প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -০৬+৭

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৬
_________________________

শাবিহার অন্ধকার চোখমুখ দেখে অয়ন বলল,
— বাইক নিয়ে আসি? পাঁচ মিনিট লাগবে৷
শাবিহা কাঠকাঠ গলায় জবাব দিলো৷
— না!
— তাহলে রিক্সা ডাকি?
এবার শাবিহা জবাব দিলো না৷ জবাব না পাওয়াকে হ্যাঁ ধরে নিল অয়ন৷ একাই মোরের দিক রওনা হলো৷ রিক্সা নিয়ে তাতে চড়ে বসলো৷ রিক্সা এসে থেমেছে শাবিহার সামনে৷ শাবিহা কিছুক্ষণ অয়নের পাশের একটুখানি যায়গার দিক
চেয়ে রইলো৷ এতটুকু যায়গায় কী বসতে পারবে? অতটুকু যায়গায় বসলে লেপ্টে থাকতে হবে অয়নের সাথে৷ আগের দিনগুলো হলে সমস্যা হতো না৷ ছোট ছেলে ভেবে অগ্রাহ্য করতো বিষয়টি৷ কিন্তু এখন তার আসলেই বেশ অদ্ভুত লাগতে শুরু করেছে৷ চোখমুখ গম্ভীর করে উঠে বসলো৷ সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করলো অয়নের শরীরের স্পর্শ৷ রিক্সা চলতে শুরু করেছে৷ শাবিহা খেয়াল করলো তার পেছনের দিকে অয়ন হাত দিয়ে রেখেছে৷ হাতটা তার শরীরে স্পর্শ করছেনা তবে মনে হচ্ছে সে অয়নের বাহুডোরে সীমাবদ্ধ৷ এভাবে প্রেমিক-প্রেমিকা রিক্সায় চড়ে৷ তারা কি প্রেমিক প্রেমিকা নাকি? শাবিহা বলল,
— হাত সরাও৷
— স্পর্শ লাগছে?
— লাগবেনা তার গ্যারান্টি কী?
— গ্যারান্টি দিচ্ছি না৷ তবে রিক্সা ধরে না রাখলে আমি পড়ে যাবো৷ এতটুকু যায়গায় বসা যায়
নাকি?
— এই ছেলে তুমি তো পুরো রিক্সা জুড়ে বসেছ!
এভাবে চেগিয়ে বসে? আমাকে দেখ আর তোমাকে দেখ!
— আমি কী মেয়ে মানুষ যে এভাবে বসব? চিমিয়ে বসবার অভ্যাস নেই আমার৷
— তাহলে আমি আরেকটা রিক্সা নিব৷
অয়ন চুপ মেরে গেল৷ মেয়ে মানুষের সাথে তর্কে পেরে উঠা অসম্ভব৷ সে আরাম আয়াসে সেভাবেই বসে থাকলো৷ রিক্সা উঁচু নিচু যায়গায় গেলে দুজনের শরীরে হালকা স্পর্শ করছে৷ শাবিহার হৃদয় কেঁপে উঠছে ক্ষনে ক্ষনে৷ এবং এই হৃদয় কাঁপা নিয়ে সে নিজেই নিজের কাছে বেশ লজ্জিত৷ বারবার মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে তার পাশের ছেলেটি একটা বাচ্চা৷ অথচ মন মস্তিষ্কের কথা শুনছেই না৷ দোটানায় ভুগতে থাকা শাবিহার দিক তাকাল অয়ন৷ হুট করে শাবিহার চোখের সামনে পড়া চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল৷ শাবিহার গলা শুকিয়ে কাঠকাঠ৷ অপ্রস্তুত গলায় ধমকে উঠলো,
— অয়ন!
— ওহ্৷ মিস্টেক!
অয়ন হাসিহাসি ঠোঁটে তাকিয়ে ৷ শাবিহার গোলাপি ঠোঁট জোড়ায় চোখ পড়তেই হুট করে বললো,
— সিগারেট খেয়েছেন কখনো শাবিহা?
— না৷
— ইচ্ছে আছে খাওয়ার?
— ছি!
— আমার একটা সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে৷
খাব?
— রিক্সা থেকে নেমে যা ইচ্ছে করো৷
অয়ন একটা সিগারেট বের করে হাতে নিয়ে রাখল৷ তার ইচ্ছে করছে এটা জ্বালিয়ে ঠোঁটে ধরতে৷ কিন্তু নিজেকে সংযত করল৷ সিগারেট আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে নাড়িয়ে বলল,
— আপনার সাথে থাকলে আমার মাথা ঠিক থাকেনা৷ মাথা ঠিক করতে সিগারেটের প্রয়োজন।
— তোমাকে থাকতে বলেছে কে!
— আপনি! এইতো এভাবে তাকালে না থেকে পারা যায়?
উপরে বিরক্ত প্রকাশ করা শাবিহার হৃদয় তোলপাড় খেলাতে মেতে৷ হঠাৎ সামনে থেকে মেয়েলী কন্ঠের ডাক ভেসে আসলো৷ অয়নের সাথে শাবিহাও তাকাল৷ একটি সুন্দরী মেয়ে দাঁড়িয়ে সামনে৷ অয়নের সমবয়সী হবে৷ হাত তুলে অয়নকে ডাকছে৷ অয়ন প্রশ্ন করলো,
— কী হয়েছে লামিয়া?
— জরুরি দরকার৷ তোমার ফোন কই? আমি তোমাদের বাসার সামনে যেতে নিচ্ছিলাম৷
— সাইলেন্ট৷ এক্ষুনি দরকার?
— প্লিজ৷ খুব দরকার…
অয়ন শাবিহার দিক তাকাল৷ শাবিহার চোখমুখ শক্ত ৷ সে অন্যপাশে ফিরে বললো,
— যাও৷ আমি একাই যেতে পারব৷
অয়ন নেমে গেল৷ মানিব্যাগ বের করে রিকসাওয়ালাকে ভাড়া দিয়ে বললো,
— তিন রাস্তার মোরে গরুর গোস্তোর দোকানের সামনে থামাবেন৷
তারপর ঘুরে শাবিহাকে বলল,
— আমি আসছি পাঁচ মিনিটের মধ্যে৷
— প্রয়োজন নেই৷ আমি একাই পারবো৷ চলুন ভাইয়া..
