শাওয়াম পর্ব -০২

#শাওয়াম
পর্ব ২
Suvhan Arag (ছদ্মনাম)

সাদাফের কথা শুনে শাওয়ামের গায়ে কাটা দিতে উঠলো।শাওয়ামের ভয়ার্ত চাহনি দেখে সাদাফ আরেক দফা হুংকার দিয়ে উঠলো,

‘বল সাইন করবি কিনা?না হলে তোকে রেপ করে তবেই ছাড়ব।’

শাওয়াম কেঁপে উঠলো।চোখের পানি ছেড়ে দিল।মিনতির সুরে বললো,

‘আমাকে ছেড়ে দিন সাদাফ ভাই।আমি আপনার বোনের মতো?’

‘বোন তো না!’

শাওয়ামের চোখ দুটো পানিতে ভরে উঠলো।চাচাতো বোনেরা সব সময় তাকে বলদ,বোকা উপাধি দিয়ে এসেছে।আজ সেই বোকামির দন্ড হারে হারে টের পাচ্ছে সে।শাওয়াম যতোই নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সাদাফ ততই নিকটে যাচ্ছে।সইতে না পেরে শাওয়াম মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেল।কি এমন ব্যাপার!একটা তো সাইন।সাইন করে দিলে যদি সে বাঁচে ক্ষতি কি?

টিভিতে,পত্রিকায় রেপ শব্দটাকে ঘিরে অনেক খবর ছাপা হতে দেখেছে সে।এই জিনিসটা যে কি আদৌ তার পুরোপুরি বোধগম্য নয়।মায়ের থেকে একবার শুনেছিল খুব খারাপ জিনিস।মেয়েদের সম্মান নষ্ট করে দেওয়া হয়।না পরিবার না মেয়েটি কখনো মাথা তুলে চলতে পারেনা।কেউ কেউ তো আত্নকে বলিদান দিতে দ্বিধা বোধ করেনা।মা তাকে সংক্ষেপে একটা শব্দ দিয়েই বুঝিয়েছিল,সর্বনাশ!মহা সর্বনাশ!এক বান্ধবীর থেকে যা একটু খোলসা করে শুনেছিল সেটাও গায়ে কাটা দেওয়ার মতোন।পুরো কথাগুলো শোনার মতো শক্তি হয়নি তার।তার আগেই ঘেমে একাকার হয়ে ভয়ে দৌড়ে চলে এসেছিল।

নিজেকে বাঁচাতেই হবে!শাওয়াম মিনতির সুরে বললো,

‘সাইন করব সাদাফ ভাই।আপনি কি তবে আমাকে ছেড়ে দেবেন?’

শাওয়ামের কথা শুনে সাদাফ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল।মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব হচ্ছে তার।একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে বললো,

‘ছেড়ে দেব তো।তুমি তো আমার বোনের মতো তাই না?’

শাওয়াম সাদাফের কথায় মাথা নাড়লো।উওর হ্যা।সাদাফ শাওয়ামকে ছেড়ে দিয়ে এক কদম পিছিয়ে এসে দাঁড়ালো।মাটি থেকে কাগজ আর কলম তুলে নিয়ে হাত দিয়ে ঝেড়ে কাগজে লেগে থাকা ধুলো পরিষ্কার করে নিল।শাওয়ামের দিকে এগিয়ে বললো,

‘নেও সাইন করে দেও তো।অনেক বেলা হয়েছে।তোমার মা বাবা চলে আসবে তো।তুমি সাইন করে বাড়ি যাও।আমিও আমার বাড়ি যাব।আমার মা আবার আমার জন্য দেশী মুরগির ঝোল সাথে ছিচ রুটি বানিয়েছে।খিদেই পেটের ভেতর ছুচো চো চো করছে।আরে তাকিয়ে দেখছো কি?নেও।নইলে কিন্তু ,,,’

সাদাফের কথা অসমাপ্ত রয়ে গেল।শাওয়াম ছো মেরে সাদাফের থেকে কাগজ কলম নিয়ে কাগজের নিচে নিজের নাম লিখে সাক্ষর করে দিল।সাদাফের দিকে নজর যেতেই টের পেলো সাদাফ কাগজের দিকেই চেয়ে আছে।তার দিকে অতো খেয়াল করেনি।এই সুযোগ।শাওয়াম কাগজ কলম হাত থেকে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দৌড় দিল।এক দৌড়ে অনেক দূরে চলে গেল।আকস্মিক ঘটনায় সাদাফ কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেল।এত দ্রুত সবকিছু ঘটে গেল!তবে মাটির ওপর পড়ে থাকা কাগজে শাওয়ামের সাইন থেকে মুখে রহস্যময়ী হাসি ফুটে উঠলো।আর কি চাই?আপাতত শাওয়াম থাকা না থাকাতে তার কিছু যায় আসেনা।তার কাজ হাসিল হয়ে গেছে।

