মায়াডোর পর্ব-১০+১১

মায়াডোর (১০ পর্ব)
.
সবাই ছুটে আসে আমগাছের নিচে। মুজিব উদ্দিনের মাথায় বোতলের পানি ঢেলে দেয় কবিরাজ। লতিফ তাকে ঠেলে বসিয়ে বললো, ‘ভাইজানের কি হইছে? পেরেশান হওনের তো কিছু নাই। দুনিয়ায় মানুষ কত আচানক কুকর্ম করে। আপনে নিজের বাপের সামান্য টাকা চু*রি করছেন। তাতে অসুবিধা কি? বাপের টাকা চু*রি করলে কোনো পাপ নাই। আপনে কি কন ওস্তাদ?’

– ‘এত কথা বলিস না, উনাকে দাঁড় করা।’

মুজিব উদ্দিনকে বগলে ধরে টেনে সে দাঁড় করালো। তিনি দাঁড়িয়ে প্রথমেই স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘বিশ্বাস করো হুস্না আমি চো*র না।’

হুস্না বেগম অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। ইতির মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে৷ একই সঙ্গে ভয় এবং বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট। এরকম ঘটনা ঘটবে সে আগে বুঝতে পারেনি। পা টিপে টিপে মুজিব উদ্দিনের হাতে এসে ধরে। তারপর থুতনি বুকের সঙ্গে লাগিয়ে মাথা নুইয়ে বলে,

– ‘টাকাটা বাবা চু*রি করেনি।’

কবিরাজ প্রতিবাদ করে বললো,

– ‘উনার কাছে তো টাকাও পাওয়া গেছে। একেবারে হাতে-নাতে প্রমাণ।’

– ‘আপনি একদম কথা বলবেন না। চোখ বাঁধায় আপনার তুলারাশি না দেখে বাবাকে ধরেছে। না হলে বারবার গেইটের দিকেই যেত। কারণ আপনারা জানেন সামান্য টাকার জন্য কেউ অন্যের বাড়ি বাটি নিয়ে ঢুকে ঝামেলা করবে না। মানুষের জিনিস হারালে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকে চু*রিটা কে করলে জানতে। এটা আপনারা ভালো করেই জানেন।’

লতিফ এগিয়ে এসে বলে,

– ‘আপা কি আচানক কথাবার্তা কন আপনে। ওস্তাদরে আমাদের দশ গ্রামের মানুষ ভয় পায়। মানুষ না শুধু, ভূ*ত-প্রে*তও উনারে রাস্তা দিয়া দেখলে খাল বিল হাতড়ে পালায়। হেই ওস্তাদরে আপনে অপমান করতাছেন।’

– ‘তুমিও চুপ করো। টাকাটা দাদাভাইয়ের রুমেই আছে। আমি নিজেই চু*রি করেছিলাম। মানতের টাকা শুনে দিয়েই দিতাম। বাটি চালান হবে শুনে দেখার জন্য আর কাউকে কিছু বলিনি।’

মুজিব উদ্দিন হুস্নার শাড়ির আঁচল টেনে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে মুছতে নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘দেখলে তো বাবা, আমি চু*র না।’

– ‘চুপ কর নির্বোধের বাচ্চা। ফরিদ মাস্টারের ছেলে চো*র হবে কিভাবে? দেখ তোর মেয়ে ঠিকই চো*র হইছে।’

হুস্না বেগম মেয়ের দিকে দাঁত কটমট করে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,

– ‘এখনই ঘরে আয় তুই।’

ইতি ভায়ার্ত মন নিয়ে মায়ের পিছু পিছু গেল। ফরিদ সাহেব সবাইকে বললেন, ‘আমার রুমে যাওয়া যাক, দেখি টাকা সত্যি আছে কি-না।’

সবাই উনার পিছু পিছু গেল। ফরিদ সাহেব পাঞ্জাবির পকেটগুলো খুঁজতে খুঁজতে তিন নাম্বার পাঞ্জাবিতে টাকাটা পেয়ে গেলেন। টাকা হাতে নিয়ে আহত চোখে কবিরাজের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘আরে শ*য়তানের বাচ্চারা, তোরা তাহলে ভণ্ড?’

মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললো,

– ‘বাবা দরজা বন্ধ করে পুলিশকে খবর দিব না-কি?’

কবিরাজ তার লাল চাদর ঠিক করতে করতে রহস্য করে হেঁসে বললো,

– ‘শুনুন মুরব্বি। আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেন। ডাক্তার কি তার সব রোগীকে সুস্থ করতে পারে?’

সবাই মাথা নেড়ে বললো,

– ‘না।’

– ‘তখন কি তাদের ভণ্ড বইলা অপমান করেন? পুলিশে দিতে চান? তাইলে আমাদের বেলায় এরকম করেন কেন? আমরা কাজ করি যারা আমাদের বিশ্বাস করে তাদের নিয়ে। বিশ্বাসই আমাদের সম্বল। সব সময় রোগী সুস্থ হয় না, চু*রির মালও বের হয় না৷’

মুজিব উদ্দিন নাক টান দিয়ে বললেন,

– ‘বিশ্বাস করি বইলাই তো আনা হইছে। এখন ব্যখ্যা দেন টাকা ঘরে রাইখা তুলারাশি আমারে ধরলো কেন?’

কবিরাজ মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘দু’জনের ছয় হাজার টাকা দেন আমার হাতে।’

দুজন টাকা বাড়িয়ে দিল। কবিরাজ অন্যদিকে ফিরে টাকা এলোমেলো করে বললো,

– ‘এখন আপনারা পারবেন এই টাকা আলাদা করতে? কার কাছে কোন তিনটা নোট ছিল বলেন। পারবেন? সেম না টাকা?’

