হৃদপিন্ড ২ পর্ব ২২+২৩+২৪

#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_ ৭
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
যে নারী সময়ে অসময়ে বারংবার একজন পুরুষের হৃৎপিণ্ডে মৃদু কম্পন ধরাতে ব্যস্ত থাকে সে নারী কি করে পারে সেই পুরুষটিকে প্রত্যাখ্যান করতে? প্রত্যাখ্যান করার আগে পুরুষটির হৃৎপিণ্ড নামক মাংসপিণ্ডটিকে দেহচ্যুত কেন করলো না? আপনমনে প্রশ্নগুলো করছে ইমন৷ এদিকে মুসকান বার বার আড়চোখে ইমনকে দেখছে আর ফোঁসছে। তার ধারণা ইমন তাকে ইগনোর করছে। এই যে সে শাড়ি পরে এতো সুন্দর করে সেজেছে। এসবের একটুও খেয়াল করেনি ইমন। অথচ এসবের পুরোটা খেয়াল করেই নিজের দৃষ্টিজোড়া কে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করে চলেছে ইমন। একবারের জন্যও যদি নিজের মন এবং চোখকে উৎসাহ দিয়ে ফেলে তাহলে পাশে থাকা ছোট্ট এই রমণীকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।

দশমিনিট পথের পাঁচ মিনিট অতিক্রম করেছে মাত্র। মুসকানের ভিতর উত্তেজনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তার অন্তরটা পুড়ে যাচ্ছে কেমন। হৃৎস্পন্দন ঝড়ের গতিতে বাড়ছে। একপর্যায়ে নিজেকে দমিয়ে রাখার তীব্র চেষ্টায় মেতে ওঠলো। এক হাত দিয়ে অপর হাত মোচড়াতে শুরু করলো ক্রমাগত। একদিকে নিঃশ্বাসের ক্রমাগত ফোঁস ফোঁস অপরদিকে চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ। ইমন চৌধুরীর আর বুঝতে বাকি নেই তার হৃদয় হরণ কারিনীর অস্থিরতার কারণ এবং অস্থিরতার মাত্রা ঠিক কতোখানি গভীর। তাই মাঝরাস্তায় আচমকাই গাড়ির ব্রেক কষলো। আতঙ্কিত হয়ে কেঁপে ওঠলো মুসকান। ইমনের দিকে ভীতিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ইমনের শান্ত এবং শীতল দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেলো তার দৃষ্টিজোড়া। বক্ষঃস্পন্দন হয়ে গেলো এলোমেলো। দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই নত করে এলোমেলো শ্বাস গ্রহণ এবং ত্যাগ করতে থাকলো। ইমন তখনো স্থির, স্থির তার মাদকীয় চাহনীও। সে যে আঁটকে গেছে মুসকানের কৃষ্ণবর্ণী দৃষ্টিজোড়ায়, আঁটকে গেছে গাঢ় গোলাপি ওষ্ঠজোড়ার নিম্নস্থলে সন্তর্পণে ইশারাকৃত কৃষ্ণবর্ণ তিলকটাতে। আজ যেনো ইমনের চারপাশ কৃষ্ণবর্ণে মুখরিত হয়ে ওঠেছে। ঘড়ি ধরে প্রায় এক মিনিট নীরবতা পালন করে রুদ্ধশ্বাস ছাড়লো ইমন। মুসকানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সামনের পিচ ঢালা রাস্তায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। এক ঢোক গিলে শুষ্ক গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে শান্ত কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” আমার এই একত্রিশ বছরের জীবনে একত্রিশেরও অধিক মেয়ের প্রপোজাল পেয়েছি। একসেপ্ট নয় বারংবার প্রত্যাখ্যান পেয়েছে তারা আমার থেকে। কিন্তু আজ বুঝতে পারছি না চাইতেই তাদের কতোখানি যন্ত্রণা দিয়েছি আমি। ”

অন্তস্তলে তীব্র কম্পন অনুভব করলো মুসকান। নত রাখা নির্মল দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই ক্রোধে পরিণত হলো। তিনটা বছর তাকে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা দিয়ে তাকে বোঝার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করলো না। অথচ তার দ্বারা প্রত্যাখ্যান হওয়া নারীদের বুঝে নিজেকে মহান পুরুষ প্রমাণ করতে চাইছে! তার এই মহান হওয়াটা কোনদিন সফল হতে দেবে না মুসকান। আর যাই হোক ইমন চৌধুরী মহান হতে পারেনা। ইমন চৌধুরী স্বার্থপর, হৃদয়হীন বই আর কিছু হতেই পারেনা৷ মুসকানের ক্রোধে জর্জরিত দৃষ্টিজোড়া দেখে ইমনের শীতল দৃষ্টিজোড়া দৃঢ় হতে থাকলো। দু’জনের নিঃশ্বাসের গতি যেনো ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সেই সাথে হচ্ছে একে অপরের নিঃশ্বাসে, নিঃশ্বাসে যুদ্ধ। সেই যুদ্ধকে স্থগিত করে মুসকান বললো,

“তিনটা বছর একটা মেয়েকে মৃত্যু সমান যন্ত্রণা দিয়ে আজ তুমি একত্রিশের অধিক মেয়ের যন্ত্রণার কথা ভাবছো? হাউ ফানি! ”

” বেশীই বড়ো হয়ে গেছিস তুই। প্রয়োজনের অধিক কিছুই ভালো নয় এক্সেস ইজ দ্যা ভেরী বেড। ”

” বড়ো ছিলাম না বলেই তো কিছু মানুষ সহজেই আঘাত করতে পেরেছে। বড়োর এতো কদর সত্যিই তখন বুঝতে পারিনি। এই পৃথিবীর মানুষ গুলোর কাছে, এই সমাজের কাছে অনুভূতির কোন মূল্য হয় না। যে জিনিসটাকে অধিক মূল্য দেওয়া প্রয়োজন তারা সে জিনিসটাকেই সবচেয়ে তুচ্ছ করে দেখে। ”

নির্লিপ্ত ভণিতায় মুসকানের যন্ত্রণাময় বাক্য গুলো শুনে অধৈর্য হয়ে পড়লো ইমন৷ অকস্মাৎ ভাবে মুসকানের দিকে ঝুঁকে দৃঢ় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” অনুভূতির মূল্য যদি নাই দিতাম আজ আমি এখানে তোর পাশে থাকতাম না। কোন এক বিদেশিনীকে বিয়ে করে ওখানেই স্যাটেল হয়ে যেতাম! ”

আচমকাই এতো কাছে আসাতে মুসকানের হাত, পা কাঁপতে শুরু করলো। গলা শুখিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা। বুকের ভিতর হৃদস্পন্দনের ঢিপ ঢিপ শব্দ এবার ধড়াস ধড়াসে পরিণত হয়েছে। ইমনের দৃঢ় দৃষ্টিজোড়ায় নিজের দৃষ্টি রাখার সাহস হয়ে ওঠলোনা আর। বিক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাতে থাকলো আর বললো,

” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে নানাভাই। ”

” হোক দেরি। কিসের কাজ তোর কি কাজ করিস কে বলেছে তোকে নৃত্যের মাস্টারনি হতে? আমি বলেছি কোন সাহসে তুই সারাদিন একা একা রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াস, কোন সাহসে তুই আজ এভাবে সেজেগুজে বেড়িয়েছিস উত্তর দে! ”

চিৎকার করে কথাগুলো বলতেই ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকলো মুসকান। মুসকানের এহেন অবস্থা দেখে আবারো স্থির হয়ে গেলো ইমন। অস্ফুটে স্বরে ‘ওহ শীট’ বলেই এক হাতে মুসকানের কান সহ চোয়াল চেপে ধরলো। আরেকটু এগিয়ে মুসকানের কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকিয়ে নাকে নাক স্পর্শ করলো। চোখজোড়া বদ্ধ করে দু’হাতে শাড়ি খামচে ধরলো মুসকান। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে শুরু করতেই ইমন শান্ত গলায় বললো,

” আমার মুগ্ধময়ী’কে এভাবে সবাই দেখুক তা আমি চাইনা। আজকের পর এভাবে কখনো বের হবি না মনে থাকবে? ”