রিক্সা চলছে৷ আঁড়চোখে শাবিহা দেখল অয়নের সামনে এসে দাঁড়ানো মেয়েটিকে৷ দুজনকে একসঙ্গে মানাচ্ছে৷ সমবয়সী তারা মানাবেই তো৷ শাবিহা নজর ফিরিয়ে সামনে তাকাল৷ তার বুকের ভেতর হাহাকার করছে৷ অদ্ভুত এক খারাপলাগা গ্রাস করছে তাকে৷ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে অনবরত৷ রিক্সা থেমেছে গোস্তোর দোকানের সামনে৷ রিক্সা থেকে নেমে শাবিহা আশেপাশে তাকাল৷ যেমন সে কারো প্রত্যাশা করছে৷ দোকানের সামনে লোকজন নেই তেমন৷ সময় নিয়ে দুই কেজি গরুর গোস্তো নিয়েছে৷ পাশের মুরগির দোকান থেকে দুটো দেশি মুরগী নিয়েছে৷ ব্যাগ দুটো নিয়ে হাঁটা দিবে তখনই তার সামনে রিক্সা এসে থেমেছে৷ অয়ন ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলল,
— উঠে আসুন৷
শাবিহা ঠাঁই দাঁড়িয়ে৷ রিক্সায় না চড়ে অন্যদিকে হাঁটা দিল৷ অয়ন উপায় না পেয়ে নেমে গেল৷ রিক্সা ভাড়া দিয়ে দৌড় লাগালো শাবিহার পেছনে৷ পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো৷ সামনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি কাচা বাজার আছে৷ হয়তো শাবিহা সেখানেই যাচ্ছে৷ পাশাপাশি হাঁটতে নিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে অয়ন থেকে দূরে দূরে রাখার চেষ্টা করছে৷ অয়ন শাবিহার মন খারাপের বিষয়টি ধরতে পারেনি এখনো৷ সে আনমনে শাবিহাকে স্পেস দিয়েছে৷ নিজেকে সামলে রেখে শাবিহার আর তার মধ্যে যায়গা রেখে হাঁটছে৷ সেধে কোনো কথা সেও বলছে না৷ বয়স অল্প হলেও অয়ন বেশ লম্বাচওড়া৷ পাঁচ ফিট চার ইঞ্চি শাবিহা অয়নের বুক পর্যন্ত পড়ছে৷ তাকাতে নিলে মাথা উঁচু করতে হয় বিদায় তাকানোর সাহস পায়না শাবিহা৷ আঁড়চোখে দেখল অয়ন তার বাম পাশে চলে এসেছে৷ তার এ’পাশ দিয়ে মানুষজন যাচ্ছিলো হয়তো তাই! অয়ন বললো,
— মেয়েটি আমার ফ্রেন্ডের গার্লফ্রেন্ড৷ সৌভিক কল ধরছে না, তাই ডেকেছিল আমাকে৷
— আমাকে বলছ কেন!
— আমার মনে হয় আপনি কষ্ট পেয়েছেন মেয়েটিকে আমার পাশে দেখে৷
শাবিহার পা’জোড়া থেমে গেল৷ রেগে তাকাল অয়নের দিক৷ বলল,
— মানে বিহীন কথাবার্তা বলবে না একদম৷
— আমি বলেছি আমার মনে হয়। শিয়রিটি দেয়নি তো৷
অয়ন দুষ্টু হেসে পুনরায় বলল,
— ওর আর ইউ রিয়েলি বোদার্ড বাই হার?
— তুমি এসব আজগুবি কথা বলা বন্ধ করবে?
অয়ন হেসে চুপ রইলো৷ তারা একে একে সবকিছু কিনে ফেলেছে৷ সব বাজার-সদাই গুলো অয়ন একাই হাতে নিয়েছে৷ শাবিহার দুহাত খালি৷ এদিকে অয়নের দু’হাতে জিনিসপত্র থাকায় ঘাড়ের পাশটা চুলকাতে পারছেনা৷ কপালের চুলগুলোর কারণেও সুড়সুড়ি লাগছে৷ তাই শাবিহার সামনে ঘাড় নামিয়ে বলল,
— এখানটায় চুলকে দিন তো৷
শাবিহা বিরক্ত সুরে বলল,
— আমার হাতে দাও৷ তারপর নিজেরটা নিজে করো৷
— অনেক হেভি৷ পারবেন না নিতে৷ আপনি বরং আমাকে একটু চুলকে দিয়ে সাহায্য করুন৷
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে শাবিহা অয়নের ঘাড়ের পাশে হাত ছোঁয়াল৷ তার ছুঁয়ে দিতেই অয়ন শব্দ করে ‘ ইশ ‘ বলে উঠলো৷
— চুলকে দিতে বলেছি ছুঁয়ে দিতে না৷ এভাবে ছুঁলে আমার কিছু-মিছু হয়৷
— আশ্চর্য! তুমি চুলকে দেবার সময় কোথায়
দিলে? অয়ন একদম ফাতরামি করবেনা৷
অয়ন শব্দ করে হেসে বললো,
— আজ এতো চুলকাচ্ছে কেন!