নিচু হয়ে বসে সাদাফ কাগজটা তুলে হাতে নিল।কলমের দিকে ভ্রূক্ষেপ করলো না।জাহান্নামে যাক কলম!এরকম ভাবনা তার।কাগজটাই এখন তার যক্ষের ধন!কি চলছে সাদাফের মনে?একমাত্র সেই জানে।যাই চলুক সেটা নিশ্চয়ই শাওয়ামের জন্য বিপদ সংকেত।মুখে পৈশাচিক হাসি রেখে একা একাই বলতে লাগলো সাদাফ,

‘রিজেক্ট!রিজেক্ট করছিলি তো!শুধু অপেক্ষা কর শাওয়াম।’

বাড়ি ফিরে সব দরজা বন্ধ করে ঘরের কোনে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে শাওয়াম।ভয়ে হাত পা থরথর করে কাঁপছে তার।বুক ধরফর করছে।চুপচাপ চোখের পানি ফেলছে।মা বাবার আসার অপেক্ষা।ঘড়ির দিকে বার বার চোখ বুলাচ্ছে শাওয়াম।সময় যেন আজ কচ্ছপ হয়ে গেছে।এগুনোর নাম নিচ্ছে না।এদিকে শাওমের মনের অজানা আশংকা।তারই ভুল ছিল ইটের এর বদলে পাটকেল মারার সাহস করা।

সেবার পিএসসি পরীক্ষার আগে সানিয়ার সাথে বেশ বড়সড় ঝগড়া লেগেছিল শাওয়ামের।সানিয়া মেয়েটা কুটনি স্বভাবের,তেমনি খারাপ।ভাইয়ের চেয়ে কোন অংশে কম না।ঐ ঝামেলার জন্য সানিয়ার মা বাবা সাদাফ সবাই মিশে শাওয়ামদের বাড়ি ফোন করে হুমকি দিয়েছিল।স্কুলে যাওয়া আসাটাই অতিষ্ঠকর হয়ে গেছিল তার।এরপর সে বছর ২৮ ডিসেম্বর শাওয়ামের পিএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলো।খুলনা বিভাগে প্রথম হলো সে।এই খবর শুনে সানিয়ার পরিবারের ওপর ঈর্ষার ঝড় বয়ে গিয়েছিল।সেদিন শাওয়ামের মনে অদ্ভুত চিন্তা এসেছিল।সাদাফ কম ডিস্টার্ব করেনি তাকে।মা বাবার ফোন ছাড়া তার মা আরেকটা ফোন ব্যবহার করতো।মূলত শাওয়ামের জন্য।সারাদিন বাড়িতে একা থাকে।আবার শাওয়ামের গান শোনার তীব্র নেশা।দ্বিতীয় ফোনটা বাড়িতেই থাকতো।এর আগে সানিয়ার পরিবার যে নাম্বার দিয়ে কল করেছিল মূলত সাদাফের নাম্বার সেটা নিয়ে নিজের কাছের ঐ ফোন থেকে মেসেজ পাঠাতে শুরু করলো।যেমন-২৩৪৫৭৭।উল্টা পাল্টা সংখ্যা।৩০ ডিসেম্বর পত্রিকায় শাওয়ামের ছবি প্রকাশ হলো।পাড়ার মিষ্টির রোল পড়ে গেছে।মেয়ের ফলাফলে খুশি হয়ে শাওয়ামের মা বাবা পুরো এলাকায় মিষ্টি ছড়িয়েছে।ঐদিকে সানিয়ার পরিবার তাদের মেয়ের ফলাফলে মুখ অন্ধকার করে ঘুরে বেড়িয়েছে।ঐ দিন ও শাওয়াম সাদাফের ফোনে সেই একই ধরনের মেসেজ করে।সাদাফের রিপলাই আসে-কে আপনি?শাওয়াম ও উওর লিখে দিল-যম!এই ছিল।মায়ের ফোনে কম বিশ্রী মেসেজ পায়নি সে সাদাফের থেকে।এক প্রকার প্রতিশোধ নিল যেন।মনে অদ্ভুত আনন্দ।দেখ জ্বালানোর মজা।ব্যস সেই থেকে শুরু।খুব কমই সে মেসেজ পাঠাতে সাদাফকে।কিন্তু সাদাফ কিভাবে জানলো এসব?প্রশ্নের উওর খুঁজে পায়না সে।

