মন_কেমনের_বৃষ্টি পর্ব ২৯+৩০

#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_২৯
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ডক্টর ইমদাদ ইশাকে গাড়িতে উঠে বসতে বললেন। ইশা একবার গলা উঁচিয়ে আদিকে দেখে। আদি এখনো সেই জায়গায় দাঁড়ানো ইশা চট করে গাড়িতে উঠে বসে। পেছনের সিটে। ডক্টর ইমদাদ বললেন,
‘ তুমি ওভাবে দৌড়াচ্ছিলে কেন মিষ্টি? এনি প্রবলেম।
ইশা এবার জবাব দিল না। গাড়ির কাচ ডিঙিয়ে দেখার চেষ্টা করল আদিকে। কষ্ট লাগল তার। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে কে জানে?
ইমদাদ সাহেব আবার ও প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘ এনিথিং রং মিষ্টি?

‘ আমার নাম মিষ্টি নয় স্যার। ইশা। ইশা আফরোজা।
ইশার সহজ গলায় সোজাসুজি জবাব।

‘ খুব সুন্দর নাম। ডক্টর কি মিষ্টি নাম দিয়েছিল নাকি?

‘ জি।

‘ এখনো মিষ্টি ডাকে? ডক্টর আছে তোমার কাছে?

ইশা থতমত খায়। বলে,

‘আমি এক জায়গায় যাব স্যার। আমাকে নামতে হবে।

ইমদাদ সাহেব হাসল। বলল, আমি জানি তুমি কোথায় নামবে। বসো। নামিয়ে দেবে ড্রাইভার। আমি আর কোনো প্রশ্ন করছিনা।

ইশা অপ্রস্তুত কৃত্রিম হাসল।

গাড়ি খান বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। ইশা তড়িঘড়ি করে নামল। ইমদাদ সাহেবকে সালাম দিয়ে গেইটের ভেতর ডুকে যাওয়ার আগেই ইমদাদ ডাকলেন ইশাকে।
ইশা থমকাল। পিছু ফিরল।
ইমদাদ সাহেব হেসে বললেন,
‘ আদি তোমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল মিষ্টি তাই না??
তুমি ওকে দাঁড়িয়ে রেখে চলে এলে কেন?
ও কিন্তু মিষ্টির জন্য দাঁড়িয়েছিল। এই মিষ্টিকে আদি চিনবে কি করে, আমি নিজেই তো চিনতে পারছিনা। তুমি কি সেই মিষ্টি যে সারাক্ষণ ডক্টরকে হারানোর ভয়ে থাকত? আদি তোমায় ভালোবাসে মিষ্টি। জানো?
ইশা আর দাঁড়াল। এই চরম সত্যির মুখোমুখি হতে পারবে না বলেই তো ইশা মুখোমুখি হয়নি আদির। ডক্টরেরর মুখে ‘ ভালোবাসি ‘ শব্দটা খুবই লোভনীয়। তার চোখের কাতর চাহনি ও খুবই লোভনীয়। যে চাহনি দেখার মতো না। ইশা দেখতে পারবে না। তার লোভ করা মানায় না। সে ভালো এভাবে । খুব ভালো।

_________________

ছোট্ট পরীর পড়নে লাল শাড়ি। সাইজে একটু বড় হওয়ায় কুচি গোজায় পেটটা বড় লাগছে। মাথায় ঘোমটা পড়িয়ে দিল রিক। পায়ে একজোড়া নূপুর পড়িয়ে দিল। হাতে ছোট্টছোট্ট লাল চুড়ি। গলায় মালা পড়িয়ে দিলে পরী তা টান দিয়ে খুলে ফেলল। চুলকাচ্ছে। রিক শাড়ি পড়ানো শেষে সাজানো শেষে কোলে করে ড্রয়িংরুমে নিয়ে আসল পরীকে। পরীর হাতে আয়না ও দিল। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই আয়না দেখে কেঁদে উঠল।
ঠোঁট দেখিয়ে বলল, ইইইইইইই।
কেউ কিচ্ছু বুঝে উঠতে পারল না।

মুনা চিনতে পারল না পরীকে। তালহা বেগম আর জহির মিয়া অবাক হয়ে দেখল পরীকে। ইশা তো চলতে চলতে থেমে গেল। পরী ইশার দিকে তাকিয়ে ডাকল, ফিপপপি ইইইইইই।

ইশা কিছু বুঝতে পারল না। রিক ইশার কোলে পরীকে দিল। বলল,
‘ একটু নে। আমি আসছি।
রিক চলে গেল উপরে। পরী ইশার দিকে তাকিয়ে বলল, ফিপপপি ওয়াহ না??
ইশা খিক করে হেসে দিল। বলল,

‘ মা বউ সেজেছে।

পরী ইশার মত করে টেনে বলল,

‘ মাআআ বৌউউউউউ।

পরী মাথা এপাশওপাশ দুলিয়ে বলল,

‘ বৌউউউ বৌউউউ….

রিক নেমে এল নিচে। হাতে মুনার শোকেসে রাখা সব লিপিস্টিক। রিক যতগুলো পারল ততগুলো নিয়ে আসল। মুনা অবাক হলো রিকের কান্ড দেখে। বলল,

‘ এসব আপনার হাতে কেন?

রিক কিচ্ছু বলল না। পরী রিকের হাতে লিপিস্টিক দেখে চিৎকার করে বলে উঠল,পাপপপা ইইইইইইই।
ঠোঁট দেখিয়ে বলল ইশাকে, ফিপপপপি ইইইই।
ইশাসহ বাকি সবার ঠোঁটদুটো আপনাআপনি আলগা হয়ে গেল। পরী লিপিস্টিক দিবে বলছে? ও আল্লাহ।
রিকের হাত কাঁপল। সে দিয়ে দিতে পারল না। ইশাকে বলল, ইশু একটু ইইই দিয়ে দে তো মা কে।
রিক কোলে নিল পরীকে। ইশা হাসার জন্য কিছু বলতে পারল না। পরী রাগ করল। ফিপি এভাবে হাসছে কেন?
তাকে কি সুন্দর লাগছে না?
পরী ঠোঁট টেনে বলল, ইশআআআআ ওয়াহ না?
ইশা হাসি থামাল। পরীর গাল জোরে টেনে দিয়ে বলল, ওয়াহ,ওয়াহ। মা খুব সুন্দর। বিউটিফুল প্রিন্সেসস।
পরী ইশার মত করে বলতে চাইল, বিটটটিফু।
ফু বলার সময় ঠোঁটটা গোল করে ফেলল। ইশা হাসতে হাসতে লিপিস্টিক লাগাতে পারল না। পরী ধমক দিল,

‘ ইশআআআআআআ ভোববববব। ইইইইইই। ইশআআআআআ???

