প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব -০৮+৯

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৮
________________________

সাতসকালে অরুর মেজাজ তুঙ্গে উঠে গিয়েছে৷ গতকাল পরিক্ষা শেষ হয়েছে৷ পরিক্ষার ছুতোয় মাস খানেক ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেনি৷ আজ একটু বেলা করে ঘুমাবে তাও পারছেনা৷ সুমিতা বেগম সাতসকালে রুমে এসে হাঙ্গামা করছে৷ আজ শুক্রবার৷ তাদের দাওয়াত পড়েছে৷ এলাকার সুনামধন্য খান বাড়ির বড় মেয়ের বিয়ে৷ বাড়ির বাচ্চাদের পরিক্ষা বলে হলুদ প্রোগ্রাম অ্যাটেন্ড করেনি৷ কিন্তু দাওয়াতে তো যেতে হবে? সুমিতা বেগম অরুর শরীরের কাঁথা টেনে নিলেন৷ ভাঁজ করতে করতে বললেন,
— তোর চাচ্চু বলে গেছে এখনই উঠতে৷ এগারোটার আগে সবাইকে তৈরি থাকতে হবে৷ দাওয়াতে যাবার পূর্বে খান বাড়ি যেতে হবে৷ সময় নেই হাতে৷
সুমিতা বেগমের কথা যেমন অরুর কান অবদি পৌঁছাচ্ছে না৷তার উঠার কোনো নামগন্ধ নেই৷ মরার মতো বিছানায় উবুড় হয়ে পড়ে৷ ঘর গোছাতে গোছাতে সুমিতা বেগম আনমনে বলে চলেছেন,
— দাওয়াতের ছুতায় ভাবী আর তন্ময়কে এক নজর দেখা যাবে৷ কত মাস হয়ে গেল ওদের দেখিনা৷
যেহেতু তন্ময় আলাদা দাওয়াত পেয়েছে৷ ইফরাদের সাথে ওর ভালো বন্ধুত্ব, ওকে তো দাওয়াতে আসতেই হবে৷ তন্ময় কী আর একা আসবে? ভাবীকেও সাথে নিয়ে আসবে৷ এই সুযোগে যেনো তাদের মানাতে পারি বাড়ি ফিরতে৷
হুট করে অরু ঘুম ছেড়ে উঠে বসলো৷ মায়ের দিক চমকে তাকিয়ে বলল,
— তন্ময় ভাই যাবে? না মানে বড়ো মা যাবে?
— যাবেনা আবার? বাধ্যতামূলক যেতে হবে৷
— আমাদের সাথে যাবে তো?
— বাড়ির ঝগড়াঝাটি বাড়িতেই সীমাবদ্ধ৷ তোর চাচ্চু তাদের আলাদা যেতে দিবে তোর মনে হয়?
— সেটাই তো৷
অরুর ঘুম আকাশপথে উড়ে গিয়েছে৷ খুশিতে চোখজোড়া জ্বলজ্বল করছে৷ বিছানা ছেড়ে দ্রুত পায়ে উঠে দাঁড়ালো৷ কোমর সমান চুলগুলো খোঁপা
করতে করতে ওয়াশরুম ছুটেছে৷ গোসল সেড়ে বেরিয়ে নিচে নামলো৷ কেউই নেই! সবাই নিজেদের রুমে তৈরি হতে ব্যস্ত হয়ত৷ অরু বাবামায়ের রুমে উঁকি দিল৷ বিছানার উপর সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির স্যাট৷ সাদা পরবে তার বাবা৷ তারপর অরু বড় চাচ্চুর রুমে উঁকি দিল৷ সেখানেও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির স্যাট গুঁছিয়ে রাখা৷ তারপর গেল ছোট চাচ্চুর রুমে৷ তার বিছানাও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবির স্যাট৷ অরু ডিসিশন নিল সে সাদা কিছু পরবে৷ সাদা গ্রাউন নাকি সাদা কামিজ? দোটানায় ভুগতে থাকা সে পাখির সামনে দাঁড়ালো৷
— পাখি আমাকে গ্রাউনে মানাবে নাকি কামিজে?
পাখি ঝিমাচ্ছে, জবাব নেই৷ অরু রেগে গেল৷ পাখির খাঁচা ঝাকিয়ে পাখিটাকে বিরক্ত করলো কিছু৷ তারপর বাড়ির আনাচে কানাচে ঘুরছে৷ ঘুরতে ঘুরতে এলো রুবির রুমে৷ রুবি বিছানায় কাপড়চোপড় মেলে রেখেছে৷ অরুকে দেখতেই টেনে নিয়ে আসলো,
— দেখ তো কোন কালারের কামিজ আমাকে বেশি মানাবে?
— সাদা!
— না না৷ সাদা গতকাল পরেছি৷ আবারো সাদা পরব না৷ ভাবছি লাল কামিজ পরব৷ তুই কি পরবি?
অরু মহানন্দে বলল,
— সাদা!
ঠিক অরু একটি সাদা কামিজ পরেছে৷ সবার আগে তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে৷ ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখছে৷ নাকটা পিটপিট করছে৷ দাওয়াত খেতে গিয়ে আবার হাঁচি চলে আসবে না তো? অরু ইদানীং হাঁচিকে খুব ভয় পায়৷ পাবে না? হাঁচি আসলে যদি সর্দি বেরিয়ে যায়? আর তখন যদি তন্ময় সামনে থাকে? অরু লজ্জায় এবার কেঁদেই ফেলবে। হাত ব্যাগে টিস্যু নিয়ে নিলো কিছু৷ পারফিউম স্প্রে করে বেরিয়ে পড়লো৷ আনোয়ার সাহেব সোফায় বসে আছেন৷ পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি৷ মোস্তফা সাহেব মোবাইলে কথা বলছেন৷ তিনিও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছেন এবং উপরে কোটি৷ অরুকে দেখে আনোয়ার সাহেব হাসতে লাগলেন,
— আমরা আজ ম্যাচিং?
