বিবর্ণ নীলাম্বরী পর্ব -১৩+১৪

#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ ত্রয়োদশ

আজিজুর রহমান বর্ণের মায়ের থেকে সবটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায়। মেয়ের হাতে ফোন দিতে বলে কিন্তু নীলা কোনো হেলদোল দেখায় না।নিস্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। বর্নের মা নীলাকে ফোন হাতে নিতে বললেও সে কথা কানে নেয় না।আজিজুর রহমান বুঝে মেয়ের মনের অবস্থা বর্ণের মাকে বলে লাউডস্পিকারে দিতে।সে ফোন লাউডস্পিকারে দিলে আজিজুর রহমান বলা শুরু করেন
-‘আম্মু তুমি কথা বলবে না বাবার সাথে? বাবাকে এবারের মতন ক্ষমা করে দেও মা।বাবা তোমায় বাঁচাতে পারে নি।তাই বলে বাবাকে এত বড় শাস্তি দিবে মা?’

নীলা কিছু বলে না।কিন্তু এতক্ষণ সে কোনো কান্না না করলেও এখন ভেঙে পড়ে।কেঁদে দেয়। আজিজুর রহমান মেয়ের কান্নার শব্দ শুনতে পায়।বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে।

বর্ণ এতক্ষণ চুপ ছিলো কিন্তু নীলার কান্না দেখে আর ঠিক থাকতে পারলো না।সে নীলার পাশে গিয়ে নীলার বাহু শক্ত করে ধরে।নীলা সরে যেতে চাইলে বর্ণ গম্ভীর কন্ঠে বলে
-‘প্লিজ নীলাম্বরী ডোন্ট ক্রাই।’

নীলাম্বরী সরে না।তবে চুপ হয়ে কেঁদে যায়।আজিজুর রহমান মেয়েকে স্বান্তনার স্বরে বলে
-‘মা কেঁদো না প্লিজ।আমরা এখনই রওনা হচ্ছি।ভোরের দিকেই পৌঁছে যাবো। কেঁদো না কেমন।ওরা যা করেছে তার শাস্তি দিবো আমি ওদের। তুমি ভেঙে পড়ো না।খুব বেশিই ব্যাথা পেয়েছো না মা?’

নীলা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল
-‘বাবা বাহ্যিক ব্যাথাটা কিছুই না ভিতরে আমার রক্তক্ষরণ হচ্ছে।এ শহর ভালো না বাবা।এ মানুষ ভালো না।যতবারই উঠে দাঁড়াতে চেয়েছি ততবারই আপন মানুষ গুলো ভেঙে দিয়েছে আমায় বাবা।আমার যে বেঁচে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে যাচ্ছে।’

উপস্থিত সবাই নীলার কথায় নির্বাক হয়ে যায়। একটা মেয়ের মন ভাঙা কি আর্তনাদ।আজিজুর রহমানও থমকে দাঁড়ায়। সত্যি আপন মানুষ গুলোই মেয়েটাকে শান্তি দিলো না।সে নিজেকে শক্ত করে বলল

–‘এরকম বলে না আম্মা। যারা তোমায় কষ্ট দেয় তারা কখনোই তোমার আপন না মা।আর যারা আপন না তাদের আচরণ জীবনে প্রভাব পড়তে দিও না।’

নীলা চোখের জল মুছে কতক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–‘বাবা আমি থাকতে চাই না এ’শহরে।আমি অন্য কোথাও যেতে চাই যেখানে কেউ থাকবে না এমন।আমি শান্তি চাই বাবা।’

নীলার কথায় বুক মোচড় দিয়ে উঠে বর্নের। সে নীলাকে কিছু বলতে যাবে তখনই নীলা উঠে রুমে চলে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দেয়।

বর্ণের কলিজা মোচড় দিয়ে উঠে।দৌড়ে গিয়ে দরজা ধাক্কানো শুরু করে।আজিজুর রহমান বর্ণকে ফোনটা দিতে বলেন।বর্ণের মা বর্ণের কাছে ফোনটা ধরতেই বর্ণ বলে উঠলো
–‘সরি স্যার আপনার কথা আমি রাখতে পারি নি।আপনার আমানত রেখে যাওয়ার মর্যাদা রাখতে পারি নি স্যার।’

