প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -০৪+৫

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৪
_________________________
তন্ময়ের ফোনে লাগাতার কল আসছে৷ তাকে কল করছে পরিবারের সবাই৷ যেমন বড় চাচ্চু তাকে দুবার কল করেছে৷ ছোট চাচ্চু করেছে চারবার৷ ছোট চাচি ছয়বার৷ তার মা করেছে নয়বার৷ মোট কথা শতশত মিসডকলস এসেছে৷ কিন্তু তন্ময় দেখেনি৷ সাইলেন্ট করা ছিলো তার ফোন৷ এখন হাতে নিয়ে কল দেখেও কাউকে কল ব্যাক করেনি৷ সবাই অরু এবং দীপ্তর চিন্তায়৷ স্কুল থেকে হয়তো এতক্ষণে বাড়িতে ফোন গিয়েছে তাদের অ্যাবসেন্সের৷ তন্ময় শাবিহাকে বললো,
— তোর ফোন কই?
— ফোন অফিসে৷
— ধর কথা বল৷ জানিয়ে দে ওরা তোর কাছে৷
তন্ময় তার ছোট চাচ্চুকে কল ব্যাক করে শাবিহাকে ধরিয়ে দিলো৷ শাবিহা সবকিছু খুলে বললো। এগুলো শুনে রেগে গেল বাড়ির সবাই৷ আজ বাড়িতে গেলে অরু এবং দীপ্তর খবর আছে৷ দীপ্ত শীতে এবং ভয়ে কাঁপছে অরুর পাশে৷ তার পাছায় আজ ড্রাম বাজাবে তার বাবা৷ অবশ্য অরুর কপালেও শনি আছে সেটা ভেবে ভয় কিছুটা কমে গেল তার। সে তো আর একা মাইর খাবেনা৷ অরুও খাবে সাথে৷ আপাতত রাতের বাজছে আটটা৷ বৃষ্টিও থামছে না৷ এদিকে কমবেশি সকলের কাপড়চোপড় ভিজেভিজে। অরু সমানে হাচি দিচ্ছে৷ দীপ্তর নাক লাল হয়ে গিয়েছে৷ এই বাচ্চার জ্বর আসবে বলে৷ কপাল ছুঁয়ে দেখল গরম৷ রাগান্বিত তন্ময় ডিসিশন নিল তার বাইকের চাবি অয়নকে দিয়ে, এখনই অরুদের নিয়ে বাসে করে রওনা হবে৷ অয়ন তন্ময়কে বললো,
— ভাই এখানকার বাস গুলো পুরো ভর্তি হয়ে যাচ্ছে৷খালি বাস পাওয়া একটু মুশকিল৷
— অপেক্ষা করি!
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর দু সিট ফাঁকা রয়েছে এমন একটি বাস পেল৷ সামনে গেলে আরও সিট খালি হবে বলা হয়েছে৷ তন্ময় সাইকেল গুলো বাসের ছাঁদে তুলতে বললো হেল্পারকে৷ অয়নের সাইকেল সহ সবগুলো সাইকেল তোলা হয়েছে৷ তারপর অরুদের নিয়ে উঠে গেল বাসে৷ খালি দুটি সিটে দীপ্ত এবং মারজি বসেছে৷ ওদের দুজনের অবস্থা বেশ নাজুক৷ অবশ্য মারজি বলেছে সে দাঁড়াবে বরং অরু বসুক৷ কিন্তু অরু না করে দিল৷ সে দিব্বি স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে৷ আরও প্যাসেঞ্জার উঠছে দেখে তন্ময় অরুর পেছনে দাঁড়ালো৷ একপ্রকার সে তন্ময়ের দু’হাতের ভেতর৷ ভেজা শরীরে তন্ময়ের সাথে লেগে থাকতে অরুর অদ্ভুত লাগছে৷ কেমন যেনো তার ঘনঘন শ্বাস ফেলতে হচ্ছে৷ আঁড়চোখে পিছু ফিরতে নিলে তন্ময় তার ঘাড় চেপে ধরে সোজা করে৷ রক্তিম চোখে তাকিয়ে বলে,
— চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক!
অরু তার কথামতো একদম সোজা হয়ে দাঁড়ালো৷ কখন দুহাত স্ট্যান্ড থেকে ছেড়ে দিলো তার মনে নেই৷ হঠাৎ বাস ঝাকিয়ে উঠলো৷ অরু সামনে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো৷ নিজেকে বাঁচাতে পেছনের যা পেয়েছে টেনে ধরেছে৷ তন্ময়ের বুকের দিকের শার্টের দুটো বোতাম শব্দ করে ছিঁড়ে গেল৷ অরু হতবাক হয়ে গিয়েছে৷ বড়বড় চোখ করে ফিরে তাকাল৷ সে তন্ময়ের বুকের শার্ট টেনে ধরেছিল৷ মাথা তুলে তাকিয়ে দেখল, তন্ময়ের চোখ জোড়া রাগে লাল হয়ে গেছে৷ ভয়ে অরুর গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ৷ সে নিচে তাকিয়ে বোতাম খুঁজতে লাগলো৷ পেল না৷ না পেয়ে শার্ট গুঁছিয়ে দিয়ে ভয়ে ভয়ে বললো,
— আমি সেলাই করে দিব হ্যাঁ ভাইয়া?
