প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ৯

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত

#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—-৯

শিহরণজাগানো অদ্ভুত অনুভূতিতে বারবার আড়ষ্ট হচ্ছে আরশী! কম্পনের বেগ বেড়ে, হৃদয়ে ধুকপুকানির আবেশটাও যেন বাড়িয়ে তুলছে আজ ! বুকের বাঁ পাশটা গভীরভাবে মোচড় দিয়ে উঠছে তার! খুব কাছে কারো ফিসফিসানীর স্বর, তার ছোট হৃদয়ে যেন ভয়ংকর তোলপাড়ের সৃষ্টি করছে। যা তার হৃদয়কে করছে ভয়ংকরভাবে আলোড়িত !
চোখ বুঝে নিজেকে স্বাভাবিক করতে ব্যার্থ চেষ্টায় নেমে গেল আরশী। শেষে অদ্ভুত এক কাজ করে বসলো সে! অচেনা ছেলেটির এমন আপনের মতো কথায়, নিজেকে ধরা রাখা যেন কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো তার কাছে! সে ভয়েস রেকর্ড পাঠালো,

” আমি আপনার ওপর কোন ধরনের রাগ করি নি। প্লিজ এইভাবে বলবেন না। আসলে পুরো দিন ব্যাস্ত থাকার জন্য দুঃখিত”

নিজের মনটা অদ্ভুত রকমের হালকা লাগছে এখন আরশীর। দুদিনের পরিচিত মানুষটিকে, হুট করেই কেমন অাপন আপন অনুভব হচ্ছে তার! হয়তো একেই কিশোরীর মোমের ঘরের স্বপ্ন বলা হয়, যা খুব স্বল্প সময়ে বিশাল স্তম্ভ হিসেবে গড়ে উঠে। আবার অল্প আঘাতে চুর্ণ-বিচুর্ণ হয়!

ইরশাদ ফোনের রিংটোন শুনতেই, ছো মেরে ফোনটি হাতে নিল। ভয়েস রেকর্ড দেখে খানিকটা অবাক হলো সে! সাথে কিছুটা ভীতও! তাড়াতাড়ি রেকর্ডটি ওপেন করতেই বিষ্ময়ে যেন থ বনে গেল সে! বিষয়টি কেমন যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে তার!একটু পর আবারও শুনলো সে!
অদ্ভুত এক শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে ইরশাদের শিরদাঁড়ার শেষভাগে!মিহি ঝুনঝুনির মতো চিকন স্বরটি, অন্যরকম তোলপাড় সৃষ্টি করলো যেন তার হৃদয়ে! হৃদয়বীণার টান ক্ষতবিক্ষত করলো যেন তার মনকে! ফোনের গ্লাসের একসাইডে ভাঙ্গা অংশের কথাও যেন বেমালুম ভূলে গেল ইরশাদ!, সবকিছু ছাড়িয়ে দৃশ্যমান হচ্ছেঠোঁটের কোনায় মিস্টি হাসিটি!
বহু বছরের বৈশাখের খরায় যেন হুট করেই বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে আজ! ঠিক এমনটাই অনুভব হচ্ছে এখন ইরশাদের মনে! তার মনের কোনে প্রস্ফুরিত হচ্ছে সুবাসিত পুষ্প আর কোকিলও যেন হচ্ছে ঢেকে সারা! আচমকা আবার মেসেজের টোনে ঘোর কাটলো ইরশাদের,

—– ভাইয়া, আমি কি ভূল কিছু বললাম?
হুট করেই ইরশাদের মনে হলো ভাইয়া ডাকটি বড্ড বেমানান! কিন্তু এর বিপরীতে কিছুই বলল না সে। আর যাই হোক বিষয়গুলো বড্ড দ্রুত হচ্ছে, এই সম্পর্কে কিছুটা চিন্তা করা দরকার, এমনটাইভাবে সে! সে লিখলো,

—– সমস্যা নেই, চায়লে ভয়েস পাঠাতেই পারো। তা ঐদিন মন খারাপ ছিল কেন?
—– আব্বু বকা দিয়েছিল।তাই কাঁদছিলাম
—— আব্বুর বকায় মন খারাপ কর! আবার কাঁদো ও!
আল্লাহ, তাহলে তো আমার এতোদিনে কেঁদে একটা পুকুর বানাতে হতো। নাহ পুকুর না ছোট খাট একটা নদীতো হতোই। নাম হতো ইরশ নদী বা ইরশ খাল!