— হু! কেমন লাগছে আমাকে বাবা?
আনোয়ার সাহেব ছোট্ট অরুর কপালে চুমু এঁকে বললেন,
— ভীষণ সুন্দর৷ মাশাআল্লাহ!
— তোমাকেও সুন্দর লাগছে বাবা৷
মোস্তফা সাহেব অরুকে তার দিক আসতে ইশারা করলেন৷ অরু চোখমুখে হাসি নিয়ে এগিয়ে এলো৷ মোস্তফা সাহেব বললেন,
— আর আমাকে? আমাকে কেমন লাগছে?
— চাচ্চু তোমাকে এতটাই সুদর্শন লাগছে যে, একটুখানি মেয়েরা তোমার পাগল হয়ে যাবে৷
অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন মোস্তফা সাহেব৷ ওহী সাহেব এসে পাশে বসেছেন মাত্র৷ তিনি তন্ময়কে কল করছেন৷ তন্ময় কল ধরতেই বললেন,
— কখন বেরোবি?
তন্ময় কিছু বলবে তার পূর্বেই মোস্তফা সাহেব পাশ থেকে বললেন,
— বাড়ি ছেড়েছে ভালো কথা৷ এখন মানুষের সামনে আমাকে হাসাহাসির পাত্র যেন না করে৷ গাড়ি পাঠাব সেটা করেই সবাই একসাথেই যাবে৷ আলাদা করে যাওয়া যেন না হয়!
স্পিকার লাউডে দেওয়া৷ মোস্তফা সাহেবের কথা শেষ হতেই, তন্ময়ের গম্ভীর স্বরের হাসি শোনা গেল৷ হাসতে হাসতে বলল,
— চাচ্চু!
— হু!
— তোমার ভাইয়ের মাথা গরম?
ওহী সাহেব বড় ভাইয়ের মুখের দিক তাকিয়ে চুপ রইলেন৷ ওপাশ থেকে তন্ময় পরপর কল কেটে দিয়েছে৷ যেহেতু তন্ময় না বলেনি তারমানে এক গাড়ি করেই যাবে সবাই৷ এবার মোস্তফা সাহেবের গম্ভীরমুখ নরম দেখাল৷ তিনি আঁড়চোখে ওহী সাহেবের দিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালেন৷
— আমাকে যেতে হবে এখনই৷ বাচ্চাদের নিয়ে সময়মত চলে আসবে৷
— জি ভাই৷
অরু শাবিহার সাথে বসেছে৷ এই গাড়িতেই তন্ময় উঠবে৷ ভাবতেই অরু উত্তেজিত হয়ে পড়ছে৷ মাস খানেক যাবত তন্ময়ের দেখা নেই৷ অরুর মন কেমন আনচান করছে লোকটাকে দেখার জন্য৷ তাদের গাড়ি মাত্র পৌঁছেছে তন্ময়দের ফ্ল্যাটের সামনে৷ অরু জানালার কাঁচ খুলে মাথা বের করে রেখেছে৷ ওইতো তন্ময় আর জয়া বেগম আসছেন৷ আশ্চর্যজনক ভাবে তন্ময়ও সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছে৷ এবং মোস্তফা সাহেবের মতো একই ডিজাইনের কোটি পরেছে উপরে৷ অরুর বুকের ভেতরটা কাঁপছে৷ শরীরে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল৷ ধ্যান মেরে তাকিয়ে রইলো৷ ছোট থেকেই অরু ভেবে এসেছে তন্ময় অসম্ভব সুন্দর দেখতে৷ সুন্দর সে সকলের কাছেই প্রিয় ছিলো সবসময়৷ যখন কাজিনদের আড্ডা বসত সবার নজর তন্ময়ের দিক থাকতো৷ এমনকি অরুরও৷ এদিকে অরুর তীক্ষ্ণ চাহনি তন্ময় দেখেও যেমন দেখল না৷ আকাশের পাশে এসে ড্রাইভিং সিটে বসলো৷ জয়া বেগম পেছনে অরু আর শাবিহার মধ্যে বসেছে৷ অরুর চোখজোড়া আঁড়চোখে তন্ময়ের দিক চলে যাচ্ছে বারবার৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সে জানালার বাইরে তাকাল৷ লোকটা এতো সুন্দর কেন? অরুর আনমনে মিনমিন করে বলল, ছেলেদের এতো সুন্দর হতে নেই৷ একদম নেই!
খান বাড়ির সামনে অলরেডি শাহজাহান বাড়ির দুটো গাড়ি পৌঁছেছে৷ রুবি, দীপ্ত, সুমিতা বেগম, মুফতি বেগম এখানো গাড়িতে বসে৷ তন্ময়দের গাড়ি পৌঁছাতে দেখে নেমে আসলেন। জয়া বেগমকে দেখে তাদের চোখজোড়া ভিজে উঠেছে৷ খান বাড়ির কর্তা এগিয়ে এসেছেন তাদের আপ্যায়নের জন্য৷ কর্তার সাথে মোস্তফা সাহেব দাঁড়িয়ে৷ তার সাথে আনোয়ার সাহেব, ওহী সাহেব ও উপস্থিত৷ তন্ময়ের পাশেই মোস্তফা সাহেব দাঁড়িয়েছেন৷ ছেলেকে দেখে স্ত্রীর দিক আঁড়চোখে তাকালেন৷ কিন্তু কিছুই বললেন না৷ জয়া বেগম মাথা নত করে রেখেছেন৷ সে ভুলেও আশেপাশে তাকাচ্ছেন না৷ স্বামীর দিক তো আরও আগে নয়৷ এতসব আলাপ-আলোচনা শোনার সময় অরুর নেই৷ সকলের আঁড়চোখে সে তন্ময়ের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে৷ উঁকিঝুঁকি মেরে কিছুক্ষণ পরপর তন্ময়ের মুখমণ্ডল দেখছে৷ সকলে যখন খান বাড়িতে ঢুকতে ব্যস্ত সেসময় তন্ময় হুট করে অরুর কান টেনে ধরলো৷ আচমকা টানে অরু আর্তনাদ করে উঠলো,
— আহ, আহ ছাড়ুন৷ কানে দুল পরেছি তো৷ ব্যথা পাই৷
— এমন ভারী কানের দুল পরার মানে কি? দেখে মনে হচ্ছে কান ছিড়ে পরে যাবে৷
— দেখতে এমনটা দেখায়, তবে ওত ভারী নয়৷ আপনি পরে দেখুন একদম ভারী না, খুব হালকা৷
তন্ময় এবার একটু শক্তি দিয়েই কান টেনে দিয়ে শুধালো,
— আমি পরব?
