শ্রাবণ_দিনের_বৃষ্টিতে পর্ব ৬

#শ্রাবণ_দিনের_বৃষ্টিতে 🖤
#পার্ট_৬
#Writer_Liza_moni

আয়রা হিতৈষীর হাত ধরে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে এলো।হিতৈষীর কোলে মাথা রেখে বলতে শুরু করল,,,

“সেদিন,,,
আয়জা আপু সবে ১০ম শ্রেনীর ছাত্রী। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হওয়ার ফলে অনেক বিষয়ের টিউশনি পড়তে হয় তাকে। পদার্থ বিজ্ঞান পড়ে বাড়িতে ফিরতে দেরী হয়ে গেছিলো তার। আমি তখন মাত্র ক্লাস 7 এ পড়ি।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল কিন্তু আপু বাড়ি ফিরে আসেনি। শ্রাবণের দিন ছিল। বৃষ্টি পড়ছিল মুষলধারে। আমরা তখন বান্দরবানে নতুন এসেছি। বছর খানেক হয়েছিল বটে।আপুকে ফিরতে না দেখে চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিল আম্মু।
সেদিন বাড়ি ফেরার পথে ৫ জন মাতাল বখাটে ছেলের কবলে পড়ে আমার আয়জা আপু।

আয়রা থামলো। আয়জা কে খুব খুব বেশি মনে পড়ছে তার। চোখ ভিজে আসছে।
আয়রা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবার ও বলতে শুরু করলো,,,

পাহাড়ি এলাকা। সুনসান রাস্তার ধারে হাঁটছিল আয়জা আপু। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে।ছেলে গুলো বাঙালি ছিল না। চাকমা দুই জন,আর মারমা তিন জন ছিল।
মাতাল বখাটে ছেলে গুলো আমার বোন কে সেদিন রাতে শেষ করে দিয়েছিল।

আমার বোনের সাথে খুব খারাপ কাজ করে ছিল তারা। জোর পূর্বক ধর্ষণ করে দুনিয়ার থেকে বিদায় হয়ে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে। বিধ্বস্ত অবস্থায় আমার বোন বাড়িতে ফিরে আসে।এক দম চুপ হয়ে যায় ও। সেদিন রাতেই সুইসাইড নোট লিখে ফ্যানের সাথে ওড়না গলায় ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করে আমার বোনটা।”

আয়রার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। হিতৈষীর চোখ থেকে ও আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে।

ধর্ষণ শব্দ টা শুনলেই কলিজা ছিঁড়ে যায় আয়রার। সেদিন যখন প্রান্ত বলে ছিল তখন যেনো আয়রার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

জানিস হিতৈষী আপু,, আমার আয়জা আপু টা এই সমাজের মানুষের জন্য আত্মহত্যা করেছে। সকাল হলে এই সমাজের মানুষ তার দিকে আঙুল তুলে মানুষ কে দেখিয়ে বলবে আমার বোন ধর্ষিতা।
ও এই সব সহ্য করতে পারতো না।এই জন্য এই ভুল পথ বেছে নেয়। আমাদের দেশে ধর্ষকের শাস্তি হয় না। সেই ছেলে গুলোর নামে মামলা করা হয়ে ছিল। পুলিশ মাত্র দুই দিন ওদের লকাপে আটকে রেখে ছিলো।মাত্র দুই দিন।

হিতৈষী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,, আয়জা সুইসাইড নোটে কী লিখেছিলো আয়রু?

আয়রা শোয়া থেকে উঠে বসলো। হাতের তালু দিয়ে চোখের পানি মুছে বললো,,
আয়জা আপু দুই টা চিঠি লিখে গিয়েছিল।

একটা আমাদের জন্য আরেকটা তার কিশোরী বয়সের প্রেমিক রাফি ভাইয়ের জন্য।

আমাদের জন্য লিখা চিঠি টা ছিল,,,

“প্রিয় আম্মু, আব্বু,আর আমার কলিজার টুকরা ছোট বোন আরু,,,

জানো আমার জীবনটা না এক মুহূর্তে নষ্ট হয়ে গেছে। আমার নামের সাথে যোগ হয়ে গেছে ধর্ষিতা।হ্যাঁ আমি ধর্ষন হয়েছি। আম্মু, আব্বু আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি তো সুন্দর একটা জীবন চেয়েছি। আমি বাঁচতে চেয়েছি। আমার সাথে কেন এমন হলো? আমি অনেক চেষ্টা করেছি নিজের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য। কিন্তু ঐ নরপশু গুলো আমাকে বাঁচতে দেয়নি। আমাকে শেষ করে দিয়েছে।আরু সোনা বোন আমার। আমার মতো ভুল কখনো করিস না।একা একা কখনও বাড়ি ফেরার শাহস করিস না সন্ধ্যা বেলায়। আমি চাই না বোন আমার সাথে যা হয়েছে তোর সাথে ঠিক তেমন হোক। আল্লাহ মাফ করুক।
আমি এই সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবো না। সমাজের মানুষ আমাকে দেখিয়ে বলবে আমি ধর্ষিতা। আমি কী করবো বলো? আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তোমাদের ছেড়ে যেতে। আমি তো অনেক গুলো বছর তোমাদের সাথে থাকতে চেয়েছিলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।আরু কে দেখে রাখবে কিন্তু।ওর সাথে যেন এমন কিছুতেই না হয়। আমি আকাশের চাঁদ হয়ে তোমাদের দেখবো।
আম্মু, আব্বু,আরু সোনা বোন আমার,, তোমাদের ভীষণ ভালোবাসি।

