হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে পর্ব ২১

#হৃদয়সিন্ধুর_পাড়ে💕
পর্ব ২১
#কায়ানাত_আফরিন

”আপনার সৌন্দর্য আমায় গ্রাস করে ফেলছে ডাক্তারসাহেব। সমুদ্রের টেউয়ের মতো আপনার সমস্ত সৌন্দর্য মাঝে মাঝে অমৃতের মতো শুষে নিতে ইচ্ছে করে।”

মৌনির কন্ঠ শুনে আড়চোখে নিভ্র তাকালো ওর দিকে। একটা প্রশস্ত হাসি দিয়ে সে বসে আছে। প্রকৃতির সাথে মৌনির নীল শাড়ির এই অপার্থিব সৌনন্দর্য যে কাউকে বাকরুদ্ধ করতে বাধ্য। তবে নিভ্র এই দিক দিয়ে অনেক সংবেদনশীল। একটা মুচকি হাসি দিয়ে সে বলে উঠলো,

–”অমৃতের মতো শুষে নেওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি?”

–”অবশ্যই আছে। আপনার সাথে মিশে আপনার সমস্ত সৌনন্দর্য আমি গ্রাস করে ফেলবো। ভেসে যাবো অন্যদুনিয়ায়।”

মৌনির চোখে মুখে ঘোর লেগে আছে। নিভ্র বুঝতে পারলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক নেই। এই মেয়ে যে কোনো সময় নিভ্রকে কাছে পাওয়ার জন্য একটা কান্ড ঘটিয়ে দিতে পারে। তাই নিভ্র নিজেকে সংযত রেখে বললো,

–”এখন এসব কথা বাদ দাও। আজ হঠাৎ শাড়ি পড়লে কেনো?”

–”শাড়িতে আমায় সুন্দর লাগছেনা বুঝি?”

–”তোমায় খুবই সুন্দর লাগছে । তোমার সাথে নীল রঙটা বেশ মানায়। ”

নিভ্র মুচকি হাসি দিয়ে কথাটি বললো। তবে চোখের দৃষ্টি ওর রাস্তার দিকে। সূর্যের মলিন প্রতিচ্ছবি বাকা রেখায় জানালা ভেদ করে নিভ্রর মুখে পড়ছে। যার জন্য কালচে বাদামী চোখদুটো লাগছে অনন্য। নিভ্রর সৌনন্দর্য গভীরভাবে অনুভব করতে গেলেই মৌনির হার্টবিট যেন বন্ধ হয়ে আসে। মৌনি তাই গাড়ির সিটে নিজের মাথা এলিয়ে দিলো।
–”খারাপ লাগছে মৌনি?”

নিভ্রর জড়ানো কন্ঠ। আসলেই মৌনির খারাপ লাগছে। শরীরটা কেমন যেন দুর্বল মনে হচ্ছে। এই জিনিসটা বুঝতে মৌনির সময় লেগেছিলো কিন্ত নিভ্র ফট করে তা ধরে ফেলেছে। আর নিভ্রর এই অনুমান সাপেক্ষের বিষয়টা মৌনির খুবই ভালোলাগে। তবুও কন্ঠস্বর স্বাভাবিক রেখে মৌনি বললো,

–”খারাপ লাগছে সত্যি কিন্ত কেন যেন আমি এই খারাপ লাগাটা উপভোগ করতে পারছি। বিষয়টা আমার কাছে এক নতুন অভিজ্ঞতার মতো মনে হচ্ছে।”

–”দিন দিন বেশ জটিল কথা বলতে শিখেছো তুমি।”

–”আপনার সাথে থেকে থেকেই তো শিখেছি।আচ্ছা আপনার নীল রঙ কি খুবই প্রিয়?”

