ভালোবাসি হয়নি বলা পর্ব ১১

#ভালোবাসি হয়নি বলা
#সাদিয়া নওরিন

পর্ব— ১১

আমি ইফ্ফাত আর ইফতিভাই পাশাপাশি হাটছি.. ইফ্ফাত আর ইফতী একজন অন্যজনের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে.. হয়তো তারা একজন অন্যজনের সাথে কথা বলে ইচ্ছুক. আমি আস্তে আস্তে তাদের থেকে সামনে এগিয়ে গেলাম..
সবাই যারযার মতো বিজি.. আরাফ, সাদাত আর মেহেদী ওদের মতো গল্প করছে.. সুনানভাই, আদি, আলভী, সিয়াম ওরা অন্যবিষয় নিয়ে হাসাহাসি করছে.. আমি ওদের দিকে তাকিয়ে আনমনে হেসে দিলাম.. সিয়াম, আলভী আর আদী ওরা আমার সমবয়সী. হয়তো হালকা বড়.ওদের দিকে তাকিয়ে আমি আমাদের শৈশবে ডুব দিলাম..
যখন আমরা ছোট ছিলাম আমাদের লাইফটা অন্যরকম ই ছিল.. আমরা ছেলে মেয়ে এমন কোন ভেদাভেদ ছিলই না আমাদের মাঝে.. একসাথে খাওয়া, খেলাধুলা করা সবযেন একসাথেই.. আমিও তখন ওদের মতো জিন্স আর টিশার্ট পড়তাম..আর এই কারনে কেউ কারো বাসায় গেলে ড্রেসের কথা চিন্তা করতে হতো না.. নিজের ভাইবোনের মতোই ছিলাম আমরা.. আর সময়ের সাথে যেন সবকিছু পাল্টাতে শুরু করলো.. যে যার লাইফ নিয়ে সমানে বিজি আর এর ভিতরে নানুর বাড়ির কিছু স্ট্রিক নিয়ম.. ছেলে মেয়ে বেশিখন বসে গল্প করলেই মনে করা হয় তারা রিলেশনে আছে.. আর এইকারনে ওদের সাথে এখন তেমন একটা কথা ও হয় না.. ওরাই এড়িয়ে চলে আমাদের.. কি দরকার যেচে পড়ে সমস্যায় জড়ানোর.. তবে সুনান ভাই আর আমার মাঝে এই একটাই খুব কমন তা হলো আমরা স্বাধীনচেতা.. আমরা এই রুলসগুলো না ফলো করি না পছন্দ করি.. আর তাই আজকে এই সমস্যার সৃষ্টি…
হঠাৎ সুনান ভাইয়ের আওয়াজ কানে এলো.. ওদের নিয়ে চিন্তা করতে করতে কখন ওদের দলের কাছে চলে এসেছি খেয়াল নেয়..
তিনি হেসে বলল– আরে,, ইস্পার কাজিন সিনান কতো কিউট তাই না.. ক্রাশ খাওয়ার মতো মেয়ে. ভাবতেছি প্রেম করলে মন্দ হবে না.. এই কথা শুনে আলভি হেসে– আরে ভাই,, তাহলে সরাসরি বলতেন ওরে.. আমাদের এতো সুন্দর ভাইকে মানা করবে না সে.. সুনান ভাই নিজের কলার ঠিক করে হালকা ভাব নিয়ে বলল..আরে নাম্বার নি নাই তো.. তবে কালকে অনেকখন কথা বলছি…
আচ্ছা তাহলে এই ব্যাপার… কালকে সিনান ভাই আপুূদের সাথে গল্প করতে গিয়েছিল. আর শেষে সন্দেহের তীরটা আমার দিকেই এলো.. আমি মাথা ধোলিয়ে নিজের দিকে তাকালাম.. আমার জন্য কয়েকবালতি সমবেদনা.. এইসব ভাবতে ভাবতে আমি পাশে তাকালাম আর দেখলাম কাকলি আপু আগের মতো সেইম স্হির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন. ওনার কনফিউসনটা দূর করা দরকার. তাই আমি ওনার কাছে গিয়ে দাড়লাম আর বললাম— আপু আসলে…
তখন আমাকে থামিয়ে তিনি বলল– দেখ রোদেলা,,, তুৃমি আমাকে তোমার শত্রু ভাবছো.. কিন্তু আমি তোমার শত্রু না.. না আমি তোমার কোন খারাপ চায়.. তোমাকে ছোট বোন ই ভাবি আমি.. তাই আগে থেকে সাবধান করা.. কিন্তু যদি তাও তোমার মন মতো চলো আমার কিছুই করার নেই.. এই বলে তিনি সামনে হেটে চলে গেল..
আমি আর আমার কথাটা শেষ করতেই পারলাম না.. ছোটবোন ভাবে তো আমার কথাটা শুনলে কি এমন ক্ষতি হতো.. অতিরিক্ত অভিমান ভর করলো আমার মনে আর সাথে চোখে কোনে পানি.. পানিগুলো অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়লো আখি থেকে…

