মোনালিসা পর্ব ৩৬

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৩৬
দুই দিন এভাবে কেটে যায় প্রিয়ম কোন রকমের যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি। মোনা অনুতাপের শিখায় দগ্ধ হচ্ছে।প্রিয়ম’কে ভালোবেসে অনুশোচনা করছে। মোনার চোখ দুটি আপনাআপনি ভিজে ওঠে। খুব দীর্ঘ সময় না, মাত্র কয়েক’টা দিন কেটেছে প্রিয়মের সাথে।সেই প্রেমময় অনুভূতি গুলো ফ্যাকাশে,বিবর্ণ হয়ে বুকের মাঝে চাপা যন্ত্রনার ন্যায় বিচলন করছে। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে মোনার। বুকের ভেতর আকাশসম হাহাকার। মোনা বুঝে গেছে প্রিয়মের সাথে পথচলা কঠিন। মোনা সব ভুলে যেতে চায়।এসব নিয়ে ভাবতে চায় না,কষ্ট পেতে চায় না। কিন্তু প্রগাঢ় এক ক্লেশ আপন নিয়মে যন্ত্রনা দিচ্ছে। প্রিয়ম একবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি,তবে কি প্রিয়মের কাছে ক্ষণকালের বিভ্রম ছিলো? নিজেকে সংযত করতে না পারার গ্লানি নতুন করে নাড়া দিয়ে উঠেছে।প্রিয়ম’কে নিয়ে চিন্তা মাথা থেকে নামাতে পারছে না।‌‌‌‌ বিষাক্ত এক যন্ত্রনায় মোনা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।
মোনার শরীর, মন ভীষণ ভাবে নিস্তেজ হয়ে গেছে। একদিকে বিচিত্র রকমের চিন্তা মোনার মস্তিষ্ক প্রবরণ করে রেখেছে অন্যদিকে চরম একাকিত্বে মোনা কাহিল হয়ে পড়েছে। অবকাশ দরকার এর থেকে।নিজের মন’কে শক্ত করার চেষ্টা করছে মোনা।ছোট বেলা থেকে কষ্ট যার সহচর,সে কেন হবে ভালোবাসার কাঙ্গাল?সম্পর্কে জড়ানোর পর মোনা সব বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসেছিল।‌ আর এখন সব যেন আগের তুলনায় প্রখর হয়েছে।
নিশানের পায়ের ব্যথা কমে এসেছে, হাঁটলে একটু ব্যথা হয়।মোনা ঠিক করেছে আজ ভার্সিটি’তে যাবে। লম্বা এক সাওয়ার নেয়।ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চিত্তক্ষোভ নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তোয়ালে দিয়ে উদাস মনে চুল গুলো মুছে।এর ভিতর নিশান স্কুলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। মোনা চোখ লাল করে তাকিয়ে ধমকে ওঠে,
-“বলেছিনা পায়ের ব্যথা ভালো হলে যাবে। হাঁটাহাঁটি করলে ইনফেকশন হবে। আর একটা কথা বলবে না।”
মোনার কর্কশ গলার ধমক শুনে নিশান মাথা নিচু করে গুটিগুটি পায়ে, রং আর কাগজ নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। মোনা ভার্সিটির উদ্দেশ্য বের হয়। সকাল থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে, বৃষ্টি যেন নিস্তেজ শরীরে আকাশ থেকে ক্লান্ত ভাবে পড়ছে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে না আবার কমছেও না একবারে। মোনা বাস্টস্যান্ডে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কোন কঠিন রোগ থেকে সদ্য সেরে ওঠা রোগীর ন্যায় ক্লান্ত চেহেরা। মোনার নিষ্প্রাভ চোখ দুটি হন্য হয়ে একদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। প্রিয়মের উপর প্রচণ্ড অনীহা,অথচ অদ্ভুত এক কারণে আবার প্রিয়ম’কে খুঁজছে।