ইতি
তোমাদের অভাগী ধর্ষিতা মেয়ে আয়জা,,,,
.
.
চিঠির কথা গুলো বলতে বলতে হিতৈষী কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল আয়রা। হিতৈষী ও কান্না করছে।নিরব কান্না।চাইলে ও ফুঁপিয়ে কান্না করতে পারছে না আয়রা।মা যদি শুনতে পায় তাহলে এখানে চলে আসবে।কান্নার কারণ যে আয়জা যদি জানতে পারে তাহলে তিনি ও কান্না করবেন।আয়জার মৃত্যুর দিন হার্ট অ্যাটাক করেন আয়রার মা। তখন থেকেই খুব প্রেশার দেয়া যায় না তাকে।

আয়রা হিতৈষীর কাছ থেকে সরে এসে চোখের পানি মুছলো।

রাফি ভাইয়ের জন্য লেখা চিঠিটা ও পড়েছি আমি। মনে আছে মোটামুটি। অন্য দিন বলবো তোকে সেই চিঠির কথা।আজ আর মুখ দিয়ে বের হবে না। সামনের মাসের ২ তারিখ আয়জা আপুর মৃত্যুর ছয় বছর পূর্ন হবে।আজ তো ২৫ তারিখ,,,, বেশি দেরি নেই।

আয়রা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।

কোথায় যাস?

রুমে।ভালো লাগছে না এখন।
আয়রা হিতৈষীর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। হিতৈষী কিছু বললো না।সবার জীবনেই কিছু না কিছু হারানোর যন্ত্রনা থাকে। যেমন আমি আমার পুরো পরিবার কে হারিয়ে ফেললাম।
.
.
.
পরের দিন সকালে মোবাইলের এলার্মের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রান্তর। ঘুম ঘুম চোখে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সকাল ৫ টা। শোয়া থেকে উঠে ওয়াস রুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। ফজরের নামাজ ঠিক মতো কোন দিন পড়তে পারছে একদম মনে নেই তার।ওয়াস রুম থেকে অযু করে বের হয়ে আসে। মসজিদ আয়রাদের বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না প্রান্তর।

রুম থেকে বের হয়ে দেখলো সদর দরজা খোলা। বাইরে বের হলো সে। একটা মাঝারি সাইজের উঠান।
উঠানের একপাশে বাগান বিলাস গাছ।তার পাশেই বেলি ফুল গাছ।বেলি ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চার দিকে। আয়রা কে বেলি ফুল কুড়াতে দেখে প্রান্ত বললো,,,

এই পিচ্চি শুনো,,,

আয়রা মাথা তুলে একবার দেখলো প্রান্ত কে।বিড়বিড়িয়ে বললো,,আমাকে যে কোন দিক দিয়ে পিচ্চি মনে হয় কে জানে?

আয়রা প্রান্তর দিকে এগিয়ে এসে বললো ,,
আমাকে দেখে কী আপনার পিচ্চি বাচ্চা মেয়ে মনে হয়?

প্রান্ত শয়তানি হেসে বললো,,,
পিচ্চি বাচ্চা মেয়ে মনে হয় বলেই তো বললাম।বাই দা ওয়ে,, আমাকে একটা জায়নামাজ দাও তো ,,, নামাজ পড়বো,,,

আয়রা ভ্রু কুঁচকে চার দিকে তাকালো। না এখনো আলো ফুটেনি ভালো করে। নামাজের সময় আছে।

আয়রা বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে বললো,,
আসুন আমার সাথে,,,

প্রান্ত বাদ্য ছেলের মত আয়রার পিছনে পিছনে চলে গেল। আয়রা নিজের জায়নামাজটা প্রান্তর হাতে দিয়ে বললো,, নামাজ শেষে আবার আমাকেই ফেরত দিবেন।

প্রান্ত একটা ধন্যবাদ দিয়ে রুমে চলে গেল। নামাজ পড়তে তার ভালোই লাগে। কিন্তু সময়ের অভাবে ঠিক মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা হয় না।
.
.
৯ টার দিকে আয়রা যখন কলেজে যাওয়ার জন্য একদম প্রস্তুত ঠিক তখনই আয়রার মা এসে জানালো,,
আজ কলেজে যেতে হবে না। হিতৈষী কে ও ভার্সিটিতে যেতে দেয়নি।

কেন আম্মু? সামনে আমার এইচএসসি পরীক্ষা।আর এখন বলছো কলেজ না যেতে?

প্রান্ত কে আজ তুই আর হিতৈষী একটা জায়গায় নিয়ে যাবি।

কোন জায়গায়?

আলি কদম ঘুহা,,আলি কদম সেনানিবাস,,চিংড়ি ঝর্ণা,, মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র,,,

আমাদের জেলা পরিষদ থেকে তো এগুলো মোটামোটি অনেক দূরে।

তুই তো কলেজ থেকে পিকনিকে সেখানে গিয়েছিলি,, হিতৈষীকে নিয়ে,, তুই তো মোটামোটি অনেক জায়গা চিনিস।

ভালোই হলো। অনেক দিন ঘুরতে যাওয়া হয় না। আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। হিতৈষী আপুকে ও তৈরি হয়ে নিতে বলো।

মা চলে গেলে আয়রা ডেভিল মার্কা হেসে বললো,,
মিস্টার ক্রাশ তোমারে মজা আমি দেখামু,, আমাকে বাচ্চা মেয়ে বলা,,আর চড় মারা না,, দাঁড়াও,,,চান্দু,,,,
আয়রা যে কী সেটা তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারবে।

চলবে,,,, 🍁

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here