দু’জন মাথা নেড়ে বললেন,

– ‘না, পারবো না। একই রকম লাগে।’

কবিরাজ হেঁসে বললো,

– ‘ঘটনা হইছে গিয়ে এই জায়গায়। মানুষ হইছে সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের বুদ্ধির কাছে সবকিছুই ছাগলের বাচ্চা। আপনারাই টাকা আলাদা করতে পারেন নাই। তুলারাশি তো বিভ্রান্ত হইবই। শুরু থাইকাই হইছে বিভ্রান্ত। দুই জায়গায় সমপরিমাণ সেম টাকা থাকায় কোথায় যাইব কোথায় না বুঝতে পারছিল না। তাই সে প্রথমে বাইরে যেতে চাইছিল৷ চারদিকে ঘুরে-ফিরে চিন্তা করে আবার ফিরে আসতো বাড়িতে৷ কিন্তু আমরা ভুল-বুঝে তারে বারবার গেইটে আঁটকে দিছিলাম। এরপর যখন এই ভাই সাহেব পকেটে তিন হাজার টাকা নিয়ে কাছে আসছেন। সে ভাবছে এটাই হইতে পারে। সকলে বুঝলেন তো এবার? ভুল সবারই হয়। তুলারাশিরও হইছে। এখন আপনারা হাদিয়া দিবেন কি-না আপনাদের ব্যাপার। আমরা গেলাম। এই চলো।’

লতিফ আর ন্যাড়া মাথার লোক পিছু পিছু বের হলো। ফরিদ উদ্দিন পুত্রের দিকে তাকিয়ে বললেন,

– ‘কিরে নির্বোধের বাচ্চা, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা ওদের হাতে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় কর।’
মুজিব নাক টান দিয়ে সেদিকে চলে গেল।

ইতি বিছানায় বসে দুইহাতে মুখ ঢেকে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। হুস্না বেগম আবার কপালে আঙুল দিয়ে ঠেলা দিয়ে বললেন,

– ‘কারবারি এদিকে থাকা। আমাকে বল তুই বড়ো হবি কবে? আজ কত বড়ো ঘটনা ঘটিয়েছিস বুঝতে পারছিস তুই? বল আমাকে, জবাব দে। চুপ করে থাকবি না।’

ইতি প্রতিবারের মতোই কোনো জবাব দেয় না। তিনি গালে মুঠো করে বুড়ো আঙুল দিয়ে ঠোকর দিয়ে বললেন,

– ‘বুঝিস তো সবই। তর্ক করার সময় তো দেখি খুবই যুক্তিবাদী হয়ে যাস। সব তো খেয়াল করি। তখন বুদ্ধি কোত্থেকে আসে? আর যখন ছেলেমানুষি করিস তখন বুদ্ধি কই থাকে? বল কথা বলিস না কেন?’

ইতি কোনো জবাব না দিয়ে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। ফরিদ সাহেব এসে ঢুকলেন রুমে। তারপর অবাক হয়ে বললেন,

– ‘আরে কাঁদছে কেন? কাঁদার কি হয়েছে। কি গো বউমা তুমি ওকে কি করছো? যাও তো, সরো এখান থেকে।’

হুস্না বেগম কোনো জবাব না দিয়ে হন-হন করে চলে গেলেন রান্নাঘরে। ফরিদ উদ্দিন ওর পাশে বসে চোখ মুছে দিতে দিতে বললেন,

– ‘কান্না বন্ধ কর তো ইতি। দাদার পকেট থেকে চু*রি করবি না তো কোথা থেকে করবি? তোর তো আর জামাই নাই।’

ইতি কাঁদতে কাঁদতে হেঁসে ফেললো। হুস্না বেগম দরজার কাছে এসে বললেন,

– ‘শুরু হয়ে গেছে দাদা-নাতনির পিরিত। এভাবেই ও আদর পেতে পেতে বাদর হয়েছে৷ কত বড়ো কাণ্ড করেছে সেদিকে খেয়াল নাই কারো।’

– ‘সবার বোধ-বুদ্ধি এক না বউমা। কেউ তাড়াতাড়ি বুঝে, কেউ দেরিতে। সেও একদিন দেখবা শান্ত হয়ে যাবে।’

– ‘আপনার কি মনে হয় ও বুঝে না? যখন ঝগড়া করে, তর্ক করে তখন দেইখো উদাহরণ আর যুক্তি দিয়ে মাস্টারনি হয়ে যায়। কিন্তু কাজের বেলায় বাচ্চামি। বুঝি তো, এগুলো ন্যাকামি করে৷ বুইড়া মাইয়া দিন দিন ন্যাকা হচ্ছে।’

ফরিদ সাহেব খ্যাকখ্যাক করে হেঁসে বললেন,

– ‘মেয়ে মানুষ একটু ন্যাকা তো হয়ই। তাই নারে বইন? পুরুষ মানুষ হবে ত্যাড়া, মাইয়া মানুষ ন্যাকা। এটাই জগতের নিয়ম।’

হুস্না বেগমের গা জ্বলে উঠলো। তিনি রান্নাঘরে চলে গেলেন। ফরিদ সাহেব ইতির চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

– ‘কান্না বন্ধ করে পড়তে বস বইন। স্কুলে যাসনি বসে বসে পড়।’

ইতি সত্যি উঠে পড়ার টেবিলে বসে।

কল্পের কোচিং এর টাকা এসেছে। বড় মামা ফোন করে বলেছেন একটা বিকাশের দোকানে গিয়ে নাম্বার দিতে। ব্যাংক থেকে তিনি বের হয়েই বিকাশে ছেড়ে দেবেন। মামাকে নাম্বার দিয়ে সে এখন দোকানের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছে। আজকের অদ্ভুত মজার ঘটনাটা সুপ্তি আপুকে বলতে তার ভীষণ ইচ্ছা করছে। কিন্তু কল দিতে গিয়ে আবার আঁটকে গেল। মামা যদি কোনো কারণে কল দিয়ে ওয়েটিং এ পান তাহলে বেকুবের বাচ্চা বলে গালাগাল শুরু করবেন। সে চুপচাপ বসে রইল। প্রায় মিনিট তিরিশেক পর কল দিলেন বড় মামা। যে নাম্বার থেকে ছেড়েছেন সেটা বললেন তাকে। সে টাকা তুলে রুমে এলো। কল দিল মামীর ফোনে। ভালোমন্দ কথা হওয়ার পর সুপ্তির কাছে দিতে বললো। সুপ্তি মোবাইল কানে নিয়েই গাল ফুলিয়ে বললো,

– ‘কিরে হারামি আজ বুঝি আপুর কথা মনে পড়লো তোর? আর আমার বই কবে পাঠাবি?’

