূর্ব সৃষ্টি। ভেজা শরীরে ওর ওপর থেকে চোখ সরানো দায়।

– এখন বল সুন্দরি? আমি তো তোমাকে ধরে ফেলেছি। এখন যাবে কোথায়? আমি তো এখন তোমাকে নিয়ে গাড়িতে ঢোকাব।
স্পর্শিয়া আরাধ্যর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– কোথাও যাব না আমি মি. চৌধুরী, তোমার সাথে বৃষ্টিতে ভিজবো।
স্পর্শিয়ার সেই ঘোর লাগা কন্ঠ শুনে আরাধ্যর আর ইচ্ছে হলো না ওকে এমন একটা দিনে গাড়িতে আটকে রাখতে।
– আরাধ্য।
– বলো।
– কোলে নাও না আমাকে।
আরাধ্য ভ্রু উপরে তুলে বলল,
– কি বললে?
– জাতির ক্রাশ কানে কম শোনে। কোলে নিতে বলেছি।
– ৯ মাসে এই প্রথম বললে কোলে নিতে।
– উফফ! নিবে নাকি অন্য কাওকে ডাক দিব কোলে নেওয়ার জন্য?
– শখ কত অন্যের কোলে ওঠার। একদম মেরে ফেলবো অন্য কারও কোলে উঠতে চাইলে।

আরাধ্য ওকে কোলে নিয়ে সারা রাস্তা ঘুরেছিল সেই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে। যতক্ষন না বৃষ্টি শেষ হয় আরাধ্য স্পর্শিয়াকে ওর কোল থেকে নামায়নি।

ভেজা কাপড় শুকানোর জন্য যখন আরাধ্য স্পর্শিয়াকে নিয়ে রেসোর্টে যায়, স্পর্শিয়া এক তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে ফেলে ৷ নাম রেজেস্ট্রি করা হয় মি. আরাধ্য আর মিসেস. আরাধ্য নামে। স্পর্শিয়া তো রেজিস্টারের সামনেই হৈ চৈ শুরু করে দিয়েছিল। ” আরাধ্য আমরা তো ম্যারিড না, তবে এই নাম দিচ্ছ কেন? ভুল নাম দেওয়ার কারন কি? ” ভাগ্যিস আরাধ্য নিজেদের এনগেইজড বলে পার পেয়ে গিয়েছিল।
রুমে ঢুকতেই স্পর্শিয়া জিজ্ঞেস করেছিল,
– এমন করলে কেন আরাধ্য?
– আরে বোকা মেয়ে, এখানে গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড আসাতে রেস্ট্রিকশন আছে। আর তার ওপর তুমি এ্যাডাল্ট নও। তারা যদি কোন ভাবে এটা আচ করতে পারতো তবেই সর্বনাশ হতো। ভাগ্যিস রেসোর্ট টা আমার পরিচিত।
– ও আচ্ছা। তুমি আমাকে আগে থেকে সব শিখিয়ে দেবে না? আমি তো বুঝতে পারিনি তাই এমন করেছিলাম।
– সমস্যা নেই । এখন তো সামলে নিয়েছি আমি৷
– হুম।
– এবার টাওয়াল দিয়ে চুল শরীর মুছে নাও। ঠান্ডা লেগে যাবে।

স্পর্শিয়া ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখলো আরাধ্য খালি গায়ে, আর টাওয়াল দিয়ে নিজের শরীর মুছছে। ওর ভেজা শরীর থেকে পানি পড়ছে বিন্দু বিন্দু। জিন্সটা হাটু পর্যন্ত ফোল্ড করে রেখেছে। আরাধ্যর পায়ের পশমগুলো পানিতে লেপ্টে আছে। কি সুন্দর পা ওর। স্পর্শিয়ার খুব ইচ্ছে করছে ওর পশমগুলো ছুয়ে দেখতে৷ নিজের ইচ্ছাকে দমন করে কিছু না বলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গেল স্পর্শিয়া । আয়নায় আড়চোখে বারবার আরাধ্যকে দেখতে লাগলো।
– স্পর্শ, আমাকে এভাবে লুকিয়ে লুকিয়ে আয়নায় দেখার কিচ্ছু নেই৷ সরাসরি ই দেখ। তোমার সামনেই আমি৷
স্পর্শিয়া চমকে উঠলো আরাধ্যর কথায়। ধ্যাৎ, মান সম্মান আর রইলো না। লুকিয়ে লুকিয়ে কেন যে দেখতে যায় আরাধ্যকে বারবার।