— না না আমিই পরব৷ ছাড়ুন, ছাড়ুন ব্যথা পাই৷ ভুল হয়ে গেছে আর বলব না৷
তন্ময় ছেড়ে দিলো৷ চেনপরিচিত মানুষদের ডাকে সেদিকে চলে গেছে৷ অরু তার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো৷ লাল কান ধরে মায়ের পেছন পেছন হাঁটছে৷ আঁড়চোখে আরেকবার তাকাল তন্ময়ের দিক৷ এবার আচমকা তন্ময় তাকিয়ে চোখ রাঙাতেই অরু নজর ফিরিয়ে ফেলল৷ যেভাবে তাকিয়েছে মনে হলো অরুকে আস্ত চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে৷
——
শাবিহা জানে এখানে অয়নকে দেখতে পাবে৷ খান বাড়ির সাথে অয়নের বাবার খুব ভালো বন্ধুত্ব৷ তাই যখন অয়নকে সোফায় বসে কথা বলতে দেখেছে, মোটেও অবাক হয়নি৷ অবাক হয়েছে অয়নের বিহেভিয়ারে৷ আজ যেমন অয়ন শাবিহাকে চেনেই না৷ ছেলেটা সিরিয়াস ভঙ্গিতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কথাবার্তায় ব্যস্ত৷ অবশ্য অয়নের এমন ব্যবহার অযৌক্তিক নয়৷ কিছুদিন আগে রাগের মাথায় শাবিহা অনেক কথা শুনিয়েছে অয়নকে৷
এতটাই শক্ত কথা বলেছে যে অয়ন এই কয়দিন যাবত তার সামনেই আসেনি৷ নিশ্চয়ই অয়ন বুঝতে পেরেছে শাবিহা আর তার কখনোই সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না৷ ভালোই হলো! শাবিহা নিরবে বুকের ভেতরের পিনপিনে ব্যথাটা অগ্রাহ্য করলো৷ মনেমনে ঠাঁই করেছে দ্বিতীয় বার তাকাবে না এই ছেলের দিক৷ কিন্তু তার নজর কীভাবে যেনো চলে যাচ্ছে ওদিকে৷ নজর ফেরাতে সে সেখান থেকে চলে এলো৷ এসে দাঁড়িয়েছে পূর্বদিকে৷ এদিকটায় মানুষের যাতায়াত কম৷ সবাই পশ্চিম দিকে আড্ডায় ব্যস্ত৷ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যাবে তখনই ওড়নায় টান অনুভব করলো৷ ঘুরে দেখল তার ওড়না রেলিঙের সাথে আটকে আছে৷ টেনে ছুটাতেও পারছেনা৷ পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,
— সাহায্য লাগবে?
শাবিহা ফিরে তাকাল না৷ না তাকিয়েই জানে এটা কার কন্ঠ৷ অয়ন সামনে এসে দাঁড়ালো৷ খুব সহজেই ওড়নাটা ছাড়িয়ে দিল৷ শাবিহা চলে যেতে নিচ্ছিলো আবারো ওড়নায় টান খেল৷ ভেবেছে এবারও রেলিঙে বেজেছে৷ কিন্তু ঘুরে দেখল ওড়না অয়নের হাতে৷ শাবিহা চমকে তাকাল৷
— এসব কেমন অসভ্য ব্যবহার ?
অয়নের জবাব নেই৷ জবাবের বদলে ওড়নাটা হাতে পেচিয়ে নিতে লাগলো৷ শাবিহা অবাকের চুড়ান্তে৷
— অয়ন!
অয়নের কানে যেমন শাবিহার কন্ঠ পৌঁছাচ্ছে না৷ নিজের মতো ওড়না টেনে যাচ্ছে৷ রাগে লজ্জায় শাবিহা বাকরুদ্ধ৷ শাবিহা সামনে আসতেই অয়ন বলল,
— আপনার জন্য কি আসলেই আমি খুব অযোগ্য?
— ওড়না ছাড়ো!
— চার বছরের বয়সের গ্যাপ কী খুবই
লজ্জাজনক?
— অয়ন! কেউ আসবে৷
অয়ন গম্ভীর স্বরে বললো,
— আসুক৷ আমার কথার উত্তর দিন৷
শাবিহা রেগে তাকিয়ে৷ ওড়না ছুটাতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে৷ কন্ঠে ক্রোধ নিয়ে বলল,
— নিজের সীমানায় থাক৷
— সীমানায় ছিলাম৷ কিন্তু আজ থেকে থাকব না৷ আপনি শুধু আমার ভালো রুপ দেখছেন৷ এখন খারাপটা দেখবেন৷
শাবিহা কী করবে দিশে পাচ্ছেনা৷ রাগান্বিত অয়নের চোখজোড়ার দিক তাকিয়ে রইলো৷ কেন এই ছেলেটা সবকিছু উলটপালট করছে? কেন তার দুনিয়া তছনছ করছে প্রতিনিয়ত? কেন এতো জ্বালাতন করে৷ দূর থেকে অরুর কন্ঠের স্বর ভেসে আসছে৷ অয়ন শাবিহার ওড়না ছেড়ে দেয়৷ দাঁতে দাঁত ঠেকিয়ে বলল,
— রাতে ছাঁদে আসবেন৷ আপনার সাথে কথা আছে৷ আল্লাহর কসম আপনি না আসলে আমি সোজা আপনার ঘরে ঢুকে যাব৷
অয়ন যেভাবে এসেছে সেভাবে অন্যপাশ দিয়ে চলে গেল৷ অরু দৌড়ে এসে দাঁড়ালো শাবিহার সামনে৷
— একা দাঁড়িয়ে আছ যে? চলো এখনই রওনা হব। চাচ্চু ডেকেছে৷
যেতে নিয়ে শাবিহা পেছনে তাকাল৷ নেউ কেউ! দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো৷ কী হচ্ছে এগুলো?