– ‘এক সঙ্গে দুইটা প্রশ্ন। থাক একটারও উত্তর দেবো না৷ আগে শুনো আজ এ বাড়িতে কত বড়ো কাণ্ড হয়েছে।’

– ‘কি হয়েছে।’

পুরো ঘটনা সে সুপ্তিকে বললো। সব শুনে সুপ্তি অনেক হাসলো। তারপর জিজ্ঞেস বললো,
– ‘মুজিব মামার মেয়ে লুকিয়ে ছিল টাকাটা?’

– ‘হ্যাঁ, ওরা ভাইবোন সব কয়টা পাজি।’

– ‘তুই কি খুব ভালো। এইতো যাওয়ার দিনই আমার টাকা চু*রি করেছিলি।’

– ‘এইটা ফেরত দিয়ে দিব বললাম না।’

– ‘আচ্ছা শোন, তোর চাচা এসেছেন দেশে জানিস তো।’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আব্বার কাছেও কল দিয়েছিলেন।’

– ‘ও আচ্ছা। নীলিমা, নিলয় ওরা কেমন আছে।’

– ‘ভালোই আছে।’

– ‘আর বই আমি পাঠিয়ে দেবো চিন্তা করো না। এখন রাখছি।’

আচ্ছা ঠিক আছে। ফোন রেখে সে পড়ার টেবিলে বসে গেল।

ইতি ছাদে এসেছে। পড়তে বসেছিল। তখন নীলা এসে মোবাইল হাতে দিয়ে বললো,

– ‘মালিহা কল দিয়েছে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।’

ইতি মোবাইল হাতে নিল। মালিহা ‘হ্যালো, হ্যালো’ করছে। নীলা চলে যেতেই ইতি কল কেটে দিল। মিনিট খানেক যেতেই আবার কল দেয় মালিহা। ফোন হাতে নিয়েই তখন ছাদে আসে। রিং হতে হতেই কেটে যায়। ইতি বসে গিয়ে পিলারে। ডায়াল থেকে ওর নাম্বারে কল দিতেই রিসিভ করে মালিহা এলোপাথাড়ি বকা শুরু করলো,

– ‘এই খা*নকি ওই দিন তুই কল কেটে দিলি। আমি ব্যাক করলাম। এরপর মোবাইল অফ করে দিলি। আমি রাগ করে আর কল দিলাম না। কিন্তু তুই কি আর রাগ ভাঙানোর জন্য কল দিবি না?’

– ‘রাগ ভাঙাতে ইচ্ছা করেনি তাই কল দেইনি।’

– ‘ইচ্ছা করবে কিভাবে। বাড়িতেই তো এখন জামাই পেয়ে গেছিস খা*নকি। তুই আমারে ভাব দেখাস। বড়ো হয়ে গেছিস তাই না? দাঁড়া আমি কয়দিন পরই আসবো তোদের বাড়ি। তখন দেখবো কত বড়ো হইছে তোর বুকের***।”

ইতি ঠাণ্ডা গলায় বললো,

– ‘আপু ওইদিন ক্লাসে কি হয়েছে জানো?’

– ‘ক্লাসে আর কি এমন হবে? কোনো ছেলে কি কোনো মেয়েকে কিস করছে?’

– ‘না আগে শুনে নাও, কয়েকদিন আগে আমার এক বান্ধবীর কাছ থেকে লেসবিয়ান সম্পর্কে জানলাম। ওর এন্ড্রয়েড মোবাইল আছে তো। কোনো একজন স্যার ক্লাসে উপস্থিত না থাকলেই আমরা গোল হয়ে ওর কাছে গল্প শুনি।
নতুন নতুন কত কিছু শিখি ওর কাছ থেকে। আমি লেসবিয়ান সম্পর্কে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তোমার মুখটা ভেসে উঠায় ভাবলাম এরকম মানুষ থাকলে থাকতেও পারে।’

– ‘মানে কিরে খা*নকি? আমার মুখ কেন ভেসে উঠবে? তুই এগুলোও শিখে গেছিস। তোর ওই বান্ধবীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিস তো। দেখবো সে আর কি কি জানে৷ আমার থেকে কি বেশি জানে? তুই কি জানতে চাস আমাকে বল। দেখবি আমি সব জানি।’

– ‘না আপু শুনবো না। একটা দরকারি কথা বলবো।’

– ‘কি বলবি বল।’

– ‘আপু তুমি একটা লেসবিয়ান।’

কথাটা বলেই ইতি খিলখিল করে হেঁসে মোবাইল অফ করে দিল। দুপুরের মন খারাপ ভাবটা এখন আর নেই। ছাদে একা একা হাসতে হাসতে নিচে গেল। নীলা তাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,

– ‘এত হাসছো কেন ঘটনা কি?’

ইতি বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে হাসছে। খুব আনন্দ হচ্ছে। মালিহা আপু রাগে জ্বলবে। কিন্তু তাকে কিছু বলার সুযোগ পাবে না। নীলা তাকে টেনে সোজা করতে করতে জসীমউদ্দিনের কবিতা বললো,
“এত হাসি কোথায় পেলে
এত কথার খলখলানি
কে দিয়েছে মুখটি ভরে
কোন বা গাঙের কলকলানি|”

ইতির মুখ লাল হয়ে গেছে হাসতে হাসতে। মালিহা আপু রাগ করবে৷ কিন্তু তাকে কিছু বলতে পারবে না। বারবার কল দিয়ে দেখবে মোবাইল অফ৷ মালিহা আপুর মুখটা যে কিরকম হবে কল্পনা করে ইতির ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। নীলা তাকে পেটে কাতুকুতু দিয়ে বললো,

– ‘বলো এত হাসার কারণ কি?’

