বিরহ শ্রাবণ ২ পর্ব – ৩৫

#বিরহ_শ্রাবণ(দ্বিতীয় খণ্ড)
#পর্ব_৩৫
#লেখিকা_সারা মেহেক

প্রোজ্জ্বল ভাই আমার দু গাল ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলছেন। উনার নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে আমার চোখেমুখে। ক্ষণে ক্ষণে মৃদু কেঁপে উঠছি। নত দৃষ্টিতে ঘনঘন শুকনো ঢোক গিলছি আর শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি আমি।
খানিক সময় বাদে যখন দুজনেই স্বাভাবিক হয়ে এলাম তখন প্রোজ্জ্বল ভাই ধীর লয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ চন্দ্রিমা? আমি কি কোনো ভুল করেছি?”

আমি নত দৃষ্টি মাথা নাড়ালাম। প্রোজ্জ্বল ভাই মৃদু শব্দে হেসে আমার কপালে গভীর চুম্বন এঁকে দিলেন। অতঃপর আমার গাল হতে হাত সরিয়ে বললেন,
“ তুই যে আমায় মেনে নিয়েছিস এতেই আমি খুশি চন্দ্রিমা। বাকিটা সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে। আজ এক কদম আমি বাড়িয়েছি। পরবর্তীতে তুই আরেক কদম বাড়িয়ে দিবি। এভাবেই এক কদম, দু কদম করে আমাদের সম্পর্ক পূর্ণতা পাবে। ”

আমি দৃষ্টি তুলে উনার পানে চাইলাম। যদিও বেশ লজ্জা লাগছে এ মুহূর্তে উনার দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি রাখতে। তবুও সাহস জুগিয়ে কাজটি করলাম। বললাম,
“ প্রোজ্জ্বল ভাই, আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো যেনো আমার অতীত আমাদের ভবিষ্যতে কোনো প্রভাব না ফেলে। আমি সংসার জীবনে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করবো। ”

“ তুই একা কেনো? আমিও তো আছি। তোর একার নিয়ে কি সংসার চলবে নাকি। সংসার তো হয় স্বামী স্ত্রীর মিলিত চেষ্টায়। একটু চেষ্টা তুই করবি, একটু চেষ্টা আমি করবো। ব্যস, একটা হ্যাপি ফ্যামিলি তৈরী হয়ে গেলো। ”

আমি মৃদু হাসলাম। বললাম,
“ আপনাকে দেখে কখনো ভাবিনি, আপনি এতোটা আপনার পার্টনারের প্রতি এতোটা বোধগম্য হবেন। সবসময় ভাবতাম, আপনার ভবিষ্যত বউ হয়তো আপনার যন্ত্রণায়ই পালিয়ে যাবে। কিন্তু কে জানতো, সেই ভবিষ্যত বউ আমি নিজেই হবো!”
এই বলে হেসে ফেললাম দুজনে। উনি জিজ্ঞেস করলেন,
“ এখন কি মনে হয়? আমায় যন্ত্রণায় পালিয়ে যাবি?”

আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,
“ উঁহু, মোটেও না। খানিক যন্ত্রণা হলেও আপনার সাথেই সারাজীবন সংসার করতে রাজি প্রোজ্জ্বল ভাই। ”

“ এই এই, আমাকে ভাই বলা কবে বন্ধ করবি বল তো!”
আমার কথা শেষ হতে না হতেই অভিযোগের সুরে কথাটি বললেন উনি। পুনরায় বললেন,
“ মানুষ কি মনে করবে বল তো? হাজবেন্ডকে ভাই বলে ডাকে কে! রাস্তাঘাটে কবে যেনো ইজ্জত সম্মান সব মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে আসিস তুই। আজ থেকে ভাই বলা একেবারে বন্ধ। মনে থাকবে তো?”