হাটতে হাটতে ডলুখালের কাছে পৌছালাম আমরা.. এখান থেকে নৌকা অথবা সাঁকোতে পার হতে হবে আমাদের… সাঁকোতে তো জিবনেও ওঠব না আমি.. কাকলি আপুকে দেখলাম মুখ বিকৃতি করে সাকোর দিকে তাকালো.. আমি সেইদিকে হেসে তাকালাম.. এই মেয়েটার মতো নাকি আমি সবাই ছোট থাকতে বলতো.. আসলে হালকা কিছু মিল আছে জাষ্ট.. আর চেহারা হালকা মিলে.. যেখানে মেঘলা আপুর সাথে তেমন চেহারার মিলই নেয় আমার.. অবশ্যই আমার সাথে কারোর ই তেমন মিল নেই.. কারন আপুরা অনেক শান্ত.. যেমন কাকলি আপু আর রোদেলা আপু দুইজনই অনেক চুপচাপ.. কিন্তু কাকলি আপুর সাথে আমার কিছুটা মিল শুধুই এইটাই দুইজনই ভিতু.. যেমন এখন কারোরই সাকোতে ওঠতে ইচ্ছে হচ্ছে.. ওনি ঘোষনা করে দিল আমরা নৌকায় যাব.. যদিও এইটাও আমরা ভয় পাই..
হঠাৎ আমার সামনে এসে হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে গিয়ে আলভীর হাতে তুলে দিয়ে বলল– বোনের ব্যাগ নিতে হয় এইটাও শিখানো লাগে.. এইবলে মুচকি হেসে আবার ভাইয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো.. আমি আনমনে হেসে দিলাম. এইজন্য বড় বোন বড় বোনই হয়.. ছোটরা শুধু রাগ ই দেখাতে পারে.. রাগের ভিতর ও বড়দের ভালোবাসা থাকে.. মেঘলা আপু হেসে বলল– কাকলি,, ভিতু.. চলনা সাঁকোতে ওঠি.. ও মুখ ফুলিয়ে বলল– তুমি যাও.. সম্ভব না আমার পক্ষে এইসব.. তারপর আমাকে ধরে বলল চল আমরা নৌকায় যাব..আমি হেসে তারদিকে তাকালাম.. ওকে দেখেই মনে হচ্ছেই না কিছুখন আগে কিছু বলছে আমাকে..

আমি হেসে ওর হাত ধরে হাটতে লাগলাম.. মেঘলা আপু আমাদের সাথে যোগ দিল.. আর তা দেখে আমরা হেসে দিলাম.. ইফ্ফাত ভয়ে ভয়ে বলল– আমি ওঠতে পারি না নৌকায়.. ইফতীভাই মুচকি হেসে বলল– আমি ধরবো তোমায়..আমি আছি কেন.. ইভান জোরে শিষ দিয়ে ওঠলো আর ভাইরা ওহহহহ বলে চিৎকার.. বেচারা আর বেচারী লজ্জায় লাল হয়ে ওঠলো এইসব দেখে.. আপুরা হঠাৎ এসে বলল– আবার কি নিয়ে শিয়ালের মতো করতেছিস তোরা..আর তা শুনে আমরা এমন ভাব করছি একেকজন যেন আদো আমরা কোন শব্দ শুনিও নায় করাতো তো দূরের কথা..
আপুরা সন্দেহ ভরা চোখে তাকিয়ে আবার চলে গেল.. সুনান ভাই হেসে বলল– দেখছো তোমাদের বাচিয়ে দিলাম.. আদি ভাই হেসে বলল– কিন্তু ভয়েস তো আপনার টা ই শুনছে ওরা বেশি.. যে হাসি আপনার..