—-
তন্ময় যেই গাড়িতে চড়েছে সেই গাড়ি অলরেডি ফিল-আপ৷ দীপ্ত, রুবি, শাবিহা আকাশ এমনকি জয়া বেগম, মুফতি বেগম এবং সুমিতা বেগম একসাথে বসেছেন৷ অরু ছোটছোট চোখ করে তন্ময়ের দিক তাকিয়ে৷ আনোয়ার সাহেব পেছন থেকে ডাকলেন,
— আম্মা! আসো বাবার সাথে বসবা৷
যাওয়ার সময় অরু ভেজা ভেজা চোখে তন্ময়কে দেখে গেল৷ মন খারাপ নিয়ে অন্যগাড়িতে তিন বাপ-চাচাদের সঙ্গে বসল৷ নাক পিটপিট করায় টিস্যু বের করতে নিয়ে দেখল তন্ময় আসছে এদিকে৷ চোখমুখে সানগ্লাস পরে৷ অরু দ্রুত টিস্যু সরিয়ে ফেললো৷ তন্ময় এসে ড্রাইভিংয়ে বসেছে৷ মুহুর্তেই গাড়ি চলতে শুরু করলো৷ তারমানে তন্ময় এই গাড়িতে যাবে? অরু খুশিতে গদগদ হয়ে আছে৷ বিড়াল যেমন তার প্রিয় মাছ দেখছে তেমন ভাবে তাকিয়ে রইলো৷ তন্ময়ের পাশে মোস্তফা সাহেব বসেছেন৷ তার চোখেও সানগ্লাস৷ অরু নিজের হাত ব্যাগ থেকে সানগ্লাস বের করে পরে নিল৷ সানগ্লাস পরিহিত সে মিটিমিটি হাসছে। আজ সে আর তন্ময় একদম সেইম টু সেইম৷
কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছাতে বিশ মিনিট লেগেছে৷ পুরো পরিবার এক টেবিলেই বসেছে৷ খাওয়ার সময় অরু কাউকেই চেনেনা৷ এমনকি তন্ময়কেও না৷ সর্বপ্রথম টেবিলে সেই বসেছে৷ সকলের আগে খেতেও আরম্ভ করেছে৷ তন্ময় যখন তার পাশে বসেছে সেটাও খেয়াল করেনি মহারানী৷ খেতে খেতে একে সেকে হুকুম দিচ্ছে খাবারের বাটি পাস করতে৷ তন্ময়ের সামনের বাটিতে ভালো ভালো গোস্তো। অরুর নজর সেটাতে পড়েছে৷ ধীর গলায় বলল,
— আমাকে তরকারির বাটি দিবেন? ওইযে আপনার সামনেরটা?
— না দিব না৷
অরু কষ্ট পেয়ে বলল,
— আপনি তো নিচ্ছেন না৷
তন্ময় মাথা ঘুরিয়ে তার দিক তাকাতেই নজর ফিরিয়ে বলল,
— লাগবেনা তো৷
কিছুক্ষণ পর খেয়াল করলো তন্ময় নিজেই তাকে তরকারি বেড়ে দিচ্ছে৷ অরুর মন ভালোলাগায় ছেয়ে গেল৷ জ্বলজ্বল নয়নে তন্ময়ের দিক তাকিয়ে রইলো৷ খাওয়া দাওয়া শেষ করে সে ভাবল তন্ময়ের পেছন পেছন ঘুরবে৷ কিন্তু সেটা হলোনা৷ তন্ময় কথাবার্তায় ব্যস্ত৷ একসময় দেখল মেয়েদের সাথে কথা বলছে৷ লম্বাচওড়া সুন্দরী মেয়ে যারা তন্ময়ের বয়সী৷ অরুর খারাপ লাগতে লাগলো৷ তন্ময়ের সাথে দাঁড়ানো মেয়ে গুলোকে তার আর সুন্দর মনে হলোনা৷ সবাইকে কালসাপ মনে হচ্ছে৷ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তন্ময়ের দিক৷ তার আশেপাশে ঘুরতে লাগলো৷ কিন্তু তন্ময় একবারও অরুর দিক নজর দিলো না৷ অভিমানী সে বাবার কাছে চলে এসেছে৷ বাকিটা সময় বাবার পেছন পেছন ঘুরতে লাগলো৷

চলবেপ্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল – ৯
________________________

ডিনার শেষে শাবিহা চুপচাপ সোফায় বসে৷ অরু তার চারপাশে বিড়াল ছানার মতো ঘুরঘুর করছে৷ মুখে যা আসছে বলছে৷ এটাসেটা নিয়ে তর্ক বিতর্ক করছে৷ কিন্তু শাবিহা কিছুই শুনছে না৷ অন্যমনস্ক হয়ে আছে৷ অরু একসময় সুমিতা বেগমের পিছু লাগলো৷ শাবিহা এই সুযোগে উঠে চলে এলো নিজের রুমে৷ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে রইলো৷ দেয়াল ঘড়িতে রাত দশটা তেত্রিশ৷ বাড়ির মানুষ এখনো সজাগ৷ শাবিহা বই নিয়ে টেবিলে বসলো৷