আজিজুর রহমান হাজারও কষ্টের মাঝে মুচকি হাসলেন।তার মেয়ে এ’শহরে খারাপ মানুষ গুলোকেই দেখে চলে যেতে চাইলো একবার যদি এই ছেলেটাকে খুঁটিয়ে দেখতো তাহলে এ’শহরে থেকে যাওয়ার ইচ্ছে দ্বিগুণ হতো।

আজিজুর রহমান মুচকি হেসে বলল
-‘মাই সান কখনো কখনো এমন পরিস্থিতি আসে আমাদের জীবনে যখন আমরা চেয়েও অনেক কিছু করতে পারি না।তখন কোনো ভাবেই নিজেকে ব্লেইম দেওয়া উচিত না। তুমি ঐ পরিস্থিতিতে লড়াই করতে চেয়েছো সেটাই বড় ব্যাপার।’

বর্ণ ভরসা পেলো মানুষটার কথায়। কেমন জেনো যাদু জানে মানুষটা।সব খারাপ লাগা এক নিমিষেই উধাও করে দেয়। হঠাৎ করেই বর্ণের নীলার দরজা আটকানোর কথা মনে পড়লো।তরিঘরি করেই সে বলল
–‘স্যার নীলাম্বরী তো রুমে গিয়ে দরজা আটকিয়ে দিয়েছে।’

আজিজুর রহমান স্বান্তনার স্বরে বলল
–‘চিন্তা করো না।ও নিজের কিছু করবে না।আসলে ও ঘটনাটি মানতে পারে নি।হঠাৎ কাছের মানুষের এত হিংস্র রূপ হজম করতে তো সমস্যা হবেই।’

–‘কিন্তু স্যার ওনার মাথা বেশ খানিক কেটেছে।রক্ত বের হচ্ছে এখনো।উনি বের না হলে কীভাবে ব্যাথার জায়গায় মেডিসিন লাগাবো?’

–‘সব ব্যাথায় কি ওষুধ লাগানো যায় বর্ণ?নীলার ভিতরের রক্তক্ষরণ যতক্ষণ না কমবে ততক্ষণ ও বাহিরের টা নিয়ে ভাববে না।আমরা রওনা দিচ্ছি। ভোরেই পৌঁছে যাবো।তোমরা নাহয় তোমাদের ফ্লাটে চলে যাও।’

আজিজুর রহমান কথাটা বলে সাড়তেই বর্ণের মা মোবাইলটা নিয়ে নিলেন।বিনীত স্বরে বললেন
–‘ভাইসাহেব আমি আমার মেয়ে রেখে কোথায় যাবো?এই অন্যায় কথা বলবেন না।আপনারা নিশ্চিন্ত মনে আসুন।আমরা সবাই আছি আমার মেয়ের কাছে।’

আজিজুর রহমান ‘আল্লাহ হাফেজ’ বলে ফোনটা রেখে দিলো।আফসানা রহমান ততক্ষণে ব্যাগ গুছিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আজিজুর রহমান ফোন কাটতেই তাড়া দিয়ে বলল
-‘কি গো কি বললো?মেয়েটা কিছু বলেছে তোমায়?আমায় ক্ষমা করো।আজ আমার বাপের বাড়ির লোকজনের জন্য এত হয়রানি মেয়েটার।আমি লজ্জিত।’

আজিজুর রহমান গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘ঐ মানুষ গুলো তোমার কখনোই আপন ছিলো না তাই এসব কথা বলো না।’

আফসানা রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
-‘চলো তাড়াতাড়ি, মেয়েটা তো একা আছে।’

আজিজুর রহমান শান্ত স্বরে বললেন
-‘আমার মেয়ে আর একা নেই আফসা।ওর সাথে ওর অদৃশ্য এক পরিবার আছে।তুমি চিন্তা করো না।’

আগন্তুক কল লাগায়। ফোনের বিপরীত পাশের মানুষটা কল রিসিভ করতেই আগন্তুক বলে উঠে
-‘সবটা শুনেছো তো?নীলা কিন্তু প্রচুর ব্যাথা পেয়েছে।’