তন্ময় রাগে বাকরুদ্ধ৷ সে ঠিক কী করবে এই মেয়ের সাথে বুঝে উঠতে পারছে না৷ একটা মানুষ এতটা মেসি কীভাবে হয়? ইচ্ছে করছে থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দিতে এর৷ নিজেকে কোনোরকমে সামলে অরুকে ঘুরিয়ে ফেললো৷ অরুর হাত দুটো পেছন থেকে পেঁচিয়ে ধরে রাখল ৷
— এভাবেই পুরোটা রাস্তা যাবি৷
চোখজোড়া ভিজে উঠেছে অরুর৷ খুব ব্যথা পাচ্ছে৷ সে কী ইচ্ছে করে করেছে নাকি? লোকটা শুধু অরুকে বকাঝকা করে৷ ছোট্ট মনের তাকে এভাবে বকাঝকা করলে হয়? কয়েকবার হাত ছাড়াতে চাইল৷ তন্ময় আরও শক্ত করে ধরলো৷ উপচে পড়া চোখের জল নিয়ে অরু এক অদ্ভুত অনুভূতি পেতে শুরু করেছে৷ তার বুক এতো দ্রুত বেগে ছুটছে কেন? মাথা ব্যথা নিয়ে দীপ্ত পাশে মুখ লুকিয়ে হাসছে৷ একসময় শব্দ করে হাসতে লাগলো৷ তার হাসি দেখে অরু রেগে গেল৷ চোখ রাঙিয়ে তাকাল৷ তাতে দীপ্তর হাসি বেড়ে গেল শতগুণ৷ মারজির অবস্থাও একই৷ সে নিজের হাসি লুকোতে জানালার বাহিরে তাকাল৷ আধঘন্টার মধ্যেই বাস পৌঁছে গিয়েছে গন্তব্যে৷ তন্ময় অরুর হাত ছেড়ে দিতেই সে কুঁকড়ে উঠলো৷ ব্যথায় হাত অবশ হয়ে গিয়েছে একপ্রকার৷ নাড়াতেও কষ্ট হচ্ছে৷ তন্ময় তাকে ফেলেই দীপ্তকে নিয়ে নেমে গেল৷ অরু নিজের হাত চেপে নেমে এসেছে একটু পর৷ তার চোখের পাতায় তখনো জল৷ হেচকি তুলে তন্ময়ের দিক তাকাল৷ তন্ময় তখন বাস হেল্পারের সাথে সাইকেল নামাতে ব্যস্ত৷ অয়নের সাইকেল নিয়ে মারজি দৌড় লাগালো৷ সে দ্রুত পায়ে অয়নদের বাড়িতে সাইকেল রেখে এসে নিজেরটা নিয়ে চলে যাচ্ছে৷ মোরেই তার জন্য তার ভাই এহসান অপেক্ষা করছে৷ তন্ময় ধমকের সুরে বললো,
— দ্রুত ঘরে যা!
অরু এক সেকেন্ড অপেক্ষা করলো না৷ সাইকেল নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে যাচ্ছে৷ হুট করে ফিরে তন্ময়কে ভেঙিয়ে গেল৷ তারপর আরেকটু গিয়ে আবারো মাথা ঘুরিয়ে জিহ্বা দেখিয়ে চলে গেল ভেতরে৷ দীপ্ত চাচ্ছিল তন্ময়কে টেনে বাড়ির ভেতরে নিবে৷ তবে যেই রাগী ভাবে তন্ময় তাকিয়ে আছে৷ তা দেখে দীপ্তর গলা দিয়ে কোনো শব্দই বেরোলো না৷ আলগোছে চলে এসেছে সেও৷ যেতে নিয়ে বেশ কয়েকবার পিছু তাকাল৷ তন্ময় তখনো দাঁড়িয়ে৷ যতক্ষণ বাড়ির গেইটে না ঢুকেছে ততক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিলো৷
ড্রয়িংরুমে মোস্তফা সাহেব বসে৷ সদরদরজা সামনে দাঁড়িয়ে আনোয়ার সাহেব৷ সুমিতা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন চিন্তিত চেহারা নিয়ে৷ মুফতি বেগম রান্নাঘর থেকে বারবার চলে আসছেন৷ কোনো কাজেই মন লাগছেনা৷ বাচ্চাগুলো এই প্রথম এমনটা করেছে৷ আগে একটু লুকোচুরি করেছে তবে কিছু সময়ের জন্য৷ এমন পুরোটা দিন পাড় করে দেয়নি৷ অরু ঢুকতেই আনোয়ার সাহেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন৷ ভেজা কাপড়চোপড় লক্ষ্য করতেই বললেন,
— কী করছ এগুলো মা?
সুমিতা বেগম তেড়ে এসেছেন৷ অরুর কান টেনে বললেন,
— কীসের মা? ওর পা দুটো ভাঙব আজ৷
দীপ্তকে ওহী সাহেব হাতের কাছে পেতেই পাছায় উদোম চড় বসালেন৷ তবে একটাই চড় মেরেছেন৷ ছেলের গরম শরীর উপলব্ধি করে মারার সাহস পেলেন না আর৷ মুফতি বেগম ছেলেকে কোলে নিয়ে উপরে চলে গেলেন৷ অরুকে মাথায় কয়েকটা চড় দিয়েছে সুমিতা বেগম৷ তবে আনোয়ার সাহেবের উপস্থিত থাকায় মারতে পারেন নি৷ মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন,
— কে দিয়ে গিছে তোমাদের অরু?
— তন্ময় ভাই৷
মোস্তফা সাহেব থমকে গেলেন৷ তারপর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন৷ আশা নিয়ে শুধালেন,
— চলে গেছে?
— দেখেছিলাম দাঁড়িয়ে৷
মোস্তফা সাহেব বললেন,
— যাও দ্রুত কাপড়চোপড় পরে নাও৷ ঠান্ডা লেগে যাবে৷
— আচ্ছা বড় চাচ্চু৷
অরু নাক টানতে টানতে উপরে উঠছে৷ পিছু ফিরে দেখল মোস্তফা সাহেব বাহিরের দিক যাচ্ছেন৷ নিশ্চয়ই তন্ময় ভাইয়ের আশায়? কিন্তু তন্ময় ভাই কী এখনো আছে? মোস্তফা সাহেব বেরিয়ে মোরের মাথায় তাকালেন৷ তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে তখনো৷ তার দৃষ্টি বাড়ির দিকই ছিলো৷ বাবা ছেলের দৃষ্টি মুহুর্তেই এক হয়ে গেল৷ অপ্রস্তুত ভাবে নড়ে উঠলেন মোস্তফা সাহেব৷ এগিয়ে যাবেন নাকি বাড়ির ভেতরে চলে যাবেন? ছেলেকে কী তিনি ফেইস করতে পারবেন? তন্ময় এগিয়ে আসল না৷ তবে সেখানকার একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো৷ এবং দুটো চায়ের অর্ডার দিল৷ মোস্তফা সাহেব এগিয়ে যাচ্ছেন ছেলের দিক। দোকানের সামনে এসে পৌঁছে তিনি সময় নিয়ে ছেলের মুখের দিক তাকিয়ে রইলেন৷ তন্ময় ও তাকাল৷ ভাবলেসহীন ভঙ্গিতে বললো,
— বসো বাবা!
