ভালোবাসি বলেই তোমাকে প্রয়োজন পর্ব -১০

#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০

টেবিলে রাতের খাবারের আয়োজন করছে শারমিন। তার বাবা পাশেই সোফায় বসে টিভি দেখছেন। চোখ টিভির দিকে থাকলেও মন অন্যদিকে তার। তিনি সীমান্তকে আগামীকাল মায়ের সাথে আসতে বলেছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত মেয়েদেরকে সে বিষয়ে কিছুই জানান নি। বড় মুখ করে বলে এসেছে মেয়েরা তার উপরে কোন কথা বলে না। কথাটা সত্যি হলেও বিয়ের সিদ্ধান্ত কাউকে না জানিয়েই নিয়ে নিয়েছেন সেটা জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া ঠিক কি রকম হবে সেটাই এখন চিন্তার বিষয়।
–বাবা খেতে এসো।

শারমিনের আওয়াজে চমকে উঠলেন তিনি। টিভি বন্ধ করে উঠে চেয়ারে বসলেন। তাকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। শারমিন আরেকটা চেয়ারে বসে বললেন
–কোন সমস্যা হয়েছে বাবা? তোমাকে এরকম চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?

তার বাবা চোখ তুলে মেয়ের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললেন
–সারিয়া কোথায়?

–আসছে।

বলেই শারমিন প্লেটে খাবার বেড়ে দিল। নিজেও বেড়ে নিলো। ঠিক সেই সময় সারিয়া তড়িঘড়ি করে এসে শারমিনের পাশের চেয়ারটা টেনে বসে পড়লো। ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলল
–খুব ক্ষুদা পেয়েছে আপু। তাড়াতাড়ি খেতে দাও।

শারমিন প্লেট এগিয়ে দিলো। সারিয়া সেটাতে নিজের মতো খাবার তুলে নিলো। এক লোকমা খাবার মুখের কাছে ধরতেই তার বাবা বললেন
–সীমান্তর সাথে তোমার কোন কথা হয়েছে সারিয়া?

নামটা কানে আসতেই সারিয়া থেমে গেলো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। তার বাবা সীমান্তকে কিভাবে চিনল? বুঝেও অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো
–জি বাবা?

তার বাবা এবার নড়েচড়ে বসলেন। স্বাভাবিক ভাবেই বললেন
–সীমান্তের সাথে আজ দেখা করতে গিয়েছিলাম।

সারিয়া এবার থমকে গেলো। তার মনে চাপা রাগের আবির্ভাব দেখা দিলো। সীমান্ত তার বাবাকে কেন ডেকেছিল? সারিয়ার রাগের আভাস তার মুখেও দেখা দিলো। ভেবেই নিলো খাবার শেষ করে সীমান্তকে ফোন করে কথা শোনাবে। তার বাবা সারিয়ার মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলেন। প্রতিক্রিয়া বোঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু কিছুই বুঝতে না পেরে বললেন
–সীমান্তের সাথে যে তোমার ভালো সম্পর্ক আছে সেটা আগে বলনি কেন? কি ভেবেছিলে বাবা রাগ করবে? বাবা হিসেবে আমি চাই তোমাকে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দিতে। সীমান্ত নিঃসন্দেহে একজন ভালো ছেলে। সে আজ আমাকে ডেকেছিল তোমাদের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে। আমার ছেলে ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি তো রাজি হয়ে গেছি।

সারিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল
–কি বলছ বাবা? বিয়ে মানে? তুমি আমাকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিলে কেন? আর কে বলেছে তোমাকে উনি ভালো ছেলে? কতটুকু জানো ওনার সম্পর্কে?