উত্তর পেলো না ইমন৷ পাওয়ার কথাওনা। একদিকে এমন ধমক অপরদিকে এমন মোহনীয় স্পর্শের পাশাপাশি মোহনীয় বাক্য। মুসকানকে কুপোকাত করার জন্য এর বেশী কিছুর প্রয়োজন নেই ইমনের। দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো মুসকানের। ইমন ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে দু’হাতের বুড়ো আঙুলে অশ্রুজোড়া মুছে দিতে দিতে বললো,

” যে অপরাধ তুই করেছিস তার তুলনায় এই রিয়্যাক্টটা জাষ্ট সিম্পল। তাই কেঁদে ভাসিয়ে আমাকে শাস্তি দেওয়ার প্ল্যানটা না করলেই কি নয়? ”

দৃষ্টিজোড়া মেলে ধরলো মুসকান দু’চোখের কাজল লেপ্টে যাওয়ার অবস্থা তৎক্ষনাৎ ইমন সরে গিয়ে বললো,

” এতো কষ্ট করে সেজেছিস এসব করার জন্য? চুপ চুপ একদম চুপ ডোন্ট ক্রাই। ”

মুসকান নাক টানতে শুরু করলো। ইমনের থেকে চোখ ফিরিয়ে শাড়ির আঁচলে চোখ এবং নাক মুছে ঘুরে বসলো৷ ইমন নিজের মাথা হেলিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো,

” কিছু বলার আগেই কান্নাকাটি করলে তো মশকিল। বড়ো আর কই হলি মুসু? ”

ইমনের দিকে না ফিরেই ভেজা কন্ঠে মুসকান বললো,

” আমার ভালো লাগছেনা তোমার সঙ্গে থাকতে প্লিজ আমাকে স্কুলে দিয়ে আসো নয়তো আমি বেরিয়ে যাবো”

” বাহ দারুণ থ্রেট। ”

কিছু বললো না মুসকান। ইমন ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটিয়েই বললো,

” পারফিউমের চেয়ে তোর চুলের ঘ্রাণটাই বেশী ফিল করছি। ”

বুকের ভিতর ধক করে ওঠলো সেই সাথে লজ্জায় নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে ফেললো মুসকান। ইমন সেসবে নজর না দিয়ে মলিন কন্ঠে বললো,

” তুই কাল যা বলেছিস আর আজ যা করেছিস আমার কি হবে মুসু? আমি উদ্ধত আচরণ করতে চাইছিনা সমঝোতা চাইছি। ”

” আমাকে স্কুলে দিয়ে আসবে কিনা।”

” যদি বলি না? ”

” আমার দু’টো পা রয়েছে। ”

কথাটি বলেই গাড়ির ডোর খোলার জন্য উদ্যত হলো মুসকান৷ ইমন তৎপর হয়ে মুসকানের বাহু টেনে একদম নিজের কাছে নিয়ে এলো। কঠিন স্বরে বললো,

” আমার অনুমতি ব্যতিত এক পা’ও নড়বি না। ”

” আহ লাগছে আমার। ”

কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো মুসকান। ইমন আশ্চর্য হয়ে বললো,

” তোর জন্য এখন তুলো দিয়ে হাত বানিয়ে আনতে হবে! ”

বলেই হাত নরম করে দিয়ে মুসকানের অতি নিকটে এলো। তারপর লম্বা এক শ্বাস টেনে কানের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু কন্ঠে বললো,

” বলিউডের রজনি কান্ত রোবট মুভিটা কেন বানিয়েছে জানিস? কারণ তিনি দেখাতে চেয়েছেন মেয়েরা শুধু পুরুষদের নয় মেশিনের মাথাও নষ্ট করতে পারে। ”

বিস্মিত হয়ে বড়ো বড়ো করে তাকালো মুসকান। চোখ পিটপিট করে বললো,

” বাজে কথা। ”

ইমন হাসলো মুসকানের থেকে সরে গিয়ে বললো,

” উত্তম কথা। শোন আমাকে যে একত্রিশের ঊর্ধ্বে মেয়েরা প্রেম এবং বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। তাদের মধ্যে পাঁচ জন আমাকে সুইসাইড করার থ্রেটও দিয়েছে। দু’জন সরাসরি ব্লেট এবং পয়জন নিয়েও ভয় দেখিয়েছে। তবুও আমি তাদের গ্রহণ করার কথা চিন্তাও করিনি। যারা আমাকে পাওয়ার জন্য সুইসাইড করতে চেয়েছে তাদের কথা যেমন আমি ভাবিনি তেমন যে আমাকে পেলে সুইসাইড করবে বলেছে তার কথাও আমি ভাববো না ? ”

” তার কথা কোন কালেই ভাবোনি।”

“সঠিক সময় বুঝতে পারবেন ম্যাডাম ভেবেছি কি ভাবিনি৷ ”

“মানে? ”

” মানেটা রজনি কান্তের সিনেমার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেছি। মাথা নষ্ট! ”

আঁতকে ওঠে ঘুরে বসলো মুসকান। নিঃশ্বাসে তার তীব্র অস্থিরতা। ঈষৎ হেসে চোখ বুঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো ইমন৷
.
স্কুলের সামনে গাড়ি ব্রেক করলো ইমন। মুসকানের দিকে গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

” বিকেলের দিকে নিতে আসবো। ”

ভ্রুজোড়া কুঁচকে মুসকান বললো,

“সায়রী আপুর সঙ্গে চলে যেতে পারবো। ”

” আমার বাড়ি যেতে হবে তিনবছরে নিজের মধ্যে এতোটা পরিবর্তন আনবি বুঝিনি। যে পরিবর্তনটায় আমার মায়ের সঙ্গে বেয়াদবি করতেও তোর বাঁধবে না। ”

আশ্চর্য হয়ে ইমনের দিকে তাকালো মুসকান বললো,

” আমি কখন বেয়াদবি করলাম! ”

” পুরো তিনটা বছরই বেয়াদবি করেছিস। আর গতকাল আমার মায়ের পাশে সায়রীর চেয়ে তোকে বেশী প্রয়োজন ছিলো। ”

” আমি কারো প্রয়োজন মেটাতে পারবো না৷ “,

হতভম্ব হয়ে গেলো ইমন। থমকানো সুরে বললো,

” মুসকান!”

” না মানে বিকেলে বন্ধু’দের সাথে সময় কাটাবো।”

বলেই মাথা নিচু করে অপরাধীর ন্যায় ডোর খুলে নেমে পড়লো। ইমনের মাথাটা পুরো ঝিম মেরে গেছে মুসকানের বলা শেষ বাক্যটি শুনে৷ ভেবেছিলো চলে যাবে কিন্তু লক্ষ্য করলো মুসকানের পায়ের গোড়ালি থেকে অনেকটা উঁচুতে শাড়ি ওঠে গেছে। নিম্নস্থানে কালো পেটিকোটের বেশীরভাগই দেখা যাচ্ছে। চুলগুলো পুরো পিঠ ছেয়ে আছে একদিকে চুল অপরদিকে আঁচল সামলাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে মুসকান৷ এদিকে রাস্তা পার হতেও পারছেনা৷ ক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়েই গাড়ি থেকে নামলো ইমন৷ শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে মুসকানের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে কিছুটা ঝুঁকে শাড়ি টেনে পেটিকোট ঢেকে দিলো। চমকে ওঠলো মুসকান বললো,

” কি হচ্ছে কি? ”

ইমন ক্ষুব্ধ হয়ে মুসকানের দিকে তাকাতেই মুসকান এক ঢোক গিলে আশেপাশে নজর বুলালো। ইমন চোখ,মুখ কুঁচকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল টেনে মুসকানের ডানপাশের কাঁধে ওঠিয়ে বললো,

” এভাবেই থাকবি নয়তো আমার থেকে খারাপ কেউ হবেনা। ”

মুসকান চোখদুটো ছোট ছোট করে তাকালো ইমনের দিকে। ইমন ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে তার বলিষ্ঠ হাত দ্বারা মুসকানের ছোট্ট কোমল হাতটি মুঠোবন্দি করে নিয়ে রাস্তা পার হলো৷ মনে মনে প্রচন্ড খুশি হয়ে ইমনের পিছন পিছন আগাতে থাকলো মুসকান।
.
মুসকানকে গেট অবদি পৌঁছে দিয়েই গাড়িতে এসে বসেছে ইমন৷ দীর্ঘ একটা সময় চুপচাপ বসে থাকার পর পকেট থেকে ফোন বের করে মুরাদের নাম্বার ডায়াল করলো।