– ‘তোমার মোবাইল অফ করেছি। এখন অন করো না৷ মালিহা আপুকে খুবই বাজে একটা কথা বলে অফ করে রেখেছি।’

– ‘কি বলেছো এমন? নিজেই হাসতে হাসতে লাল টমেটো হয়ে যাচ্ছ।’

– ‘জীবনেও তোমাকে বলা যাবে না৷ কারণ তুমি হলে আমার চাচি আম্মা।’

নীলা মুখ বাঁকিয়ে অস্ফুটে ‘ঢং’ বলে রান্নাঘরে চলে গেল।

ইতি আবার পড়ার টেবিলে বসে। মন খারাপ ভাবটা কেটে যাওয়ায় ভালোই লাগছে পড়তে।

মাগরিবের আজান হতে না হতেই বইপত্র নিয়ে বের হয়ে গেল ইতি। বারান্দা পেরিয়ে কল্পের দরজার সামনে যেতেই উচ্চ শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনে পর্দার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। কল্প খালি গায়ে বুকডন দিচ্ছে৷ ইতি প্রথমেই চোখ সরিয়ে নিল। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। শুকনো ঢোক গিলে আবার চোরা চোখে তাকায়। ফরসা ছিপছিপে শরীর ঘামে চিকচিক করছে। ঘর ভরে গেছে হাঁপানোর মৃদু শব্দে। খানিক পর উঠে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে গেল কল্প। ইতি বই হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল দরজার সামনে। কল্প বের হয়ে শরীর মুছতে মুছতে গেঞ্জি পরছে। ইতি চোখ ফিরিয়ে নিল। গলা শুকিয়ে আসছে। পুরো শরীরে যেন বৈদ্যুতিক তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। মানুষটাকে এত ভালো লাগে কেন কে জানে!
কল্প গেঞ্জি গায়ে দিয়ে পর্দার দিকে চোখ যেতেই মানুষের ছায়া দেখতে পেল। পর্দা সরিয়ে অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে তুমি কতক্ষণ থেকে এসেছো?’

ইতি নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

– ‘এইতো এখন।’

– ‘তাহলে দাঁড়িয়ে ছিলে কেন।’

– ‘গেঞ্জি পরছিলেন তাই অপেক্ষা করছিলাম। তা এই সময়ে গোসল করলেন না-কি?’

কল্প চেয়ার টেনে বসে মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘তুমি আমাকে বুকডন দিতে দেখেছো তাই না?’

ইতি লজ্জা পেয়ে প্রথমে হাসলো। তারপর চোখে চোখে তাকিয়ে বললো,

– ‘অসময়ে বুকডন দেয়ার কারণ কি? আমাকে বডি দেখানোর জন্য না-কি।’

কল্প দাঁত কটমট করে তাকিয়ে বললো,

– ‘এসব বাজে চিন্তা একদম করবে না। তুমি এত তাড়াতাড়ি আসবে ভাবিনি। আমার টেবিলে বসে কেমন ঘুম পাচ্ছিল। তাই বুকডন দিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। আর বুকডন আমি সব সময়ই দেই। খেলাধূলা কম করা হয় তো। বাইরে হাঁটাহাঁটিও কম। তাই বুকডনই একমাত্র ভরসা।’

– ‘ব্যায়াম না করলেই চলবে আপনার।’

– ‘কেন মোটা নই বলে? মানুষ কি শুধু চিকন হতে ব্যায়াম করে? সুস্থ থাকার জন্যও করতে হয়। এইযে পরিশ্রমে শ্বাস-প্রশ্বাস হয়। ঘামি। রক্ত চলাচল হয়। এগুলোও তো দরকার আছে।’

– ‘বাবা এত স্বাস্থ্য সচেতন।’

– ‘এসেই গল্প জুটিয়ে নিয়েছো। অংক দিয়েছিলাম দেখি।’

– ‘পারিনি।’

– ‘পারবে কিভাবে। সারাক্ষণ তো মাথায় শুধু দুষ্টামি ঘুরে। দেখি চেষ্টা করেছো কোথায়। দেখাও।’

– ‘চেষ্টাও করিনি ভাইজান।’

কল্প কঠিন মুখ করে তাকানোর চেষ্টা করলো। ইতি বই মুখের কাছে নিয়ে ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘প্রায় সমবয়সী ছাত্রী৷ বয়সের অভাবে রাগটাও কর‍তে পারছেন না, তাই না?’

কল্পের চেহারাটা গম্ভীর করতেই পারলো না। হাসি চলে এলো। তারপর কাতর হয়েই বললো,

– ‘আচ্ছা ইতি এরকম করলে আমার কি করার থাকে বলো? তুমি আমাকে সাহায্য করবে না?’

ইতি খাতা বাঁ হাতে নিয়ে ডান হাতের কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে হাতের তালুতে থুতনি রেখে ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে বললো,

– ‘দুষ্টামি করলেও, আপনাকে কসম সাহায্য করবো।’

কল্প ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কেমন অদ্ভুত চোখের চাহনি। চুলগুলো কপাল বেয়ে সামনে এসে পড়েছে। সে কলমের মুখ লাগিয়ে খুলে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘এরকম করো না ইতি। আর কিসের সাহায্য করবে তুমি? আমি গতকাল বললাম না পারলে বুঝিয়ে দেবো৷ আজ তুমি স্কুলেও যাওনি৷ তবুও চেষ্টাটাও করোনি, কাজটা কি ঠিক করলে?’

ইতির খুব মায়া লাগছে ওর অসহায় মুখ দেখে। যদি সত্যি সত্যি অংক না করে আসতো। এই মুখ দেখে ইতির নিজেরই ভীষণ কষ্ট হতো। এখন হচ্ছে না। কারণ খাতাটা বাড়িয়ে দিলেই মানুষটা খুশি হয়ে যাবে। ইতি খাতা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,

– ‘ স্যরি বাঁ হাত।’

– ‘কি এটা?’

– ‘রাগারাগি না করে আগে দেখুন ভাইয়া।’

কল্প অবাক হয়ে একবার খাতার দিকে আর একবার ইতির মুখের দিকে তাকাচ্ছে। খানিক পর ঝলমলে মুখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো,

– ‘আরে হয়েছে তো। পারলে কিভাবে?’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘ইতিকে এত অপদার্থ ভাবার দরকার নাই ভাইজান।’

– ‘সমাধান দেখে করোনি তো?’