বলেই উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো শাবিহার অন্ধকার চোখমুখ দেখে৷ তারপর রিক্সা ডেকে দুজন উঠে বসলো৷ এতসব বাজার-সদাই নিয়ে বসবার কারণে দুজনের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল যেমন৷ শাবিহা এবার দমবন্ধ হয়ে মারা যাবা নির্ঘাত৷

অরু একটি বাচাল এবং চঞ্চল স্বভাবের মেয়ে৷ কোনো না কোনো গন্ডগোল তার দ্বারা হতেই থাকে৷ সেই গন্ডগোল পাকানো মেয়ে যখন খামোশ হয়ে বসে থাকে, সেটা আসলেই ভয়ংকর দেখতে লাগে৷যেমন দীপ্ত কয়েকবার অরুর কপালে হাত ছুঁয়েছে৷ না জ্বর নেই৷ তাহলে? অরুকে সম্পুর্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে চলে গেল৷ পরপরই এসেছে জবেদা বেগম৷ নিজের হাতে বানানো রসগোল্লা বাটিতে করে এনেছেন৷ অরুর হাতে দিয়ে বললেন,
— কী হয়েছে? এমন হয়ে আছিস কেন?
— কিছু না৷
— খেয়ে বল কেমন হয়েছে!
রসগোল্লা খেয়ে অরুর বিষন্ন মন ফুরফুরে হয়ে গেল৷ সে মুখে চারপাঁচটা ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ বাটি হাতে জবেদা বেগমের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে বলল,
— আমি বাড়িতে গিয়েও খেতে চাই৷ প্লিজ আমাকে বাড়িতে নেওয়ার জন্য দিবে?
— আচ্ছা৷ তাহলে তুই আমার একটা কাজ করে দে৷
— কী কাজ?
— তন্ময়ের বারান্দায় ফুলের টব গুলোতে একটু পানি ছিটিয়ে দে ত৷ আজ তন্ময়ের চিন্তায় সবকিছু ভুলে বসেছি৷
অরু উড়ুউড়ু মনে এগিয়ে গেল৷ তন্ময়কে রুমে না দেখে তার মন আরও ফুরফুরে হয়েছে৷ বাথরুম থেকে পানি নিয়ে বারান্দায় বসলো ফুলের সামনে৷ রোদের তাপমাত্রা চমৎকার। ফুলগুলো উজ্জ্বলতায় ঘেরা রোদের আলোয়৷ অরু মাথাটা নুয়ে কিছুক্ষণ সুবাস নিলো৷ ফুলের সুবাস তার ভীষণ পছন্দের৷ এতটাই পছন্দের যে সে দুনিয়া ভুলে যেতে প্রস্তুত৷ বারান্দায় দু’পা মেলে রোদে বসে ফুলের ঘ্রাণ নেয়া অরুকে সম্পুর্ন ভিন্ন লাগছে৷ স্নিগ্ধ এবং সুন্দর দেখাচ্ছে৷ অরু মিনমিন সুরে গান গাইতে নিয়ে পানি ছেটাতে শুরু করেছে৷ পানি ছিটানো শেষ করে উঠে দাঁড়ালো৷ চলে যেতে নিয়ে আবারো ফিরে এলো৷ এই ফুলের টবটা ঠিক বামপাশে থাকলে বেশি সুন্দর দেখাবে৷ ভেবে সে সেটা দু’হাতে তুলে নিলো৷ আবারো ফুলগুলোর গন্ধ শুকতে গিয়ে হাচি দিয়ে উঠলো৷ সাবধান, সাবধান করে সেটা রেখে ঘুরতেই দেখল তন্ময় দাঁড়িয়ে৷ অরুর ভীষণ লজ্জা লাগছে৷ চোখেচোখ রাখতেও কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে৷ বুকের ভেতর ধুকপুক করছে৷ তন্ময় হাতের ডকুমেন্টস গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে৷ তার ভাব এমন যেন সে অরুকে দেখেনি৷ সেই সুযোগে অরু আলগোছে চলে এল৷ জবেদা বেগম তখন তন্ময়ের শার্ট এবং প্যান্ট ধুয়ে দিয়েছেন৷ অরু সেগুলো তার হাত থেকে নিয়ে নিল৷ নরম হাতে জবেদা বেগমের কোমর ডলতে নিয়ে বলল,
— কি দরকার এতসব একা করার৷
— কই এতসব? শাবিহা চলে আসবে বাজার নিয়ে৷ আমি রান্নাঘরে যাই৷ তুই বরং জামাকাপড় গুলো বারান্দায় শুকোতে দিয়ে আয়৷
অরু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে কাপড় হাতে আবারো তন্ময়ের রুমের দিক পা বাড়ালো৷ তন্ময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে৷ এখন তার হাতে বই৷ মনোযোগ দিয়ে পড়ছে৷ এভাবে হাতির মতো দাঁড়িয়ে থাকলে যাবে কীভাবে অরু? ডাকবে ভাবছে তখনই নাক পিটপিট করে উঠল৷ হাচির শব্দে তন্ময় চেপে দাঁড়ালো৷ অরু ভেতরে ঢুকে আঁড়চোখে তাকাল৷ তন্ময়ের নজর বইয়ে৷ মহারাজার নজর না পেয়ে সে হালকা অনুভব করে কাপড় শুকাতে দিতে ব্যস্ত হলো৷ শার্টটা অন্যমনস্ক ভাবে সামনেই ঝেড়ে উঠলো৷ মুহুর্তেই তন্ময়ের চোখমুখ, বই পানির ফোটায় ভিজে গেল৷ অরু বিষয়টি খেয়াল করেনি৷ শার্ট ঝেড়ে সেটা মেলে দিয়ে, প্যান্ট হাতে নিলো৷ সেটাও সমানে ঝেড়ে মেলে দিয়ে তন্ময়ের দিক তাকাল৷ তন্ময়ের মুখমণ্ডল পানিতে ভেজা৷ এখন এই শুকনো চেহারা রাতারাতি কীভাবে ভিজে গেল বুঝতে সময় লাগলো না অরুর৷ তন্ময়কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরুর বুকের ভেতর কামড় দিয়ে ধরলো৷ নিজেকে ইনোসেন্ট প্রমান করতে নিয়ে দু’পা পেছনে নিতেই পিছলে বেসামাল ভঙ্গিতে পড়ে যেতে নিচ্ছিলো, পড়ে যাবার পূর্বেই তন্ময়ের সুঠাম হাত অরুর কোমর আঁকড়ে ধরলো৷ বই ধরা হাতটি অরুর মাথা চেপে রেখেছে৷ কিন্তু শেষ রক্ষে হলোনা৷ পিচ্ছিল ফ্লোরে পা রেখে তন্ময় অরুকে নিয়েই শব্দ করে পড়লো৷ অরুর মাথা বেচেছে কিন্তু শরীর নয়৷ মনে হলো সে চ্যাপ্টা হয়ে গিয়েছে৷ কোমর ভেঙে গুড়িয়ে তছনছ৷ তন্ময় ঠিক তার উপর পড়েছে৷ সেভাবে থাকা অবস্থাই তন্ময় বলল,
— মসিবত না এনে কাজ করতে পারিস না? তোর দ্বারা একটা কাজও হয়না৷ কেন?