” হ্যাঁ ইমন বল মুসুকে পৌঁছে দিয়েছিস? ও বুঝতে পারেনিতো আমি আর দিহান প্ল্যান করেই ওকে পৌঁছে দেইনি আজ? ”

” কৈফিয়ত দেওয়ার জন্য ফোন দেইনি কৈফিয়ত নেওয়ার জন্য ফোন দিয়েছি। ”

” তোর কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন কি নিয়ে আবার চটে গেলি দোস্ত? ”

” রিমিকে এখনি সাজগোজ করে রেডি হতে বল সায়রীর স্কুলে ওকেও নিয়ে আসবো। ”

” কিহ মাথা খারাপ রিমিকে স্কুলে পাঠাবো তাও আবার সাজগোজ করে! বাড়িতেই সাজতে দেইনা আবার নাকি অনুষ্ঠানে হুহ। ”

” তার মানে বোনের প্রতি যতোটা দরদ দেখাস ভেতরে ভেতরে আসলে ততোটাও নেই? ”

” মানে! ”

” ইয়েস তোর বোন কোন সাহসে এভাবে বেরিয়েছে আনসার মি ”

প্রথমে মুরাদ কিছু বুঝতে পারলো না তারপর ইমনের থেকে সব শুনে বললো,

” মুসকান এভাবে কখনোই বের হয় না ইমন। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। আমি বুঝতে পারছিনা ও তো বাসার ভিতেরও সাজগোজ করে না আজ শাড়ি পরে এভাবে বেরিয়েছে অদ্ভুত! ”

” তোরা সব কয়টা ইবলিসের থেকেও খারাপ। নিজের বউ যত্নে ঘরে রেখে দিছিস। দিহান, সায়রীও এসব বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। অথচ মুসকানকে তোরা কেউ সঠিক শিক্ষা টা দিতে পারিস নি। ভালো ভাবে বলছি এমন উন্মুক্ত চলাফেরা ইমন চৌধুরী মেনে নেবে না। তোকে সাবধান করলাম। ”

” তুই মাথা ঠান্ডা কর আজই এভাবে বেরিয়েছে এর আগে কখনো এভাবে বের হয়নি। আমার পরিবার সম্পর্কে তোর ধারণা আছে নিশ্চয়ই। ”

” ধারণা অনেক কিছুই ছিলো সব বদলে গেছে। ”

” কিছুই বদলায়নি সময় দে সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

“আর কতো সময় দেবো? ”

চিৎকার করে ওঠলো ইমন৷ মুরাদ হকচকিয়ে গেলো। বললো,
” ওকে বুঝিয়ে বলতে পারতিস হুদাই আমারে ধমকাচ্ছিস যাকগে বাসায় ফিরে বুঝিয়ে বলবো। ”

“সে জাতের বোন অন্তত তোর না। ”

” ভাইরে ভাই তোরে কে মাথার দিব্যি দিছিলো আমার বোনের দিকে নজর দিতে? কতোবার না করছি গ্যানজাম করছি কথা শুনস নাই এখন দেখ কেমন লাগে! ”

” আমি যদি চাই তোর বোনের ত্যাড়ামি দু’সেকেণ্ডে বন্ধ করতে পারবো। করবো? ”

” ঐ শালা বাড়াবাড়ি করবি না। ”

” শালা তো তুই আমার, শোন আজ তোর বোনের সব কাণ্ড দেখবো তারপর সে অনুযায়ী এ্যাকশন নেবো। স্কুল শেষে চুপচাপ বাড়ি গিয়ে মুড়ি খাবি বোন নিয়ে নো চিন্তা ওকে? ”

” ইমন শোন মুসু কিন্তু ছোট মানুষ আমাদের মতো বোঝদার ও হয়নি তুই কিন্তু…”

বাকি কথা বলার পূর্বেই ফোন কেটে কুটিল হাসলো ইমন। বিরবির করে বললো,

” সময়টা আর আগের জায়গাতে নেই। এখন ছাড় দেওয়া মানে নিজের অধিকারকেই ছাড় দেওয়া। ”
__________________
অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়েই মুসকানের চারপাঁচ জন ফ্রেন্ড স্কুলে এলো। স্টেজের একপাশে সায়রীর সাথেই দাঁড়িয়ে ছিলো মুসকান। পূজা, স্বরণ,
স্বর্ণা,শুভ, আর তূর্যয় এসেছে এরা পাঁচ জনই মুসকানের কাছের বন্ধু। এদের মধ্যে সবচেয়ে ক্লোজ হচ্ছে পূজা। পূজা হাত নেড়ে মুসকানকে ইশারা করতেই মুসকান এক গাল হেসে দু’হাতে শাড়ি সামলে ওদের কাছে চলে এলো। পূজা আর স্বর্ণা জাবটে ধরলো মুসকানকে বললো,

“দোস্ত তোরে হেব্বি লাগতাছে। ”

স্বরণ বললো,

” দেবীর মতো সুন্দরী লাগতাছেরে পুরাই দেবী। ”

শুভ স্বরণের পিঠে চাপর দিয়ে বললো,

“শালা গবেটের বাচ্চা ও তোদের দেবী হইতে যাব কোন দুঃখে তোরা পূজারে দেবী বলগা আমাগো মুসকানরে হুরপরীর মতো লাগতাছে। ”

তূর্যয় বললো,

” আরে শালা রাখ তোর দেবী রাখ তোর হুরপরী আমাগো বান্ধবীরে বান্ধবীর মতো সুন্দর লাগতাছে।”

এ পর্যারে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সকলেই। পূজা আচমকা মনে পড়েছে এই ভণিতায় মুসকানের কাধ জড়িয়ে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,

” জানু আজ কিন্তু স্বরণ বিয়ারের ব্যবস্থা করছে। তোর কাজ শেষ হলেই আমরা জমিয়ে আড্ডা দিব আর বিয়ার খাবো উফস ”

অনেকদিনের ইচ্ছে মুসকানের সে বিয়ার খাবে। এই নিয়ে স্বরণ,শুভ তূর্যয়কে কম কথা শোনায়নি। কেমন ছেলে ফ্রেন্ড এরা যে বান্ধবীদের সামান্য এই শখই পূরণ করতে পারেনা! অবশেষে যখন বান্ধবীদের শখ পূরণের ব্যবস্থা করলো মুসকান বেশ বাহবা দিতে থাকলো। কিন্তু স্বর্ণা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো,

” এই আমরা কোথায় খাবো? আর যদি নেশা হয়ে যায় বাসায় ধরা পড়ে যাবোতো। ”

পূজা বললো,

“আমার বাড়ি যাবি একদম রিল্যাক্স মুডে সব করা যাবে। আমার বাড়ি সব ফ্রি। ”

শুভ রসিকতা করে বললো,

” তাই তাহলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে রিল্যাক্স মুডে ডেট করার ব্যবস্থাও করে ফেল। ”

” ছিঃ ফ্রি বলে এতোটা ফ্রি বলিনি। তোরা আমার ক্লোজ ফ্রেন্ড সে হিসেবে তোদের বাসায় নিয়ে আড্ডা প্লাস ড্রিংক করতেই পারি। বড়দি আর মেজদাও তাদের বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে। তাই বললাম আর কি।”

ওদের কথার মাঝে মুসকান ফোড়ন কেটে বললো,

” এই থাম তোরা আমার কথা শোন আমি যেভাবেই হোক দাদাভাইকে ম্যানেজ করবো। সন্ধ্যার দিকে তূর্যয় আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিস তাই হবে। তাহলে আমাদের শখের পার্টি পূজা সেনের বাড়িতেই হচ্ছে। ”

সকলেই হৈহৈ করে ওঠলো। মুসকান আবার চোখে মুখে বিস্ময় ফুটিয়ে বললো,

” আবার নেশাটেশা হয়ে যাবে না তো? আমি কিন্তু অল্পই খাবো জাষ্ট টেস্ট আর কি। ”