– ‘সমাধান দেখে বুঝেছি, দেখে করিনি।’

– ‘এখন দিলে পারবে?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘আচ্ছা এই অংকটা করো।’

ইতি মিনিট খানেকের ভেতরে অংকটা করে খাতা বাড়িয়ে দিল। কল্প খাতা দেখে বললো,

– ‘মুখস্থ করোনি তো? মেয়েরা তো আবার মুখস্থ করার জন্য টান। অংক-টংক মুখস্থ করে ফেলে।’

– ‘এত অবিশ্বাস? আচ্ছা এবার কি বুঝিয়ে দিতে হবে আমার?’

– ‘না তা লাগবে না। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। ধন্যবাদ।’

– ‘ধন্যবাদ দেয়া লাগবে না। পুরুষ্কার হিসাবে গল্প করুন কিছু সময়। তাতেই হবে।’

কল্প মুচকি হেঁসে সারল্য গলায় বললো,

– ‘কি গল্প করবো? গল্প তো জানি না আমি।’

– ‘আচ্ছা আমার সঙ্গেই কথা বলুন।’

– ‘বলো কি কথা।’

– ‘আপনি ফেইসবুকে ঢুকেছেন এই দু’দিন?’

– ‘হ্যাঁ কিন্তু কেন?’

– ‘ফেইক নামের একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়েছিলাম৷ গ্রহণ করেননি কেন?’

– ‘আমি আসলে অপরিচিত কাউকেই ফ্রেন্ড বানাই না।’

– ‘এত ভাব কেন আপনার?’

কল্প হেঁসে ফেললো। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বললো,

– ‘আসলে ভাব না। ফেইসবুক ইউটিউব এগুলোতে আমি আসক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ঢুকলেই কিভাবে যেন দিন চলে যেত। ঘণ্টা, দুই ঘণ্টা চলে যেত হঠাৎ মনে হতো এতক্ষণ কি করলাম আমি ফেইসবুকে? খুঁজেই পেতাম না কি করেছি। এরপর বুঝলাম আসলে ফেইসবুক নিউজফিড এমনভাবে সাজানো। তোমার সার্চ, লাইক এগুলো থেকে ফেইসবুক বুঝতে পারে পছন্দ কি। সেসবই নিউজফিডে পাঠায়। অনেক বেশি ফ্রেন্ড থাকায় নানান চমক জাতীয় জিনিস নিউজফিডে আসে আর আনমনে একটা থেকে আরেকটায় যাই আমরা। এরপর আমি ভাবলাম নতুন আইডি খুলে পরিচিতদের ফ্রেন্ড বানাবো। আর ফেইসবুকে যেহেতু আমার গল্প পড়ার অভ্যাস আছে৷ তাই পছন্দের কিছু লেখক-লেখিকাদের ফলো করে রেখেছি। তাদের গল্প সামনে এলে পড়ি। অথবা খুঁজে গিয়ে টাইমলাইন ভিজিট করি। কিছু নিউজ সাইট আছে ফলো করা। সেগুলো থেকে নিউজ পাই। এভাবে সবকিছু সীমিত করে রেখেছি। জানো তো মানুষের এটেনশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সবাই আমাদের এটেনশন চায়। চারদিকে এটেনশন দেওয়া ক্ষতিকর। আমরা যখন অনেকগুলো নাটক মুভি পাই তখন কিন্তু একটাও ভালো লাগে না৷ কোনটা রেখে কোনটা পড়বো এগুলো নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে অনেক সময় কেটে যায়। এরপর এটার অর্ধেক, ওইটার অর্ধেক দেখি। তাই সবকিছু সীমিত ভালো। আমাকে জানতে হবে কার নাটক, কার মুভি ভালো লাগে। কার গল্প, কার উপন্যাস, কার কবিতা ভালো লাগে। সেটা দেখবো মানে পুরোটাই দেখবো। তাকে দরকার হয় খুঁজে নিব। এভাবে আমি ফেইসবুকটাকে সীমিত করে নিয়েছি। অপরিচিত কাউকে বন্ধু বানাই না। যাকে-তাকে ফলো দিয়েও রাখি না।’

ইতি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অস্ফুটে বললো,

– ‘আপনি আসলেই একটা ভাবের দোকানদার।’

– ‘কি বললে শুনিনি।’

– ‘কিছু না।’

– ‘অশ্লীল কোনো গালি-টালি কিছু দিয়েছো মনে হলো।’

ইতি দুই হাতে মুখ ঢেকে খিলখিল করে হেঁসে উঠলো।

__চলবে….
লেখা: জবরুল ইসলামমায়াডোর (১১ পর্ব)
.
ইতির দিনকাল এভাবেই কাটছিল৷ ব্যতিক্রম যা ছিল, তা হলো পড়ালেখায় প্রবল মনযোগ৷ চঞ্চলতা, দুরন্তপনা একটুও কমেনি।
পড়াতে গিয়ে স্যার-ছাত্রীর সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা কল্পের জন্য ছিল প্রায় যুদ্ধের মতো। অন্যদিকে নিজের পড়ালেখা, কোচিং সহ সবকিছু ঠিকঠাক মতো চালিয়ে গেছে সে। মেধা, চেষ্টা আর ভাগ্যগুণে সাস্টে পরীক্ষা দিয়েই চান্স পেয়ে যায়। চারদিক থেকে প্রশংসার জোয়ারে ভাসে সে। ইতিদের বাড়িতে রীতিমতো হিরো। ফরিদ সাহেব কল্প বলতেই অজ্ঞান। কথায় কথায় বাড়িতে তার উদাহরণ টানেন। ততদিনে সেও এ বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছে। ইতির সঙ্গে পড়তে আসে মিলন আর নিয়নও। পরিবারটির সাথে এতটাই মিশে গেছে যে, তার নিজের কাছেও এই পরিবারের মায়া কাটিয়ে ভার্সিটি হোস্টেলে যাওয়াটাও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এদিকে ইতি দিনকে দিন প্রবল প্রেমের সাগরে তলিয়ে গেলেও কল্পকে বলতে পারে না। প্রকাশ যা পায় তা কেবলই ভালোবাসার মানুষকে যন্ত্রণা, জ্বালাতন ছাড়া কিছুই নয়। ধীরে ধীরে পড়ালেখারও চাপ বাড়ে। টেস্টেও মোটামুটি ভালো রেজাল্ট হয়। কিন্তু আজ হচ্ছে ইতির বাঁধ ভাঙার দিন৷ ভেতরের সব কথা বলে ফেলার মোক্ষম সময় এসেছে। কারণ আজ ইতির এসএসসি ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে সে জিপিএ ফোর পয়েন্ট সেভেন সিক্স পেয়েছে। বাড়ির সবাই প্রচণ্ড খুশি। খুশি কল্পও। এখন সন্ধ্যা। ইতি শাড়ি পরেছে। হাতে নীল চুড়ি। কপালে ছোট্ট একটা টিপ। এক হাতে একটা ভ্যানিটিব্যাগ আর কাপড়ের ব্যাগ। গুটি-গুটি পায়ে কল্পের রুমের সামনে এসেছে৷ পর্দা ফাঁক করে বললো,

