মেঘের পরে মেঘ-২

মেঘের পরে মেঘ-২

আজ শায়েরীর বিয়ে। কাল সারারাত ঘুমুতে পারেনি শায়েরী।মাথার বালিশটা ওর নিরব অশ্রু বিসর্জনের সাক্ষী হয়ে আছে।মনে প্রানে চাইছে এ বিয়ে টাকে মন থেকে মেনে নিতে। হাসি খুশি থাকতে।কিন্তু থেকে থেকেই মন যেন কোন সূদুরে চলে যাচ্ছে।
ওর পরনে এখনো গাঁয়ে হলুদের শাড়ী।হাতে মেহেদীর রং গাঁঢ় খয়েরী বর্ন ধারন করেছে।এক হাতে হলুদের রাখী বাঁধা। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে শায়েরী।তবে
বেশিক্ষনদেখার সময় পেলো না।ঘর ভরে গেলো খালাতো ফুপাতো বোনদের দিয়ে।

“কি রে এভাবে বসে আছিস কেনো?চল তাড়াতাড়ি? ”
বোনেদের একজন বলে উঠলো।

“কোথায় যাবো?”
বিভ্রান্তি নিয়ে প্রশ্ন করলো শায়েরী।

“কোথায় যাবি মানে কি?ফ্রেশ হবি না?”

শায়েরী ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।
“হ্যাঁ।হবো তো।”

“তো যা।বসে আছিস কেনো?তুই ফ্রেশ হলে খেয়েদেয়ে বেরুতে হবে তো।”

“কোথায় বেরুবে?”

“কোথায় বেরুবো মানে কি?পার্লারে যাবি না?”

“ওহ।”
নিজেকে সামলে নিয়ে পরক্ষনেই বললো,
“তোমরা বস।আমার বেশিক্ষন লাগবে না।এখনি আসছি।”

ওয়াশরুমে ঢুকে নিজেকে আরো একবার আয়নায় দেখলো শায়েরী।দুচোখ ভেঙে আবারো বর্ষন শুরু হলো।নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো,
“কেনো তোমাকে নিজের করে পেলাম না নাবিল ভাই?এই সাজসজ্জা, এই হাতের মেহেদী এগুলো আমি সব তোমার জন্য করতে চেয়েছিলাম।কেন বুঝলেনা আমাকে?”
___________

পার্লারের মেয়েটা নিখুঁত হাতে শায়েরীকে সাজিয়ে তুলেছে। শায়েরীর সাথে ওর খালাতো বোন পলা এসেছে।সাজ শেষ হতেই ও ছোট্ট করে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
“ও মা।তোকে কি সুন্দর লাগছে রে শায়ু!আয় একটা কালো টীঁকা লাগিয়ে দেই।যেন কারো নজর না লাগে।”

“ধুরর্।কি যে বলো না।”

“চল এবার বাইরে যাই।”

“এখন কেন? আগে গাড়িটা আসুক।”

“না চল।কাজ আছে একটু।গাড়ি আসার আগে কাজ টা শেষ করতে হবে। ”

“কি কাজ এখন আবার?”

“উফফ। তুই অনেক কথা বলিস।চল তো।”

শায়েরী বাইরে বেরিয়ে অবাক।বুকে দু হাত ভাজ করে নাবিল দাঁড়িয়ে আছে।

________

ভারী লেহেঙ্গা পরে এই ভীড়ের মধ্যে হাটতে বেশ কস্ট হচ্ছে শায়েরীর।নাবিল ওকে আগলে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে
একটু একটু করে। আর দু কদম এগিয়েই ট্রেনে উঠে পরলো দুজনেই।নাবিলের এক বন্ধু রেলওয়ের বেশ বড় অফিসার। তার বদৌলতেই এতো তাড়াতাড়ি একটা কেবিনের বন্দোবস্ত করা গেছে তাই বাঁচোয়া। নইলে এই সাজসজ্জায় শায়েরীকে নিয়ে সেকেন্ড ক্লাসের যাত্রী হয়েই সারাটা পথ পাড়ি দেওয়া একটু কস্টকরই হতো বৈকি।
নিজের ব্যাগ টা উপরে উঠিয়ে কেবিনের দরজা টা লাগিয়ে দিলো নাবিল।শায়েরী জানালার পাশে বসে আছে।চোখ মুখ জুড়ে বিষন্নতা।
শায়েরীর পাশে গিয়ে বসলো নাবিল।শায়েরী বাইরের দিকে চেয়ে। ওর পাশে যে কেউ আছে এটা যেন ও জানেই না।চোখের দৃষ্টি সূদুরে।
ওকে দু’হাতে টেনে নিজের দিকে ঘোরালো নাবিল।নিজের দু হাতে ওর হাত দুটো ধরলো শক্ত করে।

“সরি।”

শায়েরী কথা বললো না।

“কথা বলবি না?রাগ হচ্ছে? হচ্ছে তো জানি।কিন্তু কি করবো বল…
কথা শেষ করতে পারলো না নাবিল।

