বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ১৪

#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্বঃ ১৪

কয়েকদিনের সুপ্ত থাকা বুকে ব্যথা হঠাৎ আবার চাড়া দিয়ে উঠেছে সায়ানের, বুকে হাত দিয়ে খুব কষ্টে উঠে বসেছে বিছানা ছেড়ে,ইদানীং ঘুমটা খুব বেশি হয় কেনো যেন! আজকে দেরিতেই উঠেছে তাই ঘুম থেকে, উঠে ওয়াশরুমের দিকে যাবে তার আগেই পড়ে পড়ে যায় ঘুরে, অনেক চেষ্টা করেও উঠতে না পেরে হার মেনে নেয়,

এদিকে রুশি সায়ানকে ডাকতেই উপরে আসছিলো,প্রতিদিন সকাল সাতটায় ব্রেকফাস্ট করে অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয় অথচ আজ আটটা বাজে তবে নিচে নামার কোন হদিশ নেই তাই অগত্যা ও উপরেই আসছিলো কিন্তু হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দে চমকে উঠে আর দ্রুত এ ঘরের দিকে আসে। সায়ানকে পড়া অবস্থায় দেখে আতকে উঠে এগিয়ে আসে ওর দিকে আর মাথা নিজের কোলে রেখে আলতো করে ডাকতে থাকে, সায়ানের মুখ গড়িয়ে রক্ত পড়ছে, হাতেও কিছু রক্ত লেগে আছে। সায়ানের হুশ তখনো পুরোপুরি যায়নি তাই হাল্কা রেস্পন্স করছে, রুশি চিৎকার করে এলেক্স মানে বাড়িতে থাকা মেইডকে ডাক দিলো। তারপর হসপিটাল অফ লস এঞ্জেলসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো,,

ভয়ে রুশির শরীর শুধু ঘামছে, যখন সেদিন বম্ব ব্লাস্ট হয়েছিলো সেইরকম ফিলিংস কাজ করছে, বারবার মনে হচ্ছিলো যদি সায়ানের কিছু হয়ে যায়?হসপিটালে পৌছে সায়ানকে যখন কেবিনে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন ও সায়ানের হাত ছাড়ছিলো না, মনে হচ্ছিলো এইবার ছেড়ে দিলেই হয়তো আর ধরার সুযোগ পাবে না।

রুশি পাশে থাকা বেঞ্চে বসে পড়লো, বিড়বিড় করে বলছে “সায়ান প্লিজ এভাবে অভিমান করে চলে যেওনা! অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে, তুমি কি জানো আর তিনদিন পর আমাদের এনিভার্সিটি, কতো প্লেন করেছি আমি জানো! প্লিজ আমি অনেক একা হয়ে যাবে তুমি চলে গেলে। কে আমার জন্য প্রতি ভেলেন্টাইন ডে তে রেড রোজ নিয়ে এসে চুপিচুপি হাতের কাবার্ডে রেখে যাবে? রোজ আসার সময় পছন্দের চিকেন বল কে আনবে বলো?প্লিজ কাম ব্যাক, আমি কি নিয়ে বাচবো বলো?”

এখন মনে জীবনের কতোটা সময় সায়ানকে অবহেলা করে বেড়িয়েছে ও, ছেলে হারিয়ে অযথাই সায়ানের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েছে অথচ সায়ানও ওই মুহুর্তে ওর মতই অসহায় ছিলো। ওর অতীত ওর বর্তমানে এসে দাঁড়াবে তাতো ও কখনোই ভাবেনি। রুহানকে ও মারেনি কিন্তু এতোগুলা বছর মানুষটিকে ও বিনা কারণে শাস্তি দিয়েছে যার ভাগ নিজেও পেয়েছে। ও চাইলেই হয়তো গল্পটা অন্যরকম হতে পারতো কিন্তু ওর অভিমান, রাগ, জেদ সব ওর বর্তমানকে নষ্ট করে দিয়েছে, নিজের বাবাকে ঘৃণা করতে গিয়ে কখন পুরো পুরুষ জাতের উপর থেকে বিঃশ্বাস উঠে গেছে বুঝতেই পারেনি। তাইতো সায়ানের এত বলার পরও ওকে বিশ্বাস করেনি বরং ভেবেছে সায়ানের জন্যই রুহান আজ নেই। একসময় এই জিনিসটা ও বুঝেছিল যে বর্তমান চলে যাচ্ছে কিন্তু নিজের ইগোর জন্য বলতে পারেনি, মনে হচ্ছিলো সায়ান আগে কথা বলুক। এই করে কবে যে এতোগুলা সময় চলে গেলো! ও পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্ত্রী, ও ক্ষমার যোগ্য নয় কিছুতেই না।

