সেদিনও ছিলো তুমি পর্ব ৩

#সেদিনও_ছিলে_তুমি❤
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৩

৬.
আমার ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। লোকটার কোনো বদ মতলব নেই-তো? আমার সাথে এরকম করার কোনো মানে আছে নাকি? রাগের মাথায় থাপ্পড় দিয়ে ক্ষমাও তো চেয়েছি, কিন্তু ওনি বোধহয় ব্যপারটা হজম করতে পারছেন না। আসলে বড়লোকের ছেলে বলে কথা, তাদের মেজাজই আলাদা। তারওপর ভার্সিটিতে উনার আলাদা পাওয়ার আছে, যেটা বাপের নাম বিক্রি করে নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়ে অর্জন করেছেন। তা-ই সবাই সমীহ করে চলে ওনাকে, কিন্তু আমি এখন কি করবো? উপস্থিত বুদ্ধি আমার কখনোই কাজে লাগেনা, সে চেষ্টা করাও এখন আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অসহায়ের মতো একদৃষ্টিতে ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম আর মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম।

ওনি আমার সামনে একটা চেয়ার তুলে এনে বসলেন। আমি ফ্লোরে গুটিশুটি মেরে বসে আছি। কাঁদছিনা, কারণ চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি পড়ার আগেই ওনি ধমকে ওঠেন বারবার। আমি কান্না করার সময় একবারও আমার মুখের দিকে তাকাননি, অন্যদিকে ফিরে শক্ত গলায় বলে ওঠেন, ‘চোখের পানি মুছো, নইলে ফল ভালো হবেনা। শাস্তি তো শুরুই হয়নি!’

আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘ক ক ক্ক কিসের শাস্তি?’

ওনি হুংকার ছেড়ে বলেন, ‘আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই!’

—“আপনি কি আমাকে মারবেন?”

—“তোমার কি আমাকে বাচ্চা মনে হচ্ছে? শুনে রাখো, আমি মেয়েদের গায়ে হাত দিইনা। তাছাড়া তোমাকে কিভাবে টর্চার করবো সেটা আমার ভাবা হয়ে গিয়েছে।”

—“আমি তো ক্ষমা চাইলাম আপনার কাছে, স্যরি বললাম তো! তাহলে এরকম করছেন কেন?”

ওনি কপাল কুঁচকে তাকালো। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো, ‘স্যরি মাই ফুট! তুমি আমাকে থাপ্পড়
মারবে আর আমি আদ্র চুপচাপ বসে থাকবো তাই না? তাহলে বলবো, তুমি আমাকে এখনো ঠিক চিনতে পারোনি!’

আমি নীরবে কেঁদে উঠলাম। চোখ থেকে দু’ফোটা পানি বের হয়ে আসলো। ওনার অলক্ষ্যেই আমি ওড়না দিয়ে মুছে নিলাম। হাতগুলো বাঁধা নয়, ইচ্ছে করলেই আমি পালাতে পারি। কিন্তু আব্রাহাম আদ্র এতোটাও বোকা নন, তাই ক্লাসের দরজাটা ভেতর থেকে তালা দিয়ে চাবি নিজের কাছেই রেখে দিয়েছেন। চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে রইলাম, ওনিও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছেন। জানালা গলে আসা হিম বাতাস বারবার আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিলো। একটা ছেলের সাথে, একই রুমে একা আমি, ছিহ,, কেউ জানতে পারলে কি হবে আমি ভাবছি! সবাই আমাকেই খারাপ ভাববে।

৭.
এভাবে প্রায় বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেলো। সন্ধ্যা নেমে আসছে বোধহয়, তাহলে তো ভার্সিটিও ছুটি হয়ে গিয়েছে। আমার হঠাৎ হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমার মাথা ঘুরাচ্ছে, গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা। প্রচুর পানি খেতে ইচ্ছে করছে। ওনি একমনে মোবাইল টিপাটিপি করছেন। নড়ার শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলার আগে আমি কোনোমতে বললাম, ‘শুনছেন?’