খিলখিলিয়ে হেসে দিল আরশী। এভাবে অদ্ভুত ভাবে বলে কে! সে মুখ চেপে হেঁসে আবার লিখলো,
—– কেন? খুব বকা খান বুঝি?
—- আরে বকা তো আমার কাছে বোরহানীর মতো। ব তে বকা, ব তে বোরহানী কতো মিল এদের.
—- কিভাবে!
—- এই যে আমি ভাতের সাথে তিন বেলা বকা খায়। আর যেদিন খাই না সেদিন মন আকুপাকু করে। ইশ খেলাম না কেন! কি হলো!.
—– লাইক বদহজমি হয়, তাই না? আপনি তো তাহলে দুষ্টুমিতে পিএইচডি হোল্ডার।

আলতোভাবে মাথা চুলকে লাজুক হাসি দেয় ইরশাদ। মেয়েটির কন্ঠ শোনার পর থেকে তার বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটি তার সামনে বসেই ঝুনঝুনির স্বরে কথাগুলো বলছে তাকে।
কথার মালা ছড়িয়ে পড়লে তা গুছিয়ে আনতে সময় লাগে। আর এই সময়ে চলতে থাকে একগাধা কথোপকথন। এভাবে কথায় কথায় আবার লিখে ইরশাদ,
—- কাল রাঙ্গামাটি যাব। বাইকে চড়ে সকাল সকাল। হয়তো পুরো দিন কথা হবে না তোমার সাথে।
—– আপনার বাইক আছে! জানেন আমার ও বাইক অনেক প্রিয়।
—- তাই নাকি! তবে বাইকটা আমার না৷ আমার বন্ধুর
—- ওহ। আপনি চালাতে জানেন?
—– সব ধরনের গাড়ি চালাতে পারি আমি।

আরশীর হঠাৎ ইরশাদের জন্য খারাপ লেগে উঠলো! আনমনে ভাবলো সে,
” ইশ! বেচারার একটা বাইকও নেই!

অন্যদিকে ইরশাদ আফসোস ভরা স্বরে নিজে নিজে আউড়াল,
” আহা আপু, যদি তোমাকে বলতে পারতাম আমার কষ্টটা! গাড়ির পর গাড়ির কিনে দিতে পারে, কিন্তু বাইকটাই কিনে দেয় না আমার আব্বা। তবে যেদিন ইনকাম করবো প্রথমেই বাইক কিনে নিবো আমি।”

কিছু অব্যাক্ত কথা সবসময় অব্যাক্তই থেকে যায়। দু’পক্ষের কথার মাঝে না বলা অনেক কথায় নিঃশেষিত হয় ব্যাক্তিদ্বরের মাঝে। যার খবর কেবল ঐ দুই পক্ষই জানে!

পরবর্তী সময়গুলো ইরশাদ আর আরশীর জন্য কেবল স্বপ্নময়! নিজের সাথে ঘটা সকল ঘটনা একে অন্যের সাথে শেয়ার করার মাঝে যেন অনাবিল আনন্দ তাদের। আর তাই অনুভব করে পুলকিত হয় তারা। আর সময়, সে তো গতিশীল। আর এই গতিশীল সময়ে, সম্পর্কের গাড়ি গড়িয়েছে অনেকদূর!

অন্যদিকে প্রিয়ার অবস্হা শোচনীয়! প্রায় সময়ই সানমারে টুঁ মেরে আসে সে! হালকা সবুজ রঙের পান্জাবী পরিহিত কাউকে দেখলেই তার চেহারা দেখতে মরিয়া হয়ে উঠে প্রিয়া! এ যেন এক অদ্ভুত পাগলামো! অথবা এক কঠিন আবেগ,যার কারনে সে চায়লেও ভূলতে পারে না সেই মানুষটিকে! তার মনে কেবল একটা প্রশ্নই দৌড়ে বেড়ায় সারাক্ষণ ,
“মানুষটা একবারও আমার দিকে তাকালো না!”