টুং টাং শব্দে কলিংবেলের আওয়াজ।চমকে উঠলো শাওয়াম।ঘড়ির দিকে তাকালো।দুটো বেজে সতেরো মিনিট।মা চলে এসেছে!ভাবতেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো তার।চোখ জোড়া মুছে শাওয়াম উঠে দাঁড়ালো।বেসিনের কাছে গিয়ে চোখ মুখ ভালো করে ধুয়ে নিল।কান্নার কারণে চোখের কার্নিশ লাল বর্ণ ধারণ করেছে।ফর্সা মানুষদের এই এক জ্বালা।একটু হেচকি তুলতেই চোখ মুখ টমেটো হয়ে যায়।হাতে মুখে পানি দিয়ে চাবি হাতে শাওয়াম পা বাড়ালো সিড়িঘরের দিকে।

তহমিনা বেগম কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে গেটের সামনে দাড়িয়ে আছেন।দু বারের বেশি কলিংবেলের সুইচ চেপে ধরেছেন।সিড়িঘরের আবছা আলোয় এখনো মেয়ের ছায়া দেখতে পাননি।চিন্তায় কপালে ভাঁজ ফুটে উঠলো।এতো তো দেরী করেনা?বরং আগেই চাবি নিয়ে গেটের কাছে দাড়িয়ে থাকে।তহমিনা বেগমের ভাবনার মাঝে সিঁড়ি বেয়ে গড়গড় করে নেমে এলো শাওয়াম।মেয়েকে দেখে মুচকি হাসি দিলেন তহমিনা।শাওয়াম স্বচ্ছ হাসি দিয়ে গেট খুললো।তহমিনা প্রবেশ করতেই গেট বন্ধ করে আবার তালা ঝুলিয়ে দিল।মায়ের হাত ধরে ওপরে চলে গেল।

ড্রয়িং রুমে বসে ফ্যান চালিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছেন তহমিনা।শাওয়াম ছুটে এসে মায়ের পাশে বসে কোলে মাথা রাখলো।একটু চমকে গেলেন তহমিনা।মেয়ের মন খারাপ কি শরীর খারাপ না থাকলে কখনো সে এমন আচরণ করেনা। শাওয়ামের খোলা চুলগুলোতে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞাসা করলেন,

‘কি হয়েছে মা?শরীর খারাপ?’

‘না মা।’

‘তাহলে?’

‘ভালো লাগছে না।’

‘কেন?’

‘জানিনা।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেওনা।’

‘দিচ্ছি তো।’

‘থেমে যাচ্ছো যে আবার।’

‘আচ্ছা আর থামব না।’

তহমিনা পরম আদরের সাথে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।কপালে চুম্বন করছেন।শাওয়ামের খুব মাকে বলতে ইচ্ছে করছে সব কথা।কিন্তু যদি মারে!এই ভয়ে চুপসে যাচ্ছে সে।আগামী কাল শুক্রবার।সে স্কুলে যাবে না।কিন্তু পরের দিন!সে কিভাবে আবার ঐ লম্পট সাদাফের মুখোমুখি হবে!সাদাফের কথা না হয় বাদ।সানিয়া!সাক্ষাৎ ডাইনি মনে হয় তার মেয়েটাকে।ঐ মেয়েটার জ্বালায় ক্লাসে সবার সাথে কথাও বলেনা শাওয়াম।সবার চোখে তাকে খারাপ বানিয়ে রেখেছে ঐ ডাইনি।মনে মনে একটা বুদ্ধি এটে ফেললো শাওয়াম।আবদারের সুরে মাকে বললো,

‘মা,এক সপ্তাহ ছুটি নেওনা।আমার একা থাকতে ভালো লাগেনা।চলো না কোথাও বেড়াতে যাই?’

‘খালি স্কুল ফাঁকি দেওয়ার ধান্দা।’

‘না মা।সত্যি।ভালো লাগে না আমার।’

শাওয়াম উঠে বসলো।মুখ গোমড়া করে মায়ের থেকে দূরে গিয়ে বসলো।শাওয়ামের কান্ড দেখে হাসলেন তহমিনা।কিছুক্ষণ ভেবে পরে বললেন,

‘ঠিকাছে ঠিকাছে।নিয়ে যাব।সারাদিন পর এসেছি।কই মায়ের খাতির যত্ন করবে তা নয়।মুখ গোমড়া করে আছেন উনি।’

মায়ের কথা শুনে খুশিতে শাওয়ামের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো।আনন্দে ফেটে পড়লো সে।উচ্ছাস নিয়ে বললো,

‘সত্যি!’

তহমিনা হেসে মাথা নাড়িয়ে উওর দিলেন,

‘হুম সত্যি।’

আনন্দে আত্নহারা শাওয়াম।কিন্তু সে আদৌ জানেনা ভবিষ্যত তার জন্য কি সাজিয়ে রেখেছে।

চলবে————-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here