বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ১৫

#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্বঃ ১৫

কিছুক্ষণ পুর্বেই রুশির জ্ঞান ফিরে এসেছে, শরীর দুর্বল থাকায় এতোক্ষন সেলাইন দেয়া ছিলো, ও উঠেই সেলাইনের পাইপ টেনে খুলে ফেলে যাতে সুঁই লাগানো স্থান থেকে রক্ত ঝরতে থাকে কিন্তু সেদিকে তার বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। বেড থেকে নামতে নিতেই মাথা কেমন যেন ঘুরিয়ে উঠলো তাই চাদর খামছে ধরে বসে পড়লো। শক্ত বন্ধনীতে চেপে ধরায় রক্ত আরো বেশি করে পড়তে থাকে আর কিছু অংশ গায়ে থাকা জামাতেও লেগে যায়, কোনরকম উঠে রওনা হলো সায়ানের কেবিনের দিকে, কেবিন থেকে বেরুতেই নার্স ওর পিছু পিছু আসতে থাকে আর বলতে থাকে

“মেম, ইউ আর উইক প্লিজ গেট বেক টু ইউর কেবিন ”

“স্যরি এই নিড টু সি মাই হাজবেন্ড!”

বলেই চলার গতি কিছুটা বাড়িয়ে দিলো আর সায়ানের কেবিনে আসতেই খুব জোরে কেবিনের দরজা খুললো যাতে ভিতরে থাকা নার্স আর ডক্টর ওর দিকে তাকায়। সায়ানের হাতেও সেলাইনের নিডল লাগানো আর ওর সেন্স নেই।

“ডক্টর এখন কি অবস্থা ওর?” রুশি চিন্তিত কন্ঠে বললো

“মিসেস খান আপনি এতোটা ডেস্পারেট হবেন না, আপনি আবার সেন্সলেস হয়ে যেতে পারেন। আপনি বাইরে অপেক্ষা করুন, আমি আসছি ”

একজন নার্স এসে রুশি বাইরে নিয়ে আসলো যদিও তা কিছুটা কষ্টসাধ্য ছিলো, কোন বাচ্চা যেমন তার পছন্দের খেলনা না পেলে সেই স্থান আকড়ে ধরে বসে থাকতে চায় তেমনি ও যেন সায়ানের কেবিনে একটু ঠায় খুজছিলো যাতে তার প্রিয়তমর প্রথম চোখ খুলে তাকানো দেখতে পারে,,
কিছুক্ষণ পর ডাক্তার কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো আর রুশি সেতো যেন এই মুহুর্তের অপেক্ষায় ছিলো, সায়ানের কেবিনে ঢুকে তার হাত ধরে বসে পড়ে। কেবিনে উপস্থিত নার্স বের করে দিতে চাইলে ও বলে

“আমি কোন সাউন্ড করবো না প্লিজ আমি চুপচাপ বসে থাকবো ”

ডাক্তার ইশারা করে থাকতে দিতে বলতেই নার্স আর মাথা ঘামায়নি, রুশি একবার ডাক্তারের দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে সায়ানের দিকে মনোযোগ দিলো,বা হাত চেপে ধরে বসে পড়লো ওর পাশে। এই কিছুক্ষনের মধ্যেই যেন তার দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী পুরুষটি নেতিয়ে পড়েছে। মুখ শুকনো আর ঠোট গুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ঠোটের গোলাপি আভা এই কয়েক বছরে ডার্ক কালারে রুপান্তরিত হয়েছে যাতে তাকে আরেকটু বেশি সুন্দর লাগে। এতোগুলা বছরেও যেন সেই ঠিক প্রথম দেখার মতো হ্যান্ডসাম লাগে।সবেচেয়ে হ্যান্ডসাম!