ইশা থেমে গেল। রিক বলল,

‘ আর হাসিস না। একটু ইইইই দিয়ে দে তো।

পরী মাথা নাড়াল। বলল, ইইইইই ওয়াহ।

ইশা বলল, তাহলে নড়বে না। ওকে?

পরী মাথা নাড়াল। ইশা পরীর খুব কাছে গেল। কোলে নিয়ে সোফায় বসিয়ে লিপিস্টিক লাগাতে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, কয়েকদিন থেকেছে দাদীর কাছে,, সব ডং শিখে গেছে।
পরী বুঝতে পারল ফিপপি তাকে বকা দিচ্ছে। ঠাসস করে চড় মারল ইশার নাকে। ইশা হকচকিয়ে গেল।

‘ মারলে কেন? আর দেব না ইইইইই।

পরী রেগে তাকাল। তুষ্টপুষ্ট গাল দুটো লাল টকটকে হলো। সোফা থেকে নিচে নেমে মেঝেতে বসে পড়ল। ঠাস ঠাস চড় মারল
মেঝেতে। যেন নিজের রাগ ঝাড়ছে। দুহাতের তালু দিয়ে ঠাসসস ঠাসস মেরে যাচ্ছে মেঝেতে। যেন কাউকে মারছে। ইশার এমন হাসি পেল রুম ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করল। পুরো ড্রয়িংরুমের সবাই হাসল। পরী কাঁদতে কাঁদতে তাকাল রিকের দিকে। ইশার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ পাপপপপপপা ফিপপপি দুক্ককু। ইইইইই নায় নায়।
রিক হাসল। ইশা বলল,
‘ বড়দা ধরবে না। দেখি কি করে? কত বড় সাহস, হাত নাড়ানো শিখে গিয়েছে। যাকে তাকে মারছে। মাইর গুলো ও শক্ত। আমি ব্যাথা পেয়েছি। খুব মারব তোমায় পরী।
পরী ঠোঁট টেনে তাকাল মুনার দিকে, রিকের দিকে। মুনা এগিয়ে আসতে চাইল। ইশা বলল, যেওনা। দেখি কি করে।
পরী ধমক দিল ইশাকে। ইশআআআ, ইনননা।
ইশা হাত দেখিয়ে বলল, খুব খুব খুব মারব।
পরী কেঁদে দিল। হাত দেখিয়ে কেঁদে কেঁদে বলল, মাবববববো।
ইশা হেসে দিল। বলল, মুখে মুখে কথা বলা ও শিখে গেছে?
পরী হাত তুলে আবার নিচে নামিয়ে মেঝেতে আঘাত করল। বলল, ইশবআআআ মাবববো।
ইশা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, ঠাসস করে মারব।
রিক বলল, থাম না। কান্না করছে না?
পরী সবাইকে অবাক করে দিয়ে, মেঝেতে এবার মাথা ঠুকল। দুমদুম মাথা ঠুকল মেঝেতে। যেন সিজদাহ দিচ্ছে। সবাই অবাক হয়ে গেল। পরী রাগে গজগজ করে করে মেঝেতে মাথা ঠুকে ঠুকে বলল,
‘ ইশআআআ মাববববো…. ইইই নায় নায়।

রিক দৌড়ে গিয়ে কোলে তুলে নিল পরীকে। বুকের সাথে চেপে ধরল। পরী রিকের মুখে ঠাসস ঠাসস চড় মারল। বলল, ইশআআআআ মাবববো।
রিক শান্ত করতে করতে বলল, হ্যা হ্যা মারব। খুব খুব মারব।
সাথে সাথে পরীর কান্না থেমে। ইশার দিকে আঙুল দেখিয়ে হেসে বলল, ইশআআআআআ মাবববো।
ইশা আড়চোখে তাকাল। পরী আবার গুজে গেল রিকের কাঁধে। ইশাকে ভয় পেল। রিক স্পষ্ট শুনল পরী মিনমিন করে বলছে, ইশআআ মাবববো।

লাল টকটকে শাড়ি পড়ে পুরো ড্রয়িংরুম ঘুরল পরী। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা বউ। পায়ের নূপুরগুলো শব্দহীন। হাতের চুড়িগুলো আওয়াজ তুলছে। পরী দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, পরররররী বৌউউউউউ।
রিক বলল, আমার মা লাল বউ।
পরী খিলখিল করে হেসে বলল, মাআআ নানন বৌউউউউ। সবাই হাসে। পুরো বাড়িটা যেন হাসে। ইশা হাসতে হাসতে আড়াল করে দাঁড়ায় সবাইকে। নিজেকে আড়াল। সাথে নিজের দুঃখগুলোকে। পরী এভাবেই হাসিখুশি থাকুক সবসময়। ভালো থাকুক। মা বাবা পরিবার নিয়ে তার উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ হোক। ভালো থাকুক তার বাচ্চা।
আর ভালো থাকুক বাচ্চার বাবা। ডক্টর। আইমির সাথে বিয়েটা হয়ে গেলেই ভালো। ডক্টর আবার এব্রোড চলে যাবে। নতুন করে সংসার সাজাবে। নতুন জীবনে পা রাখবে। দূরে যাবে কিন্তু ডক্টর তো ভালো থাকবে। তার অনিশ্চিত জীবনের সাথে ডক্টরকে জড়িয়ে কোনো লাভ নেই। ডক্টর কষ্ট পাবে অযথা। ডক্টরের জীবন ও তার সাথে সাথে অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সে চেয়েছে,আজ ও চায় ডক্টর ভালো থাকুক।