– ‘আমি কি আসতে পারি স্যার, ভাইয়া, ভাইজান, ভাবের দোকানদার।’

কল্প হাসতে হাসতে বললো,

– ‘আসো, আজ কি তোমার জন্য কোনো দরজা বন্ধ থাকবে? তুমি তো ইতোমধ্যে বিশ্ব জয় করেই ফেলেছো।’

ইতি ভেতরে গেল। কল্প তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বললো,

– ‘তুমি আসলেই বড়ো হয়ে গেছো। তা অসময়ে এত সাজগোজ কেন?’

চেয়ার টেনে বসে ইতি। তারপর কাপড়ের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিয়ে আদেশের মতো বলে,

– ‘পাঞ্জাবিটা পরেন।’

– ‘কিসের পাঞ্জাবি? আর এখনই পরতে হবে কেন?’

– ‘পাঞ্জাবি আমার থেকে গিফট। এইযে পরীক্ষায় আমার মতো গাধা ছাত্রী পাস করলো সেই উল্লাসে।’

– ‘গাধা না, তুমি পড়ালেখায় মনযোগী ছিলে না বলেই এমন ছিলে।

– ‘আচ্ছা হইছে, এখন চট করে পাঞ্জাবি পরেন, বাইরে যাব।’

– ‘বাইরে, এখন?’

– ‘হ্যাঁ, সন্ধ্যায় বাইরে যাওয়া কোনো অষ্টম আশ্চর্যের মতো কিছু না।’

– ‘কিন্তু তোমার সামনে পাঞ্জাবি পরবো কিভাবে?’

– ‘মহিলাদের মতো কথা বলেন কেন? পরলে সমস্যা কি?’

– ‘গেঞ্জি খুলতে হবে তো।’

– ‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি করেন, আমি বারান্দায় আছি।’

ইতি বারান্দায় চলে গেল। গ্রিলের ফাঁক দিয়ে আকাশে তাকায়৷ সন্ধ্যার আকাশে মিটিমিটি তারা জ্বলছে। আজ সে কোনো দ্বিধা বা শঙ্কাকে প্রশ্রয় দেবে না৷ আজ মন খুলে সব কথা বলে ফেলার দিন৷ পিছু ফিরে বললো,

– ‘আপনার কি শেষ হয়েছে?’

কল্প ভেতর থেকে বললো,

– ‘হ্যাঁ।’

ইতি ভেতরে এসে খানিকক্ষণ তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল। নীল পাঞ্জাবিতে বেশ মানিয়েছে কল্পকে।

‘কি দেখছো এমন করে?’ কথাটি বলে কল্প উল্টো হাতে পাঞ্জাবির কাঁধের স্টিকার খোলার চেষ্টা করলো। কিন্তু মুঠোয় কাগজ ছিঁড়ে এলেও প্লাস্টিকের সেই আংটা রয়ে গেছে। ঘাড়ে খোঁচা লাগায় টেনে ছিঁড়তে গিয়েও পারলো না সে৷ ইতি আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘পরার আগে খুলতে পারলেন না?’

– ‘খেয়ালই ছিল না।’

– ‘আমি হেল্প করি?’

– ‘আচ্ছা দেখো তো।’

কল্পের চেয়ারায় কেমন শিশুসুলভ ভাব ফুটে উঠেছে। তাকিয়ে ইতির ভীষণ মায়া লাগে। বিমূঢ় হয়ে কল্পের হাতটা ধরে ফেললো। যেন সামনে দাঁড়ানো মানুষটি তার ভীষণ আপন, ব্যক্তিগত কেউ। তারপর টেনে নিয়ে বললো,

– ‘চেয়ারে বসুন। আপনি যা লম্বা নাগালই পাব না হয়তো।’

কল্প স্মিত হেঁসে চেয়ারে বসলো। ইতি আঙুল দিয়ে পাঞ্জাবির কলার উলটে ধীরে ধীরে মাথা নুইয়ে একেবারে কাঁধে নামিয়ে আনলো। কল্প অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে কাঁচি আনলেই হতো।’

ইতি এ কথার জবাব দিতে পারে না। সে কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। বাঁ হাত রেখেছে কল্পের কাঁধে। চুলগুলো ওর ওপর গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতি প্লাস্টিকের আংটায় দাঁত রাখলো। নাক লেগে আছে কল্পের ঘাড়ে। পুরুষালি একটা মাতাল ঘ্রাণ ভেতরে গিয়ে যেন রক্তে ঝংকার তুলে ফেলেছে। অনুভূতিগুলোতে আলোড়ন উঠেছে। বুকে শিরশির করে। চোখ ঘোরলাগা আবেশ। খানিক্ষণ এভাবেই রইল। বুকের ভেতর এত প্রেম নিয়ে আংটায় হিংস্র দাঁত চালাতে যেন মন সায় দেয় না। কল্প তাড়া দিয়ে বললো,