পড়ায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করছে৷ আধঘন্টা খানেক পড়েও, মনোযোগ হারিয়ে ফেলছে৷ বই বন্ধ করে বেলকনিতে দাঁড়ালো৷ ঠান্ডা বাতাস বইছে৷ আকাশ ডাকছে! বৃষ্টি আসবে মনে হয়৷ অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন আকাশের পানে, বিষন্ন চোখমুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলো৷ এক অসহায় যন্ত্রণা বুকে তোলপাড় সৃষ্টি করছে৷ খেয়াল করলো বাড়ির লাইটসোর্স ওফ হয়ে গিয়েছে৷ তারমানে সবাই নিজেদের রুমে চলে গিয়েছে৷ বাড়িটা এখন শান্তশিষ্ট৷ সম্পুর্ন নিঃস্তব্ধতায় ঘেরা৷ মুহুর্তেই শাবিহা বৃষ্টির ফোটা অনুভব করলো মুখমন্ডলে৷ বৃষ্টি হচ্ছে৷ ঝুম বৃষ্টি৷ বাতাসে উড়ে বৃষ্টি তার শরীর স্পর্শ করছে৷ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে ভিজে যাবে দেখে কার্টেইনস লাগিয়ে, দরজা ছেটে ভেতরে চলে এলো৷ ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা৷ বৃষ্টির মধ্যে তো অয়ন আসবেনা৷ শাবিহাকেও যেতে হবেনা৷ মনেমনে নিজেকে মানিয়ে ঘুমানোর জন্য তৈরি হচ্ছিলো৷ তবুও মন আকুপাকু করছে৷ এই ঝুম বৃষ্টিতে অয়ন আসবে নাকি? না আসবেনা! অয়ন একদম আসবেনা৷ আর আসলেও শাবিহা যাবেনা৷ মনমানসিকতা শক্ত করে শুয়ে পড়লো। বিছানায় এদিকসেদিক ঘুরেও ঘুমাতে পারছেনা। বৃষ্টির শব্দ বেলকনি থেকে ভেসে আসছে৷ হুট করে শাবিহা লাফিয়ে উঠলো৷ ছাতা হাতে দৌড় লাগালো ছাঁদে৷ হাঁপাতে হাঁপাতে দমবন্ধ হবার জোগাড়৷ অন্ধকার সঙ্গে প্রখর বৃষ্টির মধ্যে অয়নকে দেখতে শাবিহার সময় লাগলো না৷ টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ ছেলেটা এতো তেজী! এই ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে থাকার মানে হয়? শাবিহা এগিয়ে আসলো না৷ ছাতা মাথায় দিয়ে এখান থেকেই বলল,
– বাসায় যাও!
অয়ন ঠাই দাঁড়িয়ে৷ কথা শুনছে না একদম।শাবিহার রাগ লাগলো৷ ইচ্ছে করছে চলে যেতে৷ পা ও বাড়িয়েছে কিন্তু যেতে পারছে না৷ ফিরে তাকিয়ে দেখল অয়ন লাফিয়ে তাদের ছাঁদে চলে এসেছে৷ তাকে এগিয়ে আসতে দেখে শাবিহার বুক কেঁপে উঠলো৷ নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে বলল,
– কি এমন জরুরি কথা যে এই বৃষ্টির মধ্যে বলতে হবে?
– ভালোবাসি৷
শাবিহার হাতের ছাতা নড়ে উঠলো। শক্ত করে না ধরলে হয়তো পড়ে যেতো। অয়ন আবারো বলল,
– আমি আপনাকে ভালোবাসি৷
– বাচ্চামো ছেড়ে দাও অয়ন৷ তোমার সুন্দর উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পড়ে আছে সামনে৷ আমাকে ভালোলাগা এটা তোমার কিচ্ছুক্ষণের মোহ৷ একসময় কেটে যাবে৷
– পাঁচ বছর তো হলো৷ আর কতো?
বৃষ্টির মধ্যে ভেজা অবস্থায় দাঁড়ানো অয়ন উচ্চস্বরে প্রশ্ন করলো,
– কাটে না কেন এই মোহ? আরও পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে? নাকি সারাজীবন?
শাবিহার মাথা ঘোরাচ্ছে৷ আর একমুহূর্ত এখানে থাকা সম্ভব নয় তার পক্ষে৷
– ফিরে যাও৷
এটা বলেই শাবিহা পা বাড়ায় চলে যাবার জন্য৷ পেছন থেকে অয়ন তার হাত চেপে ধরে৷ পরপর মাথার উপর থেকে ছাতাটা সরে যায়৷ মুহুর্তেই ভিজে গেল সে৷ অয়ন হাত ছাড়ল না৷ কাছে এসে দাঁড়ালো৷ কন্ঠ যথাসম্ভব শান্ত করে বলল,
– আমাকে ভালোবাসা যায়না শাবিহা?
– এটা অসম্ভব! আমরা একটা সমাজে বসবাস করি অয়ন৷ এখানে কিছু রীতিনীতি আছে৷ মানুষ কী বলবে এটার গুরুত্ব দিতে হবে৷
আচমকা শাবিহা নিজেকে অয়নের বাহুডোরে আবিষ্কার করলো৷ শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে৷
– রীতিনীতি, সমাজ, লোকজন আমি কিছুর পরোয়া করিনা৷ আমি শুধু আপনার পরোয়া করি৷ আমি শুধু আপনাকেই ভালোবাসি৷ আমি চাই আপনিও আমাকে ভালোবাসুন৷
শাবিহা নিশ্চুপ হয়ে অয়নের বুকে পড়ে রইলো৷ নিজেকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টা করছেনা৷ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে৷ অয়নকে কীভাবে বোঝাবে তার মনের কথাগুলো? কীভাবে বোঝাবে এই সমাজ তাদের মেনে নিবেনা৷ পরিবার মেনে নিবেনা৷ শাবিহা অস্পষ্ট স্বরে বলল,
– কেউ মেনে নিবেনা৷
– আপনি যদি চান সবাই আমাদের মেনে নিক, আমি সবাইকে মানতে বাধ্য করবো৷
শাবিহা কাঁদতে শুরু করেছে৷
– তোমার সাথে আমাকে মানাবে না৷ তু..
