শুচিস্মিতা পর্ব -১২

#শুচিস্মিতা -১২
Tahrim Muntahana

~ ছোট চাচি, আমি!

গলা কাঁপছে আনতারা’র। এত রাতে গেইটের বাইরে দেখলে ছোট চাচি সন্দেহ করবে না তো? ধরা পড়ার ভয়ে নয়নযুগলে জলেরা হানা দিতে চাইলেও পলক ফেলে বাঁধা দেয় সে। মিসেস কামরুন্নাহার কিছুক্ষণ আনতারা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এসেছিল স্বামীর জন্য, আজ একটু বেশীই দেরী হচ্ছিল বলে চিন্তায় হাঁসফাঁস লাগছিল তার, তাই বাগান সাইড এসেছিলো হাঁটতে। এসেই কারো ফিসফিস কন্ঠ শুনে সন্দেহ হয় বিদেয় চেঁচিয়ে উঠেন তিনি। কিন্তু এত রাতে আনতারা’কে বাড়ির বাইরে দেখবেন সেটা হয়তো ভাবতে পারেননি। তা চোখে মুখেই প্রকাশ পাচ্ছে। আনতারা মাথা নিচু করে নেয়। বাঁচার জন্য বলে উঠে,

~ ভালো লাগছিলো না ছোটচাচি, বাগানে এসেছিলাম। ওইপাশে কে যেন কথা বলছিলো, তাই দেখার জন্য বের হয়েছি ওমনি দেখি তুমি!

মিসেস কামরুন্নাহার হাসলেন। হাসিটা ঠিক কি রকম আনতারা বুঝতে পারলো না। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

~ চলো ঘরে চলো?

ছোট ছোট পা ফেলে বাড়ির ভেতর আসলো আনতারা। বার বার পেছনে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছে হলেও সাধ্য র‌ইলো না। ছোট চাচি তার পেছনেই হাঁটছেন। নিজের ঘরে এসে একটু স্বস্তিতে বসলো তখনি মিসেস কামরুন্নাহার অপ্রসন্ন কন্ঠে বললেন,

~ এরকম বয়স আমিও পেরিয়ে এসেছি আনতারা! তোমার এমন অধঃপতন হলো যে আমাকে মিথ্যে বলছো!

আতকে উঠলো আনতারা, এবার আর চোখের জল বাঁধ মানলো না, নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়লো নিজ নিয়মে। কিছু বলতে চাইলেও গলা দিয়ে যেন কথা বের হচ্ছিল না। মিসেস কামরুন্নাহার দরজা বন্ধ করে তেড়ে আসলেন একপ্রকার,

~ বলো কে ছিলো? কার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছ? কার জন্য এত অধঃপতন?

এবার শব্দ করে কেঁদে উঠলো আনতারা, মিসেস কামরুন্নাহার তবুও শান্ত হলেন না।‌বরং আনতারা’র দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলেন,

~ কথা বলছো না কেন? সাহস হচ্ছে না? এত রাতে বাড়ির বাইরে পা রাখার সাহস হয়েছে, আমার কাছে বলতে সাহস পাচ্ছো না? ছেলে টা কে?

আনতারা তবুও চুপ করে রয়, সে কিছুতেই চায়ছে না রাশিদের নামটা সামনে আসুক। মিসেস কামরুন্নাহার এবার রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আনতারা’র গালে। সাথে গড়িয়ে পড়ে তপ্ত নোনা জল। আনতারা গালে হাত দিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ছোট চাচির দিকে‌। তাকে মারলো? মিসেস কামরুন্নাহার চোখের পানি মুছে বললেন,

~ যার জন্য এত পরিশ্রম, যার জন্য এই বয়সে চাকরি করছি, যার স্বপ্ন কে নিজের বলে দেখেছি সেই তো এখন অন্যদিকে মন দিয়ে বসে আছে‌। এই দিন দেখার জন্য বেঁচে ছিলাম? কি করে পারলে? আমার ই ভুল হয়েছে, অপাত্রে নিজের শ্রম ঢেলে যাচ্ছিলাম।

মিসেস কামরুন্নাহার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে নিতেই আনতারা তার পা জাপটে ধরে। মেয়েটা কান্নার ফলে কথায় বলতে পারছে না,

