মায়ন্তী পর্ব -০১

সিঁড়ি বেয়ে আলতো পায়ে টিপে টিপে হাঁটছি আমি।
আজ প্রথম শাড়ি পড়েছি। মূলত আপুই পড়িয়ে দিয়েছে। এক হাতে শাড়ির কুঁচি মুঠোয় নিয়ে এদিকে ওদিকে তাকাচ্ছি আমি। নিজের অসাবধানতার কারনে শাড়িতে পিরিরিয়ডের দাগ লেগে গেছে। চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। বিয়ে বাড়িতে কত মানুষ। কারো নজরে পড়ে গেলে লজ্জার ব্যপার হয়ে যাবে।

আজ আমার আপু মীনাক্ষী সিনহা’র বিয়ে। দীর্ঘ ৩ বছর রিলেশনে’র পর বিয়ে করছে আয়ুষ্মান ভাইয়া ও আপু।

আপুর বিয়ে বলে কথা শখের বসে শাড়ি পড়েছি। নীল শাড়িতে সেজেছি। খোঁপায় বেলীফুল গুজেছি। বান্ধবীদের সাথে লাফালাফি করতে গিয়ে কি থেকে কি হয়ে গেলো।

সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে চারপাশে লোকজন দেখে নিচ্ছি কারো যেন চোখে না পড়ি। সিঁড়ি থেকে নেমেই নিজের রুমের দিকে ১ পা এগুতেই –

মায়ন্তী এই মায়ন্তী তোর কানে কথা যায়না। কখন থেকে ডাকছি? কাকী মা’কে বললাম তোকে ডেকে দিতে তাঁর তো পাত্তাই নেই।

এদিকে আয় তো দেখ তোদের সবার জন্য বৌ-ভাতের জামা ও শাড়ি অর্ডার করেছিলাম অনলাইনে । এখনেই ডেলিভারী দিয়ে গেছে। সবাই এগুলো পড়ে-ই পরশু যাবি। নিজেরা যা কিনেছিস। তুই তো আবার বৌ-ভাতে যাওয়ার জন্য শাড়ি কিনেছিস। মাথা মোটা তোকে শাড়িতে দেখ একটুও মানাচ্ছে না। তোর জন্য সুন্দর একটা গাউন নিয়ে এসেছি ওটাই পড়বি। তুই শাড়ি কিনেছিস বৌ ভাতে পড়ার জন্য শুনেই আমার কেমন বাজে লেগেছে তাই কালকে অর্ডার করেছিলাম আজকেই দিয়ে গেলো।

এইযে ইনি হচ্ছেন আমাদের গুনধর মায়াঙ্ক ভাইয়া। আমাদের সম্পর্কে কাজিন। বিদেশে থাকে। আমার জীবনের ভয়ের ব্যাপার একটাই মায়াঙ্ক ভাইয়ার সামনে আসা। ভাইয়ার নাম শুনলেই কেমন যেন আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। তবে ভাইয়া দেখতে ভীষণ সুন্দর। ভাইয়াকে আমার দূর থেকে অনেক ভালো লাগে কি সুন্দর হাসি ওনার! মাথার চুল গুলো ভীষণ সিল্কি,আমার চুলও কম যায় না । তবে আমার চুলকেও ছাড়িয়ে যায় প্রায়। লম্বায় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি। ভাইয়া ভীষণ গোমরা মুখো দরকার ছাড়া আমার সাথে একটাও কথা বলেনা। যখনই সামনে পড়বো ধমকিয়ে কাজে লাগিয়ে দিবে।

আমি মায়ন্তী সিনহা। অনার্স প্রথম বর্ষে উঠেছি এইবার। লোকে বলে আমি সাদা-সিধে কিন্তু আমি কি আমি ছাড়া কেউ জানেনা।

আমরা দু-বোন। মীনাক্ষী সিনহা ও মায়ন্তী সিনহা। আমরা বড় জেঠুর বাসায় থাকি বাবার চাকরি চলে যাওয়ার পর থেকে দীর্ঘ ৪ বছর থেকে আমরা সবাই একই বাসায় থাকি। আমাদের পুরো পরিবার বলতে কাকি মনি, কাকু,মায়াঙ্ক ভাইয়া, আমি,আপুই,মা-বাবা। সবাই একই সাথে থাকলেও মায়াঙ্ক ভাইয়া আমাদের সাথে থাকেন না।

ভাইয়া গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে নিজের দেশে চাকরি না নিয়ে আজ থেকে তিনবছর আগে বিদেশে চলে গেছেন।

মীনাক্ষী আপুর বিয়ে উপলক্ষে এসেছেন । এসেছেন তো এসেছেনই তবে আমার জম হয়ে এসেছেন । আপুর বিয়ের যত কাজ আমাকে দিয়েই করিয়ে নিচ্ছেন । একটু এদিকে ওদিকে গেলেই মায়ন্তী এই মায়ন্তী কই তুই । সবার সাথেই কি সুন্দর করে কথা বলেন আর আমার সাথে ব্লা ব্লা —

কথা না শুনলে ঠাসস। এখন পর্যন্ত চারদিনে ৮টার বেশি চর খেয়েছি। আবার শাড়ি এনেছে ঢং করে। আমাদের কেনাকাটা গুলো মনে হয় খুব খারাপ ছিলো। ভাইয়া কে বুঝতে না দিয়ে একটা ভেঙ্গচি কাটলাম ।

কিরে মায়ন্তী তোর কানে কথা যায় না। চর খাইতে ইচ্ছা করেছে তোর?