স্বরণ বললো,

” আরে না কিসের নেশা হবে কিচ্ছু হবে না জাষ্ট চিল ম্যান। ”
.
বিকেল চারটার দিকে অনুষ্ঠান শেষ। সে অনুযায়ী চারটা দশমিনিটে আবারও স্কুলের সামনে এসেছে ইমন। আসার পথে মুসকানের জন্য একটি এন্ড্রয়েড ফোনও কিনে নিয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে গেটের সামনে যেতেই সায়রীর সঙ্গে দেখা হলো ইমনের। ইমন সায়রীর পিছন দিকে লক্ষ্য করে বললো,

” মুসকান কোথায়? ”

” মুসকান ওর বান্ধবীর বাসায় গেছে আমাকে বলে গেছে সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরবে। চল আমাকে পৌঁছে দে। ”

ভ্রু কুঁচকে হুম বলে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো ইমন। অথচ মনটা উদ্বেগে আকুল হয়ে রইলো। পরোক্ষণেই ভাবলো তিনটা বছর তো এমনভাবেই কাটিয়েছে মুসকান। আজ হঠাৎ তার চলাফেরায় হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। আস্তেধীরে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের মতো করে গড়ে নিতে হবে। মনকে হাজারটা স্বান্তনা দিলেও ভিতরটা কেমন জ্বালা করছিলো। তবুও নিজেকে শান্ত রেখে সায়রীকে বাসায় পৌঁছে দিতে গেলো।
.
চারদিকে মাগরিবের আজান ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বহুদিন পর বান্ধবী রিক্তা ফোন করায় রাস্তার ধারে গাড়ি থামিয়ে ফোনে কথা বলছিলো ইমন। যখন মাগরিবের আজান দিলো তখন রিক্তাকে বিদায় জানিয়ে ফোন করলো মুরাদকে। মুরাদ রিসিভ করতেই ইমন বললো,

” মুসুর জন্য ফোন কিনেছি দুপুরে দেওয়া হয়নি তুই কি বাড়িতে আছিস? ”

” হ্যাঁ বাড়িতেই। ”

” মুসু কি করে ওকে বলবি টাকাটা তুই আমাকে দিয়েছিলি আমি জাষ্ট কিনে দিলাম। ”

“মুসু তো এখনো বাড়ি ফেরেনি ফোনও সাথে নেই ওর বান্ধবীর নাম্বার খুঁজতাছি। ”

” হোয়াট!”#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_৮
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে বাড়ির সামনে থেকে মুরাদকে ওঠিয়ে পূজার বাড়ির ঠিকানায় গাড়ি ঘোরালো ইমন। বিমর্ষ মুখে ড্রাইভ করছে সে ৷ মুরাদের মুখেও বিষাদের ছায়া। ওদের দু’জনের কেউ ভাবতে পারেনি মুসকানের এতোটা অধঃপতন হবে। মুরাদ যখন পূজাকে ফোন করে মুসকান কোথায় জানতে চায় পূজা ভয়ে ভয়ে বলে তাদের বাসাতেই। বিচলিত হয়ে মুরাদ মুসকানের সাথে কথা বলতে চাইলে জানতে পারে মুসকান ড্রিংক করেছে৷ পূজা এসবে অভ্যস্ত তাই তার নেশা হয়নি। তুর্য্য মুসকানকে নিজ দায়িত্ব বাসায় দিয়ে আসতে চেয়েছিলো কিন্তু মুসকানের নাজেহাল অবস্থা দেখে মুসকানকে না নিয়েই চলে গেছে। স্বর্ণা আর মুসকান ব্যাতিত সবাই নিজ বাড়ি ফিরে গেছে। স্বর্ণা আজ পূজাদের বাসায়ই থাকবে৷ তার ফ্যামিলি থেকে এটা এলাও করলেও মুরাদ কখনোই রাত বিরাতে বোনকে অন্যের বাসায় এলাও করবেনা৷ একমাত্র ইমন ব্যাতিত এবং চৌধুরী বাড়ি ব্যাতিত আর কোথাও বা কারো কাছে মুরাদ মুসকানকে এলাও করার কথা ভাবতেও পারেনা। সবাই বিশ্বাসের যোগ্য হয় না, সবাই বিশ্বাসের মর্যাদা দিতে পারে না৷

পূজার বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতেই মুরাদ হন্যে হয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকলো৷ প্রায় মিনিট দশেক পর মুসকান ছুটে বেরিয়ে এলো। ক্রোধে পুরো শরীর কাঁপছে ইমনের৷ সে ভিতরে গেলে বা মুসকানের সামনে গেলে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে৷ যা সে ঘটাতে চায় না৷ তাই ভিতরে যায়নি মুরাদ একাই গিয়েছে। কিন্তু মুরাদকে বের হতে না দেখে মুসকান কে একা অমন বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বের হতে দেখে আর স্থির থাকতে পারলো না ইমন৷ ক্ষিপ্ত মেজাজেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। মুসকান তার ওষ্ঠজোড়া ফুলিয়ে নাক টেনে টেনে কাঁদছে আর দ্রুত পা চালাচ্ছে। ইমনের চোয়ালজোড়া ক্রমশ দৃঢ় হতে শুরু করলো। দাঁতে দাঁত চেপে দু’হাতের মুঠো দৃঢ় করে বলিষ্ঠ দেহখানা মাটিতে গেঁড়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। মুসকান যখন ছুটতে ছুটতে ইমনকে পাশ কাটাতে নেয় ইমন তখন নিজের বলিষ্ঠ হাত দ্বারা প্রচণ্ড শক্ত করে মুসকানের একটি হাত টেনে ধরে। মুসকান এবার তার অধর পল্লব আধিক্য ফুলিয়ে ঘাড় উঁচিয়ে অসুস্থ দৃষ্টিজোড়া মেলে তাকায় ইমনের দিকে। ইমনের দিকে দৃষ্টিপাত করার সঙ্গে সঙ্গেই ইমনকে প্রচণ্ড শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুসকান। বক্ষঃস্থলে মাথা রেখে দু’হাতে পিঠ খামচে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অস্ফুট স্বরে বলতে থাকে,

“নানাভাই তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। অনেক দূরে নিয়ে চলো। দাদাভাই খুব খারাপ, খুব খারাপ। দাদাভাই আমাকে মেরেছে, অনেক শক্ত করে মেরেছে। ”

কথাটি শেষ করেই ইমনের বুকপিঠের শার্ট খামচে ধরে বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে গুণগুণিয়ে কাঁদতে থাকলো। কানদুটো গরম হয়ে গেলো ইমনের। তার বক্ষঃস্থল কেউ যেনো চিঁড়ে ফেলেছে। এমন ব্যাথা অনুভূত হলো। দৃঢ় হয়ে ওঠা চোয়ালজোড়া নিজের স্বাভাবিকতায় ফিরে এসেছে৷ মস্তিষ্কে চলা সমস্ত ক্রোধ যেনো মাটিতে আছড়ে পড়েছে। মন এবং মস্তিষ্কে শুধু একটি বাক্যই উচ্চারিত হচ্ছে,

” মুরাদ কেন ওর গায়ে হাত তুলেছে? মুরাদ কতোটা শক্তি প্রয়োগ করে ওকে আঘাত করেছে? একই সঙ্গে বন্ধু এবং বোনকে আঘাত করতে ওর অন্তর একটুও কাঁপেনি? ”

মুসকান যখন তার সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে মাথা রেখে অজস্র নালিশ জানাতে ব্যস্ত ইমন তখন অনুভব করার চেষ্টায় আছে কতোখানি ব্যাথা পেয়েছে মুসকান? না হয় একটা ভুল করেই ফেলেছে এক ধমকেই যাকে কুপোকাত করা যাবে তাকে মারার কি প্রয়োজন? যেজন্য নিজে না গিয়ে মুরাদকে পাঠিয়েছে নিজের রাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই সে সেখানে যায়নি। যেটুকুর ভয়ে সে যায়নি সেটুকুই যে মুরাদ ঘটাবে বুঝতে পারলে সে নিজেই যেতো। সঠিক শাসন যখন নিতে পারবে তখন করতে হবে এমন হিতাহিতজ্ঞান শূন্য মানুষ’কে মেরে আঘাত করে তো লাভ নেই।

মুরাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ইমন মুসকানকে ওভাবে দেখে কিছুটা থেমে থেমে এগুতে লাগলো। ইমন মুরাদের রক্তিম চোখে চোখ রেখে শান্ত গলায় বললো,

” তুইও এতোটা নিয়ন্ত্রণ হীন বুঝতে পারিনি। ”

মুরাদ চটে গেলো ইমনের থেকে মুসকানকে এক টান দিতে নিলেই ইমন চোখ, মুখ দৃঢ় করে একহাতে মুসকানের পিঠ জড়িয়ে বাঁধা প্রয়োগ করলো। বললো,

” এনাফ একটা দিয়ে রাগ না কমলে বাকিগুলো আমায় দে। ”

ইমন বলতে দেরি করলেও পিঠ বরাবর কষিয়ে কয়েকটা ঘুষি দিতে দেরি হলোনা মুরাদের। গায়ের সর্বস্ব শক্তি খাটিয়ে কয়েকটা ঘুষি দিয়ে বললো,

” হ তোরেই দিমু শালা তোর জন্যই আজ এই অবস্থা। আম্মা আজ মরেই যাবো ওরে দেখলে। ”

ইমনকে ওভাবে ঘুষি দেওয়াতে মুসকান হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলো। আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অস্ফুটে স্বরে বললো,

” নানাভাই, দাদাভাই আজ আমাদের মেরেই ফেলবে আসো আমরা পালাই। ”

মুরাদ বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে রইলো। ইমন মুরাদের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো,

” ওকে আমার বাড়ি নিয়ে যাই। কাকিমা এ অবস্থায় দেখলে অসুস্থ হয়ে পড়বে৷ তোর কাকাও এসব দেখে সবাইকে বকাঝকা করবে আজ বাড়ি ফেরার দরকার নেই তোদের। তুই বরং রিমি’কে ফোন করে বলে দে সকালে ফিরবি তোরা। ”

চিন্তিত দৃষ্টিতে ইমনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো মুরাদ। মুসকান ইমনের বুকে মাথা রেখেই উন্মাদের মতো মাথা চুলকাচ্ছে, বুকপিঠে শার্টে নাক ঘষছে। যদিও এতো কিছুর মাঝে ইমনের প্রচণ্ড রিয়্যাক্ট করার কথা ছিলো। তবুও সে কোন প্রকার রিয়্যাক্ট করতে পারলো না৷ পারবে কি করে? তার হৃদপিণ্ড নামক পাখিটা যে তার বক্ষঃস্থলে নিশ্চিন্ত মনে জায়গা করে নিয়েছে। সেই নিশ্চিন্ত অনুভূতি’টা কে অনিশ্চিত করার সাহস যে তার নেই৷ মুরাদের ফোনের রিংটোনে আচমকাই ধ্যান ভাঙলো তিনজনের। মুসকান মাথা ওঠিয়ে মুরাদকে দেখে আবারও ভীতিগ্রস্থ হয়ে ইমনের পিছনে চলে গেলো। মুরাদের থেকে লুকানোর চেষ্টা করে পিছন থেকে ইমনের শার্ট খামচে ধরে বিরবির করে বললো,

” দাদাভাই আমাকে একটুও ভালোবাসেনা। সবার সামনে আমাকে মারলো। দাদাভাই খুব খারাপ আমি আর দাদাভাইকে ভালোবাসবো না ”

ফোন রিসিভ করতেই মরিয়ম আক্তার জানালো রিমি মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। তাই নিয়ে রিমির মা মরা কান্না জুড়ে দিছে। আর দোষারোপ করছে মুরাদকে। সে নাকি রিমিকে যত্ন করেনা৷ বাড়ির মেয়ে বিয়ে করে কোন দাম দেয় না মুরাদ৷ হতো পরের মেয়ে বুঝতো এমন অনাদরে পরের বাড়ির লোকেরা কেমন শায়েস্তা করে। এসব শুনে মুরাদের মেজাজ আরো খারাপ হলো। ফোন কেটে দিয়ে গালিগালাজ করতে করতে বললো,

” শালার চাচা আর আম্মার কথায় ঐ বেটির মেয়ারে বিয়া করাই ভুল হইছে। বাল ছাল আলাপ আর ভাল্লাগে না। ”

মুরাদের রাগ দেখে মুসকান ভয়ে কেঁপে ওঠলো। ইমনকে ছেড়ে ছুটে পালানোর জন্য পিছন ঘুরতেই ইমন চট করে মুসকানকে ধরে ফেললো। ব্যস্ত গলায় বললো,

” মুরাদ গাড়িতে ওঠে বোস ওকে নিয়ে। হুঁশে নেই যা তা অবস্থা ঘটিয়ে ফেলবে। ”

মুরাদ দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। পিছনের সিটে মুসকানকে বসিয়ে মুরাদকে ওঠতে বললে মুরাদ বললো,

” ডোর লক কর আমার পাশে বসবে না। কান্নাকাটি করবে ”

ইমন ভ্রু কুঁচকে মুসকানের দিকে তাকিয়ে ডোর লক করে দিলো। মুসকান গাড়ির সিটে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে গুণগুণিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।

ড্রাইভিং সিটে ইমন তার পাশে মুরাদ বসেছে। ইমন জিগ্যেস করলো,

” এবার বল কি হয়েছে? ”

” আর বলিস না জীবনটা তেজপাতা বানাই দিছে আমার চাচি। নিজেদের মধ্যে আসলে বিয়ে সাদি করাই উচিৎ না। যারে বিয়ে করছি তার কোন অভিযোগ নাই যতো অভিযোগ ঐ বেটির। রিমি অসুস্থ হয়ে পড়ছে তাই বেটির ধারণা আমি ওর যত্ন করিনা। ”

বাঁকা হাসলো ইমন বললো,

” সবাই কি আমার শাশুড়ি’র মতো হবে নাকি? একটা দু’টো ডিফারেন্ট হওয়াই চাই। ”

” মজা লস? শাশুড়ি নিয়ে গর্ব কর কর তোর জীবন তেজপাতা কুঁচি করা আমার বা হাতের খেল। ”

মিররে মুসকান’কে এক ঝলক দেখে নিয়ে ইমন বললো,

” যেমন জামাই তেমন শাশুড়ি। শাশুড়ি’কে বেটি বেটি করস ক্যান,চাচি হিসাবেও তো সম্মান দিতে পারিস নাকি? ”

তাচ্ছিল্য সহকারে মুরাদ বললো,

” সামনাসামনি যে বেটি বলিনা এইটা ওর চৌদ্দ গুষ্টির ভাগ্য। ”

” যাক বাদ দে এসব তুই বাড়ি যা রিমির পাশে তোকে দরকার এতো সমস্যার মাঝে মুসকান’কে এ অবস্থায় বাড়ি নেওয়া একদমই ঠিক হবেনা। আমি চাইনা কেউ ওকে কটুবাক্য শোনাক বা কাকি’মা ওর জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ুক। ”

” না না মুসকান কে একা রেখে যাব না আমি। ওর অবস্থা দেখছিস তুই? ”

শান্ত দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে আবার সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ইমন। বললো,

” বন্ধুর প্রতি এটুকু ভরসা করতেই পারিস। আর আমার বাড়িতে আমি একা থাকিনা মা,বাবা, আছে পারুল আছে। ”
.
মুরাদকে ওর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে সোজা নিজের বাড়ি এসেছে ইমন। ইরাবতী’কে ফোন করে মুসকানের কন্ডিশন জানানোর ফলে ইরাবতী মুসকানের জামাকাপড় নিয়ে নিচের ওয়াশরুমে অপেক্ষা করছে। মুসকানের এক সেট জামা সেদিন রেখে গেছিলো বলে আজ রক্ষা হলো। ইমন মুসকানকে ধরে ধরে বাড়ির ভিতরে নিয়ে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ো ইরাবতী’কে ডাকলো। ইরাবতী সব গুছিয়ে বের হতেই মুসকান ঢুলুঢুলু শরীরে ইরাবতী’র তাকিয়ে অধরপল্লব উঁচিয়ে বললো,

” ও আন্টি… দেখো দাদাভাই আমাকে শক্ত করে থাপ্পড় দিয়েছে। ”