অরুর চোখের কোণে পানি জমেছে৷ সে অস্পষ্ট স্বরে আর্তনাদ করছে৷ আর্তনাদ গুলো এতটাই আবেদনময়ী শুনিয়েছে যে উপরে থাকা তন্ময় নিশ্চুপ হয়ে গেল৷ সম্পুর্ন বিষয়টি ভিন্ন ভাবে দেখে সে লাফিয়ে উঠলো৷ অরুকে সেখানে রেখেই দ্রুত পায়ে চলে গেল৷ অরু তখনো ভাঙা কোমর নিয়ে পড়ে আছে৷ খুব বিশ্রী ভাবে ব্যথা পেয়েছে৷ সাথে মনে হচ্ছে তার শরীরের উপর ম্যারাথন খেলা হয়েছে৷

দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষ হয়েছে৷ তন্ময়ের অফিস থেকে আর্জেন্ট কল এসেছে৷ তাই সে চলে গেল মাত্রই৷ অয়ন ও পরপরই বেরিয়ে পড়েছে৷ অন্যের বাড়ি বেশিক্ষণ থাকাটা ভালো দেখায় না৷ ও বাড়ির থেকে আসা সবগুলো টিফিনবাক্স ভর্তি খাবার দিয়েছেন জবেদা বেগম৷ একটা বাটিও খালি রাখেননি৷ সেগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে অরু, শাবিহা এবং দীপ্ত৷ বাড়িতে ঢুকতেই অরু দাঁড়িয়ে পড়লো৷ তার মামামামী এসেছে৷ সাথে সুমনা তো আছেই৷ হঠাৎ? অরুকে দেখে তার মামী চিন্তিত সুরে বলল,
— এখন শরীর ভালো তো? জ্বর কমেছে?
অরু মাথা দোলাল৷ সুমনা উঠে এসে তাদের হাতের টিফিনবাক্সে নজর বুলিয়ে বলল,
— তন্ময় ভাইদের ফ্ল্যাট থেকে এসেছ বুঝি শাবিহা আপু?
— হ্যাঁ৷
— ইশ দেরি করে ফেলেছি৷ আমি আরও আগে আসলে তোমাদের সাথে যেতে পারতাম৷
অরুর মামী ঠোঁটে মিষ্টি হাসি এঁকে বললেন,
— বলে রাখবি তোর শাবিহা আপুকে৷ এরপর যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে৷
শাবিহা ভদ্রতা বজায় রেখে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল৷ সুমিতা বেগম ভাইয়া ভাবীর আপ্যায়নে ব্যস্ত৷ আপাতত বাড়িতে মোস্তফা সাহেব বা আনোয়ার সাহেব কেউই নেই৷ অরু হাতের টিফিনবাক্স গুলো ডাইনিংয়ে রেখে ভাবলো উপরে চলে যাবে৷ কিন্তু যেতে পারলো না৷ তাকে ডেকে উঠলো তার মামী৷
— অরু সুমনাকে নিয়ে যা একটু সাথে৷ মেয়েটা আমার বোরিং ফিল করছে৷ আমরা একটু কথা বলি, ওরে সাথে নিয়ে যা৷
অরু বিরক্ত হলো বটে৷ আজ কী নতুন এসেছে? প্রায়সময় তো আসে৷ এসে নিজেই ঘুরঘুর করে৷ মায়ের চোখ দেখে অরু মাথা দুলিয়ে উপরে উঠছে৷ পেছন পেছন সুমনা এসেছে৷ তন্ময়ের রুমের সামনে থেমে প্রশ্ন করলো,
— তন্ময় ভাইয়ার রুমের চাবি আছে?
— না!
— কার কাছে?
— বড় চাচ্চুর কাছে৷
— ইশ! থাকলে রুম দেখতে পারতাম৷
অরু কিছু বললো না৷ নিজের মতো রুমে ব্যস্ত হয়ে গেল৷ তার কোমর খানা তখনো ব্যথা হয়ে আছে৷ এমন দানব শরীরের লোক তার উপর পড়েছে, এটা কম কিছু? অরু ভেবেছিল সে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবে৷ যেভাবে শরীর অবস হয়ে গিয়েছিল ভাবতেই গলাটা শুকিয়ে কাঠকাঠ৷ কাপড়চোপড় পরিবর্তন করে টেবিলে বসলো৷ মারজিকে কল করে হোমওয়ার্ক গুলো জেনে নিবে৷ এমন সময় সুমনা বলল,
— কাল যাবি আমাদের সাথে?
— কোথায়?
— ঘুরতে৷ তুই তো একটা হ্যাবলা৷ জীবন কতো সুন্দর জানিস? আমরা কত এঞ্জয় করি তোর ধারণা আছে? একদিন আমাদের সাথে বেরিয়ে দেখিস!
— ওটাকে লাইফ এঞ্জয় বলেনা৷ সুন্দর জীবনকে গলা টিপে হত্যা করা বলে!
— তুই ব্যাকডেটেড থেকে যাবি৷ সে যাইহোক, তন্ময় ভাইয়ের নাম্বারটা দে তো৷
— নেই!
— কী নেই? কেন নেই?
— রিস্টার্ট মেরেছিলাম৷ সব গায়েব!