সারিয়ার বাবা সরু চোখে তাকালেন। মেয়ের এমন কথার ধরন তার ভালো ঠেকল না। গম্ভীর আওয়াজে বললেন
–আমি কতটুকু জানি সেটা আমাকেই বুঝতে দাও। কিন্তু সীমান্ত যখন নিজে থেকে বিয়ে করতে চেয়েছে তখন সেখানে না বলার কোন প্রশ্নই আসে না। এমন ঘর এমন পাত্র কোনটারই যোগ্যতা তোমার নেই। তবুও ভাগ্যক্রমে পেয়ে যাচ্ছ। নিশ্চয় এমন কোন পুন্যের কাজ করেছ যার বিনিময়ে সৃষ্টিকর্তা তোমাকে এমন সুখের মুখ দেখাচ্ছেন। এখন আর এই বিষয়ে কোন কথা হবে না।

শারমিন এতক্ষন তাদের কথা শুনছিল চুপ করে। তার বাবা থেমে যেতেই বলল
–কে সীমান্ত? কার সাথে তুমি বিয়ে ঠিক করেছ বাবা?

–সীমান্ত প্রোডাকশনের মালিক।

বাবার কথা শুনে শারমিনের চোখ কপালে উঠে গেলো। এতো বড় একজন মানুষ তার বোনকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ভাবতেই তার অবাক লাগছে। কিন্তু সারিয়ার এমন কথা বলার পেছনের কারন কি? সারিয়া তীব্র প্রতিবাদের সুরে বলল
–আমি এই বিয়েতে রাজি না বাবা। তুমি না করে দাও। আর আমি এমনিতেই এখন বিয়ে করবো না। আমাকে এই বিষয়ে ভাবতে হবে। আমার সময় প্রয়োজন।

তার বাবা তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। কিছুক্ষন ওভাবে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলেন। এতো সহজ ভাবে কথা বলে সারিয়াকে কিছুতেই রাজি করানো যাবে না। মেয়ে তার জেদ নিয়েই বসেছে। নিজেকে শক্ত হতে হবে। তারপর মেয়েকে জব্দ করতে হবে। যে করেই হোক এই ছেলেকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যাবে না। তিনি হুঙ্কার ছেড়ে বললেন
–আমার কথার উপরে কথা বলে কি প্রমান করতে চাও? তুমি খুব বড় হয়ে গেছো? নিজের সমস্ত দায়িত্ব নিজে নিতে শিখেছ? কোথায় ছিল এই কথা তোমার যখন তোমার মা মারা গিয়েছিল। আমি তোমাকে সেই ছোট থেকে কষ্ট করে বড় করেছি। আর আজ পড়ালেখা করে কিছু উপন্যাস লিখে নিজেকে খুব বড় ভাবছ। আমার সেসব কষ্টের প্রতিদান আজ এই দিচ্ছ তাই না? তোমার বাবা হিসেবে ভালর জন্য জীবনের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে অপরাধ করে ফেলেছি। ঠিক আছে। আমি বড় মুখ করে বলে এসেছিলাম সীমান্তকে। আমার মেয়েরা আমার কথার উপরে কোন কথা বলে না। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে তারা এখন বড় হয়ে গেছে। আমার কোন কথার মুল্য আর আগের মতো নেই। তাই আর কি করার। না করে দেবো তাদেরকে।

বলেই খাবার ছেড়ে উঠে গেলেন তিনি। সারিয়া স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। বাবার কথা গুলো তাকে ভালভাবে ঘায়েল করতে পেরেছে। সারিয়ার বাবা বেশ বুঝে শুনেই মেয়ের দুর্বল জায়গায় আঘাত করেছেন। চোখ বেয়ে তার দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। সীমান্ত সম্পর্কে তার বাবা কিছুই জানে না। কিন্তু এতেই বা তার বাবার দোষ কোথায়। সীমান্তকে দেখলে কেউ কখনো ধারনা করতে পারবে না। সবার কাছেই সে খুব ভালো মানুষ। কিন্তু এখন বাবাকে কিভাবে বলবে এসব কথা। চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। শারমিন গম্ভীর স্বরে বলল
–তোর কি অন্য পছন্দ আছে?

সারিয়া শান্ত চোখে তার দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে না বলল। শারমিন খুব সহজ ভঙ্গীতে বলল
–তাহলে এখানে বিয়ে করতে তোর এতো আপত্তি কেন?

