লুকোচুরি,পর্ব:১১

“লুকোচুরি”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
“শীঘ্রই চলো। সংসার করতে হলে পালাতে হবে। নয়তো তোমার আমার সংসার এই দুনিয়ায় সাজবে না। আমরা আলাদা বাসা নিয়ে সংসার করবো।”
“আশ্চর্য! সংসার করার জন্য পালিয়ে যাবো!”
“যেতে হবে। চলো তো।”
“এই, না। আমি যাবো না।”
ইভান হাত টেনে দু’কদম এগিয়ে নিয়ে বললো,
“আসতে বলেছি না! এসো।”
“পাগল হয়ে গেছো তুমি! ছাড়ো, আমি যাবো না।”
রিজোয়ানার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তা দেখে ইভান হাত টান রেখেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“ঝটপট এসেছো, চটপটি খাবে না? আচ্ছা, বাসায় চলে যাচ্ছি তাহলে। টাকাটা বেঁচে গেলো!”
কথার সাথে সাথে ইভান হাত ছেড়ে দিলো। তার অভিনয় বুঝতে পেরে রিজোয়ানা ক্ষেপে গিয়ে তার হাতে জোরেসোরে ঘুষি মেরে বসলো।
“ফাজিল! জানতাম আমি, মিথ্যে বলছো! এখন চটপটি খেতে যাবো কিভাবে! এতোক্ষণ বাইরে থাকলে মা আবার বকাঝকা শুরু করবে।”
শিহান বলল,
“আরে, দোকান তো কাছেই। বেশিক্ষণ লাগবে না। গপাগপ গিলে নিবে। চলো তো এবার। অনেক্ক্ষণ ধরে অপেক্ষা করাচ্ছে ভাইয়া। সেই কখন থেকে মনটা চটপটি চটপটি করছে!”
ইভান বললো,
“কিসের চটপটি! মা পাতিল ভরে ভাত রান্না করে রাখছে। ভাত খা গিয়ে, যা!”
রিজোয়ানা দুহাতে তার এক হাত পাকড়ে ধরে বললো,
“ভাত তুমি খেয়ো গিয়ে। আগে আমাদের চটপটি খাওয়াবা। আমাকে ডেকে এনে এখন পালানো হচ্ছে?”
“ডেকেছি? কখন ডাকলাম! মনে করো তুমি ঘুমিয়ে ছিলে এতোক্ষণ। আর যা ঘটেছে, তা স্বপ্ন ছিলো। এখন তোমার ঘুম ভেঙে গেছে। তুমি আবার নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করবে।”
রিজোয়ানা তাকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আমার ঘুম এখনো ভাঙেনি। আগে চটপটি খাবো, তারপর ঘুম ভাঙবে।”
“কেন খাওয়াবো, হ্যাঁ? তুমি তো পালাতে রাজি হলে না!”
“রাজি হইনি যে, সেজন্যই খাওয়াবে।”
শিহান তার ফ্রেন্ডের সাথে ফোনে কথা বলতে বলতে তাদের আগেই হাটছে। ইভান এবার স্বাভাবিকভাবে হাটতে হাটতে রিজোয়ানার পেছনে হাত রাখলে সে সরিয়ে দিলো। কিন্তু দুরত্ব বজায় রেখে হাটতে রাজি না ইভান। তাই সে হাত মুঠোয় নিয়ে তারপরই পথ চলেছে। চটপটি খেয়ে আর বেশিক্ষণ দেরি করেনি রিজোয়ানা। নয়তো এদিকে আবার মায়ের ক্লাস নেওয়া শুরু হয়ে যাবে! ইভান ইচ্ছে করে তাকে আরও লেট করানোর চেষ্টা করছিলো। কিন্তু সেখানে রিজোয়ানার প্রচেষ্টা সফল।
এমনিতে খাওয়াদাওয়া সব ডাইনিং টেবিলে হলেও ইফতারটা তাদের ড্রয়িংরুমের ফ্লোরে কিংবা বাবামায়ের রুমের খাটে আয়েশ করে বসে করা হয়। দ্বাদশ রমজানে আবহাওয়ায় গরমটা বেশি পড়ায় মায়ের কাজ সব এগিয়ে দিয়ে ইফতার তৈরির ফাঁকে রিজোয়ানা ড্রয়িংরুমের ফ্লোর মুছে দিলো। গরমের দিনে ঠান্ডা ফ্লোরে পা ফেলতেও বেশ আরাম বোধ হয়। তাই রিজোয়ানা ধেই ধেই করে হেটেই যাচ্ছে। মাগরিবের আজানের দশ মিনিট আগে কিচেন থেকে একে একে সবকিছু এনে গুছিয়ে রাখছে ফ্লোরে। বাবা ওযু করে আসছে, লিসান রুমে আছে। কিছুক্ষণ আগেই মাত্র ফিরেছে, ফ্রেশ হচ্ছে হয়তো৷ এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। রিজোয়ানা জগে পানি নিচ্ছিলো তাই লুবনা এসে দরজা খুলে দেখলো ইভান ও শিহান! ইভান হাসিমুখে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম, ফুপি। কেমন আছো?”
