মন নিয়ে পর্ব -০১

মন নিয়ে

গাড়িটা পার্ক করে ল্যাহেঙ্গা সামলে কনভেনশান সেন্টারের উদ্দেশ্যে দৌড় দিল পারিজাত। দেরীই হয়ে গেছে ওর। কার্ডে লেখা আছে ৬টায় বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু হবে। অবশ্য বাঙালি অনুষ্ঠান। ছয়টায় শুরু হলে সেটা হবে পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য। তাই বলে সাড়ে আটটা অবশ্য খুবি দেরী হয়ে যায়। কী করবে পারিজাত? উইকেন্ডে অফিসের কাজ বাসায় নিয়ে এসেছিল, কোনদিক দিয়ে যে ছয়টা বেজে গেছে, খেয়ালও করেনি। তারপরে রেডি হতেও তো সময় লাগে।
খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করছে। এতক্ষণে এপেটাইজার কিছুই পাওয়া যাবে না নিশ্চয়। ডিনার কয়টায় সার্ভ করবে, কে জানে। ডিনার খাওয়ার আগেই ও খিদায় বেহুঁশ না হয়ে যায়। হলে কিন্তু সেটা প্রচন্ড এম্বারাসিং একটা ব্যাপার হবে, নিজেকে মনেমনে সাবধান করে দিল পারিজাত। বর বউয়ের দিক থেকে এভাবে এটেনশান ড্র করাটা একেবারেই উচিত হবে না। সাথে আবার যোগ হয়ে যাবে মা’র আহাজারী। একে দেরী করে আসা, তার ওপর অজ্ঞান হওয়া। মা তো ঘরে বাইরে মুখ দেখাতে পারবে না! তার সোশ্যাল স্ট্যাটাস এক লাফে নিচে নেমে যাবে।

ল্যাহেংগার প্রান্তটা তুলে ধরে দরজা ঠেলে কনভেনশান সেন্টারে ঢুকে পড়ল পারিজাত। ওয়েডিং হল ছেড়ে বাইরের করিডোরেই মা দাঁড়ানো। চোখেমুখে প্রচন্ড স্ট্রেস আর দুশ্চিন্তার ছাপ, সমানে হাত কচলাচ্ছে। এসব আলামত বিলক্ষণ চেনে পারিজাত। ও দেরী করে এসেছে দেখে মা অসম্ভব স্ট্রেসড হয়ে গেছে। প্রথমত একমাত্র মেয়েকে পুতুলের মতো ডিসপ্লে করে মেয়ের অশেষ গুনাগুণ বর্ণনা করে নিমন্ত্রিতদের বাহবা কুড়াতে পারছে না। তাতে মা নিজেকে রীতিমত দুঃখীদের কাতারে ফেলে দিয়েছে ইতিমধ্যে। দ্বিতীয়ত নিশ্চয় কোনো শাঁসালো পাত্রের সন্ধান পেয়েছে। তার ও তার পরিবারের সামনেও পারিজাত নামক মূলাটি ঝুলিয়ে দিতে পারছে না— এ তো আরও বড়ো দুঃখ! তারচাইতে বড়ো দুশ্চিন্তা অন্য কেউ আবার শাঁসালো পাত্রটিকে বগলদাবা করে নিয়ে গেল কিনা!

— পারি! এত দেরী করতে হয়! বর বউ চলে এসেছে, সেখানে তুমি…
সে কথা শেষ না করেই অন্য কথায় চলে গেল মৃণাল
— পারি! এভাবে দৌড়িও না। একটা শ্রী আছে না। আস্তে আস্তে সুন্দর করে হাঁটো! দাড়াও দাড়াও, তোমার ওড়নাটা ঠিক করে দেই। এ কেমন করে পরে এসেছ!
পারিজাত দাঁড়িয়ে পড়ল। জানা কথা, মা ওকে নিয়ে এখন পড়বে। মৃণাল নিজের মনোমতো ওড়নাটা সেট করে দিয়ে পারিজাতের কনুই ধরে বলল
— চলো চলো, আমাদের টেবিলের সবাই এসে পড়েছে। এক তুমি ছাড়া। ওরা তোমাকে দেখবে বলে অপেক্ষা করছে। বারবার জিজ্ঞেস করছে কই আপনার মেয়ে তো এখনো এল না!
— কিন্তু মা, আমি জেরিন আর মাহা’র সাথে এক টেবিলে বসব ঠিক করেছি।
— না না, আগে কিছুক্ষণ আমাদের টেবিলে বসো। পরে দেখা যাবে। মা বাবার সাথে বসতে চাও না, এ কেমন কথা, পারি!

