ভিনদেশী পর্ব ৬+৭

#ভিনদেশী
#পার্ট ঃ৬
#আদ্রিয়ানা নিলা(ছদ্মনাম)

সোহা নিচে গিয়ে সোফায় সাদাফ আর তার চাচাকে দেখতে পেল। সে বিস্মিত নয়নে তাকালো। এতো সকালে চাচা আমাদের বাসায় কী করছে?আর সাদাফ ভাইয়া বা কেন আরছে?

–আরে শ্রুতি মা যে, বসো বসো।

শ্রুতিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সাদাফের বাবা তার পাশের সোফাটায় বসতে বললেন।শ্রুতি পাশের সোফাটায় বসল। শ্রুতি একবার সাদাফের দিকে তাকালো। দুজনের চোখে চোখ পড়ল। শ্রুতি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো । অতঃপর শ্রুতি তার চাচার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–বড় আব্বু, তোমরা যে এতো সকালে আমাদের বাসায়? আগে তো কখনো এতো সকালে আস্তে না। কোনো সমস্যা হয়েছে?

–না রে মা, কোনো সমস্যা হয় নি। তুই তো পড়ালেখা করতে আমেরিকা যাচ্ছিস।তোর বাবার কাছ থেকে সবই শুনেছি। তাই তোকে দেখতে আসলাম। আমার আবার আজকের বিকালে কক্সবাজার যেতে হবে একটা মিটিং আছে। ওখানে ৪দিন থাকতে হবে। আর তোর ফ্লাইট নাকি ২৭তারিখ। তাই তো তোকে দেখতে আসলাম। আর শোন আমাকে বছরে ১বার আমেরিকায় যেতে হয় ব্যবসায়ের কাজে। ওখানে কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাবি।

শ্রুতির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তিনি কথাগুলো বললেন। শ্রুতি সব গুলো কথা মনোযোগ নিয়ে শুনে বলল,,

–ঠিক আছে।

শ্রুতি আর কিছুক্ষণ সেখানে থেকে রান্নাঘরে গেল।সাদাফের দিকে সে একবার ই তাকিয়েছিল। সাদাফ তার দিকে আড়চোখে অনেক বার তাকিয়েছে, যা শ্রুতির দৃষ্টি এড়াইনি। শ্রুতি রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো তার মা রান্না করছে। মাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলো আজকে সাদাফ আর চাচা এই খানেই সকালের খাবার খেয়ে যাবে। শ্রুতি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল৷

শ্রুতি বারান্দায় দাড়িয়ে কফি খাচ্ছে।আর সকালে পরিবেশটাকে উপভোগ করছে। আর কটাদিন সে নিজের দেশকে দেখতে পাবে। তারপর তাকে ভিনদেশে পাড়ি জমাতে হবে। কবে যে দেশে আসতে পারবে তার ঠিক নেই। হঠাৎ শ্রুতির পাশে কেউ দাড়ালো। শ্রুতির ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখলো সাদাফ।সে কোনো কথা না বলে সামনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

হঠাৎ সাদাফ বলে উঠল,

–তুই দিন দিন অনেক বুদ্ধিমতি হয়ে যাচ্ছিস। আই এপ্রিশিয়েট ইউ।

শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

–মানে? কী মিন করতে চাচ্ছো?

সাদাফ মৃদু হেসে জবাব দিল,,

–দেখ তোকে আমি ধোকা দিসি বলেই তুই এখন আমার আর মালিহার মাঝখান দিয়ে সরে যাচ্ছসি। নাহলে তো চুইংগাম এর মতো পিছে লেগে থাকতি। আমি তোকে বোন ছাড়া আর কিছু ভাবি নি। আর তুই এখানে আমাকে আর মালিহাকে একসাথে দেখলে কষ্ট পাবি। তাই আমি মনে করি, তোর আমেরিকা যাওয়ার সিদ্ধান্তটা ১০০% সঠিক।আমার আর মালিহার মাঝখানে কোনো থার্ড পারসন থাকলো না।