সদর দরজা পেরিয়ে ডুকে পড়ল রিপ। হাতের ইউনিফর্মটা সোফায় ছুড়ে দিয়ে বসতে না বসতেই চোখ গেল লাল টকটকে শাড়ি পড়া ছোট্ট মেয়েটার দিকে। কি সুন্দর লাগছে মা টাকে। পরী দৌড়ে এল রিপের কাছে। মুখের সামনে দুহাত দিয়ে লজ্জা ঢেকে বলল, রিইইইইই পরররী বৌউউউউউউউ। ওয়াহ না??
রিপ হাসল। তবে নিঃশব্দে। বলল,
‘ মা,,, বর কই?
পরী কিছুক্ষণ কিছু একটা ভাবল। পরক্ষণে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল,জহির মিয়াকে। বলল,ওততততো।
উপস্থিত সবাই হো হো করে হেসে উঠল। রিপ ও হাসল।
পরী কোমড়ে হাত দিয়ে ধমকে বলল,
‘ রিইইইই চককো দো।
রিপ পরীকে কোলের উপর বসাল। উচু করে রাখা ঠোঁট দুটো টেনে দিল। পরী হাত ডুকিয়ে দিল রিপের পকেটে। এত্তগুলো চকলেট বের করল। দুম করে রিপের গালে চুমু খেয়ে হাত দেখিয়ে রিপকে বলল,
‘ রিইইইইইই মাববববববো।
রিপ হেসে দিল। বলল, চককো নিয়ে আবার মাইর????
পরী মাথা নাড়াল। হাসল। নিজেকে দেখিয়ে দেখিয়ে বলল, রিইইই বৌউউউউ।
ইশা দৌড়ে এল। হাতে পানির গ্লাস। বলল, রিপদা পানি নাও। রিপ পরীর সাথে বকবক করল। কিন্তু পানি হাতে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে তাকাল না।
তালহা বেগম আসল। পরীকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
‘ এবার বউ নিয়ে আয় ঘরে। পরী ঠিকই বলছে। বিয়েশাদী তো করতে হবে। তাইনা?
পরী হাত তালি দিল। বৌউউউ বৌউউউউউউ।
রিপ চেয়ে থাকল মায়ের দিকে। অনেকক্ষণ চুপ থাকল। নীরবতা ভেঙে বলল,
‘ আমি তো এখানে থাকব না মা। আমি এখানে থাকার জন্য আসিনি। একেবারে আসিনি আমি। আমাকে যেতে হবে আবার। বিয়ের কথা কেন উঠছে?
ইশা চোখ পাকিয়ে দেখল তালহা বেগমের দিকে। মুনা অবাক হয়ে বলল,
‘ কোথায় যাবি। এখানেই তো ভালো পজিশনে আছিস? আর যাওয়ার কি দরকার?
রিপ কিচ্ছু বলল না। শুধু চলে যাওয়ার আগে এটুকু বলল,
‘ আমার জীবনের সিদ্ধান্ত আমার একার। আর কারো না। আমি যেটা বলব সেটাই হবে।
ইশার অবাক দৃষ্টি দেখল না রিপ। রিপদা আবার চলে যাবে? এরকম তো কথা ছিল না।
পরী জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে রিপের দিকে তাকায়। ডাকে, রিইইইই।
তার ডাকের এই অর্থ হচ্ছে, রিইইই এসব কি বলছে। সে বুঝতে পারছেনা কেন?

____________________

আদি আসল চৌধুরী বাড়ি। আদি ফিরতে না ফিরতেই মিনি এসেই ভর করল তার কাঁধে। ডাকল, আদি। আদি। মিস ইউ। মিস ইউ।
আদি চুপচাপ বেরিয়ে আসল মিনিকে নিয়ে। পিছু ফিরে দেখল না কাউকে। মিনুমা দাঁড়াতে বলল, রাইনা বলল। দাঁড়াল না। রেহানের হাতে চকলেট বক্স দিয়ে বলল, এটা রাখো। কোনো প্রশ্ন করবে না। চাচ্চু আবার আসবে।
আলিয়া চৌধুরী নিচে নেমে আসার আগেই আদি গাড়ি ছেড়ে দিল। অত কথা শোনার সময় কই তার? তার যে অনেক কাজ বাকি? অনেক বোঝাপড়া বাকি।

এবার মেয়েটাকে মুখোমুখি হতেই হবে আদি চৌধুরীর সামনে। লুকিয়ে আর কতদিন থাকবে। কতদিন গা ঢাকা দিয়ে থাকবে।
আদি ভেবে পায়না, কিসের এত ভয়,এত লাজ মেয়েটির?
নিজে দোষ করে এখন আবার গা ঢাকা দিয়ে আছে? কতটা নিষ্ঠুর,পাষাণ হলে মানুষ এমন করে?
তার তো কোনো দোষ নেই। সব দোষ ওই মেয়েটার। সব দোষ মেয়েটার। সব দোষ আলিয়া চৌধুরীর। সব দোষ আজিজ চৌধুরীর। সব দোষ ইমির। সব দোষ ওই মেয়েটার। কি নামে সম্বোধন করবে আদি তাকে? মিষ্টি নামে?