মোস্তফা সাহেব বসলেন৷ তন্ময়ও তার পাশে বসলো৷ দোকানদার একটা চায়ের কাপ এগিয়ে দিতেই সেটা নিয়ে তন্ময় মোস্তফা সাহেবের দিক এগিয়ে দিল৷ আর একটা নিজে নিল৷ গরম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে যাচ্ছে সমানে৷ বাবার দিক তাকাচ্ছে না৷ মোস্তফা সাহেব তখনো ছেলেকে দেখতে ব্যস্ত৷ ছেলেটা তার শুকিয়ে গেছে৷ ক্লান্ত, বিষন্ন চেহারা হয়ে আছে৷ তার বুকটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হতে লাগলো৷ এতো কষ্ট করে এমন বড় রাজ্য দাঁড় করিয়ে কী হলো? এতো টাকাপয়সা কামানের কি মানে দাঁড়ায় যখন সন্তানেরা সেই টাকা ব্যবহার করেনা৷ শাবিহা রিক্সা, বাস, অটো দিয়ে চলাফেরা করে, বাড়িতে দু তিনটা গাড়ি থাকতেও৷ আর ছেলের কথা কী বা বলবেন! নিজেদের ফ্যাক্টরি, বিজনেস ছেড়ে অন্যের কোম্পানিতে চাকরি করে৷ হতাশায় তিনি নির্বোধ হয়ে গিয়েছেন৷ তন্ময় জমিন থেকে নজর সরিয়ে বাবার দিক তাকাল৷ খুব আদুরে কন্ঠে প্রশ্ন
করলো,
— কেমন আছো বাবা?
মোস্তফা সাহেবের চোখজোড়ায় জ্বালা করছে৷ তিনি ছেলের থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। নিজের লালচে চোখজোড়া লুকানোর বৃথা চেষ্টায় পড়ে রইলেন৷ অসহায় গলায় বললেন,
— সন্তান বাবাকে ফেলে রেখে গিয়ে জিজ্ঞেস করছে কেমন আছে তার বাবা!
— চা’টা ঠান্ডা হচ্ছে! খেয়ে নাও৷
— ভিজে কাপড়চোপড় পরে আছো এখনো৷ ঠান্ডা লেগে যাবে৷ বাসায় আসো৷
— মা অপেক্ষায় আছে৷ ফিরতে হবে আমায় বাবা৷
মোস্তফা সাহেব ছেলের দিক তাকালেন৷ তন্ময় উঠে দুকাপ চায়ের টাকা পরিশোধ করল৷ যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও দাঁড়িয়ে রইলো৷ যেতে পারছে না৷ মোস্তফা সাহেব নিজেই বাড়ির দিক চলে যাচ্ছেন৷ সে সেভাবে বসে থাকলে ছেলে তার যাবেনা৷ ভিজে কাপড়চোপড় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে৷ ছোট থেকেই খুব নাজুক স্বভাবের৷ অল্পতেই ঠান্ডা, জ্বর লেগে যায় ছেলেটার৷ রাতেই অসুস্থ হয়ে পড়বে ছেলেটা৷ চিন্তায় মোস্তফা সাহেবের বুকটা ব্যথা করছে৷
——-
অয়ন ভেজা কাপড়চোপড় পরে এখনো বাস স্ট্যান্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে৷ তার সামনে বাইক৷ শাবিহার ছুটি হতে পাচ মিনিট বাকি এখনো৷ অয়ন হুট করে হাচি দিয়ে উঠলো৷ ঠান্ডা লেগে গিয়েছে তার৷ নাক টানটান করছে৷ বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল৷ এখন আবার পড়ছে৷ টুপটাপ বৃষ্টির ফোটা পড়ছে৷ অয়ন এক ধ্যানে রাস্তায় তাকিয়ে রইলো৷ তার অদ্ভুত এক ইচ্ছে জেগে উঠলো৷ যদি শাবিহা শাড়ি পরে এমন বৃষ্টির রাতে ল্যাম্পপোস্টের রেখা অনুসরণ করে তার হাতে হাত রেখে হাঁটে কেমন হবে? বৃষ্টিতে ভেজা স্নিগ্ধ শাবিহাকে তখন কেমন দেখাবে? অয়ন কিছুক্ষন আগে দুটো সিগারেট কিনে এনেছিল৷ সেটা ধরাল৷ বড়বড় কয়েকটা টান মেরে ধুঁয়া ছুড়ে মারল মাথা উঁচু করে৷ আঁড়চোখে খেয়াল করলো শাবিহা বেরোচ্ছে৷ আজ আর সিগারেট সরালো না৷ টেনেই যাচ্ছে৷ এক সময় চোখে চোখ পড়লো৷ আলগোছে সিগারেট পাশেই ফেলে দিলো৷ শাবিহা হুট করে রেগে গেল৷ কিন্তু তার রাগ কী নিয়ে আন্দাজ করতে পারছে না৷ অয়নের উপর সে চরম বিরক্ত৷ এই ভেজা কাপড়চোপড় পরে এখনো দাঁড়িয়ে৷ ছেলেটা কী পাগল? আঁড়চোখে তাকাল৷ অয়নের টাই ঝুলে বুকের মাঝখানে দুলছে৷ চুলগুলো কপালের সামনে লেপ্টে আছে৷ আশ্চর্যজনক ভাবে ভার্সিটির কোড ড্রেসে অয়নকে একদম বাচ্চাবাচ্চা লাগছে না৷ বয়স তুলনায় বেশ বড়বড় ভাব নিয়ে রেখেছে৷ শাবিহার চোখের সামনে অয়ন বাইকে উঠে বসেছে৷ বাইক স্টার্ট করে বসে৷ যাচ্ছে না৷ যেমন শাবিহার উঠে আসার অপেক্ষায়৷ শাবিহা না দেখার ভান করে দাঁড়িয়ে৷ মাত্রই বাস এসে থেমেছে শাবিহার সামনে৷ শাবিহা একবার বাসের দিক তাকাল তো একবার অয়নের দিক৷ অয়ন সামনে তাকিয়ে৷ তার দিক তাকাচ্ছে না৷ শাবিহা বাসের দিক এগিয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু তার মন বিচলিত৷ ভেজা কাপড়চোপড় পরিহিত অয়নকে দেখে তার ইচ্ছে করছে না আর বাসে যেতে৷ বাস আর অপেক্ষা করলো না৷ চলে গেল৷ শাবিহা দাঁড়িয়ে তখনো৷