আমি ঠোঁট কামড়ে বললাম,
“ এতোদিনের অভ্যাস কি দুদিনে বদলানো যায়? আপনিই বলুন প্রোজ্জ্বল ভাই। ”

“ আবার ভাই! প্রোজ্জ্বল বলে ডাকবি। অনলি প্রোজ্জ্বল। ”

“ আচ্ছা আচ্ছা, চেষ্টা করবো আমি। ”

“ শুধু চেষ্টা না,ফল দেখতে চাই আমি। এখন থেকেই আমার নাম ধরে ডাকবি। কি বলবি তাহলে? ”

“ প্রোজ্জ্বল। ”

“ হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে। ”

“ ঠিক তো আছে। কিন্তু আমার কাছে কেমন যেনো অদ্ভুত লাগছে। ”

“ ওমন অদ্ভুত একটু লাগবেই। ঐ আজ কাল এমন লাগবে। তারপর দেখবি অভ্যাস হয়ে যাবে। প্রয়োজন হলে দিনে একশো বার আমাকে ডেকে অভ্যাস তৈরী করবি। ”

“ হ্যাঁ…. তাই করবো, আর পাড়া প্রতিবেশী, ব্যাচমেটরা সবাই জামাই পাগল বলে ডাকবে আমাকে। ”

আমার কথা শুনে প্রোজ্জ্বল ভাই আলতো করে আমার নাক চেপে বললেন,
” তো সমস্যা কোথায়? বলুক জামাই পাগল। আর তোর জামাইও যে বউ পাগল সেটা?”

উনার প্রশ্নে হেসে উঠলাম আমি। উনি বললেন,
“ চল,রুমে যাই। অনেকক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছি। কয়টা বাজে কে জানে!”
এই বলে উনি আমার হাত ধরে নিয়ে যেতে চাইলেন আমায়। কিন্তু আমি পূর্বের জায়গায় অটল থেকে উনার হাত টেনে ধরলাম৷ বললাম,
“ প্রোজ্জ্বল ভাই, আমার কিছু কথা ছিলো। ”

উনি সাথে সাথে আমার দিকে ফিরে চোখ গরম করে বললেন,
“ আবার ভাই!”

আমি সাথে সাথে নিজের ভুল বুঝে জিব কেটে বললাম,
“ সরি সরি। প্রোজ্জ্বল।
আমার কিছু কথা ছিলো। ”

‘ভাই’ বাদে আমার মুখে উনার নামের সম্বোধন শুনে খুশি হলেন উনি। বললেন,
“ বল,কি বলবি। ”

প্রথমে বেশ ইতস্তত বোধ করলেও পরবর্তীতে নিজেকে ঠিক করে বললাম,
“ আমার একটা ছোট্ট আবদার আছে। ”

“ কি আবদার?”

“ আপনি আমাকে হুটহাট ওভাবে জড়িয়ে ধরবেন না প্লিজ। আমার অস্বস্তি লাগে। ”

আমার কথা শুনে মুহূর্তেই হেসে উঠলেন উনি। উনার হাসির ধরণ এমন যেনো খুব মজার একটা কৌতুক শুনেছেন উনি। হাসতে হাসতেই বললেন,
“ হায় আল্লাহ! এ মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো! কি এক আবদার করে বসলি তুই!”
এই বলে উনি পুনরায় হাসিতে মশগুল হলেন। উনার এরূপ হাসি দেখে আমি চোখমুখ কুঞ্চিত করে বললাম,
“ এটা মোটেও হাসির কিছু না। ”

উনি হাসতে হাসতে বললেন,
“ অবশ্যই এটা হাসির আবদার।”
বলেই উনি মুখের অভিব্যক্তি পরক্ষণেই বদলে নিলেন। খানিক গম্ভীর চাহনি তৈরী করে বললেন,
“ সরি, ম্যাডাম, আপনার এ আবদার গ্রহণযোগ্য নয়। আমি আমার বউকে জড়িয়ে ধরবো। এতে তার এমন ওমন লাগার তো কোনো কারণ দেখছি না।”

প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এরূপ কথায় মনঃক্ষুণ্ন হলো আমার। আকুতি মিনতির সুরে বললাম,
“ প্লিজ প্রোজ্জ্বল ভাই। ”

“ আবার প্রোজ্জ্বল ভাই! ”

“ আচ্ছা, প্রোজ্জ্বল।
প্লিজ প্রোজ্জ্বল, একটাই তো আবদার। ”

“ কি এক অদ্ভুত আবদার তোর! আশ্চর্য! তাহলে এখন আমি কাকে জড়িয়ে ধরবো শুনি? বিয়ের পরও যদি বউকে জড়িয়ে ধরতে না পারি তাহলে কি রাস্তার লোককে জড়িয়ে ধরে বলবো, ‘ভাই,আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি? আমার বউকে জড়িয়ে ধরার পারমিশন নেই আমার।’ এটা বলবো?”