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল।
– তুমি তো দেখছি সত্যিই বাচ্চা। নিজের চুলটাও ভালো মতো মুছতে পার না। কিভাবে পানি পড়ছে, ঠান্ডা লেগে যাবে।
– সবসময় তো আম্মু মুছে দেয়।
– সমস্যা নেই। বিয়ের পর মুছে দেওয়ার জন্য আমি আছি না।
আরাধ্য স্পর্শিয়ার চুল মুছতে শুরু করলো। ভেজা চুলে মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগে কেন? মনে হয় যেন স্বর্গের অপ্সরী। নেশা ধরে যায় ওর দিকে তাকালে।
চুল মুছতে মুছতে আরাধ্য বলল,
– বৃষ্টির দিন, এত সুন্দর একটা রুম, অন্য কেও হলে রোমান্স করতো । আর আমি আমার বাচ্চা বউয়ের চুল মুছছি।
– কেন? বউয়ের চুল মুছে দেওয়াটা কি কোন রোমান্স না?
– হ্যা, অবশ্যই। বাট, আমি একটু এক্সট্রা ভালোবাসার কথা বলছি। ইউ নো হোয়াট আই মিন।
স্পর্শিয়া আরাধ্যর পেটে চিমটি কেটে বলল,
– হুম, তুমি তো অসভ্য, তাই মাথায় এগুলোই ঘুরে।
এ কথা বলেই স্পর্শিয়া উঠে চলে যেতেই আরাধ্য ওকে টান দিয়ে বিছানায় ফেলে দিল। স্পর্শিয়ার ওপর উঠে পড়লো ও। স্পর্শিয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
– বউকে আদর করা কি খারাপ কিছু?
আরাধ্য ওর উপরে উঠে আছে, ভয়ে স্পর্শিয়ার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আরাধ্য স্পর্শিয়ার কপালে গভীর চুমু খেল। গালে, গলায়ও চুমু মিস গেল না। স্পর্শিয়ার গলায় ওর দাড়ি ঘষতে লাগলো । স্পর্শিয়ার বুকের ওপর থেকে ওড়না সরিয়ে বুকের গভীরে চুমু খেল। আরাধ্যর দুষ্টু হাত স্পর্শিয়ার শরীর বেয়ে পেটে নামলো। স্পর্শিয়ার ভেজা কামিজ উপরে তুলে স্পর্শিয়ার পেট উন্মুক্ত করে দিল আরাধ্য। স্পর্শিয়া সাথে সাথে কামিজ নিচে নামানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু আরাধ্য নামাতে দিল না। ওর দুই হাত শক্ত করে ধরে স্পর্শিয়ার ভেজা পেট অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল ৷ আরাধ্য স্পর্শিয়ার পেটে ওর জিব ছোয়াতেই স্পর্শিয়া কেপে উঠলো। পেটে সুড়সুড়ি পাওয়াতে ভেতরে নিয়ে গেল। আরাধ্যর মাথা স্পর্শিয়া ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু কোন লাভ হলো না। স্পর্শিয়া লজ্জায়, ভালো লাগায় একাকার হয়ে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেললো। ওর পেটের প্রতিটি অংশে আরাধ্য ওর জিহ্বের ছোয়ায় ভরিয়ে দিল। স্পর্শিয়া শুধু অস্ফুট স্বরে বলেছিল,
– আরাধ্য প্লিজ এবার থাম।

ফোনের রিংটোন বাজতেই ধ্যান ভাঙলো আরাধ্যর। ফোনের স্ক্রিনে স্পর্শিয়ার নাম ভেসে উঠেছে। মনে মনে একবার হাসলো, এতক্ষন ওর কল্পনায় বিভোর ছিল, আর কলটাও ওর ই এল। কিন্তু সেসব এখন শুধুই স্মৃতি। কল পিক করলো আরাধ্য।
– হ্যালো।
– হ্যালো, আরাধ্য। তুমি কি আজ একটু বাসায় আসতে পারবে? জরুরি কিছু কথা ছিল।
প্রেম 💙 (Love has no limits)