না না ভাইয়া বলে ভাইয়ার দিকে এগুতে যাবো। তখন-ই মনে পড়ে গেল এই যা আমার শাড়িতে তো– ভাইয়া দেখে ফেললে লজ্জায় মরে যাবো।

ভা ভা ভাইয়া আ আ আমি একটু পর আচ্ছি। বলেই এক দৌড়ে নিজের রুমে ঢুকে ঠাসস করে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

ভাইয়া ওদিকে মায়ন্তী, মায়ন্তী বলে চিল্লাচ্ছে। কন্ঠ শুনেই বুঝা যাচ্ছে ভীষণ রেগে গেছে।

আমি আর বাইরের কথায় কান না দিয়ে শাড়ি খুলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। নিজে ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসলাম। আমার রুমের দরজা বাইরে থেকে খোলা যায় বিধায় বেড়িয়ে দেখি মীনাক্ষী আপু বসে আছে। বধু বেশে আমার বোনটাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।

আপু তুমি এখানে! উমম আয়ুষ্মান ভাইয়াকে দেখার জন্য মনে হয় আর তর সইছে না তাইনা। আপুকে একটু ফাজলামো শুরে বলে আপুর কাছে গেলাম।

আপু একটানে নিজের কাছে বসিয়ে দিলো। কিরে কি হয়েছে তোর? এত কষ্ট করে শাড়ি পড়িয়ে দিলাম তুই এখন আবার চেঞ্জ করলি? আবার এই সময় গোসল ও করলি? শরীর খারাপ করেছে নাকি?

আরে আপু আর বলো না। জানোই তো আজ কত তারিখ। ঐ ছাঁদে অবন্তী, অহনাদের সাথে লাফালাফি করতে গিয়ে শাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে তাই।

ও আচ্ছা বুঝেছি। যাই হোক তাড়াতাড়ি এই শাড়িটা পড়ে নে আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো । শোন আমাকে মায়াঙ্ক ভাইয়া পাঠালো তোকে নিয়ে যেতে। ভাইয়ার কথা নাকি শুনিসনি ভাইয়া খুব রেগে আছে। তাড়াতাড়ি নে আমি গেলাম।

আচ্ছা আপু আমি রেডি হচ্ছি। তুমি গিয়ে রজনীতে বসো । বলে আপু বাইরে গেলে দরজাটা লাগাই দিলাম।

আপু বেড়িয়ে যাওয়ায় আমি আনমনে ডেসিনের সামনে চুল মুছতে লাগলাম। গুনগুন করে গান গাইতে লাগলাম আর ভাইয়াকে গালি দিতে লাগলাম খাটাশ,গোমরা মুখো সবসময়ই রাগ।

বলতে বলতে শাড়ি হাতে নিলাম। বাহ গোলাপি রঙের সুন্দর একটা শাড়ি। হাতে নিয়ে পড়তে নিবো এই যা শাড়িতো আমি পড়তে পারিনা এখন কি হবে?

অহনা,অবন্তী ওরা তো ছাঁদে আপুও রজনীতে বসেছে এখন কি হবে? ধূর ভালো লাগেনা। এখন কি হবে? এ্যা এ্যা —

মায়ন্তী তোকে পারতেই হবে হুহ্ তুই পারবি বলেই নিজে নিজে উঠেই পড়তে শুরু করলাম। শাড়ি পড়তে প্রায় ১ ঘন্টা সময় খেয়ে ফেললাম। ইতিমধ্যে বাইরে বর যাত্রী এসে উপস্থিত হয়েছে — বাইরে দেখে মা ও কাকি মনি একবার এসে ডেকে গেছে।

চুল এখন অব্ধি শুকোয়নি। চুল ছেড়ে দিয়ে পুনরায় বেলীফুলের মালা চুলে দিলাম। কানে এক জোড়া ঝুমকো,কপালে টিকলি,গলায় একটা চিক হার। ব্যাস আমি তৈরি।

দরজা খুলতেই হুরমুর করে কেউ ভিতরে ঢুকে পড়লো আমার হাত জোড়া ধরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো। আমি বেশ ভয় পেয়েছি। চোখ মুখ বন্ধ করে নিয়েছি। সামনে থাকা ব্যাক্তিটি বললো —

তোর সাহস কি করে হয় আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার। আমার কথা তোর কানে যায়নি চলে এসেছিলি কেন? তোকে এই সাহস কে দিয়েছে?