সিরিয়াস মুহূর্তেও প্রোজ্জ্বল ভাইয়ের এমন কথায় না হেসে পারলাম না। উনি আমার হাসি দেখে অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
“ না, তুই-ই বল। তাহলে আমি কি করবো? হ্যাঁ? ঘুমানোর সময় কোলবালিশকে জড়িয়ে ধরে বলবো, ‘ শোন, চন্দ্রিমা আমাকে জড়িয়ে ধরতে নিষেধ করেছে। এজন্য তোকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো৷ মাইন্ড করিস না।’ না মানে বুঝলাম না, বিয়ের পরও সিঙ্গেল মানুষদের মতো জীবনযাপন করবো! কি দিন আসলো আমার।”

“ ইশ! আপনি তো বড়ই জ্বালাতন করেন! এতো ডেস্পারেট আপনি!”

“ হুম। আমি অনেক ডেস্পারেট। এনি প্রবলেম?”

“ উঁহু, কোনো প্রবলেম নেই। শুধু আমি বলছি, হুটহাট জড়িয়ে ধরবেন না আমায়। ”

“ আচ্ছা! তাহলে পারমিশন নিয়ে জড়িয়ে ধরতে পারবো তো?”

আমি এদিক ওদিক মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“ সে পারবেন। ”

প্রোজ্জ্বল ভাই যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
“ এট লাস্ট!
তবে হ্যাঁ, যদি দ্বিতীয়বার তোর মুখে ভাই ডাক শুনেছি তাহলে আমার এ অভ্যাস কখনো ছুটবে না বলে দিলাম। ”

“ আচ্ছা, আর ভাই বলবো না আপনাকে। কতবার বলবো একই কথা!”

“ তোর তো বিশ্বাস নেই। আচ্ছা, চল এবার। ”
এই বলে উনি আমার হাত ধরে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। উনার এ কাহিনি দেখে আমি বললাম,
“ শুধু শুধু এতো বড় একটা কাহিনি না করলেও পারতেন!”

উনি পাল্টা জবাবে বললেন,
“ শুধু শুধু এমন একটা আবদার না করলেও পারতি তুই!”

উনার কথা শুনে আমি আর কথা বাড়ালাম না। জানি, উনি আবারও কোনো না কোনোভাবে পাল্টা জবাব দিবেন আমাকে। এর চেয়ে বরং চুপ থাকাই শ্রেয়।

—————–

সপ্তাহখানেক পর,

রাতের বেলা আচমকা বলা কওয়া ছাড়া দমকা হাওয়া ও বিদ্যুৎ চমকানোসহ তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আমি রুমে বসে পড়ছিলাম। হঠাৎ বৃষ্টি আরম্ভ হওয়ায় দ্রুত উঠে গিয়ে বারান্দা থেকে শুকনো কাপড়চোপড় নিয়ে রুমে চলে এলাম। সে কাপড় উঠাতে গিয়েই আমার সালোয়ার কামিজের নিচের অংশ ভিজে জবজবে হয়ে এলো। ফলে কাপড়গুলো খাটের উপর রেখে জামা বদলাতে ওয়াশরুমে গেলাম।
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখলাম প্রোজ্জ্বল খাটের উপর বসে বসে মোবাইল চালাচ্ছেন। এখন আর উনাকে ভাই বলে ডাকা হয় না। প্রথম দুদিন বারংবার ভুলে ভাই বলে ডেকে ফেলেছিলাম আমি। ফলস্বরূপ যখন তখন বলা কওয়া ছাড়া উনি আমায় পিছন হতে জড়িয়ে ধরতেন। এই ভাই বলার ফলে উনি যে উনার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবেন তা বুঝে উঠতে পারিনি আমি। এজন্য এরপর থেকে চেষ্টা করেছি প্রতিবার উনায় ‘ভাই’ সম্বোধন ছাড়া ডাকতে। এভাবে কয়েকদিন ডাকতে ডাকতে এখন আর উনার নামের পাশে ‘ভাই’ শব্দটা ব্যবহার করি না। শুধুই উনার নাম ধরে ডাকি এখন।

প্রোজ্জ্বল আমায় দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“ এখন কাপড় বদল করলি যে?”

