শ্রাবণ রাতের বর্ষণ পর্ব ১৬

#’শ্রাবণ রাতের বর্ষণ’❤
#’লেখিকাঃ ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
#’পর্বঃ ১৬

.
বিমর্ষতায় ঘেড়া রাত। চারপাশ আলোয় আলোকিত হলেও চন্দ্রার মনটা যেন দৃঢ় অন্ধকারে ঘেরা। বাইরে শ্রাবণ মাসের শ্রাবণধারা বিরাজ মান। দমকা হাওয়া ছুটে এসে মৃদুভাবে চন্দ্রাকেও ছুঁয়ে দিচ্ছে। চন্দ্রার বিশেষ ভাবগতি নেই এতে। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মোমবাতিটির দিকে। মন গহীনে বারংবার নিজেকে ধিক্কার জানাচ্ছে সে। এ কেমন রাজকুমারী চন্দ্রা? রত্নমার সামান্য স্বরযন্ত্র বুঝতে পারলো না? নিজেকে রুদ্রের থেকে বাঁচাতে পারলো না? এমন ঠুনকো কেন তার বুদ্ধীচেতনা? এত ভীতু কেন সে? প্রশ্নগুলোর উত্তর একান্তই চন্দ্রার। কিন্তু আফসোস, আজ পর্যন্ত একটি উত্তরও তার কাছে স্পষ্ট নয়। দীর্ঘশ্বাসের বেড়াজালে ঘিরে রইল চন্দ্রা। কক্ষে কিরণ এসেছে একটু আগে। সেদিকে একবার চেয়ে চোখ আবারও ফিরিয়ে নিলো চন্দ্রা। মৃদু হেসে কিরণকে বলল,

—” তোমার পিতা-মাতা কি বেঁচে আছে কিরণ?”

কিরণ আবাক হলো। পরপরই শান্ত কণ্ঠে মাথা নিচু করে বলল,

—” আছে।”

চন্দ্রা ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠল,

—” তুমি কত ভাগ্যবান কিরণ। তাদের সাথে হয়তো অনেক আনন্দ করো তাই না? এই ‘আমি’ নামক অভাগীকে দেখো। তার পিতা-মাতা কেউ নেই। একদম একা সে। একদম!”

কথাটুকু বলতে বলতে চোখে জল এসে ভিড়ল চন্দ্রার। গাল গড়িয়ে পরার পূর্বেই হাত দিয়ে মুছে ফেলল সে। কিরণ খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল,

—” ক্ষমা করবেন রাণী। একটা কথা বলার ছিল।”

—” বলো! কিন্তু পরেরবার রাণী বলে সম্মোধন করবে না। আমি কোনো রাজ্যের রাণী নই। আমি আমার পিতার রাজ্যের রাজকুমারী। রাজকুমারী বলবে আমায়।”

—” কিন্তু….!”

চন্দ্রা চোখ তুলে তাকালেন কিরণের দিকে। কঠিন স্বরে বললেন,

—” তুমি কি আমার কথার বিরুদ্ধে যাচ্ছো কিরণ?”

কিরণ ভীত হয়। দ্রুত বলে উঠে,

—” না,না রাজকুমারী। ক্ষমা করবেন আমায়।”

চন্দ্রা তার চোখ আবারও স্থাপন করে মোমবাতিটির দিকে। বলে ওঠে,

—” কি বলবে বলেছিলে বলো।”

—” আসলে রাজকুমারী, সম্রাট বাহির থেকে যেমনই হোক। মন থেকে ভীষণ ভালো। উনি আপনাকে সুখে রাখবেন।”

এক মুহুর্তের জন্য চোয়াল শক্ত হয়ে এলো চন্দ্রার। পরপরই তাচ্ছিল্যের সঙ্গে হেসে বলে উঠলেন চন্দ্রা,

—” মিথ্যে সব কিরণ, সব মিথ্যে! তুমি বেড়িয়ে যাও তো কক্ষ থেকে। তোমাকেও বিরক্ত লাগছে আমার।”

কিরণ মাথা নত করে নিঃশব্দে বেড়িয়ে যায় কক্ষ থেকে। চন্দ্রা কান্নায় ভেঙ্গে পরেন পরক্ষণেই।