মুখ এগিয়ে গাল পেতে কথাটা বলতেই ইরাবতী একবার ইমনের দিকে তাকালো। ইমন মাথা নিচু করে মুসকান’কে ছেড়ে উপরে ওঠে গেলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইরাবতী মুসকান’কে ধরে ওয়াশরুমের ভিতরে নিয়ে বললো,

” আমি তোমাকে হেল্প করি গোসল সেরে নাও। ”

বিনিময়ে মুসকান হুহু করে কেঁদে ওঠলো। বললো,

“তুমিও আমাকে ভালোবাসো না আন্টি কেউ আমাকে ভালোবাসে না। আমি এখানেও থাকবো না।”

কথাটি বলেই ইরাবতী’কে ধাক্কা মেরে বেরিয়ে গেলো মুসকান৷ বাড়ির বাইরে যাবে কিন্তু নেশার ঘোরে বাইরের রাস্তা খুঁজতে খুঁজতে প্রায় পাঁচ মিনিট বাঁধিয়ে দিলো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠতে ওঠতে সোজা ছাদে চলে গেলো। এদিকে দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে ইরাবতীর বা হাতে কনুইতে বেশ লেগেছে। ব্যাথায় পুরো হাত অবশ হওয়ার উপক্রম। কোনমতে একটু পানি দিয়ে অমনি ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পারুলকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলো ইরাবতী। ডাক শুনে উপর থেকে ইমন, আকরাম চৌধুরী রান্নাঘর থেকে পারুল ছুটে এলো। মুসকান বেরিয়ে গেছে শুনতেই গা শিউরে ওঠলো ইমনের। ইরাবতীর উপর রাগ ঝাড়তে গিয়েও পারলো না। আকরাম চৌধুরীর কথা শুনে,

” এসব কি ইমন? এমন থার্ডক্লাশ আচরণ আমার বাড়িতে চলবে না। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি কোন পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে যাচ্ছি আমরা। ”

চোয়ালজোড়া শক্ত হয়ে এলো ইমনের। চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

” এটা একটা মিসটেক ছিলো বাবা। ”

ইরাবতী ক্রন্দনরত কন্ঠে বললো,

” আমি ধরে রাখতে পারলামনা ধাক্কা মেরেই চলে বেরিয়েছে বেশী দূর যায়নি ইমন তুই ওকে খোঁজ। রাত বিরাতে না জানি কোন অঘটন ঘটায়। ”

হুঁশ ফিরলো ইমনের উৎকন্ঠা হয়ে বাড়ির বাইরে গেলো সে৷ এদিক সেদিক তাকিয়ে দৌড়ে রাস্তায় গেলো। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সব দিক দেখে নিয়ে হঠাৎই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেলো ছাদের কার্ণিশে।
আর দেরি করলো না ইমন বাড়ির ভিতর গিয়ে উপরে যেতে যেতে বললো,

” পারুল মায়ের হাতে মলম লাগানোর ব্যবস্থা কর। মুসকান ছাদে আছে আমি দেখছি ওকে দরকার পড়লে ডেকে নেবো। ”

ইমন চলে যেতেই আকরাম চৌধুরী ক্রোধে ফেটে পড়লেন। চিৎকার করে বললেন,

” এসব কি ইরা! কোন সভ্য বাড়ির মেয়ের আচরণ এটা হতে পারেনা। ”

ইরাবতী সোফায় বসে ব্যথা পাওয়া হাতটি চেপে ধরে বললো,

” বাচ্চা মেয়ে ভুল করে ফেলেছে বাদ দাও। ”

“আমার নিজের সন্তান যেখানে এসবের ধারেকাছেও যায় না সেখানে ছেলের হবু বউ কিনা মাতাল হয়ে এ বাড়িতে প্রবেশ করেছে আমি কি মরে গেছি! ”

” কিসব বলছো তুমি? ”

” ইমনের বুদ্ধি লোপ পেয়েছে বলে তুমিও একই পথে হাঁটা ধরেছো? ”

” তাহলে কি করবো ওদের ওপর চিৎকার চেচামেচি করবো? এতে সমাধান হবে, কোন সমস্যার? নাকি তোমার ছেলে আমার ভয়ে তোমার ভয়ে নিজের ভালোবাসার জলাঞ্জলি দেবে কোনটা বলো? ”

ভয়ংকর রেগে হাত ঝাঁকি দিয়ে উপরে চলে গেলো আকরাম চৌধুরী। পারুল ভয়ে ভয়ে মলম নিয়ে এসে ইরাবতীর সামনে বসতেই ইরাবতী পারুল কে এক ধমক দিয়ে গটগট করে উপরে চলে গেলো। স্বামী, স্ত্রী, ছেলের সমস্ত রাগ যেনো পারুলের ওপর আছড়ে পড়লো। তব্দা খাওয়া চেহেরায় ইরাবতীর যাওয়ার পানে কয়েক পল চেয়ে থেকে রান্না ঘরে চলে গেলো পারুল।
.
রাত ন’টা ছুঁইছুঁই। শহুরে রাত। বিস্তর আকাশের নিচে বেসামাল হয়ে ছাদের কার্ণিশে দাঁড়িয়ে আছে আঠারো বছর বয়সী এক তরুণী। তারা ঝলমলে আকাশের মধ্যমনি চাঁদটির আলোয় উজ্জীবিত হয়ে আছে সমগ্র ধরণী। শহরের আনাচকানাচে রয়েছে ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র আলোক বাতি, রাস্তায় রয়েছে ল্যামপোস্টের ঘোলাটে বাতি। সে রাস্তায় বিরতিহীন ভাবে চলছে যানবাহন। চারদিকের এতো এতো আলো, ভিন্ন মাত্রার সুর ধ্বনি কোন কিছুতেই আর খেয়াল দিতে পারলো না ইমন। তার খেয়াল কেবল এক দিকেই। সেদিকেই সম্মোহনী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চেয়ে আছে। শাড়ির ধরাশায়ী আঁচলটা ছাদের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে মুসকানের। কোমড় ছাড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পুরো শরীরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ছাদের বর্ডারে দু’হাত রেখে বিরতিহীন ভাবে বিরবির করে চলেছে মেয়েটা। সেদিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়েই রইলো ইমন। এক পর্যায়ে দৃষ্টিজোড়া বদ্ধ করে ওষ্ঠজোড়া ফাঁক করে কয়েকদফা উত্তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। যখন দৃষ্টি মেলে সম্মুখে তাকালো বুকের ভিতরটা ধক করে ওঠলো।
#হৃৎপিণ্ড_২
#দ্বিতীয়_পরিচ্ছেদ
#পর্ব_ ৯
#জান্নাতুল_নাঈমা
_____________________
কপাল কুঁচকে ওষ্ঠজোড়া ফুলিয়ে নিভু নিভু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইমনের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে মুসকান৷ দিঘল ঐন্দ্রজালিক আখিঁদ্বয় দ্বারা ইমন’কে আপাদমস্তক দেখছে মেয়েটা। শ্বাসরুদ্ধ করে কয়েক পল নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়েই রইলো ইমন৷ এই একটা মুখ,এই একজন মানবীর দৃষ্টিজোড়া, এই একজন মানবীর নিঃশ্বাসের গভীরতা তীক্ষ্ণ ভাবে ঘায়েল করে তাকে। একত্রিশ বছরের জীবনে এ পৃথিবীতে শতাধিক নারীর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে তার। কেউ রূপবতী, কেউ গুণবতী। তাদের সে রূপ বা গুণ কোনভাবেই ইমন চৌধুরী কে আকৃষ্ট করতে পারেনি৷ চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলো না তাদের, শুরুতে ভাবতো সৃষ্টিকর্তা কি তার ভেতর অনুভূতি নামক যন্ত্র টা দেয়নি? নাকি তার জন্য কোন নারী’কে এ পৃথিবীতে সৃষ্টিই করা হয়নি? আশেপাশের পরিচিত বহু মেয়ের আফসোসের আরেক নাম ইমন চৌধুরী। নিজের বন্ধু – বান্ধব, বাবা মায়ের বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, পাড়া, প্রতিবেশী সকলের একটাই কৌতুহল ইমন চৌধুরী বিয়ে করে না কেন? বা তার জীবনে কোন নারীর আগমণ ঘটে না কেন? সব প্রশ্নের উত্তর সেদিন পায় যেদিন চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী’কে দেখা মাত্রই বক্ষঃস্থল কেঁপে ওঠে। নিঃশ্বাসে – প্রশ্বাসে শুরু হয় অস্থিরতা। হৃৎপিণ্ড নামক পাখিটা যাকে এক পলক দেখার জন্য ছটফট ছটফট করতেই থাকে। রূপ নয় গুণ নয় এক মায়াবতী’র মায়ার জালে আঁটকে যায় সে। অজস্র মায়ায় আচ্ছাদিত প্রগাঢ় সে দৃষ্টিজোড়ায় খুঁজে পায় একরাশ মুগ্ধতা। বক্ষঃস্থলে হাহাকার করে যেনো হৃৎপিণ্ড নামক পাখিটা বলতে থাকে হে পুরুষ রূপ নয় এক মায়াবতীর মায়ায়ই না হয় আঁটকে থাকো। গুণ নয় ছোট্ট এক কিশোরী’র মুগ্ধতাতেই না হয় ডুবে থাকো।
সেদিনই সমস্ত কৌতুহলের অবসান ঘটে৷ লজ্জিত হয় খুব যে বাচ্চা’টাকে জন্মাতে দেখেছে। চোখের সামনে হেসে খেলে মানুষ হতে দেখেছে তার প্রতি এমন অনুভূতি! এজন্যই বোধ হয় বোনওয়ালা কোন ছেলেই তাদের বন্ধু’দের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনা৷ বন্ধু’র বোন দেখে হার্টবিট নামক যন্ত্রটার দফারফা অবস্থা যদি নাই হয় তাহলে সেই হার্টবিট নামক যন্ত্রটা’কে নির্দ্বিধায় অকেজো বলে সাব্যস্ত করা উচিৎ!