“ বারান্দা থেকে কাপড়চোপড় তুলতে গিয়ে বৃষ্টির কারণে নিচের সালোয়ার কামিজ ভিজে গিয়েছিলো। ”

“ ওহ।”
উনি আবারও ফোন চালানোয় ব্যস্ত হলেন। আর আমি খাটের উপর রাখা শুকনো কাপড় গুছাতে ব্যস্ত হলাম।
হঠাৎ কাছেই কোথাও সশব্দে বা’জ পড়লো। এভাবে আচমকা বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দে খানিক চমকে উঠলাম আমি। অতঃপর এদিকে গুরুত্ব না দিয়ে কাজে মনোযোগী হলাম।
কাপড় গোছাতে গোছাতে আড়চোখে দেখলাম প্রোজ্জ্বল আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি দৃষ্টি তুলে জিজ্ঞেস করলাম,
“ কি ব্যাপার? ওভাবে তাকিয়ে আছেন কেনো?”

আমার প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না উনি। ফোন রেখে এক পায়ের উপর ওপর পা তুললেন। সে পায়ের উপর হাত ঠেকিয়ে ভাবুক ও চিন্তাশীল চাহনিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। উনার এমন নীরব অঙ্গভঙ্গি দেখে আমি এ নিয়ে প্রশ্ন করতে যাবো, এর পূর্বেই আরেকটা বা’জ পড়লো। তবে এবারের শব্দ পূর্বের চেয়ে তুলনামূলক কম। তবুও স্বভাববশত খানিক চমকে উঠলাম আমি। অতঃপর নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রোজ্জ্বলকে জিজ্ঞেস করলাম,
“ কি ব্যাপার? এতো ভাবুক হয়ে কি ভাবছেন আপনি?”

প্রোজ্জ্বল খানিক নড়েচড়ে বসলেন। বললেন,
“ না, মানে ভাবছি, একটা মেয়ে এতোটা আনরোমান্টিক কি করে হতে পারে!”

অকস্মাৎ উনার এরূপ কথায় যেনো আকাশ থেকে পড়লাম আমি। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,
“ আনরোমান্টিক! আবার কি করলাম আমি! অদ্ভুত!”

প্রোজ্জ্বল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন,
“ সাধেই সেদিন তোকে গ’ণ্ডা’র বলে উপাধি দেইনি আমি। শরীরে তোর একটুও রোমান্টিকতা নেই। কই এতো জোরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে বলে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরবি তা না করে কাপড় গোছাচ্ছিস!”

প্রোজ্জ্বলের এহেন কথায় হাসবো না কাঁদবো তা নিয়ে বেশ বেগ পেতে হলো আমায়। খানিক বাদেই ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। বললাম,
“ প্রোজ্জ্বল! আপনি এতো বিনোদন কোথায় পান একটু বলবেন?”

উনি চোখমুখ কুঞ্চিত করে বললেন,
“ এখানে বিনোদনের কি দেখলি তুই! সত্যিই তো বলছি, একটুও রোমান্টিক না তুই।”

আমি হাসতে হাসতে কাপড় গোছাতে ব্যস্ত হলাম। বললাম,
“ আমার হওয়ার দরকার নেই। আপনি হলেই চলবে। ”

“ ধ্যাত, বউ এমন নিরামিষ হলে কি মেনে নেওয়া যায়! এমন সময়ে একটু জড়িয়ে ধরে পরিবেশটা শান্তও তো করতে পারিস।”

উনার কথাবার্তা শুনে কিছুতেই আমার হাসি থামছে না। হাসতে হাসতে বললাম,
“ এসব শুধু মুভিতেই মানায়৷ বাস্তবে না আমি হিরোইন আর না আপনি হিরো। তাই, এসব কল্পনা বাদ দিন। আর আমায় কাজ করতে দিন৷ ”

প্রোজ্জ্বল আর কথা বাড়ালেন না। উঠে এসে আমার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললেন,
“ এই বৃষ্টির দিনেও তোর জন্য বোরিং সময় কাটাতে হয়। উফ!”
বলেই উনি রুম হতে বেরিয়ে গেলেন৷ উনার এ বাচ্চামো কান্ডে আমি একাই হাসতে হাসতে কাজ করলাম।