ফোনের বিপরীত পাশের মানুষটা বলল
-‘হ্যাঁ সবটাই আমি জানি।তবে নীলা যথেষ্ট প্রতিবাদ করেছে শুনে খুশি হয়েছি।ওর বাহিরের ক্ষতটার দাগ রয়ে যাবে।আর কিছু দাগ থেকে যাওয়া ভালো।ওর দাগ গুলো ওরে স্মরণ করিয়ে দিবে আপন মানুষদের আচরণ,এ দাগ গুলো ওকে ভুল মানুষ হতে সাবধান করে দিবে।

আগন্তুক ছোট্ট শ্বাস ফেলে।তারপর বলে
–‘তুমি আসবে না ওরে দেখতে?’

বিপরীত পাশের মানুষ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-‘না এসে কীভাবে থাকবো বলো।তুমি তো জানো ও আমাদের জান।’
__________

চারদিকে সূর্যের লাল আভা ছড়াচ্ছে।আধাঘন্টা হলো নীলার পরিবারের সবাই এসেছে।বাবা মাকে দেখে নীলার যতটা না শান্তি মিলছে রাহাতকে দেখে তার চেয়ে বেশি অশান্তি হচ্ছে।

আসছে পর থেকে নীলা আজিজুর রহমানের বুকে চুপটি করে শুয়ে আছে।আর ওর চাচা মানে রাহাতের বাবা নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।বাবা আসার পরই নীলা মাথায় ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ পেঁচিয়েছে।

আফসানা রহমান ভিতরে ভিতরে বেশ ভেঙে পড়েছে।কিন্তু শক্ত মনের দেখে এখনো কিছু বলছে না।মেয়ের সামনে যেতেও তার লজ্জাবোধ করছে।

বর্ণের মা শারমিন চৌধুরী নীলার বাবা মা আসার পর সবার সাথে টুকটাক কথা বলে নিজের ফ্লাটে চলে যান নাস্তা বানানোর উদ্দেশ্যে। কাল রাত হতে সবাই ই না খাওয়া। আর বর্ণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। শারমিন চৌধুরীকে সাহায্য করতে রঙের মাও চলে যায়। এখন ড্রয়িং রুমে বর্ণ,বর্ণের ভাই আর রঙ উপস্থিত ওদের বাসার।

আফসানা রহমান কতক্ষণ নির্জীব থেকে তার বড় মেয়েকে ডাক দিলেন।নিরুপমা মায়ের পাশে এসে দাঁড়াতেই আফসানা রহমান শক্ত কন্ঠে বললেন
-‘আমার ফোনটা দাও তো নিরু।’

নিরুপমা তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে আসে।আজিজুর রহমান প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে
-‘এত সকালে কাকে কল দিবে তুমি?’

আফসানা রহমান রুক্ষ কন্ঠে বলে
-‘কাকে দিচ্ছি দেখলেই বুঝবে।এখন যা করার আমাকেই করতে হবে।’

সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে আফসানা রহমানের কর্মকান্ড। ততক্ষণে অপর পাশে থেকে কলটা রিসিভ হয়েছে।

ফোনটা ধরতেই আফসানা রহমান গম্ভীর কন্ঠে বলল
-‘বাহ্ আপা আমাদের ঘুম কেড়ে আরামেই তো ঘুমাচ্ছো।’

রেহানা বেগম এত সকালে বোনের কন্ঠ পেয়ে হুড়মুড় করে শুয়া থেকে উঠে বসে।আমতা-আমতা স্বরে বলে
-‘কী বলছিস আফসু?’

আফসানা রহমান তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘ কি বলছি ভালো করেই বুঝতে পেরেছো আপা।তাও নাটক করছো কেনো?’

