মেঘমালা পর্ব ৫

#মেঘমালা
#পর্বঃ৫
#Sohana_Akther
‘কি হলো তোমার মা…’ সম্পূর্ণ কথা বলতে পারলো না মেঘ । রুমে এসে দেখে মালা এখনো শাড়ি পরা নিয়ে ব্যস্ত । শাড়ির আঁচল মাটিতে লুটিয়ে আছে , মনোযোগ দিয়ে বারবার কুচি ঠিক করার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই তা ঠিক হচ্ছে না । মেঘ যে এখানে এসে দাড়িয়ে আছে সেদিকে খেয়াল নেই মালার । সে শাড়ি নিয়েই ব্যস্ত । মালাকে এই অবস্থায় দেখে এক ঢোক গিললো মেঘ । চোখজোড়া তার বারবার মালার পেটের দিকেই যাচ্ছে । মালার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য মেঘ হালকা কাশি দিয়ে উঠলো । তার কাশির শব্দ চোখ তুলে মেঘকে দেখে শাড়ির আঁচল ঠিক করে দাড়ালো ।

— এখনো রেডি হওনি যে তুমি , আমি সেই কখন থেকে গাড়িতে বসে আছি ।

— রেডি আমি কিন্তু শাড়ির কুচিটা ঠিক ভাবে করতে পারছি না । অনেক দিন পর শাড়ি পরছি তো তারউপর নতুন শাড়ি তাই কুচি দিতে সমস্যা হচ্ছে । সেই কখন থেকে চেষ্টা করছি কিন্তু হচ্ছেই না ।

— যখন দেখতে পারছো হচ্ছে না তখন আমাকে ডাক দিলেই তো হতো আমি ঠিক করে দিতাম ।

— আপনি ঠিক করে দিতেন?

— এখানে এতো অবাক হওয়ার কি আছে , আমি কি পরপুরুষ নাকি যে তোমার শাড়ি ঠিক করে দিতে পারবো না । এখন চুপচাপ দাড়িয়ে থাকো আমি কুচি ঠিক করে দিচ্ছি ।

মালা চুপচাপ দাড়িয়ে মেঘের শাড়ির কুচি ঠিক করা দেখছে । মেঘ কুচি ঠিক করে দাড়াতেই মালা বললো ,

— ঠিক আছে, এবার আমার হাতে দিন বাকিটুকু আমি নিজে করে ফেলবো ।

— কুচি যখন ঠিক করেছি তখন গুজেও দিতে পারবো ।

মেঘ মুচকি হেসে শাড়ির কুচি গুজে দিলো । কুচি গুজার সময়ে মেঘ ইচ্ছে করেই মালার পেটে হাত বুলাচ্ছে । মালা মেঘের কাধ খামচে ধরে থরথর করে কাপছে । তার কাপাকাপি দেখে মেঘের হাসির মাত্রা বেড়ে গেল । কুচি ঠিক করে মেঘ তার শাড়ির আঁচল ও ঠিক করে দিল । মালাকে আয়নার সামনে দাড় করিয়ে তাকে আয়নাতে দেখছে মেঘ । মালা লজ্জায় এখনো মাথা নিচু করে আছে । কয়েক মুহূর্তের পর মালা চোখ তুলে মেঘকে বলো ,

— এখন দেরি হচ্ছে না আপনার? চলুন তাড়াতাড়ি ।

বলে চলে যেতে নিলে তার হাত ধরে আবার আয়নার সামনে দাড় করালো মেঘ ।

— এভাবেই চলে যাবে নাকি ?

— এভাবে কিভাবে ! ঠিকই তো আছে সব ।

— কিছুই ঠিক নেই , তুমি এই টুলে বসো আমি ঠিক করে দিচ্ছি সব ।

মেঘ মালাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলে বসিয়ে তার খোপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিল । তার হরিণীর মতো চোখে মোটা করে কাজল পরিয়ে দিল । ঠোঁটে হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক দিয়ে দিল । মালা চুপচাপ বসে মেঘের সব কার্যক্রম দেখছিল । খুশিতে তার চোখে পানি এসে পরলো, এমনটাই তো সে আশা করেছিল মেঘ থেকে আজ তা পূর্ণ হয়ে গেল ।

