বৈবাহিক চুক্তি পর্ব ২৯

#রোদে_ভেজা_মেঘ
#লিখাঃ Liza Bhuiyan
#বৈবাহিক_চুক্তি (সিজন ২)
#পর্বঃ২৯

সময় তার নিজ গতিতে চললেও চারপাশটা থমকে আছে, কারো মুখ থেকে কোন টু শব্দও বের হচ্ছে না, সায়রা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিজের বাবার দিকে যার চোখে এই মুহুর্তে অশ্রু টলমল করছে, ছেলেকে খুজে পাওয়ার সুখে নাকি নিজের রক্তের মুখে এত ঘৃণার বাণী শুনে!সায়রা দৃষ্টি সরিয়ে ছেলেটির দিকে তাকালো যে এখনো ঘৃণার চোখে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু ট্রিগার চেপে ধরেও শুট করছে হয়তো শুট করার সাহস জুগিয়ে তুলতে পারছেনা। এই ছেলেটি ওর ভাই!
ছোট থেকে মাকে অজানা কারণে অনেক কাঁদতে দেখেছে কিন্তু কারণ জিজ্ঞেস করে কোনদিন উত্তর পায়নি তাই একসময় হতাশ হয়ে জিজ্ঞেস করা ছেড়ে দিয়েছে। বাবা-মায়ের সম্পর্ক কিছুটা অস্বাভাবিক তা ছোট থেকেই বুঝতে পারতো কিন্তু তাদের কষ্ট দেয়ার ভয়ে কোনদিন জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠে নি
“মাম্মা তুমি বাবার সাথে কথা বলো না কেন?কেনো বাবা তোমাকে না ডেকে আমার মাধ্যমে তোমার সাথে কথা বলে?”
কিন্তু বরাবরের মতো প্রশ্নগুলো কখনোই করা হতোনা, কারণ ও জানে ওর মাম্মা খুবই সেন্সিটিভ। আজ এতোবছর পর বাবা মাকে স্বাভাবিক হতে দেখে ও খুব খুশি হয়েছিলো। নিজ হাতে তাদের সাথে সেলিব্রেট করেছিলো ওদের এনিভার্সিটি। কিন্তু ওর ভাই, বাবা-মাকে কখনো ওর ভাইকে নিয়ে কথা বলতে দেখেনি যদিও ঘরে একটা বাচ্চার ছবি দেখেছিলো কিন্তু কোনদিন প্রশ্ন করা হয়ে উঠেনি। তবে কি ওর কোন ভাই ছিলো আর সেটা এই সামনে থাকা ছেলেটি! তাহলে কোথায় ছিলো এতোবছর সে?আর আজই কেনো বা এখানে দৃশ্যমান হলো তাও এই ভাবে?

“রু্ রুহান…”

ইনায়ার কন্ঠস্বরে সায়রার ভাবনায় ছেদ ঘটলো, ওর দৃষ্টি ইনায়ার দিকে দিতেই দেখলো, ইনায়া ক্ষীণ পায়ে এগিয়ে আসছে ছেলেটির দিকে, ওর হাত পাঁ কাপছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিছুদূর এগুতেই ইনায়া হুট করে পড়ে গেলো যাতে সামনে থাকা ছেলেটি ছুটে গিয়ে ওকে সামান্য তুলে নিজের সাথে মিশিয়ে ধরলো, তারপর চুলগুলো ঠিক করতে করতে শান্ত স্বরে বললো

“তুমি এখানে কিভাবে এলে? কে বলেছে তোমাকে যে আমি এখানে?আর তুমি কি করে জানলে আমার নাম রুহান?”

রোয়েনের কথায় ইনায়ার কোন হেলদোল হলোনা, ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রোয়েনের দিকে। যে চোখে নিজের জন্য এতোটা ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছে কিছুক্ষণ পূর্বেই এই চোখ ঘৃণায় ছেয়ে ছিলো তাও নিজের জন্মদাতা পিতার জন্য!