– ‘আরে এতক্ষণ লাগে না-কি? এদিকে তোমার চুলের ঘ্রাণে আমার ঘুম এসে যাবে মনে হচ্ছে।’

ইতি খিলখিল করে হেঁসে মাথা তুলে ফেললো। কল্প উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বললো,

– ‘আরে আবার খোঁচা লাগছে তো।’

ইতি মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললো,

– ‘ছিঁড়তে পারিনি। আপনি তো তার আগেই হাসিয়ে ফেলেছেন।’

– ‘যাও তো কাঁচি নিয়ে আসো।’

– ‘এই সামান্য কাজের জন্য এখন গিয়ে কাঁচি নিয়ে আসতে পারবো না। আপনি আবার বসুন। কেটে দিচ্ছি।’

কল্প ওর দিকে তাকিয়ে বসে গেল। ইতি পুনরায় মাথা নুইয়ে দাঁত দিয়ে কেটে দিল স্টিকারের আংটা। কল্প উঠে দাঁড়িয়ে আঙুল চালিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিল। ইতি কেমন একটা ঘোর লাগা পুরুষালি গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইশ সামনে দাঁড়িয়ে নিজ হাতে যদি ওর চুলগুলো ঠিক করে দিতে পারতো? এতদিন হয়ে গেল মানুষটা কি কিছুই বুঝে না? একটু নিজ থেকেই তো কিছু বলতে পারে।

– ‘চলো এবার যাই।’

ইতি ভাবনা থেকে বের হয়ে ভ্যানিটিব্যাগ হাতে নিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ চলুন।’

কল্প উঠানে এসে বললো,

– ‘কি হলো আর কেউ নাই?’

– ‘আর কে থাকবে?’

কল্প অবাক হয়ে গেইটের বাইরে এসে বললো,

– ‘আমি কিন্তু ভেবেছিলাম তোমার রেজাল্ট বের হয়েছে৷ হয়তো নীলা আন্টিকে নিয়ে বাইরে যাবে, ঘুরবে। আমাকেও সঙ্গে নিচ্ছ।’

– ‘না শুধু আমরা দু’জনই।’

– ‘সত্যি করে বলো তো বাড়িতে কি বলেছো? সন্ধ্যা রাতে এরকম সাজগোজ করে আমার সঙ্গে একা বের হতে দিয়ে দিলেন?’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘রিকশায় উঠে বলবো।’

– ‘কেন?’

– ‘এমনিই।’

তারপর একটা রিকশা ডেকে দাঁড় করিয়ে ইতি বললো, ‘উঠুন।’

কল্প ইতি-উতি করে উঠে বসলো। ইতি ডান পা বাড়িয়ে এক হাত সিটে দিয়ে বললো,

– ‘শাড়ি পরেছি তো তাই আমার উঠতে অসুবিধা হচ্ছে। একটু হাতটা ধরেন না।’

কল্প বিব্রত ভঙ্গিতে ওর হাতটা শক্ত করে ধরলো। কোমল নরম হাত। যেন মুঠোয় নিয়ে চেপে ধরলেই ভেঙে যাবে৷ ইতি পাশে এসে বসে তাকিয়ে বললো,

– ‘থ্যাংক ইউ ভাইজান।’

কল্প মুচকি হেঁসে অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘তুমি খুব সুবিধাজনক অবস্থায় আছো। ইচ্ছা হলে স্যার, আবার ভাইজান, একবার ভাইয়া।’

ইতিও হাসলো। তারপর ফিসফিস করে বললো,

– ‘পড়ে যাবেন। আরেকটু কাছে এসে বসুন।’

কল্প ওর দিকে খানিক নিবিড় হয়ে বসে। রিকশা চলছে৷ চারদিকে গাড়ি যাচ্ছে, আসছে। শহরের কৃত্রিম আলোয় রাস্তাঘাট ভেসে যাচ্ছে। আকাশে জ্বলজ্বল করছে তারা। রিকশার টুংটাং শব্দ। ইতি বারবার পাশের মানুষটার দিকে তাকাচ্ছে। যদি ও পেছন দিকে হাতটা নিয়ে একটু ধরে বসতো? কবে ধরবে? কখন তাদের এমন একটা সম্পর্ক হবে। এরকম সন্ধ্যায় হাত ধরে রিকশায় বসবে। নিরিবিলি কোথাও হাত ধরে হাঁটবে। ইতি মাথা ঘুরিয়ে কল্পের দিকে আবার তাকায়। অন্যদিকে তাকিয়ে আছে মানুষটা। কিন্তু ইতির দৃষ্টি লক্ষ্য করে ফিরিয়ে আনলো চোখ।

– ‘কি দেখছো এমন করে?’

ইতি চোখে চোখ রেখে বলে ফেললো,

– ‘আপনাকে।’

কল্প ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘সারাক্ষণ শুধু ফাজলামি।’

– ‘ফাজলামো না, আজ আপনাকে সত্যিই অনেক সুন্দর লাগছে।’

– ‘ও হ্যাঁ, পাঞ্জাবিটা অনেক পছন্দ হয়েছে, ধন্যবাদ।’

ইতি চোখ ফিরিয়ে নিল। কল্প তারপর বললো,

– ‘এবার বলো কি বলে এসেছো? কারও বাসায় যাবে বা এরকম কিছু?’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘বলেছি রেজাল্ট বের হওয়ায় সন্ধ্যায় বান্ধবীরা একটা রেস্টুরেন্টে মিলবো।’

– ‘আম্মু বললো একা যাবি না-কি?’