শোঁ শোঁ করে বাস এসে থামে। মোনা বাসে ওঠে। মনের কোন এক কোণে অদ্ভুত এক শূন্যতা,রিক্ততা। বাস চলতে শুরু করে। মোনা জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ মোনার দৃষ্টি থমকে যায়,বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে ধ্বক করে ওঠে। আর একটু হলেই যেন হার্ট বিকল হয়ে যেত। প্রিয়ম একটা রেস্তোরাঁ থেকে বের হচ্ছিলো। মোনা শুধু এক পলক দেখেছে। মোনার তীব্র থেকে তীব্রতর যন্ত্রনা হচ্ছে। মোনা চোখ বুঁজে থাকে।
প্রিয়মের সাথে প্রেমের আগের দিন গুলোর কথা ভাবছে মোনা।প্রিয়ম বেহায়ার মত মোনার অপমান সহ্য করে যেত।আর এখন?মোনা তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনে হাসে। নিদারুন এক বিষাদ সে হাসি’তে।
বাস এসে ভার্সিটির সামনে থামে। মোনা বাস থেকে নামে। একটু দূরেই ওয়াটস আর শ্রুতি দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খাচ্ছে।ওয়াটসের সাথে শ্রুতির এত সখ্যতা, সমীর কি এ নিয়ে কিছু বলে না?মোনা ওঁদের দিকে এগিয়ে যায়। মোনা’কে দেখে ভুত দেখার মত চমকে ওঠে।শ্রুতি প্রথমে আমুদে হয়ে উঠলেও খানিক বাদে অনুযোগের সুরে বলে,
-“মোনা তুমি এমন কেন বলে তো? কোথায় ছিলে এ কয়দিন?ফোন’টা পর্যন্ত ধরো নি।”
একটু থেমে ওয়াটস এর দিকে তাকিয়ে আবার বলে,
-“আমি তো ঠিক করেছিলাম ওয়াটস,সমীর আর আমি মিলে তোমায় খুঁজতে বের হবো।”
মোনা অতীব কষ্টে করে একটু হাসলো। একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে বলল,
-“অসুস্থ ছিলাম একটু। তোমরা কেমন আছো?”
ওয়াটস বলে,
-“আমিও তাই ভেবেছিলাম তুমি হয়ত অসুস্থ । আমরা খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছিলাম। তুমি একটু নোটিশ করবে তো আমাদের।”
কিছুক্ষণ ওঁদের সাথে কথা বলে কেটে যায়। মোনা উদাসচিত্তে দুই একটা কথা বলছে আবার হঠাৎ হঠাৎ নানান ভাবনায় বিবশ হয়ে যাচ্ছে। ক্লাস শুরু হয়, মোনার তিক্ত লাগছে সবকিছু। ক্লাস শেষ হওয়ার পর মোনা চিন্তান্বিত গলায় শ্রুতি’কে জিজ্ঞেস করে,
-“আচ্ছা ওয়াটস আর তোমার ফ্রেন্ডশীপ নিয়ে সমীর কিছু বলে না?”
মোনার কথা শুনে শ্রুতির কপাল কুঞ্চিত হয়। যেন মোনা কোন অবান্তর প্রশ্ন করেছে।‌‌‌ শ্রুতি হেসে বলে,
-“কি অদ্ভুত প্রশ্ন! সমীর কি বলবে?সমীর আমার সকল কাজ কে সম্মান করে, আমাদের ফ্রেন্ডশীপকে ও। আর রিলেশনশিপের বিশ্বাস হলো মৌলিক বিষয়,যেটা আমাদের মাঝে সম্পূর্ণ আছে।তুমি হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন করলে?”