তারপর আমরা সবাই আবার হাসি দিয়ে দিলাম.. আর সুনান ভাই গালফুলিয়ে তাকালো আমাদের দিকে.. শেষে আপুদের অন্যপাড়ে দিয়ে নৌকা আবার আমাদের দিকে আসলো.. আর আসার সাথে সাথে ভাইরা সবগুলো ওঠে বসলো.. আদি আর আলভী ভাই নৌকার গলুই এ বসে পড়লো.. হাত দুইটা টাইটানিক স্টাইলে ছড়িয়ে পানি ধরতে লাগলো তারা ..আমার তো দেখেই ভয় লাগছে এসব.. আমি আস্তে আস্তে দুকদম পিছিয়ে গেলাম.. ইফতী ভাই নৌকাই ওঠে হাতটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিল আর ইফ্ফাতকে ইশারা করলো.. ইফ্ফাত সে দিকে একঝলক তাকিয়ে আবার এদিক ওদিক তাকাতাতে লাগলো.. বেচারী লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হচ্ছে আর আমি মুখ টিপে হাসছি.. হঠাৎ সিয়াম হেসে বলল– ডোন্টওয়ারি গাইজ, আমরা কিছুই দেখি নাই.. তারপর সবাই আরেকদফা হাসি.. এই পোলাগুলার হাসির কারন লাগে না.. একসাথে হলেই হাহা হিহি শুরু হয়ে যায়.. শেষে আমাদের জন্য আর জায়গা হলো না নৌকায়. আমি আরাফ, মেহেদী আর সাদাত আমরা তীরে দাড়িয়ে রইলাম..
ওদের পার করে নৌকা আবার আমাদের সামনে.. আরাফ সাদাত লাফিয়ে ওঠে গেল.. কার আগে কে বসবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা লেগে গেল এদের মাঝে..
মেহেদি হাতটা বাড়িয়ে বলল– তুমি আমাকে ধরে ওঠো.. আমার এই ভাইটা বেশি নরম.. পুরা পানি বললে চলে তাকে.. ইফতি ভাইয়ার জুনিয়র ভার্শন আমার বড় মামার এই একমাত্র ছেলে মেহেদী.. আমি মিষ্টি হেসে বললাম— তুই নিজে কাপতেছোস ভাই.. ফেলে দিবি.. ওনিজেকে শক্ত করে বলল– দূর ফেলবো না..ভরশা করতে পারবা… আমি ভয়ে ভয়ে যেই হাত বাড়াবো. হঠাৎ

“তোর ব্রেনটা যে আনইউস্ড ব্রেন তা কি তুই জানিস?? এস লাইক গোবর.. যেকোন বিচি লাগালে তরতরিয়ে গাছ ওঠে যাবে.সেইখানে..” আমি চমকে যেই পিছনে তাকাবো সাথে সাথে পিছলে গেলাম আমি.. ওহ আল্লাহ,,, আমার কোমড় হয়তো শেষ.. আজ নাচবো কিভাবে.. হঠাৎ খেয়াল হলো আমি শূন্যে ভেসে আছি..আরাফ হেসে বলল– এইটা দেখি রোমান্সের জায়গা হয়ে গেল.. যে যেদিকে পারছে শুধু রোমান্সই করছে…
আমি চোখ খোলে হাসনাত ভাইয়ের দিকে তাকালাম.. তার গায়ের সাথে মিশে আছি আমি.. তাড়াতাড়ি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম.. সে অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে দিল..তারপর আবার নিজের হিটলার রুপে ফিরে এসে বলল– কি সমস্যা?? সুন্দর ছেলে দেখলে শুধু গায়ে পড়তে ইচ্ছে করে??
আমার মেজাজ চরম ভাবে বিগড়ে গেল.. আন্গুল ওচিয়ে বললাম— আপনাকে ধরতে বলেছি নাকি.. ধরতে গেলা কেন?? আর এছাড়া আপনার না কাজ ছিল.. পিছন পিছন কি?? হু??
সে মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল– তোর মুখে ট্যাক্স মেশিন বসানো দরকার সত্যি সত্যি.. তারপর দেখতাম এতো কথা বলতে পারতি না.. এতো কথা কেমনে বলস?? কষ্ট হয় না তোর.. চুপ করে নিশ্বাস নে.. বলে একলাফে নৌকায় ওঠে দাঁড়ালো.. তারপর হাত ধরে আমাকে টানদিল. আমি হুমড়ি খেয়ে তার বুকে ওপর বাড়ি খেলাম.. এই তালগাছের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখা গেল নাএতে.. হঠাৎ বিরবির করে বলল– এই ইফতিয়ারে পাই আমি আজকে.. ইতার প্রেম করা বাইর করেদিব বাস্তব…
আমি তাড়াতাড়ি তার হাত আঁকড়ে ধরে দু পাশে মাথা ধোলালাম.. সে অবাক চোখে আমার দিকে তাকালো. আমি হঠাৎ নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে অন্যদিকে তাকালাম.. হঠাৎ আমার হার্ডবিট যেন দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিল.. এ কেমন অনুভূতি.. পরপর কয়েকবার ঢুক গিললাম আমি.. নিজেকে স্বাভাবিক করে আড়চোখে তার দিকে তাকালাম.. সে ঘাড়ে হাত বোলাতে বোলাতে মুচকি হাসছে.. এখন তো বুকের ভিতর মুচড় দিচ্ছে আবার. ইয়া আল্লাহ দম বন্ধ হয়ে যাবে নাকি আজ আমার.. তার মিষ্টি স্মেলটা বারবার আমার নাকে বারি খাচ্ছে…
অন্যপাশে আসার পর সে আমার আগে নেমে আমার হাত ধরে আবার নামিয়ে আনলো.. ওপরে ওঠে দেখলাম আপুরা আমাদের জন্য দাড়িয়ে আছে. ভাইরা সবাই চলে গেছে..
হাসনাত ভাই আপুদের মাঝখানে আমাকে দিয়ে সে হাটতে হাটতে সামনে চলে গেল.. আমি হাবলার মতো তাকিয়ে রইলাম. এই ছেলে মিনিটে মিনিটে পাল্টায় কেন.. তারপর আলতোভাবে নিজের চোখ বুঝে বলে ফেললাম— তাও তোমাকে ভালোবাসি আমি হাসনাত…
তারপর মুচকি হেসে সামনে পা বাড়ালাম…