~ ছোটচাচি আমি ভুল করেছি, আর এমন হবে না। আমি তোমাকে না বুঝেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তোমার পরিশ্রম আমি বিফলে যেতে দিবো না। আমি প্রমিস করছি তোমার শ্রমের মূল্য ঠিক দিবো। প্লিজ ক্ষমা করে দাও, আমি আর ওসবে আগাবো না। তোমার পায়ে পড়ছি ছোটচাচি আমাকে অবিশ্বাস করো না।

মিসেস কামরুন্নাহার কোনো কথাই বলেন না, দাঁড়িয়ে থাকেন। আনতারা’ও পা ছাড়ে না। অতিবাহিত হয়ে যায় কয়েক মিনিট, পুরো ঘরে কান্না আর নাক টানা’র শব্দ ছাড়া কোনো শব্দ‌ই ভেসে আসে না। মিসেস কামরুন্নাহার নিজের রাগ কে সংযত করেন, গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠেন,

~ আমি তোমাকে আর জিজ্ঞেস করবো না ছেলেটা কে। কিন্তু একটা কথা বলে রাখছি, এরপর কখনো এমন কিছু দেখলে আমাকে চিরতরে হারাবে তুমি। তোমার আবেগের বয়স ঠিক পেরিয়ে যায়নি। কি দেখেছো দুনিয়া? কয়টা ছেলেকে দেখেছো? যে গাঁয়ের রং নিয়ে সবাই এত তিরস্কার করে, সেই রং নিয়ে বিয়ের আগ পর্যন্ত‌ই যাওয়া যায়, বিয়ে পর্যন্ত না। যদি বিয়ের ইচ্ছেই থাকতো এরকম রাত বিরাতে লুকিয়ে দেখা করতো না। আমি না থেকে যদি অন্য কেউ থাকতো? বড়ভাবী, ছোট ভাই, বড় ভাই! কি করতে আনতারা? কোথায় মুখ লুকাতে? তারা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতো আমার ভুল, মেয়েকে ঠিক মতো মানুষ করতে পারি নি! আমার গাফিলতির জন্য মেয়ে এত রাতে বাড়ির বাইরে পা রাখতে পেরেছে তাও একটা ছেলের জন্য। কোথায় থাকতো আমার মুখ? তুমি একবারো ভাবলে না আনতারা। গ্রামের কেউ দেখলে কি হতো? পুরো দু তিন গ্রাম থ‌ইথ‌ই হয়ে যেত। তালুকদার বাড়ির মেয়ে ছেলের সাথে ধরা পড়েছে। কি মিনিং বের‌ করতো লোকে? ছি ছি করতো না? দাম থাকতো কোথাও? ফারাহ’র শশুড় বাড়ি খবর যেত না? তাদের সামনে কোন মুখ নিয়ে উত্তর দিতাম? তারা বলতো না এই মেয়ের জন্য তাদের ছেলেকে রিজেক্ট করেছি? বলতো না ভালো হয়েছে বিয়ের‌ কথা না এগিয়ে? ফারাহ’র মান থাকতো? তোমার ছোট বোনের কি হতো? সবাই বলতো না বড় টা এমন মানে ছোটটাও এমন হবে? ছেলের‌ চরিত্রে দাগ কম‌ই লাগতো, সবাই তখন বলতো মেয়ে না চাইলে ছেলে যেতে পারতো? জানো‌ না, যুগ আপডেট হলেও যুগের মানুষের ধ্যান ধারণা সেই প্রাচীনের মতোই আছে, মেয়ের দোষ টাই তারা ধরতো। কি করতে তখন? আত্মহত্যা করতে? তারপর? তুমি তো বেঁচে যেতে তবে আমরা? আমাদের ও মরতে হতো। নাম ডুবাতে না চাইলে এখানেই সমাপ্তি টানো, পড়ালেখায় মন দাও। নাহলে সত্যিই আমাকে মরতে হবে!

হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে আসতেই মিসেস কামরুন্নাহার বেরিয়ে যায়। আনতারা স্তব্দ হয়ে সেভাবেই বসে রয়। প্রেমে পড়ে সে সত্যিই সমাজ ভুলে গিয়েছিল, পরিবারের কথা ভুলে গিয়েছিল। একটুর জন্য তো নিজের স্বপ্নটাও জলাঞ্জলি দিতে চেয়েছিল। সত্যিই তার অধঃপতন হয়েছে, নাহলে আজ এই পরিস্থিতি তে পড়তে হতো? মুখে হাত চেপে কাঁদে আনতারা। একটু নয়, অনেকটা সময় কাঁদে। ফ্লোরেই শুয়ে রাশিদের কথা ভাবে। বুক ধুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যায়, কষ্টগুলো বাঁধাহীন অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ে। মানুষ টার চোখে যে খুশি দেখেছিল, আবার সেই খুশি কেড়ে নিলো সে। ভালো থাকতে দিলো না! যে মানুষটা তাকে ঘিরে বেঁচে আছে, সেই মানুষটার প্রতিটা ক্ষণের কষ্টের মূল্য সে কষ্ট দিয়েই দিলো। সে সত্যিই এরকম ভালোবাসা ডিজার্ভ করেনা। তার মতো শুচিস্মিতা’রা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়! চোখ নিভু নিভু হয়ে আসে, কার্ণিশ ঘেঁষে আবারো জল গড়িয়ে পড়ে! তবুও মুখে তাচ্ছিল্য হাসি ফুটিয়ে রাখে আনতারা,

~ আমি শুচিস্মিতা নয়, আমি আঁধারিয়া, অন্ধকার, আমার জীবন‌ সম্পূর্ণ অন্ধকারে ঢাকা। আপনি নামক আলো, আমার জীবনে এসে অন্ধকার দূর করতে পারবে না রাশিদ ভাই।‌ বরং নিজেই অন্ধকারে ডুবে যাবেন। তার থেকে ভালো দেহের দুরত্ব! মন টা তো কাছাকাছিই!

নিজের ঘরে পাইচারি করছে রাশিদ। রাজ্যের অস্থিরতা তাকে ঘিরে ধরেছে। মিসেস কামরুন্নাহারের উপস্থিতিতে সে শিউলি তলায় ই লুকিয়ে ছিলো দেয়াল ঘেঁষে। দেখেছে কিনা বুঝতে পারছে না! ভয় সেজন্য‌ই বেশী হচ্ছে। এত রাতে ফোন দিতেও সাহস হচ্ছে না। কি করবে সে মাথায় ঠেকছে না কিছু! এবার সে সত্যি মরে যাবে, সুখে নয় দুঃখে! এতদিন অপরূপার মনের খবর জানতো না, আফসোস এদিক হতো না। কিন্তু এখন! এখন তো সে তার শুচিস্মিতার মনের খবর জানে, কিভাবে দূরে থাকবে? কোনো অঘটন ঘটে গেলে কিভাবে সামাল দিবে? এই এতটুকু বিরহ যে এখন তার সহ্য হচ্ছে না! কাঁপা হাতে ফোন তুলে নিয়ে ভাবতে বসলো ফোন দিবে কি না! শেষমেষ নিজের সাথে না পেরে ডায়াল করেই দিলো! দুরুদুরু বুকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে র‌ইলো ফোনের স্কিনে, রিং বেজে কেটে গেল! আচমকায় বুকের ভেতর হারানোর অসহনীয় ব্যাথা টের পেল রাশিদ। হার্টের রোগীর মতো ছটফট করতে লাগলো। আবার ফোন লাগালো, এবার‌ও সেই এক‌ই ঘটনা! এত তাড়াতাড়ি ঘুমানোর মেয়ে আনতারা নয়, এমন ঘটানার পর তো আনতারা’র চোখে ঘুম ধরাই দিবে না! সে ভালো করেই জানে এটি। তাহলে কি তার সন্দেহ’‌ই ঠিক? প্রেম শুরুর আগেই বাঁধা এসে সামনে দাঁড়ালো, পাওয়ার আগেই হারিয়ে ফেললো? বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে রাশিদ, হাত দিয়ে বার কয়েক বুক ঢলে। জোরে জোরে শ্বাস নেয়, হার্টের সমস্যা টা আবার দেখা দিচ্ছে মনে হয়! তৃতীয় বারের মতো ফোন দিয়ে চোখ বন্ধ করেই রাখে সে, দু’বার রিং বাজার পর‌ই রিসিভ করার শব্দ! চিকচিক করে উঠে রাশিদের চোখ, ঝটপট কানে ধরতেই অপাশ‌ থেকে ভেসে আসে,

~ রাশিদ ভাই!