_____________________

সন্ধ্যে নামল শহরটাতে । বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। নীরা তার রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। মৃদুমধুর পানির ছিটকি এসে পড়ছে তার মুখে। সে সরল না। আজ এই মন কেমনের সন্ধ্যায় বৃষ্টির স্পর্শ অদ্ভুত ভালোলাগা হানা দিচ্ছে মনেপ্রাণে। আজ নয়, এ কয়েকদিন ধরে। কারণ তার বাসার পেছনেই রয়েছে একটি দীঘি। ওই দীঘির স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসে থাকা ছেলেটিই তার ভালোলাগার কারণ। তাদের বাসাটা দীঘির কিছুটা দূরে। জানালা দিয়ে দেখা যায় সেই দীঘির স্বচ্ছ জল। চারপাশে ঝোপঝাড় সেই দীঘির। ঝোপঝাড় বলা যায় না অবশ্য। কারণ ওই ঝোপঝাড় গুলোই সেই দীঘিটার সৌন্দর্য দ্বিগুণ হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বড় করে বাঁধা একটি ঘাটের মতো। বেশকিছু দিন ধরে সে লক্ষ্য করল একটি ছেলের অবয়ব সেই দীঘির ঘাটে। তার কখনো দীঘিটিকে সুন্দর মনে হয়নি। দীঘির স্বচ্ছ জলে কখনো নিজেকে দেখার ইচ্ছে জাগেনি। দুতলায় তাদের বাসা। ঘনঘন বাসা চেন্জ করতে হয়। বাবার চাকরির বদলির জন্য। দুবছর হয়েছে এই বাসায় তারা উঠেছে। এবারই বোধহয় প্রথম, যেখানে তারা দুবছর থেকেছে। বাসা পাল্টাতে হয়নি। কিন্তু এই বাসার প্রতি তার কোনোকালেই মায়া জন্মায়নি। সবাই বলে দীঘিতে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছ জলের কলকল ধ্বনিতে ও হারিয়ে যাওয়া যায়। মুগ্ধ হওয়া যায়। সেই কথা আজ অবিশ্বাস্য ভাবে সত্যি মনে হলো নীরার। ইচ্ছে করল ওই ছেলেটার পাশে বসে দীঘির স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে ঘোলা করে দিতে। তখন না হয় ছেলেটি একটি বার অন্তত রেগে কথা বলবে। তার দিকে তাকাবে। বলবে,
‘ এই মেয়ে কি করছ? নোংরা করছ কেন পানি?
তখন সে এক নিঃশ্বাসে চট করে বলে দেবে।
‘ করব না? আপনি যে আমার রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন। আপনি জানেন আমি কতরাত ঘুমায় না?
নিজের মনের এই অদম্য ইচ্ছাকে চট করে পূরণ করে ফেলতে ইচ্ছে হলো নীরার। কিন্তু তা সম্ভব নয়। ওই ছেলেটার দিকে তাকাতেই তার হৃৎপিন্ড কেঁপে উঠে। সেখানে পাশে বসার ইচ্ছাটা পোষণ করা আর মুখে মুখে তর্ক করার বিষয়টা কি হাস্যকর নয়??

ঝিরিঝিরি বৃষ্টির প্রকোপ বাড়ছে। ফোটা ফোটা বৃষ্টির ফোটা মিলিয়ে যাচ্ছে দীঘির জলে। নীরা গুনতে লাগল বৃষ্টির ফোটা।
‘ এক,দুই,তিন,চার,পাঁচ,ছয়,সাত…..
কিন্তু তার খেয়াল হলো ছেলেটি তো ভিজছে। আশ্চর্য ছেলেটা কি পাগল হলো? এভাবে ভিজছে কেন? আর এখানে এভাবে একা একা বসে থাকে কেন?

ইশা কি জানে তার ভাইটা পাগল হয়ে গেছে? এডভোকেট সাহেবকে তো দেখে মনে হয়না, প্রেমে পড়ে ছ্যাকা খাওয়ার মতো। তাহলে কিসের দুঃখে উনি ওভাবে ভিজবেন? আচ্ছা ছাতা নিয়ে গেলে কেমন হয়?

নীরা এবার আর দাঁড়াল না। নিজের এই দুদর্মনীয় ইচ্ছা পূরণ করার উত্তেজনায় সে খেয়াল করল না মা বাবার চোখে অদ্ভুত চাহনি। নীরার বাবা হেসে আওড়াল,

‘ প্রেমে পড়লে এমন হয় মাঝেমাঝে। আমি ও কি কম করেছি?

নীরা ছুটল ভিজে ভিজে। হাতের ছাতাটা ও খুলতে ভুলে গিয়েছে। বৃষ্টি শব্দটা পাল্টে সত্যি সত্যি এবার ঝড়ে রূপান্তর হলো। বৃষ্টি আর বৃষ্টি রইল না। তীব্র বাতাসে এলোমেলো হলো নীরার চুল। বৃষ্টির পানিতে লেপ্টে গেল সেই চুল মুখে, গলায় । নীরা সৌজন্য রক্ষার্থে হাতের ছাতাটা খুলল। কিন্তু সে কি কান্ডজ্ঞানহীন?
ছেলেটি ও তো ভিজেছে। সে ও ভিজে গেছে। এখন ছাতা দিয়ে কি হবে? এমন পাগলামোর কোনো মানে হয়? ছেলেটা দেখলে কি ভাববে কে জানে?

নিজেই নিজেকে বকল নীরা। দীঘির কাছাকাছি পৌছাতে সময় লাগল। যখন পৌঁছাল তখন দেখল ছেলেটি ভিজে জবজবে। আশেপাশের লোকজন অবাক হয়ে ছেলেটিকে দেখছে। নীরা বিরক্ত হলো নিজের উপর। সে কি চলে যাবে?
এতদূর এসেছে। আবার চলে যাবে?
বাতাসের ঝাপটায় রিপের মাথার চুলগুলো ও এলোমেলো হলো। তারপর ও তার ভাবনায় ছেদ পড়ল না। তার স্থির দৃষ্টি আর ও দৃঢ় হলো দীঘির জলে পড়া ফোঁটা ফোঁটা জলে। কি সুন্দর মিলিয়ে যাচ্ছে সব জল। তার অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো ও যদি মিলিয়ে যেত এভাবে। লুকিয়ে তো রেখেছে। এবার মিলিয়ে গেলে মন্দ হতো না।

নীরা যখন তার উলটপালট ভাবনায় মগ্ন তখন রিপ তাকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে থাকে। নীরা তখন তার জায়গায় দাঁড়িয়ে। লজ্জায় তার কান্না করে দিতে ইচ্ছে হলো। পিছু ফিরে দৌড় দিতে পারল না। না সামনে তাকাতে পারল। ছাতাটা ও বাতাসের দাপটে হাত থেকে উড়ে যেতে চাইল। সে ছাতাটাকে শক্ত করে ধরল। মুখ বরাবর ধরে রাখল যাতে না সরে, কেউ তার মুখ না দেখে। রিপ এগোতে এগোতে থমকে গেল । নীরা ছাতায় মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে দোয়া দরূদ পড়তে লাগল।