শ্রুতি সাদাফের দিকে তাকালো। সাদাফের কথায় তার কষ্ট হচ্ছে না। বরং হাসি পাচ্ছে। সে একটা তাচ্ছিল্যের হসি দিয়ে বলল,

–তুমি যা ভাবো। আমি তো কারো ভাবনার পরিবর্তন করতে পারি না। আমি আমার নিজের স্বার্থের জন্য সব করছি। অন্য কোনো বাহিরের মানুষের জন্য না। ভাইয়া তুমি নিচে যাও। আমার কিছু কাজ আছে। সেগুলো করতে হবে।

বলেই শ্রুতি বেলকনি থেকে রুমে চলে আসলো। কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে বিছানায় গোছাতে শুরু করল। সাদাফ শ্রুতির পিছু পিছে রুমে আসে। শ্রুতি বিছানা গোছাতে গোছাতে পিছনে তাকায়৷ দেখে সাদাফ দাড়িয়ে আছে। শ্রুতি আবার বলে উঠল,

–কী বললাম, শোনো নি। রুম থেকে বের হও ভাইয়া, আমার কাজ আছে।

সাদাফ রেগে গিয়ে শ্রুতির হাত ধরে টান দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

–দিন দিন দেখছি তোর সাহস খুব বেড়ে যাচ্ছে। তোর কত বড় সাহস আমাকে রুম থেকে বের হতে বলিস।

শ্রুতি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,,

–হাউ ডেয়ার ইউ? আমার বাড়িতে এসে আমাকে রাগ দেখাচ্ছো। আবার আমার হাত ধরে সাহসের কথা বলছেন। বের হন রুম থেকে।

সাদাফ রেগে হাত মুঠো করে চলে গেল।

শ্রুতি সাদাফের যাওয়ার পানে তাকিয়ে মনে মনে বলল,,

–এই সব ব্যবহার তোমার প্রাপ্য ভাইয়া।

_____________________________________________

দেখতে দেখতে শ্রুতির ভিনদেশে যাওয়ার দিনটি চলে আসল। রাত এগারোটায় ফ্লাইট। শ্রুতির বাবা -মা, আপু নয়টার আগেই সবাই বের হলো বাসা থেকে। গাড়ি আপন গতিতে চলল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দিকে। । গাড়িতে সবাই শান্ত হয়ে বসে আছে। কিন্তু শ্রুতি শান্ত নেই। বাহিরে থেকে তাকে স্বাভাবিক লাগলেও ভিতর থেকে দমে যাচ্ছে সে।শ্রুতি ব্যাগে থেকে নিজের পানির বোতলটা বের করে একঢোকেই অর্ধেক পানি শেষ করে দিল। আজ এই দেশে বাবা, আপুর সাথে তার শেষ দিন ভাবতেই শ্রুতি মিইয়ে যাচ্ছে। কান্নার সব দলা পাকিয়ে আসছে কন্ঠনালীর মাঝে। কোনোমতে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। মনে মনে ভাবছে, “বিদেশে গিয়ে কী সে বাবা -মার আদর ভালোবাসা ছাড়া থাকতে পারবে? কে তাকে বোনের মতো আদর করবে? আদৌ কী সেখানে থাকতে পারবে সে? ভিতরে ভিতরে প্রচুর উদ্বিগ্ন সে। একবার শ্রুতি নিজের বাবা -মা ভাইয়ের দিকে তাকালো। দুজনের মুখই শুকনো দেখাচ্ছে। শ্রুতির মা শ্রুতিকে এইটা ওইটা নিয়েছে কীনা জিজ্ঞাসা করলেও, শ্রুতির বাবা একদম চুপ। সোহার দিকে তাকালো। সেও কেমন চুপ করে বসে আসে। সকলের এই নীরবতা শ্রুতির ভালে লাগছে না। তাই সে নিজের মাথা বাবার কোলে রাখল। শ্রুতির বাবা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিলেন। মেয়ের মনের অবস্হা তিনি কিছুটা আঁচ করতে পেরেছেন। জেদি হলেও মেয়েটা যে মনের দিক দিয়ে নরম। তাই শ্রুতিকে স্বাভাবিক করতে তিনি সকলকে নিয়ে গল্প মেতে ওঠে।