এক নিমিষেই বুকের ব্যাথা কোথায় গিয়ে পালালো টের পেল না রাশিদ। মনে হলো হৃদপিন্ড টা এবার ঠিক জায়গায় বসেছে, ছুটোছুটি করছিল বলেই তো এত ব্যাথা! শান্ত স্বরে বললো,

~ তুমি আমার বুকের বাম পাশে থাকা হৃদপিন্ড নামক যন্ত্রের একমাত্র অসহনীয় রোগ শুচিস্মিতা! যার প্রতিষেধক ও তোমাতেই!

এতক্ষণের উপচে পড়া কান্নার বাঁধ বুঝি ভেঙে গেল। ছুটে গেল ওয়াশরুমে। হাউমাউ করে কেঁদে দিলো আনতারা। চোখ বুজে শুয়ে পড়লো রাশিদ, যা বুঝার বুঝে গেছে সে! নিবিড় মনে কান্না’র শব্দ শুনে গেল। মেয়ে টা তার জন্য কাঁদছে? তাকে হারানোর ভয়ে কাঁদছে? মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে কেন? কোথাও দুঃখ আবার কোথাও সুখ সুখ লাগছে। আনতারা নিজের কান্না থামিয়ে আবার ঘরে ফিরে এলো, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মনের মধ্যে কিছু কথা সাজিয়ে বলার আগেই ওপাশ থেকে শোনা গেল,

~ দুজন দুই ঘরে দুই পাটাতনে শুয়ে আছি, কি হতো এই দুই টা বাদ দিলে, তুমি থাকতে আমার বাহুতে!

~ চুপ করুন, রাশিদ ভাই! আমি অন্ধকার, আমাকে অন্ধকারেই মানেই। আপনাকে অন্ধকারে মানায় না। রাশিদ তাজ‌ওয়ারের জীবনে আনতারা’র কোনো ঠাই নেই!

~ রাশিদের জীবনে তো ঠাই আছে! তাজ‌ওয়ার নাহয় ছেড়ে দিলাম!

রাশিদের সহজ স্বীকারোক্তি আনতারা’কে আরো ভেতর থেকে ভেঙে দেয়। মানুষ টা তার জন্য নিজ পরিবার ছাড়তে চায়ছে! নেত্রপল্লবে ভেসে উঠে সুন্দর এক ছোট্ট সংসার! যেই সংসারের একমাত্র অধিকারীনী সে, সংসারের কর্তা তার নিজের যার মনকুঠিরে তার বসবাস! সুখে ভাসতে থাকে, হুট করেই আবার নেত্রপল্লবে ভেসে উঠে মিসেস কামরুন্নাহারের মুখশ্রী। কানে বাজতে থাকে কথা গুলো। জোরে জোরে শ্বাস নেয় আনতারা। সাহস জুগিয়ে বলে উঠে,

~ আজ থেকে আমাকে ভালোবাসা ছেড়ে দিন রাশিদ ভাই, ঘৃণা করবেন। যতটা ভালোবাসেন তার থেকে হাজার গুণ ঘৃণা করবেন। আমার মতো মেয়ে রা ভালোবাসার যোগ্য নয়, তাদের শুধু তুচ্ছ তাচ্ছিল্য‌ই প্রাপ্য!

রাশিদ হাসলো, প্রাণহীন হাসি। আঁধারিয়া’রা আসলেই ঘৃণা পছন্দ করে! তবে সে যে ঘৃণা করতে পারবে না। ভালোবেসে একটু একটু করে মরে যাওয়াও যেন সুখ। বললো,

~ তুমি নিজেকে তুচ্ছ ভাবে
আমি ভাবি তুষ্ট!
তুমি নিজেকে অন্ধকার ভাবো
আমি ভাবি আলো!
তুমি নিজেকে কালো ভাবো
আমি ভাবি শুচিস্মিতা!
যার একটু খানি হাসিতে ঘায়েল হয়েছি বহুবার, মরেছি শতবার!
কিন্তু আফসোস এই হাসিটা ফের দেখার জন্য হয়তো আমাকে আমৃত্য অপেক্ষা করতে হবে! তবে ক্ষতি নেই!