তার প্রার্থনা সফল হলোনা। বাতাস তার বড়ই উপকার করল। ছাতাটাকে নিজের করে নিল। উড়িয়ে ফেলে দিল। পড়ে রইল ছাতাটি এককোণায় । নীরার ভয়ার্ত মুখশ্রী ভূমিষ্ঠ হলো ছেলেটির সামনে। সে ছাতা উড়ে যাওয়ায় চট করে চোখ খুলে সামনে তাকাল। চোখগুলো তখন বড় বড় অবস্থায়। ভয় ঢেউ খেলে খাচ্ছে চোখেমুখে । ভয়ে ভয়ে সে কেঁপে কেঁপে উঠছে। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি ভাবলেশহীন। অনুভূতিহীন। চাহনি অবাককর নয়। প্রেমে পড়ার মতো নয়। প্রেমে ফেলার মতো। ঠিক সেটাই হলো। প্রেমে পড়ে গেল তার সামনে দাঁড়ানো রমণীটি। আবার ও। নতুন করে।

যদি সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি তার দিকে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে না থাকত, বৃষ্টি জলে ভিজে ভিজে সে বলে উঠত,

‘ আজ প্রেম এসেছে বৃষ্টি হয়ে। মন কেমনের প্রেম এসেছে আজ মন কেমনের বৃষ্টি হয়ে, মন কেমনের সন্ধ্যায় ।

কিন্তু সে বলতে পারল না। নড়তে পারল না। শুধু চোখ বন্ধ করে নিল। সেইভাবে দাঁড়ানো অবস্থায় বিড়বিড় করে বলল,

‘ থেমে যাক। থেমে যাক। সময়টা এখানেই থেমে যাক। এখানেই সবকিছু স্তব্ধ হয়ে যাক। তার চোখের দৃষ্টি শুধু আমাতে,শুধু আমাতেই নিবদ্ধ থাক।

কিন্তু মেয়েটি যদি একটিবার চোখ মেলে দেখত,তাহলে দেখতে পেত ছেলেটি বহুআগেই উদাও হয়েছে তার সামনে থেকে। তার যে নতুন করে আর কারো প্রেমে পড়া সম্ভব নয়। সে তো বোধহয় নীরা নামের মেয়েটিকে দেখলই না। প্রেমে কিভাবে পড়বে? বরঞ্চ প্রেমে ফেলে চলে গেল।

মেয়েটি চোখ মেলে সত্যিই কাউকে দেখল না। ছেলেটি রেখে গেল তার এক মন কেমন করা নিঃশ্বাসের মিষ্টি সুবাস। রেখে গেল এক মন কেমন করা অনুভূতিদের তীব্র আন্দোলন। রেখে গেল এক তৃষ্ণার্ত প্রেমিকার দুটো চোখ। কিন্তু দেখে গেলনা একটিবার পিছু ফিরে,,, নীরা নামের মেয়েটির হৃদয়সিন্ধুকে তারই নাম লেখা হয়েছে বহু আগে, বৃষ্টিপথিক নামে। দেখে গেল না। দেখা হলো না। কবে দেখবে? কবে চোখে পড়বে?
#মন_কেমনের_বৃষ্টি
#পর্ব_৩০
#পুষ্পিতা_প্রিমা

ড্রয়িংরুমে এল আইমি। বাবা আর চাচ্চু কথা বলছে। ইমদাদ সাহেব তাকে দেখামাত্রই বলল, ইমি দেখাও ছবি।
আইমি বলল, সারপ্রাইজ চাচ্চু।
ইমদাদ সাহেব হাসল। বলল, নো ডিয়ার। আমার তর সইছেনা। মিস্টারের ছবি আমি আজই দেখব।
আইমির কাজিন নেমে এল। বলল, বাবা ইমি আপুর বরের নাম কি জানো?

ইমদাদ সাহেব হাসল। বলল,

‘ জানব কি করে? ইমি তো বলছেই না। ভাই ও বলছে না।

আফাজ আহমেদ বলল,
‘ আমি তোকে বলেছিলাম ইমদাদ। আদি চৌধুরী। আজিজ চৌধুরীর ছোট ছেলে। তুই বোধহয় খেয়াল করিস নি? আদি মানে ওই আদি।

ইমদাদ সাহেব হাসল। আইমি বলল,

‘ চিটার বাবা। তুমি বলে দিয়েছ কেন?

আফাজ সাহেব হেসে সোফায় আয়েশি ভঙ্গিতে বসল। বলল,

‘ সরি মা। তোর চাচ্চুকে অনেক নাচিয়েছিস। তোর যে আদির সাথেই বিয়ে হচ্ছে এটা শুনে ওর চেহারাটার দিকে তাকিয়ে দেখ একবার। শক খেয়েছে প্রচুর পরিমাণ।

সবার হাসির মাঝে চেহারাখানা মলিন হয়ে আসল ইমদাদ সাহেবের। আদি চৌধুরী মানে?
ইমদাদ সাহেব হাসিখুশি আইমির চেহারার দিকে তাকিয়ে চট করে সোফা ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। কাজ আছে।

সবার অবাক দৃষ্টি উপেক্ষা করে ইমদাদ সাহেব বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। বাইরে এসে ফোন দিল আদির ফোনে। কয়েকবার রিং হলে ও কেউ ফোন তুলল না। ইমদাদ সাহেবের চেহারা রঙ পাল্টে গেল নিমেষেই। রাগ হচ্ছে আদির উপর। নিজের স্ত্রীর,বাচ্চার খোঁজখবর না নিয়ে আদি আবার বিয়ে করতে যাচ্ছে? বিয়ের ফাংশন তো আর দুইদিন পর। কি হবে?