এলেক্স ইনান আর সামায়রাকে ফোন দিয়ে হসপিটালের এড্রেস দিয়েছিলো তাই তারা ইতোমধ্যে চলে এসেছে, সামু রুশির পাশে বসে রুশিকে শান্তনা দিচ্ছে আর ইনান ডক্টরের সাথে কথা বলতে চলে গেলো।



রোয়েনের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে ইনায়া, একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি যাতে অনেক সুন্দর কারুকাজ করা, মনে হচ্ছে খুব যত্নে গড়া আলিশান বাড়ি। ভেতরে যেতে নিলেই দারোয়ান বাধা হয়ে দাঁড়াল, বললো সাহেব বাসায় নেই আর এই বাসায় কোন মেয়ে এলাউড না। ইনায়া পড়লো মহা বিপাকে, ও রোয়েনের জ্যাকেট ফেরত দিতে এসেছিলো যা রোয়েন কালকে সকালে ফেলে এসেছিলো যদিও উদ্দেশ্য হচ্ছে রোয়েনের বাড়ি দেখা। দারোয়ান বডিগার্ডকে আসতে বললো এফাকে ও চারপাশটা দেখছে, বাড়ির সামনেই সুইমিংপুল, পাশে নানা ধরনের বিদেশি ফুলের বাগান আর বাগানের মাঝখানে দুজনের একটা দোলনা যাতে সতেজ ফুল দিয়ে কারুকাজ করা হয়তো প্রতিদিন নতুন করে ফুল লাগানো হয়। কতক্ষণ পর বডিগার্ড এসে ওকে দেখেই বিনতির স্বরে গ্রিটিং করলো তারপর ভেতরে আসতে বললো আর দারোয়ানকে একদফা বকা দিলো

ইনায়া মুখ ভ্যাংচি দিয়ে বললো “সেইতো ভেতরে ঢুকতেই দিলি তাহলে আগে এতো কাহিনী করলি কেনো?” বাংলায় বলায় দারোয়ান কিছু বুঝেনি তবে ব্যঙ্গ করে বলেছে তা ঠিক বুঝতে পেরেছে, দারোয়ানও চোখ গরম করে তাকালো যে কিনা ইয়াং একটা ছেলে আর ও আরেকদফা ভেংচি কেটে ভেতরে প্রবেশ করলো। মাঝেমাঝে এইরকম বাচ্চামো করতে মজাই লাগে, হিহিহি

ভেতরে ঢুকতেই সবাই ওকে ওয়েলকাম জানাতে লাগলো তারপর একজন ওকে রোয়েনের রুমে দিয়ে আসলো কিন্তু রুমে গিয়ে বুঝতে পারলো রোয়েন বাসায় নেই তাই ভাবলো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুক। যে ছেলে তার সো কল্ড টেন মিলিয়ন ডলার মাফ করে দিয়েছে তার জন্য এটুকু করাই যায়। পুরো রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো সাথে বড় করে রোয়েনের ছবি টাংগানো।

“বুঝিনা এর হাসতে কি মানা নাকি? সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে ” তারপর দুষ্ট বুদ্ধি মাথায় আসতেই খিলখিল করে হেসে উঠলো,”এবার বুঝবে মজা, কেমন লাগে হিহিহি”