প্রোজ্জ্বলের এমন আবদার শুনে ভাবলাম দুজনে দু কাপ কফি খেতে খেতে কিছু সময় কাটাই। এজন্য রুম থেকে বেরিয়ে সোজা রান্নাঘরে চলে গেলাম। গিয়ে মামি,মামা ও নানুর জন্য তিন কাপ চা আর আমাদের দুজনের জন্য দু কাপ কফি বানালাম। চা বানিয়ে যার যার রুমে দিয়ে এসে আমাদের জন্য বানানো কফি হাতে নিলাম। কফি নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখলাম প্রোজ্জ্বল দোতলার সোফায় বসে জানালার দিকে চেয়ে আছেন। আমি পিছন হতে গিয়ে কফি এগিয়ে দিয়ে বললাম,
“ নিন কফি খান। আপনার কথা শুনে একটু রোমান্টিক হতে এলাম আরকি। ”

প্রোজ্জ্বল আমার থেকে কফির মগ নিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে চেয়ে বললেন,
“ যাক, একটু আক্কেল হলো তবে।”

উনার কথায় মুচকি হেসে উনার পাশে বসলাম। খানিক আদুরে কণ্ঠে বললাম,
“ এতো রাগ করেন কেনো? একটু তো নরম হোন আমার প্রতি। ”

প্রোজ্জ্বল কোনো জবাব দিলেন না। চোখমুখ কুঞ্চিত করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। কোনো ছোট বাচ্চাকে তার মনমতো খেলনা না দেওয়া হলে যেমন মুখের অভিব্যক্তি দেখায়, উনিও এ মুহূর্তে ঠিক তেমনই অভিব্যক্তি দেখাচ্ছেন। উনার এরূপ মুখভঙ্গী দেখে আমি কফির মগ সামনের টেবিলে রেখে এক হাত উনার কাঁধে রাখলাম৷ আর অপর হাত দিয়ে উনার গাল খানিক টেনে বললাম,
“ কিউট লাগছে আপনাকে। এভাবে একটু রেগে গাল ফুলিয়ে রাখলে ভালোই দেখা যায়। কিউট কিউট একটা ভাব আসে। ”
এই বলে আমি হেসে দিলাম। আমার সাথে প্রোজ্জ্বলও হেসে উঠলেন। বললেন,
“ কফিটা এজ অলওয়েজ এর মতো পারফেক্ট, ম্যাডাম। ”

আমি এবার কফির মগ হাতে নিয়ে চুমুক দিলাম। বললাম,
“ থ্যাংক ইউ,স্যার।
প্রোজ্জ্বল স্যার।”

প্রোজ্জ্বল মুচকি হাসলেন। কফির মগটা বাম হাত নিয়ে ডান হাত ঘুরিয়ে আমায় পিছন হতে ধরলেন। কফির মগে আরেক চুমুক বসিয়ে বললেন,
“ এটাও কিন্তু দারুণ এক রোমান্টিক পরিবেশ চন্দ্রিমা। বাহিরে তুমুল বর্ষন, গ’র্জি’ত মেঘের সাথে দমকা হাওয়া, জানালার কাঁচে ফোঁটায় ফোঁটায় আছড়ে পড়া বৃষ্টির কণা, প্রিয়তমার পাশে বসে প্রিয়তমার হাতের সুস্বাদু কফি। আহ জীবন!”
এই বলে ছোট্ট নিঃশ্বাস ছাড়লেন উনি।
আমি মৃদু হেসে জানালার ঝাপসা কাঁচের উপর হতে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির কণা গোনার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।
জীবন বদলে যেতে মাত্র কিছু সময়ের প্রয়োজন হয়। এই তো কিছুদিন পূর্বেও আমাদের মাঝে এতো একান্ত মুহূর্তে ছিলো না এতো উপভোগ্য ও নিভৃত মুহূর্ত ছিলো না। কিন্তু এখন, এসবই আছে। সুখ, দুঃখ মিলিয়ে চলে যাচ্ছে আমাদের এ সংসার। যে সংসারে দুজনেই রোজ নতুন কিছু উপভোগ করছি, নতুন কিছু শিখছি। সব মিলিয়ে প্রোজ্জ্বলের সাথে আমার সংসার জীবন মন্দ কাটছে না বেশ!

