শুধু আমারই পর্ব ৩

শুধু_আমারই
পর্ব_৩

আমার ইন্টর্নশীপ শেষ হয়েছে বলে আজ কাগজ পত্র তুলে বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরতেই স্বপ্না বু বলল ফুপু ডাকছেন। মায়ের রুমে উঁকি দিতেই মা বললেন তোমার রুমে সায়ান তার বন্ধু রাব্বিকে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। কোনো কমনসেন্স নাই দুটোরই। বিয়ে হয়েছে ঘরে বউ আছে কোথায় রুমের প্রাইভেসি রাখবে! না! যেমন গাধা আমার ছেলে তেমন তার বন্ধু! এখন কি আর ব্যাচেলর লাইফ আছে? যত্তসব!
তুমি গিয়ে দুটোকেই ঘাড় ধরে বের করে দিবে। আমার পারমিশন আছে। রাব্বিটা কিন্তু অনেক বেয়াড়া। বিয়ে শাদি করে না খালি ঘুরে বেড়ায়। ওটাকে বেশি পাত্তা দিবে না। এতো বছরেও তাড়াতে পারি নি। তুমি পারলে তাড়াও। যাও এবার উপরে যাও।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলাম আর হাসছিলাম। একমাত্র ছেলের মায়েরা বেশিরভাগই ছেলের বউদের হিংসা করে। সেখানে মা যেন আমাকে সায়ানের সকল দায়িত্ব জোর করে চাঁপিয়ে দিচ্ছেন।

রুমে ঢুকে দেখি দুই বন্ধু ডিভানে গা এলিয়ে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে রাব্বি বলে পিয়া আমাকে কিন্তু তোমার সহ্য করতে হবে। এতোদিন আন্টিকে জ্বালিয়েছি এখন তোমাকে জ্বালাবো। আন্টি নিশ্চয়ই বলেছে আমাকে পাত্তা না দিতে। কিন্তু আমাকে পাত্তা না দিয়ে পারবে না তুমি। হতে পারি আমি বেয়াড়া কিন্তু উনার এমন নাজুক ছেলেটাকে আমিই সবসময় আগলে রাখি বুঝলে!

আমি হেসে বলি ভালো তো! আমি তো ভেবেছি মায়ের সাথে বুঝি আমাকেও এ অবুঝ ছেলেটাকে আগলে রাখতে হয়।
সায়ান বলে আচ্ছা আমাকে সামনে রেখেই আমার লেগ পুলিং চলছে! সবাই খালি আমাকে আগলে রাখে, না?

আমি হেসে বলি তা আর বলতে!! আচ্ছা আপনারা কি এ রুমেই থাকবেন?? মানে আমি বাইরে থেকে এলাম তো একটু সাওয়ার নিবো।

দুবন্ধুই ভ্যাবাচেক্যা খেয়ে গেল। না..না আমরা যাচ্ছি বলে দুজনই অনেকটা ছুটে বেড রুম থেকে বেড়িয়ে গেল।
আমি মনে মনে হেসে বলি যেমন সায়ান তেমন তার বন্ধু!

শাওয়ার শেষে আমি শাড়ি পরলাম। মায়ের আদেশ প্রথম দুমাস যেন শাড়ি পড়ে থাকি বাসায়। আমার ভালোই লাগে মাকে খুশি করতে পেরে। স্বামীর আদর সোহাগ নাই কিন্তু বউয়ের দায়িত্ব পুরোই পালন করছি।

রাব্বি স্ট্যাডি রুমে বসে বলে কিরে পিয়া তো মহা সুন্দরী। তুই পিয়ার এতো গল্প করলি এটা তো বলিস নি। তোর কাছে কি খালি সানজানাই সুন্দরী??
— সানজানা তো অবশ্যই সুন্দরী। তবে পিয়াকে আমি ওভাবে খেয়াল করি নি।
— কি বলিস? পিয়া তোর বউ। তুই ওকে খেয়াল করবি না!
—- তুই তো জানিস সব। তাহলে বউ বউ করছিস কেন?
— করছি কারন তুই সারাদিন শুধু পিয়া পিয়া করিস। সানজানা সানজানা তো করিস না।
— সানজানার কথা বলি না কারন ওর সাথে আমার তেমন সময় কাটানোই হয় নি। ওকে তো কাছেই পাই নি।
— আরে এ যুগে কি সশরীরে কাছে পেতে হয়! কমিউনিকেশন এ্যাপের মাধ্যমে তো গ্রামের অশিক্ষিতরাও টাচে থাকে। আর তোর আর সানজানার কেমন প্রেম যে কেউ কারো খবরই রাখিস না।
— খবর রাখি না তা-না! যোগাযোগ তো হয়ই।আসলে সানজানা তো ব্যস্ত থাকে।
— কইছে! প্রেমে আবার ব্যস্ততা কি রে? তাও নতুন নতুন প্রেম। তুই প্রেম কি জিনিস জানিসই না।
— তুই বড় জানিস বুঝি?? তুই কি বুঝাতে চাচ্ছিস??
— দেখ সায়ান ক্লিয়ার কথা বুঝ। তোর মাথায় সারাদিন পিয়া ঘুরে আর তুই এটাকে ভাবিস বন্ধুত্ব। অন্যদিকে সানজানার ভালো লাগা, মন্দ লাগা, একটা মিষ্টি মুহূর্ত, রাগ, অভিমান কিছুই তোর ভালোবাসার ডাইরীতে নাই। কিন্তু তুই ওটাকেই প্রেম ভাবছিস। তুই তো এ যুগের খাঁটি গাধা।
— হো তোরে বলছে আজাইরা কথা!
— আজাইরা কথা না। দেখ, পিয়া তোর সাথে আছে তুই চাইলে আজীবন থাকবে। অন্যদিকে সানজানা উঠতি মডেল। তুই সানজানাকে এখন কেন পাঁচ সাত বছরেরও কাছে পাবি না।
সায়ান, সিদ্ধান্ত কিন্তু পুরো জীবনের! এমন না যে এটা চাই না ওটা, আবার ওটা না এটাই চেয়েছিলাম।
তুই পিয়াকে নিয়ে একবার মন থেকে ভেবে দেখ। তুই নিজেই উত্তর পাবি।