_______________

বৃষ্টি থামায় ঠান্ডা শীতল পরিবেশ চারপাশে। ইশা ছাদের রেলিংয়ে হাত দিয়ে নাক দিয়ে শুঁকল বকুল ফুলের গন্ধ। কতদিন ছুঁই নি সো বকুল। আজ কুড়িয়ে এনেছে কয়েকটা। রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের মৃদুমৃদু আলোয় আবছা আবছা দেখা গেল একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে খান বাড়ির গেইটের কিছুটা দূরে। ইশা বিশেষ পাত্তা না দিলে ও তার ভয়টাই সত্যি হলো। সে দৌড়ে নিচে নামল। গেইট বন্ধ করে দেওয়ার মতো চিন্তা তার মাথায় এল। সে দৌড়ে গেল, অদৃশ্য বাঁধায় পারল না গেইট বন্ধ করতে। গেইট ফেলে সে বেরিয়ে পড়ল নির্জন রাস্তায়। গাড়িটার কাছাকাছি যেতে না যেতেই মাথা নিচু করে গাড়ির উপর বসে থাকা ছেলেটিকে দেখে তার বুক কাঁপল ছন্দ তুলে। মুখ ফসকে আপনাআপনি বের হলো একটি শব্দ, ডক্টর?
ঠিক তিনবছর আগে ডক্টরকে সে দুবার এভাবে বসে থাকতে দেখেছে। আজ আবার ও? কিন্তু কেন?
আদি মুখ তুলল না। ইশা নিঃশব্দে সিদ্ধান্ত নিল সে চলে যাবে । ঠিক তাই করল। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আবার পিছু ফিরে তাকাল। সিদ্ধান্ত এবার পাকাপোক্ত হলো।

দৌড়ে চলে যাওয়ার আগেই ধীরে ধীরে আদি ঘুরে এল গাড়ির অন্যপাশ দিয়ে। গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল আকাশের দিকে মুখ করে। তাকাল না ইশার দিকে। অন্যহাতে থাকা খাঁচার দরজা খুলে দিল। মিনি উড়ে উড়ে চলে আসল একদম ইশার কাছে। ইশার গালে গাল ঘষে ডেকে উঠল,

‘ মিষ্টি। মিষ্টি। মিস ইউ। মিস ইউ।

ইশার পা দুটো অনবরত কাঁপাকাঁপি করতে লাগল। বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেল। সে পিছু হাঁটল। মিনিকে সরাতেই চাইলে ও মিনি সরল না। ডাকল,

‘ আদি। মিষ্টি। আদি। মিষ্টি। লাভ ইউ। লাভ ইউ।

ইশা তারপর ও দু পা পিছু হাঁটল। মিনিকে সরাতে চাইল। চিৎকার করে তার বলতে ইচ্ছে হলো।

‘ সব মিথ্যে। সবটা মিথ্যে। আমি মিষ্টি নই। আমি নই মিষ্টি।

কিন্তু সে উচ্চারণ করতে পারল না। চোখ সরাতে পারল না তার দিকে এগোনো ছেলেটির চোখ থেকে। ছেলেটির ভয়ানক দৃষ্টি উলটপালট করে দিচ্ছে সব। নিঃশেষ করে দিচ্ছে মিষ্টির এতদিনের জমে থাকা রাগ,অভিমান।
সে নিচে তাকিয়ে বলল,
‘ কি হচ্ছে এসব? আমি চিনি না এসব। জানিনা। কিচ্ছু জানিনা। এগোবেন না।
আমি চিৎকার করব।
আদির নীরবতা ভাঙল। সে চিৎকার করে উঠল।
‘ করো চিৎকার। করো। চিৎকার করে বলো আমি ঠকিয়েছি ডক্টরকে। বলো। বলো!

ইশা থমকে গেল আদির চেঁচিয়ে বলা কথায় আর তুমি,, ঠিক আগের তুমি সম্বন্ধে । বিড়বিড় করে কি যেন বলল। আদি তার বিষণ্ণ চেহারায় অসহায় হয়ে তাকাল মিষ্টির দিকে। ইশা গলল না তারপর ও। ঘাড় ঘুরিয়ে দৌড় দিতে চাইল। কিন্তু হিতে বিপরীত কিছু হলো। সে আটকা পড়ল। আটকে গেল বহুদিন পর ডক্টরের বাহুবন্ধনে। একেবারে বুকের মধ্যিখানে যখন এসে তার মুখ ঠেকল সে স্পষ্ট শুনতে পেল সেই ডাক,
‘ মিষ্টি। মিষ্টি। মিষ্টি,,,,,,,,,,,,,,
আদিকে মিষ্টিকে তার বুক থেকে মুখ তুলে দুইবাহু খামচে ধরল। চেয়ে রইল মিষ্টির ভয়ার্ত মুখের দিকে। ডাগর ডাগর চোখদুটোর দিকে।
মিষ্টির গলার একপাশে চোখদুটো চেপে ধরে বলল, আই হেইট ইউ। রিয়েলি হেইট ইউ। হেইট ইউ সো মাচ মিষ্টি।
তোমার জন্য টেডিবিয়ার আমি এনেছি মিষ্টি। আছে আমার কাছে খুব যত্নে। খুব যত্নে রেখেছি আমি সেটিকে।
কিন্তু আমারটা কোথায়? আমার দেওয়া পুতুলটি? সেটা কোথায় মিষ্টি? তুমি মেরে ফেলেছ?
মিষ্টি গলে আসে। কিন্তু সেই গলানিকে স্থায়ী হতে দেয়না সে। দূরে ঠেলে দেয় আদিকে। চেঁচিয়ে বলে,
‘ কোথাও নেই সে। হারিয়ে গেছে। আপনার জন্য সে মরে গেছে। মিষ্টি ও মরে গেছে। যান। সরুন। আমার পথ ছাড়ুন।
সে চলে যায় আদিকে একা রেখে। আদির ভয়ংকর চাহনি নিমেষেই পরিণত। হয়
অসহায়ে।

সে ওই চলে যাওয়া মেয়েটিকে কি করে ভালোবেসেছিল? যার মনে দয়া মায়া, ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ও নেই তার প্রতি। বহুদিন পর আজ তার স্পর্শে কেঁপে উঠার কথা ছিল মিষ্টির । চোখের চাহনিতে হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। বহুদিন পর আজ হেসেখেলে বলার কথা ছিল,
‘ ডক্টর আমাদের বাচ্চা আছে। আমার কাছে আছে। আমি যত্নে রেখেছি তাকে।
কিন্তু মেয়েটি তা বলল না। বলল, সে নাকি হারিয়ে গেছে। বুক কাঁপল না মিষ্টির। ঠোঁট কাঁপল। গলা ধরে এলো না। এতবড় কঠিন কথা কি করে একজন মা বলতে পারে?