————————
এক মাস পর,

আজ বুধবার। প্রত্যাশা আপুর একমাত্র ননদ হিয়া আপুর মেহেদি অনুষ্ঠান। আগামীকাল হলুদ এবং আগামী শুক্রবার বিয়ে। বিয়ে উপলক্ষে আন্টি আমাদের দাওয়াত দিয়েছেন। বলেছিলেন, উনাদের বাসায় থেকেই তিনদিনের অনুষ্টানে যেনো উপস্থিত থাকি। কিন্তু মামা এতে রাজি হননি। কারণ বিয়ে বাড়ির এতো ঘিঞ্জি পরিবেশে নানু থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। এমনিতেও নানু কিছুদিন ধরে বেশ অসুস্থ। এজন্য মামা এ বিষয়ে আর রিস্ক নিতে চাননি। তাই আমাদের বাড়িতে থেকেই মেহেদি, হলুদ, বিয়েতে যাবো আমরা।

মেহেদি অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রত্যাশা আপুর বাড়ির সব মেয়েরা কলাপাতা রঙের শাড়ি পরবে আর হিয়া আপু পরবে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। প্রত্যাশা আপু গতকালই আমাকে শাড়ি দিয়ে যায়। তাই আজ মেহেদি অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে শাড়ি পরে রেডি হয়ে বসে রইলাম। আজকের অনুষ্ঠানে আমি, মামি আর প্রোজ্জ্বল যাবেন। নানু বাসায় থাকবেন। আর মামা ৯টার মধ্যে চেম্বার শেষ করে বাড়িতে আসবেন।

প্রোজ্জ্বল, মামি আর আমি গিয়ে বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হতে না হতেই মামি গল্পে মশগুল হয়ে পড়লেন। যেহেতু প্রোজ্জ্বলেরও কোনো কাজ নেই, তাই উনিও চলে গেলেন শাহেদ ভাইয়ার সাথে গল্প করতে। আর আমায় নিয়ে প্রত্যাশা আপু বসলো। হিয়া আপুর সাথে ভালোভাবে পরিচয় করিয়ে দিলো। হিয়া আপুকে মেহেদি দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। উনি মেহেদি নিতে নিতে আমার সাথে গল্প করলেন।

আধ ঘণ্টা বাদে প্রত্যাশা আপু এক মেহেদি আর্টিস্টকে দিয়ে আমার দু হাতে মেহেদি দিয়ে দিলেন। এই সিম্পল মেহেদি নিয়ে শেষ করতে করতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় এগারোটায় গিয়ে ঠেকলো। বেশ রাত হয়ে যাওয়ায় আমরা দ্রুতই বেরিয়ে পড়লাম। একটা অটো নিয়ে সোজা বাড়ির সামনে এসে নামলাম।

বাড়িতে ঢুকেই মামি চলে গেলেন নিজের রুমে। আর আমি গিয়ে দাঁড়ালাম সিঁড়ির সামনে। পড়লাম এক বিপাকে। একদিকে দু হাতে মেহেদি, অন্যদিকে শাড়ি। এভাবে মেহেদি হাতে নিয়ে শাড়ির কুঁচি ধরে কিভাবে সিঁড়ি বেয়ে উঠবো তাই চিন্তা করতে লাগলাম। কারণ মেহেদি এখনও সম্পূর্ণরূপে শুকায়নি। এ অবস্থায় শাড়ির কুঁচি ধরলে শাড়িও যাবে, মেহেদিও যাবে। কি এক মু’সি’ব’ত!

অটোর ভাড়া মিটিয়ে বাড়ির প্রধান দরজায় তালা লাগিয়ে প্রোজ্জ্বল এসে দাঁড়ালেন আমার পাশে। আমায় এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
“ ব্যাপার কি? দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

আমি অসহায় চাহনিতে উনার দিকে চেয়ে বললাম,
“ হাতের মেহেদি পুরোপুরি শুকেনি। তাই শাড়ির কুঁচিও ধরতে পারছি না। আর শাড়ির কুঁচি না ধরে সিঁড়ি বেয়ে উঠলে নি’র্ঘা’ত উল্টো হয়ে পড়বো।”

প্রোজ্জ্বল আমার দিকে একবার চাইলেন এবং সিঁড়ির দিকে একবার চাইলেন। তারপর ছোট্ট করে বললেন,
“ ওহ, এই সমস্যা। ”
বলেই আচমকা উনি আমায় পাঁজা কোলে তুলে নিলেন। উনার আকস্মিক এ কাজে আমি ছোট করে একটা চিৎকার দিতে উদ্যত হলাম। কিন্তু এর কোলে তোলার সাথে সাথেই উনি বললেন,
“ খবরদার চিৎকার করবি না। শুধু চুপচাপ আমার কাঁধে হাত দিয়ে রাখ। আর নড়াচড়া করবি না।”