এয়ারপোর্টের সামনে আসতেই একেক করে সকলে নেমে গেল। শ্রুতির বাবা গাড়ি থেকে দুটো লাগেজ বের করেন। আর গিটারটা শ্রুতির কাছে দেন। শ্রুতি গিটার টা নিজের কাধে ঝুলিয়ে নেয়। এই গিটারটা তার সব থেকে প্রিয়। তাই এটা সে নিজের সাথে নিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে সবার সাথে গল্প করার কারণে শ্রুতির এখন কিছুটা প্রশান্তি লাগছে। শ্রুতি আকাশের দিকে তাকালো। গোল থালার মতো একটা চাদ উঠেছে। তারপর শ্রুতি আশেপাশে তাকালো। ভীড় নেই তেমন চারদিকে। কোলাহল ও নেই। হয়তো আজকে আর তেমন ফ্লাইট নেই। ইমিগ্রেশননের সমস্ত প্রক্রিয়া শেষ করল শ্রুতি। বেশি দেরি হয়নি কারণ তেমন ভীড় নেই। শ্রুতির বাবা মা, বোন শ্রুতির সাথেই ছিল। তারপর সবাই মিলে ওয়েটিং রুমে বসলাম। শ্রুতির বাবা একটা পানির বোতল কিনে আনতে গেছেন। এখনো ৪০মিনিট বাকি আছে ফ্লাইটের। শ্রুতি মা শ্রুতিকে উপদেশ দেয়া শুরু করল। সাথে যোগ দিল সোহাও। মা বলছেন, বাস্কেটবল কম খেলবি।হাত -পা ভাঙ্গলে কী করবি? বেশি লাফলাফি করবি না, সবার সাথে মিলেমিশে চলবি, কোথায় বের হলে লুসিকে সাথে নিয়ে যাবি, এটা ওটা উপদেশ দিতেই আছে। আজ মার উপদেশ শুনতে শ্রুতির একটুও বিরক্ত লাগছে না। অন্যসময় হলে শ্রুতি বেশ বিরক্ত হতো। কিন্তু আজকে ভালো লাগছে। আবার কবে শুনতে পাবে এইরকম উপদেশ তার ঠিক নেই। তাই মন দিয়ে সবার কথা শুনছে। এর মধ্যেই বাবা চলে আসলো। শ্রুতির বাবাও শ্রুতি কে কিছু কথা বলল। শ্রুতি মনোযোগ দিয়ে শুনল। এর মধ্যেই ফ্লাইটের ঘোষণা এল। শ্রুতি বাবা লাগেজ দুটো নিয়ে দাড়ালো।
সামনে কাচের গেট। দুই জন গার্ড দাড় করানো। এরপর বাবা, মা, ভাই আর কেউ যেতে পারবে না। শ্রুতিকে একাই যেতে হবে। শ্রুতির বাবা লাগেজ দুটো শ্রুতির দিকে এগিয়ে দেয়। শ্রুতি সিক্ত নয়নে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায় সামনের দিক। কিন্তু আবার পিছনে ফিরে থমকে দাড়িয়ে গেলাম। বাবা হাত দিয়ে ইশারা করল, কীরে যাচ্ছি না কেন? শ্রুতি দৌড়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। শ্রুতির মা ইতোমধ্যে কান্না করে দিছে। শ্রুতির বাবার চোখেও পানি চলে আসছে।তিনি শ্রুতির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

–মা কাদিস না। আমরা তো তোকে দেখতে যাবো,মাঝে মাঝে। এখন যা। দেরি হয়ে যাচ্ছে।

শ্রুতি বাবার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে, চোখের পানি মুছে সকলকে আর একবার বিদায় জানিয়ে ভিতরে ঢুকল।