মোনা অন্য দিকে তাকিয়ে খুব সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কেবল আস্তে করে বলল,
-“এমনি জানতে ইচ্ছে হলো।”
ভার্সিটি শেষে মোনা কিছু’টা পথ শ্রুতির সাথে যায়।শ্রুতির বাসা ভার্সিটির কাছেই। এরপরে মোনা একা একা হাঁটছে। গুড়িগুড়ি ফোঁটায় বৃষ্টি অবিরাম পড়ে চলেছে। মোনা আকাশের দিকে তাকায়, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।মোনার মনের মত বিষণ্ণতায় ছেয়ে আছে অম্বর। হঠাৎ পিছন থেকে কেউ এসে মোনার হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়। মোনা প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠে ত্রাসিত চোখে তাকায়। প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়মের চুল গুলো বৃষ্টিতে ভিজে চোখ অবধি লেপ্টে আছে, চুল থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পানি পড়ছে নাক-মুখে। চোখ গুলো ঘোলাটে দেখাচ্ছে, উদ্ভ্রান্তের মত চাহনি। মোনা কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল প্রিয়মের দিকে। খুব শীতল গলায় বলল,
-“আপনি!”
-“হ্যাঁ আমি। দুই দিনে একবারও আমার খোঁজ নেওয়া যায় নি মোনা?”
মোনা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল,
-“বলেছি না আমার সামনে আসবেন না কখনো। অসহ্য লাগে আমার।”
মোনা ঠান্ডা গলায় বলছে কথা গুলো কিন্তু ভিতরে প্রচণ্ড আক্রোশ। মোনা একটু থেমে আবার বলল,
-“পৃথিবী’তে না আমি আপনার জন্য সৃষ্টি হয়েছি,না আপনি আপনি আমার জন্য। আমরা দুইজন দুই মেরুর মানুষ, আমাদের পথ ভিন্ন ভিন্ন। এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। অনুরোধ আপনার কাছে, কখনো আমার সামনে আসবেন না।”
মোনা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টি ক্রমশ বাড়ছে।প্রিয়ম কাতর গলায় বলল,
-“আসলে কি হয়েছে জানো মোনা?তুমি আমায় নিয়ে দ্বিধান্বিত। তাই যে কোন বিষয়ে সর্বপ্রথম আমায় ছেড়ে যাওয়ার কথা মনে আসে তোমার,তোমার মনে হয় তুমি ভুল করেছো আমার সাথে সম্পর্ক জড়িয়ে।তুমি আমায় নিয়ে সন্দিহান। হ্যাঁ আমি ওইদিন অন্যায় কিছু কথা বলেছি,উচিত হয়নি আমার ওসব বলা। আমার রাগ হয়েছিল,আর রেগে গেলে আমি জ্ঞানশূন্য হয়ে যাই।ভুল করেছি বলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে, শুধরে নেওয়ার সুযোগ দিবে না? আসলে আমার ছেড়ে চলে যাওয়ার চিন্তা তোমার অস্থিমজ্জায় গেঁথে আছে। তুমি সব সময় ভাবো—”
মোনা চাপা গলায় চিৎকার করে উঠল। চোখ মুখ ইস্পাতের মত কঠিন।প্রিয়মের কথাটা অসমাপ্তই থেকে গেলো। মোনা শক্ত গলায় বলল,
-“আমার যেতে হবে।আমি সব ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনার কথায় আমার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।”
প্রিয়মের চোখে মুখে অসহায় ভাব ফুটে উঠলো। অস্থির গলায় বলল,
-“মোনা, আমি জ্যাক কিংবা তোমাদের বন্ধুত্বের বিষয়ে কিছু বলব না। একবার সুযোগ দেও।আমি কত প্রেম করেছি, ওঁরা আমার চোখের সামনে অন্য মানুষ’কে চুমু খেলেও আমি ঈর্ষান্বিত হইনি। অন্য পুরুষের সাথে রাত কাটালেও আমি ডেকে জিজ্ঞেস করিনি। তোমার বেলায় অন্য আমি হয়ে যাচ্ছি মোনা।”