— বৃষ্টি হচ্ছে৷
শাবিহার কথায় তাকাল অয়ন৷ তার উপরেই তো বৃষ্টি পড়ছে৷ সে কীভাবে না জানা যে বৃষ্টি পড়ছে? শাবিহা আকাশের দিক তাকাল৷ মৃদু বৃষ্টি৷ এই বৃষ্টিতে বাইক চড়ে গেলে এক আলাদা অনুভূতি কাজ করবে৷ এই অনুভূতি শাবিহা উপভোগ করতে চায়৷ এগিয়ে গেল বাইকের দিক৷ যখন অয়নের কাঁধে হাত রেখে পেছনে উঠে বসলো, অয়নের ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের এক অমায়িক হাসি ফুটে উঠলো৷ সে একটানে বাইক নিয়ে দূর দূরান্তে ছুটে চললো৷ শাবিহা প্রস্তুত ছিলো না মোটেও৷ শক্ত করে ধরলো অয়নের কাঁধ৷
— ধীরে চালাও৷
অয়ন বললো,
— আমাকে শক্ত করে ধরুন শাবিহা৷
শাবিহার হৃদয় কেঁপে উঠলো৷ সে এই প্রথম তার নাম অয়নের মুখে শুনেছে৷ আগে কখনো নাম ধরে বলেনি৷
— আমি তোমার বড়৷
অয়ন বৃষ্টির মধ্যে চেঁচিয়ে উঠলো নিজের সর্বশক্তি দিয়ে, ‘ শাবিহা ‘! শাবিহা ক্রোধের ভান করে শাসাল,
— অয়ন!
অয়ন আরও জোরে তার নাম উচ্চারণ করলো৷ নিজের নাম যেনো চারপাশ থেকে শুনছে সে৷ এই ব্যাকুল অনুভূতি কীভাবে অস্বীকার করবে? অয়ন শব্দ করে হাসছে৷ তার হাসির শব্দে শাবিহার ঠোঁটের কোণ উঁচু হয়ে আসছে৷ পরপর চোখজোড়া বন্ধ করে ফেললো৷ বৃষ্টির ফোটা তার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে৷ চুলগুলো খুলে গিয়েছে ততক্ষণে৷ ওড়না ছুটাছুটি করছে বিদায় সেটা পেঁচিয়ে নিলো৷ অয়ন শব্দ করে বললো,
— আমাকে শক্ত করে ধরুন৷
— এই না না৷ আমি ভয় পাই৷
— ভয় পেয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবেন আমিতো তো তাই চাই৷
— আমি কিন্তু নেমে যাবো৷
— আমি নামতে দিব না আপনাকে৷
বাইক আরও স্পিডে চলছে৷ ভয়ে শাবিহা কখন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছে খেয়াল করেনি৷ তার দু হাত অয়নের দু’কাঁধে৷ ভয়ে খামচে ধরে আছে সেখানটায়৷ অয়ন বৃষ্টির মধ্যে উচ্চস্বরে একটি গানের সুর তুললো,
সে বৃষ্টি ভেজা পায়ে
সামনে এলে হায়, ফোটে কামিনী
আজ ভিজতে ভালো লাগে
শূন্য মনে জাগে প্রেমের কাহিনী
আশ্চর্যজনক ভাবে অয়নের গলা খুব সুন্দর৷ গান গাওয়ার ভঙ্গিমা বলে দিচ্ছে সে প্রায়শই গান গায়৷ শাবিহার খুব করে ইচ্ছে হলো, একটা সম্পুর্ন গান অয়নের থেকে শুনতে৷ পরক্ষণেই নিজেকে মনেমনে বকল৷ লজ্জার মাথা খেয়েছে৷ বুড়ো বয়সে একটা একটুখানি ছেলের মুখ থেকে গান শুনতে ইচ্ছে করে তার৷ নিজেকে নিজেই ভেঙাল শাবিহা৷ তারপর রাস্তায় নজর রাখল৷ তবে এই বৃষ্টির রাতে বাইকে বসে অয়নের মুখে শোনা এই গান মনে হয়না সে কখনো ভুলতে পারবে৷ তার বুকের ভেতরে ধুকপুক করতে থাকা হৃদয় তাকে ভুলতে দেবেনা৷ অনেক রাস্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তারপর বাড়ির সামিল বাইক থামিয়েছে অয়ন৷ শাবিহা নেমে দ্রুত পায়ে বাড়িতে ঢুকে গেল৷ ফিরে তাকাল না৷ অয়ন তাকিয়েই রইলো৷ তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি৷ তার মন বলছে সে একটু হলেও শাবিহার মন নাড়াতে সক্ষম হয়েছে৷ হঠাৎ শাবিহা ফিরে এলো৷ ধমকের সুরে বললো,
— এই ছেলে যাচ্ছ না কেন!