আদির ফোন বাজল। সে বসে রইল গাড়ির উপর কতক্ষণ!
ফোন বাজল বেশ কয়েকবার। ফোন তুলল সে অবশেষে । ফোনের ওপাশে এক মায়ের আহাজারি শোনা গেল।

‘ আদি মিনিকে নিয়ে চলে গেলে? মায়ের সাথে দেখা করলে না একবার? তোমাকে যে অনেক কথা বলার ছিল। একটিবার মায়ের কথা মন দিয়ে শোনো। তুমি আমার আদরের বাচ্চা। তোমার খারাপ কি করে চাই আমি?

বলতে না বলতেই আলিয়া কাঁদল। আদি তার নীরবতায় জল ঢেলে দিয়ে বলল,

‘ কেন কাঁদছ মা? তোমার বাচ্চা তোমার কথা শুনছে না বলে? শুধু কথা শুনছে না বলে?

আর আমার বাচ্চা? সে নেই মা। হারিয়ে গেছে। মরে গেছে। আমার বাচ্চা মৃত মা। মিষ্টি বলেছে।

আলিয়া না না করে উঠল। বলল,

‘ তোমার বাচ্চা বেঁচে আছে আদি। তোমার একটা রাজকন্যা আছে। একটি জীবন্ত পুতুল আছে। সে বেঁচে আছে। সে কোমল ঠোঁট দুটো নেড়ে কথা বলে। পিটপিট করে তাকায়। খিলখিল করে হাসে। ঠোঁট ফুলিয়ে কান্না করে। গুটিগুটি পায়ে হাঁটে। পাকা পাকা কথা বলে। আমাকে দাদ্দা ডেকেছে আদি। তুমি জানো ও খুব দুষ্টু। ও তোমার বাবাকে মুখ ভাঙিয়ে দিয়েছে। তুমি জানো সে সেজে আয়নায় নিজেকে দেখে খিলখিল করে হাসে। ও তোমার প্রিন্সেস আদি। চোখদুটো তোমার মতো। ওর রাগগুলো তোমার মত আদি। ভীষণ রাগী। তোমার মেয়ে।

আদি কথা বলতে পারেনা। শুকনো ঢোক গিলে বলে,
‘ মা আমার প্রিন্সেস আছে? আমাকে বাবা ডাকে? আমার কথা তার মনে পড়ে কখনো? মিষ্টিকে মা ডাকে?
আলিয়া চুপ হয়ে যায়। বলে, সে খান বাড়িতেই আছে আদি। আদিশা খানম পরী। তোমার প্রিন্সেস।

কিছুক্ষণের মধ্যে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। আদি মনোযোগ দেয় ফোনে। ফোনের ওয়ালে নিয়ে আসে মনকাড়া, নজরকাড়া একটি ছবি। যেখানে একটি মা তার মেয়ের গালে গাল রেখে হসপিটালের কেবিনে শুয়ে আছে আধশোয়া হয়ে। কি অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য! কি মনোরম! কি মনোমুগ্ধকর!
আদি হাসল ছলছল চোখে। ফোনের ওয়ালে হাত বুলিয়ে বলল, ওতততো মাই প্রিন্সেস! আদিশা!!!

ইশা ঘুমন্ত পরীকে দোলনা থেকে নিয়ে নিল কোলে। দোলনায় ঘুমোবে বলে বায়না ধরেছিলল । রিকের সাথে বকবক করতে করতে এই অসময়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে এভাবে আচমকা কোলে নিয়ে নেওয়ায় রিক অবাক হয়ে পড়ল। কোনো কথা বলতে পারল না ইশার কান্না দেখে। মুনা ছুটে এল তার পিছু পিছু সাথে তালহা বেগম ও। ইশা দেয়াল ঘেষে বসে পড়ল পরীকে কোলে নিয়ে। ঘুমন্ত পরীর ঠো্টে চুমু খেল। পুরো গালে, মুখে মমতার স্পর্শ একেঁ দিল। বুকের সাথে চেপে ধরে এলোমেলো হয়ে কাঁদল। ছোট্টছোট্ট চুল গুলো কপাল থেকে সরিয়ে পাগলের মতো চুমু খেয়ে বকতে লাগল,

‘ আদিশা। আমি দেবনা ওকে। কাউকে দেব না। ডক্টরকে দেবনা। ও আমার কাছে থাকবে। আমার সামনে থাকবে। আমি কাউকে দেব না। বড়দা তোমাকে ও দেব না। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি ওকে আমার কাছে রাখব। ও আমার মেয়ে। শুধু আমার মেয়ে। ডক্টর ওকে নিয়ে যাবে! আমি দেব না। না। না
কিছুতেই দেব না। এই শোন তুই যাবি না। আমাকে ছেড়ে যাবি না। আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না। আমি ডক্টরকে ছাড়া বাঁচতে শিখেছি। কিন্তু তোকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।

গুনগুন করে কাঁদল সে। হাঁটুমুড়ে। কোলে বাচ্চা মেয়েটি। মুনা এগোনোর সাহস পেল না। রিক ও সাহস পেল না। পরী নড়লচড়ল। মায়ের বুক পেয়ে আবার ও তলিয়ে গেল ঘুমের দেশে।

দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল রিপ। ইশা তখন পরীর মাথায় মুখ লাগিয়ে বসে আছে। রিপ এগিয়ে গেল ইশার কাছে। একটি হাঁটুগেড়ে বসল ইশার কাছে। ইশা ধীরে ধীরে মাথা তুলে তাকাল রিপের দিকে। ইশা কেঁদে দিল।

‘ রিপদা। আমায় ক্ষমা করো তুমি। রেগে থেকোনা। মুখ ফিরিয়ে থেকোনা। আমার কষ্ট হচ্ছে রিপদা।

রিপ চুপটি মেরে শুনল ইশার কথা। কিছুক্ষণ পর বলল,

‘ ফিরতে হবে আপনাকে। ডক্টর আদির কাছে। খুব শীঘ্রই। প্রস্তুতি নিন। মিসেস চৌধুরী।

ইশা চেপে ধরল পরীকে।

‘ যাব না রিপদা। এভাবে বলোনা। আমি নিজেকে আর জড়াতে পারব না ডক্টরের সাথে। পারব না। ডক্টর আইমির সাথেই ভালো থাকুক। শুধু আমার মেয়েটাকে নিয়ে না গেলে হবে। পরী আমার কাছে থাকবে। শুধু আমার কাছে থাকবে। তুমি যেওনা রিপদা।