আন্টির বাসায় গিয়ে দেখলাম জেরিন আপু মুখ ফুলিয়ে বসে আছে.. এই আপু সারাখন হাসতে পারে.. যেকারো খারাপ মুড তাড়াতাড়ি ঠিক করে দেওয়া যেন এর স্পেশাল গুন. আপুরা গিয়ে জড়িয়ে ধরতেই মুমের মতো গলে গেল সে.. আর কাকলি আপু হয়তোওর মন ভালো করার অসুধ.. অন্যকারো সাথে ওর বন্ডটা এতোটা স্ট্রং না..
আমি চারিদিকে চোখ বোলালাম.. সিয়াম কাগজ দিয়ে সুন্দর সুন্দর ঘর বানিয়ে রেখেছে.. এই ছেলে ইন্জিনিয়ারিং পড়লে অনেক ভালো হতো কিন্তু সে কুরআনে হাফেজ… আমার আজো মনে আছে.. যখন আমরা খুব ছোট.. আমি ওর খেলনা ধরাই সব খেলনা ডাসবিনে ফেলে দিয়েছিল সে.. কারন একটাই আমি মেয়ে.. এখনো রাগ লাগে মনে পড়লে আমার.. যদিও কতবার সরি বলে নিয়েছি ও আমার থেকে…

আপুরা সবাই পুকুরে গোসল করতে যাবে.. আন্টিদের বাউন্ডারির ভিতর ই পুকুর.. বিশাল বাড়ি, বাগান..
পুকুরে গোসল করলে কেউ দেখার চান্স ও নেই.. আমি যেই পা বাড়াবো হাসনাত ভাই আপেল খেতে আমার সামনে ধুপ করে বসে পড়লো.. আপেলে কামড় বসাতে বসাতে বলল– কই যাস??
আমি— পুকুরে গোসল করবো…
সে ব্রু কুঁচকে বলল– সেইখানে কি?? ড্রেস চেন্জ করার ব্যবস্হা নাই…
আমি হেসে বললাম— তো,, ভিজা ড্রেস নিয়ে আসবো.. অথবা আপুদের মতো করে পাল্টাবো.. সরেন যাব আমি..
সে দাতে দাত পিষে বলল– কোন দরকার নাই.. ওয়াসরুমে কর..
আমি কিছু বলার আগে হঠাৎ সে ইফতীভাইকে দেখে চিল্লাই বলল– ইফতীইয়া.. দাড়া ওইখানে তুই এইখানে আসতেছি আমি.. তোর খবর আছে বদেরহড্ডি…
এইবলে আমার দিকে তীঘ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রস্থান করলো..
আর আমি সেদিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম—- আজ ভাইয়া যে কি হবে.. এই হিটলারকে সত্যি সত্যি তুলে আছাড় দিতে মন চায় আমার.. কিন্তু আফসোস.. আমি আলগাতে পারবো না তারে.. শতআফসোস নিয়ে পুকুরের দিকে প্রস্হান করলাম আমিও…

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here