– আমি মানিয়ে দেব৷ ম্যাচুরিটি বাড়াতে হবে তো? বাড়াব৷ এখন থেকেই দুনিয়ার সম্মুখীন হতে হবে? হবো! আপনার দায়ভার নেওয়ার জন্য কাজ করতে হবে তো? আমি কাজ করতে শুরু করবো শাবিহা৷ আপনি শুধু আমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করুন৷ আমার অপেক্ষা করুন৷ আমাকে কিছু বছর সময় দিন৷
শাবিহা কেমন গলে গেল৷ চোখজোড়া বন্ধ করে অয়নের মিষ্টি কথাবার্তা শুনতে থাকলো৷ এগুলো শুনতে কতটাই না ভালো লাগছে৷ আসলেই কী সম্ভব? অয়ন এখনো অনার্সে৷ সম্পুর্ন পৃথিবী দেখা বাকি তার৷ বাইরের সুন্দর পৃথিবী ঘুরে এসে কি শাবিহাকে তখনো ভালোবাসবে? এভাবেই তার জন্য পাগল থাকবে?
———
অরুর ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট আউট হয়েছে।
ভালো করেছে৷ চার-পাঁচ দিনের মাথায় ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হয়ে এসেছে৷ রেগুলার ক্লাস অ্যাটেন্ড করছে আর সন্ধ্যায় দৌড়ে তন্ময়ের কাছে হায়ারম্যাথমেটিকস করার ছুতায় চলে আসে৷ তন্ময় দৈনন্দিনের মতো একই ব্যবহার করে৷ অরুর আবেগী মন, ব্যাকুলতা, তীক্ষ্ণ নজর কিছুই যেমন সে চোখে দেখেনা৷ কিন্তু দিন যাচ্ছে আর অরুর অস্থিরতার মাত্রা বেড়ে চলেছে৷ যেমন মাস খানেক আগে হুট করে বালিশ বুকে জড়িয়ে কেঁদেকেটে টিস্যু দিয়ে ঘর ভর্তি করে ফেলেছে৷ এখন কান্না কেন করেছে নিজেই জানেনা৷ সেদিন তন্ময় তার ম্যাসেজ সিন করেনি দেখে অরু সারাদিন খাওয়াদাওয়া করলো না৷ পরশু কল করেছে তার কল রিসিভ করেনি দেখে, সারাদিন চোখের কোণে জল নিয়ে পুরোটা বাড়ি ঘুরেছে৷ গতকাল ভাত খেতে বসে হুট করে কেঁদে ফেললো৷ কাঁদতে কাঁদতে সর্দি চোখের জল দিয়ে চোখমুখ ভরে ফেলেছে৷ মোস্তফা সাহেব, আনোয়ার সাহেব সকলেই চিন্তিত সুরে প্রশ্ন করেছেন, ‘ কী হইছে আম্মা? ‘ প্রতিত্তোরে অরু নাক টেনে বলেছিল,
– আমাকে ভালো ডাক্তার দেখাও না কেন তোমরা! আমাকে কি ভালোবাস না? আমার সারাটা বছর ঠান্ডা লেগে থাকে কেন!
আনোয়ার সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
– আম্মা তুমি সারা রাত এসি ছেড়ে শুয়ে থাক৷ শরীর কাঁথা জড়াও না৷ তো ঠান্ডা তো লাগবোই৷ তুমি চলো আমরা এখনই ডাক্তারের কাছে যাব৷
বাবার আদূরে কথাবার্তায় অরুর মন ঠান্ডা হয়েছে ঠিকই৷ তবে আজকে আরেক কান্ড ঘটতে চলেছে৷ অরুর বেশকিছু ক্লাসমেটদের বয়ফ্রেন্ড আছে৷ এবং তাদের থেকে শুনেছে কাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে৷ ভালোবাসা দিবস৷ এই দিন ভালোবাসার মানুষদের উৎসবের দিন৷ প্রেমিক-প্রেমিকারা ঘুরতে যায়। অরুও যেতে চায় তন্ময়ের সাথে৷ কিন্তু তন্ময় আর সে তো প্রেমিক-প্রেমিকা না৷ তাহলে? এখন অরু চায় প্রেমিকা হতে আর তার প্রেমিক হিসেবে তন্ময়কে চায়৷ দরজার ছিটকানি আটকে সেলফোন হাতে অরু বিছানার মধ্যে বসলো৷ সাথে এনেছে টিস্যু বক্স। যদি তন্ময় তার সাথে যেতে না চায় তাহলে অরু কাঁদবে৷ কেঁদেকেটে তন্ময়কে শোনাবে৷ শুনিয়ে রাজি করাবে৷ প্রথম কলে রিং বেজেছে কিন্তু ধরেনি৷ দ্বিতীয় কলে তন্ময় রিসিভ করেছে৷ অরু চুপ হয়ে রইলো৷ ওপাশ থেকে তন্ময়ের গভীর রাতের গম্ভীর স্বরে শোনা গেল,
– কি হয়েছে?
অরু মিনমিনে সুরে বলল,
– আপনি কি কাল ফ্রি!
– বুঝিনি৷
অরু এবার উচ্চস্বরে বলল,
– আপনি কি কালকে আমাকে নিয়ে বেরোবেন?
– কেন?
– আমি ঘুরতে যেতে চাই৷
– কাল নয় অন্য একদিন যাস৷ শাবিহাকে বলে দিব নিয়ে যাবে৷
– না!
তন্ময় ধমকের সুরে বলল,
– কী না?
ধমক খেয়ে অরুর মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল৷ ইনিয়েবিনিয়ে বলল,
– আমি আপনার সাথে যাবো৷
– অফিস আছে৷
– আপনি কী ছুটি নিতে পারবেন না একটা দিন?
