শ্রাবণ ধারা-২ পর্ব -০৬

#শ্রাবণ_ধারা-২
#পর্ব-৬
#সাদিয়া

আজকে ধারার ছুটি। তাই এখনও সে ঘুম থেকে উঠেনি। তিথির ক্লিনিক খোলা থাকায় সে চলে গেছে।

—ধারা উঠ অনেক বেলা হয়ে গেছে। এই ধারা।

মিসেস তন্নির ডাকাডাকিতে দশটায় উঠলো ধারা। ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলো সে।
—আবার ওখানে বসেছিস কেন? খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। খেতে আয়।
—আসছি আন্টি।

রুটিকে ছোট ছোট টুকরো করে সবজি মাখিয়ে খাচ্ছে ধারা।
—আন্টি?

—হুম বল।

—চলো না আজকে কোথাও ঘুরতে যাই। আজকে তো তিথিও বারোটায় চলে আসবে।

—বল কোথায় যেতে চাস?

—শপিংয়ে যাবে?

মিসেস তন্নি হাসি মুখে বলে,
—যাওয়া যায়।

ধারা খুশি মনে খাবার শেষ করলো। নিজের রুমে এসে তিথিকে ফোন করে শপিংয়ে যাওয়ার কথা বলে দিলো। বেলা বারোটায় তিথি আসলো। ওরা লাঞ্চ শেষ করে বেরিয়ে যায় শপিংয়ে। তারা কাছের একটা শপিং মলে গেলো।
—কি কিনবি বল।

—কয়েকটা চুড়িদার নেবো আমি।

—আর তিথি তুই কি নিবি?

—ইয়ে মানে বলছিলাম কি আম্মু আমাকে এই লাস্ট বারের মতন একটা শাড়ি কিনে দেবে গো?
মিসেস তন্নি রেগে তাকালো তিথির দিকে।
—আলমারি ভরা শাড়ি থাকতেও তুই আবার শাড়ি কিনতে চাইছিস?

—প্লিজ আম্মু।

—ঠিক আছে জাস্ট একটা।
তিথি খুশি মনে শাড়ি দেখতে লাগলো। অনেক দেখার পর তিথি একটা নীল শাড়ি কিলনো। তিথির সাথে সাথে ধারাও একটা কালো রঙের শাড়ি নিলো।
তিনজন মিলে প্রচুর শপিং করলো সাথে অনেক মজাও করলো। তারা একেবারে ডিনার করে বাসায় ফিরলো।

.
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে ধারার। কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে না খেয়েই হাসপাতালে ছুট লাগায় সে।

হাসপাতালে বোর্ড বসেছে একটা ক্রিটিকাল সার্জারীর জন্য। সবাই বসে আছে বিরস মুখে। আর শ্রাবণ বসে আছে রাগি থমথমে মুখে। আসলে সকলে ধারার জন্য অপেক্ষা করছে কিন্তু ধারার দেখা নেই।
অনেক কষ্টে ধারার হাসপাতালে এসে পৌছাল। প্রায় পুরোটা পথই সে হেঁটে এসেছে।ক্লান্ত হয়ে চেয়ারে বসতে যাবে তখনই একজন এসে বলে যায় বোর্ড রুমে সবাই তার জন্য অপেক্ষা করছে। ধারার আর বসা হলো না। সে চলে গেলো বোর্ড রুমে।

—আসবো?

—আসুন আসুন মিস ধারা আসুন। রাফি মিস ধারাকে ফুলের তোড়া দিয়ে ওয়েলকাম জানাবে না? ম্যাডাম ভিক্টোরিয়া এতোক্ষণে আমাদের সামনে প্রকট হয়েছেন।

সবাই গম্ভীর মুখে বসে আছে। ধারা সকলের মুখের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছে না আসলে কি হয়েছে আর কি চলছে এখানে।
—শ্রাবণ এখন এসব রেখে মিটিং শুরু কর।