— ওহ্ আচ্ছা৷ শাবিহা আপুর থেকে নেই তাহলে!
— তন্ময় ভাইয়ের নাম্বার দিয়ে কি করবি? তুই না রিলেশনশিপে মুবিন স্যারের সাথে?
— এসব ফালতু কথাবার্তা কোথা থেকে শুনিস? এই তুই আবার এগুলো তন্ময় ভাইকে বলিস না তো? এগুলো বলে আমার উপর থেকে তার এট্রাকশন সরিয়ে ফেলতেছিস না ত?
অরু চোখমুখ ডলে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ বিছানায় চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়লো৷ কাঁথা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে বলল,
— আমি ঘুমাব।

চলবেপ্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৭
__________________________

শাহাজাহান বাড়ির ভেতরের পরিস্থিতি গুমোট এবং গম্ভীর৷ মোস্তফা সাহেব সোফায় বসে৷ আনোয়ার সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন৷ ওপর পাশের সোফায় ওহী সাহেব বসেছেন৷ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে সুমিতা বেগম৷ মুফতি বেগম ট্রে করে চা এনেছেন৷ মোস্তফা সাহেবের হাতে চায়ের কাপ দিয়ে তারপর আনোয়ার সাহেবকে দিলেন৷ শেষ কাপ ওহী সাহেবের হাতে দিয়ে পাশেই ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন৷ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শান্ত সুরে মোস্তফা সাহেব বললেন,
— অরু এখনো ছোট৷ মাত্র কলেজ উঠেছে৷ শাবিহা মাস্টার্স পড়ছে এখনো ওর বিয়ের কথা তুলছি না৷ সময় দিচ্ছি, দিব ভবিষ্যতে৷ এতো তাড়াহুড়োর কী প্রয়োজন আছে সুমিতা?
সুমিতা বেগম মাথা তুললেন না৷ নীচু স্বরে বললেন,
— ভাইয়া বলছিল শুধু ওদের আগধ করিয়ে রাখবে৷ অরু পড়াশোনা করবে সমস্যা নেই৷
আনোয়ার সাহেব রাগে থরথর করে কাঁপছেন৷ স্ত্রীকে কিছু বলবেন সেসময় মোস্তফা সাহেব তাকে চোখ রাঙালেন৷ তারপর ঠোঁটে হাসি স্মিথ হাসি ঝুলিয়ে বললেন,
— অরু আমারও মেয়ে৷ শাবিহাকে যতটুকু ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি সমান ভালোবাসা দিয়ে ওকেও করেছি৷ শাবিহার জন্য যতটা চিন্তা করি ওকে নিয়েও ততটাই করি৷
আনোয়ার সাহেবের কন্ঠে অসহায়ত্ব বিদ্যমান,
— ভাইয়া আপনি…
— আমাকে আমার কথা শেষ করতে দাও৷ নাকি আমার সিদ্ধান্তের প্রয়োজন নেই?
আনোয়ার সাহেব মন খারাপ করে ভেজা বিড়ালের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন৷ আঁড়চোখে বড়ো ভাইয়ের গম্ভীরমুখ খানা দেখলেন৷ আনোয়ার সাহেবকে খামোশ করে মোস্তফা সাহেব আবারো বলতে শুরু করলেন,
— অরুর বয়স নাহলে সাইডে রাখলাম আপাতত৷ তোমার ভাইয়ের ছেলের কথা বলি। তাদের বাড়ির ছেলে তো ভালো না৷ নেশাদ্রব্য পান করে৷ মেয়েদের ত্যক্তবিরক্ত করে৷ রাতবিরেত নাইট ক্লাব জয়েন করে৷ প্রায়শই বাড়ি ফিরে না৷ ভালো ব্যবহার জানেনা৷ তেমন শিক্ষিতও না৷ এমন একটা ছেলে আমার মেয়ের দু’হাত দূরে থাকবার ও যোগ্যতা রাখেনা৷
সুমিতা বেগম নিশ্চুপ৷ ওহী সাহেবের চা প্রায় শেষের পথে৷ তিনি কাপে লাস্ট চুমুক দিয়ে খালি কাপটি মুফতি বেগমের হাতে দিলেন৷ মোস্তফা সাহেবের দিক তাকিয়ে বললেন,
— ভাই আমার মনে এইসব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা না বলাই ভালো৷ আমি দুঃখিত তবে ওই বাড়ির কোনোকিছুই আমার পছন্দ না৷ তাদের ব্যবহার চলাফেরা সবকিছু কেমন বিরক্তিকর দেখায় আমার কাছে৷ ওটা অরুর জন্য ভালো পরিবার নয়৷ একদমই নয়৷ আমার সিদ্ধান্ত চাইলে না বলবো৷
তিনি উঠে চলে যেতেই মুফতি বেগম তার পিছু ছুটলেন৷ মোস্তফা সাহেব ধীরেসুস্থে সুমিতা বেগমকে বললেন,
— তোমার কাছে কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তোমার মেয়ে নাকি তোমার ভাই এবং ভাইয়ের পরিবার? সুমিতা!
তুমি তোমার ভাইদের আমার থেকে ভালো চেনো এবং জানো৷ তাও বলছি, তুমি বিশ্বাস করবে নাকি জানিনা৷ যদি তোমার আর আনোয়ারের মধ্যে কখনো ঝগড়াবিবাদ হয়৷ আর তুমি রাগ করে বাড়ি ছেড়ে তোমার ভাইয়ের বাসায় ওঠো, তারা তোমাকে একদিনও শান্তিতে থাকতে দিবেনা৷ তোমাকে ফেরত পাঠানোর জন্য উতলা হয়ে যাবে৷ তোমার সাথে কেমন ব্যবহার করবে তা তুমি ভালো জানো৷ তাহলে তেমন একটা পরিবারে তোমার আদরের একমাত্র মেয়েকে কীভাবে দিতে রাজি হলে?