______________

রিপ গুছিয়ে নিয়েছে স্যুটকেস। লন্ডনে ফেরার জন্য নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। এবার আর কোনো পিছুটান নেই তার। কারো জন্য আর দিনরাত চিন্তায় মগ্ন থাকতে হবেনা। কারো একটা ফোনের অপেক্ষায় দিনতিপাত করতে হবেনা। কারো মিষ্টি কন্ঠস্বর শোনার জন্য চাতকের মতো অপেক্ষা করতে হবেনা। এবার সে মুক্ত। এবার নিজেকে নিয়ে বাঁচার লড়াই। নিজের কথা ভাবার লড়াই। নিজেকে নিয়ে তার পৃথিবীটা সাজাবে এবার। নিজেকে ভালোবাসবে এবার।
দুপুর থেকেই পুরো বাড়িটা থমথমে। তালহা বেগম শুকনো মুখে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। জহির মিয়া বেতের চেয়ারে বসা। রান্নাঘরে টুকিটাকি কাজ করছে মুনা। রিক রিপের সাথে এয়ারপোর্ট যাবে। রিপ নেমে এল নিচে। চুল কাটিং করেছে। তাই আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে। রিপ নিচে নেমে এল। মুনার সাথে আলাপ শেষ করল। মা বাবাকে সালাম করল। তাদের দিকে না তাকিয়ে বলল,
‘ আমায় দোয়া করো। তোমাদের আবদার না রাখতে পারায় আমি দুঃখিত। বিয়ে নামক শব্দটার কোনো জায়গা হবে না আমার জীবনে। আমি ঠাই দেব না সেই শব্দটিকে। আমার ভালো লাগেনা। কি দরকার। আমি এভাবেই ভালো আছি। আমি যাচ্ছি।
তালহা বেগম ডুকরে কেঁদে উঠে। বলে,
‘ কেন বারবার যাচ্ছি, যাচ্ছি বলিস?
রিপ হাসল। মাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, আসছি। আসছি বাবা।
মুনা দৌড়ে এল। কোলে তার পরী। ঘুমন্ত। রিপ নিয়ে নিল পরীকে। বলল,
‘ কে বলেছে আমার পিছুটান নেই? আমার পিছুটান তো এই মা। আমার পরী মা। এই মাকে আমি খুব খুব মিস করব। আমার কষ্ট হবে। খুব কষ্ট হবে।
মুনা শান্ত কন্ঠে বলল,
‘ ইশুর সাথে দেখা করবি না? ঘুমের ঔষধ নিয়েছে ও । শরীরটা ও ভারী অসুস্থ। ওকে এই অবস্থায় রেখে চলে যাবি?

‘ ডাক্তারের বউদের কাছে এসব সামান্য অসুস্থতা। ডাক্তার তো আছেই। কি দরকার আমার মতো ছোঁয়াছে রোগীকে। আমি ছুঁলে সে বরঞ্চ আর ও অসুস্থ হবে।
রিপের কন্ঠে মেশানো উৎকন্ঠা তারপর ও। ”’ বড়দাকে বলেছি একটা ভালো ডাক্তার দেখাতে। ভালো হয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। চিন্তা করোনা। আমি আসছি। দেখে রেখো।

রিপ চলে যায়। গাড়ি নিরুদ্দেশ হয় মুহূর্তে খান বাড়ির গেইট পেরিয়ে।

________________

সেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে ইশা। উঠার নামগন্ধ নেই। পরীকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়েছে। কাউকেই দিতে চাইছিল না। ছুতে ও দিচ্ছিল না। মুনা তাই পরীর সাথে ঘুমাতে বলেছিল। ঘুমানোর আগে বলেছিল, আমি ঘুমের ঔষধ নিয়েছি। আমার মেয়েকে পাশে রেখো। আমি আজকে ঘুমোবো ওর সাথে। মানা করোনা প্লিজ। শুধু আজ।
কিন্তু এতক্ষণে ও উঠছেনা কেন সে? সে কি জানে তার রিপদা চলে গিয়েছে?
মুনা পায়ে হাত দিতেই দেখল পা বরফ। হাত ও ঠান্ডা বরফ। মুনা চেঁচিয়ে ডাকল সবাইকে। শুধু তালহা আর জহির মিয়া এগিয়ে আসল। রিক তো রিপের সাথে। পরী গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসল। বিছানার উপর উঠে ইশার মুখ ধরে ডাকল,
‘ ফিপপপি????
ফিপি চোখ তুলে তাকাল না। পরী বলে ডাকল না। মা বলে ডেকে উঠল না। পরীর রাগ লাগল। কষ্ট লাগল। ইশার মুখে ঠাস করে চড় মেরে ডাকল, আমমমমমমা?
ইশা তারপর ও চোখ খুলল না। পরী তার ভেজা গাল লাগিয়ে দিল ইশার চোখ দুটোতে। মুখে। ঠোঁটে।
ইশা তারপর ও জেগে উঠল না। পরী এবার কাঁদল। নিজের মাথা ঠুকল খাটের সাথে। কান্না করল। তার কান্না দেখার সময় কারো হয়ে উঠল না। আশেপাশের লোকজন ডেকে এনে ইশাকে তোলা হলো অ্যাম্বুলেন্সে। তালহা বেগম আর জহির মিয়ার আহাজারিতে ভারী হলো পরিবেশ। সাথে পরীর। পরী কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে পড়ল সেই লোকজনের পিছুপিছু। মুনা আটকাতে গেলে হাতে কামড় বসাল। তালহার চুল টেনে দিল। কাঁদতে কাঁদতে এসে গেল গেইটের কাছাকাছি। হাতের মুঠো দিয়ে চোখ মুছল। অ্যাম্বুলেন্সটার দিকে তাকিয়ে কাঁদল। হাত বাড়িয়ে ডাকল, আমমমমমমা আয় আয় আয়। আমমমমা!!

চলবে,
চলবে,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here