একটা নিঃশ্বাস ফেলল পারিজাত। কিছুই বলা যাবে না এখন, তাহলে মা শুরু করে দিবে। সম্প্রতি ডাউনটাউনে আলাদা এপার্টমেন্ট ভাড়া নিয়ে থাকছে দেখে মৃণাল সবসময় এনিয়ে কথা তুলবেই তুলবে।
কেন পারিজাত বাবা মা’র সাথে থাকছে না!
কেন আলাদা বাসা ভাড়া করা লাগবে! বাসায় থাকলে কী হয়!
পারিজাত যতোই বোঝায় ডাউনটাউন থেকে স্কারবরো যাওয়া আসা করা কম ঝক্কির কাজ না ততোই মৃণালের মুখ ভার হয়ে যায়। শেষে গোমড়া মুখে বলে
— ঠিক আছে, যা খুশি তাই করো। আমার কী! আমার দিকটা তো কারও দেখার দরকার নাই।
পারিজাত অপস্তুত হয়ে কিছু বলতে পারে না। অবশ্য সে একা থাকে না, তাহলে মা বোধহয় ফিটই হয়ে যেত। জেরিনের সাথে এপার্টমেন্ট শেয়ার করছে। জেরিন আর ও একসাথে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে বের হয়ে এখন দুজনেই ডাউনটাউনে চাকরি করছে। ওদের বাবা মা অনেক বছর ধরে পরিচিত। জেরিনও এই পথ ধরেছে দেখে মা খুব জোরালোভাবে আপত্তি জানাতে পারে নি। তবে প্রতি উইকেন্ডে ওকে বাড়িতে গিয়ে থাকতে হয়। শুধু এ উইকেন্ডে একটা ইম্পর্ট্যান্ট প্রেজেন্টেশানের প্রিপারেশান নেবার জন্য ও এপার্টমেন্টেই রয়ে গেছিল। জেরিন অবশ্য নাই। সে ওদের হুইটবির বাড়িতে চলে গেছে।

ওদের জন্য নির্ধারিত টেবিলের সামনে পৌঁছাতেই দেখে জেরিনের বাবা মা জাকিয়া আন্টি ও আসিফ আঙ্কেল ছাড়াও আরও একজন অপরিচিত বয়স্ক দম্পতী বসে রয়েছে। সবাইকে সালাম দিল পারিজাত। মৃনাল গর্বের সাথে নিজের মেয়েকে পরিচয় করিয়ে দিল
— এই আমার মেয়ে পারিজাত, দোলা ভাবী। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এখন বড়ো কম্পানিতে জব করছে। অনেক বেতন পায়।
লজ্জায় মরে গেল পারিজাত। এভাবে বলতে হয়? ছি ছি। আন্টি না জানি কী মনে করল!
তাড়াতাড়ি বলে ফেলল
— মা একটু বাড়িয়েই বলছে, আন্টি। স্টার্টিং স্যালারি সবাই যা পায়, আমিও তাই। এমন কিছু না।
ঝিকিমিকি শাড়ি পরা দোলা একগাল হাসল।
— অসুবিধা নাই, পারিজাত। মা’রা একটু বাড়িয়েই বলে। তবে আমার ছেলে রিক কিন্তু সত্যি খুব ভালো চাকরি নিয়ে টরোন্টোতে কেবলি মুভ করল। মাইনে শুনে তো আমার ফিট লেগে যাবার অবস্থা।
দোলার হাজব্যান্ড রানা বলল
— একটু আগে তোমার আন্টি বলল না মা’রা একটু বাড়িয়েই বলে, কথাটা মনে রেখো কিন্তু পারিজাত। সে ভালো ইনকাম করে ঠিকই কিন্তু ফিট লেগে যাবার মতো না।
— আহা! তুমি কতো বছর চাকরি করার পরে এত বেতন পেতে শুনি?
— আমাদের অবস্থা আর ওদের অবস্থায় পার্থক্য আছে, দোলা। ওরা সেকেন্ড জেনেরেশান ইমিগ্র্যান্ট। বর্ন এন্ড ব্রট আপ এখানেই।