#পর্বঃ ২০

আরাধ্য আর স্পর্শিয়া মুখোমুখি বসে আছে। আরাধ্য চেয়ারে, আর স্পর্শিয়া বেডে। এরই মধ্যে একবার স্নিগ্ধা এসে নাস্তা দিয়ে গেছে ওদের জন্য। দীর্ঘ সময় দুজনেই চুপ থাকার পরে আরাধ্য বেশ কর্কশ গলায় বলে উঠলো,
– ডেকেছ কেন? তোমার মতো সারাদিন শুয়ে বসে দিন কাটাই না। অনেক ব্যস্ত থাকি আমি। আমার প্রতিটা মূহুর্তের অনেক মূল্য।
স্পর্শিয়া দম নিল। নিজেকে মূহুর্তেই প্রিপেয়ার করলো আরাধ্যকে কিছু কড়া কথা শোনানোর জন্য, আরাধ্যর কথার পাল্টা জবাব দেওয়ার জন্য।
– হ্যা, আমি জানি তোমার কাছে সময়ের অনেক মূল্য। তাই, আমি চাচ্ছিও না আমার মতো মেয়ের জন্য তুমি তোমার সময় আর জীবন কোনটাও নষ্ট কর।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার কথার মানে বুঝতে পারছে না। কি বলতে চাচ্ছে ও।
– এত ঢং না করে যা বলার সরাসরি বলো। তোমার অনেক ঢং দেখে ফেলেছি এতদিনে। জীবন তো আমার অলরেডি নষ্ট করেই দিয়েছ, আর কি নষ্ট হবে?
– জীবন তো অনেক পড়ে আছে তোমার। আমি না হয় কিছুটা সময় নষ্ট করেছি। বাকি জীবনটা ঠিক করার রাস্তা না হয় আমিই দিয়ে দেই?
– কি বলতে চাও ঠিক মতো বলবে? নাকি আমি চলে যাব?
স্পর্শিয়া আরেকবার র্দীর্ঘ দম নিয়ে খুব সাহস করে বলল,
– আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই না, আর এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন। কোন কিছুর বিনিময়েও এই ডিসিশন পরিবর্তন হবে না।
এই কথা শুনে সাথে সাথে আরাধ্যর চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। স্পর্শিয়া জানে আরাধ্যর মধ্যে এখন কি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তাই ও আর সাহস করলো না আরাধ্যর দিকে তাকানোর ৷ মুখ নিচু করে রাখলো। আরাধ্য জিদ কন্ট্রোল করতে না পেরে ট্রেতে রাখা পানি ভর্তি কাচের গ্লাসটা ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। স্পর্শিয়া চমকে গিয়ে একবার ফ্লোরে পড়া গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলোর দিকে তাকালো, আরেকবার আরাধ্যর দিকে তাকালো। আরাধ্যর চোখ রক্ত লাল। চেহারায় ক্ষোভ স্পষ্ট। সত্যিই, শান্ত মানুষ সহজে রাগে না, আর যখন রাগে তখন এতটাই হিংস্র হয়ে উঠে যে তাদের কন্ট্রোল করার ক্ষমতা কারও থাকে না। ভাগ্যিস সবাই নিচে। নয়তো এই গ্লাস ভাঙার শব্দে কেও না কেও চলে আসতো।

আরাধ্য স্পর্শিয়ার দিকে এগিয়ে ওর গাল শক্ত করে চেপে ধরলো। ব্যথায় স্পর্শিয়া কুকড়ে যাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে “উফফ” করে উঠলো স্পর্শিয়া। আরাধ্যকে এই মূহুর্তে ওর বাঘের মতো ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে ওর সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু উপস্থিত।

আরাধ্য কোথায় আছে সেই খেয়াল ওর নেই৷ নিজের মস্তিষ্কের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে আরাধ্য। ও গর্জে উঠে বলল,
– আজ এই কথা বলে তুই প্রমান করে দিলি যে তুই সত্যিই একটা নোংরা মেয়ে। বেশ্যা চিনিস? ওরা যা করে পেটের দায়ে করে, বাধ্য হয়ে একাধিক মানুষের সাথে সম্পর্ক করে, আর তুই? ছিঃ! ঘৃণা হচ্ছে তোর ওই চেহারা দেখতে আমার।

স্পর্শিয়া দুচোখ ভরে পানি পড়তে লাগলো। ও আজ আরাধ্যর কাছে এতটাই নিচ যে, আজ ওকে বেশ্যার সাথে তুলনা করছে আরাধ্য। ঘৃণা এসে পড়লো নিজের ওপর নিজের। এরই যোগ্য ছিল ও। ভালোবাসার মূল্য যারা সময় মতো না বুঝে তাদের এমনই হওয়া উচিত।