উনার কথামতো আমি চুপচাপ রইলাম। উনি খানিক কষ্টেসৃষ্টেই আমায় কোলে করে দোতলায় উঠলেন। দোতলায় উঠে রুমে গিয়ে আমাকে কোল থেকে নামানো মাত্রই কোমড়ে দু হাত চেপে উনি বললেন,
“ কি ব্যাপার চন্দ্রিমা? এতো ভারী হলি কবে থেকে? কোলে নেওয়ার আগে তো ভাবিইনি যে তোকে কোলে নেওয়ার পর আমার কোমড়ের বারোটা বাজবে। ”

উনার এ কথায় হেসে উঠলাম আমি। কয়েক সেকেন্ড পর উনার পানে চাইলাম৷ আজ স্কাই ব্লু রঙের একটি পাঞ্জাবি পরেছেন উনি। এ পাঞ্জাবিতে উনাকে খানিক বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে আমার কাছে। উপরন্তু উনার মাথার চুলগুলোও কিঞ্চিৎ এলোমেলো করে রাখা। আর ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। উফ! ভাবছি, উনি কি সত্যিই আমার। নাকি অন্য কারোর!

আমার এরূপ তাকানো দেখে প্রোজ্জ্বল ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
“ ওভাবে হা করে কি দেখছিস?”

আমি অকপটে স্বীকার করলাম,
“ আপনাকে দেখছি। ”
বলেই আমি কোনোরূপ চিন্তাভাবনা ছাড়াই উনার দু কাঁধে দু হাত রাখলাম৷ উনার দৃষ্টি বরাবর চেয়ে পূর্বের ন্যায় বললাম,
“ আপনাকে আজ অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে। ভাবছি, আপনি আমার কল্পনা নাকি বাস্তবতা। ”

অকস্মাৎ আমার এহেন কান্ডে চমকে উঠলেন প্রোজ্জ্বল। হয়তো একটু মেকি কাশি দিয়ে সন্দেহজনক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“ ব্যাপার কি চন্দ্রিমা? আজ এমন ব্যবহারের কারণ?”

আমি মুগ্ধ গলায় বললাম,
“ কারণ আজ আপনাকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে। দা হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং প্রোজ্জ্বল। ”

প্রোজ্জ্বল আমার এরূপ কথা হজম করতে পারলেন না বোধহয়। জিজ্ঞেস করলেন,
“ এই রাতে বাইরে থেকে এসেছিস বলে কি গায়ে জ্বি’ন ভূ’ত ভর করলো নাকি?”

আমি নিঃশব্দে হেসে উঠলাম। বললাম,
“ উঁহু। জ্বি’ন ভূ’ত ভর করেনি। তবে প্রোজ্জ্বল নামক মানুষটা ভর করেছে আমার উপর। ”

প্রোজ্জ্বল কয়েক সেকেন্ডের জন্য আমার পানে চেয়ে রইলেন। অতঃপর অকস্মাৎ আমার কোমড় জাপটে ধরে বললেন,
“ আজ না তোর কোনো কথাই হজম হচ্ছে না আমার। তুই নিজে থেকে এপ্রোচ করেছিস এটা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।”

“ এতো কষ্ট হচ্ছে কেনো শুনি? সবসময় তো অভিযোগ করেন যে আমি একদম নিরামিষ। আজ একটু রোমান্টিক মুডে আসলাম, আর আপনি এমন করছেন। হুহ।”

প্রোজ্জ্বল হাসলেন। খানিক এগিয়ে আমার কপালে আলতো চুমু দিয়ে বললেন,
“ তুই মোটেও নিরামিষ না, আজ যা বুঝলাম। শুধু কালেভদ্রে তোর এ রূপ দেখা যায় এই তো।
বাই দা ওয়ে আজ কিন্তু তোকে অনেক সুন্দর লাগছে। এভাবে শাড়ির সাথে হিজাব পরলে তোকে মানায় খুব। মাঝে মাঝে এভাবে আমার সামনে শাড়ি পরে ঘুরবি। ওকে?”

আমি মুচকি হেসে জবাব দিলাম,
“ আচ্ছা। আর আপনি পাঞ্জাবি পরে। ”

“ অবশ্যই ম্যাডাম। আপনি বললে আমি সারাদিন আপনার সামনে পাঞ্জাবি পরে বসে থাকবো। ”
এই বলে প্রোজ্জ্বল হেসে উঠলেন। উনার সাথে যোগ দিলাম আমিও।
®সারা মেহেক

#চলবে
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here