রোয়েনই যে রুহান তা ও জানতে পেরেছে কয়েকদিন পুর্বে যখন ময়মনসিংহে গিয়েছে তখন,বিয়ের দিন সকালে খুব ভোরে উঠে চারপাশটা ঘুরে দেখেছিলো ও, তখনি একটা রুমে ছিটকিনি লাগানো অবস্থায় দেখলো। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে রুমটির দরজা অন্য সকল রুমের দরজা থেকে আলাদা আর কেমন যেনো অদ্ভুত সব কারুকার্য। প্রথমে সেটা পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে যেতে নিয়েও কি মনে করে সেই রুমে প্রবেশ করলো। রুমটায় অনেক দিন যাবৎ কারো চলাচল নেই তা রুমের অবস্থা দেখেই বুঝা যাচ্ছে,কিছুটা ধুলা ইনায়ার নাকে যাওয়ায় খুকখুক করে কেশে উঠলো তারপর হাত মুখের সামনে নাড়িয়ে ধুলা সরানোর চেষ্টা করলো, আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রুমটায় পুরোনো বেশ কিছু সরঞ্জাম রয়েছে, দেয়ালে থাকা ঝংকার ধরা ফ্রেমগুলো ধুলোবালিতে ছেয়ে আছে যাতে বেশ কিছু ছবি রয়েছে তবে অস্পষ্ট! ইনায়ার আশেপাশে খুজে কিছু না পেয়ে নিজের গায়ে জড়ানো শাল দিয়ে মুছে নিলো আর তাতেই একজন ষাটোর্ধ লোকের চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠলো তাতে ইনায়া চমকে উঠলো। এই চেহারা খুব ভালো করে চিনে ও, রোয়েনের সবচেয়ে কাছের লোক ওর বড় আব্বু হয় এই লোক। তবে বিস্ময়ের সীমা সেখান পর্যন্তই ছিলো না, কোলে থাকা ছেলেটিকে দেখে ওর পিলে চমকে উঠলো। কাঁপা হাতে নিজের ফোন খুলে গেলারিতে ছবি খুঁজতে থাকলো, একসময় পেয়েও গেলো। সেই চেহারা,সেই চোখ আর সেই গম্ভীর মুখভঙ্গি! কিন্তু এই বাড়িতে এই ছবি কি করছে?
ও দ্রুত বাকি ছবিগুলো দেখা শুরু করলো আর অবাক হয়ে কয়েকপা সরে গেলো। ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সায়ানের কোলে সেই বাচ্চাটি মানে রোয়েন। ও জোরে জোরে শ্বাস নেয়া শুরু, খুব কষ্ট হচ্ছে চোখের সামনে থাকা জিনিসগুলো মেনে নিতে।
ও পিছনে পড়ে যেতে নিলেও একজন এসে ধরে ফেলে, ও তাকিয়ে দেখে এই বাড়ির কেয়ার টেকার আন্টি ‘মনি খালা’। তিনি কিছু ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললো

“আম্মা আমনে এইহানে কিতা করেন? জানেন না এই রুমে আওন নিশেধ!এই রুমে যারা থাকতো তারা মারা গেছে তাই এইহানে কেউ ঢুকে না”

খালার কথায় ইনায়ার কোন হেলদোল হলো না, হয়তো কানেই ঢুকে নি। একদৃষ্টিতে ছবিগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, নিজেকে কিছুটা সামলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো

“খালা! ওই ছবিগুলোতে বাচ্চাটির ছবি সে কে?”

“ওই পোলা হইলো গিয়া এই বাড়ির ছোট সাহেব, সায়ান ভাইসাবের পোলা। নাম হইছে গিয়া রুহান! কিন্তু গাড়ি এক্সিডেন্টে মইরা গেছে। তারপর থেকেই মেডাম কেমন জানি হইয়া গেছিলো, সাবের লগে কথা কইতো না। তারপর তো চইলা গেলো এই শহর ছাইড়া চইলা গেলো। এখন তো দেখি সব ঠিকঠাক হইয়া গেছে সাবের লগে। তয় পোলাডা খুব ভালা আছিলো, কার যে নজর লাগছিলো!”

মনি খালা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো, তারপর ইনায়াকে টেনে সেই রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। রুহান মরে যাওয়ার পর থেকে এই রুমে ঢুকার সাহস পায়নি আর এমনকি আশেপাশের আসেও নি। তাছাড়া তার বিঃশ্বাস যেসব মেয়ের বিয়ে হতে নেয় তাদের উপর ভুত আসর করার সম্ভাবনা বেশি তাই ইনায়াকে চোখে চোখেই রাখছিলো। ভাগ্যিস এখানে আসতে দেখেছে নাহয় বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারতো!
তিনি ইনায়াকে ঘরে পৌঁছে কয়েকদফা সাবধান করে চলে যান। ইনায়া পুরো রাস্তায় হিসাব মিলাতে মিলাতে আসছিলো, প্রথমে মনে পড়লো সেই ছবিটির কথা যা পদর্শনিতে দেখেছিলো যার ঠিক নিচে লিখা ছিলো “RJK” যার মানে এখন বুঝতে পারছে “রুহান জামিল খান”। তারপর কিছু একটা ভেবে নিজের ফোন বের করলো আর সেই নারীর ছবি বের করলো। গভীর ভাবে কিছুক্ষণ তাকানোর পর বুঝতে পারলো এটা ওর মামির ছবি, কিন্তু পুরোপুরি মামির সাথে মিলে না তবে অনেকখানি মিলে যায়, অনেকখানি!