সুমিতা বেগমের চোখে জল৷ গাল বেয়ে জল ফ্লোরে পড়ছে৷ তিনি মাথা উঁচু করে তাকানোর স্পর্ধা পাচ্ছেন না৷ মোস্তফা সাহেব পুনরায় বললেন,
— আমি ওই বাড়িতে মেয়ে দিতে ইচ্ছুক নই সুমিতা৷ তোমার ভাইয়ের পরিবার আমার মেয়েকে ডিজার্ভ করেনা৷ আমি এই বিষয়ে আর কিছুই শুনতে চাইনা৷ এবং আশা রাখবো এগুলো অরুর কানে যেন না যায়৷ ওর পড়াশোনার ডিস্টার্ব হবে৷ সামনে এক্সাম আছে ওকে কনসেনট্রেশান করতে দাও৷
মোস্তফা সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। বড়বড় পায়ের ধাপে নিজের রুমের দিক চললেন৷ সুমিতা বেগম নিশ্চুপ হয়ে কাঁদছেন৷ আনোয়ার সাহেব কিছুক্ষণ স্ত্রীর দিক তাকিয়ে রইলেন৷ মনে একরাশ রাগ ধামাচাপা দিয়ে তিনি মনকে শান্ত করলেন৷ সুমিতা বেগমের হাত ধরে নিজেদের রুমের দিক নিয়ে যাচ্ছেন৷ ভেতরে ঢুকে তিনি স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরলেন৷ মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— আমি কখনোই তোমাকে অবিশ্বাস করিনি৷ সর্বদা তোমার ইচ্ছে, চাওয়া-পাওয়াকে সম্মান করেছি, এবং তা পূরণও করেছি৷ আমি জানি এটা তোমার ইচ্ছে বা চাওয়া নয়৷ কিছু একটা হয়েছে তোমার সাথে বা হচ্ছে হয়তো৷ সেগুলো আমাকে না বললে আমি কীভাবে বুঝব? কীভাবে সাহায্য করবো তোমায়? আমি চাই তুমি নিজে সেধে আমাকে সবকিছু সত্য বলবে৷ আমি সত্যটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই সুমিতা৷
স্ত্রীকে একা রেখে আনোয়ার সাহেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন৷ তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন সুমিতা বেগম৷ অঝোরে কাঁদছেন তিনি৷
তার কান্না চার দেয়ালের মধ্যে সীমাবদ্ধ৷

ওহী সাহেব বিছানায় বসে শার্ট খুলছেন৷ শার্ট খুলে ছুড়ে মারলেন সোফায়৷ মুফতি বেগম সেটা তুলে ভাজ করছেন৷ আঁড়চোখে স্বামীর রাগী চেহারা দেখছেন৷ শার্টটা গুঁছিয়ে রেখে স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন৷ নরম কন্ঠে শুধালেন,
— তুমি রাগছ কেন?
— রাগবো না বলছ? ফাতরামি সব! কতটা নির্লজ্জ ওই পরিবার ভাবতে পারছ? এভাবেই সুমিতার নাম করে কতো ফায়দা নিচ্ছে আমাদের থেকে৷ সাহায্য নিতে নিতে ছোট ভাঙাচোরা বিজনেস উপরে উঠিয়েছে৷
— এখন নিশ্চয়ই আমাদের বাড়ির মেয়ে নিতে চাচ্ছে আরও ফায়দা লুটতে৷ তাদের কথাবার্তার ধরনে বোঝা গেল সুমনা মেয়েটাকে তন্ময়ের গলায় ঝুলাতে চায়৷
ওহী সাহেব রাগী সুরে হাসলেন,
— আমাদের পরিবারের খারাপ রুপ দেখেনি তাই এমন চিন্তাভাবনা করতে পারছে৷ সুমিতার মুখের দিক তাকিয়ে বারবার রেহাই দিচ্ছি৷ যেদিন সুমিতা এসে সবকিছু খুলে বলবে, সেদিন ওদের পুরো খান্দান সাগরে চুবাব৷
— আচ্ছা তুমি শান্ত হও! তন্ময়ের সাথে কথা
বলেছ? ওকে জানিয়েছ কোম্পানির সম্পর্কে? অবস্থা ভালো না যে৷
ওহী সাহেব চিন্তিত সুরে বললেন,
— না বলিনি৷ ভাই বলতে না করেছে৷
— তুমি বরং একবার তন্ময়ের সাথে কথা বলেই দেখ! ও এসব শুনে বাড়িতে না আসলেও কোম্পানির দায়ভার নিবে৷
— দেখি কী করা যায়৷ তুমি তো জানো, তন্ময়কে এসব বললে ভাই রেগে যাবেন।
— রাগলে রাগবে৷ ছেলে সামনে আসলে রাগ হাওয়ায় উড়ে যাবে দেখ৷। ওহী সাহেব হাসলেন৷ বালিশে মাথা গুঁজে দিলেন৷ মুফতি বেগম কয়েক মাসের আগের বিষয়টি তুললেন৷
— রুবির জন্য যেই প্রস্তাব এসেছিল সেটা নিয়ে কিছু ভাবলে? শুনেছি ছেলে ভালো৷ পরিবারের অবস্থাও ভালো৷ সবকিছুই..
