সুখপাখির খোঁজে পর্ব ৬

#সুখপাখির_খোঁজে 💔
#লেখনিতে_সুমাইয়া_ইসলাম_মিম
#পর্ব_৬
.
ড. আবদুল্লাহ এর কেবিনে ড. ইরামের মুখোমুখি থমথমে হয়ে বসে আছে ইয়াসিন। তার নিজেকে এই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম প্রানী মনে হচ্ছে। ইয়াসিনের এমন ভোলাভালা ব্যবহার কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না ড. ইরাম! তার চোখমুখে রাগ ফুটে আছে। বেশ ঝাঁঝালো গলায় বলল,

-“আপনার মতো কেয়ারলেস হাসবেন্ড আদো দেখেছি কি না সন্দেহ আছে! আপনার ওয়াইফ একজন মানসিক রোগী, আপনি জানেন?”

ইয়াসিন অবাক চোখে ড. ইরামের দিকে তাকালো।

-” নাহ! আমি জানতাম না। নাদিরাকে ঔষধ খেতে দেখে কয়েকবার জিজ্ঞাসা করেছি কিন্তু ও আমাকে কিছুই বলেনি!”

ড. ইরাম চটে গিয়ে বললেন,

-“কেমন স্বামী আপনি? আপনার কোন অধিকারবোধ নেই?”

ইয়াসিন কথা ঘুরিয়ে বলল,

-“নাদিরার ঠিক কি হয়েছে বলবেন?”

ড. ইরামের ইচ্ছে হচ্ছিলো এখানেই ইয়াসিনকে পুতে দিতে! কিন্তু সে নিরুপায়। টেবিলে জোরে একটা শব্দ করে সে উঠে জানালার পাশে দাঁড়ালো। তারপর নিজেকে শান্ত করে বলতে শুরু করলো,

-” নাদিরা অ্যাংজাইটি ডিসওর্ডারের পেশেন্ট!

অ্যাংজাইটি ডিসওর্ডার এইরোগের রোগীরা সবসময় একটা অপ্রীতিকর কিছূ ঘটার ভয়, ফলে মানসিক চাপ এবং তার ফলে নানারকম শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয় অ্যাংজাইটি অনেক মনরোগে থাকতে পারে তবে এই রোগে প্রধান লক্ষণই হল আতঙ্ক।

কারণ বলতে গেলে কিছূটা জিনেটিক আর শৈশবে কোন ভীষণ ভয়ংকর অভিজ্ঞতা শিশুদের মনে চিরস্থায়ী আতঙ্কের কারণ হয়ে দাড়ায়।

প্রধান লক্ষণ আতঙ্ক বা উদ্বেগ, রোগীর মনে সব সময় একটা ভাব কখন কি হয়? কিন্তু এই “কিছু” সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব। এই আতংকভাব তরুণ বয়স থেকে শুরু করে সারাজীবন চলতে থাকে।”

কিছুক্ষন থেমে ড. ইরাম আবার বলতে শুরু করলো,

-“নাদিরাকে বহুবার জিজ্ঞাসা করেছি, ওর অতিতের অনেক কিছু জানলেও এটা জানতাম না ওর আসল ভয়, আতংকই ছিলেন আপনি! স্বাভাবিক ভাবে কোন মানুষ তার স্বামীর বা স্ত্রী এর এতোটা অবহেলায় মানসিক রোগী হয়ে যাবে। কারণটা মানসিক অশান্তি! আমি জানি না নাদিরা আর আপনার সম্পর্ক কেমন! কিন্তু নাদিরার অবস্থার অবনতির কারণটা অবশ্যই বুঝতে পারছি!”

কথাগুলো বলে একটা নিশ্বাস ছাড়লো ড. ইরাম। তার বড্ড কষ্ট হচ্ছে, কিছু না পাওয়ার কষ্ট, কিছু হারাবার কষ্ট, আর তার এক তরফা ভালোবাসাকে কষ্টে দেখে তার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো জানালার পাশে।

.
নাদিরার কেবিনের সামনে বসে আছে ইয়াসিন। লাবনি খবর পেয়ে এসেছে। নাদিরাকে এভাবে দেখে সে একদম ভেঙে পড়েছিলো। লাবনির হাসবেন্ড তাকে সামলেছে। লাবনি নাদিরার ছোটবেলার বেস্টফ্রেন্ড। তার খুঁটিনাটি সবই সে জানে। ইয়াসিন এর পাশে লাবনির হাসবেন্ড মিস্টার রিশাদ বসা। সে ইয়াসিনকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“লাবনি নাদিরার ব্যাপারে খুব বেশিই পসেসিভ। আর নাদিরা আমার কাছে আমার ছোট বোনের মতো। আপনাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক না জেনে লাবনি অনেকবার নাদিরাকে বলেছে আমাদের কাছে চলে আসতে কিন্তু সে আসে নি। হয়তো আপনার প্রতি তার ভালোবাসাটাই ছিল পিছুটান! সে আপনাকে বড্ড বেশিই ভালোবাসে।”

ইয়াসিন কোন কথা বলে নি সে শুধু শুনেছে। আজ তার ভুলেই তাকে কথা শুনতে হচ্ছে। এর মধ্যে নাদিরার কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে লাবনি। নাদিরার স্যালাইন শেষ। তাকে এখন টেস্ট করাতে নিয়ে যাবে। লাবনি এসে ইয়াসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ গলায় বলল,

-“অনেক করেছেন আমার বোনের জন্য, আর আপনার সময়ের প্রয়োজন হবে না। আপনি আসতে পারেন।”

ইয়াসিন অবাক চোখে লাবনির দিকে তাকায়।

-“আমি কেন চলে যাবো? সে আমার স্ত্রী!”