খানিকবাদ হঠাৎ কারো স্পর্শ মাথায় পেতেই চমকে যান চন্দ্রা। মাথা তুলে তাকাতেই দেখেন রুদ্র বাঁকা হেসে তাকিয়ে আছেন তারই দিকে। চন্দ্রা এক ঝটকায় হাত সরিয়ে ক্রোধিত কণ্ঠে বলে উঠল,

—” ছুঁবেন না আমাকে।”

—” অধিকার আছে।”

—” আমি মানি না।”

এবার খানিকটা কাছে এগিয়ে এলেন রুদ্র। চন্দ্রার কানে ঠোঁট লাগিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে উঠেন,

—” মানতে হবে। বাধ্য তুমি। তাছাড়া আমি তো নির্দোষ! প্রমাণ পেয়েছো তুমি।”

—” হুম পেয়েছি। কিন্তু আপনি নির্দোষ হোন আর যাই হোন, আমি আপনাকে ভালোবাসি না, কখনো ভালোবাসবও না। কেননা, আপনি আমার রাজ্য আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন।”

রুদ্র ভ্রু কুঁচকে বললেন,

—” ব্যাস! এতটুকুই কারণ?”

সঙ্গে সঙ্গে চন্দ্রা কঠিন কণ্ঠে বলে উঠলেন,

—” আপনি অমানুষ, নারী লোভী, নিষ্ঠুর, নির্মম, নির্লজ্জ, পাষাণ সম্রাট। এমন কাউকে আমার জীবন সঙ্গী হিসেবে আমি ভাবি নি নিশ্চয়ই। এবং মনে রাখবেন, আমার পিতা-মাতা, কিরণ সবার মৃত্যুর জন্য আপনিই কোনো না কোনো ভাবে দায়ী।”

রুদ্র ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠলেন,

—” অবশ্যই আমি জ্ঞাত এ বিষয়ে। কিন্তু তুমি চাইলে পাল্টাতে পারবে আমায়। নিজের মতো গড়ে তুলবে।”

—” ইহা আপনার দুঃস্বপ্ন সম্রাট।”

রুদ্র বিরক্তি প্রকাশ করলেন এবার। এক হাত দিয়ে চন্দ্রার গাল চেপে নিজের মুখের একদম কাছে নিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

—” রুদ্র কখনো দুঃস্বপ্ন দেখে না রাণী চন্দ্রপ্রভা।”

রুদ্রের হাত সরাতে চেষ্টা করলে চন্দ্রা। ব্যর্থ হলেন প্রতিবারের মতোই। হার মেনে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,

—” আমি কোমো রাণী নই সম্রাট। কূঞ্জনরাজ্যের রাজকুমারী আমি।”

—” উহু! এই রুদ্রের সম্রাজ্ঞী এবং এই সম্রাজ্যের রাণী চন্দ্রপ্রভা তুমি। আমার চন্দ্রপ্রভা।”

বলেই চন্দ্রাকে আর সুযোগ দিলেন না রুদ্র। কোলে তুলে জানালার অগ্রে দাঁড় করালেন তাকে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চন্দ্রার কানে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

—” তুমি আমার চন্দ্রপ্রভা। শুধুই আমার।”

চন্দ্রা কেন যেন আর নড়তে পারছেন না। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। রাগ, জেদ এবং ভয় জেঁকে বসেছে তার ভেতর। অতীব বিরক্তি নিয়ে চন্দ্রা বলে উঠল,

—” আপনার ভেতর সব ছলনা সম্রাট। সত্য মিথ্যা ঘেড়া মায়াজাল!”

রুদ্র শান্ত কণ্ঠে বললেন,

—” কি ছলনা আছে আমারর ভেতর?”

চন্দ্রা খানিক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

—” এই যে আমার সাথে যা করছেন। আচ্ছা! রত্নমা তো আপনাকে ভালোবাসত। হত্যা করলেন কেন ওকে?”

রুদ্র স্বাভাবিকভাবে বলে উঠলেন,

—” তোমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল ও।”

—” হত্যা তো করেনি।”

রুদ্র চন্দ্রার কেশে নাক ডোবানো বন্ধ করে ভ্রু কুঁচকালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন,

—” তোমার কি মনে হয় আমি অপেক্ষা করতাম ও কখন তোমাকে হত্যা করবে আর আমি তোমার মৃত্যুর পর ওকে শাস্তি দিবো? মোটেও না। আর হ্যাঁ! ও কখনো আমাকে ভালোবাসে নি। ওর লোভ ছিল এ রাজ্যের রাণী হবে। হয়েছে! কিন্তু আমার থেকে সে মর্যাদা কখনো পায় নি। আর না পেতো ভবিষ্যতে।”

—” তাই বলে ওকে হত্যা করবেন?”

