মেঘের পরে মেঘ-৩

মেঘের পরে মেঘ – ৩

সিলেট পৌঁছেই নাবিল শায়েরীকে নিয়ে ছুটলো কাজী অফিসে।সেখানে আগে থেকেই ওর চারজন বন্ধু উপস্থিত ছিলো। আধ ঘন্টার মধ্যে সমস্ত নিয়ম কানুন শেষ করে ওরা বেরিয়ে আসলো।
নাবিল স্থানীয় হোটেলে উঠতে চাইলে ওর বন্ধুরা রাজি হলো না।সবাই নবদম্পতি কে নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাইলো।সবশেষে সিদ্ধান্ত হলো আগামী দুদিন ওরা কবিরের বাড়িতে থাকবে।কবিরদের বাড়িটা বেশ বড় এবং নিরিবিলি। ওর মা বাবা এখন লন্ডন আছে ওর ছোট বোনের কাছে।কাজেই বাড়ি এখন আরো ফাঁকা।
মিনিট পনেরোর মধ্যে কবির সবাইকে নিয়ে নিজের বাড়িতে চলে এলো।
নাবিল শায়েরীকে একটা রুমে নিয়ে বসায়।

“তোরা একটু বস এখানে।আমি দেখি খাবারদাবারের কি ব্যবস্থা করা যায়।ফ্রেশ হয়ে নে।নয়তো শাওয়ার নিয়ে নে।ভালো লাগবে।আসছি আমি।”
বলেই কবির বের হয়ে গেলো।

শায়েরী খাটের এক কোনায় গুটিশুটি হয়ে বসে আছে। নাবিল ওর দিকে একটু সরে আসলে ও আরেকটু পিছালো যেন।নাবিল আর এগুলো না।উঠে গিয়ে নিজের ট্রলিব্যাগ টা সামনে এনে তার থেকে নিজের জামাকাপড় তোয়ালে আর হালকা গোলাপি রঙের একটা তাঁতের শাড়ি, সাথে কালো রঙের ব্লাউজ আর পেটিকোট বের করলো। শাড়ির উপর বাকি জিনিসগুলো রেখে শায়েরীর সামনে এগিয়ে দিলো।
“যা।ফ্রেশ হয়ে আয়।”

শায়েরী শাড়ি টার দিকে একবার তাকালো।পরক্ষণেই দৃষ্টি উদাস হয়ে গেলো। ধীর স্বরে বললো,

“যাচ্ছি। আপনি যান।”

নাবিল ওকে আর ঘাটালো না।তোয়ালে আর ট্রাউজার টা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।গোসল শেষ করে বেরিয়ে এসে দেখলো শায়েরী একি ভাবে বসে আছে। একহাতে চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে ওর পাশে গিয়ে বসলো।শায়েরীর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিলো।

“মন খারাপ?মন খারাপ করিস না।সব ঠিক হয়ে যাবে।”

শায়েরী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো।

“কিভাবে হবে?বাবা কখনো আমাকে মাফ করবেন না।হয়তো কখনো আমার চেহারাই দেখতে চাইবে না।”

বলতে বলতেই দুচোখে পানি চলে এলো ওর।দুহাতে অতি সযত্নে সেই পানি মুছে দিলো নাবিল।তারপর বললো,

“করবে।করতেই হবে।সন্তান যত বড় অন্যায়ই করুক বাবা মা কখনো রাগ করে থাকতে পারে না।তাকে মাফ করে দেয়।শুধু একটু সময় লাগে।”

“কত সময় লাগবে?”

“উমম।এই ধর তাদের কে নাতিনাতনির মুখ দেখাতে যতটুকু সময় দরকার ততটুকু সময় তো লাগবেই।”

শায়েরী খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলো নাবিলের দিকে।কিন্তু ওর এই কথা শুনে লজ্জায় একেবারে নুইয়ে গেলো। আর ওর এ লজ্জা পাওয়া দেখে নাবিল হেসে ফেললো। শাড়ি টা শায়েরীর হাতে দিয়ে বললো,

“যা।গোসল করে আয় ভালো লাগবে।”

শায়েরী ওর দিকে না তাকিয়ে শাড়ি টা নিয়ে ছুটলো ওয়াশরুমে।

_______

“তোমরা বিয়ে করেছো ভালো। তা আমাকে জানানোর কি আছে?”

“আপনি শায়েরীর ভাই। তাই বোনের বিয়ের খবর টা জানানোর প্রয়োজন বোধ করছিলাম যাতে ওকে নিয়ে আপনাদের চিন্তা টা একটু কম হয়।”

“তোমাকে কে বললো আমরা ওকে নিয়ে চিন্তা করছি?ও আমাদের জন্য মরে গেছে। আর যে মরে গেছে তাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।”
বলেই কল টা কেটে দিলো ফয়সাল।

“কে কল করেছে? ”

ফয়সাল ঘুরে তাকালো। বাবা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে উৎকন্ঠা।

“তোমার মেয়ের জামাই।”

“কে?নাবিল?”