ধমক দিয়েই সে ঘরে ঢুকে গিয়েছে৷ এবার অয়ন শব্দ করে হাসতে লাগলো৷ হাসতে হাসতে সে বাইক স্টার্ট করে একটানে চলে গেল৷ আপাতত বাইক সে তন্ময়ের বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে, তারপর বাড়ি যাবে৷ একটা লম্বা ঘুম দেবে৷

চলবেপ্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৫
_________________________

শাহজাহান বাড়ির তিন দুলাল আজ জ্বর, ঠান্ডা নিয়ে বিছানায় পড়ে আছে৷ ডাক্তার আশরাফুল রাত ন’টায় এসেছিলেন৷ অরু, শাবিহা এবং দীপ্ত৷ এই তিনজনকে দেখে ঔষধ দিয়ে গেছেন৷ শাবিহা এবং দীপ্ত ঔষধ খেয়ে নিজেদের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ কিন্তু অরু জ্বর নিয়ে বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরছে ফিরছে৷ আর তাকে বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজছে সুমিতা বেগম। হাতে পেলেই চড়টড় মেরে দিতে পারেন৷ অরু ঘুরেফিরে পৌঁছেছে মোস্তফা সাহেবের রুমের দিক৷ মোস্তফা সাহেব চিন্তিত ভঙ্গিতে পায়চারি করছেন অন্ধকার রুমে৷ অরু হুট করে দরজা খুলে মাথাটা ঢুকিয়ে দিল৷ মোস্তফা সাহেব ধড়ফড় করে বুকে হাত চেপে ধরলেন৷ আরেকটু হলে তিনি চিৎকার করে বসতেন৷ নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীরস্বরে ধমক দিলেন৷
— অরু!
অরু ঘুমন্ত কন্ঠে বলল,
— সরি চাচ্চু!
তারপর বোকাসোকা চেহারায় গম্ভীর ভাব নিয়ে উষ্কখুষ্ক অবস্থায় মোস্তফা সাহেবের রুমের লাইট জ্বালালো৷ লাফিয়ে বিছানায় বসলো৷ পাশের যায়গা থাপড়ে মোস্তফা সাহেবকে বসতে ইশারা করলো৷ মোস্তফা সাহেব গম্ভীরমুখে বসলেন৷ অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে তার পানে তাকিয়ে৷ তারপর আরেকটু চেপে বসলো তার দিক৷ মোস্তফা সাহেবকে হাতের ইশারায় মাথাটা তার দিক আনতে বললো৷ মোস্তফা সাহেব আসতেই সে ফিসফিসিয়ে বললো,
— আমি জানি৷
— কি?
— আমি জানি তুমি কেন চিন্তিত!
— কেন?
— তুমি তন্ময় ভাইকে নিয়ে চিন্তিত৷ আজ তন্ময় ভাই বৃষ্টিতে ভিজেছে না! তার তো নাজুক শরীর। অল্পতেই জ্বর, ঠান্ডা তাকে কাবু করে ফেলে৷ আজ তো তার তুখোড় জ্বর উঠবে৷ তুমি নিশ্চয়ই জানতে চাও জ্বর কতটুকু উঠেছে? বেশি না কম! ডাক্তার পাঠাবে নাকি এসব ভাবছ! শোনো আমি বলি…
মোস্তফা সাহেব অরুর দিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের কপাল চাপড়ালেন৷ এই মেয়ে নিশ্চয়ই জ্বরে বোধগম্য হারিয়ে ফেলেছে৷ তাই তার সামনে এমন আবোলতাবোল বকার সাহস পাচ্ছে৷ ডান হাতের উল্টোপাশ অরুর কপালে ছুঁয়ে দিলেন৷ জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে৷ এই মেয়ের মাত্রাতিরিক্ত জ্বর উঠলে, নিজের মধ্যে আর থাকেনা৷ আবোলতাবোল বলে এবং করে৷ তার উপর ঘুমের মধ্যে কথা বলার অভ্যাস, আর হাঁটাচলা তো আছেই৷ মোস্তফা সাহেব নিচে নেমে আসলেন৷ সুমিতা বেগম তখন সোফার নিচে দেখছেন৷ মেয়েটা তার এখানে লোকাল নাকি৷ মোস্তফা সাহেবকে দেখে দ্রুত তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন,
— অরুকে পাচ্ছি না৷
— আমার রুমে৷
সুমিতা বেগম মেয়েকে বকাঝকা করতে করতে উপরে উঠছেন৷ গিয়ে দেখেন মেয়ে তার ঘুমিয়ে পড়েছে বিছানার কোণায়৷ যে-কোন সময় ফ্লোরে পড়ে যাবে৷ এগিয়ে গিয়ে অরুকে ওঠালেন৷ তারপর নিয়ে চললেন নিজের রুমে৷ আজ বাবামায়ের সাথেই ঘুমাবে সে৷ মোস্তফা সাহেব বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন ড্রয়িংরুমে৷ যেমন মনস্থির করছেন৷ নিজেকে প্রস্তুত করে কল করলেন ম্যানেজারকে৷ ম্যানেজার আলামিন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন৷ গভীর ঘুমের তাকে মোস্তফা সাহেব একটি কাজ দিলেন,
— ডাক্তার আশরাফুলকে নিয়ে এক্ষুনি চার নাম্বার লাইনের ছয় নাম্বার বাড়ির পাঁচ নাম্বার ফ্ল্যাটে যাবে৷ এবং আমার ছেলেকে দেখে আসবে। ওষুধপত্র অন্যান্য যা লাগবে দিয়ে আসবে৷
আদেশ দিয়ে তিনি পুনরায় নিজের রুমে চলে গেলেন৷ যতক্ষণ না ম্যানেজার আলামিন নিজের কাজ শেষ করে জানাবেন, ততক্ষন মনে হয়না মোস্তফা সাহেব আর ঘুমাবেন৷

ম্যানেজার আলামিন ছয় নাম্বার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে৷ দারোয়ান গেইট খুলছে না৷ অচেনা মানুষদের ঢোকার অনুমতি নেই৷ আলামিন বললেন পাঁচ নাম্বার ফ্ল্যাটের একজন সদস্যকে ডেকে দিতে, তাহলেই হবে৷ দারোয়ান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বললেন৷ ডাক্তার আশরাফুল মাত্রই ম্যানেজার আলামিনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন৷ বারবার হাত ঘড়ি দেখছেন৷ তিনি সকাল থেকে ব্যস্ত রুগী দেখতে৷ এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি৷ তন্ময়কে দেখেই বাড়ি ফিরবেন৷ জবেদা বেগম পরপরই নিজেই নিচে নেমে এসেছেন৷ দরজার সামনে এসে ম্যানেজার আলামিনকে দেখে চমকে উঠলেন৷ ম্যানেজার আলামিন সালাম জানালো,
— আসসালামু আলাইকুম৷
— আলাইকুমস সালাম৷ ম্যানেজার এতরাতে আপনি এখানে?
