মেঘবিলাসী পর্ব ১৭+১৮+১৯

#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_17

পশ্চিম আকাশের লাল সূর্যটা ঢলে পড়বে কিছুক্ষণ পর। এই সুন্দর সময়টাতে ক্যাফেটেরিয়াতে বসে আড্ডা দিচ্ছে তিন্নি ও তার বন্ধুরা। মূলত আজকের ট্রিট তিন্নি দিচ্ছে। মৌমিতা, শামীম, নীলিমা ও আমরিন সকলেই এসেছে। কিছুদিন পর সবাই যার যার লাইফে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাইতো এই ট্রিটের ব্যবস্থা।

আমরিন বললো, “দোস্ত তুই তো চান্স পেয়ে গেলি। আমি আর শামীম ও পরীক্ষা দিসিলাম। পাইলাম না রে।”

শামীম বলে উঠলো
“তুই এই কথা বলোস! আমি যে কী প্যারায় আছি সেটা তো জানিসনা। রিমির অনেক স্বপ্ন তার জামাই ডাক্তার হবে। প্যারা খেয়ে অনেক কষ্ট করে পড়াশুনা করে পরীক্ষা দিসিলাম মেডিকেলে। আর রেজাল্ট কি আসলো? ফেইল!!! এখন রিমিকে আমি কি করে বোঝাবো সেটাই বুঝতেছিনা। না জানি আবার ব্রেকআপ করে।”

তামিমের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলো।

মৌমিতা বললো
“আমি আগে থেকেই জানতাম মেডিকেল পরীক্ষা আমার ধারা পাস করা সম্ভব না। তাই আমি পরীক্ষাই দিইনি।”
নীলিমা বলে উঠলো
“আমার তো আগে থেকেই প্ল্যান ছিল আমি বি.বি.এ করবো। আর তিন্নি যে মেডিকেলে চান্স পাবে সেটা আমি শিওর ছিলাম।”

মৌমিতা বললো
“তিন্নির না পেয়ে আর যাবে কোথায়? আমাদের তিন্নি পড়ারসোনায় এতটাই ব্যস্ত যে সংসার শুরু করতে পারছে না। বেচারা দুলাভাই বিয়ে করেও ব্যাচেলর থাকছে।”
এই কথা শুনে সবাই আরেকদফা হেসে উঠলো। তিন্নির এবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সবাইকে দিলো এক ধমক।
______________
সূচনা আজ মহা খুশি। তাইতো সে জিসান আর তিন্নিকে তার বাসায় দাওয়াত করলো। সূচনার নাম শুনে তিন্নি আর মানা করেনি। সন্ধ্যা নাগাদ তিন্নি আর জিসান সুচনাদের বাসায় পৌঁছালো।
আজকের দাওয়াতের কারণটা তিন্নি জানেনা। কিন্তু এখন এখানে এসে সে বুঝতে পারলো আসল ঘটনা কি? মূলত সেই ড্রাগ ডিলারকে শুট করার জন্য জিসান এবং তার পুরো টিমের ওপর ইনভেস্টিগেশন হচ্ছে। তাই আপাতত তাদের এক সপ্তাহের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে।
তিন্নি প্রথমে বেশ অবাক হয়েছিলো। সে তো ভেবেছিল পুলিশ রা যাকে যখন খুশি তখনই শুট করতে পারে। তবে এখন সে বুঝতে পারলো এক্ষেত্রে বেশ জটিলতা আছে। প্রত্যেকটা গুলির হিসাব তাদের দিতে হয়। অথচ এই বিষয়টা নিয়ে তিন্নি জিসানকে কত কথাই না বলেছে।
কিন্তু সূচনার খুশি হওয়ার বিষয়টা সে এখনো বুঝতে পারছ না। হাসবেন্ড সাসপেন্ড হয়েছে এতে খুশি হওয়ার কি আছে?
তিন্নিকে এত কনফিউজড দেখে সূচনা বললো