বিমানে উঠে নিজের সিটে বসতেই শ্রুতির বুকটা ধক করে উঠল। অজানা এক ভয় হ্রাস হয়ে যেতে থাকে শ্রুতির দৃঢ় মনোবল। বিচলিত হয়ে ওঠে তার মনে। তার ইচ্ছা করছে, তার বাবা মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে,

–চল, তোমরা বাসায় চলো। তোমাদের ছাড়া থাকতে পারবো না।
আদৌ কী এসব কীছু সম্ভব? শ্রুতি কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল। নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করে গা এলিয়ে দিল সিটে। চোখ দুটির কপাট বন্ধ করে এভাবেই কিছুক্ষণ বসে রুইল। নিজের মনোবল আরও শক্ত করল। এখনো কিছু মানুষ বোডিং পাস করছে। শ্রুতি এইবার জানালার বাহিরে তাকালো শেষ বারের মতো প্রাণ ভরে দেখে নিল রাতের চাঁদের আলোতে নিজের জন্মভূমিকে। ক্ষনিকের মাঝে নিজের দেশের মায়া ছাড়িয়ে যাচ্ছে ভিনদেশে। শেষবারের মতো সাদাফের হাস্যজ্জ্বল চেহারা, তার সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো মনে পড়ল। এটাই শেষবার। এরপর যে আর এই সব তার জীবনে জায়গা দিবে না। সব ভুলে নতুন উদ্যম, নতুন পন্হা, নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে বাঁচবে সে। কিন্তু আদৌ কী তা সম্ভব? মানুষ কী তার অতীত ভুলতে পারে? ভালোবাসা ছাড়া কী মানুষ বাঁচতে পারে? নতুন দেশে, নতুন ভোরের রৌদ্রছায়ায় সে কী নিজের জীবন পুনরায় কারো ভালোবাসায় সাজাতে সক্ষম হবে?

ক্ষণেই স্পিকার এর সুরেলা কন্ঠ তার কর্ণকুহরে এসে ঠেকতেই শ্রুতি নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। সচকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাইট টেক অফ করবে বলে ইশারায় সকলকে সিটবেল বাঁধার বিনীত অনুরোধ করছে এক তরুণী। মুখে তার মৃদু হাসির ঝলক।অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রুতি সিটবেলটি বেঁধে নিল। চোখ দুটি বন্ধ করে পুনরায় সিটে গা এলিয়ে দিল।ফ্লাইটের মধ্যে প্রায় সব যাত্রী ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। অতঃপর মিনিট দশকেই উড়াল দিল বিমান।
#ভিনদেশী
#পার্ট ঃ৭
#আদ্রিয়ানা নিলা

সচকিত দৃষ্টিতে সামনে তাকায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিমান টেক অফ করবে বলে ইশারায় সকলকে সিটবেল বাঁধার বিনীত অনুরোধ করছে এক তরুণী। মুখে তার মৃদু হাসির ঝলক।অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রুতি সিটবেলটি বেঁধে নিল।ফ্লাইটের মধ্যে প্রায় সব যাত্রী ঘুমানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। অতঃপর মিনিট দশকেই উড়াল দিল বিমান। শ্রুতি চোখ বন্ধ করে সিটে নিজের গা এলিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে গলে। মাঝখানে বিমান বালা কয়েকবার ডেকেছিল খাওয়ার জন্য। কিন্তু শ্রুতি সাড়া দেয়নি।হালকা ঝাকুনিতে শ্রুতির ঘুম ভেঙে গেল।স্পীকারের সুরেলা কন্ঠে আবার কিছুর ঘোষণা দিল। দুবাই পৌছে গেছি। এরপর এখান থেকে আমেরিকা৷ হঠাত্ কারো ডাকে, শ্রুতির চোখের কপাট খুলে দেখলো, এয়ার হোস্টেস নাস্তা দিয়ে গেলো। কিন্তু শ্রুতির খেতে ইচ্ছে করছে না। সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু ঘুম আসছে না। তাই শ্রুতি ভাবল এখন কীভাবে সময় কাটাবে? হঠাৎ শ্রুতির ব্যাগের কথা মনে পড়লো। সে ব্যাগে তার কিছু পছন্দের লেখকের বই নিয়েছিলো। সেখান থেকে হুমায়ুন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসের বইটি বের করে পড়তে শুরু করল। পড়তে পড়তে সময় যে কীভাবে গেল শ্রুতি বুঝতেই পারলো না।