— চলো এবার যাওয়া যাক ।

মালা ও মেঘ দুজনে বের হয়ে গাড়িতে বসলো । গন্তব্য তাদের মালার বাবার বাড়ি । সারা রাস্তায় কেউ কিছু বলে নি, আধ ঘণ্টার পর তাড়া পৌঁছালো । গাড়ি থেকে নেমে এক প্রকার দৌড়ে ভিতরে চলে গেল । মেঘ তাদের সকলের জন্য নিয়ে আসা উপহার গুলো গাড়ি থেকে বের করে মালার পিছু পিছু গেল । বাড়ির মুল দরজার সামনে দাড়িয়ে বেল বাজাচ্ছে মালা কিন্তু এখনো কেউ দরজা খুলে নি ।

— এত কেনো বেল বাজাচ্ছো , অস্থির হয়েও না এখনি আসছে হয়তো কেউ ।

তাদের কথার মধ্যেই মালার ছোট বোন মধুরিমা দরজা খুললো । দরজা খুলে সে মালাকে দেখে খুশিতে জোরে চিৎকার দিয়ে মালাকে জরিয়ে ধরলো । মধুরিমার চিৎকার শুনে মালার মা ও মাদিহা ও দরজার কাছে এসে মালাকে দেখে খুশিতে গদগদ করে উঠলো ।

— এই মধু বোন আর বোন জামাইকে কি দরজায় দাড় করিয়ে রাখবি নাকি ভিতরে আসতে দে তারপর যতো কথা আছে সব বলে নিতে পারবি ।

মেঘ ও মালা ভিতরে ঢুকে সোফায় যেয়ে বসলো । মেঘ এক এক করে তাদের জন্য নিয়ে আসা উপহার গুলো বের করে দিচ্ছে । মধুরিমা ও মাদিহা তো এগুলো পেয়ে অনেক খুশি । সত্যিই মেঘ মালার বোনদেরকে নিজের বোনের মতো করে ভালোবাসে ।

— মা.. বাবা কোথায়?

— কোথায় হতে পারে তোর বাবা বল । স্কুলেই আছে একটু পরেই চলে আসবে , তোরা ভিতরের রুমে যেয়ে বস । আমি দুপুরের খাবারের আয়োজন করছি , কতদিন পর আমার মেয়ে আর মেয়ের জামাই বাড়িতে এসেছে ।

— আচ্ছা ঠিক আছে যা করার করো ।

দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর সবাই মিলে যখন কথা বলছিল তখন মালার মা মেঘের কাছে মালাকে একরাত থেকে যাওয়ার জন্য আবদার করলো । মায়ের সাথে সাথে মাদিহা ও যোগ দিল।

— হ্যা, প্লিজ একদিনের জন্য থাকতে দিন । বিয়ের একমাস পর যে ছিল এরপর তো আর থাকেনি , আজ থাকতে দিন ।

তাদের কথা শুনে মালা মেঘের দিকে তাকলো । মেঘ ও তার দিকেই তাকিয়ে আছে । শাশুড়ির মুখের উপর কথা কিভাবে বলবে তাই আজ থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো । তার এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হলো মালা । এই একটি রাত থাকার পর পরের দিন সকালেই মালাকে নিয়ে মেঘ চলে আসলো । মালাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে মেঘ অফিসে চলে আসলো ।

অফিসের প্রতিটা স্টাফ মেঘকে যমের মতো ভয় পায় । মেঘ কাজ নিয়ে খুব স্ট্রিক্ট , কাজের বাহিরে সে কোনো রকম কথা পছন্দ করে না । মেঘকে যমের মতো ভয় পেলেও অফিসের মেয়েরা তাকে নিয়ে গবেষণা করতেই থাকে । তাদের লাঞ্চ টাইমের আড্ডার টপিকই মেঘ আহমেদ । অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী মেঘ । তার এই অসাধারণ ব্যক্তিত্ব সবাইকে তার দিকে আকৃষ্ট করে । মেয়েরা তার আগে পিছে ঘুরঘুর করলেও মেঘ সেদিকে পাত্তা দেয় না । মেঘ কখনো কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলেও তাকায়নি । তার এসব মেয়েদের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই । মেঘের পিএ ও সে একটি ছেলেকেই রেখেছে । কখনো কোনো মেয়ে স্টাফকে সে তার কেবিনে ঢুকার অনুমতি দেয় না ।

একটা প্রজেক্টের কাজ করতে যেয়ে মেঘ খেয়াল করলো প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন এর ফাইল সে বাড়িতে ফেলে এসেছে । এখন নিজে চাইলেও যেতে পারবে না তার আরো কাজ আছে । তাই সে তার এক স্টাফকে কল করে তার কেবিনে আসতে বললো ,

— মে আই কাম ইন স্যার?