বাচ্চাদের মতো ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুসকান। এক গালে হাত রেখে চোখ গুলো টেনে টেনে বড়ো করে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে। ইমন নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়েই বললো,

” কি ভাবছিস। ”

মুসকান এবার চোখ পিট পিট করে এক হাত বাড়িয়ে ইমনের টিশার্ট টেনে ধরে বললো,

” এই কালারটা খুবই জঘন্য তুমি এটা পড়বে না। ”

বলেই নিজের শাড়ির আঁচল দেখিয়ে বললো,

” আমারটার সাথে মিলছে না কেন নানাভাই? তখন তো ঠিক মিল ছিলো। ”

মৃদু হেসে ইমন বললো,

” তাই… ”

মুসকান গালে তর্জনী আঙুল ছুঁইয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো, “হুম”

ইমন মাথা দুলিয়ে বললো,

” মিলবে কি করে আমিতো পোশাক পালটে নিয়েছি। এবার তুইও নিবি। কিন্তু এটুকু হুঁশ তোর আছে?তারমানে তুই পুরোপুরি মাতাল নস? ”

খিলখিল করে হেসে ওঠলো মুসকান পরোক্ষণেই আবার ফুঁপিয়ে কেঁদেও ওঠলো। মুখ টা চুপসে গেলো ইমনের মুসকানের দিকে দু’কদম এগিয়ে বললো,

” কি হলো? ”

” তুমি এসেছো নানাভাই? ”

ক্রন্দনরত সুরে কথাটি বলেই ইমন’কে জড়িয়ে ধরলো মুসকান৷ বুকে মুখ গুঁজে গুণগুণিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো,

” তুমি আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেলে নানাভাই? আমাকে তুমি একটুও ভালোবাসো না একটুও না। ”

একদম স্থির হয়ে গেলো ইমন। পা থেকে মাথা অবদি অদ্ভুত ভাবে শিউরে ওঠলো। বক্ষঃস্থলে সুক্ষ্ম এক ব্যাথাও অনুভূত হলো। নিঃশ্বাস হয়ে ওঠলো ভারী। মুসকান বিরবির করে কত-শত নালিশ যে করতে লাগলো হিসাব নেই। মুসকানের প্রতিটা ভারী নিঃশ্বাস,আধো আধো কন্ঠে বলা প্রতিটা কথা ইমনের অন্তরে গিয়ে লাগছে। ইমন যখন স্তব্ধ হয়ে আছে মুসকান তখন ইমনের দিকে মাথা উঁচিয়ে তাকিয়ে আবারো বুকে মাথা রাখলো। তারপর নিজে নিজেই ইমনের দু’টো হাতের একটি টেনে কোমড়ে অপরটি টেনে পিঠে রাখলো। বুক পিঠে মুখ ঘষতে ঘষতে প্রচন্ড শক্ত করে জড়িয়ে রইলো। শ্বাসরুদ্ধকর এই পরিস্থিতি’তে ইমন আর কিছু ভাবতে পারলো না৷ মুসকান যে তার বুকে একটু ঠাঁই চাইছে, তার ভালোবাসা ময় আলিঙ্গন চাচ্ছে এটুকু বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। তবে এটাও সত্যি যদি হুঁশে থাকতো কখনোই এমনটা করতো না। হোক রাগে বা লজ্জায়। বেহুঁশ বলেই এতো সহজে নিজের অনুভূতি গুলো প্রকাশ করে ফেলছে। ছোট্ট একটি শ্বাস ছেড়ে দুচোখ বন্ধ করে মুসকান’কে দু’হাতে আবদ্ধ করে নিলো ইমন৷ দু’জনের মাঝে দীর্ঘ একটা সময় আর কোন কথা হলো না। জোৎস্নার রাতে চারদিকের মৃদু আবহাওয়ায় একজোড়া মানব-মানবীর তীব্র নিঃশ্বাসের শব্দে কেবল পরিবেশটি মুখরিত হয়ে ওঠলো। ইমন যেনো চলে গেলো অন্য এক দুনিয়ায়। বুকের ভিতর যে ঝড় বয়ে চলছিলো সে ঝড় থামানোর চেষ্টায় উন্মাদ হয়ে ওঠলো। চারদিকের মৃদু আবহাওয়ায় মুসকানের গভীর আলিঙ্গনে মাতাল প্রায় হয়ে গেলো। এ মূহুর্তে শ্রেষ্ঠ মাতাল বোধ হয় সে নিজেই। তা কেবল তার মাতলামোতেই প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সে মাতালামি খুব বেশী দীর্ঘস্থায়ী হলো না৷ ইমন যখন প্রচন্ড আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে মুসকানের মাঝে ডুবে যাচ্ছিলো একের পর এক প্রগাঢ় স্পর্শে কেঁপে ওঠছিলো মুসকানের সর্বাঙ্গ। ঠিক সেসময়ই বেজে ওঠলো ইমনের ফোন। চমকে ওঠে মুসকান’কে ছেড়ে দিলো ইমন। ঘনঘন শ্বাস ছেড়ে ফোন রিসিভ করতেই মুরাদ বললো,

” দোস্ত গুড নিউজ রিমি প্র্যাগনেন্ট আম্মা আর চাচি মিলে জোর করে টেস্ট করাইছে ওরে। কাল’কে হাসপাতাল যাইয়া আরো ভালো ভাবে কনফার্ম হমু। ”