হালকা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেন মাটি স্পর্শ করল। শ্রুতি নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে।তারপর চারদিকে তাকালো। লম্বা একটা জার্নি। প্রায় ২৩ঘন্টা। সবাই ধীরে ধীরে বের হচ্ছে।
শ্রুতিও নিজের ব্যাগ নিয়ে ধীরে ধীরে বের হলো। আমেরিকার মাটিতে পা রাখতেই শ্রুতির শরীর দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল। সকালের বিশুদ্ধ বাতাস শ্রুতির ভেতরটাকে ছেদ করে ছুয়ে গেল৷ সে নিজের দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল। শ্রুতি মনে মনে বলল,

–ওয়েল কাম টু আমেরিকা।

শ্রুতি এয়ারপোর্টের ভিতরে গেল। ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের স্হানীয় এয়ারপোর্টে যখন পৌঁছছে তখন এইখানের স্হানীয় সময়ে ৯ঃ৩০। ওয়াশিংটন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Pacific Northwest অঞ্চলের একটি অঙ্গরাজ্য। ১৮৮৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৪২তম অঙ্গরাজ্য হিসেবে ওয়াশিংটন অন্তর্ভুক্ত হয়।মোট জনসংখ্যার ৬০% বাস করে যোগাযোগ, শিল্প-বাণিজ্য আর রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু Seattle metropolitan area তে। মূলতঃ যুক্তরাষ্টের প্রথম রাষ্টপতি জর্জ ওয়াশিংটনের নাম অনুসারে রাজ্যটির নামকরণ করা হয়। District of Columbia থেকে পৃথক ভাবে চিহ্নিত করতে প্রথমে একে স্টেট অব ওয়াশিংটন অথবা ওয়াশিংটন স্টেট বলে ডাকা হত। তবে এটি রাজধানী নয় এটি আমেরিকার ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য।
সকাল হওয়ার কারণে এই সময়ে বিমানের চাপ কম থাকায় শ্রুতি লাইনে দাঁড়িয়ে ৫মিনিটেই ইমিগ্রেশনে পৌঁছে গেল। ইমিগ্রেশন সেরে লাগেজ নিতে নিতে প্রায় ১১টা বেজে গেছে ।তারপর শ্রুতি খুজতে লাগলো, মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টার । এখন মানি এক্সচেঞ্জ না করলে শ্রুতিকে আমার পরে অনেক ভোগ পোহাতে হবে। তাই এখনি করে নিল। তারপর সে এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়ালো। অনেকে অনেক জনের জন্য দাড়িয়ে আছে। কেউ হাতে প্লাকার্ড নিয়ে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু লুসিকে কোথাও দেখছে না। তাই অপেক্ষা ছাড়া শ্রুতির কোনো উপায় নেই৷

শ্রুতি আবার ভিতরে ঢুকে অপেক্ষা করতে লাগল।অপেক্ষা করতে করতে ১ঘন্টা পেরিয়ে গেল। এখনো খবর নেই৷ কেউ কেউ শ্রুতির দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রুতির বেশ অস্বস্তি লাগছে। তাই নিজের দুইটা লাগেজ নিয়ে বাহিরে বের হলো। কিন্তু এখনো সে লুসিকে কোথায় দেখতে পেল না। শ্রুতি একটা হতাশার নিশ্বাস ছেড়ে সামনের দিকে হাটা শুরু করল। দুপুর তখন ১২টা বাজে। রাস্তায় মানুষে গিজ গিজ করছে। শ্রুতি একটা দোকানের সামনে গেল। সেখানে একটা লোক দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল।শ্রুতি তাকে দেখে বলল,

–Excuse me!