সকাল ঠিক‌ই হলো, তবে অন্যদিনের মতো আজকের সকাল টা নয়, ভিন্ন। প্রকৃতির রূপ আজ আনতারা’কে ডাকছে না। অনুভূতি হীন জড়বস্তু’র মতো ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হলো। ঘুমিয়েছে বললেও ভুল হবে। শেষ রাতের দিকে চোখ টা একটু লেগে এসেছিল এই যা! ফ্রেশ হয়ে বাইরে গিয়ে দেখলো রান্না ঘরে মিসেস কামরুন্নাহার একাই কাজ করছেন। আনতারা গিয়ে পাশে দাঁড়ালো। মিসেস কামরুন্নাহার না দেখার ভান করেই কাজ করতে লাগলেন। আনতারা বুঝলো তাকে এড়িয়ে চলছে। বললো,

~ আমাকে এক কাপ চা দিবে ছোটচাচি।

মিসেস কামরুন্নাহার দিলো, তবে টু শব্দ পর্যন্ত করলো না। অভিমানী আনতারা’র অভিমান যেন আকাশ ছোঁয়া হয়ে গেল। চোখ ভরে আসতে চাইলো, ঠিক তখনি রান্না ঘরে ঢুকলো কেয়া। কোনো দিক না তাকিয়েই মা কে জড়িয়ে ধরলো, এসেছিল আবদার করতে অথচ সে তো জানেই না তার মায়ের মন মানসিকতা ঠিক নেই। মিসেস কামরুন্নাহার ধমকে বললেন,

~ রান্না করছি দেখতে পারছো না? আদিক্ষেতা দেখাতে আসবে না। এত সকালে ঘরের বাইরে কি? পড়াশোনা সব লাটে উঠিয়েছ? পড়লে ভালো করে পড়ো, নাহলে বলো বিয়ের ব্যবস্থা করছি। মাথার ঘাম পায়ে ঠেলে আমরা টাকা উপার্জন করছি এমনি এমনি? অযহত টাকা ঢালার জন্য? যদি এই পরিশ্রমের মূল্য না দিতে পারো দরকার নেই এমন পড়াশোনার।

কেয়া কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে নিজের ঘরে চলে যায়, এমন ব্যবহার মায়ের থেকে আশা করা যায় না। সকাল সকাল মনটাও ভেঙে যায় তার। আনতারা ঠিক বুঝলো কথাগুলো কেয়ার সাথে তাকেও বলা হয়েছে। ভেজা নয়নে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা ধরলো সে! তখনি শোনা গেল শোরগোলের আ‌ওয়াজ। মিসেস মমতা’র উল্লাসিত কন্ঠ। নিজের ঘরে ঢুকেই আনতারা পর্দার আড়াল থেকে বাইরে নজর দেয়। মানুষ টা চলে যাচ্ছে! অপলক তাকিয়ে রয় মুখপানে। রাশিদ তার মায়ের কথা‌ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। আনতারা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, ঘরের ভেতর এসে বসে পড়ে। ঠিক তখনি নড়ে উঠা পর্দায় চোখ দেয় রাশিদ, হাসে! অপরূপা তাহলে তার যাওয়ায় পুড়ছে! সময় হতেই অটো তে উঠে বসে সে, চলতে শুরু করে অটো। তালুকদার, তাজ‌ওয়ার দুটো বাড়িই একপলক করে দেখে নেয়! দু বাড়িতেই তার আপনজন রয়েছে, যাদের কে ছেড়ে সে দূরে চলে যাচ্ছে। নির্মল গ্রামের প্রকৃতি ছেড়ে শহরের ভিড়ভাট্টায় হারাতে যাচ্ছে সে‌। তবে হৃদয় টা যে এখানেই রেখে গেল, তার শুচিস্মিতার কাছে! গ্রামের মোড়ে খানিকক্ষণ দাঁড়ায় রাশিদ, খুব মিস করবে আড্ডা গুলো। ছেলেপেলে গুলোও তাকে বিদায় দিতে এসেছে। আবার চেপে বসে অটোতে‌। গ্রামের শেষ মাথায় গিয়ে মাথা বের করে আরেকবার গ্রাম টাকে দেখে নেয়। দু বছর আগেও সে শহরে থেকেছে, এতটা মায়া টের পায় নি এই গ্রামের জন্য, তবে আজ মনে হচ্ছে গ্রামটা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছে। বিড়বিড় করে বলে উঠে,