আরাধ্য স্পর্শিয়াকে ছেড়ে দিল। চুপ হয়ে গেল। খুব জোড়ে জোড়ে ফোপাতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষন পর স্পর্শিয়ার চোখে চোখ রেখে বলল,
– শোন। তুই শুধু আমাকেই বিয়ে করবি। তোর ওই সায়ান প্রেমিকের জন্য আমাকে বিয়ে করতে অস্বীকার জানাচ্ছিস না তুই? তুই যদি বিয়ে না করিস, তাহলে তোর সব কুকির্তী আমি তোর ফ্যামিলিকে জানিয়ে দিব।
– ব্ল্যাকমেইল করছ তুমি আমাকে ?
– যা ভাবিস।
– তুমি আর কি জানাবে, আমার যতই কষ্ট হোক, যা কিছুই শুনতে হোক, আমি নিজেই সব জানিয়ে দিব আমার ফ্যামিলিকে। তোমার আর কষ্ট করতে হবে না।
– আর তোর ফ্যামিলি এত সহজেই রাজি হয়ে যাবে?
– জোর করে না হয় বিয়ে করবে আমাকে। কিন্তু, কখনো কি ভালোবাসা পাবে? আমি তো তোমাকে ভালোবাসি না আরাধ্য। জোড় করে তো ভালোবাসা পাওয়া যায় না।
আরাধ্য রাগে কটমট করতে করতে বলল,
– তুই একটা বাজে মেয়ে। রাস্তার কীট। এক পুরুষে হয় না তোর মতো মেয়েদের। তোদের একসাথে কয়েকটা পুরুষ লাগে।
স্পর্শিয়াও চেচিয়ে বললো,
– হ্যা, হয়না আমার এক পুরুষে। একাধিক পুরুষ লাগে আমার। তুমি যখন এতই ভালো, তবে তোমার মতোই একটা ভালো মেয়ে খুজে নাও।

আরাধ্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, স্পর্শিয়া ওর সামনে থেকে উঠে পড়লো । ফ্লোরের যেদিকে ভাঙা কাচের টুকরোগুলো পড়ে ছিল সেগুলোই পারা দিয়ে গেল। বেশ কয়েকটা টুকরো ওর পায়ের ভেতর দিয়ে ঢুকে গেল। পুরোটা ফ্লোর রক্তে ভিজে গেল। আরাধ্য শুধু টলমল চোখে স্পর্শিয়ার যাওয়ার পথে তাকিয়ে রইলো। স্পর্শিয়া কি ওকে সায়ানের জন্য এভাবে রিজেক্ট করে গেল? তখনই ওর মনে পড়লো, পৃথিবীতে একটা মেয়ের প্রথম প্রেমের মতো সর্বগ্রাসী আর কিছুই নেই। ওই যে একটা কথা আছেনা, কোন মেয়ের প্রথম প্রেম হতে পারাটা সৌভাগ্যের ব্যাপার। আজ আরাধ্যর আফসোস হচ্ছে সেই সৌভাগ্যটা ওর নেই বলে, সায়ানের আগে ও স্পর্শিয়ার লাইফে আসতে পারলো না বলে।

.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
.
পরদিন ___
সবাই আড্ডা দিচ্ছে কলেজে, কিন্তু স্পর্শিয়ার ধ্যান অন্যদিকে। কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছে। কোন কিছুই ভালো লাগছে না। সায়ানকে গতরাতেই কল দিয়ে সব জানিয়ে দিয়েছে। সায়ান ছেলেটা খুব কষ্ট পেয়েছিল ওর কথায় ৷ এক পর্যায় কেদেই দিয়েছিল। স্পর্শিয়া কোন উত্তর দিতে না পেরে কল কেটে দিয়েছিলি। নিজেকে দুই দুইটা ছেলের অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। তীব্র অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে বার বার। কলেজ ক্যাম্পাসে বেশিক্ষন সময় না দিয়ে বাসায় ফিরে এলো। পুরো রাস্তা আরাধ্যর কথা ভাবতে ভাবতে চোখের পানি ফেললো। আর ডিসিশন নিয়ে নিল আজ রাতে সবাই যখন বাসায় থাকবে, তখন সবাইকে সায়ান আর ওর সম্পর্কে সব বলে দিবে। আর, আরাধ্যর সাথে এজন্যই ও বিয়ে করতে চাচ্ছে না তাও জানিয়ে দিবে। সাহস জোগাতে লাগলো মনের মধ্যে। কিন্তু মনের অস্থিরতাটা যেন বেড়েই চলছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হারাতে বসেছে। কি যেন চলে যাচ্ছে ওর কাছ থেকে দূরে।

বাসায় আসতেই ঘরে হৈ চৈ শুনতে পেল স্পর্শিয়া। হল রুমে কেও নেই, কিন্তু ভেতরে খুব হৈ চৈ শোনা যাচ্ছে। কিন্তু কি হয়েছে? ভয় পেয়ে দৌড়ে ভেতরে যেতে নিতেই ছোট চাচী ওকে ধরে বলল, “স্পর্শিয়া! মা রে, তোর আরাধ্য তো সুইসাইড করেছে। ”

(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi
(চলবে)

লিখা: Dewan Oishi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here