ইনায়া উচ্ছাসিত হয়ে রোয়েনকে ফোন দিতে গিয়ে বুঝতে পারলো ওর সিম প্রায় একমাস পুর্বে ওর মা নিয়ে গেছে আর ওর মোবাইলে কোন এম্বি নেই যে রোয়েনকে বলবে। আর মামা মামিকে বললেও বা কিভাবে নিবে ও বুঝতে পারছিলো না তাই রাফিনকে ডেকে ওকে পুরোটা খুলে বললো কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারলো ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে। ওর কথা কেউ শুনতে চায়নি, না ওর মা, না ওর বাবা এমনকি মামা-মামিও না। কারণ বাবা মা নিষেধ করে দিয়েছে তারা যাতে ওর সাথে দেখা না করে আর সায়রাও আশেপাশে ছিলো না। তাই একমাত্র উপায় ছিলো রোয়েন তাই রাফিনকে বললো এম্বি এনে দিতে কিন্তু মায়ের কাছে ধরা খেয়ে যায় আর ইনায়ার মা ওর ফোন নিয়ে চলে যায়। ও খুব করে চেয়েছিলো রোয়েনকে বলতে যে ওর বাবা-মা কে?
পরে ভাবলো রোয়েন হচ্ছে জঘন্য এক মাফিয়া যার মানুষ খুন করতে হাত কাঁপে না। মামা মামি যদি জানতে পারে তাদের সন্তানের এই অবস্থা তাহলে বেঁচে থেকেও মরে যাবে আর রোয়েন…
ইনায়া সেই মুহুর্তে আর ভাবতে পারছিলো না, ওই মুহুর্তে ঠিক ওর কি করা উচিৎ। প্রচণ্ড মাথা ব্যথায় ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো যতোক্ষণে ঘুম ভেংগেছে তখন প্রায় সন্ধ্যা, সবাই ওকে সাজানোতে ব্যাস্ত ছিলো তাই কাউকে কিছু বলতে পারেনি। ঠিক বলতে পারেনি না, ওকে বলতে দেয়া হয়নি! নিয়তি মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিলো না ওর।

রোয়েনের ক্রমাগত মৃদু ধাক্কায় ওর হুশ ফিরে আসলো, বুঝতে পারলো ও রোয়েনের বাহুডোরে শুয়ে আছে। তাই ও মৃদু কন্ঠে বলে উঠলো

“নিজের বাবা জেনেও তাকে খুন করতে চান আপনি! আর কতো নিচে নামতে চান আপনি?এই খুন করে কি হাসিল করে ফেলবেন আপনি?”

রোয়েন ওর কথায় চোটে গেছে ও বুঝতে পারছে, রোয়েন নিজের চোয়াল শক্ত করে বললো

“শান্তি… বুঝতে পারছো শান্তি পাবো আমি! বড় হওয়ার পর থেকে শুধু তার জন্য আমার ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই।সে আমার জন্মদাতা হতে পারে তবে আমার বাবা নয়। আমার জীবনের একটাই লক্ষ্য তা হচ্ছে এই লোকটিকে শেষ করা। তুমি জানতে চেয়েছিলে না আমি কেনো মাফিয়া হয়েছি?এই লোকটির জন্য, এই লোকটিকে খুজে বের করার জন্য তারপর আমার মায়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য”

রোয়েন তেজি বাঘের মতো উঠে দাঁড়ালো তারপর হাত থেকে পড়ে যাওয়া গান উঠিয়ে সায়ানের দিকে তাক করলো, সায়ান নির্বিকার হয়ে ছেলের দিকে চেয়ে আছে। নিজের ছেলের চোখে ঘৃণা দেখার থেকে মরে যাওয়া উত্তম তাই চোখ বন্ধ করে ফেললো ও।

সায়রা ক্রমাগত গাড়ির দরজা খুলার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে, আর বাবাই বলে চিৎকার করে যাচ্ছে। আর ইনায়া রোয়েনের নাম ধরে তাকে থামানোর কথা বলছে, ওর সমস্ত শরীর যেনো অসাড় হয়ে আছে। উঠার চেষ্টা করেও উঠতে পারছে না, তখনি তীব্র আওয়াজ হলো! ইনায়া তাকিয়ে দেখলো ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে ক্ষুব্ধ চোখে, থাপ্পড়টা সেই মেরেছে রোয়েনের গালে। কিন্তু রোয়েনের সেদিকে খেয়াল নেই, ও নিজের থেকে তিনফুট দুরত্বে তাকিয়ে আছে। পড়নে মেজেন্ডা কালারের শাড়ি পড়া এক মধ্যবয়সী নারী দাঁড়িয়ে আছে ওই লোকটির কাছে, হ্যাঁ ওই লোকটি যে ওকে জন্ম দিয়েছে!
ওর চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো, অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো “মাম্মা…”

#চলবে

(আচ্ছা অতীত আর বর্তমান কি খুব বেশি গুলিয়ে যাচ্ছে আপনাদের কাছে?আপনারা কি বুঝতেই পারছেন না কোনটি অতীত আর কোনটি বর্তমান? আমি অনেক দুঃখিত গুছিয়ে লিখতে না পারার জন্য 😥)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here