–”বলতে পারো। হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

–”আপনি যে আমায় নীল শাড়ি পড়তে বললেন তাই আরকি।”

কপালে ভাঁজ পড়ে যায় নিভ্রর। চিন্তার ভাঁজ। ও কখন মৌনিকে শাড়ি পড়তে বললো? যতদূর নিভ্রর মনে পড়ে শাড়ির প্রসঙ্গ নিয়ে মৌনির সাথে নিভ্রর কোনোপ্রকার কোনো কথাই হয়নি। তবে মৌনির এ কথাটির মর্মার্থ নিভ্র বুঝতে পারলো না। বিষয়টা রোমাঞ্চকর। খুবই সাবধানের সাথে মৌনির সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা আগাতে হবে।

–”হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন কেনো ডাক্তার সাহেব?”

নিভ্র মুখে একটি বিশ্বস্ত হাসির আবরণ টেনে দিলো। বিচক্ষণতার সাথে কথার জালে নীল শাড়ির উত্তরটি এখন বের করতে হবে। তাই বিদ্রুপ কন্ঠে বললো,

–”আগে তো নিভ্র ভাই নিভ্র ভাই করে মাথা খেয়ে ফেলতে। এখন আবার হুট করে ডাক্তারসাহেব বলা শুরু করলে কেনো?”

–”নিভ্র ভাই বলার থেকে ডাক্তারসাহেব বলাতে আমি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আপনাকে বেশি আপন আপন লাগে।”

–”আর তাই আমার কথামতো নীল শাড়ি পড়েছো তাই না? তো বলোতো আমি কখন তোমায় নীল শাড়ি পড়তে বলেছিলাম?”

মৌনি উত্তর দিতে গিয়ে থমকে গেলো। নিভ্র কখন শাড়ি পড়তে বলেছিলো এটা ওর মনে আসছে না। নিভ্র ওর অবস্থা দেখে কিছু একটা অনুমান করতে পারলো। আসলে নিভ্র ওকে কখনোই নীল শাড়ি পড়তে বলেনি। সবই মৌনির মন আর মস্তিস্কের কল্পনা। মৌনি আমতা আমতা করে বললো,

–”আ-আমার ম-মনে পড়ছে না।”

–”মনে পড়বেও না। কেননা এগুলো সব তোমার কল্পনা ছিলো। আমি কখনোই তোমায় এ কথা বলিনি।”

মৌনি অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে নিভ্রর দিকে। নীল শাড়ি পরিহিতা এই হাস্যোজ্জল মানবীটি এখন মলিনতার ছায়ায় হারিয়ে গিয়েছে। নিভ্র ইশারায় মৌনিকে বললো ওর কাধে মাথা এলিয়ে দিতে। বাধ্য মেয়ের মত মৌনি সেটাই করে।
গাড়ি এগিয়ে চলছে নিজ গতিতে। বাতাসের শব্দের প্রবাহ ছাড়া সারা গাড়িতেই এখন নীরবতার অনশন খেলা করেছে।

–”আমি কবে সুস্থ হবো ডাক্তারসাহেব?”
মৌনির ব্যাকুল কন্ঠ। নিভ্র ওকে আশ্বস্ত করার জন্য মুখে একটা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললো মুখটিতে। নিভ্রর মুখে মুচকি হাসিটা মৌনির কাছে বরাবরই প্রাণবন্ত মনে হয়। যেনো এই হাসি আর এই ব্যাক্তির সৌন্দর্যের জালে সহজেই নিজেকে মৌনি বিলিয়ে দিতে পারবে।

নিভ্র স্বাভাবিকভাবে বললো ,
–” তুমি সুস্থ মৌনি । তবে একটি জিনিস তুমি কাটিয়ে উঠতে পারছো না। ডিপ্রেশন। আর এই ডিপ্রেশন তুমি নিয়ন্তনে আনতে না পারলে তিলে তিলে তুমি শেষ হয়ে যাবে।”

মৌনি ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে নিভ্রর মুখপানে। নিভ্র আপনমনে ড্রাইভ করতে ব্যস্ত। মৌনি মিহি কন্ঠে বললো ,

–”আমি আপনার কথা বুঝলাম না। আমি ডিপ্রেশনে আবার কখন পড়লাম?”

নিভ্র এতক্ষণ নিজের উপরের ঠোঁট দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে রেখেছিলো। মৌনির কন্ঠ শুনে নিজের কোমল ঠোঁটজোড়া হালকা জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নেয়। তারপর মিহি স্বরে বললো……….