“আমি জানি তুমি কি ভাবছো? রিয়াজ, জিসানদের সাসপেন্ড হওয়ার আমি এত খুশি কেন? শুনো এরা কাজ ছাড়া কিছুই বোঝে না। রিয়াজ আমাকে একদমই সময় দিতে পারেনা। তাই যখনই ওরা সাসপেন্ড হয় আমি মহা খুশি থাকি। এই পুরো সময়টা আমি আর রিয়াজ একসাথে কাটাই।”
এবার রিয়াজ বললো
“আমার বউয়ের মত পাগল তুমি আর একটাও পাবেনা। হাসবেন্ড সাসপেন্ড হয়েছে আর সেই খুশিতে সবাইকে দাওয়াত করে খাওয়াচ্ছে। শুধু এইটুকুতে থেমে নেই, সে এক সপ্তাহের ট্যুর প্ল্যান করে ফেলেছে। কিরে জিসান তিন্নিকে এখনো বলিস নি?”
জিসান মুচকি হেঁসে মাথা নেড়ে না জানালো। জিসানের এই হাসিতে তিন্নি কয়েক সেকেন্ডের জন্য হারিয়ে গেলো। আবারো সেই অসহ্যকর হাসি। জিসানের এই হাসি তিন্নির মনের সূক্ষ্ম জায়গায় শিহরণ সৃষ্টি করে। তিন্নি চোখ নামিয়ে নিলো।
সূচনা চোখ রাঙিয়ে জিসান কে বললো

-“এটা কোন কথা জিসান? তুই এখনও তিন্নিকে বলিস নি? তোর দ্বারা কিছুই হবে না। শোনো তিন্নি আমরা সবাই একসাথে কক্সবাজার যাচ্ছি।”

-“আপু এখন কক্সবাজার.. কয়েকদিন পর থেকে আমার ক্লাস শূরু হয়ে যাবে?”

জিসান ভাবছে
-“আমি জানতাম তিন্নি এমনটাই বলবে। এই ভয়েই আমি ওকে কিছু বলিনি?”

সূচনা এবার তিন্নির হাত ধরে বললো
-“তিন্নি প্লিজ মানা করোনা। আর তাছাড়া তোমার ক্লাসে কিছুদিন পর থেকে শুরু হবে। তোমার ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই আমরা চলে আসবো। এটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিলো।”
তিন্নি এবার সূচনা কে মানা করতে পারলো না। তিন্নি যে যেতে রাজি হবে এটা তো জিসান ভাবতেই পারেনি। তার মনটা খুশিতে বাকবাকুম করছে।
সেদিন রাতে আর সূচনা তিন্নিকে যেতে দিলো না। প্রায় অনেক রাত পর্যন্ত তারা একসাথে গল্প করলো। গল্প শেষে সূচনা তাদের গেস্ট রুম দেখিয়ে দিলো।
তিন্নি ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে আসতেই জিসান বললো

-“আসলে সূচনা হঠাৎ করে এমন একটা প্ল্যান করে ফেললো। আমি তোমাকে আসলে বলার সুযোগ পাইনি। তুমি কি রাগ করেছো?”

তিন্নি হেসে ফেললো। আর বললো
-“আপনি এমন কেন মনে হচ্ছে আমি রাগ করেছি? আমি মোটেও রাগ করিনি। আর তাছাড়া ক্লাস শুরু করার আগে আমার মাইন্ড একটু ফ্রেশ হয়ে যাবে।
জিসান ভীষণ খুশি হলো তিন্নির কথায়।জিসান বললো
-“আমরা কিন্তু কাল রাত্রের বাসে যাব। তোমার কোন শপিং এর প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে আমি নিয়ে যাব তোমাকে।”
-“আমার কিছুই লাগবেনা। কিছুদিন আগেই শপিং করলাম। আর ওই দিন ই তো..
তিন্নি আর বলতে পারলো না। জিসান বুঝতে পারলে তিন্নি সেই দিনের কথা বলছে।
জিসান এবার তিন্নির পাশে বসলো। তিন্নির হাতের মাঝে নিজের হাত রেখে বললো

-“আমি জানি আমার লাইফ স্টাইল এর সাথে তোর মানিয়ে নিতে অনেক সমস্যা হচ্ছে। বাট ট্রাস্ট মি তুমি যেন আছো আমার তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে। তোমার এই ব্যক্তিত্বই আমাকে মুগ্ধ করে। আমি জানি আমার লাইফে অনেক ভায়োলেন্ট আছে। তবে আমি সবসময়ই আমার প্রফেশনাল আর পার্সোনাল লাইফ কে আলাদা রাখার চেষ্টা করবো।”

তিন্নি জিসানের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এই মানুষটা সব সময় এত সুন্দর ভাবে কেনো কথা বলে? মানুষটা জীবনে অনেক বেটার কাউকে ডিজার্ভ করে। সে মোটেও জিসানের যোগ্য না।