রেহানা বেগম নিচু স্বরে বলল
-‘কালকের ঘটনার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি আফসু।’

আফসানা রহমান আগের ন্যায় তাচ্ছিল্য হাসিটা মুখে বজায় রেখে বললেন
-‘এত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে কাহিনী করে ক্ষমা চাইলেই সবটা শেষ হয়ে যাবে আপা?আমাদেরও জাঁকজমকপূর্ণ কিছু করতে দেও।’

রেহানা বেগম ভরকে যায় আফসানা রহমানের এমন কথায়। তোতলিয়ে বলে
-‘কি বলতে চাইছিস আফসু?

আফসানা রহমান তীক্ষ্ণ স্বরে বলল
-‘কি বলতে চাইছি বুজছো না?আমার মেয়েকে বাড়ি বয়ে এসে মেরে যাওয়ার বিচার চাইছি আমি।আর তোমাদের বিচার অবশ্যই হবে।রেডি হও জেলের ঘানি টানার জন্য। অকারণে পরিবার শুদ্ধ এসে আমার মেয়েকে মারধর করে যাওয়ার শাস্তি আমি আইনী ভাবে দিবো।
#বিবর্ণ_নীলাম্বরী
#মম_সাহা

পর্বঃ চতুর্দশ

ড্রয়িং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা। আফসানা রহমানের এমন রণচণ্ডী রূপ দেখে কেউই কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।

নীরবতা ঠেলেই নীলা বলে উঠলো
–‘আমি চাচ্ছি না মা এ ব্যাপারটা আরও বড় হোক।’

নীলার কথায় অবাক হলেন ড্রয়িং রুমের সবাই।শুধু একজন বাদে সে হলো আজিজুর রহমান।আফসানা বেগম অবাক নয়নে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন
–‘তুমি কি বলছো ভেবে বলছো তো?তোমাকে বাড়ি বয়ে এসে মেরে যাবে আর তুমি তাদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিবে না সেটা কেমন কথা হলো নীলু?তুমি তো জানো অন্যায় যে করে আর অন্যায় করে দুজনই সমান অপরাধী। তবুও এসব ভিত্তিহীন কথা কেনো বলছো?’

নিরুপমাও মায়ের কথায় সমর্থন করে বোনকে বলল
-‘ঠিকই তো নীলু।সব জায়গায় সবাইকে ভালোমানুষি দেখাতে নেই।আর সব থেকে বড় কথা ওরা ভালো মানুষির যোগ্য না। তুই মায়ের কথায় রাজি হয়ে যা বোন।এর একটা শক্ত বিহিত করা প্রয়োজন।’

নীলা বাবার বুক থেকে মুখ তুলে তাকাল। তারপর কিছু একটা ভেবে রাহাতের দিকে তাকিয়ে শক্ত চোখে তারপর তার বোনের উদ্দেশ্যে বলল
–‘না আপু সবার সাথে ভালো মানুষি আর দেখাবো না।আমি ভালো করেই জানি কারা ভালোমানুষির যোগ্য আর কারা না।সবার কাজেরই বিচার হবে তবে অন্য উপায়ে।’

নীলার কথার ভঙিতে রাহাত ভ্রু কুঁচকে ফেলে।বুঝতে পারে এখানের প্রতিটা কথা তাকেই উদ্দেশ্য করে বলা।

আফসানা রহমান বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন
-‘তোমার কথার আগামাথা বুজছি না নীলু।ওদের একটা শাস্তি না দিলে আমার শান্তি মিলবে না।’

নীলা মায়ের দিকে তাকালো।তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল
-‘আমি যেহেতু এ কথাটা বলেছি সেহেতু একটা কারণ আছে তাই না আম্মু?আগে আমার কথা টা শুনো।’

এবার রাহাতের বাবা আমজাদ আলী গম্ভীর কন্ঠে তার ভাই আজিজুর রহমানকে বললেন
-‘তুমি কিছু বলছো না কেনো আজিজ।নীলু মা তোমার কথা একমাত্র মন দিয়ে শুনে।তাই তুমিই বুঝাও ওরে।’

আজিজুর রহমান এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন
–‘নীলু কেনো না করেছে তা আমি হয়তো জানি।আর আমার মনে হয় নীলুর না টা যুক্তিযুক্ত।’

বর্ণের মা ততক্ষণে নাস্তা নিয়ে হাজির।নাস্তার ট্রে টা টেবিলের উপর রেখে।নীলুর মাথায় রেখে বুলিয়ে আজিজুর রহমানকে উদ্দেশ্য করে বললেন
-‘কি বলছেন ভাই সাহেব।ওদের এত তাড়াতাড়ি এত সহজে ছেড়ে দেওয়া উচিত না।আমার মেয়েকে ওরা আঘাত করেছে ভুলে যাচ্ছেন কেনো সেটা?’