ধমকিয়ে কথা গুলো বলতে লাগলো! আমি চোখ খুলে দেখি মায়াঙ্ক ভাইয়া। ভাইয়া ভীষণ রাগ হয়ে আছে। ওনার ফর্সা মুখ লাল আকার ধারন করেছে। ভাইয়াকে দেখে বেশ আমার ভয় লাগছে। ভা ভা ভাইয়া আমার হাতে লাগছে আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ব্যথা পাচ্ছি। আমি ইচ্ছে করে আসিনি। কিছু একটা ভুলে যাওয়ায় চলে এসেছিলাম।

মায়াঙ্ক ভাইয়া আমার কথা না শুনেই আমার হাত দুটো আর-ও চেপে ধরলেন। রাগী চোখে আমার দিকে চেয়ে রইলেন । আমার হাতে আমি প্রচন্ড ব্যথা পাওয়ায় আমার চোখ থেকে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

ভাইয়া হুট করে আমাকে ছেড়ে দিলেন। আমি জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলাম। এতক্ষণ আমার হাত-পা কাঁপছিলো। ভাইয়া আমার দিকে আর না তাকিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন এভাবে বাইরে আসবিনা। তোর শাড়ি পড়া হয়নি আমি কাকিমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি বলে চলে গেলেন।

আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি শাড়িতে আমার আংশিক পেট দেখা যাচ্ছে। আল্লা ছিঃ বলেই তাড়াহুড়ো করে শাড়িতে নিজেকে ঢেকে নিলাম। দরজা বন্ধ করে শাড়ি খুলে বসে আছি। কিছুক্ষনের মধ্যেই আম্মু আসে।

কিরে মায়ন্তী কি হয়েছে? বর যাত্রী এসে গেছে। মায়াঙ্ক কেন যানি জরুরি তোর ঘরে আমাকে পাঠালো। আর একি শাড়ি খুলে বসে আছিস কেন?

আরে আম্মু চুপ করোতো তাড়াতাড়ি আগে আমাকে শাড়ি পড়িয়ে দাওতো।

আম্মু শাড়ি পড়িয়ে দিলো। শাড়ি পড়িয়ে বললো বাহ গোলাপি শাড়িতে তো আমার মেয়েটাকে খুব সুন্দর লাগছে। কারো যেন নজর না লাগে।

উফফ আম্মু তুমি কি যে বলোনা। কার আবার নজর লাগবে! যাও তো এখন এখান থেকে আমি যাচ্ছি এখনেই।

তৈরি হয়ে বাইরে বেড়িয়ে আসি। এসে দেখি আয়ুষ্মান ভাইয়া,মীনাক্ষী আপুকে একসাথে বসিয়ে রাখা হয়েছে। আপু ও ভাইয়ার পাশে আয়ুষ্মান ভাইয়া কাজিনেরাও বসে আছে। আমি আপুদের কাছে গেলাম। আয়ুষ্মান ভাইয়ার সাথে কথা বলে বসতে যেতেই মায়ন্তী তোমাকে তো রুপসী লাগছে গোলাপী টুকটুকে পরী হয়েছ!! বউ হবে? পাশ থেকে আয়ুষ্মান ভাইয়ার কাজিন রাজিব ভাইয়া বলে উঠলেন।

আমার বেশ রাগ লাগলো। আয়ুষ্মান ভাইয়া,মায়াঙ্ক ভাইয়া,রাজিব ভাইয়া এরা তিনজন খুব ভালো বন্ধু। মুলত মায়াঙ্ক ভাইয়ার কারনেই আজ আয়ুষ্মান ভাইয়া ও মীনাক্ষী আপুর বিয়ে হচ্ছে। আয়ুষ্মান ভাইয়া অনেক ভালো কিন্তু এই রাজিব ভাইয়াটা কেমন যেন সবসময় আমাদের বাসা আসলেই বা ওনার সাথে দেখা হলেই কীভাবে যেন তাকিয়ে থাকেন আর আজগুবি কথা বলেন।

আমি রেগে কিছু বলতে যাবো তাতেই পিছন থেকে মায়াঙ্ক ভাইয়া বলে উঠলেন রাজিব কি যা তা বলিস তুই এই মেয়ে আবার বউ। এর চেহারা দেখেছিস কঙ্কাল ও ভালো,কালো পেত্নী টাইপ আবার একে বউ বানানো যায়। ছিঃ তোর রুচি।

মায়াঙ্ক ভাইয়ার কথায় এখানে থাকা প্রত্যেকটা মানুষ হাসাহসি শুরু করে দিলো। এই মানুষটা যেন আমাকে সহ্য করতেই পারেন না। সবসময়ই আমাকে ছোট করে কথা বলেন।

পাশ থেকে আয়ুষ্মান ভাইয়া বলে উঠলেন। মোটেও না মায়াঙ্ক আমার শালিকা মায়ন্তী বেশ রূপবতী এবং গুনবতিও। ও যার বৌ হবে সে খুবই লাকি হবে দেখে নিস।

মায়াঙ্ক ভাইয়া বাঁকা হেসে উওর দিলেন দেখা যাক। কেমন হয় এই পেত্নী টা।

চলবে……………..

#মায়ন্তী
#রাইদাহ_উলফাত_আনিতা
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here