লোকটা শ্রুতির দিকে তাকালো। শ্রুতি কিছুটা ভয় পেল। তারপর নিজেকে শক্ত করে ইংরেজিতে বলল,

–সিয়াটল শহরটা এখানে থেকে কত দূরে?

লোকটা শ্রুতিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে বলল,

–এখান থেকে ১৬৫কিমি দূরে। প্রাইভেট কার এ গেলে ২ঘন্টার মতো লাগবে।

শ্রুতি আবার জিজ্ঞেস করল,

–শহরটা কোন দিকে?

–ডান দিক দিয়ে যান। হেটে গেলে তো অনেক সময় লাগবে। সামনে অনেক ক্যাব পাবেন। সেগুলোতে করে যান।

শ্রুতি লোকটার কথা মতো রাস্তার ডান দিক ধরে এগোতে থাকে। রাস্তার পাশে বিশাল বড় বড় বিল্ডিং।রাস্তার গুলো খুব পরিষ্কার,একেবারে ঝকঝকে । দুপুর তবুও সূর্যের আলোর তেমন একটা তাপ নেই। হঠাৎ শ্রুতির সামনে একটা গাড়ি ব্রেক করলো । ভাবনার মাঝে এতোই বিভোর ছিলো যে কখন রাস্তার মাঝখানে চলে আসল ঠিক নেই। রাস্তাগুলো একেবারে সোজা হওয়ার কারণে গাড়িগুলোর স্পিড বেশি।

শ্রুতি চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে রাখছে।শ্রুতি ভাবছে আজকেই হয়তো তার শেষ দিন। খুব ভয় পেয়েছে বেচারা৷ হঠাৎ সামনে কাউকে দেখতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে লাগলো। মানুষটা যে কে সেটাও দেখি নি। শ্রুতি কাঁপা কাপি বন্ধ হলে চোখ খুলে তাকালো। কারো বুকের উপর নিজের মাথাটা দেখে সে বেশ অবাক হলো৷ ধীরে ধীরে হাতের বাঁধন আলগা করে মুখটা তুলল। একটা ছেলেকে দেখল৷ অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার কারণে কপালে ব্রাউন কালারের চুল গুলো ছড়িয়ে আছে,স্বচ্ছে নীল চোখ, গোলাপের পাপড়ির মতো ঠোঁট, একটা কানে ছোট্ট একটা রিং পড়ানো।ছেলেটার মুখে ভয়ের ছাপ।খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলেটাকে দেখলো শ্রুতি।শ্রুতির কাছে মনে হলো এই সুদর্শন ছেলেটা নিঃসন্দেহে হলিউডের হিরোকেও হার মানাবে৷ শ্রুতিকে এরকম তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা বলল,

–হেই বিউটিফুল গার্ল। আর ইউ ওকে?

শ্রুতি কথাটা কর্ণগোচর হতেই শ্রুতি ছেলেটাকে ছেড়ে দিয়ে, ছিটকে খানিকটা দুরে চলে গেল৷ শ্রুতি এতক্ষণ কী করছিল মনে পড়তেই লজ্জায় তার গাল লাল হতে শুরু করল। সে কীভাবে একটা ছেলেকে জড়িয়ে ধরল? ছেলেটা আবার শ্রুতির সামনে এসে মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,
–তুমি ঠিক আছো? কোথায় ব্যথা পেয়েছো?