লাবনি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

-“সিরিয়াসলি? এটা মজা করার সময় না। আর এমনও নয় যে আমি আপনাদের সম্পর্কের কথা কিছু জানি না! সবটাই জানি! কেন এখনো নাটক করে চলেছেন?”

ইয়াসিন একটা শ্বাস ফেলে বলল,

-“তুমি কিছুই জানো না লাবনি! আচ্ছা আমাকে নাদিরার অতিত সম্পর্কে বলো তো! আমি জানি না নাদিরার অতিত কি! ওর মামারা আমাকে কিছুই জানায় নি।”

লাবনি ভ্রু কুঁচকে ইয়াসিনের দিকে তাকালো। তার কাছে ইয়াসিনকে এই মুহূর্তে সব থেকে বিরক্তিকর মানুষ বলে মনে হচ্ছে। কিছু কড়া গলায় বলতে যাবে তার আগেই রিশাদ লাবনির হাত ধরে নাদিরার সম্পর্কে বলতে বলে। লাবনি রিশাদের পাশে বসে বলতে শুরু করলো,

-” আমি আর নাদু সেই তিনবছর বয়স থেকেই ফ্রেন্ড। বলতে গেলে আমাদের ছোটবেলা একসাথেই কেটেছে। আমাদের বয়স যখন পাঁচ, আমরা মোটামুটি সবই বুঝি। নাদিরার বাবা আর মায়ের খুব মিল ছিলো। আংকেল আন্টিকে ছাড়া আর আন্টি আংকেল কে ছাড়া চলতে পারতো বললেই চলতো। কিন্তু আস্তে আস্তে আংকেল এর মধ্যে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। প্রথমত অবহেলা, পরবর্তীতে ঝগড়া সৃষ্টি করে। কারণ ছিলো আংকেল কোন এক পরনারীর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। আন্টি বিষয়টা মানতে পারে না। সে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে। আর নাদিরার বয়সই কত ছিলো? সে ছোট থেকে বাবা মায়ের এমন আচরণ দেখে প্রতি মুহূর্তে আতংকে থাকতো। সেসময় আমিও ছোটই ছিলাম তাই ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কিছুই বুঝতাম না, কিন্তু আমি ওকে ছেড়ে যাই নি। ছোট থেকেই ও ভালোবাসার কাঙাল। এক মুহূর্তে আংকেল আর আন্টির ডিভোর্স হয়ে যায়। যদিও আন্টি খুব নরম মনের ছিলো। সে আংকেল কে প্রচন্ড ভালোবাসতো, আংকেলকে ডিভোর্স দিতে চায় নি, কিন্তু আংকেল এক প্রকার জোর করেই ডিভোর্স নেয়। কিন্তু হয়তো নিয়তিই অন্যরকম ছিল। ডিভোর্সের পরপরই আন্টি হার্ট অ্যাটেক করে, আর আংকেল এর এক্সিডেন্ট হয়। আর দুজনেই একই দিনে পৃথিবী ত্যাগ করে। তারপর থেকেই নাদিরা আস্তে আস্তে ট্রমার মধ্যে চলে যায়। নাদিরার দায়িত্ব তার মামারা নিলেও কোন দায়িত্বই তারা পালন করে নি। তাদের লোভ ছিল নাদিরার সম্পত্তির প্রতি। আপনাদের বিয়ের সময় নাদিরাকে লোভ দেখানো হয়! কিসের জানেন? ওকে বলা হয় সে তার কাঙ্খিত ভালোবাসা আপনার থেকে পাবে। আপনি তাকে ভালোবাসেন! নাদিরা বড্ড বোকা! সে আপনার ভালোবাসার লোভে নিজের সব সম্পত্তি তার মামাদের নামে করে দেয়। আর বিয়ের পর আপনিও ওকে শূন্যহাতেই ফিরিয়ে দেন। বোকাটার কাছে না রইলো একূল আর না রইলো ওকূল! বিয়ের পর থেকে ওর মানসিক সমস্যা আরো বেশি দেখা দেয়। কারণটা নিশ্চয়ই অজানা নয়!”

লাবনি বলার আগেই মাথা নিচু করে ইয়াসিন বলে,

-“আমার অবহেলা!”

লাবনি তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

-“বুঝতে পারছেন আপনি?”

মনে মনে ইয়াসিন একটা কথাই বলে সে সবটা বলবে নাদিরাকে।

,
,
,
চলবে………………..❣️

(আজকেই যত পারো ইয়াসিনকে গালি দিয়ে নাও! পরে যদি মায়া হয়!😁)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here