ওহী সাহেব স্ত্রীকে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন,
— রুবি শাবিহার থেকে দু বছরের ছোট৷ যেহেতু শাবিহার বিয়ে নিয়ে এখনো কথাবার্তা হচ্ছেনা, তাই এখন রুবির বিয়ের বিষয় না তোলাই ভালো৷
মুফতি বেগম হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন৷
—–
সামনে অরুর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের ফাইনাল এক্সাম৷ নভেম্বরের পঁচিশ তারিখ থেকে শুরু৷ মাত্র ছয় দিন বাকি৷ কলেজের বেতন, পরিক্ষার ফি এবং যাবতীয় লেনদেন পরিশোধ করতে এবার শাবিহা যাবে৷ প্রত্যেকবার মোস্তফা সাহেব নিজে আসেন৷ তার আবার প্রিন্সিপালের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক৷ কিন্তু তিনি এবার ভীষণ ব্যস্ত। আসতে পারেননি৷ শাবিহার রিকশা মাত্রই থেমেছে ভার্সিটির সদরদরজার সামনে৷ সবুজ শার্ট-প্যান্ট পরে লাঠি হাতে দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে৷ রিকশাভাড়া দিয়ে শাবিহা ভেতরে ঢুকলো৷ প্রথমেই স্কুল৷ স্কুলের পাশে বড় গার্ডেন৷ তারপর আরেকটি বিশাল বড় দরজা সেটার পেছনে কলেজ সামনে ভার্সিটি৷ খোলামেলা জায়গার অভাব নেই চারপাশে৷ ঘাষের উপর শিক্ষার্থীরা বসে আলাপ-আলোচনায় ব্যস্ত৷ কাঁধ ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া শাবিহার পা জোড়া হুট করে থেমে গেল৷ সামনেই অয়ন দাঁড়িয়ে তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে৷ বাইকের সাথে ঠেলে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। হাতের কলম ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা বলছে৷ শাবিহার ভীষণ নার্ভাস লাগছে৷ এই নার্ভাসনেস একদম পারসোনাল৷ চোখমুখ শক্ত করে সে আবারো হাঁটতে শুরু করেছে৷ আশেপাশে কোথাও তাকাচ্ছে না৷ অয়নের সামনে দিয়ে যেতে নিতেই তার বুক ধুকপুক করতে শুরু করেছে৷ হুট করে শুনতে পেলো অয়নের গলা,
চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কী তাতে
রাগ করো না সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো৷
লজ্জায় শাবিহার কান গরম হয়ে উঠছে৷ মনেমনে বকল অয়নকে৷ ফাজিল ছেলে৷ বড়দের সম্মান করতে জানেনা৷ এদিকে অয়নের বন্ধুবান্ধব সিটি বাজিয়ে হাসছে৷ তবে অয়ন হাসছে না৷ কিন্তু তার ঠোঁট জুড়ে দুষ্টু হাসি৷ বন্ধুবান্ধবদ ফেলে দৌড়ে শাবিহার সামনে এসে দাঁড়ালো৷ শাবিহা তাকে ডিঙিয়ে যেতে চাচ্ছে আর অয়ন ঘুরেফিরে তার সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে৷ শাবিহা রেগে তাকাল,
— সমস্যা কী তোমার?
— সুন্দর লাগছে আপনাকে৷ চুলের ঘ্রাণটা মারাত্মক সুন্দর৷ কী শ্যাম্পু দিয়েছেন?
— অয়ন! রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াও৷
— আপনার রাগী চেহারা আরও আকর্ষণীয়
দেখতে৷
শাবিহা রেগেমেগে অন্যদিকে হাঁটা ধরলো৷ এবার আর রাস্তা আটকে দাঁড়ায়নি অয়ন৷ বরং পিছুপিছু হাঁটছে৷ শাবিহাকে প্রিন্সিপালের রুমে যেতে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ ঘুরেফিরে চলে এলো বন্ধুদের কাছে৷ বন্ধ সৌভিক বলল,
— শাবিহা আপুকে দেইখা মনেই হয়না সে মাস্টার্স পড়তেছে৷
অয়ন হেসে যাচ্ছে৷
–শালা মাইয়া পাস না খুঁইজা? তন্ময় ভাই জানলে তোর হাতপা কাইটা ফেলব৷
— বোনের জামাইয়ের হাতপা কাইটা ফেললে তার বোন কান্না করব ত৷
— জামাই? জাইগা জাইগা স্বপ্ন কম দেখ! আমি ভাবতেছি শাবিহা আপু তোরে এখনো জুতাপেটা করে নাই কেন?
— দুষ্টু সৌভিক কিছুই বুঝেনা৷ তোর শাবিহা আপুর ভালোবাসা আমি। ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ জুতাপেটা করে নাকি? চুমু খায়, আদর করে৷
সৌভিক হাসছে৷ অয়ন তখনো ভার্সিটির কাউন্টারের দিক তাকিয়ে৷ সৌভিক এবার সিরিয়াস ভাবে বলল,
— দোস্ত তুই ফাইসা যাইতেছছ! আমার মনে হয়না শাবিহা আপু পটব কখনো৷ সবদিক দিয়া পারফেক্ট তিনি৷ দেখতে সুন্দর উচ্চবিত্ত পরিবার থেইকা, পড়াশোনায় ফার্স্টক্লাস৷ ক্যারিয়ার ও গড়ে নিছে৷ বাবার থেকে শুনছি ভালো ভালো পরিবার থেইকা তার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ আসতেছে৷ বিয়েও হয়ে যেতে পারে৷ তুই পড়ে কিন্তু…
কথার মাঝপথে থামিয়ে দিলো অয়ন৷ চোখমুখে গম্ভীর ভাব৷ সৌভিকের চোখেচোখ রেখে বলল,
— ওর বিয়ে হইব৷ আর সেটা আমার সাথে৷ ওর পরিবার উচ্চবিত্ত আর আমার পরিবারও৷ ও পড়াশোনায় ফার্স্টক্লাস আর আমিও৷ ও ক্যারিয়ার গড়ছে আমিও গড়ব লাগলে। শুধু বয়সের গ্যাপ তো? আমি পুলিশ স্টেশন, কোর্ট, আদালত ঘুরে চার বছর বয়স বাড়াই নিব৷ ঠিকাছে না?
সৌভিক হেসে মাথা নাড়াল,
— মাম্মা তুই গেছোস৷ একদম গেছোস! প্রেমে পাগল হয়ে কবে যেন রাস্তায় ঘুরোছ৷ আমি মনপ্রাণ দিয়ে দোয়া করি, এই মাইয়া তোর কপালে পড়ুক৷ আমি আমার বন্ধুরে পাগল হইতে দেখতে পারমু না৷
অয়ন সৌভিকের কাঁধে হাত রেখে বলল,
— হইবো কী? শাবিহা তো আমার৷ শুধুমাত্র
অয়নের!