—” উহু! হত্যা করতে চাই নি আমি। বাধ্য হয়েছি!”

—” কিরুপ?”

—” বলেছি একবার! তোমার যে ক্ষতি করবে বা করতে চাইবে তাকে হত্যা করতে পিছাবো না আমি।”

এ কথার পিঠে আর কথা বললেন না চন্দ্রা। আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। বুকের ভেতরটায় অস্থির লাগছে তার। রুদ্রের স্পর্শে কেঁপে উঠছে বারংবার। আর সহ্য করতে না পেরে চন্দ্রা কঠিন কণ্ঠে বলে উঠেন,

—” দূরে সরুন সম্রাট।”

—” উহু! সম্রাট নয়। বলো রুদ্র।”

চন্দ্রা প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,

—” সরুন।”

—” আগে বলো তারপর।”

—” আমার নিদ্রা আসছে।”

রুদ্র মুখ তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালেন চন্দ্রার পানে। হুট করে কোলে তুলে নিলেন চন্দ্রাকে। এক মুহুর্তের জন্য হতভম্ব হয়ে গেলেন চন্দ্রা। পরক্ষণেই কি হয়েছে বুঝতে পেরে চেঁচিয়ে উঠলেন। কিন্তু এতে বিশেষ ভাবগতি হলো না রুদ্রের। সে তার মতো করে চন্দ্রাকে নিয়ে শয্যায় শুইয়ে দিলো। পরপরই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন রুদ্র। এদিকে রুদ্র চন্দ্রাকে এহেন ভাবে জড়িয়ে ধরেছেন যে চন্দ্রা নড়তেই পারছেন না। তবুও খানিকটা প্রয়াস করতেই রুদ্র চন্দ্রার গলায় মুখ ডোবানো অবস্থায় মৃদু ও ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে বলে ওঠেন,

—” আর একবার নড়াচড়া করলে কিন্তু অঘটন ঘটিয়ে ফেলব চন্দ্রা। চুপচাপ ঘুমাও।”

চন্দ্রা বেকুবের মতো রুদ্রকে দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু রুদ্রের মুখ তার কেশের আড়ালে ঢেকে গেছে। তাই সেই ব্যর্থ চেষ্টা বাদ দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করতে লাগলো সে। তবে এভাবে কি ঘুমানো যায়? রুদ্রের ঘনঘন নিশ্বাস পরছে চন্দ্রার গলায়। শিহরিত হচ্ছে চন্দ্রা। সাথে প্রশ্নও জাগছে মনে- “এত দ্রুত কি কেউ ঘুমাতে পারে? তাও আবার কাউকে এভাবে শক্ত করে ঝাপটে ধরে!”

___________________

সকালের প্রথম প্রহরেই চন্দ্রার নিদ্রা ছুটে যায়। চোখ খুলে তাকাতেই অবাক হোন তিনি। সাথে চমকে যানও বটে। কেননা তার সামনে কেদারায় বসে রুদ্র আপেল খাচ্ছেন। কেমন করে যেন হাসছেন তিনি। যার বোধগম্য নয় চন্দ্রা। বিরক্তি নিয়ে রুদ্রের দিকে একবার তাকিয়ে শয্যা ছেঁড়ে উঠে দাঁড়ালেন চন্দ্রা। স্নানাগারের দিকে যাওয়ার পথে হঠাৎ তার চোখ গেল পার্শ্বে থাকা দর্পনে(আয়নায়)। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠে চেঁচিয়ে উঠলেন চন্দ্রা। রুদ্রের হাসি যেন প্রবল হলো এবার। চন্দ্রা ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন দর্পনের দিকে। এবার রাগে চোখ লাল হয়ে এলো তার। কেননা কালো রঙ দিয়ে তার পুরো মুখশ্রীতে আঁকা-আঁকি করা হয়েছে। চন্দ্রা নিশ্চিত, এটা রুদ্রেরই কাজ!

____________চলবে____________
Maya Mrinalini, Afrin Shuvra, Anazha Khan সহ সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ❤
Ishanur Tasmia

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here