— শুনেছি তন্ময়ের জ্বর৷ তাই ডাক্তার নিয়ে এসেছি।
— কার থেকে শুনলেন?
— অরু বলছিলো আরকি৷
জয়া বেগম তাদের ঢুকতে দিলেন৷ সাথে নিয়ে চললেন উপরে৷ তন্ময়ের মাত্রাতিরিক্ত জ্বর উঠেছে৷ তিনি এতরাতে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না৷ ফার্মেসিও সব বন্ধ! বাধ্য হয়ে সকালের অপেক্ষা করছিলেন৷ এখন যেহেতু ডাক্তার নিয়ে এসেছে ম্যানেজার আলামিন, তিনি তার উপর ভীষণ কৃতজ্ঞ৷
——–
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে, নির্লজ্জ অরু পেট ভর্তি গ্যাস্টিক নিয়ে পুরি, সিঙ্গারা, সমুচা খাচ্ছে৷ তার চারপাশ ফিল-আপ হয়ে আছে ব্যবহিত টিস্যু দিয়ে৷ জ্বর কমেছে৷ তবে ঠান্ডা একটুও কমেনি৷ তাতে কী? কলেজ যেতে হবেনা দেখে সে মহা আনন্দে৷ আনন্দিত সে ঠান্ডা কী উপলব্ধি করতে পারছেনা৷ শাবিহা এসেছে তার রুমে৷ এসে ঝা’টা দিয়ে বিছানার চারপাশে থাকা টিস্যু গুলো নিচে ফেলে দিল৷ তারপর অরুর পাশেই শুয়ে পড়লো৷ তারও আজ ছুটি৷ সকাল সকাল উঠে শুনছে তার বাবা অফিস থেকে সিকলিভ নিয়েছে৷ জ্বর নেই তবুও তাকে রেস্ট নিতে হবে৷ কাজে যাওয়া যাবেনা৷ অরু আপুর সামনে সমুচা ধরে বললো,
— একটু খাবা?
— না৷
— একটু খেয়েই দেখ না৷
শাবিহা উঠে বসলো৷ একটা সমুচা নিয়ে চিবুচ্ছে৷ চিবানোর ফাঁকে সে অরুর দিক তাকাল৷ অরু তার দিক আশাহত চোখে তাকিয়ে৷ নজর ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
— কী?
— চিন্তা করছ তন্ময় ভাইকে নিয়ে তাই না? মন আকুপাকু করছে তার খবরাখবর জানার জন্য? তাহলে চলো এক্ষুনি বেরিয়ে পড়ি৷
— কীসের বেরিয়ে পড়ি? তুই যাবি এখন৷ গিয়ে দেখবি কী অবস্থা৷ তারপর আমকে এসে জানাবি৷ যা!
— বললেই হলো৷ পারবো না৷ তুমি সঙ্গে না গেলে যাচ্ছি না।
— বাবা যেতে দিবেনা৷
— দিবে দিবে৷ বড় চাচ্চুর মন এখন কটন ক্যান্ডির মতো৷ ছুঁয়ে দিলেই গলে যাবে৷
শাবিহা দ্বিধাবোধ করছে তবুও৷ তার দ্বিধা চুরমার করতে এসেছে দীপ্ত৷ হাফ প্যান্ট, টি-শার্ট মাথায় ক্যাপ এবং পিঠে ব্যাগ চেপে তৈরি হয়ে এসেছে৷ হাতে টিফিনবাক্স তার৷ কপালের থেকে ঝাকড়া চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল,
— মা তন্ময় ভাইয়ের ফেভারিট ডিস রান্না করে দিয়েছে৷ তাড়াতাড়ি চলো এগারোটা বেজে গেছে৷
অরু হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ ঘর দুয়ার উথাল-পাতাল করে তৈরি হচ্ছে৷ শাবিহার মন আকুপাকু করছে৷ সেও যেতে চায় ভাইকে দেখতে৷ কিন্তু…
অরু শাবিহার হাত টেনে দাঁড় করালো৷ শাবিহা অলরেডি তৈরি আছে৷ সে অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু তাকে যেতে দেওয়া হয়নি৷ সেভাবেই শাবিহাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অরু৷ ড্রয়িংরুমে টিফিনবাক্স হাতে দাঁড়িয়ে সুমিতা বেগম৷ অরু আসতেই হাতে ধরিয়ে দিলো বাক্স৷ সেও তন্ময়ের পছন্দের একটি ডিস বানিয়ে দিয়েছে৷ মোস্তফা সাহেব কিছুক্ষণ পড় বেরিয়ে এলেন৷ হাতের প্যাকেট খানা অরুর হাতে দিলেন৷ তিনি এনেছেন মোল্লা হোটেলের কাকড়া ভাজা৷ এখানকার কাকড়া তন্ময় খুব পছন্দ করে৷ তারপর শাবিহার দিক তাকিয়ে শুধালেন,
— তুমি যাবে?
— না মানে বাবা…
— গেলে যাও৷ দেখে আসো!
তারপর তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ শাবিহা খানিক হাসলো৷ বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো৷ মোস্তফা সাহেবের কড়া আদেশ ছিলো, কেউ যেনো ও-বাড়িটায় না যায়৷ কারণ আছে অবশ্য৷ তিনি ভেবেছেন হয়তো কারো দেখা না পেলে স্ত্রী- সন্তান বেশিদিন আলাদা থাকতে পারবে না৷ তাদের ছাড়া ওদের মন টিকবে না৷ ঠিক চলে আসবে! কিন্তু তিনি ভুল৷ দু’বছর তো চলে গেল৷ এই দ্বিধার দেয়াল টপকে তিনি গেলেন না, আর স্ত্রী সন্তানও এলো না৷
যাওয়ার সময় অরুদের সাথে রুবিও যোগ হয়েছে৷ তন্ময়দের ফ্ল্যাট এখান থেকে এখানেই৷ দশ মিনিটের রাস্তা৷ তাই গাড়ি নিল না৷ হেটে চলেছে৷ রাস্তার মোরে এজ ইউজুয়াল অয়ন দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে৷ অরুদের দেখে এবার এগিয়ে আসলো না৷ বরং দীপ্ত চেঁচিয়ে বললো,
— অয়ন ভাইয়া আমরা তন্ময় ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি৷ তাকে দেখতে৷
অয়ন খানিক হাসলো৷ অরু বললো,
— আমাদের সঙ্গে যাবে?