—বসুন। যত্তসব ইরিসপন্সিবল মানুষ।
চরম বিরক্তি নিয়ে শ্রাবণ মিটিং শুরু করে। যেহেতু এটা তুলনামূলক একটু বেশি ক্রিটিকাল সার্জারী তাই এই সার্জারীটা শ্রাবণ করবে আর সৈকত শ্রাবণকে এ্যাসিস্ট করবে। শ্রাবণ ডা.রাফিকে বলেছিলো সার্জারীটা করতে কিন্তু রাফি মানা করে। সিনিয়র নামকরা দুজন ডাক্তার থাকতে সে এতবড় রিস্ক নিতে চায় না। যদিও এর কারণে শ্রাবণ তাকে অনেকগুলো কথা শুনিয়েছে। যেমন, রিস্ক কমবেশি সব সার্জারীতেই থাকে। তুমি যদি এত ভয় পাও তাহলে ডাক্তার কেন হতে এসেছো ইত্যাদি ইত্যাদি। শ্রাবণ ধারাকেও সার্জারীটা অফার করেছিলো। কিন্তু অন্য ডাক্তাররা এতে মত দেয় নি। সবার এক কথা, যে ডাক্তার টাইমলি হাসপাতালে আসতে পারে না তাকে এতোবড় একটা দায়িত্ব দেওয়া বোকামি। তবুও শ্রাবণ ধারাকে সার্জারীটা করতে বলেছিলো আর এ-ও বলেছিলো এই সার্জারীতে সে ধারারকে এ্যাসিস্ট করবে। কিন্তু এতো মানুষের অমতের কারণে ধারা নিজেই শ্রাবণকে না করে দেয়। শ্রাবণ আর কাউকে জোর করলো না।

হাসপাতালের টাইম শেষে রাস্তা দিয়ে চুপচাপ হাঁটছে ধারা। সকালের ঘটনার জন্য তার মনটা এখনও কিছুটা খারাপ। হাঁটার এক পর্যায়ে ধারা বুঝতে পারলো তার পাশে কেউ আছে। ধারা বুঝতে পারলো মানুষটা শ্রাবণ। ধারা কিছু না বলে চুপচাপ হাঁটছে। শ্রাবণও নিশ্চুপ। আচমকা শ্রাবণ “ফুচকা” বলে চেচিয়ে উঠলো। এতে ধারা কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।
—কি হয়েছে কি? এভাবে চেচাচ্ছেন কেন?

—ওই দেখো ধারা ফুচকা!

ধারা দেখলো রাস্তার অপর পাশে এক লোক ফুচকা বিক্রি করছে। এতোদিন পর ফুচকা দেখে ধারার মুখে পানি চলে আসলো।
—চলো চলো চলো।

ধারা অবাক হয়ে জিনিস করলো,কোথায়?

—আরে কোথায় মানে? দেখতে পাচ্ছো না সামনে ফুচকা আছে। এভাবে দূর থেকে ফুচকা দেখে না খেয়ে চলে গেলে বুঝি ফুচকার অপমান হয় না। এদেরও তো একটা মান-অপমানবোধ আছে নাকি। ফুচকা বলে কি তারা মানুষ থুরি খাবার নয়।

শ্রাবণের কথায় ধারা ভীষণ কনফিউজড। ধারা ভাবছে যে শ্রাবণ ডাক্তার কি করে হলো। তার উপর নাকি সে একটা ডিপার্টমেন্টের হেড। ভাবা যায়!
শ্রাবণ ধারাকে এক প্রকার টেনে নিয়ে গেলো ফুচকার দোকানে।
—মামা বেশ ঝাল ঝাল করে দু’প্লেট ফুচকা দিন তো।

—ঝাল? কিন্তু আপনি তো ঝাল খেতে পারেন না।

—ঝাল ছাড়া ফুচকা খাওয়ায় কোনো মজা আছে নাকি আজব। মেয়ে হয়ে এটুকু জানো না। আর ঝাল খেতে পারি না তো কি হয়েছে। একদিন খেলে কিছু হয় না।
ধারার বাধা শুনলো না শ্রাবণ। ফুচকাওয়ালা ফুচকার প্লেট টেবিলে রাখতেই শ্রাবণ এক প্রকার হামলে পড়লো ফুচকার উপর। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক দিনের ভুখা!
—আস্তে খান নয়তো গলায় আটকে যাবে।

—ফুচকা কি আস্তে খাওয়ার জিনিস?

ধারা কিছু বললো না। অনেক দিন পর ফুচকা খাচ্ছে ধারা। জার্মানিতে তো আর ফুচকা খেতে পাওয়া যায় না। ধারা নিমিষেই ফুচকার প্লেট খালি করে দিলো। এক প্লেটে তার মন ভরেনি। তার আরো এক প্লেট ফুচকা খেতে মন চাচ্ছে। কিন্তু সে মুখ ফুটে তা বলতে পারছে না।
শ্রাবণ কিছুক্ষণ ধারার মুখের দিকে দেখলো। তারপর ফুচকাওয়ালাকে বললো আরো এক প্লেট ফুচকা দিতে।
—আরো এক প্লেট কেন?