তিন্নি আর জিসান দাঁড়িয়ে আছে বাস স্ট্যান্ডের সামনে। রিয়াজ ভাই আর সূচনা এখনো পৌঁছায়নি। আজকের ওয়েদার টা তিন্নির খুব ভালো লাগছে। ঠান্ডা বাতাস। এর আগে তিন্নি কখনই কক্সবাজার যায়নি। তাই সে এখন অনেকটাই এক্সাইটেড।
কিছুক্ষণ পরেই সূচনা আর রিয়াজ আসলো। তাদের দেখেই জিসান বললো
-“রিয়াজ ভাই আপনার মত একজন পাঞ্চুআল মানুষ এমন করলে হয়?কখন থেকে দাড়িয়ে আছি।”
-“আরে ভাই তোর কি মনে হয় আমার জন্য দেরি হয়েছে? তোর ওই বান্ধবীর জন্য আমার দেরি।”
সূচনা বললো
-“হে সব দোষ তো আমার।আর একটু দেরি করলে কি হইসে?তোর বউকে কেউ তো কিডন্যাপ করে নিয়ে যায়নি?”
-“আমি থাকতে আমার বউয়ের দিকে কেউ চোখ তুলে তাকিয়ে দেখুক, চোখ তুলে ফেলবো।”
তিন্নি তাদের কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকে।
সূচনা তিন্নিকে দেখে বললো
-“তোমাকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে।”
-“আপু আপনাকেও অনেক ভালো লাগছে।”
রাতের জার্নি তিন্নির কাছে ভীষণ ভালো লাগে।লাস্ট বার তারা পুরো ফ্যামিলি মিলে সিলেট ঘুরতে গিয়েছিলো।
জিসান একবার আড়চোখে তিন্নিকে দেখলো।জিসানের খুব আফসোস হচ্ছে বাসটা কেনো এসি বাস হলো।নাহলে জানালা খুলে মুক্ত বাতাসের সাথে প্রিয়সীর চুলের সুভাষ নিতে পারতো।জিসানের হটাত চোখ পরলো পাশের একটা কাপল এর দিকে।ছেলেটা মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কথা বলছে আর হাসছে।দিখে বুজা যায় নতুন দম্পতি তারা।
জিসান একবার ভাবলো সে কি একবার জড়িয়ে ধরবে তিন্নিকে? পরে ভাবলো দরকার নেই।এমনই জা রাগী তার বউ।দেখা যাবে আমাকে বাস থেকে বের করে দিয়েছে।
গভীর রাতে জিসানের হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো।পাশে তাকিয়ে দেখে তিন্নি তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে।জিসান তিন্নির চুলে একবার হাত বুলালো।মন ভরে চুলের গ্রান নিলো।কোন ব্র্যান্ডের শ্যাম্পু ইউজ করে তিন্নি? তারপর সে তার সেই চাওয়া পূরণ করলো।তিন্নিকে কিছুটা জড়িয়ে ধরলো।ঘুমের মাঝে তিন্নি তার দিকে চেপে আসলো আর বুকে মাথা গুঁজে দিলো।
জিসান ভাবছে এখন যদি বাসটি অন্ধকার না হতো তবে সে এই মুহূর্তটাকে ক্যাপচার করে রাখতো।#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_18

খুব ভোরে তারা কক্সবাজারে পৌঁছুলো।রুমে এসেই তিন্নি ফ্রেশ হতে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে জিসান বেঘোরে ঘুমাচ্চে। তিন্নি সারা রাত ঘুমিয়েছে তাই তার এখন ঘুম আসছে না।সে বারান্দায় চলে গেছে।

বারান্দায় এসে তিন্নি মুগ্ধ হলো।কারণ তার ঠিক সামনেই সমুদ্র।সকালের শীতল ঠান্ডা আবহাওয়া তার মনের ও শরীরের ক্লান্তি নিমিষেই দূর করে দিলো।এই মুহূর্তে তার পাপর কথা মনে পড়ছে।পৃথিবীর সকল সুখ বা সুন্দর্যে যখনই সে বিমোহিত হয়েছে,তখনই তার সবার আগে তার পাপার কথা মনে পড়ে।কারণ তার সকল সুখের উৎস তার পাপা।
এক মিনিটও দেরি না করে সে সবার আগে তার পাপাকে কল করলো।
সকাল সকাল মেয়ের কল পেয়ে আনিসুর রহমান ভীষণ খুশি হলেন।সারা রাত টেনশনে ঠিক মতো ঘুমাতে পারেনি।জিসান তার মেয়ের কোনো অসুবিধা হতে দিবেনা তা তার জানা।তবুও বাবাতো চিন্তা তো হয়।তিনি কল রিসিভ করলেন।

-“মামনি তোমরা ঠিকমত পৌঁছেছো?”