ওনি না তাকিয়েই বললেন, ‘শুনছি।’

—“আমাকে প্লিজ ছেড়ে দিন। আমাকে হোস্টেলে যেতে দিন!”

—“সেটা আজ আর হয়ে উঠছেনা!”

আমি অসহায় কন্ঠে বললাম, ‘আমার সঙ্গে এরকম করে আপনার লাভটা কি?’

ওনি আগেই মতোই, যেন কিছু হয়ইনি এমনভাবে বললেন, ‘তোমাকে শাস্তি না দিতে পারলে আমি আজ রাতে ঘুমাতেই পারবোনা, বুঝলে? আমাকে কেউ এভাবে অপমান করে শান্তিতে ঘুমাবে, তা এই আদ্র কখনোই টলারেট করতে পারবেনা।’

আমি আর কিছু শুনতে পেলাম না। হঠাৎ লোডশেডিং হলো, গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা পড়ে গেলো ক্লাসটা, ঢেকে গেলো আমার সামনে থাকা মানুষটা। আমি দুর্বল গলায় একটা আত্মচিৎকার দিয়ে উঠলাম। অন্ধকারে আমার ফোবিয়া আছে, অন্ধকার সহ্য হয়না। আদ্র চমকে উঠে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে আমার দিকে তাকালো। গাঢ় অন্ধকারে ওনাকে আমি মনে মনে আত্মার’ সাথে তুলনা করছি। বাতাসে ওনার চুল কপালে পড়ে অর্ধেক মুখ ঢেকে একটা ভয়ংকর প্রতিবিম্ব দেয়ালে ফুটে উঠেছে। যদিও ওনি দেখতে মোটেও ভয়ংকর নন।

৮.
আমি ঠকঠক করে কাঁপছি। আদ্র আমাকে এভাবে কাঁপতে দেখে অবাক চোখে তাকালো। আমার কাছে এসে হাটু গেড়ে ফ্লোরে বসে আমার গালে হাত রেখে বললো, ‘কি হয়েছে তোমার? এই মেয়ে?’

আমি উত্তর দিলাম না।

ওনি আবারও উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন, ‘এই আরশি? এই তুমি এভাবে কাঁপছো কেন?’

আমি এবার কাঁপতে থাকা হাতটা হাতটা দেয়ালের দিকে উঁচিয়ে দেখালাম। ওনি পেছনে ঘুরে দেখলেন। আমি অস্পষ্ট গলায় বললাম, ‘ও ও ওখখানে কে কেউউ আছে!’

ওনি হয়তো বুঝতে পারলেন আমি কিছু একটা দেখে ভয় পাচ্ছি। তাই ওনি আমাকে বললেন, ‘ওখানে কিছু নেই আরশি!’

—“আ আছে!”

—“কেউ নেই আমি আর তুমি ছাড়া। তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো!”

আমার মাথা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। সামনে তাকানোর সাহস হচ্ছেনা।আমি ভয়ে কেঁদে দিলাম। চোখ দুটো বন্ধ করে বললাম, ‘আ আপনি ক এ এ কে? আপনি নাম নিশ্চয়ই অন্যকেউ? আমাকে প্লিজ ভয় দেখাবেন না, আমাকে ছেড়ে দিন!’

আমি যখন ভয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে ওনাকে এসব উল্টোপাল্টা বলছি তখন ওনি আমাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বারবার বুঝানোর চেষ্টা করছেন ‘যে কিছু হয়নি, আমি যাতে ভয় না পাই!’

কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। এক নাগাড়ে এসব বলেই যাচ্ছি। আমার চোখের পানি ওনার পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। ওনার বুকে মাথা রেখে আমি যেন ওনার হার্টবিটের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। হৃদস্পন্দনের শব্দটা খুব জোরে কানে বাজতে লাগলো। তারপর হঠাৎ পিনপতন নীরবতা গ্রাস করলো অন্ধকার ওই ক্লাসরুমটাতে। আমি ধীরেধীরে জ্ঞান হারাতে লাগলাম। জ্ঞান হারানোর আগে শুধু বলতে পারলাম, ‘পানি, পানি খাবো!’