—অবশ্যই দেখার জন্য নয়। ডেফিনেটলি খাওয়ার জন্য মিস ধারা।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুচকা হাজির হলো। শ্রাবণ ফুচকার প্লেটটা ধারার দিকে এগিয়ে দিলো।
—নিন শুরু করুন মিস ধারা। আমি একটু আসছি।
শ্রাবণ উঠে একটু রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ায়। কারণ সে জানে সে এখানে থাকলে ধারা খেতে ইতস্তত বোধ করবে। ধারা শ্রাবণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে ফুচকায় টক ভরে মুখে দিলো।
ফুচকা খেয়ে তারা গাড়িতে উঠে বসলো। শ্রাবণ স্টেয়ারিংয়ে ধরে কিছু একটা ভাবছে।
—কি ভাবছেন স্যার?

—লেকের পাড়ে যাবেন মিস ধারা?

ধারা অবাক হয়ে শ্রাবণের দিকে তাকালো। আজকাল শ্রাবণকে চিনতে ধারার ভুল হয়। আগের শ্রাবণ আর এখনকার শ্রাবণের মধ্যে যেন আকাশ পাতাল ব্যাবধান। শ্রাবণের ব্যবহারে কোনো প্রকার অপরাধবোধ নেই। সে ধারার সাথে এমন ব্যবহার করে যেন আট বছর আগে তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি।

—কি হলো মিস ধারা,যাবেন?
ধারা রাজি হয়। শ্রাবণ হাসিমুখে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
লেকের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে ধারা। শ্রাবণ গেছে চা আনতে। শ্রাবণ বলেছে এখানের চা নাকি অনেক মজা। যদিও ধারা খুব একটা চা পান করে না তবুও সে আজ রাজি হলো। হয়তো শ্রাবণের জন্য!
—নিন মিস ধারা চা ধরুন।

মাটির একটা ছোট ভার শ্রাবণ ধারার হাতে ধরিয়ে দিলো। ধারা ভ্রু কুঁচকে চায়ের ভারে চুমুক দিলো। চায়ের ভারে চুমুক দিতেই ধারা চোখ বন্ধ করে নিলো। সত্যিই চা-টা অনেক সুস্বাদু!

—চা-টা কেমন লাগলো মিস ধারা?

—অসাধারণ!

—এই দোকানের চা আমার অনেক প্রিয়। রুশাকে নিয়ে এর আগে কয়েকবার এসেছিলাম।
রুশার কথা বলতেই ধারার ভালো মনটা নিমিষে খারাপ হয়ে গেলো। বুকের বা পাশটায় চিন চিন ব্যাথা অনুভব করলো ধারা। শ্রাবণ আপন মনে বকবক করে চলেছে আর ধারা লেকের পানির দিকে তাকিয়ে আছে। ধারার কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শ্রাবণ ধারার দিকে তাকিয়ে দেখলো ধারার লেকের পানি দেখছে মন দিয়ে।
—মিস ধারা আপনার কি মন খারাপ? একটু আগেও তো দেখলাম মন ভালো। হঠাৎ করে কি হলো?

ধারা উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করলো না বিধায় সে চুপ রইলো। কিয়ৎকাল নিরবতা পালন করে ধারা বলে সে বাড়ি যাবে। শ্রাবণ বিনা শব্দে গাড়িতে উঠে গাড়ি স্টার্ট দেয়। পুরো রাস্তা দুজনেই মুখে কুলুপ এঁটে ছিলো। তিথিদের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই ধারা ধির পায়ে ভেতরে চলে গেলো। একবার কথা বলা তো দূর সে পিছন ফিরে তাকালো পর্যন্ত না। শ্রাবণ ধারার এহেম ব্যবহারের মানে বুঝতে পারছে না। গভীর ভাবনায় ডুবে যায় শ্রাবণ। তার সে ভাবনার ছেদ ঘটে ফোনের রিংটোনের শব্দে।
—হ্যাঁ রাসেল বলো।

—স্যার রকির উপর কারা যেন এ্যাটাক করেছে।

—হুয়াট? কি বলছো এসব?

—জ্বী স্যার। অবস্থা খারাপ না ভালো বুঝা যাচ্ছে না। আপনি তাড়াতাড়ি আসুন।

—আ..আমি আসছি। আমি এক্ষুনি আসছি।
ফোন পকেটে ঢুকিয়ে শ্রাবণ গাড়ি ঘুরিয়ে হাসপাতালে ছুট লাগায়।

#চলবে…ইনশাআল্লাহ

(

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here