হঠাৎ একদিনের ঘটনা, সবুজ পান্জাবী পরিহিত একইভাবে সজ্জিত এক ছেলেকে পেছন থেকেই প্রপোজ করে বসে প্রিয়া! আর পরে ছেলেটির চেহারা দেখতেই মাথায় হাত তার, যেন ভূত দেখেছে এইভাবেই চমকে উঠলো সে! কারন ছেলেটি স্বয়ং তারই বয়ফ্রেন্ড!
আর তারপর, তারপরের বিষয়টা ভয়ংকর রকমের কষ্টদায়ক! ছেলেটি ছেড়ে দেয় প্রিয়াকে সেদিন। আর এর পরপরই পুরো স্কুল জুড়ে প্রিয়ার নাম ছড়িয়ে পড়ে, “সবুজ পান্জাবী!”

______________
“মেয়ে, তুমি এখনও আমায় বন্ধু ভাবো কি?
কখনো কি আমায় ভেবেছিলে বন্ধুর চেয়ে একটুখানি বেশি?
নাকি ভেবে নেবো আজও তুমি আমায় চেনো নি?

ভালো লাগে না, তোমায় একথা বলেছি বার বার
তোমার মন ভেঙে যাবে ভেবে এসেছিলাম আমি আবার
সবই ছিলো ভালোবাসা, বুঝলেনা বুঝলেনা
বুঝতে যদি দেখতে আমায় লাগছে অচেনা

হাসছি আমি বলছি কথা, ভাবছো দেখি না তোমায়
তুমি আমার হৃদয়ে আর দূর থেকে তাকিয়ে দেখায়
ক্ষণিকের বন্ধুরা যখন আর থাকবেনা
খুঁজে দেখো পাবে আমায়, আমি সেই চির চেনা

তুমি আমি দিয়েছি পাড়ি দুজনে এপার ওপার
সবই আমার স্বপ্ন আর সুখের ছবি কল্পনার
জানি তুমি আমায় এখনো চিনতে পার নি
ভালোবেসে ডাকবে যখন, আসবো তখনি

মেয়ে তুমি এখনো আমায় বন্ধু ভাবো কি?
কখনো কি আমায় ভেবেছিলে বন্ধুর চেয়ে একটু খানি বেশী
নাকি ভেবে নেবো আজও তুমি আমায় চেনোনি”

চোখ বুঁঝে গানের লাইনগুলো অনুভব করছে আরশী। বুকের ভেতরটাও যেন উথাল-পাথাল করছে তার! মনে হচ্ছে গানটির প্রতিটি শব্দ কেবল তার জন্যই তৈরি!কেবল তারই জন্যই লিখা! চোখ বুঝলেই যেন অনুভব হয় সবটা!

“ঠিন” শব্দে ঘোর কাটলো তার। আজকাল এই শব্দটি শুনলেই মনটা ভালো হয়ে যায় আরশীর! অদ্ভুত শিহরন মিশ্রিত কম্পনে আবিষ্ট হয় তার কোমল মন! নতুন এনড্রইড মোবাইলটিতে কয়েকটি চুমু কাটে সে। ফোনটির গরম উষ্ণ গায়ে চুমু কাটতেই তার ইরশাদের ঠোটে চুমু কাটছে এমন অনুভূতি হয়! অদ্ভুত শিহরনে চোখ বুঝে আসে তার ! এই ফোনটি নতুন দিয়েছে তার মামা তাকে। আর ফোন হাতে পেতেই একটা মানুষের কথা মনে পড়েছে তার। ইরশাদ!এই মানুষটির সাথে কথা কেবল কয়েকদিনের তার! কিন্তু কথা বলার সময় কেবল ইচ্ছে করে সে বলতেই থাকে!
আনমনে বুলি আউড়ায় সে “ইরশাদ মেহতাব আরশি মাহমুদ “!