কতদিন পর এই ছেলেটা প্রত্যক্ষ কথা বললো তার সাথে। তাছাড়া তাদের উপস্থিতিতে লুবনা অবাক হয়েই বললো,
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই। তোরা কেমন আছিস?”
শিহান জবাব দিলো,
“ভালো আছি বলেই তো হুটহাট ফুপির বাড়ি ইফতার করতে চলে এলাম।”
লুবনা হেসে বললেন,
“ভালো করেছিস। অনেক খুশি হয়েছি। আয়, ভেতরে আয়। অয়ন নিয়নকে নিয়ে এলি না?”
“ধুর, বাদ দাও। অন্যদিন পাঠিয়ে দিবো।”
রিজোয়ানা কিচেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে! ইভান এভাবে এসে সারপ্রাইজ দিবে ভাবতেই পারেনি! ইভান তাকে দেখে মুচকি হেসে ব্রু নাচালো। রিজোয়ানা লজ্জা পেয়ে হাসি চাপা রেখে পানির জগ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বললো,
“শিহান, কেমন আছো?”
“এইতো ভালো আছি, ভাবি।”
সবসময় আপু, আর এখন তাকে ভাবি ডাকায় রিজোয়ানা চোখ পাকালো। শিহান হেসে লুবনার হাতে তাদের নিয়ে আসা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো। লুবনা বললো,
“এগুলো কেন নিয়ে এসেছিস! রোজার দিনে ইফতার তো বাসায়ই বানানো হয়েছে। বোকা কোথাকার!”
ওদিকে শিহান জবাব দিচ্ছে, এদিকে ইভান রিজোয়ানাকে বলছে,
“ভালো আছো রিজোয়ানা?”
এমনিতে সবসময় রিজু, আর আজ রিজোয়ানা! শ্বশুরবাড়ি পদার্পণ করে কতো নম্রতা কতো পরিবর্তন! মুখভঙ্গি এমন যেন কতোদিন পর আজ দেখা হলো। লুবনা মুখ চেপে অস্পষ্টভাবে হাসলো। রিজোয়ানাও মুখ টিপে হেসে জবাব দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
সে আর পাল্টা কোনো প্রশ্ন করলো না। মায়ের সামনে ইভানের করা অভিনয়েই লজ্জিত, তাই নিজে অভিনয় করে লজ্জা ভারী করলো না। মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“মা, খাবার কি টেবিলে তুলবো?”