এর ভিতর ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। প্রিয়ম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাকভেজা হচ্ছে। প্রচণ্ডবেগে উত্তল বৃষ্টি, সাথে দমকা বাতাস। মোনার হাতের ছাতা’টা এত বাতাসে নড়বড়ে হয় যাচ্ছে। মোনাও প্রায় অর্ধেক ভিজে গেছে। প্রিয়ম মোনার উত্তরের অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে। মোনা’কে নিরুত্তর দেখে প্রিয়ম আবার অধৈর্য হয়ে বলল,
-“একবার তো সুযোগ দিবে মোনা?আমি জ্যাক’কে স্যরি বলব প্রয়োজন বোধে। মোনা আমি থাকতে পারছি না তোমায় ছাড়া, আমার প্রচণ্ড যন্ত্রনা হয়।”
মোনা প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“নিশান ঝড় বৃষ্টি ভয় পায়। বাসায় যেতে হবে আমার।”
মোনা হাঁটতে উদ্যত হলে প্রিয়ম পথ রুখে দাঁড়ায়। বৃষ্টির বেগ ক্রমে ক্রমে বেড়েই চলেছে। সেই সাথে বেড়ে চলেছে মোনা’কে হারানোর শঙ্কায় প্রিয়মের অসহায়ত্ব। প্রিয়ম নির্বাক দৃষ্টিতে তাকায়। উপায়হীন হয়ে নিস্তেজ গলায় বলল,
-“একটা বার সুযোগ দিবে না তুমি? ভবিষ্যতে যদি তুমি আমায় ছেড়ে যাওয়ার মত কারণ পাও তাহলে ছেড়ে যেয়ো।আমি তোমার কল্পনার মানুষ’টা হবো।তোমায় সাপোর্ট দিবো,সম্মান করব,তোমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব দিবো, তোমায় স্বাধীনতা দিবো।”
প্রিয়মের কথায় মোনার অন্তরতম প্রদেশে ঝড় বৃষ্টির মত তাণ্ডব শুরু হয়। গত দুই দিনের যন্ত্রনা কিংবা সিদ্ধান্তের কথা ভেবে মোনা বিমুখ হয়ে পড়ে। অনিচ্ছাকৃত ভাবেও মোনার নেওয়া শক্ত সিদ্ধান্ত গুলো অচিরেই যেন ধুয়ে মুছে গেলো। মোনা আবার দুর্বল হয়ে পড়ে। মোনা কোন উত্তর দেয় না। প্রিয়ম পথ ছেড়ে দেয়,মোনা হাঁটতে থাকে। উত্তাল ঝড়, বৃষ্টি’তে ভিজে গেছে পুরো।অকারণেই মাথার উপর ছাতা’টা। প্রিয়ম মোনার পিছু পিছু হাঁটছে। মোনা প্রিয়মের দিকে তাকাচ্ছে না।প্রিয়মের দিকে তাকালে’ই মোনা মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ে যেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।
-“মোনা কিছু বলো প্লীজ।আমি তো বলছি জ্যাক’কে আমি স্যরি বলব। জ্যাকের বিষয়ে কিছু বলবো না। এক বার সুযোগ চেয়েছি শুধু।”
প্রিয়মের কথা গুলো মোনার কানে বিদ্ধ হয়। এই স্বর,এই মুখ,এই চাহনি মোনার প্রথম প্রেমানুভূতির কারণ,প্রথম ভালোবাসা। এ উপেক্ষা করা যে কঠিনতর কাজ। প্রথম স্পর্শনুভূতি,প্রথম চুমু মোনার চোখের সামনে পর্দার মত ভাসছে।মোনা তাকাচ্ছে না প্রিয়মের দিকে,কোন কথার উত্তর দিচ্ছে না। ভার্সিটি থেকে মোনার বাসা বেশ দূরে, এত দূরের পথ কিভাবে পেরিয়ে এসেছে?কত সময়ে পেরিয়ে এসেছে মোনার খেয়াল নেই। মোনা বাসার ভিতরে ঢুকে যায়। প্রিয়ম বৃষ্টির ভিতর বাসার গেটের সামনে দাঁড়ি থাকে। মোনা নেশাগ্রস্ত মানুষের মত রুমে ঢুকে। জানালার ফাঁক দিয়ে অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকে প্রিয়মের দিকে। তারপর মোনা ভেজা কাপড় বদলে নেয়। প্রিয়ম তখনো বাসার সামনে দাঁড়ানো। মোনা জানালা বন্ধ করে বসে থাকে।প্রিয়ম কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো মোনা জানে না।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here