পরপর আরো কয়েকটি মেসেজ আসার শব্দ হলো! সে তাড়াতাড়ি ফোনটি উড়নার তলে লুকিয়ে সাউন্ড বক্সটি চেপে ধরলো। সাউন্ডটা যে মিউট করবে, সেই খেয়াল আর তার মাথায় ই আসলো না!
ইরশাদের কন্ঠ শুনলেই বুকটা ধরফরিয়ে উঠে তার! আর এখন তো গোটা একটা গানই গেয়ে পাঠিয়ে দিল সে! অদ্ভুত মাতাল করা অনুভবের রেশভাবটি যেন এখনো কাটে নি তার। আঁড়চোখে রান্নাঘরে উঁকি দিল আরশি। আজকাল মা টাও যে খুব করে চোখে চোখে রাখছে তাকে! সামনে নবম শ্রেনীর বার্ষিক পরীক্ষা। কিন্তু নতুন ফেইসবুক খুলেই আরশাদের খুনশুটির প্রেমে পড়ে গিয়েছে সে!

” ইশ কি সুন্দর কন্ঠ! দেখতে না জানি কতো সুন্দর! ”
আনমনে ভাবে আরশি! তখনই আবার ম্যাসেজের শব্দে, চিৎকার করে পড়তে পড়তে তাড়াতাড়ি এসএমএস টি ওপেন করে সে,

—– পড়ছো?
—- এই পিচ্চি কই গেলা?
—- কিরে, আমার সামনে অনার্স সেকেন্ড ইয়ার পরীক্ষা। এখন কি আমি থাকবো না কি চলে যাব?

—– আরে, পড়তে হবে তো আমার। না পড়লে আব্বু বকবে তো।
—- পিচ্চি তুমি কি বিজি?

নাক ফোলায় আরশী। সে কি পিচ্ছি! তার এখন পনেরো চলে। সে নাক ফুলিয়ে এসএমএস পাঠায়

—– আপনার এতো পড়া থাকলে নেটে কেন? পড়তে বসুন।

মেসেজের শব্দে ধরফরিয়ে ফোনটি হাতে নিল ইরশাদ। ঠোঁটের কোনে ঝুলছে তার বাঁকা হাসি! ঠোঁটের কাছে দেবে চমৎকার টোলের সৃষ্টি হয়েছে এতে। বেরিয়ে এসেছে সমান চিকন ঝকঝকে দাঁতগুলো। আলতো ঠোঁট কামড়ে আবার এসএমএস করলো,

—– সায়র অর্থ জানো?

আরশি মায়ের সামনে বসে আছে। মা নাকি পড়া নিবে! সে পড়া বলতে বলতে আড়চোখে ওরনার নিচে দেখলো! ফোনের লাইট টা জ্বলছে!
হঠাৎ বেতের বাড়ি পড়লো তার হাতের ওপর! আহ্ করে হাত সরিয়ে ফেলল সে। করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকাতেই মায়ের অগ্নিদৃষ্টির সম্মুখীন হলো সে! মা বইটি তার দিকে বাড়িয়ে রাগী স্বরে বলল,
—- দু ঘন্টা ধরে এই একটা রচনা মুখস্থ হচ্ছে না তোর? আরশি বাংলায় এতো কাঁচা কেন তুই? অংক তো বাতাসের আগে করিস৷ আবার পড়। আমি বিশ মিনিট পরে আবার আসবো।

বইটি আরশির সামনে রেখে আবার রান্না করতে চলে গেলেন তিনি। আরশি যেন এতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে। তাড়াতাড়ি ফোনটি হাতে নিতেই রাগ উঠে যায় তার!

” কেমন বদ মানুষ, আমাকে আবার বাংলা শব্দের অর্থ জিগায়৷ যা শালা আর কথাই বলবো না আমি”

ইরশাদ আরশির পাঠানো মেসেজটির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। মেয়েটা পুরো বাচ্চা! আনমনে ভাবে সে! এই যে এখন মেসেজ করলো
” আপনার মাথা”!

ইরশাদ মেসেঞ্জারের আইডির নামটি দেখে আবার।
” স্বপ্নের ছন্দপাত” লিখা একটি আইডি! মেয়েটির আসল নামটি কখনোই বলে নি তাকে! আচ্ছা ছন্দ কি তার আসল নাম! আনমনে ভাবে সে!

সে মনে মনে ভাবে,
অদেখা মেয়েটি হলো, আমার প্রেম সায়রের ছন্দপাত!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here