লুবনা হ্যাঁ বললেও শিহান নিষেধ করে সাথে সাথে নিচেই বসে পড়লো। ইভানও নিষেধ করেছে তবে সাথে সাথে বসে যায়নি ফ্লোরে। বরং দাঁড়িয়ে থেকে শিহানকে সতর্ক করে দিলো,
“হুট করে তো বসে পড়লি, টুপ করে আবার গিলে ফেলিস না। আযান কিন্তু দেয়নি এখনো।”
রিজোয়ানার বাবা এলো, তারা সালাম দিলো। লিসান এলো, শিহান কথা বললেও ইভান কিছু বলেনি। লিসানও স্বেচ্ছায় কিছু বলেনি। আযান পড়লে ইফতার করতে করতেও তাদের মধ্যে গল্পসল্প চললো। খুবই ভালো কেটেছে সময়, পুরোনো কোনো কথাবার্তা উঠে আসেনি তাদের এই সুন্দর মুহুর্তে। যেন পরিস্থিতি সবটাই স্বাভাবিক, কোনো ঝগড়া বিবেধ কিছুই হয়নি কখনো! ইফতার শেষে তারা বেরিয়ে এলো নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে। লুবনা কতোবার বললো দুজনকে রাতের খাবার যেন এখানে খায়। তারা অন্য একদিনের কথা বললো, আজ কোনোমতেই রাজি হলো না।
এখান থেকে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আবার ফোনে কথা হলো রিজোয়ানার সাথে।
“দেখা হলে সালাম পর্যন্ত দেই না, কথা তো দূরেই থাক, ছায়া দেখলেই পালিয়ে যাই, আরও কি কি যেন বলছিলে? এবার কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, হুম? একেবারে বাড়িতে গিয়ে শ্বশুর শ্বাশুড়ির সাথে সাক্ষাৎ করে এলাম।”
“ইশ! কি সারপ্রাইজ! আর কি বীর পুরুষ! ভয়ে ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে এসেছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য, বুঝিনি মনে করেছো?”
“তুমি তো সবসময় একটু বেশিই বুঝো।”
“বেশি না, ঠিকই বুঝি। এসব চাপা ছেড়ে লাভ নেই, বুঝেছো? আবার কি অভিনয়, যেন শ্বাশুড়ি জানে না উনি যে লুকিয়ে লুকিয়ে পীরিতি জমিয়ে ক্ষীর! ইশ! কি ঢং! ভালো আছো রিজোয়ানা…?”
তার ভেঙানোতে ইভান হাসলো। রিজোয়ানা বললো,
“কোথায় এখন?”
“বেশি খেয়ে ফেলেছি তো, রাস্তায় হাটছি।”
“আসবে আবার? রাতে খাওয়াদাওয়া করে যাও…”
“বুক চিনচিন করছে হায়, মন তোমায় কাছে চায়। মনটা খুব কাছে চাইছে নাকি আমাকে, আবার আহ্বান জানাচ্ছো যে?”
“স্টুপিড! খাওয়ার জন্য বলেছিলাম। থাকতে বলিনি।”
“খাওয়ার পর যে আবার বলবে না, থেকে যাও…! তার গ্যারান্টি কি?”
“অই, আসা লাগবে না তোমার।”
“হা হা হা, আসবোও না। আজ বাসায় ইফতার করিনি, সেটা নিয়েই পেরেশানিতে আছি মা কি না কি বলবে! আবার রাতের খাবার!”
“ভীতুর ডিম!”
“শিক্ষাজীবনের প্রতিটি ক্লাসেই ছিলো এক পিস মিম!”
“হি হি হি! মামী জিজ্ঞেস করলে কি বলবে? হুম?”
“জিজ্ঞেস করবে না মনেহয়। আর যদি করেও তাহলে সত্যিটা বলে দিবো।”
“তাহলে নিশ্চিত, গণ্ডগোল বেঁধে যাবে।”
“বাঁধলে বাঁধুক, অযথা মিথ্যার আশ্রয় কেন নিবো? লুকোচুরি আর কতদিন?”
“বলিনি তো আমি মিথ্যে বলতে। আচ্ছা, বাসায় যাও। অফিস থেকে ফিরে বাসায়ও তো যাওনি। পোশাক চেঞ্জ করে বিশ্রাম নাও গিয়ে।”
“হুম, ভবিষ্যতে যে তুমি আমাকে বড্ড জ্বালাবে তা বুঝতেই পারছি।”
“মানে?”
“যারা প্রেম জীবনে বেশি কেয়ার করে, তারা সংসার জীবনে বেশি জ্বালাতন করে। এখন বলছো বিশ্রাম নাও, তখন বলবে বিশ্রামের গুল্লি মারি!”
“ও আচ্ছা! তো জানোই যখন আগে থেকেই সাবধান হয়ে যাও।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here