” কি করবেন মানে?কি করবেন মানে কি?এই যে এতোগুলো দিন আপনি সময় পেয়েছেন কই তখন তো কিছু বলেননি?কখনো তো জানতেও দেন নি আপনি আমাকে ভালোবাসেন।এমন কি আমার কথাগুলোও আপনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন।এখন যখন বিয়েতে মত দিয়েছি তখন আপনার ভালোবাসা উথলে পরলো।”
কাঁদতে লাগলো শায়েরী।

“আমি তো ভেবেছিলাম তোর অনার্স পরীক্ষার পর তোদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাবো।কিন্তু তোর বাবা মা তোকে তাড়ানোর জন্য এতো পাগল তা কে জানতো।”

“তো এ কয়েকদিন কি করেছেন?গত শুক্রবার জেনেছেন বিয়ের কথা।আর আজ এসেছেন আমাকে তুলে আনতে।আমার বাবার কাছে যেতে পারতেন না? ”

“কে বললো যাই নি?”

“গেলেন কবে?আপনি গেলে আমি বুঝি জানতাম না?”

“তোমাকে জানতে দেয়া হয় নি তাই জানোনি।”

“মানে? ”

“মানে হলো আমি সেদিন রাতেই তোর ভাইয়ার সাথে কথা বলেছিলাম।উনি বললেন তোর বিয়ের ব্যাপারে যাবতীয় সিদ্ধান্ত তোর বাবা নেবেন।তো গেলাম তোর বাবার অফিসে।নানাভাবে উনাকে বুঝাতে চেষ্টা করেছি।উনি মানেন নি।উনার এক কথা এখন না কি আর কিছুই করার নেই। সব ফাইনাল।এখান থেকে উনি নড়বেন না।আর তোকেও না কি আগেই জিজ্ঞেস করেছিল এ ব্যাপারে তুই না কি না করেছিস।তাই এই অভাগার কোন কথাই কাজ করে নি।আর তোর সাথে যোগাযোগের তো কোন রাস্তাই নেই।রাত্রী বাড়ি থাকলে এক কথা ছিলো।ও তো রাজশাহী। ”

“এর জন্য এমন করবেন?আমার বাবা মার মান-সম্মান আর থাকবে? কিছুই থাকবে না।কতো লোকে উনাদের কতো কটুকথা শোনাবে।আমাকে উনারা কোনদিন ক্ষমা করবেন না।”
বলেই আরো জোরে কাঁদতে লাগলো শায়েরী।

“তুই এভাবে কাঁদছিস কেনো? কাঁদিস না।প্রমিস করছি সব ঠিক করে দেবো।আর কাঁদিস না।প্লিজ। ”

নাবিলের কথা খুব একটা কাজ করলো বলে মনে হয় না।নাবিল নানা ভাবে ওকে মানানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলো। একসময় হার মেনে বললো,

“আমি মনে হয় ভুল বুঝেছিলাম শায়েরী।”

“কি?”
নাক টানতে টানতে জিজ্ঞেস করলো শায়েরী।

“আমি ভেবেছিলাম তুই আমাকে খুব ভালোবাসিস।কিন্তু না।ঔ লোকটাকেই বিয়ে করার জন্য তুই পাগল।তোকে আমার সাথে যেতে হবে না।চল তোকে দিয়ে আসি।”
বলেই শায়েরীর একটা হাত টান দিলো নাবিল।

শায়েরী কান্না ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। কি বলছে এই লোক?এতোদুর আসার পর বলছে চল তোকে দিয়ে আসি।এখন যাওয়া আর না যাওয়ার মধ্যে কোন তফাৎ আছে?এতোক্ষনে পাড়াসুদ্ধ ঢি ঢি পরে গেছে যে শায়েরী পার্লারে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।ওর বয়ফ্রেন্ডের হাত ধরে পালিয়েছে।

“কি হলো চল।”
নাবিল তাড়া দিলো।

“যাবো না কোথাও।”
কঠিন গলায় বললো শায়েরী।

“কেন যাবি না?আমাকে তো ভালোবাসিস না।তুই তো পাগল তোর না দেখা বরের জন্য। ”

“কে বলেছে এসব?”

“ভালোবাসিস আমাকে?”

শায়েরী উত্তর করলো না।হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগলো।
নাবিল এগিয়ে গিয়ে ওকে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো।

“আমি জানি তুই আমাকে অনেক ভালোবাসিস।আর তাই তো আমার মরা মুখ দেখবি না বলে সারা দুনিয়া কে একপাশে রেখে আমার সাথে চলে এসেছিস।এতোদিন কখনো বলিনি আজ বলছি।আমি তোকে খুব ভালোবাসি।আর তোকে খুব সুখে রাখবো দেখিস।যে স্যাক্রিফাইস তুই আমার জন্য করলি তার মূল্য আমি তোকে দেবো।”

চলবে……..

মুনিরা মেহজাবিন।

  • LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here