শ্রুতি ছেলেটার কথায় শিউরে উঠল। হঠাত্ শ্রুতির ছেলেটার হাতের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। একটা রুপার মতো স্টিলের চ্যাপ্টা বেল হাতের সাথে জড়িয়ে রেখেছে। সূর্যের আলোতে বেল্টা যেন আরো চক চক করছে। সেখানে চারটা অক্ষর দিয়ে কিছু লেখা। শ্রুতি পূর্ণ দৃষ্টিতে সেটার তাকালো। সেখানে লেখা হলো, JACK।শ্রুতি একদৃষ্টিতে সেটার দিকে তাকিয়ে রইল৷ এদিকে যে জ্যাক তাকে ডেকেই যাচ্ছে তাতে তার কোনো খেয়াল নেই। হঠাৎ শ্রুতি তার গালে কোনো কিছুর উষ্ণ স্পর্শ পেতেই কেঁপে উঠল। চোখ তুলে তাকাতেই দেখে জ্যাক তার গালে হাত রেখেছে। শ্রুতি আর একবার জ্যাক এর দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে লাগেজ দুটো আরো শক্ত করে আকড়ে ধরল। জ্যাক তখনই বলে উঠল,

–হেই বিউটিফুল,তেমাকে আমি কতক্ষণ ধরে ডাকছি তুমি তো কথাই বলছো না। তুমি কী ব্যথা পেয়েছো?

শ্রুতি মাথা নিচু করে বলল,

–না, আমি ব্যথা পায়নি।

জ্যাক নামের ছেলটি শ্রুতির গাল থেকে হাত সরিয়ে নিল। অতঃপর বলল,

–রাস্তার মাঝখান দিয়া হাঁটছিলে কেন? পাশ দিয়া হাঁটবে। নাহলে এরকম এক্সিডেন্ট হবে। এখন তো ব্যথা পাওনি পরে দুর্ঘটনা হতে পারে।

শ্রুতি জ্যাকের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,

–ছেলেটা কতো ভালো!আর বাংলাদেশ হলে এতক্ষণে ঝগড়া বাধিয়ে দিত।

জ্যাক আবার বলল,,

–তুমি কোথায় যাচ্ছো? আর এতো জিনিসপত্র নিয়ে হাঁটছো কেন?কাউকে খোঁজতেছো নাকি?

শ্রুতি খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বলল,,

–হ্যাঁ, আমি আমার একজন কাজিনকে খুজছিলাম। কিন্তু তাকে দেখছি না। আমি এখানে নতুন তো কিছুই চিনি না।

–ওহ! সো স্যাড। তো আমি তোমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?

শ্রুতির ততক্ষণাত্ মাথায় একটা বুদ্ধি আসলো। ওর কাছে তো লুসির নাম্বার আছে। কিন্তু এ সিম দিয়ে তো এখন আর কল দেয়া যাবে না। তাই শ্রুতি জ্যাক বলল,

–আপনার মোবাইলটা একটু দিন। আমি তাকে ফোন করে আসতে বলি।। তার আমাকে নিতে আসার কথা ছিল।

জ্যাক ছেলেটি ওকে বলেই মোবাইলটা বের করে দিল। শ্রুতি লুসির নাম্বারটা ডায়েল করল। কিছুক্ষণের মধ্যে লুসি শ্রুতি লুসির কন্ঠস্বর শুনল।শ্রুতি লুসিকে বলল,,

–লুসি আমি শ্রুতি বলছি। আমি তো পৌঁছে গেছি। কতক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছি। তুমি কোথায়?

–শ্রুতি তুমি ওখানেই আর একটু ওয়েট কর।গাড়ি জ্যামে আকটে ছিলো৷ আমি আর ১৫মিনিটের ভিতরেই চলে আসবো৷ ওখানেই দাঁড়াও কোথাও যেওনা।

শ্রুতি হুম বলে কলটা কেটে দিল। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে দেখে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে৷ শ্রুতি বলল,

–এই নিন আপনার ফোন।

–কথা বলেছো?