অয়নের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি ফিরে এসেছে৷ সামনে শাবিহা৷ এদিকটায় আসছে৷ অয়ন ঠোঁট কামড়ে শাবিহার দিক তাকিয়ে রইলো৷ শাবিহার নেওয়া একেকটা পায়ের ধাপ গুনছে যেমন৷ শাবিহা ভার্সিটি থেকে বেরি দীর্ঘশ্বাস ফেলল৷ রিকশা ডাকবে তখনই তার সামনে বাইক নিয়ে অয়ন এসেছে৷ শাবিহা দেখেও না দেখার ভান করে রিকশা ডেকে উঠে বসলো৷ অয়ন রিকশার সাথে যাওয়ার যথাসম্ভব চেষ্টা করছে৷ তবে হচ্ছে না৷ রিকশা যেই ধীরগতি অবলম্বন করে, এই গতিতে বাইক চালিয়ে মজা আছে নাকি?
—–
কিছুদিন ধরে ড়াশোনায় বিভোর অরু৷ গতকাল হায়ারম্যাথমেটিকসের এক্সাম গিয়েছে। তন্ময় যেহেতু তাকে শুধু ম্যাথম্যাটিকস করাতো, আর এখন ম্যাথম্যাটিকসের পরিক্ষা শেষ তাই আর পড়াশোনার ছুঁতো দিয়ে যেতেও পারছেনা তন্ময়দের বাসায়৷ আজ বন্ধ কাল আবার এক্সাম৷ কালকের এক্সামের জন্য শক্তপোক্ত প্রিপারেশন যে নিবে তাও পারছেনা৷ তন্ময়ের ভুত চেপেছে মাথায়৷ শুধু তন্ময়ের মুখমণ্ডল ভেসে উঠছে চোখের পাতায়৷ বই বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো৷ বিছানায় রাখা ফোন হাতে নিলো৷ দরকার ছাড়া কখনো তন্ময়কে কল করেনি৷ তন্ময়ও করেনি৷ ম্যাসেজ ও কখনো আদানপ্রদান হয়না প্রয়োজন ছাড়া৷ কিন্তু ইদানীং অরু চায় তন্ময় তাকে ম্যাসেজ করুক, কল করুক৷ কিন্তু লোকটা করেনা৷ অরু তন্ময়কে ম্যাসেজ গিফ পাঠাল ম্যাসেঞ্জারে৷ গিফ টি হলো একটা মেয়ে হাচি দিয়ে সর্দি দিয়ে চোখমুখ ভরিয়ে ফেলেছে৷ গিফ দিয়ে বিছানায় ফোন হাতে বসে রইলো৷ রাত বারোটা৷ এখন তন্ময়ের বাসায় থাকার কথা৷ রিপ্লাই কেন দিচ্ছে না? তন্ময়ের রিপ্লাই এলো না৷ এসেছে কল৷ অরু চমকে তাকিয়ে৷ ভয়ে ভয়ে কল রিসিভ করলো৷ মনকে প্রস্তুত করেছে বকা খাওয়ার জন্য৷ কিন্তু তন্ময় বকল না৷ গম্ভীর স্বরে বললো,
–কাল এক্সাম আছে না?
–আছে তো৷
— তাহলে তুই এখনো জেগে কেন?
–পড়ছিলাম৷
— সারাবছর কী করছিস?
— পড়েছি৷
— তাহলে আর পড়তে হবেনা৷ ঘুমাতে যা৷
–ঘুম আসছে না৷
— জোরপূর্বক ঘুমাবি৷
— জোরপূর্বক ঘুমানো যায়?
— যায়৷ যা চেষ্টা কর গিয়ে৷
অরু জবাব এবার নিশ্চুপ রইলো কিছুক্ষণ৷ বুকে হাত চেপে রাখল৷ বুকের ভেতরটা খুব জ্বালাতন করছে৷ শান্তি দিচ্ছে না একদম৷ হৃদয়টা কি লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে নাকি? অরু ধীর গলায় বলল,
— ঘুম আসছে না। কথা বলবেন আমার সাথে একটু?
— তোর সাথে কথা? ঠিকাছে বলবো৷ বড়ো হয়ে নে আগে তারপর৷
— আমিতো বড়৷ আমার অনেক বন্ধুদের বিয়েসাদী হয়ে গেছে৷ অনেকের তো বাচ্চা হয়ে গেছে৷
— এখন কী তুই বিয়ে করে ওদের মতো বাচ্চা নিতে চাস?
— না ছি ছি!
— তাহলে রাখ ফোন৷ যেদিন বিয়েশাদি করে বাচ্চা নিতে পারবি সেদিন কথা বলবি৷
কল কেটে গেল৷ অরু বোকার মতো ফোনের দিক তাকিয়ে৷ কথাটার আগামাথা বুঝল না অরু৷ কিছুক্ষণ ভাবলো তাও বুঝতে পারছেনা৷ অবশেষে আবারো ম্যাসেজ করলো তন্ময়কে,
— বুঝিনি৷ কথাটা আরেকবার বলবেন প্লিজ?
তন্ময়ের জবাব এলো সময় নিয়ে,
— আমার মাইর খাস না কতো মাস হচ্ছে যেন?
অরু একটা মন খারাপের একটা গিফ পাঠিয়ে অনলাইন থেকে চলে এলো৷ তন্ময় ঠিক কী বলেছিল সেটাই ভুলে গিয়েছে এখন! কী যেন বলেছিল লোকটা? ভাবতে ভাবতে টেবিল গুঁছিয়ে লাইট ওফ করলো৷ বালিশে মাথা দিতেই তার আবারো তন্ময়কে মনে পড়তে লাগলো৷ হুট করে চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেদিনের অপ্রস্তুত দৃশ্যটি৷ দৃশ্যটি ভাবতেই অরুর সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠলো৷ শক্ত করে চোখজোড়া বন্ধ করলো। মনেমনে নিজেকে নিজেই বকাঝকা করছে৷

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here