-“হ্যাঁ পাপা আমরা ঠিকমতো পৌঁছেছি। তোমার শরীরটা ঠিক আছে?”

-“হ্যাঁ আমি ঠিক আছি। তো কেমন লাগছে কক্সবাজার?”

-“এখনো বাইরে বের হইনি। তবে সমুদ্র দেখেই আমার মনটা খুব ভালো হয়ে গেছে। আর সকালের ওয়েদার টা জাস্ট ওয়াও।”

-“ভেরি গুড ইনজয় করো। জিসান কোথায়?”

-“উনি ঘুমোচ্ছে। মনে হয় ঘুম হয়নি রাতে।”

-“ঠিক আছে মামনি নিজের খেয়াল রেখো আর জিসানেরও।”

-“পাপা তুমিও না।একজন ACP র খেয়াল রাখতে বলছো আমাকে?”

-“একজন ওয়াইফ যেভাবে একজন হাজবেন্ডের খেয়াল রাখে আমি সেই খেয়াল রাখার কথা বলেছি।”

-“পাপা তুমিতো জানো এটা আমার জন্য এত সহজ না।”

-“তুমি চাইলে সবই সহজ।”

-“এসব নিয়ে আমি এখন ভাবতে চাচ্ছি না পাপা। বরং এই সময়টাতে আমি উপভোগ করতে চাচ্ছি।”

-“তুমি যেটা ভালো মনে করো। ঠিক আছে রাখছি।”

-“ঠিক আছে পাপা আল্লাহ হাফেজ।”

কথা শেষ করে তিন্নি জিসানের দিকে তাকালো। জিসানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে তিন্নির মনে শীতল এক অনুভূতি বয়ে গেলো।মানুষটার চেহারায় মায়া যেন উপচে পড়ছে। কিন্তু সেই মায়ায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে ভয় হয় তিন্নির। প্রথমদিকে এই মানুষটাকে অনেক ভুল বুঝেছে সে। কিন্তু এই মানুষটা কখনো তার অসম্মান করেনি। সে এই মানুষটার একটা জিনিস খেয়াল করেছে। মানুষটা তার প্রফেশনাল লাইফে যেমন কঠিন কিন্তু তিন্নির কাছে এই মানুষটা তুলোর মত নরম।

সকলে একসাথে বসে নাস্তা করলো প্রথম তারা। তারপর বেরিয়ে পড়ল বিচ এর উদ্দেশ্যে। বিচ সাইড এর কাছাকাছি আসতেই তারা শুনতে পেলো উত্তাল সমুদ্রের শ্রুতি মধুর ধ্বনি। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ সারিবদ্ধ ভাবে এসে আঁচড়ে পরছে তীরে। তার সাথে ভেসে আসছে বিভিন্ন শামুক ও কাঁকড়া। এমন মনোরম দৃশ্য দেখে তিন্নি খুবই এক্সাইটেড হয়ে গেলো। সূচনা এবং তিন্নি দুজনেই নেমে পরলো পানিতে। জিসান মুগ্ধ হয়ে দেখছে তার অর্ধাঙ্গিনী কে। কে বলবে এত গম্ভীর মেয়েটা এতটা বাচ্চা সুলভ হতে পারে? সূচনা চেঁচিয়ে রিয়াজ আর জিসান কে বললো

-“এই সমস্যা কি তোমাদের পানিতে নামছে না কেন?”

রিয়াজ বললো
-“লবণাক্ত পানিতে আমার শরীরে এলার্জি উঠে যায়। আমি এখানেই ভালো আছি।”

সূচনা এবার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। রিয়াজ টা এত আনরোমান্টিক কেনো? দাঁড়াও দেখছি তোমার এলার্জি?