সারিয়া একটা শ্বাস টেনে ভাবতে লাগলো। আসলেই সীমান্তকে বিয়ে করতে তার আপত্তিটা ঠিক কোথায়? তার প্রতি সীমান্তের যে একটা দুর্বলতা কাজ করত সেটা বুঝতে তার অসুবিধা হয়নি। এমন কি বিভিন্ন সময়ে সীমান্ত তার আচরনেও সেটা প্রকাশ করেছে। সেসব আচরন তো তার দুর্বলতা থেকেই আসতে পারে। তাই বলে একজনকে চরিত্রহীন ভাবাটা নিতান্তই ভুল। তবুও মনের কোথাও যেন একটা বাধা। সায় দিতে পারছে না কিছুতেই। কারণটা স্পষ্ট নয় তার কাছে। তীব্র ভাবে বোঝার চেষ্টা করতেই মস্তিস্ক তাকে অরন্যর কথা জানিয়ে দিলো। আঁতকে উঠলো সারিয়া। অরন্যকে সে শুধুই একজন ভালো বন্ধু ভেবেছিল। আর ঢাকায় আসার পর থেকে তো তার সাথে যোগাযোগও করেনি। তাহলে কেন অরন্যর কথা মনে পড়ে গেলো। তাহলে কি অরন্যর জন্য তার মনে কোন অনুভূতি তৈরি হয়েছে? প্রচণ্ড ভাবনায় ডুবে গেলো সে। এই বিয়েতে তার মন সায় না দেয়ার কারন হিসেবে অরন্যকে কিছুতেই মানতে পারল না সারিয়া। এবার জেদ চেপে গেলো। অরন্যর সাথে তার এমন কোন সম্পর্ক নেই যার কারনে এই বিয়েতে সে না করবে। এবার বাবার কথা মাথায় আসতেই আবারো আবেগি হয়ে উঠলো। কেদে ফেললো সে। ওড়নায় মুখ চেপে কাদতেই শারমিন মাথায় হাত দিলো। শান্তনা দিয়ে বলল
–বাবা তোর ভালই চাইবে। অন্য কোন কারন না থাকলে না বলিস না। বাবা ভীষণ কষ্ট পাবে। তুই তো দেখেছিস মা মারা যাওয়ার পর বাবা আমাদেরকে খুব কষ্ট করে মানুষ করেছে। নিজে বিয়ের কথাও ভাবেনি।

শারমিন থেমে গেলো। খাবার ছেড়ে উঠে গেলো। সারিয়া ওখানেই বসে থাকলো চুপ করে। আজ রাতে আর কারো খাওয়া হল না।

—————
মধ্য রাত। নির্ঘুম চোখ জোড়া নিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। বিক্ষিপ্ত মস্তিস্কে এলোমেলো ভাবনা। কিছুতেই কোন একটা সিদ্ধান্তে পৌছতে পারছে না সারিয়া। একটা পিছুটান কাজ করছেই। কিন্তু সেটাকেও মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। শারমিন ঘুম থেকে উঠে তার দিকে তাকাল। সারিয়াকে এই অবস্থায় দেখে তার খুব খারাপ লাগছে। উঠে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বলল
–এতো রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন? চল ঘুমাবি।

সারিয়া ঘুরে তাকাল। রক্তিম চোখ জোড়া ফুলে উঠেছে। কান্না করছে অনবরত। শারমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
–বিয়ে করতে না চাইলে করবি না। তোকে কেউ ধরে বেধে বিয়ে দেবে না। বাবা হয়তো একটু কষ্ট পাবে। কিছুদিন মন খারাপ করে থাকবে। কিন্তু ঠিক হয়ে যাবে। কতদিন আর তোর উপরে রাগ করে থাকবে। বাবা তোকে খুব ভালবাসে রিয়া।

সারিয়া কেদে ফেললো। শারমিন বোনকে খুব জত্নে আগলে নিলো বুকে। বেশ কিছুক্ষন নীরব থাকলো দুজন। দুজনের মন বেশ বিক্ষিপ্ত। এক পর্যায়ে শারমিন বলল
–চল ঘুমাই। কাল সকালে উঠে বাবাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। তুই ভাবিস না।

বলেই বিছানার দিকে পা বাড়াল। সারিয়া শান্ত কণ্ঠে বলল
–কিছু বলতে হবে না আপু। বাবার সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভালো হবে। আমার কোন আপত্তি নেই।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here