এরপর আমার আর কিছু মনে নেই।

৯.
রোদের চিকচিক আলো যখন আমার মুখটার ওপর ছুরির মতো ধারালো আলো ফেললো, ঠিক তখনই আমার জ্ঞান ফিরলো। মাথাটা ভার হয়ে আছে, আশেপাশে চোখ মেললাম। কিন্তু যা আমি দেখলাম তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

আমি অচেনা এক রুমে, অচেনা কোনো বিছানায় শুয়ে আছি। লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। আমি এখানে এসেছি কিভাবে? সবকিছু মনে করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওইটুকুই, ভার্সিটির অন্ধকার রুমে আমি আদ্রে’র সাথে, আদ্রে’র বুকে। এরপর আমার আর কোনোকিছু মনে আসছেনা। আমাকে এখানে আনলো কে? আমার সাথে কি কেউ খারাপ কিছু করেছে? মনে হতেই চমকে উঠলাম। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নাহ! সব তো ঠিকই আছে! অতিরিক্ত ঘুমানোর ফলে মুখচোখ ফোলা ফোলা লাগছে।

এসব ভেবে ভেবে অবাক হচ্ছি আর নখ কামড়াচ্ছি। ঠিক তখনই ক্যাচক্যাচ শব্দ করে রুমের দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকলো আদ্র! আমাকে এভাবে বিছানায় বসে থাকতে দেখে গম্ভীর গলায় বললো, ‘ঘুম ভাঙলো?’

আমি চুপ।

—“এখন কেমন লাগছে তোমার?”

আমি এবারও চুপ। ওনি এবার রেগে বললেন, ‘এই বেয়াদব মেয়ে। কি বলছি কানে যাচ্ছেনা? নাকি কালকের মতো টাইট দেবো?’

আমি এবার চুপ করে থাকতে পারলাম না। ভয়ে ভয়ে বিছানার এক কোণায় গিয়ে বসে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে এখানে আপনি নিয়ে এসেছেন?’

ওনি কপাল কুঁচকে তাকালেন। পরণের পাঞ্জাবির হাতা’টা ফোল্ড করতে করতে বললেন, ‘তোমার সামনে যেহেতু আমাকে দেখতে পাচ্ছো তার মানে আমিই সব করেছি!’

আমি কাঁদোকাঁদো গলায় বললাম, ‘সব করেছেন মানে? আপনি আমার অসহায়তার এভাবে সুযোগ নিলেন?’

ওনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে, ওনি কিছু ভুল শুনেছেন বা আমার কথাটা ওনি বিশ্বাস করতে পারছেন না। ওনি জোর গলায় চিল্লিয়ে বললেন, ‘তোমার মাথায় এসব কি উল্টোপাল্টা চিন্তা আসে? আমাকে দেখে কি তোমার এমন মনে হয়? আর তুমি কি প্রস্টিটিউট, এভাবে কথা বলা দেখে সবাই-ই কিন্তু তোমাকে প্রস্টিটিউট ভাববে! তোমার আর আমার মধ্যে কি হয়েছে জানতে চাও? ওয়েট বলছি। কাল রাতে আমি আর তুমি…..!’

আমি কানে দু’হাত চেপে ধরে বললাম, ‘আল্লাহ’র ওয়াস্তে আপনি চুপ করুন!’

ওনি সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললেন, ‘তোমাকে শুনতে হবে আরশি। কাল রাতে তুমি যা পাগলামোটাই না করলে, আমাকে তো ছাড়তেই চাইছিলে না।’

👉”হে নবী- ধৈর্য ধরুন, চরম ধৈর্য!”

~ (সুরা মা’রিজঃ ০৫)

চলবে….ইনশাআল্লাহ! গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। গল্পটাকে বাস্তবের সাথে মেলাবেন না, বাস্তবে এমন অনেক কিছুই হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here