সে এক প্রকার ধরে বেঁধে রিয়াজকে পানিতে নামালো। জিসানও মনে মনে সূচনাকে ধন্যবাদ দিলো।আসলে রিয়াজকে একা রেখে সেও যেতে পারছিলো না। সে চলে গেলো সোজা তিন্নির কাছে।তিন্নি যতই গভীর পানিতে যেতে চাইছে কিন্তু বিশাল বড় বড় ঢেউ তাকে তীরে নিয়ে আসছে।তিন্নির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।তিন্নির অবস্থা দেখে জিসান হেসে দিলো।
সে তিন্নির কাছে এসে তার হাত ধরলো।
হঠাৎ এমন হাওয়ায় তিন্নি কিছুটা চমকে পাশে তাকালো।জিসান তিন্নির হাতটা শক্ত করে ধরে সামনে যেতে লাগলো।কোমর পানি অব্দি এসে জিসান থামলো। এর চাইতে বেশি সামনে যাওয়াটা সে সেভ মনে করলো না।তিন্নির ব্যাপারে সে কোনো রিক্স নিতে চায়না।তিন্নি ভীষণ ইনজয় করছে এই মুহূর্তটা।একজন ফটগ্রাফার তাদের প্রতিটা মুহূর্তকে ক্যাপচার করতে লাগলো। হঠাৎ একটা বড় ঢেউ আসায় তিন্নি নিজেকে সামলাতে না পেরে জিসানকে জড়িয়ে ধরলো।জিসানও তিন্নিকে ধরলো।সে বুঝতে পারলো তিন্নি অনেকটা ভয় পেয়েছে।জিসান আর দেরী না করে তিন্নিকে নিয়ে তীরের দিকে চলে আসলো।
তারা একটা খাটে বসে পড়লো।দূর থেকে তারা দেখতে পারলো সূচনা আর রিয়াজ ঝগড়া করছে।তিন্নি তাদের ঝগড়া দেখে হেসে ফেললো।সে জিসানকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“এই দুজনের জুটিটা একদমই মিসম্যাচ। এরা দুজন দুজনের প্রেমে পড়লে কিভাবে?”

তিন্নির কথায় জিসান হেসে দিলো। তারপর বললো

-“মজার বিষয় কি জানো, আমাদের ভার্সিটিতে এই কাপল টাই ছিল পপুলার। রিয়াজ ভাই তো টানা দু’বছর সূচনার পিছনে ঘুরে ছিল। সূচনাও রিয়াজ ভাইকে পছন্দ করতো। তবু সে রিয়াজ ভাইকে দুই বছর ঘুরিয়েছে। সূচনার বাসা থেকে তো বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিলো। বহুকষ্টে রিয়াজ ভাই তাদের কনভেন্স করেছিলো। এরা এত ঝগড়া করলে কি হবে। একজন অন্যজনকে ছাড়া মোটেও ভালো থাকতে পারে না।”

-“আসলেই ওদের দেখে তাদের সম্পর্কের গভীরতা আন্দাজ করা যায় না।”

-“ভালোবাসা জিনিসটাই এমন! এটা কাউকে বলে বোঝানো যায় না। শুধু অনুভব করে নিতে হয়।”

এই দিকে সূচনা আর রিয়াজের মধ্যে একজন ঝগড়া চলছে।সূচনা বলছে
-“তুমি আসলেই একটা আনরোমান্টিক লোক। বাবার কথায় ওই রায়হানকে বিয়ে করলেই ভালো হতো।সে অন্ততো তোমার মত এমন রোবট হতো না।”

-“আমারই ভুল হয়েছে। তোমাকে ওই বলদ রায়হানের সাথে বিয়ে দিলেই ভালো হতো।”

-“খবরদার ওকে বলদ বলবা না। ও বলদ হলে তুমি একটা বেকুব। কাজ ছাড়া কিছুই বোঝনা। এবার ঢাকায় পৌঁছে আমি বাবার বাসায় চলে যাব।”

এবার রিয়াজ কিছুটা দমে গেলো। সে বউটাকে মনে হয় বেশি রাগীয়ে দিয়েছে। আর যাই হোক সূচনাকে ছাড়া সে একদিনও থাকতে পারবে না। যে কটা দিনই সূচনা তার বাবার বাড়িতে থাকে, সেই কয়টা দিনই রিয়াজের খুব খারাপ কাটে। দিনশেষে সূচনা কে দেখলে তার সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সে বলে উঠলো

-“আরে আমার মিষ্টি বউটা এত রাগ করেনা। যাও আজকে তোমাকে আত্তো গুলা আদর দিব।”

-“লাগবেনা আমার তোমার কোনো আদর। ফালতু লোক একটা। খবরদার কথা বলবা না আমার সাথে।”

রিয়াজ এবার লেগে পড়ল সূচনার রাগ ভাঙ্গাতে। এমনিতেই সে বউটাকে বেশি সময় দিতে পারেনা। তাই সুন্দর সময় গুলোতে সে সূচনা কে খুশি দেখতে চায়।#মেঘবিলাসী
#israt_jahan_arina
#part_19