পারিজাত বুঝল এবারের বকরাটির নাম রিক। একে টার্গেট করে করে রেখেছে ওর মা। বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে গেল। কিছুদিন পরপর এই এক যন্ত্রণা।
তা সে বান্দা গেল কই? দি গ্রেট রিক?
বলতে না বলতেই এক চশমাচোখা লম্বা তরুণ এসে একমাত্র খালি চেয়ারটিতে বসে পড়ল। দোলা এমনভাবে পরিচয় করিয়ে দিল যেন প্রাইজ পাওয়া কোনো দুস্প্রাপ্য বসরাই গোলাপ!
— এই যে আমার ছেলে, রিক। অনেক কষ্টে ওকে পাওয়া গেছে। নাহলে সবসময় কাজের অযুহাত দিয়ে এসব বিয়ের অনুষ্ঠানে আসতে না করে দেয়।
পারিজাত বুঝল মা এতক্ষণ ওর কাজের প্রতি নিষ্ঠার গুণগাণ গাইছিল। তারই পালটা জবাব দিল এখন দোলা।
— হাই, আই এম পারিজাত। নাইস টু মিট ইউ।
পারিজাত হাত বাড়িয়ে দিল।
— হাই। নাইস টু মিট ইউ টু।

কেউ কোনো কথা বলার আগেই খাবারের এনাউন্সমেন্ট দিয়ে দিল। সবাই উঠে পড়ল। বাফে টেবিলের দিকে যেতে যেতে দেখা হয়ে গেল মাহা আর জেরিনের সাথে। সুযোগ পেয়ে ওদের দলে ভিড়ে গেল পারিজাত। রিক নামক দামী পাত্রটি থেকে নিজেকে যত দূরে রাখা যায়, ততোই ভালো।
ইনারা কারা? আগে কোথাও দেখেনি তো! নিশ্চয় আউট অফ টাউন থেকে এসেছে।
কিন্তু রিক তো টরোন্টোতে মুভ করেছে। তারমানে আগামী কয় সপ্তাহ ওর জীবন রিকময় হয়ে যাবে। মা’র মুখে রিক জিকির আরম্ভ হয়ে যাবে!
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল পারিজাত। কী যে যন্ত্রণা। এজন্য বিয়ে শাদীতে আসতে চায় না ও। সবার মুখে এক কথা।

দেখা হলেই আন্টিরা ছেঁকে ধরবে
— কী করছ, পারিজাত?
— ইউনি শেষ করে এখন চাকরী স্টার্ট করলাম, আন্টি।
— তা তো করছ কিন্তু বিয়ে করবে কবে?
— দেখি আন্টি।
— এনিয়ে তোমার মা বাবা কতটা চিন্তিত তুমি জানো? না না, দেখি টেখি না। বেশি দেরী করলে বয়স বেড়ে যাবে, চেহারা খারাপ হয়ে যাবে, ভালো ছেলেরা সব হাতছাড়া হয়ে যাবে। তখন?
আরেকজন বলে বসবে
— তোমার কপালে তখন দুনিয়ার ডিভোর্সি, এক বাচ্চার বাপ পড়ে থাকবে। বড়োজোর গ্যাস স্টেশানের মালিকের ছেলে!
কথাটা বলে আন্টিরা এমনভাবে শিউরে উঠবে যেন এরথেকে ভয়াবহ জিনিস আর হয়না। সেদেখে পারিজাত একটুখানি খোঁচা দিতে ছাড়েনা
— ইয়ে আন্টি, ওদেরও বিয়ে করার রাইট আছে কিন্তু।
শুনে আঁতকে উঠে মৃণালকে পড়িমড়ি জানাতে ছুটবে তারা
— কী সর্বনাশ। এখুনি তোমার মা’কে জানাচ্ছি। মৃণাল ভাবী, শোনেন আপনার মেয়ের কথা। ও নাকি গ্যাস স্টেশানের মালিকের ছেলেকে বিয়ে করবে। না পেলে ডিভোর্সিকে!
তৃতীয় জন ওকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে সন্দেহের গলায় জিজ্ঞেস করবে— কোনো বিদেশীর সাথে প্রেম করছ নাকি যে বাঙালি ছেলে পছন্দ হচ্ছে না?
পারি আর কী বলবে, মানেমানে সরে পড়ে। কিন্তু তাও কি শেষরক্ষা হয়?
মৃণাল ওকে বাড়ি নিয়ে সারা উইকেন্ড ধরে তখন লেকচার দিবে। কী যে একটা অবস্থা! ভাল্লাগে না!
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here