ডাক্তারের কেবিনে চিন্তিত ভংগিতে বসে আছে ইনান,ডাক্তারের বলা কথা তার টেনশনের মুল কারণ।

“দেখুন আপাদত কি হয়েছে তা আমি আপনাকে বলতে পারি, উনি কিছুক্ষণ পুর্বে হুশে ছিলেন তাই আমি তার সমস্যা গুলো জিজ্ঞেস করেছি যাতে আমার ধারণাই ঠিক ছিলো ওনার খ্রুনিক ব্রংকাইটিস হয়েছে যা দীর্ঘস্থায়ী। অনেক দিন ধরে ধুমপানের ফলে এই সমস্যা দেখা দেয়। এটা একটু জটিল সমস্যা হলেও নিরাময় যোগ্য আমি ভয় পাচ্ছি অন্য জায়াগায়। এই প্রদাহ জটিল সমস্যার দিকে ইংগিত করে যেমন লোভ কেন্সার, সিপিওডি তার জন্য পালমোনারি টেস্ট করেছি। কিন্তু ভয় হচ্ছে লোভ কেন্সার যদি প্রথম ষ্টেজে ধরার পর আরোগ্য হওয়ার চান্স ১৬.৮%। যদি পাচ বছরের কেমোথেরাপি দেয়া হয় তবে বেঁচে থাকার চান্স ১৪%। মার্কিন যুক্ত্রাষ্ট্রের ৭০ শতাংশ রোগি রোগ ধরার পর কমপক্ষে এক বছর বেচে থাকেন। তাই আপনারা দোয়া করুন যাতে রিপোর্ট ভালো আসে।
টেস্ট রিপোর্ট বেরুবে বিকাল পাঁচটায় তার আগ পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না”

ইনান ডাক্তারের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো, এখনো সায়ানের অবস্থা বলার মতো নয়, যেকোন কিছু হতে পারে কিন্তু একটা বিষয় ওকে আশ্চর্য করছে, সায়ান স্মোকিং কবে থেকে করছে আর ডাক্তারের মতে অতিরিক্ত স্মোকিং এর ফলে এই অবস্থা। এতোদিন একসাথে উঠাবসার পরও নিজের বেস্টফ্রেন্ডের মনের হাল ও বুঝতে ব্যর্থ। কেউ একজন ঠিকই বলে

“একজনকে মানুষকে অন্যকারো ততোটা বুঝার সাধ্য কারো নেই যতোটা সে নিজেকে নিজে বুঝে ”

তাই হয়তো সামনের মানুষটার হাসির আড়ালে ঠিক কতোটা কষ্ট লুকিয়ে যায় তা বুঝার সাধ্যি কারোর নেই। কেবিনের সামনে থাকা বেঞ্জে বসে পড়তেই সামু পাশে বসলো আর কাধে হাত রেখে বললো

“কি হয়েছে ভাইয়ার? হঠাৎ এরুপ কি করে হলো! ডাক্তার কি বলেছে?”

“এখনো কিছু বলতে পারছেনা, রিপোর্ট আসলে বুঝতে পারবে কি হয়েছে”

“সব ভাবির জন্য হয়েছে, এতোগুলা বছর ভাই কষ্ট করেছে শুধুমাত্র ভাবির জন্য।ভাবিকি পারতো না সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে? কিন্তু তা করেনি বরং অতীতকে পুঁজি করে বসেছিলো। ভাইয়ের কিছু হলে ক্ষমা করতে পারবে নিজেকে?এখন এতো আদিখ্যেতা দেখিয়ে কি হবে যখন বুঝার ছিলো তখনিতো বুঝেনি”

“বাইরে থেকে আমরা যা দেখছি তা দিয়েই জাজ করছি কিন্তু এটা ঠিক নয় সামু। একজন মায়ের কাছে তার সন্তান থেকে বড় কিছু নয়। ধরো যদি আমার ভুলের কারণে তোমার সন্তানের কিছু হতো তাহলে ক্ষমা করতে পারতে আমায়? হয়তো না।
কিন্তু এখানে রুশির ভুল কোথায় জানো? ও রুহানকে একা বড় করেছে তাই ওকে শুধুমাত্র নিজের সন্তান ভাবছে। ও যে সায়ানেরও ছেলে এই জিনিসটা ও বুঝতে পারছেনা তাই ও সায়ানকে ক্ষমা করতে পারছেনা। রুশি সায়ানের দিক থেকে বিষয়টা কখনো ভাবে নি তাই ও সায়ানের কষ্ট বুঝতে পারেনি। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো সবার মুভ অন করার ক্ষমতা থাকে না।
ও ছোট থেকে বিভৎস বাস্তবতা দেখে বড় হয়েছে তাই ও অতীত ভুলতে পারেনা। এই ধরনের মানুষগুলো অতীতে এতোটা ডুবে থাকে যে ওরা বর্তমান দেখতে পায়না আর মুভ অন করতে পারেনা। তুমি যখন জানতে পেরেছো যে সায়ানের ক্ষতি আমিও করেছি তুমি কিন্তু আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছো কারণ তোমার আমার প্রতি ভরসা ছিলো যে আমি ইচ্ছে করে করিনি। তুমি মুভ অন করতে পেরেছো কিন্তু সায়ানের প্রতি রুশির সেই ভরসার জায়গা তৈরি হওয়ার পুর্বেই ওই ঘটনা ঘটেছে তাই ও না বিশ্বাস করতে পেরেছে আর না ভুলতে। তাই রুশিকে কিছু বলার আগে ওর জায়াগায় এক মুহুর্তের জন্য নিজেকে বসাও”