–হুম, আসতেছে।

জ্যাক শ্রুতির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে গাড়িতে বসল। জ্যাক গাড়ির জানালার কাচ টা নামিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বলল,

–সাবধানে যেও।

শ্রুতি একটু নিচু হয়ে মুখটা জানালার কাছে নিয়ে মৃদু হেসে বলল,

–আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাকে সাহায্য করার জন্য।

–ইট’স মাই প্লেজার।

বলেই জ্যাক গাড়ি নিয়ে চলে গেল।

শ্রুতি ওখানে আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকল। হঠাৎ তার পিছন থেকে কেউ বলল,,

–এক্সকিউজ মি! আর ইউ শ্রুতি?

শ্রুতি পিছনে ঘুরে লুসিকে দেখতে পেলো। সে পরনে জিন্স প্যান্ট, আর একটা গেঞ্জি। মাথায় একটা কালো কালার ক্যাপ পড়া। লুসিকে চিনতে শ্রুতি কষ্ট হয়নি। কারণ তাদের ভিডিও কলে অনেকেবার কথা হয়েছে। লুসি শ্রুতিকে জড়িয়ে ধরে বলল,

—ওয়াও তোমাকে পেয়ে গেলাম। সরি তোমাকে অনেক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য।

শ্রুতি মৃদু হেসে বলল,,

–ওকে ডিয়ার, এটা এমন কোনো বিষয় না।

–আসতে তো কোনো কষ্ট হয়নি।

–একদম না।

তারপর লুসি শ্রুতির হাত থেকে লাগেজ গুলো নিয়ে গাড়ির পিছনে তুলে ড্রাইভিং সিটে বসল আর শ্রুতিকেও বসতে বলল।শ্রুতিও শান্ত মেয়ের মতো বসল। সে সময়ের এক্সিডেন্ট এর কথাটা লুসিকে বলল না।বলার মতো তো কিছুই হয় নি। বললে আবার শুধু শুধু টেনশন করবে। লুসি আবার আন্টিকে বলবে, আন্টি আবার বাবা মাকে বলবে। বাবা মা ঐদিকে বসে চিন্তা করবে।হঠাৎ লুসির ফোনটা বেজে ওঠে। লুসি কলটা রিসিভ করে বলল,

–হ্যাঁ মম, আমি শ্রুতিকে পেয়েছি। আমার পাশেই আছে। আমরা আসতেছি।

লুসি শ্রুতিকে সিটবেল্টটা বেধে নিতে বলে গাড়ি স্টার্ট দিল। শ্রুতিও সিটবেল্ট টা বেধে নিল। গাড়ি চলতে লাগল। হঠাৎ লুসি বলল,

— শ্রুতি গান শুনবে?

–তোমার ইচ্ছা।
লুসি স্লো ভলিউমে একটা ইংরেজি গান ছাড়ল। শ্রুতি নিজের সিটে গা এলিয়ে দিল।

_____________________________________________

এদিকে জ্যাক গাড়ি চালাচ্ছে।হঠাৎ কিছু একটা মনে পরলে গাড়ির ব্রেক কষে বলল,

–আরে ওই মেয়েটার নাম কী? নাম জিজ্ঞেস করতে তো মনেই নেই।

জ্যাক গাড়িটা আবার ঘুরালো। ২০মিনিট পরে সেই আগেই জায়গায় এসে গাড়িটা থামালো। তারপর গাড়ি থেকে নেমে চারপাশ টা ভালো করে তাকিয়ে শ্রুতিকে খুজতে লাগলো । কিন্তু শ্রুতিকে কোথাও পেলো না।হঠাৎ রাস্তায় পাশে উজ্জ্বল কিছু একটা রোদের আলোতে চিকচিক করতে দেখলো। জ্যাক এগিয়ে গিয়ে হাটু মুড়ে বসে আংটিটি তুলে নিল। একটা জ্যাক মনে মনে বলল,

–এই আংটি টা কী ওই মেয়েটার। হ্যা,হয়তো ওর ই হবে। ওই তো এখানে দাড়িয়ে ছিল ।
কিন্তু ওকে এটা দেবো কীভাবে?এই এত বড়ো শহরে কোথায় খুঁজবো?

,(,চলবে)

(বিঃদ্রঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here