আজিজুর রহমান বিচক্ষণ মানুষ।সে মুচকি হেসে বললেন
–‘ছেড়ে কই দিলাম।ওদের শাস্তি নাহয় রিভেঞ্জ অফ ন্যাচারের ভিত্তিতে ছেড়ে দিলাম।’

বর্ণ এতক্ষণ সবটা চুপ করে শুনছিলো।এবার সে শান্ত স্বরে বলল
-‘স্যার আপনি যেহেতু কিছু বলছেন সেহেতু একটা কারণ আছে।কিন্তু আমরা সেটা কেউ ধরতে পারছি না।একটু যদি পরিষ্কার করে বলতেন।’

আজিজুর রহমান মাথা দুলিয়ে বললেন
-‘দেখো ওরা যা করেছে সেটা খুবই বিশ্রী একটা কাহিনী। ওরা হয়তো ভুলে গেছে আত্মীয়তা।কিন্তু আমাদের সেটা ভুলে গেলে চলবে না।থুতু যদি উপরের দিকে মারা হয় তাহলে সেটা নিজের দিকে এসেই পরে সেটা জানো তো? ওদের জেল হাজত নিয়ে কাহিনী হলে সেই কালি আমাদের শরীরে এসেও পড়বে।আর সব থেকে বড় কথা যখন এটা জানাজানি হবে যে একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের জন্য প্রতিবাদ করেছে বলে তার আপন মানুষও তাকে বাড়ি বয়ে এমে মারতে দ্বিধা বোধ করে নি তখন মানুষ রাস্তায় অন্যায় হলে আর প্রতিবাদ করতে যাবে না।খারাপ প্রভাব পড়বে এটা।’

উপস্থিত সবাই অবাক হলো।আসলেই তো তারা এভাবে ভেবে দেখে নি।

শারমিন চৌধুরী অবাক হয়ে বললেন
-‘আপনি ঠিক বলেছেন ভাই সাহেব আমরা এভাবে ভেবেই দেখে নি।তবে এটার বিচার হবে না?’

আজিজুর রহমান হেসে বললেন
-‘বিচার হবে না কেন আপা।অবশ্যই বিচার হবে।কিছু বিচার সাথে সাথে করার দরকার নেই।রেখে দেন উপরওয়ালার নামে।মানুষ যা বিচার করুক না কেনো সেটা সামান্যই হয় কিন্তু উপরওয়ালা যদি বিচার করে তাহলে সে ভারী পরে যায়।তাই এত বড় কাজের বিচার আমি সামান্য মানুষের হাতে দিবো না।উপরওয়ালাই করবে এ বিচার।’

এবার সবাই সহমত পোষন করলো আজিজুর রহমানের কথায় তার পাশে বেশ অবাকও হলো তার বিচক্ষণতা দেখে।তার কথার ধরন বুঝিয়ে দেয় সবসময় ঝোঁকের বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। বর্ণ বরাবরের মতন মানুষটার বচন ভঙিতে মুগ্ধ হলো। সাথে নীলার ভাবচিন্তা তাকে বেশ আকৃষ্ট করলো।

বর্ণের ভাই নীড় বলেই ফেলল
-‘স্যার আপনার মতন আমাদের ছোট নীলু আপুও বেশ বিচক্ষণ।’

উপস্থিত সবাই হেসে উঠলো আর নীড়ের কথার সম্মতি দিলো।

শারমিন চৌধুরী সবার হাতে হাতে একটা করে নাস্তার প্লেট তুলে দিয়ে নীলার সামনে বসলেন।তারপর একটা নাস্তার প্লেট তুলে নিলেন।রুটি ছিড়ে নীলার মুখের সামনে ধরলেন।