ইনান মাথা এলিয়ে দিলো বেঞ্চে আর সামু ভাবতে লাগলো ইনানের একটা কথাও মিথ্যে নয় তবে কোথাও না কোথাও রুশির ভুল ছিলো নাকি ও সায়ানের বোন বলে দোষটা চাপিয়ে দিচ্ছে!

🌸🌸🌸

উত্তর-পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্র যুক্তরাজ্যের রাজধানী শহর হচ্ছে “লন্ডন”।শহরটি “গ্রেট ব্রিটেন” দ্বীপের দক্ষিণাংশের ‘টেমস নদীর’ তীরে অবস্থিত ইউরোপের বৃহত্তম শহর। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে এটি বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী নগরী ছিলো। লন্ডনের সময় বিকাল পাঁচটা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিটে রওনা দিয়েছিলো ক্যালিফোর্নিয়ার উদ্দেশ্যে যখন লস এঞ্জেলসের সময় ছিলো ৯টা বেজে সাঁইত্রিশ মিনিট।

কিছুক্ষণ পুর্বেই এয়ারপোর্টে পৌঁছেছে ইনায়া, ইমিগ্রেশন থেকে সব কিছু ঠিকঠাক করে বেরিয়ে পড়লো লস এঞ্জেলসের হসপিটালের উদ্দেশ্যে। জার্নিতে অনেকটা ক্লান্ত তাই টেক্সিতে বসেই গা এলিয়ে দিলো আর কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। চোখ খুলতেই নিজেকে ছোটখাটো একটা রুমে আবিষ্কার করলো, গায়ের কোট খোলা অবস্থায় নিচে পড়ে আছে। পুরো রুম জুড়ে উটকো মদের গন্ধ আর সিগারেটের ধোয়ায় ভরপুর,ও হাত দিয়ে ধোয়া সরাচ্ছে আর কেশে উঠছে। তখনি ছেলেদের হাসির আওয়াজ আসছে রুমের পাশ থেকে, তাকিয়ে দেখে তিন থেকে চারজন ছেলে বসে বসে জুয়া খেলছে আর ড্রিংক করছে। মুহুর্তের মধ্যেই ও বুঝতে পারলো ওর সিচুয়েশন কি তাই একমুহুর্তও দেরি না করে উঠে দাঁড়িয়ে দরজা ঠেলে দৌড় দিলো, পেছনে তীব্র আওয়াজে কতোগুলো পা ওকে ফলো করছে তা ঠিক বুঝতে পেরেছে। প্রায় অনেক দৌড়ানোর পর মেইন রোডে আসতেই ও কিছুটা স্বস্তি পেলো, পেটে হাত দিয়ে গুজো হয়ে হাপাচ্ছিলো তখনি চোখের সামনে তীব্র আলো এসে হানা দিলো। খুব দ্রুত গতিতে একটা গাড়ি ছুটে আসছে আর ও নড়তে চেয়েও পা যেন একটুও নড়ছে না। এই বুঝি জীবনের শেষ, মাম্মা, পাপা, মামা মামি আর সায়রু কারো সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। আচ্ছা রোয়েন! ওকি মিস করবে ওকে!

#চলবে

(আচ্ছা সায়ানের কিছু হলে আমাকে কি খুব বেশি বকা দিবেন! আর বাবারে বাবা রুশিকে এতো মানুষ দেখতে পারেনা তাতো আমি জানতামই না! কতোগুলো সারপ্রাইজ পেলাম 🙃🙃)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here