দুপুরে ফ্রেশ হয়ে তারা বেরিয়ে পড়লে লঞ্চের উদ্দেশ্যে। তারা গেলো কক্সবাজারের প্রসিদ্ধ হোটেল পউষী হোটেলে। সেখানেই তারা অর্ডার করলো লইট্টা ফ্রাই, কাচকি ফ্রাই, গরুর কালা ভুনা, ভর্তা প্লেটার, রূপচাঁদা ফ্রাই আর ডাল। খাবার গুলো দেখেই তিন্নির জিভে জল এসে গেলো। এই খাবারগুলোর অনেক মজার সে আগে অনেক শুনেছিলো। আজ টেস্ট করে বুজলো আসলেই এগুলো অনেক টেস্টি।তিন্নির আজ মনে হচ্ছে সে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছে।খাওয়া দাওয়া শেষ তারা রুমে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলো।
সন্ধ্যার পর সমুদ্রের তীরে বিশাল মেলা জমা হয়। সমুদ্রের তীরে বিশাল বড় মার্কেট। সেখানে শামুক,মতির বিভিন্ন গহনা বিক্রি হয়। এছাড়াও বিভিন্ন আচার পাওয়া যায়। আশপাশ থেকে শুটকির মৌ মৌ গন্ধ বের হচ্ছে। তারা একটু সামনে এগুতেই দেখতে পেলো সেখানে কাঁকড়া ফ্রাই বিক্রি হচ্ছে।তারা সেখানে কাঁকড়া অর্ডার করলো। তিন্নি এবার কিছুটা বিপদে পড়ে গেলো। সে এর আগে কখনোই কাকড়া খায় নি। তাই সে কাকড়ার খোসা কিছুতেই ছাড়াতে পারছিল না। তাই জিসান তাকে হেল্প করলো। সুচনাকে দেখি মনে হচ্ছে সে কাঁকড়া খাওয়া এক্সপার্ট। তারা আশপাশ থেকে টুকটাক শপিং করলো। আটটার মধ্যেই তারা ডিনার শেষ করে হোটেলে ফিরলো।
বাহিরে প্রচন্ড ঝড় হচ্ছে। তিনি আর জিসান দুজনে বসে বসে টিভি দেখছে। কিছুক্ষণ পরেই রিয়াজ আর সূচনা আসলে ওদের রুমে। সূচনা এসেই বললো

-“এই জিসান, তুই আমাদের রুমে যা।এই ফালতু লোকের সাথে আমি থাকতে চাই না। আমি এই রুমের ঘুমাবো তুই ওই রুমে যা।”
জিসান করুন চোখে রিয়াজের দিকে তাকালো।
আরে লক্ষী বউ আমার এতো মাথা গরম করে না।দাড়াও আইসক্রীম অর্ডার করছি।আইসক্রীম খেয়ে মাথা ঠান্ডা করো।
সূচনা বললো

-“জিসান তুই ওকে বলে দে আমার সাথে যেনো লাগতে না আসে।”

জিসান বেচারা আছে বিপদে। সিনিয়র ভাইকে না কিছু বলতে পারে।আর না সূচনাকে।তিন্নি ওদের কাহিনী দেখে খুব মজা পাচ্ছে। কিছুক্ষন এর মধ্যে আইসক্রিম চলে আসলো।আরো বেশ কিছক্ষন আড্ডা দেওয়ার পর রিয়াজ এক প্রকার জোর করে সূচনার নিয়ে গেলো।

রাতের আবহাওয়া এখানে খুবই ঠাণ্ডা। গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো তিন্নি একদম তার গা ঘেঁষে ঘুমিয়ে আছে। আজ পর্যন্ত সে যতবারই তিন্নির পাশে ঘুমিয়েছে এমনটা কখনো হয়নি। সে ঘুমের মাঝেও নিজেকে গুছিয়ে রাখে। হঠাৎ জিসানের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলো। সে রুমের টেম্পারেচার আরো কমিয়ে দিলো। তার কিছুক্ষণ পরে জিসানের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। কারণ তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। টেম্পারেচার কমে যাওয়ায় তিন্নি জিসানকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। এই সুযোগে সে ও তার অর্ধাঙ্গিনী কে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো। কেমন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে তার। ভালোবাসার মানুষকে জড়িয়ে ধরে শরীর অনেকটা সুখ পাওয়া যায়। তিন্নি তার জীবনে না আসলে সে কখোনই সুন্দর মুহূর্ত গুলো উপভোগ করতে পারত না।
সকালের নাস্তা শেষ করে তারা বেরিয়ে পড়লো হিমছড়ি পাহাড়ে। হিমছড়ি যাওয়ার জন্য তারা একটা টমটম ভাড়া করলো। আশেপাশের ভিউ দেখে তিন্নি মুগ্ধ হচ্ছে। এক পাশে সমুদ্র আর অন্যপাশে পাহাড়ের ছোট ছোট টিলা। এর মাঝে ছোট ছোট ঝরনার দেখা পেল তারা। বেশ কিছুক্ষণ পর তারা হিমছড়ি পাহাড় এর পৌঁছলো। জিসান দেখতে পেলো তিন্নি ভীষণ এক্সাইটেড।