“হু।”

“কি বললো? ”

“বললো ওদের বিয়ে হয়ে গেছে।ওরা ভালো আছে।”

“তুমি কি বললে?”

“আমি বললাম ওর খবরের আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।শায়েরী নামের কাউকে আমরা চিনি।ও আমাদের জন্য মরে গেছে। ”

“ভালো বলেছো।আমি যে কথা টা বলার জন্য তোমাকে ডাকতে এসেছি।”

“কি কথা বাবা?”

“চল ড্রয়িংরুমে চল। সেখানেই সবাই অপেক্ষা করছে।”

“চলুন।”

দুজনে মিলে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলো।সেখানে আগে থেকেই সবাই বসে ছিলো।সোফার এককোনে শায়েরীর মা খাদিজা বেগম বসে ছিলেন।তার চোখমুখ অস্বাভাবিক রকমের ফোলা।চোখ লাল হয়ে আছে।বোঝাই যাচ্ছে এতোক্ষন যাবত কাঁদছিলেন।
আফজাল হোসেন একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন।কিছু সময় অতিবাহিত হলো।ঘরে পিনপতন নীরবতা। আফজাল হোসেনই কথা শুরু করলেন।

“আজকের ঘটনা সমন্ধে তোমরা সবাই জানো।এবং এও জানো কি পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে আজকের দিন পাড় করেছি।যার জন্য আজকের এ অপমান জনক পরিস্থিতির তৈরী হয়েছিল আমি চাই আজকের পর থেকে তার নামও এ বাড়িতে উচ্চারিত হবে না।তার সাথে বাড়ির কারো সাথে যদি কোন রকম যোগাযোগের প্রমান পাই তবে তার সাথে আমার কোন সম্পর্ক থাকবে না।সে যেই হোক না কেনো।কাল ওর সমস্ত জিনিসপত্র পুড়িয়ে ফেলবে তোমরা।ওর কোন কিছু এ বাড়িতে থাকুক আমি চাই না।”

খাদিজা বেগম কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন।কিন্তু থেমে গেলেন।স্বামীর মেজাজ এখন একদমই ঠিক নেই।ঠিক থাকার কথাও না।পাত্রপক্ষ ওনাকে অনেক অপমান করেছে। মেয়ে লালন পালন সম্পর্কিত নানা বাজে মন্তব্য করেছে।এসব তিনি নিরবে সহ্য করে গেছেন।এমন দিন কখনো আসবে তিনি কল্পনাও করেন নি।

________
কিছু ক্ষন আগেই রাতের খাবার শেষ করেছে নাবিল ওর বন্ধুদের সাথে। শায়েরী শুয়ে আছে। ওর নাকি শরীর ভালো না।এক প্লেটে খাবার গুছিয়ে নিয়ে ওর কাছে গিয়ে বসলো।

“শায়েরী? ”

“শায়েরী? ”

“হুম।”

“খাবার এনেছি। উঠ। খেয়ে নে।”

“আমি খাবো না নাবিল ভাই।”

শায়েরীর মুখে নাবিল ভাই শুনে একটু হাসলো নাবিল।
জোর করে ওকে উঠিয়ে খাইয়ে দিলো খাবারটুকু।এরপর দরজাটা লাগিয়ে দিলো।খাটের দিকে আসতে গিয়ে দেখলো শায়েরী ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।

“কি হয়েছে? ”

শায়েরী মাথা নিচু করলো।

“বল।দরজা বন্ধ করতে দেখে এমন করলি?”

শায়েরী তবুও কোন কথা বললো না।সত্যি বলতে কি ওর কেমন যেন লাগছে। এমন অনূভুতি কখনোই হয়নি।নাবিল আর ও এক ঘরে ভাবতেই কেমন যেন লাগছে।
শায়েরী কে চুপ থাকতে দেখে নাবিল এগিয়ে আসলো।দু’হাতে ওর মুখ তুলে ধরলো।শায়েরীর চোখ পিটপিট করছে ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপছে।

“তবে কি দরজা খোলা রেখে ঘুমাবো?নবদম্পতি দরজা খোলা রেখে ঘুমায়?কত সিক্রেট টাইম আছে জানিস?”

শায়েরী কাঁপতে থাকলো।এমন করছে কেন নাবিল?হৃদস্পন্দন বন্ধই না হয়ে যায়?ভাবনাতে ছেদ পরলো।উষ্ণ ছোঁয়ায় কপাল টা ছেয়ে গেলো যেন।
শায়েরী তাকাতে পারলো না।চোখদুটো একে অপরকে আরো তীব্র ভাবে জড়িয়ে ধরলো। জোরে শ্বাস নিতে গিয়ে নাবিলের হাসির শব্দ শুনলো।

“শুয়ে পর।”

চলবে……

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here