— ফালতু বুদ্ধি দিবি নাতো!
— আচ্ছা তোর ভাবার দরকার নাই। তুই পিয়াকে একবার ভালো করে দেখ। ঘুরে ঘুরে দেখ। মনে মনে দেখ। বিভিন্ন এঙ্গেলে দেখ। দেখবি পিয়াকে তোর ঠিকই সুন্দরী লাগবে, আপন আপন লাগবে। নিজের বউও মনে হবে।

এমন সময় পিয়া রুমে উঁকি দেয়। দুপুরের খাবার টেবিলে দেয়া, খেতে আসেন!
রাব্বি বলে, না পিয়া আমি এখন খাবো না। খেলে আগেই বলতাম।
আচ্ছা বলে পিয়া চলে যেতেই রাব্বি সায়ানকে আড় চোখে একবার দেখে তারপর বলে পিয়া কি শাড়ি পরে থাকে সব সময়??
— হু!
—শাড়িতে তো ওকে বেশ মানায়!

সায়ানের কেন জানি মেজাজ চড়ে যায়। বলে দুপুরে খাবি না যখন যা। বাসায় যা।

রাব্বি হেসে বলে এটুকুতেই এতো জ্বলা দোস্ত ! আবার বলিস পিয়া শুধু বন্ধু, তাই না???

— ধুর শালা তুই বিদায় হো..

সায়ান রাব্বিকে বিদায় করে নিজের রুমে এসে বসে। পিয়া তখন আয়নার সামনে বসে হেয়ার ড্রায়ারে চুল শুকাচ্ছে।
সায়ান পিয়ার পেছনে বিছানায় বসে ল্যাপটপে কাজ করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু রাব্বির কথা মাথায় ঘুরতে থাকে।
শাড়িতে পিয়াকে তো বেশ লাগে.. মনে হতেই সায়ানের মেজাজ চড়ে যায়। শালাকে আর আসতেই দিবে না বাসায়। আর পিয়ারই বা রোজ রোজ শাড়ি পরার দরকার কি!
বিরক্তি চোখে সে পিয়ার দিকে তাকায়।

পিয়ার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ে যাচ্ছে হেয়ার ড্রায়ারের বাতাসে। সায়ান দেখতে থাকে। হাতে কিছু কাঁচের চুড়ি পরে পিয়া কপালে ছোট টিপ দেয়। সায়ান চোরা চোখে দেখতেই থাকে।
পিয়া আয়নায় সায়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিরে তাকায় সায়ানের দিকে। সায়ান সাথে সাথে ল্যাপে চোখ বসিয়ে দেয়। পিয়া কিছু না বুঝে বারান্দায় গিয়ে মোবাইলে কথা বলতে থাকে। সায়ান আবার পিয়াকে দেখতে থাকে। আসলেই তো পিয়া অনেক সুন্দরী। কি মিষ্টি হাসি, চোখ, ঠোঁট! চুলগুলো কি সুন্দর কোমর পর্যন্ত লম্বা! বারান্দায় ঝুলানো গাছগুলো নাড়তে নাড়তে পিয়া অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলছে। হাত উঁচু বলে পিয়ার আঁচল উপরে ওঠা আর তার অনাবৃত পেট, কোমরের খাঁজ দেখা যাচ্ছে।
অনাবৃত কোমরে চোখ যেতেই সায়ান শুকনো ঢোঁক গিলে। কিন্তু চোখ সরাতে ভুলে যায়। হঠাৎ দেখে পিয়া ইশারায় কি দেখছে জিজ্ঞেস করছে।
ওমনি সায়ান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ল্যাপে তাকায় কিন্তু নিজের চোরা কর্মের ফলে খুব অপরাধী লাগে বলে পরক্ষণেই রুম থেকেই পালিয়ে যায়।

পিয়া মুখ টিপে হাসতে থাকে। সায়ান যে ওর কোমর দেখছিল তা পিয়া বুঝতে পারে। কিন্তু সায়ানের অপরাধী ভ্যাবাচেকা মুখ দেখে হাসি আটকাতে পারে না। মনে মনে বলে ভ্রম্মচারী একটা!