সূচনা বায়না করলো এই সিঁড়ি বেয়ে সে পাহাড়ে উঠবে। রিয়াজ তাকে সাথে সাথে মানা করে দিলো। কারণ সে জানে রাতে তাকেই আবার সূচনার পা টিপে দিতে হবে।
সূচনার সাথে সাথে এবার তিন্নির পাহাড়ে উঠতে চাইলো। জিসান তাকে বুঝানো এ পাহাড়ে উঠতে গেলে অনেকগুলো সিড়ি পার হতে হবে।তারা জিসান বা রিয়াজের কোনো কথাই শুনলো না।
বেশকিছু সিঁড়ি উঠার পরে দুজন হাঁপিয়ে উঠলো। রিয়াজ সূচনা কে উদ্দেশ্য করে বললো

-“বলেছিলাম পারবে না। কিন্তু তুমি তো কখনোই আমার কথামত চলবে না। এখন এই সিঁড়িতে বসে থাকো।

-“এই তুমি একদম ফালতু কথা বলব না। দেখছো আমি দম নিতে পারছিনা। একটু হেল্প করবে তা না কথা শোনাচ্ছ।”

তিন্নি বেচারীর অবস্থা খুবই খারাপ। আবার সে কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা। জিসান তিনি অবস্থা বুঝতে পেরে আর এক মিনিটও দেরি করলো না।সে সোজা তিন্নিকে কোলে তুলে নিলো। আকর্ষিক ঘটনায় তিন্নি হতবম্ব হয়ে গেলো।তিন্নি মনে হয় বার বার তার হার্টবিট মিস করছে।
জিসান এই কাজ দেখে সূচনা রাগান্বিত চোখে রিয়াজের দিকে তাকালো।রিয়াজের চেহারা মুহূর্তেই মলীন হয়ে গেলো।
সে জিসানকে বললো

-“ব্যাটা হিরোইজম দেখানোর আর জায়গা পাওনা।আমার বউয়ের সামনেই এইগুলা করতে হবে?আমার কি তোর মত ফিট বডি আছে নাকি?আর না আছে পেনসিল সাইজের বউ।”

রিয়াজের কথা শুনে তিন্নি ভীষণ লজ্জা পেলো।সে বার বার বলছে তাকে নিচে নামিয়ে দিতে।
শান্ত কন্ঠে জিসান বললো

“তোমার কিছু হয়ে গেলে বাবার কাছে আমি কি জবাব দিব?তোমাকে আমি নিজ দায়িত্বে নিয়ে এসেছি।তাই তোমার সকল সুবিধা অসুবিধা দেখার দায়িত্ব আমার।”

সূচনা আবার বেশ ক্ষিপ্ত হলো রিয়াজের উপর।সে রাগান্বিত হয়ে রিয়াজকে বললো

“তুমি আমাকে ইনডাইরেক্টলি মোটা বললে?আমি মোটা তাই আমাকে কোলে তুলে নিতে পারব না?এটাই শোনার বাকি ছিল।আমি আজই বাবাকে বলবো যে সে ঠিক ছিল আর আমি ভুল।”

সূচনা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে গেলো।আর রিয়াজ তাকে বুঝাতে লাগলো।
জিসান আর সেখানে দাড়ালো না।সে তিন্নিকে নিয়ে সোজা উপরে উঠে গেলো।উপরে এসে তিন্নি আসে আসে দেখতে লাগলো।পাহাড়ের উপরে উঠে সমুদ্রের আসল সুন্দর্যের উপলব্ধি পাওয়া যায়।তিন্নি একদম পাহাড়ের সাইডে আসে দাড়ালো।সে পাহাড় থেকে নিচে দেখতে চায়।জিসান তিন্নির হাত ধরে রাখলো।এই মুহূর্তে তিন্নির নিজেকে খুব সেভ মনে হচ্চে। আজকাল জিসান এই স্পর্শ তিন্নির মনে শিহরন জাগিয়ে তোলে।