~ আবার দেখা হবে কোনো এক কোলাহলপূর্ণ রেলওয়ে স্টেশনের। আবার দেখা হবে কোলাহলপূর্ণ কোনো বাস স্টেশনে। আবার দেখা হবেই, আমি অপেক্ষা করবো শুচিস্মিতা! হয়তো দীর্ঘক্ষণ!

~ আম্মা, মেজ ভাবী কে বলেন রান্না ঘরে যেতে। এখানে অযহত বসে থেকে লাভ নেই!

ফারাহ’র কথার রিনু মুখ বেঁকালো। মিসেস নাজমা কিছু বললেন না আগেই। রিনু বললো,

~ অযহত ব‌ইসা আছি মানে? শুনো ফারাহ, আমারে কাজ শিখাইতে আসবা না‌। বললেই হ‌ইতো রান্না ঘরে যেতে, উল্টাপাল্টা কথা বলবা না।

~ কাজের সময় এলেই তো আপনার আম্মার কথা মনে পড়ে মেজ ভাবী, তাই আমাকেও বলতে হলো।

দুই ব‌উয়ের কথা কাটাকাটিতে বিরক্ত হলেন মিসেস নাজমা। ধমকে বললেন,

~ যাও তো, আমার ঘর থেইকা বাইর হ‌ও। মিল্লামিশা কাম করবো, তা না ক‌ইরা ঝগড়া লাগাই দিছে, এরা নাহি আমার সংসার সামলাইবো। হাঁটুর ব্যাথাডা ভালা হ‌ইক, তার‌পর তোমাগরে দেইখা লমু।

ফারাহ, রিনু দুজন‌ই মুখ বেঁকিয়ে বের‌‌ হয়ে গেল‌ ঘর থেকে‌। দুজন যেন দুই মেরুর। একজন ফাঁকি দিতে উস্তাদ, আরেকজন এসব সহ্য না করার দলে‌। মধ্যে বাড়ির বড় ব‌উ চুপচাপ নিজের কাজ করে যায়! পুরুষ রাও হ‌য়েছে একরকম, ব‌উ শাশুড়ির মধ্যে নাকি তাদের কাজ নেই! এক হিসেবে ভালোয় হয়েছে না, নাহলে হয়তো প্রতিদিন সালিশ বসতো! রিনুর রাগী মুখশ্রী দেখে পারভিন হাসলো, দুপুরের রান্না বসাবে, তরকারী কাটতে বসিয়ে দিলো রিনুকে, যত রাগ তরকারীর সাথে মিটাক, ঘরে শান্তি ফিরুক। অন্যদিকে ফারাহ এসেই অন্য কাজ করতে লাগলো, তার কাজ করতে মানা নেই, বাড়িতে প্রায় দিন রান্না করতো সে। কিন্তু তার সমস্যা অহেতুক হুকুম সে মেনে নিতে পারে না! এর জন্য‌ই হয়তো ঝগড়া লেগে যায়, তার ই বা কি করার। মুখ কি সে তালুকদার বাড়িতে রেখে আসছে, তার সংসার তার মতামত থাকবে না? তা কি করে হয়! অন্যকেউ ভুলভাল একটা বললে , সে পরিবর্তে তিনটা বলতে পারে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই নিজের কাজ শেষ করে একটু ফোন নিয়ে বসলো ফারাহ, বোনের সাথে কথা বলা প্রয়োজন! ফোন দিতেই সাথে সাথেই রিসিভ হলো, খানিক অবাক হলেও হাসিমুখে কিছু বলার আগেই কারো কান্না ভেজা কন্ঠ শুনে থেমে যায় সে,

~ আপায়, আপায় গো, আমার যে আর ভালোবাসা পাওয়া হলো না!

চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here