– পারবো না৷
অরু নাক ফুলিয়ে চলেছে৷ চোখের কোণ লাল হয়ে গেছে তার৷ কেঁদে দিবে দিবে ভাব৷
– আপনার কি আমার প্রতি একটুও মায়া নেই?
আপনি আমাকে দেখতেই পারেন না তাই না? আপনার ওসব মেয়ে ভালো লাগে৷ আমাকে ভালো লাগে না৷
– চাচ্চুরে ফোন দে তো!
অরু কল কেটে দিলো ভয়ে৷ এগুলো যদি তার বাবাকে বলে, অরু অনেক কষ্ট পাবে৷ বাবা কী ভাববে তাকে? ছোট থেকে যাকে ভাই বলে গেছিস, এখন তাকে বিরক্ত করিস? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে? ভয়ে অরু কাঁদতে বসল৷ তন্ময় কল করেছে৷ অরু কান্না থামিয়ে ধরলো৷ নাক টানার মধ্যে বলল,
– আর বলবো না হ্যাঁ? এগুলো একদম বলবো না৷ আপনি বাবাকে কিছুই বলিয়েন না৷ এইযে কান ধরেছি!
তন্ময়ের গলার স্বর মুহুর্তেই নরম শোনা গেল৷ একটু তাড়াহুড়োও শোনাল বটে,
– কান্না থামা কথা শ….
অরুর ফোনের চার্জ চলে গেল৷ ফোনও চাচ্ছেনা অরু কথা বলুক৷ কথা বললেই বিপদ! সেলফোন চার্জে দিয়ে অরু ঘুমাতে গেল৷ তার শুধুই কান্না পাচ্ছে৷ বালিশ ভিজে ছারখার৷ তন্ময় তাকে বোনের নজরে দেখে৷ আর সে? অরু আসলেই নির্লজ্জ৷
সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে চোখমুখ ফুলে কলাগাছ৷ আয়নায় নিজেকে নিজেই দেখে লাফিয়ে উঠলো৷ এই চেহারা নিয়ে নিচে গেলে তাকে সবাই আস্ত খেয়ে ফেলবে৷ গোসল নিলে নিশ্চয়ই ফোলা ভাব চলে যাবে? অরু সকাল সকাল গোসল নিল৷ নাহ, চোখমুখ ফোলাই রয়ে গেছে৷ কলেজ ড্রেস পরে, মাথা সহ মুখ স্কার্ফ দিয়ে পেঁচিয়ে নিচে নেমে এলো৷ দীপ্ত তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে৷ অরু তার পাশে বসে ধীরেসুস্থে খেয়ে বেরোলো৷ সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে বিদায় রাস্তাঘাটে নজর বোলাতে বোলাতে যাচ্ছে৷ সবখানে গোলাপফুল আর গোলাপফুল৷ যেমন সম্পুর্ন বাংলাদেশে ফুল ছাড়া আর কিছুই নেই৷ কলেজের সামনে ফুলের মেলা বসেছে আজ৷ অরু একশো টাকা দিয়ে একটা গোলাপ কিনেছে৷ এবং সেটাকে নিয়ে পুরো ক্লাস জুড়ে কাহিনী করলো৷ যেমন তার পার্সোনাল ডায়রির এক পেইজে দুটো ছেলেমেয়ে এঁকেছে৷ উপরে সুন্দর ভাবে লিখেছে ভালোবাসা দিবস৷ ছেলেটার মাথার উপর লিখেছে তন্ময় আর মেয়েটির মাথার উপরে লিখেছে অরু৷ তারপর গোলাপ ফুলটা মধ্যে লাগিয়ে দিলো৷ পাশে বসা মারজি ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এগুলো দেখছে৷ ঘুমন্ত কন্ঠে বলল,
– তন্ময় ভাই এগুলো দেখলে তোরে এক থাপ্পড়ে সুইজারল্যান্ড পাঠাই দিবে৷
– এভাবে বলবিনা৷ আমি কষ্ট পাই৷
– আহারে আমার শোনাটা৷ কষ্ট তো পাবাই৷ ফাঁদে যে পড়ছ৷
সবগুলো ক্লাসে অমনোযোগী ছিলো অরু৷ শেষ ক্লাস সেড়ে ক্যাম্পাসে পা ঝুলিয়ে বসে থাকলো৷ এহসান বাদাম এনেছে৷ সেগুলোই খাচ্ছে হেলেদুলে৷ এহসান কথায় কথায় বলে ফেলল,
– এই অরু তন্ময় ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড নাই রে? আমার মনে হয় তার গার্লফ্রেন্ড আগুন সুন্দরী হইবো৷ তিনি নিজেই যেই সুন্দর৷ সেদিন সন্ধ্যায় একটা মাইয়ার সাথে দেখছিলাম৷ ওইটা মাইয়া ছিলো না পরী বুঝতে পারিনি, এতো সুন্দর!
মারজি ঠোঁট কামড়ে আঁড়চোখে অরুর দিক তাকাল৷ অরু ঠোঁট, নাক ফোলাচ্ছে৷ কেঁদে দিবে৷ ভাবতে না ভাবতেই দেখল অরুর গাল বেয়ে চোখের জল গড়িয়ে পড়ছে৷ মারজি এহসানকে বুঝতে না দিয়ে আলগোছে অরুকে নিয়ে সরে এলো৷ চোখমুখ মুছে দিয়ে বলল,
– বোকা তো তুই! ভাইয়া কাজ করে সেখানে শতশত মেয়েরা আছে৷ যেমন তোর আশেপাশে কতশত ছেলেরা৷ তুই দুই একজনের সঙ্গে তো কথা বলিস তাই না? তো, তেমন সেও বলে৷ এটাকে সিরিয়াস নেওয়ার কী আছে?