দুপুরে খেতে বসে সায়ান চুপ থেকে মাথা নিচু করে খায়। পিয়ার মজাই লাগে। মা একা একাই বকবক করে চলছেন। সায়ান হঠাৎ বলে উঠে পিয়া তুমি রোজ রোজ শাড়ি পরো কেন??
পিয়া হঠাৎ এমন প্রশ্নে কি উত্তর দিবে বুঝে না।

মা অবাক হয়ে বলে এটা কেমন প্রশ্ন? নতুন বউ শাড়ি পরবে না? তোর ওকে শাড়ি পরা দেখতে ভালো লাগে না? নতুন বউ কি জিন্স ফতুয়া পড়ে ঘুরবে। আর ঘুরলেও পড়ে ঘুরবে। এখন নতুন নতুন শাড়িই পরুক। পরে না হয় অন্যকিছু পরবে। আর রোজ রোজ শাড়ি পরতে আমি ওকে বলেছি। নতুন বউ শাড়ি পরে ঘুরাঘুরি করে এটা দেখে আমার মনটা ভরে উঠে। তোর কোনো সমস্যা??

সায়ান এতো লম্বা লেকচার খেয়ে চুপ হয়ে থাকে। আমি মুখ টিপে হাসি।

বিকালে সায়ানের কাজিনরা আসে। এ বাসাটা এদের আড্ডাখানা। সব মিলে মোট ছয়জন। এর মধ্যে জমজ দুটো বোন আছে। সবকটাই ইয়াং এবং কাছাকাছি বয়সী। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে বলে মেয়েগুলো ঠোঁট ফুলিয়ে ঢঙ্গিলা সুরে কথা বলে। তবে মনের দিক থেকে সবকটাই ইনোসেন্ট, মিশুক কিন্তু অনেক বেশি বিচ্ছু । মারামারি, বিছানায় লাফানো, একে অন্যকে ধাক্কা দেয়া তো জড়িয়ে ধরা, এক সাথে কুস্তি লড়া কি করে না এরা ! এদের ছেলে মেয়েতে কোনো ভেদাভেদ নাই। আমি খালি চোখ বড় বড় করে এদের কৃর্তি দেখি, তবে মজাও পাই। সায়ান হয়তো এর জন্যই আমার সাথে এতো বেশি সাবলীল। কারণ ছাড়া আমার হাত ধরা, আমার গা ঘেষে বসা এসব সায়ানের কাছে খুব সহজ ব্যাপার। হয়তো ও আমাকে এদের মতোই ভাবে!

সায়ান যেন সবকটার বস! জমজ বোন দুটো একটু বেশিই দুষ্ট। সায়ানের কাছে আদরও এরা বেশি পায়। যতই দুষ্টুমিই করুক সায়ান এদের কিছুই বলে না।

আমি কিচেনে ওদের সন্ধ্যের নাস্তা বানাচ্ছি আর নিচ থেকেই উপরের হৈ চৈ শুনছি। কাজ শেষ করে আমি কেবল আমার রুমে গেছি দেখি জমজ দুটো অন্ধকার রুম থেকে চিৎকার দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে বের হচ্ছে। আমার সাথে ধাক্কা খেতেই দুটো আরও জোরে চিৎকার দিয়ে হাসতে লাগে। আর মুহূর্তেই আমার হাতে পাউডার ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায়।
আমি কিছু না বুঝে লাইটের সুইচ ওন করতেই আমার সামনে সাদা ভূত আবিষ্কার করি। সায়ানের চুল, চোখের পাপড়ি, মুখ সব সাদা হয়ে আছে। সায়ানের এমন রূপ দেখে আমিও হাসিতে ফেটে পড়ি। সায়ান মুহুর্তেই বীর যোদ্ধার মতো আমার হাত থেকে পাউডারের বোতল নিয়ে আমার উপর এলোপাথাড়ি ঢালতে লাগে।
— আরে, আমি কি করলাম! আমার দোষ কোথায়!

কে শুনে কার কথা! আমি পালাতে গেলে ও আমাকে পিছন থেকে কাছে টেনে নেয়। তারপর জাপটে ধরে আমার মাথায় পাউডার ছিটাতে লাগে। একপর্যায়ে সায়ান ওর অজান্তেই আমার অনাবৃত পেটে হাত দিয়ে আমায় চেপে ধরে।
এমন করে হয়তো ওর নিজেরই হুশ আসে। ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো দূরে সরে যায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সরি সরি বলতে থাকে।

আমি চুপ হয়ে থাকি।

—ধুর! তুমি শাড়ি পরো কেন সবসময়? আমি চাই না তুমি আর শাড়ি পরো বলে সায়ান বেরিয়ে যায়।

কোথায় আমার গায়ে হাত দিয়েছে বলে আমি রাগ করবো উল্টো আমাকেই বকে সায়ান গজগজ করে চলে গেলো।

আমি পুরোই বেকুব বনে তাকিয়ে রইলাম।

চলবে।।
লেখকঃ ঝিনুক চৌধুরী

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here