সে জিসানের দিকে একবার তাকালো।সামনের মানুষটাকে ভীষণ হেন্ডসাম লাগছে।কিছু একটা ভেবে তিন্নি আশেপাশে চোখ বুলালো। যা ভেবেছে তাই।কয়েকটা মেয়ে জিসানের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।এই বিষয়টা তিন্নির এক দিকে ভালো লাগলো,আবার আরেক দিক দিয়ে বিরক্তও লাগলো।ভালো লাগলো এইটা ভেবে যে অতি সুদর্শন এই যুবকটিকে তার পাশে দেখে কতো মেয়ে জ্বলছে।আর খারাপ লাগলো মেয়েরা এমন করে কেনো জিসানকে দেখছে।জীবনে কি সুন্দর ছেলে দেখেনি?

বেশ কিছক্ষন পর রিয়াজ আর সূচনা আসলো পাহাড়ের উপর।দুজনেই হাপিয়ে গেছে।জিসান তাদের দিকে পানি এগিয়ে দিলো। সূচনা জিসানকে বললো

“নেক্সট টাইম এই জায়গাতে আসলে আগে তুই আমাকে কোলে করে উপরে তুলবি।তার পর তোর বউকে তুলবি।”

তিন্নির ভীষণ হাসি পাচ্ছে সূচনার কথা শুনে।
জিসান বললো

-“আমি কেনো তোকে তুলতে যাবো?তোর জামাইকে বল তুলতে।”
-“এই ব্যাটা তুলবে আমাকে? এর গায়ে কোনো শক্তি আছে?আমাকে দিয়ে খালি রান্না করাবে আর তা খেয়ে খেয়ে ফুলে উঠবে। মটকু একটা।”

-“এখন থেকে জিম এ পাঠাবি।”

রিয়াজ বললো
-“এই পাহাড়ে আমি আর জীবনেও আসছি না।”
তার পর তারা সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটলো।
আজ তারা যাবে ছেড়া দ্বীপ সেন্টমার্টিন। সমুদ্রের মাঝে এই দ্বীপ অপরূপ সুন্দর্যের অধিকারী। সেন্টমার্টিনে পৌঁছে তিন্নি আবারো মুগ্ধ হলো।ছোট বড় পাথরের ঘেরা দ্বীপের তীরে।
এই সময় গুলি তিন্নি ভীষণ উপভোগ করছে জিসানের সাথে সে এখন অনেকটা স্বাভাবিক হতে পেরেছে। মানুষটা তার ভীষণ খেয়াল রেখেছে।এই মানুষটাকে আর আগের মত অসহ্যকর লাগে না।

আজ ওরা সবাই ঢাকা ফিরে এসেছে। এই কয়েকটা দিন জিসানের জন্য অনেক স্পেশল ছিলো। তিন্নির সাথে খুব ভালো সময় কাটাতে পেরেছে।
বাসার দরজা খুলে অবনী রহমান বেশ অবাক হলেন। চিৎকার দিয়ে বললেন

-“এই তোদের অবস্থা কেন? দুজনই তো পুড়ে ছাই হয়ে গেছিস। কক্সবাজারে যে কি তোরা সানস্ক্রিম ইউজ করিস নি?”

তিনি মুচকি হেসে বললো

-“পুড়েছে তো ভালোই হয়েছে। এমনিতেই সাদা চামড়া বেশি ভালো লাগে না।”

-“এই তুই আমার সাথে ফাইজলামি করিস?”

জিসান পরিস্থিতি ঠান্ডা করার জন্য বললো
-“আম্মু সানস্ক্রিন টা ইউজ করেছিলাম আমরা। কিন্তু তবুও এমন হয়েছে। সমস্যা নেই কয়েক দিন এর মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”
তিন্নির বাবা এসে বললো

-“এখনই কি শুরু করেছো? বাচ্চাগুলোকে আগে বাসায় ঢুকতে দাও।”
বাচ্চার খেতাব পেয়ে জিসান কিছুটা লজ্জা পেলো। তারা সবাই একসাথে সকালের নাস্তা করলো। জিসান আজ থেকেই অফিসে জয়েন করতে হবে। তাই সকালে নাস্তা শেষ করে অফিসে চলে গেলো।

মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তিন্নির বাবার মুখে প্রশান্তির হাসি বেরিয়ে আসলো। তিন্নি যে এই ট্রিপ টা ভীষণ এনজয় করেছে সেটা তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। তার বিশ্বাস একমাত্র জিসান পারবে তার মেয়েকে সম্মান করতে এবং গভীরভাবে ভালবাসতে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here