— ইয়াহ কাম ।

— কি জন্য ডেকে ছিলেন স্যার ?

— মিঃ হাসান , আপনাকে একটু আমার বাসায় যেতে হবে এখন । রায়হান গ্রুপের প্রজেক্টের যে প্রেজেন্টেশন ছিল ঐটা ভুলে আমি বাসায় ফেলে এসেছি । আপনাকে একটু কষ্ট করে ফাইলটা আনতেহবে ।

— নো প্রবলেম স্যার, আমি এক্ষুনি যেয়ে ফাইলটা নিয়ে আসছি ।

— ইয়াহ ইউ গো নাউ ।

মিঃ হাসান কেবিন থেকে যাওয়ার পর মেঘ বাড়ির ল্যান্ডলাইনে ফোন করলো । এইদিকে ফোন বাজার কয়েক সেকেন্ড পর মালা তা রিসিভ করলো ।

— হ্যালো মালা , রুমে টেবিলের উপর আমার একটি ব্লু কালার ফাইল পরে আছে । আমি আমার একজন স্টাফকে পাঠিয়েছি তার জন্য । রহিমা খালাকে দিয়ে ফাইলটি তাকে দিয়ে দিও তোমার সামনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই ।

— আচ্ছা ঠিক আছে ।

মেঘ লাইন কেটে দিল । আধ ঘণ্টার পর কলিং বেল বেজে উঠলো । কিন্তু রহিমা খালা তো ছাদে কাপড় শুকাতে গেছে । অপরদিকে অনেকক্ষণ ধরেই বেল বেজে যাচ্ছে, মেঘের কাজের দেরি না হয় এই জন্য মালা নিজেই ফাইল নিয়ে দরজা খুলে দিল । অফিসের লোকটি কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে সালাম দিয়ে ফাইল নিয়ে চলে গেল । অফিসে যেয়ে সে মেঘকে ফাইল দিয়ে বাহিরে যেয়ে অন্য স্টাফের সাথে মালাকে নিয়ে কথা বলছিল ।

— আরেহ করিম ভাই আপনাকে কি বলি…আমাদের বসের বউ যে এতটা সুন্দর তা ত জানতাম না ।

— তাই নাকি হাসান ভাই ।

— আরেহ হ্যা, আপনি একবার দেখলে চোখ ফেরাতে পারবেন না । হেব্বি একটা মাল , বসে কপাল ভালো বলতে পারেন ।

— তাহলে তো এই মালকে একটা বার দেখতে হয়” বলে সামনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চুপ হয়ে গেল মিঃ করিম । তার চুপ হওয়া দেখে পিছনে ফিরে মিঃ হাসান একদম ভরকে গেল । ভয়ে তার ঘাম জড়া শুরু করে দিয়েছে । তাদের এতক্ষণের সব কথা মেঘ শুনে ফেলেছে ।

— স্যার, আসলে হলো কি…..

সম্পূর্ণ কথা বলার আগেই মেঘ তাকে এক ঘুষি মেরে নিচে ফেলে দিলো । সে করিম ও হাসানকে নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে মেরে চলছেই । বাকি স্টাফরা তাকে আটকাতে পারছে না । মেঘের এই হিংস্র রূপ তারা আজ প্রথম দেখেছে ।

— স্যার প্লিজ মাফ করে দেন, এমন আর কখনো হবে না ।

— এমন হবার সুযোগ ও পাবি না । তোরা দুটোই রেস্টিক্যাট । আর কখনো এই অফিসে তোদের না দেখি , দেখলে কি করবো তা তোরা ভাবতেও পারবি না ।

— না স্যার, দয়া করে এমন করবেন না । আমাদের বউ বাচ্চা আছে , চাকরি চলে গেলে তাদের কি হবে ।

— অন্যের বউকে মাল বলার সময় নিজের বউ বাচ্চার কথা মনে ছিল না । এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে চলে যা নাহলে পরিণতি খুব খারাপ হবে ।

মেঘ সোজা অফিস থেকে বের হয়ে চলে আসলো। গন্তব্য তার বাড়ি , আজ যে মালার কপালে কি আছে তা শুধু সময় বলতে পারবে ।

কি হতে চলেছে মালার সাথে? আজও কি তাকে মেঘের হিংস্রতার শিকার হতে হবে ?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here