ইমনের মেজাজ খিঁচে গেলো। পরোক্ষণেই ভাবলো নাহ ভালোই হয়েছে একটু বেশীই হয়ে যাচ্ছিলো। মুরাদকে কনগ্রেস জানালো ইমন৷ এদিকে ইমন ছেড়ে দেওয়ায় প্রচন্ড রেগে গেছে মুসকান৷ সে ইমন’কে চায়, চায় তার স্পর্শ’কে অস্থিরতায় তার বক্ষবন্ধনী ক্রমান্বয়ে ওঠানামা করছে। এদিকে ইমন মুরাদের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে একবার মুসকানকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। এক ঢোক গিলে সিদ্ধান্ত নিলো ফোনে কথা শেষ করেই নিচে চলে যাবে। পরিস্থিতি খুবই ডেঞ্জারাস! কথা বলতে বলতে ইমন বা’দিকে ধীর গতিতে হাঁটা ধরবে এমন সময় মুসকান কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে ইমনের সামনে দাঁড়ালো। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তার পূর্বেই ইমন একহাতে টেনে মুসকানকে নিজের কাছে নিয়ে এলো। মুসকানের পিঠ নিজের বুকে ঠেকিয়ে একহাতে ওর মুখ চেপে ধরলো। ফোনের ওপাশে মুরাদ যা বলছে সব শুনে ইমন শুধু হুম,হা উত্তর দিচ্ছে। কিন্তু মুসকানের ছটফটানি সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এমন একটা ভাব যে মুখ থেকে হাত সরালেই কন্ঠ দিয়েই তাণ্ডব শুরু করবে। কিন্তু মুরাদ যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে মুসকান এখনও তার সাথে বা মুসকানের পাশে সে তাহলে গালিগালাজ করে গুষ্টি উদ্ধার করে ছাড়বে। বিয়েতে মত দিছে বলে বিয়ের পূর্বে শান্তিতে প্রেম কোনভাবেই করতে দেবে না এই বান্দা। তাই হিটলার বন্ধুর বোন’কে হিটলারি ছাড়া ঘায়েল করার উপায় নেই। ভাবতেই চোখ বুঝে মুসকানের ঘাড়ে গভীরভাবে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে বললো, ” হুম “। মুরাদ বললো,

” তাহলে রাখি তুই সকাল সকাল মুসুকে নিয়ে চলে আসিস মুসুকে রেখে আমার সাথে হাসপাতাল যাবি।”

ইমন সেভাবেই বললো,

” হুম। ”

মুরাদ ফোন কেটে দিতেই ফোন ট্রাউজারের পকেটে রেখে মুসকানের মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিজের দিক ঘোরালো। মুসকান ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে তখনো ইমন বললো,

” অনেক রাত হয়েছে নিচে যেতে হবে। ”

কি হলো মুসকানের কে জানে দু’হাতে ইমনের বুকপিঠে ধাক্কা মেরে সরিয়ে বিরবির করে কিসব বলতে বলতে ছাদের ওপাশে চলে গেলো। আশ্চর্যান্বিত হয়ে পিছু ছুটলো ইমনও। মুসকান সুইমিং পুলে পা ডুবিয়ে বসলো। ইমন সেদিকে গিয়ে বললো,

” এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। আমি কিন্তু রেগে যাব।”

” রেগে গেলে তো হেরে গেলে। ”

পানিতে পা নাচাতে নাচতে বললো মুসকান। ইমন ভ্রু বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য সুরে বললো,

” এই রাগ হারার রাগ না মিস মুগ্ধময়ী। ”

মুসকানের পাশে ইমনও বসে পড়লো। কেন জানি ভালোই লাগছে তার হুঁশে থাকা অবস্থায় কখনো এভাবে মুসকান’কে পায়নি৷ এতো সুবোধ্য ভাবে মুসকান তার সঙ্গে কখনো কথাও বলেনি৷ কেন জানি লোভ হলো এই মুসকানের প্রতি। যে কিনা অবলীলায় নিজের সবটুকু অনুভূতি উজার করে দিতেও আজ প্রস্তুত। একহাত বাড়িয়ে মুসকান’কে নিজের বুকে টেনে নিলো ইমন। আরেক হাতে হাঁটু অবদি ট্রাউজার গুটিয়ে নিজের পা’দুটোও মুসকানের মতো ডুবিয়ে দিলো পানিতে। তা দেখে খুশিতে মুসকানের চোখ দু’টো জ্বলজ্বল করে ওঠলো। শাড়ি ওঠিয়ে হাঁটু অবদি তুলে ইমনের দিকে তাকিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠলো। ইমন বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে শ্বাস রুদ্ধ করে বললো,

” মরে যাবো নাকি মেরে ফেলবো বুঝতে পারছিনা। ”

মুসকান হাসি থামিয়ে বোকা বোকা চেহেরায় তাকিয়ে রইলো। ইমন ছোট্ট করে শ্বাস ছেড়ে মুসকানের কপালে চুমু খেয়ে মুসকানের ডুবানো পা দু’টো নিজের দু’পা দ্বারা আবদ্ধ করে ফেললো। কিছুটা শিউরে ওঠলো মুসকান। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মুসকানের দু’হাত নিজের হাতে মুঠোবন্দি করে নিলো। মুসকান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইমন তার সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

” আই ওয়ান্ট ইউ সো মাচ মুসু। ”

মুসকান পিটপিট করে তাকিয়ে বললো,

” চলো আমরা বিয়ে করে নেই। ”

ইমন কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

” হুহ বিয়ে, বিয়ে করলে কে জানি সুইসাইড করবে বলেছিলো? ”

মুখটা ভার হয়ে গেলো মুসকানের ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,

” তুমি আমায় বিয়ে করবে না নানাভাই? ”

হেসে ফেললো ইমন মাথা এদিক, সেদিক করে না বোঝালো। সঙ্গে সঙ্গে মুসকান এক ঝটকায় ইমনের থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো,

” তোমরা সবাই স্বার্থপর। কেন বিয়ে করবে না? আমিতো বড়ো হয়ে গেছি। আমি আর বাচ্চা নেই নানাভাই, আমি বাচ্চাদের মতো আর হেসে,খেলে বেড়াই না। আমি বড়োদের মতো গম্ভীর হতে শিখে গেছি। জানো নানাভাই আমি সব রান্না শিখে নিয়েছি। একজন নারী’র কাছে একজন পুরুষ ঠিক যা যা আশা করে সবটা পাবে তুমি তাহলে কেন বিয়ে করবে না? ”

” মুসু! ”

কান্নামিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকালো মুসকান। অসহায় ভঙ্গিতে বললো,

“আমি রান্না করতে পারি নানাভাই তোমার পছন্দের সব রান্না আমি শিখে নিয়েছি। রান্না পারি, ঘর গোছাতে পারি,কাপড় পরিষ্কার করতে পারি সবটা শিখে নিয়েছি। বাচ্চা বলে আমার অনুভূতির গুরুত্ব তোমরা কেউ দাওনি। তাই আমি নিজেকে বড়ো করে তুলেছি। পঁচিশ, ছাব্বিশ বছর বয়সী নারী’রা যা পারে আমিও তাই পারি। তাহলেও কেন বিয়ে করবে না বলো? ”

অসহনীয় যন্ত্রণায় বুক ফেটে যাচ্ছে ইমনের। রাগে শরীরের রক্ত টগবগ করছে। কোনরকম নিজেকে সামলে নিয়ে ঠোঁট কামড়ে মুসকানের এক গালে হাত রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,

” চুপ আর কোন কথা নয় আমরা নিচে যাবো। ”

মুসকান চুপ করলো না বরং এগিয়ে এসে ইমনের দুগাল নিজের ছোট ছোট হাত দু’টো দিয়ে আঁকড়ে ধরে কাতর কন্ঠে বললো,

” আংকেলের ধারণা যেনো সঠিক না হয় তাই শত রাগ, অভিমান থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় কোন পুরুষ’কে আমার জীবনে আসতে দেইনি। আমি সব দিক থেকে নিজেকে তৈরী করেছি। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি খুব ভালোবাসি তোমাকে। ”

হুহু করে কেঁদে ওঠলো মুসকান। সহ্য করতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে ইমন মুসকানের দুগাল শক্ত করে চেপে ধরলো। বললো,

” আমাকে এতো এক্সপ্লেইন করার প্রয়োজন নেই। আর একবার যদি কেঁদেছিস মেরে ফেলবো। ”

গাল ছেড়ে মুসকানকে একহাতে তুলে কোলে বসিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মুসকানও গুটিশুটি হয়ে পড়ে রইলো ইমনের বুকে। বিরবির করে বলতে থাকলো,

” আমার অনেক কষ্ট নানাভাই। আমার বুকে খুব ব্যাথা করে, আমি খুব কষ্ট পাই, আমার খুব যন্ত্রণা হয়। ”

বুকের ভিতর টা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো ইমনের৷ আর বেশীক্ষণ থাকলে হয়তো স্ট্রোক করে মৃত্যুই ঘটবে তার। তাই আর এক মূহুর্ত দেরী করলো না। মুসকান’কে ওভাবে নিয়েই নিচে নেমে গেলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here