–”তুমি ডিপ্রশনে আছো কখন বুঝবে জানো???

১/চারিদিকে অনেক মানুষ থাকা সত্ত্বেও তোমার নিজেকে খুব একলা মনে হবে।
২/তুমি ভালো আছো কথাটা কাউকে বলার সময় বুকের ভেতর কষ্ট বিঁধবে।
৩/সব কাজেই ভীষণ রকমের বেখেয়ালি হয়ে যাবে,নিজেকেই নিজের অচেনা মনে হবে।
৪/তোমার মনের ভেতর সবসময় এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করবে।

৫/তোমার বুক চাপা যন্ত্রণার কথাগুলো সবসময় মনে পড়তে থাকে।
৬/কাউকে কিছু বলতেও ইচ্ছে করবে না,কারো কথা শুনতেও ইচ্ছে করবে না।
৭/সব আপন মানুষ গুলোর উপর জানা সব অভিমানে,তাদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে আনবে।
৮/আবার কখনো কখনো চোখের কোণা বেয়ে পানি গাল গড়িয়ে পড়বে,অথচ তুমি টেরই পাবেনা।
৯/নিজের পরিবারকেও কখনো কখনো অনেক দূরের মনে হবে
১০/সময় যেতে থাকবে কিন্তু,সব কিছুতেই জীবনের ছন্দ হারিয়ে গেছে মনে হবে।
১১/এতোটুকু কোলাহলও সহ্য হবেনা,নীরবতা আর অন্ধকার টাই শুধু নিজের মনে হবে।
১২/নিজেকে অনুভুতিহীন মনে হবে প্রায় সময়,কোন ব্যাথা বা খুশি তখন তোমার মনকে ছুঁতে পারবে না।
১৩/জীবনকে মাঝে মাঝে অসহ্য মনে হয়ে,বেঁচে থাকাটা কঠিন মনে হবে।

ডিপ্রেশন একটা মানুষের জীবনের সব থেকে ভয়ংকর অধ্যায়।এসময়ে প্রতিটা মুহুর্ত যে কতটা যন্ত্রণার সেটা কেবল সেই মানুষটাই জানে।
অনেক কঠিন অসুখেও মানুষ চিকিৎসা পেয়ে সেরে উঠে।কিন্তু ডিপ্রেশন থেকে বের হতে গেলে মানুষের বিশাল যুদ্ধ করতে হয়।

সে যুদ্ধ যত কঠিনই হোক না কেন,তোমার জীবনের মূল্যের কাছে কিছুই না।ধৈর্য্য ধরো,নিজের সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাও।দেখবে খুব দ্রুত ডিপ্রেশন থেকে বের হয়ে যেতে পারবে।

মনে রাখবে,পৃথিবীতে তোমার জন্য যদি সবচাইতে দামী কিছু থেকে থাকে তবে সেটা তোমার জীবন।
আর জীবন একটাই।একবার চলে গেলে ফিরে পাওয়া যায় না।জীবনটাকে নতুন করে সাজানোর চেষ্টা করো,দেখবে জীবন তোমাকে সুন্দরভাবে বেঁচে থাকা উপহার দিবে নতুন করে।”

নিভ্রর কথায় এতক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিলো মৌনি। কথাগুলো গভীরভাবে অনুভব করলে বোঝা যাবে যে কথাগুলোর গুরুত্ব আসলে কি। একজন মানুষ কতটা বিচক্ষণ না হলে এভাবে সাজিয়ে কথাগুলো বলতে পারে।

দুপুর ঢলে এখন নেমেছে বিকেল। চারিদিক সুবাসিত হয়ে আছে কমলা রোদ্দুরে। নিভ্রর কথায় মৌনির হতাশা এবার আত্নবিশ্বাস হয়ে জেগে উঠলো। না ! কিছুতেই ভেঙ্গে পড়া যাবে না। নতুনভাবে বাঁচতে শিখবে মৌনি। উপভোগ করবে এই জীবনটাকে।

~চলবে
আজকে অল্প সময় নিয়ে লিখেছি। কেমন হয়েছে জানিনা। তাই অগোছালো হলে ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here