— যাওয়া যাবে বুঝি?
— অবশ্যই৷ এসে পড়ো!
— হাতে এতকিছু? সব তন্ময় ভাইয়ের জন্য বুঝি? আমারও তো জ্বর হলো, কই আমার জন্য তো কিছু আনলে না?
অরু একটা টিফিনবাক্স অয়নের দিক এগিয়ে দিলো,
— এই নাও তোমার জন্য৷
অয়ন নিলো৷ সাথে দীপ্তর হাতের টাও নিয়ে নিল৷ কিন্তু শাবিহার হাতেরটা নিল না৷ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে সে শাবিহার পাশে হাঁটছে৷ আওয়াজ নামিয়ে নম্র সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— রাতে জ্বর এসেছে?
–………..
— মাথা ব্যথা আছে এখনো?
— ……….
— আমার কিন্তু এখনো জ্বর শরীরে!
শাবিহা আচমকা মাথা তুলে তাকাল অয়নের দিক৷ অয়ন হেসে ফেললো৷ হেসে ভ্রু জোড়া উঁচু করে বললো,
— এইতো জ্বর সেড়ে গেল৷
শাবিহা চোখমুখ অন্ধকার করে অয়নের সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ৷

জবেদা বেগম স্যুপ বানাতে ব্যস্ত৷ রান্নার ফাঁকে ফাঁকে তিনি ছেলেকে দেখছেন৷ তন্ময় তখনো ঘুমিয়ে৷ রাতে সিকলীভ নিয়ে রেখেছে অফিস থেকে৷ তার উপর জ্বর কমেনি৷ ঠান্ডা লেগে নাক লাল হয়ে আছে৷ জবেদা বেগম বিছানার কোণায় বসলেন৷ ছেলের কপালের চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলেন।
— ওঠ আব্বা! একটু কিছু খেয়ে ঔষধ নিয়ে তারপর নাহয় শুয়ে থাক৷
তন্ময় নেড়েচেড়ে উঠলো৷ সেসময় ক্রমাগত কলিং বেল কেউ টিপে চলেছে৷ জবেদা বেগম ভড়কে গেলেন৷ আসছি, আসছি বলে তিনি দৌড়ে ছুটলেন দরজা খুলতে৷ চোখের সামনে শাবিহা দাঁড়িয়ে৷ তিনি নিজের চোখকে যেমন বিশ্বাস করতে পারছেন না৷ অবাক চোখে তাকিয়ে৷ শাবিহা এগিয়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরলো৷ হুশ এলো জবেদা বেগমের৷ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন৷ অরু তাদের পাশ দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে৷ তার দাঁড়িয়ে থাকার সময় নেই৷ দীপ্ত এবং রুবিও তাই করলো৷ শুধু অয়ন দাঁড়িয়ে মা-মেয়ের কান্না দেখছে৷ একসময় কাঁদতে কাঁদতে জবেদা বেগমের চোখ গেল অয়নের উপর৷ তাকে দেখেই কান্না কোনোরকমে বন্ধ করলেন৷ লজ্জিত ভঙ্গিতে মেয়েকে ছেড়ে অয়নের মাথায় হাত রাখলেন৷ অয়ন সালাম জানাতেই, তিনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
— ভেতরে আসো৷ গতকাল তন্ময়ের বাইক বুঝি তুমি রেখে গিয়েছিলে?
— জি!
— এভাবে কেউ রাখে? কই আমার সাথে দেখা অবদি করলে না৷
— রাত হয়ে গিয়েছিল ভীষণ৷
— হ্যাঁ সেটাও ঠিক৷ এখন এসে ভালো করেছ৷ দুপুরে খেয়েই যাবে বলে দিলাম৷
অয়ন হাসলো৷ আঁড়চোখে দেখল শাবিহা বাম পাশের একটি রুমে যাচ্ছে৷ সেখানে অরু, দীপ্ত রুবিও ঢুকেছে৷ নিশ্চয়ই তন্ময়ের রুম সেটা৷ অয়ন সেদিকেই পা বাড়াল৷ শাবিহা তন্ময়ের পাশে বসেছে৷ রুবি চেয়ার টেনে বসেছে৷ দীপ্ত বিছানার ওপর বসেছে৷ আর অরু তন্ময়ের পড়ার টেবিল ঘাটাঘাটি করতে ব্যস্ত৷ হাতিয়ে খুঁজে বের করেছে তন্ময়ের ডায়েরি৷ বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকা তন্ময় হালকা চোখ খুলে আগে অরুকে ধমকে উঠলো,
— আমার টেবিল থেকে দূরে যা!
অরু কেবলই ডায়রিটা হাতে নিয়েছিলো৷ তন্ময়ের হুংকারে সেটা ফেলে এক লাফে দরজার সামনে চলে এলো৷ শাবিহা হেসে প্রশ্ন করলো,
— এখন একটু ভালো লাগছে ভাইয়া?
— এটাকে সাথে এনেছিস কেন? ওকে দেখেই আমার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে৷
অরু ভীষণ কষ্ট পেল৷ অভিমানী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে গেল৷ শাবিহা পিছু ডাকল,
— অরু! উফ ভাইয়া৷ এভাবে কেউ…
তার বলার পূর্বেই অরু মাথাটা ঢুকিয়ে তন্ময়কে ভেঙিয়ে চলে গেল৷ শাবিহা গলায় থাকা কথাগুলো হজম করে ফেললো৷ কার সাপোর্ট টানতে নিয়েছিল সে? তন্ময়ের গম্ভীরমুখের ঠোঁটের কোণে স্মিথ হাসি দেখা গেল৷ দীপ্ত বললো,
— আমি মাথা টিপে দেই?
— উঁহু৷
তন্ময় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। ফ্লোরে পড়ে থাকা ডায়েরি উঠিয়ে সেল্ফের ভেতরে ঢুকিয়ে রাখল৷ বললো,
— ফ্রেশ হয়ে আসি৷ বোস তোরা!