শারমিন চৌধুরীর কার্যক্রমে উপস্থিত সবাই অবাক।শুধু একজন বাদে।তিনি হলেন আজিজুর রহমান। তার চোখ তৃপ্তিতে ছলছর করছে।আফসানা রহমান কিছুক্ষণ অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের খাবারে মন দিলো।

নীলা হা হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে তারপর খাবার মুখে তুলে নিলো।

ওদের খাওয়ার মাঝেই কেউ প্রবেশ করলো রুমে।সবাই দরজার দিকে দৃষ্টি দিতেই শুভ্রমকে চোখে পরলো।নীলার খাবার অটোমেটিক থেমে যায়। শুধু নীলার না সবার খাওয়া থেমে যায়।

শুভ্রম ধীর পায়ে ভিতরে এসে সালাম দেয়।আজিজুর রহমান ভদ্র ভাবে সালামের জবাব দিয়ে সুন্দর ভাবে হাসিমুখে বললেন
-‘বসো শুভ্রম।’

শুভ্রম ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো
-‘না আঙ্কেল বসতে আসি নি। আসলে নীলাকে দেখতে এসেছিলাম।কাল ওরা যা করলো তার জন্য আমি লজ্জিত।ক্ষমা করবেন আঙ্কেল।’

আজিজুর রহমান হাসি মুখ বজায় রেখেই বললেন
-‘তোমার পরিবার যা করেছে হয়তো সেটা লজ্জিত হওয়ার বিষয়ই।এতে আমি কিছুই বলবো না।কিন্তু তুমি যদি সময় মতন না আসতে তাহলে আরও বড় কিছু হতো সেই হিসেবে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।’

শুভ্রম মাথা নিচু করে বলল
-‘লজ্জা দিবেন না খালু।আমি ভাবতেও পারি নি সবার মানসিকতা এত নিচে নামবে।’

আফসানা রহমান শক্ত কন্ঠে বলল
-‘তুমি কি এখন কাটা ঘাঁতে নুনের ছিটা দিতে এসেছো শুভ্রম?’

শুভ্রম তরিঘরি করে বলল
-‘না খালামনি কখনোই না।আমি নীলাকে দেখতে এসে ছিলাম।’

আফসানা রহমান আর কিছু বললেন না।শুভ্রম নীলার দিকে তাকিয়ে বলল
-‘নীলা ভালো থেকো।আসছি আমি।’

শুভ্রম বের হয়ে গেলো।শুভ্রমের পিছে গেলো বর্ণও।শুভ্রম লিফটে উঠবে এমন সময় বর্ণ বলে উঠলো
-‘ও তো কখনোই নীলা ছিলো না। নীলাম্বরী ছিলো।তাহলে আজ হঠাৎ নীলা হলো কেন?’

শুভ্রম তাচ্ছিল্য হেসে বলল
-‘ও তো কখনোই আমার ছিলো না।নীলাম্বরী থেকে নীলা হওয়ার গল্পটা বেশ ব্যাথাতুর।’

বর্ণ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল
-‘আপনিও তো কখনোই আমার অপরিচিত ছিলেন না।না এত দূরের ছিলেন তাহলে আজ কেনো?’

শুভ্রম তাচ্ছিল্য হাসলো।তারপর বলল
-‘স্বার্থপর মানুষরা এমনই হয় বুঝলেন তো।তাদের সবকিছু প্রয়োজনে পরিবর্তন করে। যেটার ইতি টেনেছি ভিনদেশে সেটা নাহয় আর নাই তুললেন। ভালো থাকবেন আপনার নীলাম্বরীকে নিয়ে।আমি দেখতে এসেছিলাম।’

শুভ্রম লিফটে ওঠে গেলো।বর্ণ একটা হতাশার শ্বাস ফেললো।মানুষ কীভাবে এতটা বদলে যায়।চেনা সম্পর্ক গুলো কীভাবে এমন অচেনা পরিচয় পায়।দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে ভিতর থেকে।সাথে অতীতের কিছু যন্ত্রণা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here