অরুর কান্না থেমে গেল৷
– তাই তো৷ আমিতো সেভাবে ভেবে দেখিনি
মারজি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল৷ এরমধ্যে সুমনা এসে সামনে দাঁড়ালো৷ তার সাথে এসেছে সাঙ্গপাঙ্গ৷ সুমনার হাতে গোলাপফুলের বাগান৷ অরুকে দেখিয়ে বলল,
– এগুলো সব পেয়েছি৷ চকলেট ডে, টেডি সব ডে’তেই আমার বাড়িঘর ভরিয়ে ফেলে ছেলেরা গিফট দিয়ে৷ কী একটা অবস্থা! তা তুই একটাও পাস নি?
অরু যেতে যেতে বলল,
– খোলা বাজারে মাছি বেশি থাকবেই ।
সুমনা রেগে গেল৷ দৌড়ে তাকে ধরবে তার আগেই মারজি সামনে এসে দাঁড়ালো৷ চোখ রাঙিয়ে তাকাল সুমনার দিক৷ তারপর অরুর সাথে চলে এসেছে।যে যার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে৷ গেইটের সামনে আসতেই চমকে গেল অরু৷ তন্ময় দাঁড়িয়ে৷ অরুর চোখজোড়া পিটপিট করছে৷ সত্যি দেখছে তো? তন্ময় ভীষণ রেগে৷ তার চোখমুখ থেকে আগুন বেরোচ্ছে যেমন৷ অরু ভয় পেল৷ গতকালের জন্য লোকটা এখনো রেগে নাকি? অরুকে কী মারতে এসেছে? অরুর পেছনে দাঁড়ানো মারজি আর এহসান একটু পেছনে চেপে গেল৷ তন্ময় তাদের দিক এসে নিজেকে শান্ত করল৷ অরুর হাতের সাইকেল নিয়ে এহসানে হাতে দিয়ে বলল,
– বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারবেনা?
– জি ভাই পারবো৷
– ধন্যবাদ৷
তারপর শক্ত করে অরুর হাত ধরে নিয়ে চলেছে৷ অরু ভ্যাবলার মতো পিছুপিছু যাচ্ছে৷ মোর থেকে তন্ময় রিকশা নিয়েছে৷ অরু উঠে বসতেই সেও পাশে উঠে বসেছে৷ কন্ঠে তীব্র রাগ নিয়ে বলল,
– তুই ফোন বন্ধ করেছিস কেন?
– আমি করি নাই ত৷ চার্জ ছিলোনা৷
– চার্জ ছিলোনা যেহেতু আমায় কল দিছিস কেন?
তারপর ফোন চার্জ দিয়ে কল ব্যাক করিস নি
কেন?
তন্ময়ের ঝাড়ি খেয়ে কেঁপে উঠেছে দৃশ্যমান রুপে৷
চোখমুখ অন্ধকার করে বলল,
– আমি ভেবেছি আপনি কথা বলতে চাচ্ছেন না৷
তন্ময় অরুর মাথায় আঙুল ঠেকিয়ে বলল,
– এই ভাবনা কল দেবার আগে কই ছিল?
– কি জানি! আপনি কি বাবাকে বিচার দিতে যাচ্ছেন?
– হ্যাঁ৷
– আমিতো বললাম আর বলবো না।
তন্ময়ের জবাব নেই৷ অরু ফ্যালফ্যাল নয়নে তন্ময়ের দিক তাকিয়ে৷ সেই চেনা পারফিউমের ঘ্রাণ৷ অরুর বুক কাঁপছে৷ শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে চলেছে৷ ইচ্ছে করছে তন্ময়ের শক্ত বড় হাতটা ধরতে কিন্তু সাহসে কুলালো না। রিকশা থেমেছে ধানমন্ডি বত্রিশের লেকের সামনে৷ তন্ময় নামতেই অরুও নামলো৷ চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ অরুর চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো৷ তন্ময়ের দিক ফিরে বলল,
– আপনি আমাকে ঘুরতে এনেছেন?
তন্ময়ের জবাব নেই৷ তবে আঁড়চোখে ঠিকই অরুর হাস্যজ্বল চেহারায় কয়েকবার তাকিয়েছে৷ অরু তখন খুশিতে গদগদ৷ তন্ময়ের আঁড়চোখে তাকানো লক্ষ্য করার সময় নেই৷ মান অভিমান, মন খারাপ সবকিছু উধাও তার৷ একসময় অরুর কাঁধের ভারী ব্যাগটা তন্ময় নিজে হাতে নিল৷ মানুষের ভিড়ে অরু হারিয়ে যাচ্ছে দেখে ডান হাত নিজের হাতে নিয়ে ধরে রাখল৷ মধ্যবয়সী চাচা ফুলের ডালা নিয়ে বসেছে মাঝরাস্তায়৷ অরু সেখানে দাঁড়িয়ে বলল,
– একটা কিনে দিবেন আমায়?
তন্ময় একটা না বরং দশ বারোটা মিলিয়ে একটা বুকে বানিয়ে নিয়েছে৷ গোলাপফুলের বুকে হাতে নিয়ে অরু হাসতে লাগলো৷ হাসিতে তার চোখজোড়া ছোটছোট হয়ে গেছে৷ দুজন হেঁটে পৌঁছেছে পশ্চিমের রেস্টুরেন্টে৷ অরুকে দুপুরের খাবার খাইয়ে সম্পুর্ন বিকেল জুড়ে ঘুরিয়েছে তন্ময়৷ অরু মাঝেমধ্যে রাস্তায় থেমে এটাসেটা খাচ্ছে ত, কিছু একটা কিনছে৷ পৃথিবীর সকল ধৈর্য যেমন তন্ময়ের কাছে৷ আজ সে কিছুতেই অরুকে না বলেনি৷ অরু যা চাচ্ছে দিচ্ছে, যা বলছে করছে৷ বলা যায় আজকের দিনটা অরুর জীবনের সবথেকে সুন্দর দিন৷ আজকের তন্ময় অরুর জীবনের দেখা সবথেকে সুন্দর তন্ময়৷

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here