– ‘আমি বললাম কল্প ভাইয়াকে তাহলে নিয়ে যাই। মা তাতে রাজি হয়ে গেল৷ ব্যস।’

কল্প আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘তাহলে আমি এখন একদল মেয়েদের কাছে যাচ্ছি? একা একা খুবই নার্ভাস হব।’

ইতি মুখ টিপে হেঁসে বললো,

– ‘আপনি একদল মেয়েদের কাছে যাচ্ছেন না। ওদের কথা মিথ্যে বলেছি। শুধু আমরা দু’জনই একটা রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি। অসম্ভব সুন্দর মনোরম পরিবেশ। খাব আর দু’জন অনেক্ষণ বসে গল্প করবো।’

কল্প বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে বললো,

– ‘তোমার কি মাথা খারাপ! মিথ্যে বলে আমাকে নিয়ে বের হয়েছো কেন? আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ ছিল। এখন ওরা যদি এগুলো জানে কি মনে করবে তুমি জানো?’

– ‘আরে ধুরো, আপনি এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন? সিম্পল একটা বিষয়।’

– ‘সিম্পল মানে? তুমি জাস্ট আমার সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে আড্ডা দেয়ার জন্য সন্ধ্যা-রাতে মিথ্যে বলে বের হয়েছো এটা কেমন কথা? আমাদের কি কোনো গোপন সম্পর্ক চলছে?’

ইতি আহত নয়নে তাকায়। তারপর ব্যগ্র গলায় হাত ধরে বলে,

– ‘প্লিজ শান্ত হন। আপনার সঙ্গে আমার আজ কিছু কথা আছে তাই নিয়ে যাচ্ছি।’

কল্প এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

– ‘তোমার মাথা খারাপ। কথা বলতে এভাবে আমাকে পাঞ্জাবি পরিয়ে, নিজে শাড়ি পরে বের হতে হয়? আমি তো প্রথমে ফ্যামিলি সহ কোনো প্রোগ্রাম ভেবে পরেছি। না হলে তোমার মতো পাগল না আমি।’

– ‘আচ্ছা এখন তো বের হয়ে গেছি। আর রাগ করে কি হবে। বাদ দিন।’

– ‘দেখো ইতি। আজ তোমার রেজাল্ট বের হয়েছে। ভালো রেজাল্ট হওয়ায় আমি অনেক খুশি হয়েছি। বাজে কিছু বলে তোমাকে কষ্ট দিতে চাই না। এখনই বাড়িতে চলো।’

– ‘না আমি এখন আর ফিরবো।’

– ‘ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি মামা রিকশ রাখেন।’

রিকশা থামতেই কল্প নেমে গেল। ইতি রিকশা থেকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ ভরে এসেছে জলে। ভ্যানিটিব্যাগে একটা ছোট্ট কাগজ। সেখানে সব কথা লেখা আছে। ভেবেছিল মুখে বলতে লজ্জা লাগবে। তাই রেস্টুরেন্টে কাগজ হাতে দিয়ে সামনে বসে থাকবে মানুষটার। ইতি ব্যাগ থেকে কাগজ বের করে ছলছল চোখে তাকায়,

‘প্রিয় ভাবের দোকানদার
একটু ভাব কমিয়ে কোমল চোখে সামনে বসা মেয়েটির দিকে তাকান। দেখেছেন শাড়ি পরে আপনার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে? জানেন মেয়েটা খুবই নির্লজ্জ, বেহায়া। আপনাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে৷ মেয়ে মানুষ হয়েও প্রিয় মানুষটিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে এসেছে ভালোবাসার কথা বলবে বলে। তাকে দেখে হাসিখুশি লাগছে না? অথচ সে প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। এইযে চিঠি পড়ছেন। সে সামনে বসে আছে। তার বুকের ভেতর যে কি ভীষণ তোলপাড় হচ্ছে আপনি জানেন না। নির্লজ্জ এই মেয়েটির হাতটা একবার ধরবেন প্লিজ? দেখুন নিল চুড়ি পরেছে৷ আপনি হাতটা ধরলে একটা শব্দ হবে। এই শব্দ আজীবন আমার কাছে হয়ে থাকবে প্রিয় সংগীত। প্লিজ হাতটা ধরুন। আর কিছুই লাগবে না। আমি বুঝে নিব এই পৃথিবীটা আমার স্বর্গ হয়ে গেছে। আপনাকে পাওয়ার থেকে আমার কাছে এই পৃথিবীতে আর কোনোকিছুই বড়ো নয়। আপনাকে আমার এত ভালো লাগে কেন বলুন তো? কোনো তন্ত্র-মন্ত্র কি আপনি জানেন?
কসম, আমি ঠিকঠাক মতো পড়ালেখা করবো। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবে চলবো, শুধু অনার্স শেষ করে একটা চাকুরি পেলেই বিয়ে করে নিবেন আমায়। নির্লজ্জ মনে হচ্ছে না? একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে বলতে পারলো…।
জানি না কিভাবে বললাম। আমার ভীষণ ইচ্ছা করে আপনাকে ভালোবাসতে। আপনার সামান্য চুলে হাত দেওয়ার আমার কত লোভ। এগুলো কিভাবে পূর্ণ হবে বলুন। তাই বিয়ের কথা বলেছি।
আচ্ছা দেরি করছেন কেন? হাতটা ধরেও তো চিঠি পড়া যায়, যায় না বলো?
আমার খুব ভয় করছে। এই দেখো লিখতে গিয়েও আমি যেন মাতাল হয়ে গেছি। প্রথমে বললাম সামনে একটি মেয়ে বসে আছে। অথচ কখন যে আবার ‘আমি আমি’ বলা শুরু করেছি নিজেই জানি না। জানেন, আপনার কথা ভাবলেই আমি এরকম মাতাল হয়ে যাই। আপনি আমার নেশা হয়ে যাচ্ছেন না তো? হলে, হবেন। পুরো জীবনভর আপনাকে পান করতে করতে আমি নিজেকে শেষ করে দেবো।

ইতি
একটা নির্লজ্জ মেয়ে (শুনুন মিস্টার, এই “ইতি” মানে আমার নাম না। চিঠির শেষের “ইতি” এটা)

চিঠির দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে আছে সে। দু’ফোঁটা জল গাল বেয়ে আসার আগেই মুছে নিয়ে পিছু ফিরে তাকিয়ে দেখে কল্প অনেকদূর চলে গেছে।
চিঠিটা ইতি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলে দিল রাস্তায়।

__চলবে…
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here