এদিক সব দেখেও যখন রোয়েন আসছে না তখন ভাবলো একটা বই পড়ে নেয়া যাক। রুমে থাকা বিশাল বইয়ের সমাহার থেকে একটা বই টানদিতেই বইয়ের লাইব্রেরি দুইফাক হয়ে গেলো। আর একটা অনেক সুন্দর পরিপাটি রুম দৃশ্যমান হয়েছে। ইনায়া গুটিগুটি পায়ে সেই রুমের দিকে এগুলো আর সামনেই সেই পেইন্টিং পড়লো যা ও সেইদিন ওডিটরিয়ামে দেখেছিলো। পেইন্টিংটা খুব সুন্দর লাগে ওর তাই একটা ছবি তুলে নিলো। পুরোরুম জুড়ে একটা বাচ্চার ছবি যার সাথে কিছুকিছু ছবিতে একজন বুড়ো লোককেও দেখা যাচ্ছে। ইনায়া মজার ছলেই কতোগুলো ছবি তুলে নিলো। রোয়েনের ছোট আর বড়কালের ছবির মধ্যে বিস্তর ফারাক তবে একটা জিনিস চেঞ্জ হয়নি তা হচ্ছে গম্ভীর ফেস। একি মায়ের পেট থেকেই এমন?মনে হয় জন্মের পর মা মধু দিতে ভুলে গেছে।

আরেকটা ছবি তুলবে তখনি দেখে সায়রা ফোন করেছে যা জান দিয়ে সেভ করা। এই কয়দিন ব্যস্ততার জন্য কথা বলা হয়নি ওর সাথে।

“কিরে সায়রু বেবি হোয়াটস আপ?”

“ই…নু!”

“কি হয়েছে সায়রু কাঁদছিস কেন?কি হয়েছে বল?”

ইনায়া চিন্তিত ভংগিতে জিজ্ঞেস করলো, ছোট থেকেই অল্প কিছুতে পেনিক করার অভ্যাস ওর কিন্তু সায়রা বরাবরি স্ট্রং একটা মেয়ে। তাই এই সাহসী সায়রা হঠাৎ কাঁদছে তা শুনে ওর বুক চিনচিন করে উঠলো।

“ইনু,বাবাই খুব অসুস্থ হসপিটালে এডমিট আর মাম্মাও সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। আমার খুব ভয় করছে ইনু, তুই কি আসবি!”

“কি হয়েছে মামুর? আর মামি সেন্সলেস কেন হলো?”

“বাবাই এখনো ডাক্তারদের অবজারভেশনে আছে আর মাম্মা বেশি পেনিক করার কারণে সেন্সলেস হয়ে গেছে, তুই কি আসবি?”

“আমি আসছি, বাসায় গিয়ে প্যাক করেই রওনা দিবো”

ইনায়া যুক্ত্রাষ্ট্রের একজন নাগরিক, আর যেহেতু স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডনে এসেছে তাই যেতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। রোয়েনের বাসা থেকে এক প্রকার দৌড়ে বেরিয়ে এলো ও, কাউকে কিছু না বলে এভাবে চলে যাওয়াতে গার্ড- সার্ভেন্টদের সবাই বিব্রত হলো, রোয়েনের পরিচিত না হলে হয়তো চোর সম্মধোন করে আটকে রেখে দিতো।

বাসায় গিয়ে সব প্যাক করে ভিসা আর পাসপোর্ট নিয়ে সোজা রওনা দিলো এয়ারপোর্টের দিকে, বাসায় থাকতেই লস এঞ্জেলসের টিকেট কেটে ফেলেছে। এনাকে কোনরকম বুঝিয়ে রওনা দিলো ওর সেকেন্ড মাতৃভূমির দিকে যেখানে জন্ম, বেড়ে উঠা, এমনকি কৈশোরও কাটিয়েছে তবে তবুও দিনশেষে ও বাঙালী। এটাই হয়তো মাতৃভূমির টান যে অনেক দূরে থেকেও শিকড়কে ভুলা যায়না। ইনায়ার জীবনের আদর্শ পুরুষ হচ্ছে ওর মামা আর তার এই করুণ অবস্থা সত্যিই মেনে নেয়া যায়না। রীতিমত ফুফিয়ে কাঁদছে ও। পাশে থাকা পেসেঞ্জার অলরেডি কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে কি হয়েছে কিন্তু কিছুনা বলে ও ঘাপটি মেরে বসে আছে আর ভাবছে কখন পৌঁছাবে!

#চলবে

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখিবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here