— মায়ের কাছে যাই৷ তুমি এসে দেখ তোমার জন্য কতকিছু পাঠিয়েছে চাচীরা৷
— আসছি!
শাবিহার পেছন পেছন অয়নও ড্রয়িংরুমে চলে এসেছে৷ অরু তখন টিভি দেখতে ব্যস্ত৷ অয়ন ঠিক তার পাশেই বসলো৷ জবেদা বেগম রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন৷ ফ্রিজ খুলতেই তার চোখমুখ অন্ধকার৷ গরুর গোস্তো নেই৷ অনেক সবজিও শেষ৷
কী রান্না করবেন? ছেলেটাকে বাজারে পাঠাবেন তারও উপায় নেই৷ অসুস্থ শরীর নিয়ে কী বাজারে যাওয়া সম্ভব? শাবিহা হুট করে মায়ের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে৷ ফ্রিজে চোখ বুলিয়ে বললো,
— কি আনতে হবে? আমায় বলো এনে দিচ্ছি৷
— পারবি?
— পারবো না কেন? তুমি লিস্ট করে দাও৷ যাবো আর আসবো৷
— একা যাস না!
অয়ন মন দিয়ে টিভি দেখছিল না! তাই জয়া বেগমের কথাগুলো শুনে নিয়েছে৷ সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
— আমি যাই?
জবেদা বেগম হেসে বললেন,
— অয়ন যাবে বলছে৷ শাবিহা ওকে সাথে নিয়ে যা৷
শাবিহার চোখমুখে সংকোচ দেখা যাচ্ছে৷ সে চাইছে না অয়নের সাথে যেতে৷ মোট কথা সে চাচ্ছে না অয়নের আশেপাশে থাকতে। কিন্তু ভাগ্য ঘুরেফিরে তাকে এমন পরিস্থিতিতে কেন ফেলছে? শাবিহার এসব চিন্তাভাবনা নিতে আর ভালো লাগছেনা৷
———
অরু ছাঁদে এসেছে৷ ছাঁদে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে৷ ছেলেটাকে মুহুর্তেই চিনে ফেললো সে৷ এই ছেলেটাই তো ছিলো সুমনার সাথে গতকাল৷ ছেলেটার নাম নিলয়! নিলয় আর সে একই ক্লাসের ৷নিলয়কে দেখেই তো অয়ন বলেছিল, চরিত্র ভালো না৷ অরু আলগোছে চলে যেতে চাচ্ছিল৷ অথচ তাকে দেখে ফেলে নিলয় এগিয়ে আসলো,
— আরে অরু যে৷ কী অবস্থা?
— ভালো৷ আজ কলেজ যাও নাই?
— না! ভাই বৃষ্টিতে ভিজে জ্বরে কাত আমি৷
অরু মনে মনে বকল৷ শালা সারারাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট টানলে জ্বর তো বাধবেই৷ মুখে বললো,
— ওহ্!
নিলয় কথায় কথায় অরুর খুব কাছে চলে আসার চেষ্টা করছে৷ অপ্রস্তুত অরু পিছিয়ে গেল কিছুটা৷ তন্ময় তাওয়াল হাতে মাত্রই ছাদে উঠেছে৷ তাকে দেখে নিলয় সরে গেল৷ হাসার চেষ্টা করে কিছু বলতে নিচ্ছিল৷ তার পূর্বেই আচমকা তন্ময় তার কলার চেপে ধরলো৷ লম্বাচওড়া, সুঠাম দেহের তন্ময়ের সামনে নিলয় ছোট মাছ যেমন!
— আশেপাশে যেনো না দেখি ওর, মনে থাকবে?
নিলয় মাথা দোলাল৷
— জি ভাই!
— বলছি না ওয়ার্নিং দিচ্ছি! যা ভাগ!
নিলয় যেতে নিয়ে অরুকে ঘুরিয়ে দেখে নিল৷ অরু তখন তন্ময়কে দেখতে ব্যস্ত৷ গোসল সেড়ে এসেছে৷ চুল ভেজা-ভেজা৷হাফ প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে সে৷ হাতে তাওয়াল, অন্যহাতে ফোন৷ অরুর বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হয়েছে ৷ তন্ময় ঘুরে দাঁড়ালো তার দিক৷
— এই ছেলের থেকে একশো হাত দূরে থাকবি৷ আর এখানে আসলে ছাদে উঠবি না৷ এখন নিচে নাম।
অরু বললো,
— ছেলেটা লুইচ্চা তাই না? আমি জানি৷ মেয়েদের সাথে খারাপ কাজ করে তার ভিডিও করে৷ ক্যারেক্টরল্যাস৷
তন্ময় আচমকা অরুর কান টেনে ধরলো৷
— এতকিছু কীভাবে শিখছিস?
অরু ভয়ে রয়েসয়ে বললো,
— মানুষজন থেকে৷
— লুইচ্চা হু?
— আপনারে বলি নাই ত৷ ওই নিলয়রে…
তন্ময়ের শান্ত মস্তিষ্ক অশান্ত হয়ে গেল মুহুর্তেই৷ অরুকে রেখে হুড়মুড়িয়ে নেমে গেল৷ অরুও তার পিছু দৌড়ে চলেছে আর বলছে,
— আপনারে বলি নাই তো! আপনি কী ভাবছেন আপনারে বল…
কথাগুলোর মাঝখানে তন্ময় থেমে গেল৷ সিঁড়িতে দাঁড়ানো অবস্থায় ঘুরে অরুকে সিঁড়ির রেলিঙে আটকে ধরলো৷ তার সুঠাম হাত দুটো অরুর দু’পাশে রয়েছে৷ ঝুকে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অরুর চোখাচোখি হলো৷ ধীর স্বরে বললো,
— আমাকে যেদিন বলবি, সেদিন তোকে লুইচ্চামির এ বি সি ডি শিখিয়ে দেব৷
পরপর সে চলে গেল৷ অরু পাথরের ন্যায়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ কথাগুলো তার মস্তিষ্ক এখনো বুঝে উঠতে পারেনি৷ বুঝতে পেরে আর হজম করতে পারছেনা৷ সে এমন কথা আসলেই প্রত্যাশা করেনি৷

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here